#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা
পর্বঃ ৪
রাতের মাঝামাঝিতে তুমুল ঝড়বৃষ্টি হলো, বাড়লো উঠোনে উপস্থিত নারীর মাঝে উৎকণ্ঠা। কণ্ঠ তার মাত্রাতিরিক্ত কাঁপছিল। কিন্তু মনের ভিতর ক্ষীণ সাহসটাই বজায় রেখে বললো,
“দিদি! এটা কী সত্যিই আপনি?”
ছায়ার কথায় সামনের নারী অবয়বটার মাঝে তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না। সে তুমুল বৃষ্টির ছাঁট সয়েও ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। ছায়া আবার কণ্ঠ থেকে শব্দ উচ্চারণ করার আগেই সামনের অবয়বটা নুপুরের ভয়ঙ্কর শব্দ তুলে বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে বাহিরে বের হয়ে গেলো। ছায়ার আর সাহস ধরে রাখার ক্ষমতা হলো না। তার মাঝেই আকাশ হতে গমগমে বজ্রপাতের শব্দে প্রকৃতিও ক্ষানিক ভীত হয়ে গেলো বোধহয়। কেঁপে উঠলো ছায়ার শিরা উপশিরা অব্দি। বাহির থেকে সেই নারী অবয়বটার খিল খিল হাসি প্রকৃতিকে যেন আরও গুরুগম্ভীর করে তুললো। হাসির ঝংকারে মুগ্ধতা থাকলেও এই রহস্যময় গোলকধাঁধার জন্য তা কেবল গা ছমছমে ভয়ঙ্কর কিছু মনে হলো।
ছায়া কেবল তাকিয়ে রইলো নির্মিশেষ। তার হাত থেকে সেই কখন জ্বলন্ত হারিকেনটা পড়ে গিয়েছে৷ কাদায় মাখামাখি হয়ে আলোর ক্ষীণ রেখাটাও বিলীন হয়ে গেছে আঁধার গর্ভে। ছায়ার কেবল চোখে ভাসছে তার ননাসের অল্প বয়স থাকাকালীন বেনারসি পড়া লতার মতন অঙ্গখানি। যা আজ আবার বহু যুগ পড়ে দেখলো। মুহূর্তেই ছায়ার বোধশক্তি ফিরে আসতেই সে ছুটে গেলো নিজের ঘরে। নিমিষেই তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠলো। সে কী করলো এতক্ষণ! কীভাবে এতো সাহস তার ভেতর এলো! কীভাবে সে পারলো এমন ভাবে একটা অস্বাভাবিক কিছুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে! ছায়ার গা কেঁপে কেঁপে উঠলো। মনে হচ্ছে শরীরের তাপমাত্রা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পড়নের কাপড়টা বদলেই ছায়া কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। আজ রাতটা তার কাছে কেবল স্বপ্নের মতন মনে হচ্ছে।
–
সারারাত বৃষ্টির পর আজ শুদ্ধ, শীতল একটা সকালের দেখা মিললো। প্রকৃতির মাঝে কেমন সতেজতার ভাব। গাছপালা, পশুপাখি যেন সকল অলসতা ছেড়ে বেঁচে উঠেছে। বৃষ্টির জল ধুয়ে নিয়েছে সকল অলসতা। রোজকার সকালের মতন আজকের সকালটাও ফুড় ফুড়ে হয়ে এসেছে কিন্তু আজ একটা নিয়মের পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। আজ পত্রদের বাড়িতে ছায়ার হৈচৈ নেই। এমনেতে আজ সাপ্তাহিক বাজারের দিন তার উপর পত্র, পুষ্পের স্কুলও বন্ধ। এই দিনে সকাল হতেই একটা হৈচৈ থাকে পত্রদের বাড়ি। বাজার থেকে কি কি আনা হবে সে লিস্ট তৈরী করতে করতে ছায়ার কণ্ঠ বাজারের মোড় অব্দি যায়। আবার এর মাঝে পত্রকেও কয়েক ধাপে বকাঝকাও করেন। কিন্তু আজ তেমন কিছুই হলো না। সকলেই ঘুম থেকে উঠলো, নিজেদের কাজ সম্পন্ন করলো, একমাত্র ছায়া নির্জীব হয়ে শুয়ে রইলো। পদ্ম আজ রান্না ঘরের কাজে হাত লাগালো, পত্র উঠোন পরিষ্কারে লেগে পড়লো। সারারাত বৃষ্টির জন্য উঠোনটাতে কেমন ফ্যাচফ্যাচে কাদার মাখামাখি, গাছের ছোটো ছোটো ডাল ভেঙে পড়ে আছে, বড়ই গাছের পাঁকা পাঁকা বরই পড়ে আছে উঠোন জুড়ে। তা আবার কুড়িয়ে নিলো দুপুরে রোদ উঠলে ভর্তা করে খাবে বলে। কেউ আর ছায়াকে ডাকার সাহস পেলো না। পত্রদের বাবা বাজার থেকে ফিরলেন, হাত ভর্তি বাজারের ব্যাগ রান্নাঘরে রাখতে রাখতে পত্রকে ডেকে এক গ্লাস জল দিতেও বললেন। পত্র জল নিয়ে এলো, বাবার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
“বাবা, আজ মায়ের কী হয়েছে? সে যে বিছানায় শুয়ে আছে?”
সমিরবাবু শান্ত মনে জলটা পান করলেন অতঃপর মেয়ের দিকে গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“তোর মায়ের তো শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। কাল রাতেও ঠিক ছিলো। আজ ভোরে উঠে দেখি জ্বরে তার শরীর কাঁপছে। কী হলো! আবহাওয়া টা বোধহয় সয় নি শরীরে। তা তোরা এখানে, পুষ্প কোথায়?”
পত্র জবাব দেওয়ার আগেই পদ্ম থালায় গরম ভাত নিতে নিতে বললো,
“পুষ্পেরও তো জ্বর এসেছে। কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ওরেও রাতে ঠিক দেখেছি। হুট করে জ্বর উঠলো কেন যে এতো!”
সমিরবাবু চিন্তিত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো। ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“আবহাওয়া পরিবর্তন হলে এমন সর্দি-জ্বর বেধে যায়। আমি এখন একটু কোয়াটারে যাবো, যাওয়ার পথে বিপ্লবরে দিয়ে ওষুধ পাঠাবো, তোর মাকে আর পুষ্পকে কিছু খাইয়ে ওষুধ টা খেতে বলিস। কেমন?”
“তুমি খেয়ে যাবে না?”
“না। দুপুরে নাহয় পত্রকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিস কোয়াটারে, কেমন? আসি।”
দুই মেয়ে মাথা নাড়িয়ে বাবাকে বিদায় জানালো। ততক্ষণে পত্রের উঠোন পরিষ্কার করাও শেষ। পদ্ম গরম ভাত নিয়ে মায়ের ঘরের দিকে অগ্রসর হলো, তার পিছে পিছে গেলো পত্রও। মায়ের ঘরের উত্তর দিকের জানালাটা খোলা। সেখান দিয়ে এক টুকরো আলো এসে লুটোপুটি খাচ্ছে তাদের মেঝেতে। পত্র গিয়ে জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিলো যেন আরও ভালো করে আলো আসতে পারে ঘরে। এখান দিয়ে পুকুর পাড়ের রাস্তা দেখা যায়। বিশাল বটগাছ টা একবারে স্পষ্ট দেখা যায়। আগে পত্ররা তিন বোন এই ঘরে থাকতো। তারপর নতুন টিনের ঘর উঠানোর পর যে যার মতন আলাদা আলাদা ঘর বেছে নিলো। পুষ্প এবং পদ্ম একসাথে ঘুমাতো, পত্র এবং পিসি একঘরে ঘুমাতেন। আজও একই ধারাবাহিকতা বজায় আছে।
গরম ভাতের থালাটা ছোটো কাঠের টেবিলের উপর রেখে মাকে ক্ষীণ স্বরে ডাক দিলো পদ্ম,
“মা? মা।”
ছায়ার তেমন কোনো হেলদোল দেখা গেলো না দেখে এগিয়ে এলো পত্র। মায়ের বাহু কিঞ্চিৎ ঝাঁকিয়ে সে বড়ো কণ্ঠে ডাক দিলো,
“মা? উঠবে না?”
এবার ছায়া নড়েচড়ে উঠলেন কিছুটা। কিছু সেকেন্ড পর পিটপিট করে চোখের পাপড়ি ঝাপটালেন। বেশ কতক্ষণ লাগিয়ে চেষ্টা করে অবশেষে চোখ টেনে টেনে চাইলেন, কপালে মৃদু ভাজ। পদ্ম কোমল কণ্ঠে বললো,
“মা উঠো, খাবার নিয়ে এসেছি। উঠো।”
ছায়া চোখ টানটান করে তাকালেন। চোখের সামনে ভেসে উঠলো মেয়ে দু’টির মুখ। সে কপাল কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“সকাল হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ, উঠো তো। সকাল পেরিয়ে দুপুর ঘনিয়ে এলো বলে, কখন খাবে শুনি? উঠো।”
ছায়া আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। শরীর একবারেই দুর্বল হয়ে গেছে বললেই চলে। কোনো শক্তিই যেন নেই। মৃদু কাঁপছেও বোধহয়। সেদিকে খেয়াল করেই পদ্ম বোনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“পত্র, মায়ের শরীর কী খুব গরম? জ্বর কেমন?”
পদ্মের প্রশ্নে পত্র ক্ষাণিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। আমতা-আমতা করে বললো,
“হ্যাঁ, গরমই তো মনে হচ্ছে।”
“গরমই তো মনে হচ্ছে আবার কী? কেমন জ্বর? অনেক বেশিই কী লাগছে? তুই তো মায়ের শরীর ধরে আছিস। বুজছিস না তাও?”
দিদির প্রশ্নে আরেকটু অস্বস্তিতে পড়লো পত্র। ছায়া তা দেখে মুচকি হাসলো। দুর্বল কণ্ঠে বললো,
“ও আমার জ্বর মাপবে কী? জ্বর তো ওর নিজের শরীরেও। আমার চেয়েও তো ওর শরীর বেশি গরম মনে হচ্ছে।”
মায়ের কথায় অবাক হলো পদ্ম। তৎক্ষণাৎ সে বোনের কপালে, গলায় হাত ছুঁয়ালো। হাত ছুঁইয়ে আৎকে উঠলো সে। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“হে ঈশ্বর! এত জ্বর তোর শরীরে! অথচ সকাল থেকে একটা বারও বলিস নি? কিরে!”
বোনের বিস্মিত কণ্ঠের পরিবর্তে পত্র আমতা-আমতা করে বললো,
“আমার ঐ একটু গা গরম হয়েছে। এটা অত বড়ো ব্যাপার না।”
“তা গা গরম হলো কীভাবে? রাতে বৃষ্টিতে ভিজে ছিলিস নাকি?”
মায়ের প্রশ্নে অবাক হলো পত্র। বি স্ফো রি ত নয়নে চাইলো পদ্মও। পর পর বোন ও মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে পদ্ম বললো,
“বৃষ্টিতে ভেজার কথা তুমি কীভাবে জানলে! তবে ও ভিজে নি, মা। তোমার আদরের দুলালি পুষ্প ভিজেছে। সকালে আজানের সময় উঠেছিলাম। উঠে দেখি তোমার মেয়ে সেই ভোরে লুকিয়ে লুকিয়ে কী সুন্দর ভিজছে। আমাকে দেখে সে তো কী চমকে গেছে! আমাকে কতো ভাবে বলেছে যেন তোমাকে না বলি। সেই বৃষ্টিতে ভেজার জন্য ই এখন জ্বরে পড়ে আছে। আর তুমি তো জানোই, ছোটোবেলা থেকেই দু’টো হয়েছে এক পদের। একটার একটু রোগে ধরলে আরেকটাকেও ধরে। ওটার জন্য এখন এটারও জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। অকাজ করে তোমার মেয়েটা।”
ছায়া মনে মনে কী যেন ভাবলো কতক্ষণ। খুব গোপনে দীর্ঘশ্বাস টা ফেলতে নিতেই তার চোখ গেলো এবার বড়ো মেয়ের পায়ের দিকে। সাথে সাথে ই চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেলো। শরীর বেয়ে শুরু হলো অস্বাভাবিক কম্পন। কাঁপতে কাঁপতেই সে আঙ্গুল দিয়ে বড়ো মেয়ের পায়ের দিকে ইশারা করে বললো,
“আলতা! তুই আলতা পেলি কোথায়? কখন দিলি?”
এবার বোধহয় মনে মনে কিছুটা হোঁচট খেলো পদ্মও। খুব সন্তপর্ণে চেষ্টা করলো পা লুকানোর। তার মাঝেই উঠোন থেকে একটা পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো। পদ্ম হাঁপ ছেড়ে বাঁচতেই সে উছিলায় ছুটে গেলো উঠোনে। কি যেন একটা লুকানোর অদম্য চেষ্টা ফুটে উঠেছে তার চোখ-মুখে। মানুষের আবেগ, অনুভূতিই এমন, তারা যা লুকিয়ে রাখতে চায় তা আরও বেশি বহিঃপ্রকাশ হয়ে যায় তাদের লুকানোর চেষ্টায়।
বাড়ির উঠোনে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে বিপ্লব নামের কালো ছিমছাম গড়নের ছেলেটা। মাথায় তার এক ঝাঁকড়া চুলের গোছা। পদ্মকে আসতে দেখেই সে বোকা বোকা হাসলো। হাতের ঔষধ গুলো এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
“এই নেও পদ্ম ওষুধ। কাকা বললো কাকীমা আর পুষ্প নাকি অসুস্থ?”
“হ্যাঁ, একটু অসুস্থ। আপনি বসুন না বিপ্লব ভাই। চা করে দিচ্ছি।”
ওষুধ গুলো হাতে নিয়ে আন্তরিকতার সাথে মোড়া এগিয়ে দিতে দিতে হাসলো পদ্ম। ততক্ষণে পত্রও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। বিপ্লবকে দেখে তার মুখে তেমন কোনো উৎফুল্লতা দেখা দিলো না। সে মুখে চোখে আঁধার টেনে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ালো। বিপ্লব হাসি টেনেই পত্রের উদ্দেশ্যে বললো,
“কেমন আছো, লেখা? অনেকদিন দেখি না তোমায়।”
পত্র মুখ চোখ কালো করে পদ্মের দিকে তাকিয়ে বললো,
“দিদি, আমি একটু জেঠিমাদের বাড়ি যাবো। বিন্নীর সাথে দেখা করে আসবো। যাই।”
“ওমা! তোরও তো জ্বর। বিপ্লব ভাই একটু জ্বরটা দেখুক তারপর নাহয় ওষুধ খেয়ে যাবি।”
পদ্মের উৎকণ্ঠিত কথাতেও পত্রের হেলদোল হলো না। সে আসছি বলে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। বিপ্লব আর পদ্ম দু’জন দু’জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। পত্র বিপ্লব ভাইয়ের ছোটোখাটো ভক্ত বলা যায়। গ্রামে বিপ্লবের যে ফার্মেসীটা আছে সেখানে প্রায়ই পত্রের দেখা মিলতো। অথচ আজ পত্র এতটা মুখ গোমড়া করে রাখলো, বা এমন আচরণই বা করলো কেন! বোধগম্য হলো না তাদের। বিপ্লব তার গোল ফ্রেমের চশমাটা ঠেলতে ঠেলতে পুষ্পের জ্বর মাপতে চলে গেলো। পদ্ম ছোটো শ্বাস ফেলে রান্নাঘরে গেলো চা বানানোর জন্য।
_
জ্বর শরীরটা নিয়ে হেঁটে যাওয়াটা আজ বেশ পরিশ্রমের লাগছে পত্রের কাছে। হেলতে দুলতে তবুও কোনোমতে সে বিন্নীদের বাড়িতে পৌঁছালো৷ বাড়িতে পৌঁছাতেই বিন্নীর খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে এলো তাদের পূবের উঠোন দিক থেকে। পত্র কৌতুহলী হয়ে পা বাড়াতেই চোখে পড়লো বেশ অবিশ্বাস্যকর কাহিনী। আতস আর বিন্নী দু’জন মুখোমুখি বসে কি নিয়ে যেন হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।
#চলবে