বিবর্ণ সিঁদুর পর্ব ১৩

বিবর্ণ সিঁদুর
পর্ব- ১৩
#Taniya_Sheikh

বাতাসে ধূপের গন্ধ। শঙ্খ আর উলু ধ্বনিতে মুখর পাড়ার মণ্ডপগুলো। সে শব্দ বাড়ি বসেও শোনা যাচ্ছে। একটু পর বাইরে যাবে বলে নতুন কাপড় পরিধান করেছে সবাই। রজনী পড়েছে হলুদ টপ, নীল স্কার্ট। মিতুল পনিটেল করলেও রজনী গলায় ম্যাচিং ওড়না ঝুলিয়ে চুল এক কাঁধের উপর ফেলেছে। কোনোরকম সাজসজ্জায় মন নেই রজনীর। মিতুল তা মানতে নারাজ। জোর করে চোখে গাঢ় কাজল,ঠোঁটে লিপস্টিক, কানে পাথরের জ্বলজ্বলে দুলে সাজিয়ে দিল। অন্য সবার চেয়ে এই সাজ সামান্য তবুও অসামান্য লাগল তন্ময়ের চোখে। ওরা নিচের খাবার ঘরে বসে জলখাবার খাচ্ছিল। রজনী আনমনা হয়ে দু’ঠোটে পাপড় ভাঙছে। সবেমাত্র রেডি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছে তন্ময়। এখানে আসার পরদিনই মাসির বাড়ি গিয়েছিল। দু’গ্রাম পরেই ওর মাসির বাড়ি। তন্ময়কে চোখে হারান তিনি। ছোট বোন এবং ভগ্নিপতির অকাল মৃত্যুর পর তমালিকা দেবীই একটা সময় তন্ময়কে কাছে রেখেছিলেন। সময়টার স্থায়িত্ব কম হলেও তাদের সম্পর্ক মা-ছেলের মতোই। তন্ময়ের মন খারাপ হলে সোজা শহর ছেড়ে চলে আসত মাসির বাড়ি। গত রাতেই সেখান থেকে ফিরেছে। সারাটা দিন ঘুম দিয়ে সন্ধ্যার আগে বেরিয়েছিল পুরোনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। রাত আটটা অব্দি আড্ডা শেষে বাড়ি ফিরে হালকা কিছু খেয়ে আবার বেরোবে এখন। এতো দৌড় ঝাপের মধ্যেও যার কথা একবারও ভোলে নি এইতো সে সামনে বসে। আধভেজা চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রজনীকে দেখছে তন্ময়। নিচের ঠোঁট কামড়ে ভাবছে,

” সর্ষে ফুল সেজে বসে আছ, রাই। এই ভ্রমরা দংশিল করবে হায়!হায়। নিজেরে বুঝিয়ে রেখেছি দূরেতে সরিয়ে। এখন যে সর্ব সাধনা আমার ভঙ্গ হবার উপায়। শুনেছ, রাই ও ঠোঁটে পাপড় নয় এ দু’ঠোঁটের ঠাঁই হওয়া চাই।”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় তন্ময়। পূর্ণ চাহনী মেলে এগোতে থাকে সামনে বসা রজনীর দিকে। যত এগোচ্ছে ততই হৃদকম্পনের গতি দ্রুততর হচ্ছে। ভেতরে ঝড়, বাহিরে তার নেই কোনো পূর্বাভাস।

” দীপ্ত। ”
হঠাৎ পাশ থেকে তন্ময়ের গলা শুনে ঠোঁটের মাঝে পাপড় চেপে ধরে বসে রইল রজনী।

” কী রে, এখনো তোরা এখানে কেন?”

তন্ময়ের ধমকে সবাই সচকিত হয়ে সিঁড়ি দিকে ফিরে তাকায়। পাঞ্জাবির হাতা ভাঁজ করতে করতে এগিয়ে আসছে তন্ময়। পাপড় ঠোঁটে সেদিকে আড়চোখে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে যায় রজনী। গোল্ডেন পাঞ্জাবি,মুখভর্তি খোঁচা দাড়িতে বড্ড বেশিই আকর্ষণীয় লাগছে আজ তাকে। চুলগুলোকে সে যখন আঙুল চালিয়ে সাইড করতে করতে কারো দিকে তাকায়, তখন সম্মোহিত হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তন্ময় ভ্রুকুটি করে রজনীর সামনে দাঁড়ায়।

” মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?”

রজনী আধোমুখে মাথা নাড়ায়। ঘোরে মধ্যে এখনো কিছুটা সে। তন্ময় চোয়াল শক্ত করে ধমকে বলে,

” আহাম্মক, মুখ থেকে পাপড় সরাও বলছি।”

রজনী এতোক্ষনে নিজের বোকামি বোঝে। তাড়াতাড়ি পাপড় ফেলতেই তন্ময় সেটা উঠিয়ে নিল। পাপড়ে লেগে থাকা লিপস্টিকের দাগ দেখিয়ে বলে,” পাপড় কি এসব করার জন্য?”

সবার সামনে লজ্জায় মাথা কাটা গেল রজনীর। বাকিদের হাসি পেলেও হাসল না ভয়ে। রজনী মুখ আরো নামিয়ে মৃদু স্বরে বলে,

” সরি, স্যার।”

সে জবাব উপেক্ষা করে তন্ময় পাপড় মুখে দিয়ে সরে দাঁড়ায়। সবাই হাঁ করে তাকাতেই চোখ গরম করে করে সুদীপ্ত কে বলে,

” সবসময় এদের সাথে তোর কী? চল।”

সুদীপ্ত সম্পর্কে মিতুলের বাবার বন্ধুর ছেলে।এবার অনার্স পড়ছে। আর সবার মতো সেও তন্ময়কে সমীহ, ভয় দুটোই করে। পাশাপাশি বাড়ি বলে সম্পর্কটা ঘনিষ্ট ওদের। সুদীপ্ত দাদার কথার জবাব দেওয়ার পূর্বেই তন্ময় ঘুরে দু’কদম এগিয়ে ফের ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,

” বাকিদের দুই মিনিটের মধ্যে যেন বাইরে পাই আমি।” শেষবার রজনীর দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো। কপাল কুঁচকে সাথে সাথে মুখ ফিরে হাঁটা ধরল তন্ময়। যেন সে মহাবিরক্ত। তন্ময়ের পিছু পিছু সুদীপ্তও গেল।

” এই চল,চল।” মিতুলের কাজিনগুলো দ্রুত ওদের পিছু নেয়। রজনীর হাতটা ধরে চলল মিতুল। রজনী বেশ ভাবনায় ডুবেছে। সেদিন মিতুল ওকে যা বলল তা যদি সত্যিই হতো, তবে স্যার ওর সাথে খ্যাক খ্যাক করে কেন? ভালোবাসলে এমন করে কস্মিনকালেও শোনেনি সে। নাকি এই ব্যাটার প্রেম, ভালোবাসেই খ্যাক খ্যাক মার্কা। যা হোক তাতে রজনীর কি? ইহজীবনে তন্ময় স্যারকে ভালোবাসা তো দূরের কথা সেকথা ভাবতেও পারে না, পারবেও না কোনোদিন। এই মিতুল নিশ্চয়ই অন্য সবার মতোই ভুল ভাল শুনেছে। হ্যাঁ তাই হবে। রজনীকে ভালোবাসতে বয়েই গেছে স্যারের। রজনী মুখ ভেংচে একচিলতে স্বস্তিভাব প্রকাশ করে।

আজ মহা সপ্তমী। পাড়ার মণ্ডপে ঘুরতে বেরিয়েছে ওরা। বাড়ির পাশের নির্জন পথ ধরে হাঁটছে। মিতুলদের এই পুরোনো বাড়িটা দ্বিতল,সামনে বড় শান বাঁধানো ঘাটওয়ালা পুকুর। ডানপাশ দিয়ে আধাপাকা রাস্তা গ্রামের মধ্যে দিয়ে সোজা গিয়ে মিলেছে প্রধান সড়কে। ওরা সেই পথ দিয়ে হাঁটছে। দু’ধারে বাড়িঘর,আবার মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়, গাছপালার দেখা মিলছে। অন্ধকারে ভুতূড়ে লাগছে আশপাশটা। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেসে আসছে ঝিঁঝি পোকার গুনগুন। অনেকের বাড়িতে এখনো আলো জ্বলছে। এ রাস্তায় হেডলাইট নেই। আশেপাশের বাড়িঘর থেকে যা আলো আসছে আর ঐ আসমানের চাঁদই ভরসা চলার জন্য। সামনে একটা ছোট্ট মন্ডপ দেখল। কিছু মানুষও আছে সেখানে এখনো। ওরা আরও সামনে হাঁটছে। সামনের ছোট্ট নদীর উপর ব্রিজ। সেটা পাড় হয়ে ওরা এলো এখানকার সবচেয়ে বড়ো মণ্ডপটাই। চমৎকার লাইটিং করা হয়েছে। রাত হলেও মানুষের সমাগম প্রচুর। পাশের স্টেজে গানের অনুষ্ঠান চলছে। সবাই মিলে চেয়ার টেনে বসল। রজনী তাড়াহুড়ো করে বসতে গিয়ে বসল ঠিক তন্ময়ের পাশের চেয়ার টাই। একদম গায়ে গা লাগল। চট করে নিজেকে সংকুচিত করে নেয়। আড়চোখে তন্ময়ের দিকে তাকাতেই দেখল, ভাবলেশহীন চেহারায় ঝুকে মোবাইলে মগ্ন। কী আছে এই ছাই মোবাইলে? সামনের স্টেজে গান চলছে, এমন জমকালো পরিবেশ। আর মহাশয় মোবাইলে মুখ গুঁজে আছেন। রজনী আড়চোখে দুএকবার দেখে গান শোনায় মনোযোগ দিল। বললেই তো মনোযোগ দেওয়া যায় না।তারউপর যখন এই লোক পাশে বসা। কী পারফিউম মেখেছে কে জানে? মেখেছে সে আর গন্ধে মৌ মৌ করছে রজনী নিজে। এঃ কী অদ্ভুত ভাবনা। রজনী চোখ বন্ধ করে মৃদু মাথা ঝাকিয়ে নিজের ভাবনা চিন্তার অবসান ঘটাতে চাইল। কিছুটা কমলো আর কি! গান শুনতে শুনতে একবার পাশে তাকাতেই বিষম খেলো। ওর দিকে ভ্রু তুলে তাকিয়ে ছিল তন্ময়। চোখাচোখি হতেই ভ্রু নাচালো মুচকি হেঁসে। রজনী জিহ্বা কামড়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে উঠেছে ওর। বাকিরা গিয়েছিল খাবার কিনতে। এতোক্ষনে ওরাও ফিরে এসেছে। হাতে মুড়ি,মোয়া,গজা, চানাচুর সিঙ্গাড়া সহ আরও অনেক খাবারের ঠোঙ্গা। রজনীকে লজ্জায় মুখ নুয়ে থাকতে দেখে মিতুল মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,

“কি রে? নতুন বউয়ের মতো লজ্জা পেয়ে বসে আছিস যে?”

এ’কথা শুনে ওর বাকি কাজিন দুজন খেতে খেতে এদিকে তাকাল কৌতূহলে। তাতে যেন লজ্জার সীমা রইল না রজনীর। মিতুলকে চিমটি কেটে বলল,

” চুপ থাক।”

” তুই খালি চিমটি কাটোস কেন? চুপ থাকুম কেন তাই ক? বড়’দা কি প্রপোজ করে ফেলছে?” চাপাস্বরে বলে ফিক করে হেঁসে উঠল মিতুল। ওর কাজিনরা ততক্ষনে নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল। এদিকে তেমন খেয়াল নেই তাদের। রজনী তাই দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলেও তন্ময় পাশে ভেবে লজ্জায় মরে গেল। মিতুলকে চোখ রাঙিয়ে চুপ করতে বললেও মিতুল তা অগ্রাহ্য করে বলল,

” যার জন্য এতো লজ্জা সে কৈ? বড়’দা কোথায়?”

কথাটা শুনে বিস্ময়ে রজনী পাশ ফিরে দেখে চেয়ার শূন্য। এ্যা, এই লোক কখন উধাও হলো? “যাক বাবা বাঁচা গেল”অবশেষে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে এক চিলতে হাসি ফোটে মুখে।

” কী বাঁচা গেল?” মিতুল ঠোঁট টিপে হাসতেই রজনী এবার জোরে ওর হাতে চিমটি কেটে বলল,

” তোর মাথা।”

” উঁহু, তুই এমন কেন?”

” তুই এমন তাই।” দু’জনেই একসাথে হেঁসে ওঠে।

তন্ময় মোবাইল অন করে ব্রিজের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়। চারপাশ থেকে হু হু করে বাতাস এসে গায়ে লাগছে। বন্ধুদের সাথে চ্যাট শেষে মোবাইল পকেটে পুরে ব্রিজের রেলিং-এ চড়ে বসে। নদীটি এঁকেবেকে হারিয়ে গেছে ঐ আঁধার ঘন গাছপালার আড়ালে। যতদূর দেখা যাচ্ছে ততদূরই দেখছে সে। রাইয়ের পাশে বসে অস্থির হয়ে উঠেছিল তার বুকের ভেতর। তার উপর যখন আড়েঠাড়ে ওকেই দেখছিল, অশান্ত হয়ে উঠেছিল তন্ময়ের মন । বাধ্য হয়েই এখানে চলে আসে । আসার পূর্বে অবশ্য বাকিদের সেখানে ফিরে আসতে দেখে এসেছে। প্রেম,ভালোবাসা মানুষকে বদলে দেয়। ছন্নছাড়াকে করে গৃহী আর গৃহীকে করে ছন্নছাড়া। তন্ময়ের অবস্থা দ্বিতীয় পর্যায়ে। মাঝে মাঝে সব এলোমেলো হয়ে যায়। ভাষা, জীবনের ছন্দ সব। কতকিছুই সে বিনা দ্বিধায় বলতে পারে, শুধু ভালোবাসি বলতেই এতো সংশয়, সংকোচ কেন হচ্ছে তবে! কেন বলতে পারছে না, ” রাই, তুমি হীনা মোর কেহ নাই,কিছুই নাই। তোমা বিনে জগৎ সংসার বিবর্ণ প্রায়। ভাবনায় যবে তোমারে সিঁদুর পড়াই, পৃথিবী আমার সেই রঙে রঙিন হয়।ও রাই কিশোরী, তোমাকে ভালোবাসি বলেই কি এমন হয়?”

———————————————————————————————–

ওরা রাত বারোটার দিকে বাড়ির পথে হাঁটে। তন্ময় সবার পেছনে এবার। মিতুল কী নিয়ে যেন সুদীপ্তের সাথে কথাকাটাকাটি করছে। আরো যে দুজন মেয়ে ছিল। অনন্যা,অনিমা মিতুলের মাসতুতো বোন। জমজ হলেও চেহারায় মিল তত লক্ষ্য করা যায় না। স্বভাবেও ঢের বৈসাদৃশ্য। একজন কথায় কথায় হাসে, আরেকজন কিছুটা গম্ভীরমুখো। এরা দুজনই সুদীপ্তর কথায় সাড়া দেওয়ায় মিতুল খুব চটেছে। একপ্রকার রাগ দেখিয়ে আগে আগে হাঁটছে সে। জমজ বোন দু’টো দীপ্ত’দা দীপ্ত’দা বলে বিগলিত হলেও দীপ্তর তাতে ভাবান্তর নেই। সে মিতুলের রাগ ভাঙাতে ব্যস্ত। মিতুল বড্ড অভিমানি আর জেদি। সহজে রাগ ভাঙবে এমন মেয়ে সে নয়। বেচারা দীপ্ত!

ওদের এই রাগ,অভিমানে একা পড়ে গেল রজনী। সে আর তন্ময় ছাড়া বাকিরা সামনে এগিয়ে গেছে। একটা মোড় বাক নিতেই ওরা উধাও। রাস্তায় কেবল তারা দুজন। রজনী যত চাইছে জোরে পা চালাতে ততই পা দুটো জমে যাচ্ছে। এই শীত শীত আবহাওয়ায় বিন্দু বিন্দু ঘামছে কপাল। হৃদস্পন্দনের গতি তীব্র হলো, যখন পেছন থেকে তন্ময় ওর হাতটা টেনে ধরে। এক মুহূর্তে জন্য পাথর হয়ে গেল সে। বুকের মধ্যে হাতুরী পেটানোর আওয়াজ পাচ্ছে।

” একটু দাঁড়াও, রাই।” “রাই” ডাকটা শুনে ভ্রুকুঞ্চন করে রজনী। ঘুরে তাকানোর শক্তি একরত্তি পেল না। তন্ময় রজনীর হাতটা দু’হাতের মধ্যে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। হাত ছাড়িয়ে নেবে ভেবেও ছাড়াতে পারছে না রজনী। একদিকে নিজের অতীত অন্যদিকে এই বর্তমান। একদিকে সৌমিত্রের ছেড়ে চলে যাওয়া অন্য দিকে তন্ময়ের আসা। কী হচ্ছে তার জীবনে? এ কেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি সে আজ। কী বলবে? কিভাবে বলবে?

মাথা হেট করে দাঁড়ান রজনী। চোখে অশ্রু ছলছল। বুক দুরুদুরু কাঁপছে। তন্ময় কিছুক্ষণ ওর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে বলল,

” কথাটা কী করে বলব ভেবে পাচ্ছি না। আবার না বলেও স্বস্তি পাচ্ছি মোটেও। রাই,,,,,”

” স্যার, আমি বিবাহিতা।” দমবন্ধ করে বলে হাত ছাড়িয়ে ছুটে চলে গেল তন্ময়ের চোখের আড়ালে। রাতের নিস্তব্ধতা, আঁধার ভয়ানক ভাবে নেমে এলো তন্ময়ের সম্মুখে। পা দু’টো অসার হয়ে ভেঙে পড়বে মনে হচ্ছে। কোনোমতে পাশের সুপারি গাছটা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। পাঁজরের হাড্ডি ভাঙছে মট মট করে। না,না, সত্যি নয় আবার যেন মিথ্যেও নয়। ব্যথার সাগরে একটু একটু ডুবে যাচ্ছে তন্ময়। একটু একটু করে শ্বাসকষ্ট শুরু হচ্ছে ওর। বিবাহিতা রমণীর প্রেমে পড়েছে! সে মরেছে,মরেছে বিবেকের দহনে এবার। সে রাতে কী করে? কী অবস্থায়? রুমে ফিরেছিল তন্ময় জানে না। মরার মতো ফ্লোরে পড়েছিল মধ্যে রাত অব্দি। জেগে থেকে এ কষ্ট আর সহ্য করতে পারছিল না। হুশজ্ঞান হারিয়ে আলমারি থেকে ঘুমের ওষুধের কৌটা বের করে আনে। কাঁপা হাতে যতোগুলো ট্যাবলেট বের করতে পারল সব মুখে পুরে পানি দিয়ে গিলে ফেলে। ধীরে ধীরে চোখের সামনে অন্ধকার নামে। টলতে টলতে বিছানায় যাওয়ার পূর্বেই পাকা ফ্লোরের উপর পড়ে গেল অচেতন হয়ে।

সে রাতে ভালো ঘুম হলো না রজনীর। দুশ্চিন্তায় কাটল রাত। পাশে শায়িত মিতুল দীপ্তর উপর অভিমান করে শুয়ে ছিল চুপ করে। এখানে আসার তিনদিন আগেই ওদের মিউচুয়াল ব্রেকাপ হয়েছে। মিউচুয়াল বলতে মিতুলের বাড়াবাড়িতেই বাধ্য হয় দীপ্ত। এতোটা পোজেসিভ মেয়ে মিতুল, দীপ্ত ভাবতেও পারেনি। কোনো মেয়ের সাথেই কথা বলতে দেবে না সে। এসব কেন্দ্র করেই ব্রেকাপ হয়েছিল ওদের৷ মিতুলের সোজা কথা তার সাথে সম্পর্ক রাখলে তাকে ছাড়া ভিন্ন কারো সাথে কথা বলা তো দূর চোখাচোখিও করা যাবে না। শর্ত মানলে সম্পর্ক থাকবে নয়তো ব্রেকাপ। দীপ্তর প্রচন্ড মেজাজ চড়ে গিয়েছিল মিতুলের ব্যবহারে। রাগের মাথায় তাই সেও ব্রেকাপ করে দেয়। কিন্তু রাগ পড়তেই মনটা অস্থির হয়ে ওঠে মিতুলের জন্য। এখানে আসার পর থেকে ওর রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে। সে চেষ্টা বৃথা তো গেলই এখন আবার নতুন করে প্যাঁচ লেগেছে অনিমার জন্য। অনিমা দীপ্তর হাত ধরাতেই যত রাগ মিতুলের। এতো যে বোঝাচ্ছে জাস্ট ওরা বোনেরই মতো, তবুও মানছে না মিতুল। রাতে কয়েকবার কল করে রেসপন্স না পেয়ে ঘুমিয়ে গেল দীপ্ত। এদিকে মিতুলের রাগে শরীর জ্বলছে। ইচ্ছা করছে দীপ্ত ঘাড় মটকে ছাঁদ থেকে লাথি দিয়ে নিচে ফেলে দিতে সাথে ঐ শাকচুন্নি অনিমাকেও। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে একসময় সেও ঘুমিয়ে গেল।

ভোরে দরজার বাইরে দীপ্তর চেঁচামেচি আর দরজায় অনবরত আঘাতের শব্দে ঘুম ভাঙল মিতুল,রজনীর। ধড়ফড়িয়ে উঠে এলো দু’জন। দরজা খুলে দীপ্তকে সামনে দেখে গতরাতের রাগটা মাথা চারা দিয়ে উঠল। গলা খেঁকিয়ে বলল,

” কী সমস্যা তোমার? কুত্তায় কামড়াইছে যে পুরো বাড়ি মাথায় তুলছ?”

মিতুলের বকা হজম করতে সময় লাগল দীপ্তর। কোনোমতে নিজেকে সামলে বলল,

” কথা না বুঝে উল্টো পাল্টা জবাব দেওয়াটা তোমার বদ অভ্যাসে পরিনত হচ্ছে। সে যাক, অভ্যাস বদলাতে এখন আসিনি। তন্ময়’দা সুইসাইড এ্যাটেম্পট করছে সেটাই বলতে এসেছি। বলা শেষ এবার আমি গেলাম। ঘুমাও আরাম করে।”

দীপ্ত রেগেমেগে প্রস্থান করল। মিতুল, রজনী বাকরুদ্ধ হয়ে পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে ছুটে গেল নিচে। নিচে নেমে জানতে পারল তন্ময়কে একটু আগেই হসপিটালে নিয়ে গেছে। অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে নাকি মরতে বসেছিল সে। বাড়ির সবার চোখে মুখে আতঙ্ক। তারা বিশ্বাস করতে পারছে না তন্ময়ের মতো ছেলে একাজ করতে পারে। মিতুলে মা মাথায় হাত দিয়ে বসে বিলাপ করছে। তার সাথে বসা দু’জন মহিলা সান্ত্বনা দিচ্ছে। ক্রমশ বাড়িতে মানুষের আনাগোনা শুরু হলো তন্ময়ের সুইসাইডের খবর শুনে। মিতুল কাঁদছে,রজনী ওকে সাথে করে বিষন্ন মুখে চলে এলো রুমে । অপরাধ না করেও সে আজ অপরাধী। তন্ময় স্যার ওর কারনে মরতে বসেছে ভেবেই কান্না পেল। মনপ্রাণ দিয়ে প্রার্থনা করছে তন্ময়ের সুস্থতার জন্য। সেদিন কারো নাওয়া খাওয়া হলো না। দুপুরে খবর এলো তন্ময় বিপদমুক্ত। মিতুলের বাবা,মামারা বিমর্ষ মুখে ফিরে এসেছে। তাদের মুখ দেখলেই বোঝা যায়, কী ঝড় গেছে তাদের উপর দিয়ে।

ডাক্তার, আত্মীয় স্বজন সবার কথা উপেক্ষা করে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে তন্ময়। এখনো তার শরীর দূর্বল। ফুল বেড রেস্ট প্রয়োজন। কিন্তু কারো কথায় শুনছে না সে। বাড়ির মধ্যে থমথমে পরিবেশ। কেউ কিছু বলছে না। যার যার মতো ঘরে বসে আছে। সবাই যখন ঘরে রজনী পা টিপে টিপে সতর্কতা অবলম্বন করে তন্ময়ের রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজা কোনোরকমে চাপানো ছিল। নিজের ভীরু,অস্থির মনটাকে সাথে করে দরজা সরিয়ে রুমে ঢুকল। শরীর কাঁপছে কী হবে? কী হবে ভেবে। মুখের উপর হাত রেখে শুয়ে ছিল তন্ময়। শরীরে অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে তারচেয়েও বেশি যন্ত্রণা হচ্ছে তার মনে। দরজার খোলার শব্দ পেয়ে হাত সরিয়ে চোখ মেললো সামনে।

” তুমি?” রজনীকে দেখে যন্ত্রণা মাখা মুখটা কঠিন হয়ে ওঠে। চট করে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। রজনী তাই দেখে এগিয়ে আসতেই তন্ময় হাত দেখিয়ে বলে,

” খবরদার! একদম কাছে আসবে না।” তন্ময়ের গলা ভিজে আসে। মুখ ঘুরিয়ে উঠে বসে বিছানার উপর। রজনী কাঁদতে কাঁদতে বলে,

” স্যার,সরি।”

” এসব নাটকের অর্থ কী? কেন এসেছ তুমি এই রুমে?”

” আমাকে মাপ করে দিন, স্যার। আমার জন্য আজ আপনার এই অবস্থা,,” রজনীর কথা শেষ না হতেই তন্ময় তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,

” ওয়েট,ওয়েট। কার জন্য? কি অবস্থা? ও গড, তোমার ধারণা তুমি বিবাহিতা শোনার পর আমি মরতে চেয়েছি? রিয়েলি! নিজেকে কী ভাবো তুমি? অনিন্দ্য সুন্দরী, অসাধারন রূপবতী? লিসেন মেয়ে, তন্ময়কে চিনতে ভুল করেছ তুমি। তন্ময় কারো বিরহে মরার মতো পুরুষ নয় অন্তত তোমার জন্য তো নয়ই।”

” স্যার, আপনি কেন আমাকে ভালোবাসলেন? আমাকে,,” রজনীর কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই চেঁচিয়ে ওঠে তন্ময়,

” তোমাকে ভালোবেসেছি মানে? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? নিজেকে আয়নায় দেখেছ কখনো? কৈ তুমি আর কৈ এই তন্ময়। আমার সামনে এসব বলার সাহস কী করে হয়? এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও বলছি।” তন্ময় উঠে রজনীর হাত ধরে টেনে বের করে দেয় রুমের বাইরে। তন্ময়ের যন্ত্রণাভরা মুখটা দেখে রজনী কাঁদছিল। তন্ময় ওর শূন্য সিঁথিতে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে ক্ষুব্ধ স্বরে বলল,

” গতকাল বেখেয়ালে দুটো ট্যাবলেট বেশি খাওয়ায় এই অবস্থা আমার। প্রেম, ভালোবাসা না পেয়ে মরতে যাওয়ার ছেলে এই তন্ময় নয়। আর কিসের প্রেম ভালেবাসা? ধোঁকায় রেখেছ তুমি আমাদের। চরম ধোঁকায়। বিবাহিতা হয়ে অবিবাহিতা সেজে মানুষকে রূপের মোহে ফেলতে ভালো লাগে খুব,তাইনা? চরিত্রহীনা, মিথ্যাবাদী। আর কখনো যদি তোমাকে আমার সামনে দেখেছি,,? তন্ময় তর্জনী উঁচু করে দাঁত কামড়ে আসন্ন বুক ভাঙা কান্না দমায়। কিছুক্ষন রজনীর নত মুখে তাকিয়ে থাকে। কষ্ট নোনাজল হয়ে গড়ায় চোখের কোনা দিয়ে। রজনী মুখ তুলে তাকাতেই শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দেয় মুখের উপর। রজনীর কানে যেন বিষ ঢেলে দিল কেউ। চরিত্রহীনা অপবাদের বিষে সর্ব শরীর বিষাক্ত হয়ে ওঠে। দু’চোখে ঘন শ্রাবনের জল নিয়ে টলতে টলতে সিঁড়িতে এসে বসে। তন্ময়ের দরজার দিকে তাকিয়ে মুখে হাত চেপে ডুকরে কাঁদে। অস্ফুটে বলে,

” বিশ্বাস করেন, স্যার। আমি মিথ্যাবাদি সত্যিই কিন্তু চরিত্রহীনা না। আপনাকে ব্যথা দিয়ে যে ব্যথা আমার মন পেল, তার শেষ নেই।” করতলে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে আবার বলল,”ভগবান, আমার মরণ হয় না কেন? আমার মরণ দাও ভগবান। আমি যে আর পারছি না সইতে এই লোকদেখানো সম্পর্কের ভার।”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here