#বিরহ_শ্রাবণ
#পর্ব_১৬
#লেখিকা:সারা মেহেক
বাড়ি আসার পথে আজকের পুরো ঘটনাটা প্রোজ্জ্বল ভাইকে বললাম। অভ্র ভাইয়ের দেওয়া দিক নির্দেশনাও শোনালাম উনাকে। সব শুনে উনি অভ্র ভাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। স্বভাবতই, বন্ধুর প্রশংসায় প্রোজ্জ্বল ভাই কখনো পিছিয়ে থাকেন না।
বাড়ি ফিরে কলেজ ব্যাগ রেখে ড্রেস বদলিয়ে দ্রুত এসে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। ক্ষুধায় পেটটা চোঁ চোঁ করছিলো৷ উপরন্তু মামির হাতের সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ সেই দোতলায় এসে নাকে বাড়ি খাচ্ছিলো। এর ফলে কোনোভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। নিচে এসেই রান্নাঘর হতে খাবার নিয়ে ডাইনিং এ বসে গেলাম খেতে।
আমার খাবার খাওয়া শুরুর পরপরই ডাইনিং এ নানু এসে উপস্থিত হলো। আমাকে এভাবে খেতে দেখে এক গাল হেসে বললো,
” খুব ক্ষুধা লেগেছিলো বুঝি?”
আমি এক লোকমা ভাত মুখে তুলে বললাম,
” হ্যাঁ নানু। সেই সকালে খেয়েছিলাম। আর ক্যান্টিনেও কিছু খাইনি। এ কারণে আরো বেশি ক্ষুধা লেগেছে। ”
” আচ্ছা খেয়েনে আরাম করে। ”
আমি আর কথা না বাড়িয়ে খেতে লাগলাম। আমার খাবার খাওয়া যখন শেষের দিকে তখন মামি রুম হতে বেরিয়ে ডাইনিং এর চেয়ারে এসে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
” চিংড়ির তরকারিটা কেমন হয়েছে চন্দ্রিমা?”
” দারুণ হয়েছে মামি। তোমার হাতের রান্নায় জাদু আছে। ”
এই বলে রান্নাঘরে প্লেট রেখে হাত ধুয়ে ডাইনিং এ এসে বসলাম। আমি বসতেই মামি বললেন,
” বলি কি, পড়ার পাশাপাশি টুকটাক রান্নাবান্নাও শিখেনে। ”
” রান্না তো পারিই। আর কি শিখবো।”
” ও কোনো রান্না হলো নাকি? নেট থেকে দেখে কি-টি রান্না করিস তার নেই ঠিক। এই যে আমার মতো মাছের তরকারি, মাংস রান্না, নানারকম ভাজি, এগুলো শিখবি কবে?”
” শিখবো মামি শিখবো। তবে এখন না। এক দু সপ্তাহের কোনো এক ছুটিতে এগুলো শিখবো। ”
এবার নানু বললেন,
” এমন ছুটি তো অনেকদিন পর পাবি। এ সপ্তাহ থেকেই না হয় একটু আধটু শিখা শুরু কর। ”
হঠাৎ দুজনের রান্না শেখার প্রতি জোরাজোরি দেখে আমার মনে সন্দেহের ছোট্ট এক দানা বাঁধলো। কেননা এর পূর্বে মামি বা নানু কখনো আমার সাথে রান্না বা ঘরের কাজ শেখার প্রতি কোনোপ্রকার জোরাজোরি করেনি। আজ হঠাৎ দুজনে একত্রেই এভাবে রান্না শিখতে বলছে মানে কোনো না কোনো ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে।
সন্দেহজনক কণ্ঠে দুজনকেই জিজ্ঞেস করলাম,
” হঠাৎ আমার রান্না শেখার প্রতি দুজনের ইন্টারেস্ট কেনো? নানু, সত্যি করে বলো তো, কি চলছে তোমার মনে?”
মুহূর্তেই নানু চোখেমুখে একরাশ আনন্দ নিয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
” তোর জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। ছেলে……”
অকস্মাৎ বিয়ের প্রস্তাবের কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। ফলস্বরূপ পানি খেতে খেতে মুহূর্তেই তা গলায় আটকে নাক দিয়ে উঠে এলো। কাশতে কাশতে আমি উঠে দাঁড়ালাম। মামি ও নানু দ্রুত আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। মামি পিঠে কয়েকটহ আলতো চাপড় দিয়ে বললেন,
” বিয়ের কথা শুনে এতো হুলস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে ফেললি কেনো? পাগল নাকি!”
মামির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বার কয়েক কাশি দিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। অতঃপর পুনরায় চেয়ারে বসে দুজনকে উদ্দেশ্য করেই বললাম,
” মাস দুয়েক আগেই তো প্রত্যাশা আপুর বিয়ে হলো। এতো দ্রুত আমাকে বিদায় করতে চাও তোমরা!”
মামি চেয়ারে বসে ঝলমলে গলায় বললেন,
” ছেলে যে কত্ত ভালো সেটা দেখবি না! ছেলে কানাডায় থাকে। ওখানে পড়াশোনা শেষ করে ওখানকারই এক কোম্পানিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছে। তার স্বভাব চরিত্রও খুব ভালো। তাহলে সুযোগ থাকতে এতো ভালো ছেলে হাত ছাড়া করবো কেনো। ঠিক বলিনি আম্মা?”
নানুও মামির যুক্তিতে সায় দিয়ে বললো,
” একদম ঠিক। আর ছেলের পরিবারও আমাদের পরিচিত। অনেক আগে থেকেই চিনি ওদের। খুব ভালো পরিবার। স্বভাব চরিত্রে যেমন ভালো তেমন সয়-সম্পত্তিতেও ওদের নামডাক আছে। ”
বিয়ের পক্ষে দুজনের এ যুক্তি দেখেই মুহূর্তেই এ প্রস্তাব নাকচ করে বললাম,
” ছেলে যত ভালোই হোক, আমি বিয়ে করবো না। তোমাদের ছাড়া কোথাও যাবো না আমি। এক কথা আমার।”
মামি কিছু বলতে যাবে, এর পূর্বেই অকস্মাৎ প্রোজ্জ্বল ভাই এসে চেয়ার টেনে আমার পাশে বসলেন। বললেন,
” এইটুকু এক বাচ্চা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য তোমরা পাগল হয়ে যাচ্ছো! যার এখনও নাক টিপলে দুধ বের হয় তাকে বিয়ে করবে কে?”
প্রথমার্ধে প্রোজ্জ্বল ভাইকে নিজের দলে পেয়ে খুশি হলেও উনার শেষোক্ত কথাটি শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলাম। উনার বাহুতে বার কয়েক মেরে ঝেঁঝে উঠা গলায় বললাম,
” কি খারাপ আপনি প্রোজ্জ্বল ভাই! আমার পক্ষ নিয়েও আমাকে এভাবে অপমান করলেন!”
প্রোজ্জ্বল ভাই প্রাণ খোলা হাসি দিলেন। হাসতে হাসতেই বললেন,
” যা বললাম ঠিকই তো বললাম। সত্যি বললে মানুষ আসলেই খারাপ হয়ে যায়! ”
প্রোজ্জ্বল ভাই ও আমার এ ঝগড়া দেখে মামি ও নানু হেসে উঠলেন। কিন্তু হাসতে পারলাম না আমি। কারণ উনার কথাগুলো মোটেও হাস্যকর ছিলো না। ভীষণ রাগের কারনে আমি আর কথা না বাড়িয়ে গলা ফুলিয়ে বসে রইলাম।
প্রোজ্জ্বল ভাই ততক্ষণে হাসি থামিয়ে দিয়েছেন। কিছুক্ষণ বাদে শান্ত হয়ে মামিকে বললেন,
” মা, এখনই চন্দ্রিমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছো কেনো? ও ক্লাস শুরু করলো মাত্র সপ্তাহ তিনেক আগে। এখনই যদি বিয়ের প্রেশার দাও ওর উপরে তাহলে পড়া কন্টিনিউ করবে কি করে?”
মামি বললেন,
” এক সময় না এক সময় ওকে বিয়ে করতেই হবে। আমরা বলছি না এখনই বিয়ে দিবো। ছেলের সাথে পরিচিতি হোক, কথা বলুক। যদি দুজনেই একে অপরকে পছন্দ করে তাহলে কথা আগাবো। আর এসব হতে নিশ্চয়ই দু তিনদিন লাগবে না। ”
নানু মামির সাথে সায় দিয়ে বললেন,
” তোর মা ঠিক বলেছে প্রোজ্জ্বল। আর চন্দ্রিমা মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আশেপাশের কতজন বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে! কিন্তু আমাদের কোনোটা ভালো লাগেনি বলে আমরা কথা তুলিনি। তবে এবারের ছেলেটা অনেক ভালো, ছেলের পরিবারও ভালো। আমার মনে হয় ও চন্দ্রিমাকে সুখী রাখবে।”
প্রোজ্জ্বল ভাই বললেন,
” শুধু মনে হওয়ার ভিত্তিতে একটা ছেলের সাথে ওকে বিয়ে দিবে!”
” তো কি করবো? কার কাছে ওর সুখী হওয়ার গ্যারান্টি পাবো? তোর দাদা যখন আমাকে বিয়ে করেছিলো, তখন আমার মা বাবাও বলেছিলো, তোর দাদার সাথে হয়তো আমি সুখী হবো। তোর মার বিয়ের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছিলো। এ জগতে কে সুখী হওয়ার গ্যারান্টি দিতে পারে? এসব আমরা বলি, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। আমাদের বুড়ো চোখ বুঝে কে ভালো কে খারাপ। ”
নানুর এ যুক্তিতে প্রোজ্জ্বল ভাই হয়তো ধরাশায়ী হলেন। তাই তো কথা সেদিকে না বাড়িয়ে মুহূর্তেই বলে উঠলেন,
” ওসব কথা বাদ দাও। চন্দ্রিমাকে বাইরে বিয়ে দেওয়ার পক্ষে আমি নেই। একবার যদি ও দেশের মাটি ছেড়েছে, তবে এ দেশে ওর আসার সম্ভাবনা তেমন নেই বললেই চলে। যদি আসেও তাহলে কয়েক বছর পর একবার এসে এক সপ্তাহ থেকেই বিদেশে পাড়ি জমাবে আবারো। সো, চন্দ্রিমার এ বিয়ের পক্ষে আমি নেই। আর আমি অ্যাশিওর করবো যেনো বাবাও এ বিয়ের প্রস্তাবকে নাকচ করে। ”
এই বলে উনি উঠে গেলেন। প্রোজ্জ্বল ভাই চলে যেতেই আমি মামি ও নানুর দিকে চেয়ে বিজয়ীর হাসি হাসলাম। ভ্রু নাচিয়ে, ঠোঁট বাকিয়ে সদর্পে দুজনকে বললাম,
” বিয়ের পক্ষে তোমার দুজন৷ আর বিপক্ষে আমরা তিনজন। সুতরাং জয়ী টিম কিন্তু আমরাই৷ এবার হার মেনে নিন মামি। ”
এই বলেই আমি উঠে চলে এলাম। পিছে ফিরে একবার মামি ও নানুকে দেখলাম। দুজনের মুখশ্রীতে এ মুহূর্তে একরাশ হতাশা বিরাজ করছে। তাদের হতাশা আমার জন্য বিজয়ের লক্ষণ ভেবেই খুশিতে গদগদ করে উঠলাম।
রুমে এসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে গোসল করতে গেলাম। গোসল করে বের হয়ে চুল মুছে পানির স্প্রে বোতল নিয়ে রুমের বাইরে চলে এলাম। দোতলার ইনডোর প্ল্যান্টগুলোয় বেশ কিছুদিন পানি দেওয়া হয় না। সেই ইনডোর প্ল্যান্টগুলোয় পানি দিতে দিতে সময় কাটানোর জন্য গুনগুন করে গান গাইলাম।
” আজ ঝরঝর মুখোর বাদল দিনে……….”
পানি দেওয়া শেষে সবগুলো গাছ ঠিকঠাকভাবে রেখে রুমে চলে এলাম। অতঃপর ফ্যানের নিচে চেয়ার নিয়ে বসে আরামে চুল শুকাতে লাগলাম।
দু মিনিট যেতেই হঠাৎ কিছু পড়ার শব্দে চমকে উঠলাম আমি। দ্রুত চেয়ার ছেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যা দেখলাম তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। দেখলাম, প্রোজ্জ্বল ভাই মেঝেতে পড়ে আছেন আর তার পাশে পড়ে আছে আমার শখের মানি প্ল্যান্ট। প্রোজ্জ্বল পড়ে যাওয়া দেখে যতোটা হাসি পেলো এর চেয়েও বহুগুণ বেশি আমার মানি প্ল্যান্টের জন্য কষ্ট লাগলো। আমি দ্রুত গিয়ে প্রোজ্জ্বল ভাইকে পাশ কাটিয়ে মানি প্ল্যান্টের কাছে গেলাম। গিয়ে দেখলাম প্লাস্টিকের টবের মাটি চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে আর মানি প্ল্যান্ট পড়ে আছে সামনের দিকে। আমি দ্রুত হাঁটু গেঁড়ে বসে টবে মাটিগুলো তুললাম। অতঃপর মানি প্ল্যান্ট নিয়ে ভালোমতো মাটিতে পুঁতে তা জায়গা মতো রেখে দিলাম৷ এর মাঝে লক্ষ্য করলাম, প্রোজ্জ্বল ভাই আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। হয়তো মেঝে হতে উনাকে তোলার জন্য।
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এ হাত বাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি আমি আড়চোখে চেয়েও সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করলাম। কারণ উনার প্রতি এখন ভীষণ রেগে আছি আমি। দু সপ্তাহ আগেই নতুন কাটিং বসিয়েছিলাম। এতোদিনে মানি প্ল্যান্টের কাটিংটা বসে যেতে শুরু করেছিলো। কিন্তু আজ হঠাৎ পড়ে যাওয়ার যে বেশ ক্ষতি হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমার নিকট হতে সাহায্য না পেয়ে প্রোজ্জ্বল ভাই হাত গুটিয়ে নিলেন। আমিও উনাকে কিছু না বলে চলে এলাম। তবে পিছে শুনলাম, উনি গলার স্বর যথাসম্ভব উঁচিয়ে বলছেন,
” মানুষ এতোটা থ্যাংকলেস কিভাবে হতে পারে আল্লাহ জানে!”
আমিও এ কথার প্রত্যুত্তরে যেতে যেতে উনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম,
” যে আমার ক্ষতি করে তার প্রতি কোনো মায়াদয়া নেই আমার।”
এই বলে আমি সোজা ওয়াশরুমে চলে এলাম। ভালোমতো হাত পরিষ্কার করে বেরিয়ে দেখলাম প্রোজ্জ্বল ভাই ক্রুদ্ধ চাহনিতে কোমড়ে হাত রেখে আমার রুমে দাঁড়িয়ে আছেন। উনাকে দেখিনি এমন একটা ভাব ধরে বললাম,
” আমি এখন কথা বলার মুডে নেই। ”
আমার কথা শোনা মাত্র প্রোজ্জ্বল ভাই তেড়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। বিছানায় পড়ে থাকা তোয়ালে আমার মুখের উপর ছুঁড়ে মেরে বললেন,
” সারা ঘরে পানি ছিটিয়ে দোষ দিচ্ছিস আমাকে! গোসল শেষে চুল মুছিস কি করে হ্যাঁ? চুলের আগায় পানি থাকে কি করে? এক্ষুণি ভালোভাবে চুল মুছেনে।”
প্রথম পর্যায়ে প্রোজ্জ্বল ভাইকে কিছু বলতে উদ্যত হলেও পরবর্তীতে বুঝতে বাকি রইলো না, উনার মেঝেতে পড়ে যাওয়ার পিছনে হাতটা আমারই আছে। যদিও সেটা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়েছে। তবে দোষটা আমার বলে কথা না বাড়িয়ে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের আদেশ মানলাম। পিছন হতে ভেজা চুল পাশে এনে মুছতে লাগলাম। চুলগুলো ভালোভাবে মুছে নিয়ে অতঃপর চুলে তোয়ালে পেঁচিয়ে ক্ষান্ত হলাম। দৃষ্টি তুলে দেখলাম প্রোজ্জ্বল ভাই এখনও আমার রুমে দাঁড়িয়ে আছেন। উনাকে এখনও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
” এখনও দাঁড়িয়ে আছেন যে? আর কিছু বলবেন?”
হঠাৎ চমকে গিয়েছেন এমন ভঙ্গিতে প্রোজ্জ্বল ভাই বললেন,
” না না। আর কিছু বলবো না। তবে এখন থেকে ভালোভাবে চুল মুছে ঘর থেকে বেরুবি। তোর কারণে যে মানুষ রাস্তাঘাটে পড়ে কখন অক্কা পাবে আল্লাহ জানে। ”
এই বলেই উনি চলে গেলেন। আর আমি দায়সারাভাবে চেয়ারে বসে পড়লাম।
—–
প্রোজ্জ্বল ভাই কানাডিয়ান সেই ছেলের বিয়ের প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়ার এক সপ্তাহ অব্দি আর বিয়ে নিয়ে কথা হয়নি। কিন্তু গতকাল হতে মামি ও নানু পুনরায় ‘বিয়ে বিয়ে’ জপ ধরেছে। আজ সন্ধ্যায় ছেলের বিষয়ে আমার সাথে কথা বলতে চাইছিলো দুজনে। কিন্তু এ বিষয়ে কথা বলার পূর্বেই বাড়ি হতে পালিয়ে অভ্র ভাইদের বাড়িতে চলে এলাম। আজ অনামিকাকে পড়ানোর কথা না হলেও জোর করে ওকে পড়ালাম। এ নিয়ে অনামিকা অবশ্য আমার সাথে কিছুক্ষণ ঠান্ডা যু’দ্ধও চালালো। পরে বেশ অনুরোধ করার পর ও পড়তে রাজি হলো। তবে সারাটা সময় এক প্রকার খিটখিটে মেজাজ নিয়ে পড়লো ও।
অনামিকার পড়া শেষ হতে না হতেই ওর রুমে এসে হাজির হলেন অভ্র ভাই। চা খাওয়ার বাহানায় আমাকে উঠিয়ে নিয়ে অনামিকাকে পড়া হতে ছুটি দিলেন উনি। অগত্যা অনামিকার মুখ দেখে অভ্র ভাইয়ের সাথে আমাকে উঠে যেতে হলো। উনি অনামিকার রুম হতে আমাকে বের করিয়ে রান্নাঘর হতে দু মগ কফি নিয়ে এলেন। এক মগ আমার হাতে দিয়ে অপর মগ নিজের হাতে নিলেন। বললেন,
” চলো, বাড়ির পিছনে গিয়ে বসি। ”
বলে অভ্র ভাই বেরিয়ে গেলেন। উনার পিছু পিছু আমিও চলে এলাম। গিয়ে বসলাম সেই বেঞ্চিতে। শেষবার এখানে বসেছিলাম পরীক্ষার আগে।
বেঞ্চিতে বসেই আমার দৃষ্টি চলে গেলে ভরা আকাশের চাঁদটা দেখে। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, শেষবার যেদিন এখানে বসেছিলাম সেদিনের চাঁদ আর আজকের চাঁদ হুবুহু একই স্থানে অবস্থান করছে। এ বিষয়ে অভ্র ভাইকে বলতেই উনি বললেন,
” একই জায়গায় তো আছেই। সাথে যে একদম হুবুহু একই রকম চাঁদ গঠন ও রঙের চাঁদ উঠেছে তা কি খেয়াল করেছো?”
উনার কথা শুনে আমি বিস্মিত চাহনিতে চাঁদের দিকে চেয়ে রইলাম। সত্যিই আজও চাঁদটা একই রকম দেখা যাচ্ছে! আমি চাঁদের এ সমাপতন দেখে বিস্ময়ে কিয়ৎক্ষণ হা হয়ে রইলাম। অতঃপর কফির মগে এক চুমুক বসিয়ে অভ্র ভাইকে বললাম,
” কি এক কোইন্সিডেন্স! সেদিনকার মতো আজ সবকিছুর মিল হলেও চা আর কফির পার্থক্য হয়ে গেলো। ”
এই বলে মৃদু হাসলাম আমি। অভ্র ভাইও আমার সাথে হাসলেন।
কিয়ৎক্ষণ বাদে অভ্র ভাই বললেন,
” পার্থক্য শুধু কফি আর চায়ে না। আরেকটি বিষয়েও পার্থক্য রয়েছে। ”
আমি কফিতে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” কি বিষয়ে?”
অভ্র ভাই তৎক্ষনাৎ আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বরং কফির মগ বেঞ্চিতে রেখে নত মস্তকে জোরে জোরে কয়েকটি নিঃশ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর মাথা তুলে আমার দিকে চেয়ে বললেন,
” সেদিন তোমাকে আমার স্বপ্নচারিণী সম্পর্কে বলেছিলাম। আর আজ আমি আমার স্বপ্নচারিণীকে আমার মনের কথা বলবো।”
অভ্র ভাইয়ের এ কথায় বিস্ময়ে আমার চোখজোড়া বৃহদাকার ধারণ করলো। আমি বিস্মিত কণ্ঠে বললাম,
” সত্যিই!”
” হ্যাঁ। তুমি বারবার জানতে চেয়েছিলে না, আমার স্বপ্নচারিণী কে, নাম কি তার, সে কি করে, কোথায় থাকে?”
অভ্র ভাইয়ের কণ্ঠে কেমন এক বিচলিত ভাব প্রকাশ পেলো। উনার এরূপ কথার ভঙ্গিতে আমি কিঞ্চিৎ দ্বিধাবোধ করলাম। কোনো রকমে জবাব দিলাম,
” হ্যাঁ, জানতে চেয়েছিলাম।”
আমার কথার প্রত্যুত্তরে অভ্র ভাই তৎক্ষনাৎ বললেন,
” আমার স্বপ্নচারিণী এ মুহূর্তে আমার সামনে বসে আছে। চন্দ্রিমা? আমার স্বপ্নচারিণী অন্য কেউ নয়। বরং তুমিই।”
®সারা মেহেক#বিরহ_শ্রাবণ
#পর্ব_১৭
#লেখিকা:সারা মেহেক
অভ্র ভাইয়ের কথাগুলো কর্ণপাত হতেই আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে এলাম। উনার মুখ নিঃসৃত প্রতিটি শব্দ আমার কানে ঝংকার তুললো। হতবাক হয়ে এলাম আমি। কিয়ৎক্ষণ উনার পানে নিষ্পলক চেয়ে রইলাম। সত্যি কি আমিই অভ্র ভাইয়ের সেই পছন্দ করা মেয়ে যাকে তিনি ভালোবেসে ‘স্বপ্নচারিণী’ নাম দিয়েছেন! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। এ কি করে হতে পারে! অভ্র ভাই আমাকে পছন্দ করেন!
বিস্ময়ে হতবাক আমি মিনিট দুয়েক পর মুখ খুললাম। আধো আধো স্বরে অভ্র ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম,
” আ-আপনি কি জানেন, কি বলছেন আপনি? ”
অভ্র ভাইয়ের মাঝে বিচলিত ভাবটা এখনও বিরাজ করছে। উনি নিঃসংকোচে গলায় বললেন,
” অবশ্যই জানি আমি কি বলেছি। ”
” অভ্র ভাই? আপনি কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছেন? নাকি কোনোপ্রকার ভ্রমে আছেন যে, আমাকে ভুলে নিজের ভালোবাসার মানুষ ভাবছেন?”
অভ্র ভাইয়ের কণ্ঠে এ পর্যায়ে কিঞ্চিৎ উৎকণ্ঠার দেখা মিললো। উনি বৃথা হাসার চেষ্টা করে বললেন,
” ভ্রমে নেই আমি চন্দ্রিমা। আমি পুরোপুরিভাবে সজাগ আছি। আর আমি জানি আমি কাকে কি বলছি। কেনো? তোমার কি বিশ্বাস হচ্ছে না?”
আমি চাপা গলায় দৃষ্টি হটিয়ে বললাম,
” না। এটা বিশ্বাসযোগ্য কোনো কথা ছিলো না। ”
” কেনো বিশ্বাসযোগ্য হবে না? আমি কি তোমাকে পছন্দ করতে পারি না? ভালোবাসতে পারি না?”
এই বলে অকস্মাৎ অভ্র ভাই বেঞ্চি হতে উঠে হাঁটু গেঁড়ে আমার সামনে বসে পড়লেন। আমার হাত হতে কফির মগ বেঞ্চিতে রেখে আমার হাতজোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিলেন। আমার দৃষ্টি বরাবর গভীর দৃষ্টিপাত করলেন। অতঃপর প্রগাঢ় গলায় বললেন,
” তোমাকে ছোট থেকে চিনি চন্দ্রিমা। এ বাড়িতে আসার পর থেকে আমি সবসময় তোমার আশেপাশে থেকেছি। তোমার প্রয়োজন বুঝার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কখনো তোমাকে ওভাবে দেখিনি। তখন তোমার প্রতি কোনো অনুভূতিও ছিলো না আমার। আমার বন্ধুরা কলেজ লাইফ থেকে অনেকে আবার স্কুল লাইফ থেকেই প্রেম করতো। কিন্তু আমি কখনো এসব ঝামেলায় পড়তে চাইনি বলে সবসময় এই টপিকটা এভোয়েড করে যেতাম৷ তবে আমি যখন কলেজ পেরিয়ে মেডিকেলে ভর্তি হলাম, তখন মনে হল একটা প্রেম করা দরকার। কিন্তু পছন্দের কোনো মেয়েই পাচ্ছিলাম না। তাই আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম৷ ভেবেছিলাম, আমার দ্বারা এসব হবে না৷ কিন্তু ভাগ্যে আমার তা ছিলো না। ”
এই বলে উনি কয়েক সেকেন্ড বিরতি নিয়ে পুনরাশ বলতে আরম্ভ করলেন,
” তোমার বয়স তখন তেরো কি চৌদ্দ। সেদিন তোমাদের স্কুলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান ছিলো। আমার স্পষ্ট মনে আছে তুমি লাল সাদা পাড়ের একটা শাড়ি পরেছিলে। চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে লাল কালারের লিপস্টিক। এই ছিলো তোমার সেদিনকার সাজ। সত্যি বলতে সেদিনই তোমার প্রতি আমার প্রথম ভালোলাগা কাজ করে। আই নো, এটা খুবই বিতিকিচ্ছিরি একটা ব্যাপার। কারণ তুমি তখন মাত্র ক্লাস এইটে পড়ো। এমন ছোট্ট মেয়ের প্রতি আমার ভালোলাগাটা বেশ দৃষ্টিকটু একটা বিষয়। এ নিয়ে আমি নিজেকে বুঝিয়েও ছিলাম। নিজেকে বলেছিলাম, ছোট থেকে তোমাকে দেখে আসছি। তোমার খেয়াল রাখছি। এখন তোমার প্রতি এমন অনুভূতি জন্মানোটা ভালো দেখায় না। কিন্তু আমি কেমন যেনো হয়ে পড়েছিলাম চন্দ্রিমা। নিজেকে সামলাতে পারিনি। খুব চেষ্টা করেছি, তোমাকে ভালো না বাসার। কিন্তু কিভাবে কিভাবে যেনো আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলি। আমার মনে সর্বপ্রথম যখন তোমাকে নিয়ে ভালোলাগা তৈরী হয়, তখন আমি নিজেকে বুঝিয়েছিলাম। আটকে রেখেছিলাম। কিন্তু তা ছিলো মাত্র এক বছরের জন্য। এরপরের বছরই যখন চঞ্চল মা’রা যায় তখন তোমাকে দেখে ভীষণ মায়া লাগতো, খারাপ লাগতো। দেখতাম তুমি অনামিকার সাথে খেলার বাহানায় এসে আমাদের বাড়ি বসে কাঁদতে। একা একা বসে থাকতে। কারোর সাথে তেমন কথা বলতে না। খুব কষ্ট হতো তোমার প্রতি। বলা যায়, তখন থেকে তোমার মায়ায় পড়েই আমি তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। তখন থেকে আজ অব্দি আমার এ ভালোবাসা বেড়েছে বৈকি কমেনি। আমি রোজ রোজ তোমাকে দেখতাম আর মনে হতো, তোমার প্রতি আমার অনুভূতি সকল বেড়েই চলছে। এরপর থেকে আমি নিজেকে আটকে রাখিনি। তোমাকে ভালোবেসেছি। মনের গভীর থেকে তোমার জন্য অনুভব করেছি। যখন তুমি কষ্টে থাকতে তখন আমি কেমন যেনো অস্থির হয়ে পড়তাম। কিন্তু এ ব্যাপারটাকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতাম।
সেদিন নাহিদের সাথে যখন রেস্টুরেন্টে এসে পথ হারিয়ে ফেলেছিলে, বিশ্বাস করো চন্দ্রিমা, সেদিন মনে হয়েছিলো, আমি বোধহয় তোমাকে হারিয়ে ফেলবো। পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তোমার ফোন পেয়ে রোগী অন্যজনের কাছে দিয়ে দৌড়ে চলে এসেছিলাম। এরপর যখন তোমাকে সহিসালামত দেখলাম, আমিই জানি, আমি কিভাবে নিজের ইমোশন কন্ট্রোল করেছিলাম। মনে হচ্ছিলো, সেখানেই তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদি। কারণ তোমাকে হারানোর ভয় আমাকে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো চন্দ্রিমা। আমি তোমাকে হারাতে চাই না। সারাজীবনের মতো নিজের করে পেতে চাই।”
এই বলে অভ্র ভাই আমার পানে চেয়ে রইলেন। উনার চাহনিতে অসহায়ত্ব, দ্বিধাগ্রস্ততা, উৎকণ্ঠতা, সকল একসাথে প্রকাশ পাচ্ছে। আর আমি…..আমি হতভম্ব হয়ে উনার পানে চেয়ে আছি। মুখের বুলি যেনো হারিয়ে বসেছি এ মুহূর্তে। এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, অভ্র ভাই আমাকে ভালোবাসেন! আর এ ভালোবাসা এক মাস বা এক বছরের নয় দীর্ঘ চার বছরের!
অভ্র ভাই আমার হাতজোড়া এখনও পূর্বের ন্যায় ধরে আছেন। বহুক্ষণ বাদে উনি নত মস্তকে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর যথাসম্ভব শান্ত কণ্ঠে বললেন,
” আমি জানি, চন্দ্রিমা, হুট করে এসব কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিলো না। ভেবেছিলাম সঠিক সময়ে তোমাকে আমার মনের কথা বলবো। কিন্তু আম্মার কাছে শুনলাম, তোমার জন্য ছেলে ঠিক করছে। একটা ছেলে তো তোমাকে দেখতেও চাইছে। এসব শুনে আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। মনে হয়েছিলো, আজ না বললে আর কখনো বলতে পারবো না। ভয় হচ্ছিলো, যদি দেরি হয়ে যায়! যদি তুমি অন্য কারোর হয়ে যাও! এজন্য বেশ সাহস নিয়েই তোমাকে আমার মনের কথা বললাম চন্দ্রিমা। এসব জানার পর আমার প্রতি তোমার আচার-আচরণ, অনুভূতি কেমন হবে তা জানা নেই। তবে আমি এটা জানি, আমি কোনো ভুল করিনি। তোমার কি মনে হয় চন্দ্রিমা?”
আমি কিয়ৎক্ষণের জন্য বোধহয় অভ্র ভাইয়ের চোখের গভীরতায় হারিয়ে গিয়েছিলাম। উনার বলা প্রতিটা কথা মন দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ আমার হুঁশ এলো, এ আমি কি করছি!
আমি তৎক্ষনাৎ উনার হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বড় বড় কয়েকটি শ্বাস টেনে অবিন্যস্তভাবে দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘোরালাম। আমার উচিত, এ মুহূর্তেই দৌড়ে এখান থেকে পালানো। কিন্তু কেনো যেনো, আমার পা জোড়া এ সিদ্ধান্তে আমাকে সহযোগীতা করলো না।
অভ্র ভাই এখন আমার একদম সোজাসুজি দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে এভাবে দেখে হয়তো তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
” তোমার কি মনে হয় চন্দ্রিমা? আমি কি কোনো ভুল করেছি? ”
অভ্র ভাইয়ের এ প্রশ্নে আমি কিয়ৎক্ষণের জন্য পুরোপুরি শূন্য হয়ে পড়লাম। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নিজেকে সামলে বললাম,
” আমি জানি না অভ্র ভাই। আপনার ভুল সঠিক বিবেচনা করার মতো সাহস আমার নেই। তবে এটা বলবো, আমি কখনো আপনাকে ঐ নজরে দেখিনি। এমনটা হলে, আমি এখন আপনার সাথে এতো স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারতাম না। ”
অভ্র ভাই তৎক্ষনাৎ কিছু বললেন না। বরং কিয়ৎ সময় নিয়ে বললেন,
” আমার দিকে তাকাও চন্দ্রিমা। তোমাকে একটা কথা বলবো। ”
কিছুক্ষণ পূর্বেই অভ্র ভাইয়ের সমস্ত কথাগুলো শোনার পর এ মুহূর্তে আমার সাহস হলো না উনার দিকে তাকানোর। এজন্য আমি নত দৃষ্টিতেই দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি পুনরায় একই কথা বললেন আমাকে। এবার আমি সাহস নিয়ে দু হাতের মুঠো শক্ত করে উনার দিকে চাইলাম। আমাদের দুজনের মধ্যে মাঝামাঝি দূরত্ব। উনার গলা বরাবর আমার উচ্চতা। এ যাবতকালে প্রথম অভ্র ভাইয়ের দিকে তাকাতে ভীষণ দ্বিধাবোধ করছিলাম। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমার সমস্ত শরীর আড়ষ্ট হয়ে এসেছে। কারণ, এতোদিন আমি উনার মনের অবস্থা জানতাম না। কিন্তু আজ আমি জানি, উনি আমায় নিয়ে কি অনুভব করেন। স্বভাবতই একটা মেয়ের পক্ষে এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকা দুষ্কর।
অভ্র ভাই আমার দৃষ্টি বরাবর দৃষ্টি রেখে মৃদু হেসে বললেন,
” জানো তো, যে তোমাকে ভালোবাসে তাকেই বিয়ে করা উচিত?”
অকস্মাৎ অভ্র ভাইয়ের এরূপ কথা শুনে শুকনো মুখেও বিষম খেলাম আমি। ফলস্বরূপ চোখজোড়া বিস্ময়ে বৃহদাকার ধারণ করলো। আমি আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বললাম,
” বিয়ে! ”
অভ্র ভাইয়ের ঠোঁটের কোনে পূর্বের ন্যায় হাসি বিরাজ করছিলো। তবে আমার এ আশ্চর্যান্বিত ভাব দেখে উনার সে হাসি মুহূর্তেই পরিবর্তন হয়ে যায়। উনি পূর্বের চেয়ে জোড়ালোভাবে হেসে বললেন,
” কেনো? বিয়েতে চাও না? প্রেম করতে চাও?”
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। তৎক্ষণাৎ আমতাআমতা করে বললাম,
” মানে, না মানে, আমি কখনো প্রেম করতে চাইনি। আসলে…..”
” তাহলে ডিরেক্ট বিয়ে করতে চেয়েছো, তাই তো?”
আমার কোনো জবাব দেওয়ার পূর্বেই আচমকা পিছন হতে প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো।
” তোরা দুজন কি করছিস ওখানে?”
উনার এ প্রশ্নে চমকে উঠলাম আমি। ফলস্বরূপ দু কদম পিছিয়ে এলাম। কিন্তু পিছনে বেঞ্চি থাকায় ভারসাম্য না রাখতে পেরে পরে যেতে নিলাম। তৎক্ষনাৎ অভ্র ভাই সামলে নিলেন আমাকে। প্রোজ্জ্বল ভাইও ততক্ষণে দৌড়ে এখানে চলে এসেছেন। এসেই কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” ঠিক আছিস চন্দ্রিমা?”
আমি ততক্ষণে অভ্র ভাইয়ের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে পরেছি। প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এ প্রশ্নে আমি ছোট্ট করে জবাব দিলাম,
” হুম। ”
উনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,
” বেশ কিছুক্ষণ ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তোদের দুইজনকে দেখলাম। ব্যাপার কি? কি কথা বলছিলি তোরা?”
উনার এ প্রশ্নে আমি ও অভ্র ভাই একে অপরের দিকে চাইলাম। অতঃপর প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের দিকে চেয়ে তৎক্ষনাৎ মাথা নিচু করে ফেললাম। অভ্র ভাই কিছুটা আমতাআমতা করে বললেন,
” কি-কিছু জরুরি কথা বলছিলাম। ”
” হ্যাঁ তা তো বলছিলিই। কিন্তু কি এতো জরুরি কথা বলছিলি এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে?”
অভ্র ভাই এবার সশব্দে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” দোস্ত? তোকে একটা মেয়ের কথা বলেছিলাম না?”
” হ্যাঁ বলেছিলি। কি হয়েছে তার?”
” সেই মেয়েটা আর কেউ নয় বরং চন্দ্রিমা।”
” কিহ!” প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কণ্ঠ শুনে মনে হলো, বেশ জোরেসোরে একটা ধাক্কা খেয়েছেন উনি। আমি দৃষ্টি তুলে উনার দিকে চাইলাম। সত্যিই, উনি বেশ বড় ধাক্কা খেয়েছেন। উনি হতভম্ব চাহনিতে একবার আমার দিকে অতঃপর অভ্র ভাইয়ের দিকে চাইলেন। মুহূর্তেই রসিকতাময় কোনো কথা শুনেছেন এমন ভঙ্গিতে হেসে বললেন,
” মজা করিস না অভ্র। তুই বললেই আমি মেনে নিবো এমনটা না। ”
” মজা না প্রোজ্জ্বল। আ’ম সিরিয়াস। সত্যিই সেই মেয়েটা চন্দ্রিমা। চন্দ্রিমাই সেই মেয়ে যাকে আমি চার বছর ধরে ভালোবাসি। ”
প্রোজ্জ্বল ভাই বোধহয় এখনও এ ধাক্কা হতে বেরিয়ে আসতে পারেননি৷ তাই তো আমার দিকে কিয়ৎক্ষণ ফ্যালফ্যাল চাহনিতে চেয়ে রইলেন। অতঃপর অভ্র ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন,
” চন্দ্রিমা জানে? ”
” হ্যাঁ, আজই ওকে সবটা বলেছি। ”
অভ্র ভাইয়ের এ কথা শোনার পর প্রোজ্জ্বল ভাই নিমিষের জন্য আমার দিকে চেয়ে বললেন,
” চন্দ্রিমা, তুই বাড়িতে যা। মা তোকে ডাকছিলো। আমি অভ্রর সাথে একটু কথা বলবো।”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এ কথা বলতে দেরি হলো, তবে আমার সেখান থেকে কেটে পড়তে দেরি হলো না। আমি কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই প্রোজ্জ্বল ভাই ও অভ্র ভাই নিজেদের মধ্যে কথোপকথনে ব্যস্ত হলেন। গেট অব্দি যাওয়া পর্যন্ত অভ্র ভাইয়ের শেষ একটি কথা শুনলাম,
” প্রোজ্জ্বল, তোর হেল্প লাগবে। প্লিজ না করিস না।”
®সারা মেহেক
#চলবে
( groups/259972409591747/