বিরহ শ্রাবণ পর্ব -১৮+১৯

#বিরহ_শ্রাবণ
#পর্ব_১৮
#লেখিকা:সারা মেহেক

বাড়িতে পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই নানু আদেশ দিয়ে বসলো আমাকে। তার আর তার ছেলের জন্য এখনই বেসনের বড়া বানিয়ে দিতে হবে। এ কাজের জন্যই মূলত মামি এতোক্ষণ অব্দি খুঁজছিলেন আমাকে। আমার হাতের বেসনের বড়া মামার ভীষণ প্রিয় বলে মামি কখনো নিজ হাতে বেসনের বড়া বানান না৷ মামার বড়া খাওয়ার ইচ্ছে জাগলে আমিই বানিয়ে দেই উনাকে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যদিও আমার এ মুহূর্তে কোনো কাজই করতে মন চাইছে না। চাইবেই বা কি করে, কিছুক্ষণ পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনা সকল মনে করলেই তো নাওয়াখাওয়া সব বন্ধ হয়ে জোগাড় হয়ে বসে। কিন্তু এটি যে কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না! এ কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রান্নাঘরে গিয়ে কাজ শুরু করলাম। যদিও আমার উড়ু উড়ু মন কিছুতেই রান্নার কাজে বসলো না। বরং অভ্র ভাইয়ের প্রতিটি কথার চুল চিরা বিশ্লেষণ করতে ব্যস্ত হলো। চিন্তা, দুশ্চিন্তা, ভাবনায় বিভোর হলাম আমি৷ মনের মাঝে উঁকি দিলো প্রশ্নের সারিরা। সবকিছু বাস্তবে ঘটলেও এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, অভ্র ভাই সত্যি আমাকে ভালোবাসেন! উনার মুখে বর্ণিত সেই স্বপ্নচারিণী আর কেউ নয় বরং আমি! তাহলে এতোদিন উনি যে আমার চিন্তা করতেন, আমার খেয়াল রাখতেন, তার সবটাই তিনি করতেন আমাকে ভালোবাসেন বলে! কিন্তু আমি যে উনাকে ভালোবাসি না। এমনকি আমার মনে উনার প্রতি কখনো তেমন কোনো অনুভূতিই তৈরী হয়নি৷ অথচ উনি তৎক্ষনাৎ সেখানে দাঁড়িয়েই পরোক্ষভাবে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলেন! আশ্চর্য!
এই ভাবনাতে মশগুল থেকে পেঁয়াজ কাটতে কাটতে অসাবধানতাবশত ব’টিতে ডান তর্জনী আঙুল কেটে গেলো। তড়িৎ গতিতে পিছিয়ে পড়লাম আমি৷ ফলস্বরূপ হাতের পেঁয়াজটা অদূরে ছিটকে গিয়ে পড়লো। ভয়ার্ত চাহনিতে লক্ষ্য করলাম, আঙুল বেয়ে গলগল করে র’ক্ত ঝড়ে পড়ছে। নিমিষের মাঝে এতো র’ক্ত দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। ততক্ষণে কয়েক ফোঁটা র’ক্ত আঙুল বেয়ে হাতের কব্জি ছাড়িয়ে মেঝেতে গিয়ে পড়লো। আমি দ্রুত কোনোমতে হাত নিয়ে বেসিনের ট্যাপের সামনে ধরলাম। আঙুলের র’ক্ত ধুয়ে যেতে যেতেই রান্নাঘরে নানু ও মামি উপস্থিত হলেন। তাদের দেখে আঙুল ট্যাপের পানি হতে সরাতেই আবারো র’ক্ত বের হওয়া শুরু হলো। আমার আঙুল কেটে এভাবে র’ক্ত বেরুতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন মামি। একরাশ উদ্বিগ্নময় কণ্ঠে হায় হায় করতে করতে বলে উঠলেন,
” হাত কাটলি কিভাবে! দেখি দেখি কতখানি হাত কেটেছিস?”
এই বলে মামি এগিয়ে এসে আমার হাতটা ধরলেন। তখনও আঙুল দিয়ে র’ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বুঝতে পারছি, বেশ গভীর একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে।
মামি ও নানুর এ আতঙ্কিত চাহনি ও মুখশ্রী দেখে আমি সশব্দে হেসে বললাম,
” এতো হাইপার কেনো হচ্ছো নানু? আর মামি আপনার এই টেনশনের কারণে আমার সুস্থতাও মাঝে মাঝে ভয়ে পালিয়ে যায়। কি এমন হয়েছে শুনি? এর আগে কি কখনো হাত কাটেনি আমার? রুমে গিয়ে ওষুধ লাগিয়ে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। ”

” এই গভীর ক্ষত একদিন ওষুধ লাগালেই বুঝি সেরে যাবে!”
হঠাৎ প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কণ্ঠস্বর শুনে দৃষ্টি তুলে চাইলাম আমি। স্বাভাবিক কণ্ঠেই উনার কথার প্রত্যুত্তরে বললাম,
” একদিন না হলে দু তিনদিন লাগাবো। সারতে বেশি সময় লাগবে না৷ ”

এবার নানু শাসন করে জিজ্ঞেস করলো,
” এভাবে হাত কাটলো কি করে? মন কোথায় ছিলো তোর?”

নানুর এহেন প্রশ্নে খানিক থতমত খেলাম আমি। বাস্তবেই আমার মন কাজে ছিলো না। ক্ষণিকের জন্য মনটা অভ্র ভাইয়ের কথায় মশগুল হয়ে ছিলো। কিন্তু এটি যে স্বীকার করার মতো অপরাধ নয়। এ কারণে আমতাআমতা করে বললাম,
” তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কেটে গিয়েছিল নানু। উফ, এতো টেনশন করো না তো। আমি এখন রুমে গিয়ে ওষুধ লাগিয়ে নিচ্ছি। আর প্লিজ তোমরা কেউ এসো না। তুমি আর মামি আসলে নির্ঘাত হইহই বাঁধিয়ে দিবে। ”
এই বলে আমি নানু ও প্রোজ্জ্বল ভাইকে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘর হতে বেরিয়ে এলাম। তবে বের হওয়ার পূর্বে লক্ষ্য করলাম, প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের মুখখানা কেমন যেনো থমথমে হয়ে আছে। হঠাৎ এমন থমথমে মুখশ্রীর পিছনে রহস্য কি তা তৎক্ষনাৎ উদঘাটন করতে পারলাম না। আর চেষ্টাও করলাম না৷ এ মুহূর্তে আমার ব্যান্ডেজ লাগানো ফরজ হয়ে গিয়েছে। কারণ এখনও ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ছে আর ভীষণ জ্বালা করছে। আমি বাম হাত দিয়ে তর্জনী আঙুল চেপে ধরে রুমে চলে এলাম। ওয়ারড্রবের উপর হতে ছোট্ট ওষুধের বক্সটা খুলে স্যাভলন আর একটা ব্যান্ডএইড বের করলাম। স্যাভলন খুলে একটুখানি হাতে নিলাম ক্ষতে লাগানোর জন্য। কিন্তু এটা দেওয়ার পরে যে জ্বালা শুরু হবে তা ভাবতেই আমার বাম হাত আপনাআপনি পিছিয়ে এলো। কিন্তু ক্ষতে ওষুধ যে লাগাতেই হবে। তাই সাহস নিয়ে এবার এগিয়ে গেলাম ওষুধ দিতে। কিন্তু এর পূর্বেই কারোর হাতখানা আমার বাম হাত চেপে ধরলো। দৃষ্টি তুলে দেখলাম প্রোজ্জ্বল ভাই এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছেন৷ আমার বাম হাতে স্যাভলন দেখে শান্ত কণ্ঠে বললেন,
” সারাজীবন বেক্কলই দেখে যাবি তুই। হাতের র’ক্ত পরিষ্কার না করেই ওষুধ দেয় কোন পাগল?”

প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের কথায় তৎক্ষণাৎ নিজের ভুল বুঝতে পেরে আলতো করে জিব কাটলাম। বললাম,
” সরি প্রোজ্জ্বল ভাই। খেয়াল ছিলো না। ”

প্রোজ্জ্বল ভাই আমার কথার প্রত্যুত্তরে তৎক্ষনাৎ কিছু বললেন না। বরং আমার সামনে খাটে বসে ওষুধের বক্স হতে একটু তুলো নিয়ে হাতের স্যাভলন মুছে ফেললেন। অপর একটি তুলো নিয়ে আঙুলে র’ক্ত পরিষ্কার করতে করতে বললেন,
” এখনই এতো ভুলোমনা হয়ে যাচ্ছিস তুই! সামনে কি হবে তাহলে?”

আমি নিরুত্তর রইলাম। উনার এমন প্রশ্নের ঠিক কি জবাব দেওয়া যায় তা বোধগম্য হলো না বলেই নিশ্চুপ রইলাম। খানিক বাদে পূর্বের তুলনায় অত্যধিক রাশভারি গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” তখন অভ্রের কথা চিন্তা করছিলি তাই না?”

অকস্মাৎ প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এরূপ প্রশ্নে থতমত খেলাম আমি। উনি আমার মনের কথা বুঝলেন কি করে! জানলেন কি করে যে আমি অভ্র ভাইকে নিয়েই চিন্তায় মগ্ন ছিলাম! অদ্ভুত!
আমার পক্ষ হতে জবাব না পেয়ে প্রোজ্জ্বল ভাই মৃদু স্বরে হাসলেন। বললেন,
” অভ্রকে পছন্দ করিস তুই?”

উনার এ প্রশ্নে আমার মাঝে আড়ষ্টতা বিরাজ করলো। স্বভাবতই একজন মেয়ে হওয়ার দরুন এমন প্রশ্নের জবাব হুট করে সরাসরি দেওয়া বেশ দুঃসাধ্য। তা সে প্রশ্নের জবাব যতই নেতিবাচক হোক না কেনো। ফলে উনার এ প্রশ্নের জবাব দিতেও ব্যর্থ হলাম আমি। উনি আর কথা বাড়ালেন না। তুলো দিয়ে র’ক্ত পরিষ্কার করে একটুখানি স্যাভলন নিয়ে আমার ক্ষতে লাগালেন তিনি। তাজা ক্ষত ওষুধের স্পর্শ পেতেই জ্বলে উঠলো। ফলস্বরূপ তড়িৎ গতিতে হাত সরিয়ে নিলাম আমি। কাতর কণ্ঠে বললাম,
” খুব জ্বলছে তো! ”

প্রোজ্জ্বল ভাই আমার কাতর কণ্ঠ শুনেও যেনো তা উপেক্ষা করলো। উনি ভাবলেশহীন চাহনিতে আমার পিছিয়ে রাখা হাতটা ধরে এগিয়ে নিয়ে আসলেন। শক্ত করে চেপে ধরে পুরো ক্ষততে স্যাভলন লাগিয়ে দিলেন। ওদিকে আমি ব্যাথায় চোখমুখ কুঁচকে আছি৷ কিন্তু প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। অন্যান্য সময় হলে আমাকে এক ধমকেই চুপচাপ বসিয়ে রাখতেন উনি৷ অথচ আজ আমার আর্তনাদের আওয়াজেও নিশ্চুপ আছেন উনি। অদ্ভুত!
স্যাভলন লাগানো শেষে ঐ আঙুলে ভালোমতো ব্যান্ডএইড লাগিয়ে দিলেন তিনি। অতঃপর সবকিছু গোছগাছ করে ওষুধের বক্সে রেখে দিলেন। এরই মাঝে উনার এরূপ আচরণ দেখে জিজ্ঞেস করে বসলাম,
” আপনার কি হয়েছে প্রোজ্জ্বল ভাই? এতো শান্ত কেনো আপনি?”

আমার প্রশ্নের জবাবে উনি আমার পানে চেয়ে মৃদু হাসলেন। বললেন,
” কেনো? শান্ত থাকাও কি সমস্যা? ”

” না, সেটা বলছি না। ”

” তাহলে কি বলছিস?”

ইতোমধ্যে প্রোজ্জ্বল ভাই উঠে গিয়ে ওষুধের বক্স ওয়ারড্রবের উপর রেখে দিয়েছেন। আমি তখনই জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি কি অভ্র ভাইয়ের প্রপোজালের কারণে রেগে আছেন? ”

উনি বক্স রেখে আমার রুম হতে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। এর মাঝে আমার প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়িয়ে বললেন,
” রাগ করবো কেনো? রাগ করার কোনো কারণ দেখছি না তো। ”
এই বলেই তিনি প্রস্থান করলেন। অকস্মাৎ উনার এরূপ আচরণ ভাবিয়ে তুললো আমায়। অভ্র ভাইয়ের এমন প্রপোজাল দেখেই উনি এমন আচরণ করছেন? এ কারণে অভ্র ভাইয়ের উপর উনি রাগ করেননি তো! এসব প্রশ্ন ভীষণ ভাবিয়ে তুলছে আমাকে।

———-

গতকাল রাতেই ঘুমানোর পূর্বে প্রত্যাশা আপুকে কল করে সব ঘটনা বিস্তারিত বলেছি। প্রথম প্রথম আপু বিশ্বাস করতে চায়নি। কিন্তু পরে ঠিকই বিশ্বাস করেছে। আপাতত এ বিষয়ে কথা বলতেই দুপুরের শ্বশুরবাড়ি হতে বাড়িতে ছুটে এসেছে আপু। হঠাৎ আপুর এমন আগমন দেখে মামি ভীষণ অবাক হলেও খুশি হলেন বেশি।

আপু রুমে এসেই আমার দিকে প্রথম প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
” গতকাল রাতের পর অভ্রের সাথে আর কথা হয়েছে তোর?”

” না আপু। কি কথা বলবো বলো। উনি প্রপোজ করার পর থেকেই স্বভাবতই আগের মতো কিছুই স্বাভাবিক থাকবে না৷ আজ কলেজে উনার সাথে দেখা হলেও লজ্জায় কথা বলতে পারিনি। ”

” অভ্র এগিয়ে আসেনি কথা বলার জন্য?”

” না। হয়তো উনি আমার অস্বস্তি বুঝতে পেরেছেন। ”

” হয়তো। কিন্তু আমি এই ভাবছি যে, আমাদের অভ্র মিয়া কত বড় ছুপারস্তুম! চার বছর ধরে তোকে ভালোবাসে। অথচ কাউকে কিছু জানতে দেয়নি! আবার একদিনে মনের কথা বলে ঐদিনই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেছে! কি ফাস্ট!
আচ্ছা, তোর মনে কি চলে বল তো আমাকে। ”

” আমার মনে কি চলবে আবার! ”

” ওমা! কি চলবে মানে! এই যে অভ্রের প্রতি কোনো ফিলিংস বা টান?”

” তুমি পাগল না কি আপু! উনাকে আমি কখনোই ঐ নজরে দেখিনি। সুতরাং উনার প্রতি ফিলিংস বা টান না থাকাই স্বাভাবিক। ”

” হ্যাঁ সেটাও ঠিক বলেছিস। তবে আমার এখন কি মনে হয় জানিস?”

” কি মনে হয়?”

” মনে হয়, অভ্র খুব শীঘ্রই অফিশিয়ালি তোকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসবে।”

আপুর এহেন কথায় আমি বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেলাম। বললাম,
” এসব কি বলো আপু!”

” হ্যাঁ। সত্যিই বলছি। ”

” অভ্র ভাই এমন করলে আমি শেষ। লজ্জায় কারোর সামনে মুখ দেখাতে পারবো না৷ ”

আপু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” লজ্জা! লজ্জা লাগবে কেনো? এখানে লজ্জা লাগার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। সেই ছোটবেলা থেকে পরিচিত তোরা। ”

” ছোটবেলা থেকপ পরিচিত বলেই তো লজ্জা লাগবে বেশি। একবার চিন্তা করো, সবকিছু কেমন ওলটপালট হয়ে যাবে না? মানে…. উফ, কিভাবে কি বুঝাবো তোমাকে!”
এই বলে আমি মাথায় হাত রাখলাম। আপু আমার মাথা থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
” আচ্ছা, আমাকে কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দে। ”

” হুম করো প্রশ্ন।”

” তুই কাউকে ভালোবাসিস?”

” আস্তাগফিরুল্লাহ! কি বলছো! আমি কাউকে পছন্দ করি না। হ্যাঁ, আমার ক্রাশ আছে। যদিও সবগুলো সেলিব্রিটি। ”

” ইশ! ওসব সেলিব্রিটি ক্রাশের কথা বাদ দে।
আচ্ছা, ভালোবাসিস না। তাহলে কাউকে পছন্দ করিস?”

” উঁহু। ”

” বিয়ের আগে প্রেম করতে চাস?”

” মোটেও না। ”

” অভ্রর মধ্যে খারাপ কিছু আছে?”

আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম এর জবাব। অতঃপর বললাম,
” না। খারাপ কিছুই নেই। ”

” গুড। তাহলে বলবো, এক্ষুণি অভ্রকে বিয়ে করেনে।”

” এক্ষুণি! আপু, তোমার মাথা গেলো না কি! কি বলছো?”

” দেখ, তুই কাউকে পছন্দ করিস না, ভালোবাসিস না। তাহলে তোর দিকে সবকিছু ক্লিন। কিন্তু অভ্র তোকে পছন্দ করে, ভালোবাসে। ইভেন তোকে বিয়েও করতে চাইছে। তাহলে আপত্তি কিসে?”

” আপু বুঝছো না৷ আমাদের বিয়ে, ব্যাপারটা কেমন অড হয়ে যায় না?”

” রাখ তোর অড-ফড। স্বভাব চরিত্র ভালো মিলিয়ে একটা ছেলে তোকে ভালোবাসে আর তুই বলছিস কেমন অড দেখায়!
আর অভ্রের সাথে তোর বিয়ে হলে একদিন না একদিন ওকে তুইও ভালোবেসে ফেলবি। আর বিয়ের আগে যে দু পক্ষেরই ভালোবাসা থাকতে হবে এমনটা নয়৷ একজন ভালোবাসলে বিয়ের পর অপরজন ঠিকই ভালোবেসে ফেলবে। ”

” তোমার কথায় যুক্তি আছে আপু। কিন্তু….. ”

” কোনো কিন্তু না৷ শুধু অস্বস্তি লাগার জন্য এমন ভালো ছেলে কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। সো, অভ্র বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলে তুই নিষেধ করবি না। আর সরাসরি হ্যাঁ না বলতে পারলে আমাকে বলিস। আমি তোর পক্ষ থেকে বিয়েতে মত দিয়ে দিবো।”
এই বলার পর আপু আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টেনে নিচে নিয়ে গেলো। একসাথে নুডলস রান্না করে খাবে তাই। আমিও আপত্তি না জানিয়ে কাটা আঙুল নিয়েই টুকটাক আপুকে সাহায্য করলাম।

——-

গতকাল সারারাত প্রায় জেগে ছিলাম। কারণ আমি আর আপু মিলে একটা মুভি দেখে সাথে গল্প করে সময় কাটিয়েছিলাম৷ স্বভাবতই ভোর রাতে ঘুমানোয় এদিকে ঘুম ভেঙেছেও দেরিতে। শুক্রবার হওয়ায় ক্লাস নিয়ে কোনো প্যারা না থাকা ধীরেসুস্থে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলাম নাস্তা খেতে। কিন্তু নিচে নেমে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার শিকার হবো তা কল্পনাও করিনি আমি৷ ডাইনিং এ ঢুকে দেখলাম, ড্রইংরুমে আমাদের পরিবারের সবাই উপস্থিত আছে৷ আর তারা সবাই সোফায় বসে থাকা অভ্র ভাই ও উনার বাবা মার আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ছুটির দিনে অভ্র ভাইয়ের সাথে অকস্মাৎ উনার বাবা মার আগমনে আমার বুকটা ধক করে উঠলো। ক্ষণিকের পর্যবেক্ষণে মনে সন্দেহ জেগে উঠলো, অভ্র ভাই কি সত্যিই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন!”
®সারা মেহেক
#বিরহ_শ্রাবণ
#পর্ব_১৯
#লেখিকা:সারা মেহেক

ড্রইংরুমে উপস্থিত সকলকে দেখে কিয়ৎক্ষণ তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি৷ আমার বিস্ময়ের মাত্রা আকাশচুম্বী হতে না হতেই প্রত্যাশা আপু এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। চোখের ইশারায় ফিসফিস করে বললো,
” মাথায় ওড়না দে মেয়ে! এভাবে হবু শ্বশুর, শাশুড়ীর সামনে কেউ যায় নাকি!”

আপুর মুখে এহেন কথা শুনে বিস্ময়ে হা হয়ে লোকলজ্জার কথা ভুলো বসলাম। অতি আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলে উঠলাম,
” কিহ!”

আপু সাথে সাথে চোখের ইশারায় আমায় চুপ হতে বললো। বুঝলাম, ভুল জায়গায় ভুল আচরণ করে বসেছি। আমি সাথে সাথে জিব কেটে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলাম। আপু আর কথা না বাড়িয়ে আমার মাথায় ওড়না টেনে দিয়ে আমায় নিয়ে সোফায় বসালো। আমি বাধ্য মেয়ের মতো বসে পড়লাম। তবে আমার মাথায় বইতে লাগলো একরাশ প্রশ্নের ঝর্ণা। এরই প্রেক্ষিতে আমি প্রশ্নাতুর চাহনিতে অভ্র ভাইয়ের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম৷ ওদিকে অভ্র ভাইও আমার দিকে চেয়ে আছে। তবে উনার চাহনি আমার ন্যায় নয়। বরং উনার চাহনিতে বিশাল এক অর্জনের খুশি প্রকাশ পাচ্ছে। উনার ঠোঁটের কোনে লেপ্টে আছে স্নিগ্ধ হাসি।

” আজকালকার ছেলেপুলেদের দেখি লাজ শরম সব হাওয়া হয়ে গেছে। বড়দের সামনেও কেমন করে একে অপরের দিকে তাকায় আছে দেখো!”
অকস্মাৎ নানুর কণ্ঠে সচকিত দৃষ্টিতে নানুর দিকে তাকালাম এবং তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি নিম্নে এনে বসে রইলাম।
নানুর এহেন কথায় খোদেজা মামি হেসে বলে উঠলেন,
” আরে চাচি, বুঝেন না, ছোট থেকে পরিচয় একে অপরের সাথে। এভাবে তাকিয়ে থাকা স্বাভাবিক ব্যাপার। ”

মামি বললেন,
” যাই বলেন না ভাবী, এভাবে সবার সামনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকাটা কেমন দেখায় না!”

” ওসব কথা বাদ দিন ভাবী। যে কাজে এসেছি সে কাজটা তো করি। বলুন, বরযাত্রী নিয়ে কবে আসবো আমরা?”

খোদেজা মামির শেষোক্ত কথাটি কর্ণপাত হতেই আশ্চর্যান্বিত চাহনিতে দৃষ্টি তুলে চাইলাম আমি। কি হচ্ছে এসব! সকাল থেকে একের পর এক ধাক্কা খেয়েই চলছি। প্রথমত অভ্র ভাইয়ের এমন অকস্মাৎ আগমন। উপরন্তু এখন বিয়ের তারিখ পাকাপোক্ত করা! সেটাও আবার আমার মতামত না জেনে! বিয়ের মতো সিদ্ধান্ত আমার মতামতবিহীন এগুনোয় ভীষণ রাগ হলো। ফলস্বরূপ তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করে বললাম,
” আমার বিয়ে অথচ আমার মতামত না নিয়েই সব সিদ্ধান্ত হচ্ছে! এ কেমন কথা!”

আমার এহেন কথায় মামি ও খোদেজা মামির মধ্যে চলা কথাবার্তা মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেলো। আমার কথার প্রেক্ষিতে মামা মুহূর্তেই বলে উঠলেন,
” ধু’র পা’গ’ল মেয়ে! তোর মতামত ছাড়া তোর বিয়ে দিবো, এটা ভাবলি কি করে? তোর মতামত ছাড়া কিছুই হবে না। তোর মামিরা একটু মজা করছিলো শুধু৷
গতকাল রাতেই ইয়াসির ভাই আমাকে ফোন করে দেখা করতে বলে। উনার সাথে দেখা হওয়ার পর উনি তোর আর অভ্রর ব্যাপারে বললেন। এও বললেন যে অভ্র তোকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে। এসব শুনে ইয়াসির ভাইকে বললাম, কালকে ভাবীসহ অভ্রকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতে। সবার সামনেই কথা বলে বিয়ের ব্যাপারে আগাবো। তবে এর আগে তোর মতামত নিবো। আর তোর মতামতটাই সবচেয়ে জরুরি। এছাড়া তোর নানু,মামি আর আমার এ বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই৷ তুই হ্যাঁ বললেই হ্যাঁ।”
এই বলে মামা চুপ হয়ে গেলেন। সাথে সাথে ড্রইংরুমে উপস্থিত প্রতিটি ব্যক্তির দৃষ্টি আমার উপর এসে স্থির হলো। এ মুহূর্তে আমিই তাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তাদের এ চাহনিতে আমার মধ্যে অস্বস্তির মাত্রা বেড়ে গেলো। চরম অস্বস্তিতে পড়ে মাথা নিচু করে দু হাত দিয়ে ওড়না খুঁটতে লাগলাম৷ এমতাবস্থায় নানু বললো,
” আমাদেরও বুদ্ধিজ্ঞান সব লোপ পেয়েছে। একটা মেয়েকে এভাবে সবার সামনে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করে কেউ! আমি না হয় বুড়ি হয়ে গেছি। তোরা তো এখনও জোয়ান আছিস!
ইশ প্রত্যাশা! যা তো। চন্দ্রিমাকে নিয়ে রুমে যা। আক্কেলজ্ঞান তো কিছু নেই! যা। আমরা রুমে এসেই কথা বলছি ওর সাথে। ”

নানুর এ কথায় আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। বিতিকিচ্ছিরি এবং উদ্ভট এ পরিস্থিতি হতে নিস্তার পেতে মুহূর্তেই উঠে দাঁড়ালাম। প্রত্যাশা আপুর অপেক্ষায় না থেকে আমি একাই ড্রইংরুম পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিজের রুমে চলে এলাম৷ এসেই দরজা লাগিয়ে দিলাম। এ মুহূর্তে আমার মাঝে ঠিক কি অনুভূত হচ্ছে তা নিয়ে আমি নিজেই দ্বিধান্বিত। কেমন এক খুশি, লজ্জা, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা সকল মিলিয়ে এক মিশ্র অনুভূতি খেলা করছে আমার মাঝে। তবে এর মধ্যে অস্থিরতাই অনুভূত হচ্ছে বেশি। হাত পা ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে আসছে। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছি, আমার কি এ বিয়েতে রাজি হওয়া উচিত? অভ্র ভাইকে কি নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে পছন্দ করা উচিত? এসব প্রশ্নের জবাব হিসেবে কিছু সময় আমার মন কুঠির একদম শূন্য পাতার ন্যায় জবাবহীন হয়ে আসছে। আবার কিছু সময় সে মন কুঠিরে শূন্য পাতায় রঙিন কালি দিয়ে লিখে জানাচ্ছে, হ্যাঁ, অভ্র ভাইকে বিয়ে করা উচিত। কারণ উনার সাথে আমি কখনো অসুখী হবো না। যে মানুষ আমাকে এতো বছর ধরে নীরবে, নিঃস্বার্থে ভালোবেসে গিয়েছে সে নিশ্চয়ই আমার জন্য খারাপ বলে বিবেচিত হবে না।

আমার এ ভাবনার মাঝে দরজায় কড়া নাড়লো আপু। আমি দরজা খুলে দিতেই আপু, নানু ও মামি আমার রুমে প্রবেশ করলেন। নানু আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললেন,
” বস চন্দ্র‌িমা। বসেই কথা বলি।”

আমি খাটে বসলাম। আমার সোজাসুজি বসলো নানু। আমার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো,
” অভ্রকে পছন্দ করিস?”

আমি খানিক ইতস্ততার সহিত বললাম,
” আমি কখনো অভ্র ভাইকে পছন্দ করার নজরে দেখিনি নানু।”

” হুম। বুঝলাম। কিন্তু অভ্র যে তোকে ভীষণ ভালোবাসে চন্দ্রিমা। চার বছর যাবত তোকে ভালোবাসে ও। কম কথা!
আচ্ছা, এখন বিয়ের কথায় আসি। তোর এ বিয়েতে মত কি? অভ্রকে পছন্দ, অপছন্দ করাটা ব্যাপার না। কারন তোর নানা আর আমার বিয়ের সময়ও এমন আগে থেকে পছন্দ বা ভালোবাসার কোনো ব্যাপার ছিলো না। আমি পুরো সিদ্ধান্তটাই আমার পরিবারের উপর দিয়ে দিয়েছিলাম। তারাই পরে বিয়ের সিদ্ধান্ত দিয়েছিলো। এখন যেহেতু তোদের বিয়ের প্রস্তাবে একপক্ষ হতে পছন্দের বিষয়টা আসে সেহেতু অপরপক্ষের মত নেওয়াটাও জরুরি। এবার বল, তোর কি মনে হয়।”

নিজের মাঝে এতক্ষণ যাবত যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলমান ছিলো, নানুর কথায় সেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব পূর্বের চেয়েও বৃদ্ধি পেলো। বাড়লো অস্থিরতার মাত্রা।
মামি জিজ্ঞেস আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রেখে নম্র কণ্ঠে বললেন,
” তুই যা সিদ্ধান্ত নিবি আমরা তাই করবো। তুই না বললে আমার বিয়ের কথা আগাবো না। ”

আপুও মামির কথার সুরে সুর মিলিয়ে বললো,
” হ্যাঁ চন্দ্রিমা। তুই যে ডিসিশন নিবি সেটাই ফাইনাল। তবে আমার মতামত যদি জানতে চাস তাহলে বলবো, লাইফ পার্টনার হিসেবে অভ্রর চেয়ে ভালো ছেলে মনে হয় না পাবি। এজন্য একটু ভেবেচিন্তে জবাব দিস। ”

আমি পড়লাম এবার মহা দ্বিধায়। কি করবো, কি করবো চিন্তা করেই আমার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে এলো। একবার দৃষ্টি ঘুরাফিরা করলো একবার নানুর উপর,একবার মামির উপর, একবার আপুর উপর। সর্বশেষ আমার দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো দরজার বাইরে থাকা অভ্র ভাইয়ের উপর। অভ্র ভাই আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। দরজার বাইরে হেলান দিয়ে দু হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে মুচকি হাসি সহিত দাঁড়িয়ে আছেন উনি। উনার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন প্রোজ্জ্বল ভাই।
আমার মাঝে এতোক্ষন যাবত চলমান দ্বিধার উত্তাল সাগর অভ্র ভাইয়ের হাসির রেশ ধরে আরো উত্তাল হয়ে উঠলো। তবে এ উত্তল সাগরেই আমার দ্বিধান্বিত মন দিশা খুঁজে পেলো যেনো। মুহূর্তেই মাথা নিচু করে নানুকে বললাম,
” নানু, তোমরা আমার জন্য যে সিদ্ধান্ত নিবে আমি তাতেই রাজি। তোমরা যদি এ বিয়েতে আমার ভালো মনে করো, তবে আমি এ বিয়েতে রাজি। ”

আমার কথা শোনামাত্র নানু আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমার পিঠে আদরের পরশ বুলিয়ে বলে,
” আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ। তোর এ সিদ্ধান্তে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমাদের সবার ইচ্ছা, অভ্রর সাথেই তুই বাকিটা জীবন কাটা। আলহামদুলিল্লাহ, আজই অভ্রর সাথে তোর বিয়ের তারিখ পাকাপাকি করবো আমরা। ”
®সারা মেহেক

#চলবে
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here