বৃষ্টি শেষে রোদ পর্ব -২১ ও শেষ

#বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ২১)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

লেখাটা কয়েকবার পড়ে স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে আরশি। এক মুহুর্তের জন্য ঘটে যাওয়া সব কিছুকেই একটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে। নাকি কোনো দুঃস্বপ্ন? কাঁপা হাত থেকে পড়ে গেলো চিরেকুট। তাড়াহুড়ো করে সেটা তুলে নিয়ে হাতের মাঝে মুষ্টিবদ্ধ করে চেপে ধরলো।

‘শত অপেক্ষার পর অবশেষে নিজের করে পেতে চলেছি তোমায়।’ এই লাইনটার মানে কি? কয়েক সেকেন্ড ভাবলো আরশি। তার মানে যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে সে ঐ অগন্তুক? মা’ও তো সেদিন বলেছিল বিয়ে ঠিক হওয়া মানুষটা আমাকে আগে থেকেই চেনে। তাহলে কে এই লোক? কি হচ্ছে এসব? মাথা ভার হয়ে আসছে তার। লোকটা ছাদে দাড়িয়ে আছে তার অপেক্ষায়। তার কি যাওয়া উচিৎ? এই সন্ধা বেলায়,,, না সন্ধা বললে ভুল হবে। সন্ধা পেড়িয়ে রাত হয়ে এসেছে। এই রাত্রিকালিন কোনো অপরিচিত মানুষের ডাকে ছাঁদে যাওয়াটা কি আদৌ ঠিক হবে?

একটা শ্বাস নিল সে। তার ভাবনা মতে এই জীবনের কোনো মূল্য নেই এখন। এই মূল্যহীন জীবন নিয়েই বা এত ভাবার কি আছে? কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাড়িয়ে থেকে অতঃপর ওড়নাটা মাথায় টেনে হাটা চুপচাপ সিড়ির রুমে এসে দাড়ালো। অস্থিরতায় এক এক করে সব সিড়ি পেড়িয়ে পৌছে গেলো ছাদের কিনারায়। সিড়ির ঘরের দরজা পার হলেই খোলা ছাঁদ। মানে ঐ মানুষটা। হটাৎ যেন বুকটায় ধুকপুক করতে শুরু হলো। উত্তেজনায় অন্য কোনো কিছুর প্রতি মনযোগ নেই তার। আবারও চোখ বুঁজে পূনরা নিজেকে স্বাভাবিক করে নেওয়ার চেষ্টা করতেই ছাদের এক পাশ থেকে গিটারের শব্দ কানে এলো তার।

এবার যেন হার্ট’টা প্রচন্ড রকমে বিট হতে শুরু করলো। কিছু সময়ের জন্য মনে মনে বারংবার দোয়া করতে লাগলো, সে এই মুহুর্তে যেটা ভাবছে সেটাই যেন সত্যি হয়। গিটার গান এটাতো তার খুব পরিচিত প্রিয় একটা মানুষের শখ।
ছাঁদে দাড়াতেই সমস্ত শরির যেন জমে গেলো তার। এক মুহুর্তের জন্য যেন মনে হচ্ছে এটা শুধুই একটা দৃষ্টিভ্রম। নয়তো বাস্তবে এটা কিভাবে সম্ভব? হয় দৃষ্টিভ্রম নয়তো স্বপ্ন। এক দৃষ্টিতে সামনে ছাদের কর্নিশে বসে থাকার মতো করে গিটার হাতে গান গাওয়া রিদের দিকে চেয়ে আছে সে।

‘এই সন্ধায় দু’চোখ সাগরে,
বুকের পাঁজরে ভেসে যায়।
অবাক জোছনায় লুকিয়ে রেখেছি,
ভেজা চোখ দেখাইনি তোমায়।
এই অবেলায় তোমারই আকাশে,
নীরব আপসে ভেসে যায়।
সেই ভীষণ শীতল ভেজা চোখ,
কখনো দেখাইনি তোমায়।’

এতটুকু গেয়েই থেমে গেলো রিদ। শেষ দুই লাইন আরশির দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে গেয়েছিল। সত্যিই তো, দুর দেশে প্রিয় মানুষটার জন্য লুকিয়ে কাঁন্নার সেই অঝড় অশ্রু কখনো দেখানো হয়নি তাকে। সব কান্না সব দুঃখ নিজের মাঝেই লালন করেছিল নীরবে নিভৃতে।

নিশ্চুপ হয়ে কয়েক পা এগিয়ে রিদের পাশে গিয়ে দাড়ালো আরশি। রিদের মুখপানে বিষণ্নতায় ঘেরা স্থির দৃষ্টি রেখে বলে,
“এটা কি সত্যিই আপনি? কোনো ভুল হচ্ছে না তো আমার? নাকি কোনো স্বপ্ন এটা? যা একটু পরই ভেঙে যাবে?”

এতটুকু বলে কাঁপা হাত বাড়িয়ে রিদের গাল ছুয়ে দেখলো এটা সত্য নাকি তার কল্পনা। কিছু বললো না রিদ। ক্ষনিকটা মৃদু হেসে তাকালো আরশির দিকে। এবার যেন আর এক মুহুর্তও দেড়ি না করে রিদকে ঝাপটে ধরে হুহু করে কেঁদে দিল আরশি। যেন তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওয়াটা এখানেই। কিভাবে হয়েছে, কিভাবে চিরেকুটের এতকিছু ঘটেছে কিছুই বুঝতে পারছে না। এই মুহুর্তে বোঝার ইচ্ছেও নেই। শুধু এতটুকুই বুঝতে পারছে প্রিয় মানুষটার বুকে মুখ লুকিয়ে অশ্রুকনায় সব বিষাদ ধুয়েমুছে শেষ করে দিচ্ছে সে। প্রাপ্তির কাঁন্না এটা। এক মুহুর্তের জন্য মনে হচ্ছে তার জীবনের সব সুখ এই মুহুর্তটাকেই আটকে ছিল। যেটা ছিল তার জীবনে পাওয়া সবচাইতে বড়ো সারপ্রাইজ।

আরশিকে দু’হাতে আবদ্ধ করে কপালে চুমু এঁকে দিল রিদ। আরশি ছিল ছোট কোমল হৃদয়ের বাচ্চাসূলভ একটা মেয়ে। সবে তখন আবেগের বয়সে পা রেখেছিল। অথচ সেই পিচ্চিটাকে ঘিরেই প্রেমময় অনুভুতি গুলো যেন রঙিন প্রজাপতির ন্যায় ডানা মেলে উড়ে বেড়াতো। আবেগ কে প্রশ্রয় দিয়ে ভুল করতে চয়নি রিদ। কারণ এই পিচ্চিটাকে শুধু তারই মনে হতো। হারানোর প্রশ্নই উঠে না। যেন হারালে মরেই যাবে সে।

তাই প্রকাশ্যে না বললেও অনুভূতি গুলো চিরেকুট আকারে পৌছে দিত প্রিয় মানুষটার কাছে। সরাসরি কখনো আরশিকে ভালোবাসি শব্দটা রিদ একবারের জন্যও বলেনি। কারণ তার মতে ভালোবাসা এতটা সস্তা না, যে যখন তখন তা বললেই ভালোবাসার প্রকাশ হবে। এটা খুবই মুল্যবান একটা শব্দ। আর এই মহা মুল্যবান শব্দটা তখনই বলবে যখন পিচ্চিটা বড়ো হয়ে ভালোবাসার মানে বুঝতে শিখবে।

রিদ যাওয়ার আগে কয়েক রাত জেগে প্রায় দুইশত চিরেকুট লিখে রোহানকে দিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল প্রতি সাপ্তাহে একটা করে আরশির বারান্দায় পৌছে দিতে। তবে আরশি যেন কোনো ভাবেই টের না পায়। রোহান প্রথম এমন পাগলামি দেখে হাসলেও অতঃপর রিদের কথায় রাজি হলো।
একদিন আরশির কাছে ধরা পড়তে পড়তে অল্পের জন্য বেচে গিয়েছিল। যদিও সেদিন আরশি সন্দেহও করেছিল তাকে। কোনো ভাবে সেদিন বেচেছিল।

অনেকটা সময় কেটে গেলো। রাত হলো অনেকটা। রিদের বুকে মাথা রেখে বসে আছে আরশি। শান্ত গলায় বলে,
“আমার উপর কি এখন আর একটুও অভিমান নেই আপনার? এখনো আমাকে ঘৃণা করেন তাই না?”
রিদ তার চুলে বিলি কেটে দিয়ে বলে,
“আমি কখনোই তোকে ঘৃণা করতে পারিনি।”
“তাহলে এতটা কষ্ট দিয়েছেন কেন?”
“যাতে তুই নিজেকে বুঝতে পারিস।”
আরশি এবার মুখ তুলে রিদের চোখে দৃষ্টি রেখে বলে,
“আমি ভেবেছিলাম, ভুল বুঝে আপনি মন থেকেই মুছে ফেলেছেন আমায়।”

ক্ষনিকটা মুচকি হাসলো রিদ। অতঃপর স্বাভাবিক গলায় বলে,
“কারণ না খুঁজে ভুল বুঝে দুরে সরিয়ে দেওয়ার জন্যই কি ভালোবেসেছিলাম? যদিও কষ্ট দিয়েছিস খুব। কিন্তু ভালোবাসলে সেক্রিফাইজ করতেও শিখতে হয়।”
আরশি মুখ লুকালো রিদের বুকে। লাজুক স্বরে বলে,
“এবার ভালোবাসায় সব কষ্ট মুছে দিব আপনার। তখন হৃদয় জুড়ে শুধু ভালোবাসাই অনুভব করবেন।”
,,

ঘরে প্রবেশ করে আরো অবাক হয় আরশি। রিদের মা, রুমকি, রোহান ভাইয়াও উপস্থিত সেখানে। এরা কখন এলো? ছাঁদে যাওয়ার সময় তো এরা কেউই ছিল না ঘরে। ভাবতে ভাবতেই মামির সাথে কথা বলে রুমকির পাশে গিয়ে দাড়ালো সে। রোহানের দিকে কিছুটা রাগম্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে বিড়বিড় করে বলে,
“খবর আছে আপনার।”

আরশির কথায় কিছুটা হাসলো রোহান। পাশ থেকে রুমকি হাত ধরে আরশিকে নিয়ে চলে গেলো ভেতরের রুমে। ক্ষনিকটা ভ্রু নাচিয়ে বলে,
“ভাইয়ার সাথে সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে, তাই না ভাবি?”
“তার মানে তুইও জানতি সব।”
“না, সত্যি আমি কিছুই জানতাম না। তবে রোহান বললো সে সব জানতো।”
“রোহান ভাইয়া কি তোর ছোট? নাম ধরে বলছিস কেন, বেদ্দপ?”
রুমকি ক্ষনিকটা ইতস্তত বোধ করে বলে,
“মানে রোহান ভাই।”
বলেই পিটপিট করে তাকালো আরশির দিকে। কিছু বললো না আরশি। হয়তো সন্দেহটা গাড়ো হচ্ছে একটু একটু।

“””””””””””””””””””””””””””””””””

সকাল সকাল একটু হাটাহাটি করতে ছাদের দিকে পা বাড়ালো রিদ। নিচে নাস্তা রেডি করছে ফুপি ও মা মিলে। ছাঁদে পৌছে ঘুম ভাঙার ক্লান্তিতে দু’দিকে হাত মেলে ক্ষনিকটা ক্লান্তি কাটাতেই বাম দিকে দৃষ্টি পড়ে তার। অবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল সেদিকে।

ছাদে গোলাপ জবা সহ কয়েক রকমের ফুল গাছ লাগানো আছে। এটা অবাক হওয়ার মতো কিছু না। প্রায় সব জায়গায়ই ছাদের সোন্দর্য বাড়াতে এমনটা লাগানো হয়। রিদের চরম অবাক হওয়ার কারণটা হলো রোহান ও রুমকি। এই সাজ সকালে ছাদের এক পাশে থাকা জবা গাছটার নিচে দাড়িয়ে রুমকির চুলে লাল টকটকে একটা জবা গুঁজে দিল রোহান। আরেকটা ফুল ছিড়তেই রিদকে চোখে পড়ে তার। ফুল টা আচমকাই পরে গেলো হাত থেকে। এক মুহুর্তের জন্য যেন আজ তার বন্ধুর মতো ভাই রিদের দিকে তাকাতেই বুকটা কেঁপে উঠলো তার।

রিদ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দুজনের দিকে। চোখ বুঁজে নিল রুমকি। হয়তো ভয়ে, নয়তো লজ্জায়। কারণ প্রেম করতে গিয়ে ভাইয়ের হাতে ধরা পরার অনুভূতি টা এই মুহুর্তে বলে বোঝানোর মতো না।

To be continue………………#বৃষ্টি_শেষে_রোদ (অন্তিম পর্ব)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

রিদ অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে দুজনের দিকে। যে দৃষ্টি লক্ষ করেই ভয়ে অনেকটাই চুপশে গেলো রুমকি। রিদ কয়েক কদম ফেলে তাদের সামনে এগিয়ে গেলো। চেহারায় অনেকটাই রাগী ভাব রেখে বলে,
“কি এসব?”
রুমকি চুপ করে রইল। এমন পরিস্থিতিতে পড়ে অনেকটা নার্ভাস হয়ে গেলো রোহানও। দুজনকেই চুপ থাকতে দেখে রিদ এবার ধমকের স্বরে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,
“জিজ্ঞেস করছি কি হচ্ছে এখানে?”

ধমকে ক্ষনিকটা কেঁপে উঠলো রুমকি। কিছু বলতে চাইলেও রিদের পূনরায় ধমকে চুপ হয়ে গেলো সে। পাশ থেকে রোহান নার্ভাস দৃষ্টিতে থামা থামা স্বরে বলে,
“ভাই, রুমকিকে বকিস না প্লিজ। ওর কোনো দোষ নেই। আমিই,,,,”
এতটুকু বলতেই রিদ তাকে থামিয়ে বলে,
“আমাদের ভাই বোনের মাঝে তোকে কথা বলতে বলেছি আমি? আর তোর সাহস হয় কি করে রুমকির দিকে চোখ তুলে তাকানোর?”

চুপ হয়ে গেলো রোহান। ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে রুমকিও। সব সময় ফটরফটর করলেও সিরিয়াস সময়ে বিড়ালের রুপ ধরণ করতে যেন এক মুহুর্তও সময় লাগে না তার।

দুজনকেই মন খারাপ করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে এবার রিদ কিছুটা মুচকি হেসে বলে,
“হেল্প লাগবে?”
দুজনই এক সাথে মাথা তুলে অবাক দৃষ্টিতে তাকায় রিদের দিকে। যেন মুহুর্তেই রিদের গিরগিটির মতো রুপ পাল্টানো দেখে বিষ্মিত হয়েছে তারা। রিদ এখনো হাসি ধরে রেখে রোহানের দিকে চেয়ে বলে,
“তোকে আমার ভালো করেই চেনা আছে। মুখ ফুটে তো কখনোই কাউকে বলতে পারবি না। হেল্প লাগলে বলতে পারিস।”

আচমকাই রোহান কয়েক পা এগিয়ে রিদকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“বুকে আয় ভাই। তোর স্থান এই বুকে। মনের কথা টেনে বের করে নিলি।”
রিদ জোড়ে চেপে ধরতেই রোহান আর্তনাৎ করে পূনরায় বলে,
“ওমা ভাই, ভেঙে গেলো সব।”
রিদ তার কানে ফিসফিস করে বলে,
“আমার বোন কখনো কষ্ট পেলে তোর এই ‘ওমা’ টা সোজা ইন্না-লিল্লায় রুপ নেবে, মনে রাখিস।”

“””””””””””””””””””””””””””””””””””

আজকের সন্ধাটা যেন অন্যরকম। বিয়ের সাজে নিজ ঘরে বসে আছে আরশি। মেহেদী রাঙা হাত গুলোর দিকে তাকিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নিচু করা। আশেপাশে আরিশা আপু সহ আরো কয়েকজন মেয়ে। অনেক্ষণ ধরে তাকে সাজাতে ব্যস্ত ছির তারা।
প্রশান্তি ও উত্তেজনায় বুকটা ধুকপুক করছে আরশির। বছরের পর বছর অপেক্ষার পর এই অবশেষে এই দিনটা এসেছে জীবনে। প্রিয় মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার দিন। ভাবতেই শীতল শিহরণ বয়ে গেলো সারা গায়ে।

নানান ফুলে সাজানো রিদের গাড়ি ছুটে চলছে প্রেয়সিকে সারাজীবনের জন্য নিজের ঘরে তুলে আনতে। আনমনে বাইরের দিকে চেয়ে আছে রিদ। যেন এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি।
কিন্তু এই অনুভূতি নষ্ট করল রোহান। আচমকাই গাড়ি ব্রেক চাপায় রিদ ক্ষনিকটা অবাক হয়ে বলে,
“কি হলো আবার!”
রোহান চোখ-মুখ কুঁচকে কনে আঙুলটা দেখিয়ে বলে,
“ভাই, নিম্নচাপ।”
রিদ কিছুটা বিরক্তিকর চাহুনিতে বলে,
“আর অল্প পথ। চেপে রাখ।”
“সম্ভব না ভাই, অবস্থা খুব সিরিয়াস। এক মিনিট ওয়েট কর আসছি আমি। শুনিস নি, ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ।”
রিদ একটা শ্বাস নিয়ে বলে,
“ওকে, তাড়াতাড়ি কর।”
পাশ থেকে রুহি আপু মজা করে রিদের দিকে চেয়ে বলে,
“রিলাক্স রিদ সাহেব। এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আরশি পালিয়ে যাচ্ছে না কোথাও। বৌকে দেখতে পাবে। এত অধৈর্য হইও না। সবুর করো।”

অতঃপর হেসে দিল সে। তার সাথে হাসলো রুমকিও। রিদকে উদ্দেশ্য করে রুহির দিকে চেয়ে বলে,
“না জানি বৌ সাজে আমার একমাত্র ভাবিটাকে আজ কত কিউট লাগছে। ওফ আর কতক্ষণ লাগবে পৌছাতে। কখন দেখবো লাল টুকটুকে ভাবিকে।”

রিদকে হিট লাগানোর জন্যই বললো কথাটা। মনে হয় কাজে দিয়েছে। রিদ দুজনের দিকে চেয়ে বলে,
“মজা নেওয়ার শাস্তিস্বরূপ আগামী পাঁচ বছরেও বাড়িতে আর কোনো বিয়ের আয়োজন হবে না।”
এবার ক্ষনিকটা চুপসে গেলো রুমকি। ঠোঁট ফুলিয়ে ভাইয়ের দিকে চেয়ে বলে, স্যারি। কারণ রিদের বিয়ে পরই রুমকি আর রোহানের বিয়ে কথা পরিবারকে জানিয়ে রাজি করাবে বলেছিল রিদ।
,,

‘বর এসেছে’ এমন কিছু শুনে কেঁপে উঠে আরশি। তারা তাহলে চলে এসেছে। আজ খুশি হওয়ার দিনে এতটা নার্ভাস লাগছে কেন? এখনই সবাই রওনা হবে কমিউনিটি সেন্টার এর উদ্দেশ্য। যেখানে যাওয়ার আগেই আরশিদের বাড়ি পরে। তাই যাওয়ার পথেই আরশিকে রিদের সাথে নিয়ে যাবে সেখানে। আর বাকিরা আগেই পৌছে গেছে হয়তো। আজকের দিনে দুজন মানুষকে ঘিরে এত সব আয়োজন। ভাবতেই কেমন যেন সেলিব্রিটি মনে হচ্ছে নিজেকে।

দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকায় আরশি। মুহুর্তেই যেন দ্বিগুণ খুশিতে বুকটা ভরে যায় তার। তার জন্মের পর তার দুই মামাকে এই প্রথমবার তাদের বাড়িতে আসতে দেখেছে সে। এর আগে অনেক চেষ্টা করেও আনতে পারেনি তাদের। আরশি সব সময় মাকে কারণ জিজ্ঞেস করলেও চুপ থাকতো মা। অথচ আজ সব বিবাদ ভুলে প্রথমবার তাদের বাড়িতে। মাকে কাছে টেনে মাথায় মমতাময়ী হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাসি-মুখে কথা বলছে তারা। আজকের এই বিয়ে শুধু তাদের দুজনের মিল হচ্ছে না। দুটো পরিবারেরও মিল হচ্ছে এই বিয়ের মাধ্যমে। এর চাইতে খুশির দিন আর কি হতে পারে?

“”””””””””””””””””””””””””””””””””

কেটে গেলো অনেক দিন। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। কিছুক্ষণ আগে একটা গল্পের বই শেষ করে এখন খাটে হেলান দিয়ে বিষণ্ন মনে বসে আছে আরশি। কারণ গল্পের শেষটায় পূর্ণতা ছিল না। অপূর্ণতায় ঘেরা একটা বিষাদের গল্প ছিল এটা। ইশ তাদের মিল হলে কি এমন ক্ষতি হতো?

ভাবতেই পুরোনো স্মৃতি গুলো জেগে উঠে মনে। তার জীবনও কি কম নাটকিয়তার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল? বন্ধু বান্ধবদের বলা প্রেমিকের পুতুল বলে হাসি-ঠাট্টা, ফারুক নামক সেই সুবিধাবাদীর পাল্লায় পরে প্রিয় মানুষটাকে কতই না কষ্ট দিয়েছিল সে। তবুও হাজারও কষ্ট সহ্য করে সেই প্রিয় মানুষটাই পরম যত্নে আগলে নিয়েছে বুকে। অথচ সেই হাসি-ঠাট্টা করা বন্ধু বা সম্পর্কের তৃতীয় ব্যাক্তি কেউই এখন তেমন একটা খোঁজ রাখে না। রাখবেই বা কেন? ঐ সম্পর্ক গুলো যে ছিল ক্ষনিকের। দিন শেষে ঐ মানুষগুলো না, প্রিয় মানুষটাই সারা জীবন ছায়া হয়ে পাশে থাকে। অথচ আমরা তাদের পাল্লায় পরে অজান্তেই প্রিয় মানুষ গুলোকে কতই না কষ্ট দিয়ে থাকি।

রিদকে রুমে প্রবেশ করতে দেখেই ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে আশে আরশি। খাট থেকে নেমে হাসিমুখে তার সামনে গিয়ে দাড়ালো। প্রেয়সির মিষ্টি হাসিমাখা মুখ সামনে আসতেই যেন সব ক্লান্টি দুর হয়ে গেলো রিদের। মৃদু হেসে আরশিকে বুকে জড়িয়ে কপালে আলতো করে চুমু এঁকে দিয়ে বলে,
“আমি মানুষকে অনেক রোগের ঔষধ লিখে দিই। কিন্তু আমার সব ক্লান্তি নিমেশেই দুর করার মহা ঔষধটার নাম, তুমি। আমার পরীর মত প্রেয়সি। আমার একমাত্র ভালোবাসা।”
,,

রাত হতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। খাটের এক পাশে ল্যাপটপ হাতে বসে আছে রিদ। আরশি মোবাইলে ঘরির দিকে এক পলক চেয়ে দেখে রাত তখন প্রায় বারোটা। ঘুম কাতুর চোখে রিূের দিকে চেয়ে অস্পষ্ট গলায় বলে,
“কয়টা বাজে এখন?”
রিদ তার দিকে চেয়ে বলে,
“ঘুমাওনি এখনো?”
“ল্যাপটপ রাখেন, ঘুমাবো আমি।”
“তো ঘুমাও। ল্যাপটপের সাথে ঘুমের সম্পর্ক কি?”
“রাখতে বলেছি আমি।”
“আর একটু কাজ বাকি আছে।”

আর কিছু বললো না আরশি। অভিমানী মনে অন্য দিকে ফিরে শুয়ে থাকে চুপচাপ। রিদ আড়চোখে তাকালো সেদিকে। ক্ষনিকটা মৃদু হেসে ল্যাপটপ টা অফ করে রেখে দিল সে। আরশির পাশে শুয়ে পেছন থেকে এক হাতে জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল তাকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“এত অভিমানী কেন, হুম?”
কিছু বললো না আরশি। শুধু ক্ষনিকের অভিমান একটা মুচকি হাসিতে হাওয়ায় মিলিয়ে দিল। এভাবে বললে কি অভিমান ধরে রাখা যায়?

“”””””””””””””””””””””””””””””””””

মাঝ রাতে চিৎকার করে জেগে উঠে আরশি। সাথে জেগে যায় রিদও। চোখ কচলে তাকিয়ে দেখে ভয়ার্ত চেহারায় পরপর শ্বাস নিচ্ছে আরশি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। রিদ খাট থেকে নেমে এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে হাতে দিল তার। আরশি একটানে পুরো গ্লাস শেষ করে নিলেও অস্থিরতা কমছেনা কিছুতেই। রিদ পরম যত্নে নিজের বুকে মিশিয়ে নেয় তাকে। অভয় দিয়ে বলে,
“কিছু হয়নি। হয়তো দুঃস্বপ্ন ছিল ওটা। এই তো আমি। ভয় কিসের, হুম?”

কিছুক্ষণ ওভাবে থেকে নিজেকে ক্ষনিকটা স্বাভাবিক করে নেয় আরশি। রিদের বুকে মাথা রাখা অবস্থায় বলে,
“খুব ভয়ঙ্কর একটা স্বপ্ন ছিল এটা। তবে দুঃসপ্ন না। কারণ স্বপ্নে আমি আমাদের ছেলেকে দেখেছিলাম।”

ক্ষনিকটা কপাল কুঁচকালো রিদ। কি বলে এই পা’গল মেয়ে। বিয়ে হয়েছে সবে ক’দিন হলো। একনো কোনো সু-সংবাদও পায়নি, এর মাঝে ছেলে আসলো কই থেকে?
আরশি পূনরায় বলে,
“দেখলাম ভয়ঙ্কর কিছু মানুষ আমাদের দিকে তেড়ে আসছে। আপনি ঠিক এভাবেই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন যেন আমার কোনো ক্ষতি না হয়। তবুও আমি ভয় পাচ্ছিলাম খুব। কারণ ভয়ঙ্কর মানুষ গুলো আক্রমনাত্বক ভাবে তেড়ে আসছিল। মনে হয় আমাদের জীবনটা বোধহয় এখানেই সমাপ্তি হতে চলেছে। ঠিক তখনই আমাদের ছেলে রুশান সামনে এসে এক এক করে মে’রে ফেলে তাদের সবাইকে। র’ক্তে রঞ্জিত হয়ে গিয়েছিল মাটি।”

এতটুক বলতেই রিদ ক্ষনিকটা ভ্রু-কুচকে বলে,
“রুশান!”
“হুম, আমি ঠিক করে রেখেছি নামটা। রিদ ও আরশি দুটো নাম মিলিয়ে রুশান। সুন্দর না নামটা?”
রিদ তার ভয় দুর করার জন্য তাল মিলিয়ে বলে,
“হুম, খুব সুন্দর।”
আরশি কিছুটা কৌতুহল নিয়ে বলে,
“আচ্ছা, শুনেছি আপনার দাদা ছিল পলিটিক্যাল লিডার। তিনি চেয়েছিল আপনার বাবাও বড়ো হয়ে পলিটিক্স করবে। কিন্তু বাবা হলেন বিজনেসম্যান। আর শুনেছি বাবাও চেয়েছিলেন আপনি তার মতোই বিজনেসম্যান হবেন। কিন্তু আপনি হলেন ডাক্তার। আচ্ছা আমাদের রুশান হলে সে কি হবে?”

রিদ একটু ভাব নিয়ে বলে,
“অবশ্যই আমার ছেলে আমার মতোই ডাক্তার হবে।”
আরশি দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,
“জ্বি, না।”
“তাহলে কি হবে?”
“আমি জানি কি হবে।”
“কি?”
আরশি কিছুক্ষণ চিন্তিত ভঙ্গিতে চুপ থেকে অতঃপর হেসে দিয়ে বলে,
“বলবো না। হিহিহি।”

হেসে দিল রিদও। অতঃপর বলে,
“আচ্ছা পরে দেখা যাবে। এখন আসো ঘুমিয়ে পরো।”
রিদের সাথে আরশিও শুয়ে পড়লো চুপচাপ। রিদের বুকে মাথা রেখে চোখ বুঁজে নিল সে। তাকে দু’হাতে আগলে ধরে রেখেছে রিদ। যেন আবারও ভয় না পায়। কপালে চুমু এঁকে দিয়ে নিজের মাঝে বিড়বিড় করে বলে,
“আমার পরীর মতো প্রেয়শি। তোমার সাথে তোমার এই বাচ্চামো গুলোও বড্ড ভালোবাসি আমি। তুমি আমার বৃষ্টি শেষে উঁকি দেওয়া সেই সোনালি রোদের মতোই ফিরে পাওয়া এক আস্ত ভালোবাসার উপমা।”

~ সমাপ্ত।

বিঃদ্রঃ ১- ফারুকের কোনো শাস্তি হয়নি কেন? আমাদের চারপাশে ফারুকের মতো এমন অনেক তৃতীয় ব্যাক্তি থাকে। যাদের জন্য প্রিয় মানুষটাকেও অজান্তেই কষ্ট দিয়ে ফেলে অনেকে। কিন্তু দিন শেষে কষ্ট পেতে হয় তাদের দুজনকেই। সম্পর্কের তৃতীয় ব্যাক্তিটা কিন্তু ঠিকই ভালো থাকে। ফারুক চরিত্রটা দিয়ে এটাই বোঝালাম, কখনো কোনো তৃতীয় ব্যাক্তির জন্য প্রিয় মানুষটাকে কষ্ট দেওয়া উচিৎ না। কারণ তৃতীয় ব্যাক্তিগুলো জীবনে আসে ক্ষনিকের জন্য। আবার হারিয়েও যায়। তবে শেষ অব্দি আপনার পাশে কখনোই থাকবে না। আজকাল অনেক ভালোবাসায় বিচ্ছেদের গল্প আসে এই একটা কারণেই।

বিঃদ্রঃ ২- গল্প শেষে রুশানের নাম আসছে মানে আমার কিছু পাঠক/পাঠিকা ঠিকই অনুমান করতে পারছেন, পরবর্তি কোন গল্পের ইঙ্গিত দিচ্ছি আমি। শিগ্রই নতুন করে কোনো ধামাকা আসতে চলছে। শুধু অপেক্ষা করুন কয়েক দিন। পরিশেষে বলবো, ভালোবাসা নিবেন সকলে। আর গল্প সম্পর্কে মতামত জানাতে ভুলবেন না।❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here