বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা ২ পর্ব -০৮

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা

পর্বঃ ৮

স্রোতের বেগে চলে গেলো আষাঢ় মাস। থেকে গেলো কেমন আঁধার করা আকাশ আর মন খারাপ করে রাখা প্রকৃতি। সময়টা ঠিক দুপুরের মাঝামাঝি। পত্র আর বিন্নীর স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হওয়ায় তারা বাড়ি ফিরছে দুজনেই। দু’জনের মাঝে শুনশান নিরবতা। বিন্নীর সুন্দর হাস্যোজ্জ্বল মুখ খানায় আজকাল তেমন হাসির ছোঁয়া থাকে না। পত্রের চঞ্চলতা ভরা শরীরে চঞ্চলতারও বড্ড অভাববোধ করে সে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই জিপ গাড়ির গম্ভীর শব্দটুকু শুনতে পায় পত্র ও বিন্নী দু’জনই। পত্র অবাক চোখে সামনে তাকাতেই দেখে সুদর্শন পুরুষটি ঠোঁটে মুগ্ধ হাসি ঝুলিয়ে উপস্থিত হয়েছে এখানে। কি মনে করে পাশে তাকাতেই দেখে বিন্নীর চোখ মুখে চাপা হাসির ছোঁয়া। পত্র ভ্রু কুঁচকালো। আতসকে নামতে দেখে বিন্নীর সেই হাসি যেন বিস্তৃতি লাভ করলো। উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
“আতস!”

পত্রের কুঁচকানো ভ্রু যুগল আরও কুঁচকে গেলো, প্রায় কিছুটা বিস্মিত হয়েই বললো,
“আতস? এত বড়ো ছেলেকে তুই নাম ধরে ডাকিস?”

পত্রের প্রশ্নতেই ঘোর কেটে গেলো বিন্নীর। প্রায় সেকেন্ডের মাঝেই নিজেকে সামলে নিলো। কিঞ্চিৎ ঢোক গিলে আমতা-আমতা করে বললো,
“আতস ভাইয়া বলেছি, পাতা। তুই আজকাল কানে কম শুনিস?”

পত্র সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো বিন্নীর পানে। সে তো ভুল শুনে নি অথচ বিন্নী কী সুন্দর কথা ঘুরিয়ে ফেলছে! পত্র আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আতস এসে তাদের সামনা-সামনি দাঁড়ালো। মিষ্টি এক হাসি উপহার দিয়ে বললো,
“কী ব্যাপার বিন্নী, পত্র? বাড়ি ফিরছো বুঝি?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

বিন্নীর প্রশ্নে আবারও পত্র অবাক হলো। চোখ বড়ো বড়ো করে বিন্নীর দিকে তাকালো। অবিশ্বাস্যকর ভাব তার চোখ-মুখে। কিন্তু এবার সে তার অবিশ্বাস্য হাব ভাবটা অগোচরেই গিলে নিলো এবং স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“হ্যাঁ বাড়ি যাচ্ছি।”

“তুমি কোথায় যাচ্ছো বললে না তো?”

বিন্নীর প্রশ্নে আতস ছোটো হাসি দিয়ে উত্তর দিলো, “তোমাদের বাড়ির ওখানেই। প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়েছে তো তাই একটু ঘুরতে যাচ্ছি।”

“ওহ্।”

পত্র এর মাঝে একটা কথাও বললো না কেবল দু’জনকে সচেতন দৃষ্টিতে পরখ করে নিলো। আতস এবার পত্রের দিকে তাকিয়ে বললো,
“চলো তোমাদের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসি।”

“না। আমার বাড়ি তো এখানেই, আপনি বরং বিন্নীকে নিয়ে যান।”

পত্রের কাঠ কাঠ জবাবেও বিন্নী কিছুটা আঁচ করতে পারলো না বরং খুশি মনে সে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাকে নিয়ে যাও। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।”

“ওমা? এই প্রথম বুঝি তুই হেঁটে এসেছিস? এর আগে কী উড়োজাহাজ দিয়ে আসতিস?”

প্রত্রের বাঁকা প্রশ্নে মুখটা মলিন করে ফেললো বিন্নী। কোমল কণ্ঠে বললো,
“এমন করে খোঁচা দিচ্ছিস কেন রে পাতা? তুই না চাইলে আমি হেঁটেই যাবো।”

বিন্নীর কোমল কণ্ঠে মায়া হলো পত্রের। সে বিন্নীর বাহু জড়িয়ে ধরো হাসি মুখে বললো,
“আরে না, মজা করলাম। যা তুই উনার সাথে, আমি হেঁটেই যেতে পারবো।”

বিন্নী ঘাড় কাঁত করেই জিপে গিয়ে উঠলো। আতস সে দিকে একবার তাকিয়ে পত্রের দিকে দৃষ্টি দিলো, ক্ষীণ স্বরে বললো,
“তোমার দিদির বিয়ে নাকি? তা, আমাদের নিমন্ত্রণ দিলে না যে?”

“কাল বিকালে পুকুর পাড়ে আসবেন, কথা আছে।”

“আচ্ছা, যাই তাহলে।”

কথাটা বলেই আতস গাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেলো। পত্র আলগোছে একটা শ্বাস ফেললো। ভালোবাসলে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়, পত্র নিজেই সে কথাটার প্রমাণ। পত্রের পাশ কাটিয়ে গাড়িটা চলে গেলো, পত্র নিজেও নিজের বাড়ির পথে পা বাড়ালো। ঐ তো বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো হয়েছে বাড়ির গেইট। বিয়ে বিয়ে একটা আমেজ চা বাগানে। আর অদ্ভুত ভাবে এ কয়েকদিন চা বাগানে আর তেমন কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে নি। সব যেন মুহূর্তেই চুপ হয়ে গেছে। কিন্তু পত্র থেমে নেই, যেভাবেই হোক এই রহস্যের ঘোলাটে ভাব সে সরিয়ে ফেলবেই।

বাহিরে মানুষের একটা গমগমে ভাব, পত্র বসে আছে তার মায়ের ঘরে কারণ তার ঘর অতিথিতে পরিপূর্ণ। কাল বড়দির আশীর্বাদ। দু’দিন পরেই বিয়ের তারিখ রাখা হয়েছে। ছেলে তাদের পাশের গ্রামেরই একটা স্কুল মাস্টার। পরিবারও ভালো, তারা এক দেখাতে দিদিকে পছন্দ করেছে আর মায়ের ইচ্ছেতেই বিয়েটা খুব দ্রুতই সম্পন্ন হবে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে যখন সে সকল হিসাব মিলাতে ব্যস্ত তখন পুকুর পাড়ে চোখ যেতেই সে চমকে উঠলো। আতস দাঁড়িয়ে আছে সাদা শার্ট পড়নে। হুট করেই তার মনে পড়লো আজ আতসের সাথে দেখা করার কথা ছিলো তার আর সে বেমালুম ভুলে বসে আছে!

শরীরের ওড়নাটা আরও ভালো ভাবে জড়িয়ে পত্র বাহিরে বেরিয়ে গেলো। উঠোন জুড়ে হাসি-ঠাট্টার ঢেউ। পুষ্প রান্নাঘরের দরজায় বসে রান্নার জন্য মসলা বাটছে। আজকাল মেয়েটা একদম পরিবর্তন হয়ে গেছে। কোনো হৈচৈ নেই তার ভেতর, ঝামেলা ঝঞ্জাটও করে না আগের মতন। একদম ভিন্ন এক পুষ্পের আবির্ভাব।

পত্র উঠোন পেরুনোর আগেই উঠোনে হাজির হলো একদল অপরিচিত লোকজন। চোখে-মুখে কাঠিন্যতা। পত্র সহ বাড়ির সকলে অবাক হলো। ছায়া রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে বুঝার চেষ্টা করলেন উঠোনে কারা। লোক গুলোর মাঝে একজন গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“সমির বাবু কোথায়? উনাকে ডাক দেন।”

ছায়া রান্নাঘর থেকে উঠে এলেন। মাথায় আঁচল দিয়ে বেশ বড়সড় ঘোমটা টেনে বললেন,
“উনাকে কী দরকার?”

“আপনি কে?”

“আমি উনার স্ত্রী।”

“আপনার স্বামীকে ডাকুন। তাকে বলা হয়েছিল এ বাড়ি ছাড়তে। বারবার চা বাগানের কমিটি থেকে নোটিশও পাঠানো হয়েছে, অথচ সে বাড়ি না ছেড়ে এখানে উৎসব শুরু করে দিয়েছেন! ডাকুন তাকে।”

ছায়া অবাক হলেন, অবাক কণ্ঠে বললেন,
“বাড়ি ছাড়তে হবে মানে? কে ছাড়বে বাড়ি? আমাদের বাড়ি এটা।”

“আপনারা ছাড়বেন বাড়ি।”

ছায়া মুহূর্তেই রেগে গেলেন। আঙ্গুল উঁচিয়ে বললেন,
“আপনারা বেরিয়ে যাবেন। যান বেরিয়ে, যান বলছি। কতো বড়ো সাহস আপনাদের! আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকে বলছেন বেরিয়ে যেতে! এত সাহস?”

ছায়ার রণমুর্তি দেখে ক্ষাণিক ভ্যাবাচেকা খেলো ছেলে গুলো। পঁয়ত্রিশের রমণীর এমন তেজ মোটেও কাম্য নয়। যেখানে মেয়েরা পুরুষদের আড়ালেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সেখানে কি-না এমন তেজ?

ছেলেদের মাঝে একজন এগিয়ে এলেন, ছায়ার কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,
“আপনি সরুন সামনে থেকে, নাহয় আমরা হাত তুলতে বাধ্য হবো৷”

কথাটা শেষ করার সাথে সাথে তৎক্ষনাৎ চ/ড় পড়লো উক্ত কথা বলা লোকটার গালে। লোক গুলোর সাথে সাথে সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ছায়া তখন রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। রান্নাঘর থেকে চেলাকাঠ তুলে এনে লোক গুলোর সামনে দাঁড়ালো। শাসানোর ভঙ্গিতে বললো,
“এক্ষুণি উঠোন ছাড়বি তোরা আর নাহয় পৃথিবী। কোনটা চাস বল?”

ছায়ার আকস্মিক আচরণে লোকগুলো প্রায় ভীত হলো। থতমত খেয়ে তারা দ্রুত প্রস্থান নিলো। বাড়ির উপস্থিত মানুষজন বিস্মিত হয়ে সবটা দেখলো। ছায়া রেগে যায়, মাঝে মাঝে চিৎকার চেঁচামেচিও করেন কিন্তু সবটাই বাড়ির মানুষের সাথে। বাহিরের মানুষ তো ছায়ার চেহারাই দেখতে পান না আবার চিৎকার শুনবে তো দূরের কথা।

সবাইকে থম মেরে আগের ন্যায় নিজ জায়গায় অবস্থান করে থাকতে দেখে নিজেকে স্বাভাবিক করলো ছায়া। খানিকটা কেঁশে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
“যে যা করছো, করো। ভালোই ভালোই আমার মেয়ের বিয়েটা মিটে যাবে কেউ চিন্তা করো না। যে যার যার কাজ করো।”

ছায়ার একটা কথাতেই সবাই স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। নিজেদের হাসি তামাশায় আবার মনযোগ দিলো। পত্র কতক্ষণ নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। সবটা স্বাভাবিক হতেই তার মাথায় খেলে গেলো অন্য এক ভাবনা। লোকগুলো কে কারা পাঠিয়েছে? প্রজেক্টের কাজের জন্য ই তো এই জমিটা প্রয়োজন, তবে আতসেরা পাঠিয়েছে! চমকে গেলো পত্র। তার পিঠ পিছে আতস অন্যকিছু করছে। অন্যরকম কিছু!

#চলবে

[গত দুই পর্বে হয়তো উত্তেজনা থিতিয়ে গেছে কিন্তু ভয়ঙ্কর কিছু আসতে চলেছে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here