#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা
পর্বঃ ৭
সকাল হতেই আবার সকলে দলবল নিয়ে ছুটলো দুলাল ঠাকুরের বাড়ি। মুখে মুখে সবার আহারে, আহারে করা আফসোসের বুলি। ছেলেটা মারা যাওয়ার পর থেকেই ঠাকুর বাড়িতে কেমন অশান্তি নেমে এলো! ক’দিন আগে অসুস্থ হলো বাড়ির কত্রী আজ নাকি অসুস্থ হয়েছে কর্তা। পত্রও সবার মতন ছুটে গেলো জেঠা মশাই দের বাড়ি। সুঠাম দেহী মানুষটা এক রাতের মাঝেই কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে! দেহে কোনো মতে প্রাণটা টিকে আছে বললেই চলে। মুখটা প্রায় বাঁকা হয়ে গেছে। মানুষটা কথা বলছে অথচ কেবল শোনা যাচ্ছে গোঙানোর আওয়াজ। বিন্নী ঘরের এক কোণে বসে কাঁদছে। জেঠিমা খাটের এক ধারে বসে আঁচল দিয়ে বার বার নিজের চোখের অশ্রু টুকু মুছে নিচ্ছে। পরিবারটার প্রায় বিধ্বস্ত দশা। পত্র আগলে নিলো বিন্নীকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“কাঁদিস না, খই। আমরা আছি তো।”
প্রাণ প্রিয় বান্ধবীকে পেয়ে আরও হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো বিন্নী। পত্রের কোমড় জড়িয়ে ধরে অস্ফুটস্বরে বললো,
“আমাদের সাথে এমন কেন হচ্ছে রে, পত্র? আমরা কার ক্ষতি করেছিলাম?”
“কারো ক্ষতি করিস নি। ভগবান তোদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। ধৈর্য ধর, খই।”
বিন্নীর কান্না বন্ধ হলো না। সে আগের তুলনায় আরও বেশি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। পত্র স্বান্তনা দিতে থাকলো। ভেতর ভেতর বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। হাসি, খুশি চা বাগানের এমন দশা তার মোটেও ভালো লাগছে না যে। অথচ এমন গোলমেলে সমস্যার সমাধানও তার জানা নেই। সে কেবল চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছে একজনকে, ভালোবাসে কিনা। কিন্তু তার পরও সকল কিছুই তার বড্ড ভেজাল যুক্ত মনে হচ্ছে। কেমন যেন পেঁচিয়ে আছে ব্যাপারটা। ভয়ঙ্কর পেঁচিয়ে আছে।
_
অবশেষে পুরো দু’দিন পর ছায়া দরজা খুললো। তার রাগ, জেদ সে ঠিকই বজায় রেখেছে দুই দিন যাবত। যখন সমির বাবু রাজি হলেন পদ্মের বিয়ে দিতে তখনই ছায়া দরজা খুললেন। তার শরীর অসাড় হয়ে অতঃপর লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। একটা হৈচৈ পড়লো, ডাক্তার ডাকা হলো।
নিত্যনতুন ঘটনায় প্রায় অসহ্য হয়ে গেছে পত্র। একটু শান্তি, একটু মুক্তির জন্য সে আস্তে করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। হাঁটা শুরু করলো সরু পথটা দিয়ে। তখন বিকেলের প্রথম ভাগ। শিরশিরে বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে। উড়িয়ে নিচ্ছে তার সকল ক্লান্তি। হাঁটতে হাঁটতে সে চা বাগানের পূর্ব দিকের খোলা মাঠটার দিকে এসে দাঁড়ালো। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা খেলছে মাঠ জুড়ে। একটা হৈ হৈ, রমরমা ভাব এখানে। নানান রকমের আনন্দ হাসছে যেন এখানে। পত্রের ভালো লাগছে দেখতে। যাক, অন্তত কোথাও তো কেউ খুশি আছে, কেউ হাসছে। নাহয় তো পুরো চা বাগান জুড়েই কেমন দুঃখদের উৎপাত। কেমন দমবন্ধকর চিৎকার চেঁচামেচি।
“কী করো, হে পত্রলেখা?”
পাশ থেকে পুরুষালী কণ্ঠে বেশ ভড়কে গেলো পত্র। খুব দ্রুত পাশ ফিরে তাকাতেই একটা হাস্যোজ্জ্বল মুখ চোখে পড়লো। পরিচিত মুখটা দেখতে পেয়ে হাসলো পত্রও। ধীর কণ্ঠে বললো,
“খেলা দেখছি।”
“তুমিও তো ওসব খেলা পারো শুনলাম। খেলবে না?”
আতসের প্রশ্নের বিপরীতে পত্র হতাশার শ্বাস ফেললো। মাথা ডানে-বামে হেলিয়ে বললো,
“নাহ্। এখন ভালো লাগে না এসব।”
“কেন লাগে না? পত্রলেখা, আমি যতটুকু বুজেছি তা হলো তুমি খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। আর তোমার সবকিছু নিয়ে ভাবনা একটু আলাদা রকম। সবার চেয়ে ভিন্ন। তোমার ভিতরে একটা নিদারুণ স্বত্তা আছে, আর আমি জানি, সেটার সৃষ্টিকর্তা তোমার অভ্রদা। যে তোমাকে একদম আলাদা একটা মানুষ তৈরী করে দিয়েছে। এতটুকু মেয়ের মাঝে ঐ অসাধারণত্বটা আমার পছন্দের। আর হ্যাঁ, এটা অবশ্যই তোমার আবেগের বয়স। তাই সব কিছু ছাপিয়ে তোমার আবেগটাই বেশি প্রাধান্য পাবে৷ কিন্তু বেশি আবেগ প্রয়োগ করতে গিয়ে নিজের ভালো-মন্দটা হারিয়ে যেতে দিও না। দিনশেষে আমরা মানুষ কেবল নিজেদের জন্য ই বেঁচে থাকি। তাই সেই নিজের সবটাকে প্রাধান্য দেওয়া হলো আমাদের আসল কাজ।”
পত্র মনযোগ দিয়ে শুনলো আতসের কথা। বেশ গম্ভীর হয়েই কথা গুলো বলেছে ছেলেটা কিন্তু মুখে সেই সবসময়ের হাসিটা রয়েই গেছে। সেই হাসিটা দেখে নিজের মাঝে কিঞ্চিৎ খারাপ লাগা ছড়িয়ে গেলো পত্রের। ভেতর ভেতর সে ভীষণ উদ্বিগ্ন হলো। চারপাশের অগোছালো ঘটনা গুলো তাকে বিরক্ত করছে। ভালো খারাপ ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিচ্ছে। কী করা উচিৎ, কী করা উচিৎ না, কী করলে ভালো হয়, এসব নানা চিন্তায় সে বিরক্ত। অথচ সমাধান নেই কিছুর।
–
বাহিরে তুমুল ঝড়বৃষ্টি। পত্র বসে আছে নিজের ঘরে। হারিকেনের মিটমিট আলোয় নিজের পড়া গুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। এই যে এতকিছু হচ্ছে তার মধ্যে পত্রের পড়া বন্ধ নেই। বড্ড পড়াশোনা পছন্দ করে কিনা। তাছাড়া পিসিও পড়াশোনা করতে বলতো সবসময়। পিসিরও পড়াশোনা পছন্দ ছিলো। বৃষ্টির চঞ্চল শব্দ ছাপিয়ে একটা গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো পাশের ঘর থেকে। পত্রের মনযোগে ব্যাঘাত ঘটলো। কপাল কুঁচকে বুঝার চেষ্টা করলো ভুল শুনেছে না ঠিক। অতঃপর আবারও একই ডাক ভেসে আসতেই পত্র উঠে দাঁড়ালো। বই গুলো গুটিয়ে রেখে সাবধানী পায়ে বোনেদের ঘরে গেলো। হালকা বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগলো তার শরীরেও।
ঘরে ঢুকতেই দেখে বড়দি বসে আছে খাটের এক কোণায়। বিকেলে রোদ থেকে আনা জামাকাপড় গুলো গুছোচ্ছে। পত্র স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“ডেকেছিলে বড়দি?”
“হ্যাঁ।”
জামাকাপড় ভাঁজ করতে করতেই পত্র জবাব দিলো। পত্র আরও দু’কদম এগিয়ে কাঠের ভাঙা, নড়বড়ে চেয়ারটাতে বসলো। ঘরের চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে বললো,
“পুষ্প কোথায়? ওরে যে দেখছি না?”
“অভ্রদা’র বাড়িতে। জেঠা মশাই অসুস্থ, জেঠিমা এবং বিন্নীরও মন মেজাজ খারাপ, ভেঙে পড়েছে উনারা, কারো তো সেখানে থাকা দরকার। পুষ্প নিজেই বললো ও থাকবে। তাই বাবা ওরে দিয়ে আসছে সেখানে। আমি অবশ্য যেতে চেয়ে ছিলাম।”
“মা রাজি হয়ে গেলো!”
পত্রের চোখ-মুখে বিস্ময়। কারণ সচারাচর তাদের মা মেয়েদের বিকেলের পর বের হওয়া পছন্দ করেন না। সবসময় সে চায় যেন তার মেয়েরা চুপচাপ, গম্ভীর ও পরিপাটি থাকে। পত্র এমনটা ছিলো না বিধায় মা রাগ বেশি করতেন। আর আজ কিনা সে মা পুষ্পকে আরেক জনের বাড়িতে থাকার অনুমতি দিলো!
পত্রের বিস্ময় হওয়ার কারণটা পদ্মও জানে। তাই সে আগের ন্যায় জামাকাপড় গুছাতে গুছাতে বললো,
“বাদ দে ওসব কথা, তোকে আমি অন্য কথা বলতে ডেকেছি।”
“কী কথা, বড়দি?”
পত্র বেশ আগ্রহের সাথে ই জিজ্ঞেস করলো। বড়দি সব জামা কাপড় গুলো আলনাতে রেখে এলেন। এর মাঝে সে একটা কথা ও বলেন নি। জামাকাপড় রেখে খাটের নিচ থেকে স্টিলের একটা বাক্স বের করলেন। সেখান থেকে আলগোছে একটা ছোটোখাটো কিছু বের করে ধরলেন পত্রের সামনে। ছোটো জিনিসটা চোখে পড়তেই পত্র খানিকটা কেঁপে উঠলো। ভয় স্রোতের বেগে তার শরীরে খেলে গেলো। কম্পনরত কণ্ঠে পত্র শুধালো,
“তুমি কোথায় পেয়েছো এটা, বড়দি?”
“যেখানে তুই গোপন করে রেখে ছিলিস, সেখানেই। তা, এটা কোথায় পেয়েছিস বললি না তো!”
পত্র নিজেকে বেশ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। এমন শীতল রাতেও সে ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। ওড়নার কোণা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বললো,
“এটা তো রথের মেলা থেকে কিনে ছিলাম। মনে নেই তোর?”
“সে তো আরও চার পাঁচ মাসেরও আগের কথা। এখনো এই আংটির রঙ যায় নি কেন? স্বর্ণের মতন চিকচিক করছে তার রঙ! ব্যাপার কী রে?”
পত্র বড়দির হাতে থাকা আংটিটা ছিনিয়ে নিতে চায়। কিন্তু পদ্ম তা করতে দেয় না বরং বেশ শক্ত হাতে আংটিটা চেপে ধরলো। বাঁকা হেসে বললো,
“স্বর্ণের আংটি তাই না? তা তোকে কে দিলো এটা? আমাদের তো নুন আনতে পানাতা ফুড়ানোর জোগাড় অথচ তোর কাছে স্বর্ণের আংটি! দিলো কে শুনি?”
পত্র মাথা নাড়ালো, গলায় আটকে গেলো কথা। শেষমেষ ধরা পড়ে গেলো।
#চলবে,,,,