#বেদনার_রঙ_নীল
তেইশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz
রিসব বারান্দায় দাঁড়িয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। কফির সুগন্ধের চেয়েও প্রখর তার ঘাড় অবধি চুলের শ্যাম্পুর সুগন্ধ! রাইফা বিমোহিত! ছেলেদের শ্যাম্পুর ঘ্রাণও বুঝি এতো সুন্দর হয়? এখন থেকে সে বয়েজ শ্যাম্পু ব্যবহার করবে। তাহলে মনে হবে রিসব সারাক্ষণ আশেপাশে আছে। আহারে, মানুষটি কারণে-অকারণে দূরে চলে যায়। আজ সে চোখ ভরে তাকে দেখে নিচ্ছে। কতদিন পর দেখা! রাইফা কত অস্থির হয়ে অপেক্ষায় ছিল। অথচ মানুষটি জানেও না।
গতরাতে যখন রাইফা এখানে এসেছিল তখন শান রিসবের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে দেখে খুশি আর বিস্ময়ে রাইফার হিঁচকি উঠে যাওয়ার উপক্রম। রিসব ফিসফিস করে কথা বলছিল। যাতে শানের ঘুম না ভাঙে। সেই কথা শোনার জন্য রাইফাকে তার কাছাকাছি যেতে হচ্ছিল। কি ভালো-লাগার মুহূর্ত ছিল! রিসব হাসপাতালে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মিষ্টি তাকে যেতে নিষেধ করল। সকালে সবাইকে নিয়ে আসতে বলেছিল। রিসবও খুব ক্লান্ত ছিল। সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর রাইফা তার পাশেই জেগে বসেছিল। ঘুমন্ত রিসবের মাথায় খুব সাবধানে হাত বুলিয়েছিল। সেই কথাও রিসব জানে না।
রাইফা এখন লুকিয়ে আছে জানালার আড়ালে। রিসব যদি ভুলবশতও এদিকে তাকায়, তাহলেই রাইফা সরে যাবে ফট করে।
রিসবের গালভরা উসকোখুসকো দাড়ি। চুল উড়ছে বাতাসে। তার উজ্জ্বল গায়ের রঙ অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। তবে শরীরের খুব উন্নতি হয়েছে। মাসল বেড়ে ভয়ানক অবস্থা। তাকে ঠিক দেখাচ্ছে তামিল নায়ক বিজয় দেবেরাকন্দার মতো। রাইফা ফিসফিসিয়ে বলল,” আমার ব্যক্তিগত বিজয়।”
হঠাৎ শান বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠল,” হোয়াট আর ইউ ডুয়িং হেয়ার? লুকিয়ে ভাইয়াকে দেখছো কেন? সামনে গিয়ে দেখো! নাকি সাহস নেই?”
রিসব চমকে পেছনে তাকাল। রাইফা থতমত খেয়ে সরে গেল। রিসব মুচকি হেসে ডাকল,” রাইফা? এদিকে আসো।”
রাইফা শানের দিকে চেয়ে কিড়মিড়িয়ে বলল,” ফাজিল ছেলে! তোমাকে থাপ্পড় দিবো।”
শান চকলেট খেতে খেতে নির্বিকারচিত্তে বলল,” দিয়ে দেখাও।”
রাইফা শানের হাত থেকে চকলেট কেঁড়ে নিয়ে ফেলে দিল।তারপর ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,” ইডিয়েট।”
শান হাসি মুখে বলল,” আমার কাছে আরেকটা আছে।”
সে পকেট থেকে দ্বিতীয় চকলেট বের করল। রাইফা বারান্দায় ঢুকল। বিব্রত কণ্ঠে বলল,” আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম, হসপিটালে কখন যাবেন?”
রিসব ভদ্রলোকের মতো হাসি দিয়ে বলল,” এইতো, এখনি। কফি খাওয়া শেষ হোক। টায়ার্ড খুব। এখনও ঘুম আসছে। কফি না খেলে ক্লান্তি ছাড়বে না।”
” বুঝতে পেরেছি। আমি তো আপনাকে বলেছিলাম আরেকটু ঘুমান। আপনিই উঠে গেলেন।”
” তুমি কফি খাবে?”
” না। আমি যাই। আমার ফ্রেন্ডকে ফোন করতে হবে। কি জানি ওইদিকে কি অবস্থা!”
” আমার মিষ্টি আপুর সাথে কথা হয়েছিল। অবস্থা ভালো। টেনশনের কিছু নেই।”
” ওকে।”
রাইফা দ্রুত বারান্দা থেকে বের হতে নিয়ে হোচট খেল। শান এই দৃশ্য দেখে ফিক করে হাসল৷ রাইফা কটমট করে বলল,” ফালতু ছেলে।”
শান মজা করে বলল,” ভাইয়াকে দেখলেই তুমি এমন আউট অফ মাইন্ড হয়ে যাও কেন? ব্যাপারটা অনেক সিলি!”
” শাট আপ। আরেকটা কথা বললে তোমার চুল টেনে ছিঁড়ে দিবো আমি।”
তুলি মিষ্টির সাথে ক্যান্টিনে বসে আছে। গরম গরম পরোটা আর ডিম ভাজি অর্ডার করা হয়েছে। মিষ্টি আবার তুলির জন্য চিকেন স্যান্ডউইচও আনিয়েছে। তুলি অনীহা প্রকাশ করল,” আমি এতো খাবো না আপু।”
” কেন খাবে না? সারারাত ধরে এখানে আছো৷ তোমার কি ক্ষিদে পায়নি?”
তুলি আর কথা না বলে খেতে লাগল। কিন্তু তার বমি আসছে। খাবারের ঘ্রাণও সহ্য হচ্ছে না। ওইদিকে প্রিয়ন্তী আর প্রণয় কি করছে আল্লাহ মালুম। মিষ্টির ফোন বাজল। সে মোবাইলটা তুলির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,” নাও তুলি। রাইফা ফোন করেছে। তোমার সঙ্গে কথা বলবে।”
তুলি মোবাইল নিয়ে রিসিভ করল,” হ্যালো রাইফা।”
” স্যরি তুলি। রাতে আসতে পারিনি। তুই রাগ করিসনি তো?”
তুলি মুচকি হেসে বলল,” একদম না। তোর উপর আমি রাগ করি কিভাবে?”
” তুই কি সিরিয়াস? আমি তো ভেবেছিলাম এতোক্ষণে রেগে বোম্ব হয়ে আছিস। একবার মিষ্টি আপুর মোবাইল থেকে আমাকে ফোন করলি না কেন?”
” এমনি। ফোন করে কি হবে? মিষ্টি আপু বলেছিল তুই সকালে আসবি।”
রাইফা তুলির ঠান্ডা আচরণ দেখে হাঁফ ছাড়ল৷ সে ভেবেছিল তুলি রাগে কথাই বলবে না। কিন্তু তাকে শান্তই মনে হচ্ছে। অবশ্য রাইফা জানে না তুলি রাতে হাসপাতালেই থাকতে চেয়েছিল। তাই রাইফা না আসায় সে খুশি।
রাইফা বলল,”এইতো কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি আমরা।”
” আমরা মানে? তুই আর কে?”
” আমার জান।”
” ও।”
তুলি প্রথমে কথাটা ধরতে পারেনি। তবে ফোন রাখার পর তার মাথায় এলো, জানটা আবার কে?
শান হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিল তার ঘরে। রাইফা সেখানে ঢুকতেই শান একটা ভারী পেন্সিল বক্স ছুঁড়ে মারল। রাইফা মাথায় আঘাত পেয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। তার কপাল ছিঁলে গেল। রিসব এই দৃশ্য দিয়ে ধমক দিয়ে বলল,” শান, এসব কি?”
শান অভিযোগের সুরে বলল,” ও পারমিশন ছাড়া আমার রুমে কেন ঢুকেছে? আমি ন্যাকেড ছিলাম।”
” তুই ন্যাকেড কোথায়? তোর প্যান্ট আছে।”
” কিন্তু শার্ট নেই।”
রাইফা চোখে হাত দিয়ে বলল,” আমি কিছু দেখিনি।”
রিসব হাত বাড়িয়ে রাইফাকে তুলল,” এদিকে এসো।”
রাইফা রিসবের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। রিসব তাকে অন্য একটা ঘরে নিয়ে ব্যাগ থেকে টিস্যু আর সেভলন বের করে ছিঁলে যাওয়া জায়গায় মালিশ করে দিতে লাগল। রিসবের ব্যাগে সবসময় প্রাথমিক চিকিৎসার জিনিসপত্র থাকে। স্যাভলন লাগানোর সময় রাইফার ত্বকে খুব জ্বলছিল। রিসব তখন কপালে ফুঁ দিয়ে দিচ্ছিল। রাইফা চোখ বন্ধ করে একদম চুপ হয়ে রইল। মনে মনে শানকে ধন্যবাদ জানাল।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় শান বলল,” রাইফা আপু, আই এম স্যরি।”
শানের কণ্ঠে ‘স্যরি’ শুনে রাইফার বিষম খাওয়ার উপক্রম। শান মাথা নিচু করে আরও বলল,” আমি তোমার সাথে ঠিক করিনি।”
রাইফা শানের নাক টেনে দিয়ে বলল,” ইটস ওকে, ছোট রুস্তম!”
” তুমি সত্যি রাগ করোনি?”
” রাগ করার প্রশ্নই আসে না। বরং আমি খুশি। থ্যাঙ্কিউ। ”
শান বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,” থ্যাঙ্কিউ কেন? তোমার মাথায় পেন্সিল বক্স ছুঁড়ে মারার জন্য?”
” হ্যাঁ। ধরে নাও সেজন্যই।”
শান কিছুই না বুঝে চোখমুখ কুচকে তাকিয়ে রইল। রিসব বের হয়েই সর্বপ্রথম জানতে চাইল,” শান তোমাকে স্যরি বলেছে তো রাইফা?”
রাইফা খোশমেজাজে উত্তর দিল,” হ্যাঁ বলেছে।”
রিসব হেসে শানের চুল ঘেঁটে দিয়ে বলল,” গুড বয়।”
শান আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে আওড়াল,” কিন্তু রাইফা আপু আমাকে থ্যাংকস… ”
রাইফা দ্রুত শানের মুখ চেপে ধরল। রিসব তাদের কান্ড দেখে হাসতে হাসতে সামনে এগিয়ে গেল। রাইফা ফিসফিসিয়ে বলল,” চুপ থাকো প্লিজ।”
শান এবার ঘটনা বুঝে ফেলল। রাইফার মতো সেও ফিসফিসিয়ে বলল,” তোমার মাথায় ব্যান্ডেজ ভাইয়া করে দিয়েছে তাই না?এইবার বুঝেছি তুমি আমাকে থ্যাংকস কেন দিলে! ”
” তুমি দিন দিন বেশি পন্ডিত হয়ে যাচ্ছো শান। একদুম চুপ।”
” পন্ডিত মানে কি?”
” পন্ডিত মানে ইন্টিলিজেন্ট।”
শান খুশি হয়ে বলল,” ওহ, থ্যাংকস!”
গাড়িতে ওঠার সময় শান পেছনে গিয়ে বসল। রিসব ড্রাইভিং সিটে উঠবে। সে শানকে পেছনে যেতে দেখে বলল,” তুই তো সবসময় সামনে বসতি। আজকে ওদিকে কেন?”
শান থাম্বস আপ দেখিয়ে বলল,” আমি এখানেই ঠিকাছি৷ ইটস অলরাইট। ”
রিসব বলল,” ঠিকাছে। রাইফা, তাহলে তুমি আমার সঙ্গে বসো।”
রাইফা খুশি খুশি দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকাল। শান বলল,” ওয়েট, এর আগে রাইফা আপু আমার জন্য কয়েকটা কিন্ডার জয় নিয়ে আসবে।”
” এখন কিন্ডার জয় কেন? প্রয়োজন নেই রাইফা। তুমি বসো।”
শান উঠে বলল,” থাক আমি তাহলে সামনেই বসছি।”
রাইফা তড়িঘড়ি করে বলল,” না থাক, আমি কিন্ডার জয় নিয়ে আসছি। কয়টা আনবো শান?”
” অনলি ফাইভ।”
” হাসপাতালে গিয়ে তারপর কিনে দিবো। ওকে?”
” ডান।”
প্রিয়ন্তী প্রণয়ের কেবিন থেকে বেরই হচ্ছে না। তুলির তাদের কথা শুনতে ভালো লাগে না। তাই সেও কেবিনে ঢুকছে না। করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলল,” এই জায়গা কি খুব বেশি সুন্দর? কি আছে ওইদিকে? আমিও একটু দেখি!”
তুলি একটু চমকালো। প্রণয় উঠে এসেছে। একদম তুলির পাশে দাঁড়ালো সে। তুলি লাজুক হাসল। প্রণয় দেয়ালে কনুই ঠেঁকিয়ে গালে হাত রেখে তুলির দিকে তাকিয়ে বলল,” কিছুই তো নেই। এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছেন তাহলে?”
তুলি মাথা নিচু করে বলল,” আমার এখানে করার কিছু নেই। তাই দাঁড়িয়ে আছি। আপনি তো খুব ব্যস্ত।”
প্রণয় কি যেন বলতে নিচ্ছিল। ঠিক তখনি এসে বাগড়া দিল প্রিয়ন্তী,” তুই এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস প্রণয়? আমি একটু বাথরুমে গেলাম আর ওমনি তুই উঠে চলে এলি? ”
“শুয়ে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছিলাম। একটু হাঁটি।”
” হাঁটার দরকার নেই। তোর শরীর কত দূর্বল জানিস? অনেক রক্ত গেছে। আমার কথা শোন প্লিজ। ”
প্রণয় বিরক্তি ঝরা কণ্ঠে বলল,” তোর সব কথা শুনতে হবে নাকি?”
” আমার কথা না শুনেই তো এই অবস্থা। আমি তোকে আজমীরের ডাকে যেতে নিষেধ করেছিলাম। তবুও তুই গেছিলি।”
প্রিয়ন্তী তুলির চোখের সামনে দিয়েই প্রণয়কে টেনে নিয়ে যেতে লাগল৷ তুলি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল। কিছুক্ষণ পর রাইফা তুলির কাছে এসে শব্দ করল,” ভাউ।”
তুলি ভয় পেয়ে বলল,” আরে, কখন এলি?”
” মাত্র।”
শানও রাইফার সাথে এসেছে। সে একটা কিন্ডার জয় তুলির দিকে বাড়িয়ে বলল,” আপনার জন্য মিস।”
তুলি অনেক খুশি হয়ে বলল,” থ্যাঙ্কিউ। ”
রাইফা কোমরে হাত রেখে বলল,” আমার টাকায় কিন্ডার জয় কিনে তুলি আপুকে দিচ্ছো? আমাকে তো একটাও দিলে না!”
শান জবাব না দিয়ে কেবিনের দিকে হেঁটে গেল। সে কিন্ডার জয়গুলো ভাগ করে নিচ্ছে,” একটা রেডলাইটের জন্য। আরেকটা মিষ্টি আপুর জন্য। আরেকটা ভাইয়ার জন্য।”
রাইফা বিড়বিড় করে বলল,” ইবলিশ!”
তুলি হেসে জিজ্ঞেস করল,” তুই ওকে এতোগুলো কিন্ডায় জয় কিনে দিয়েছিস? এই ওয়েট, তোর কপালে কি হয়েছেরে?”
” আরে, ছোট একটা এক্সিডেন্ট…”
রাইফা থেমে গেল৷ কারণ প্রিয়ন্তী বের হয়ে রিসবকে জড়িয়ে ধরেছে তখন। এই দৃশ্য দেখে রাইফা হতভম্ব। তার মনে হলো কেউ বুঝি তার হৃদয় খামচে ধরেছে। প্রিয়ন্তী উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,” তুই কেমন আছিস দোস্ত? কতদিন পর দেখছি! একদম কালা ভূত হয়ে গেছিস। এতোবড় চুল রেখেছিস কেন? দাঁড়ির কি অবস্থা! পুরা রবীন্দ্রনাথ লাগছে।”
রিসব হাসতে হাসতে বলল,” তুই দেখি আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়ে গেছিস।”
” আচ্ছা তাই? উফ, লজ্জা পেলাম।”
রিসব প্রিয়ন্তীকে নিয়ে প্রণয়ের কেবিনে ঢুকল। রাইফা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল,” এখান থেকে চল তুলি। ”
” প্রণয়ের সাথে দেখা করবি না?”
” পরে করবো।”
রাইফা তুলিকে নিয়ে ক্যান্টিনে এলো। তার ক্ষিদে পেয়েছে খুব। সকাল থেকে তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি। রাইফা একা খাবে না। তাই অগত্যা তুলিকেও ভরাপেটে আবার খেতে বসতে হলো। খাওয়ার সময় তুলি জিজ্ঞেস করল,” তোদের সাথে ওই ছেলেটা কে?”
” রিসবের কথা বলেছিলাম না?”
” ও আচ্ছা। উনিই তাহলে রিসব? আমার সাথে পরিচয় করালি না কেন?”
” কিভাবে করাবো? এর আগেই তো লাল চুলের পেত্নীটা চলে এলো।”
তুলি খুব জোরে হেসে উঠল। রাইফা প্রিয়ন্তীকে ‘লাল চুলের পেত্নী’ বলায় সে ভীষণ মজা পেয়েছে। একটু পরেই রিসব আর প্রিয়ন্তী উপস্থিত হলো ক্যান্টিনে। তারা রাইফাদের টেবিলের ঠিক সামনের টেবিলেই বসল। রাইফার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। তুলিরও রাগ হলো। প্রিয়ন্তীকে দেখলেই তার রাগ হচ্ছে গতরাত থেকে।
রিসব হঠাৎ রাইফাকে দেখে মুচকি হাসল। রাইফাও উত্তরে সামান্য হাসল। রিসব খাবার অর্ডার করতে উঠল। প্রিয়ন্তীও তার সাথে উঠে দাঁড়াল। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল,” তুই যে কেমন ভগাব্যান্ড হয়ে গেলি দোস্ত! গ্র্যাজুয়েশনটা কম্পলিট করা উচিৎ তো। আবার ভর্তি হো না! আমরা সবাই তোকে অনেক মিস করি।”
রিসব মৃদু হেসে বলল,” এসব পড়াশুনা আমার দ্বারা আর হবে না। নেক্সট মান্থ আমি ট্রেনিং-এ যাচ্ছি।”
” আবার কিসের ট্রেনিং?”
রাইফা তাদের কথা শুনছিল আর ফুঁসছিল। একসময় সে তুলিকে বলল,” দোস্ত আমাকে একটা হেল্প করতে পারবি?”
” কি রকম হেল্প?”
” এই মেয়েটাকে একটা শিক্ষা দিবো।”
” তুই কি প্রিয়ন্তির কথা কথা বলছিস?”
” এর নাম প্রিয়ন্তী না হয়ে বিরক্তি হওয়ার দরকার ছিল। ইরিট্যাট করে দিচ্ছে একদম।”
তুলি হাসিমুখে বলল,” প্লিজ কিছু একটা কর। আমিও কালরাত থেকে অনেক ইরিট্যাট হচ্ছি।”
” সত্যি বলছিস?”
” হুম!”
” ঠিকাছে। তাহলে দ্যাখ এবার আমি কি করি!”
রাইফা আর তুলি হাত মিলিয়ে দ্রুত খাওয়া শেষ করল।
চলবে#বেদনার_রঙ_নীল
চব্বিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz
প্রণয়কে হসপিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হবে বিকালে। বাড়িতে গিয়ে দুইদিন বেডরেস্টে থাকতে হবে। এই মুহূর্তে রিসব আর প্রণয়ের মাঝখানে প্রিয়ন্তী বসে আছে। তিনজন জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। তাদের মাঝে তুলি আর রাইফা যেন নীরব দর্শক। ভোঁতামুখে বসা তারা দু’জন। শান পাশেই একটা চেয়ারে বসে আইপ্যাডে গেইমস খেলছে। মিষ্টি এখানে নেই। ফোনে কথা বলার জন্য সে বাইরে গেছে।
প্রিয়ন্তী কারণে-অকারণে প্রণয়ের কাঁধ চেপে ধরছে। সেই দৃশ্যই তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে তুলি। একবার তো প্রণয়ের কাঁধে মাথা রেখে শুয়েই পড়ল সে। তুলি এই দৃশ্য দেখে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। প্রিয়ন্তী তাকে দাঁড়াতে দেখে বলল,” কি ব্যাপার তুলি? কোনো প্রবলেম?”
তুলি মাথা নেড়ে বলল,” না।”
” তাহলে দাঁড়িয়ে পড়লে যে?”
” মশা কামড়াচ্ছে পায়ে।”
” এইখানে তো কোনো মশাই নেই।”
তুলি অসহায় চোখে তাকালো রাইফার দিকে। প্রণয় অস্বস্তিবোধ করছিল। আলগোছে সে প্রিয়ন্তীর মাথা সরিয়ে বলল,” গায়ের সাথে লাগবি না, সর! সুযোগ পেলেই খালি সাপটা-সাপটি!”
প্রিয়ন্তীর মুখ থমথমে হয়ে গেল। রাইফা কাটা ঘাঁয়ে নূনের ছিঁটা দেওয়ার উদ্দেশ্যে হো হো করে হাসতে লাগল। তুলিও তার সাথে তাল মিলিয়ে হাসল। প্রিয়ন্তী অবাক হওয়ার ভাণ ধরে বলল,” এভাবে বলতে পারলি প্রণয়? গতবছর কানাডা ট্যুরে যাওয়ার সময় তুই পুরো ফ্লাইটে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলি। তখন কি আমি কিছু বলেছিলাম?”
এই কথা শুনেই তুলির মুখের হাসি উধাও হয়ে গেল। প্রিয়ন্তী তুলির দিকে চেয়েই কথাটা বলছিল। যাতে তুলির জ্বলে। প্রণয় বিব্রত কণ্ঠে বলল,” কবে? আমার তো মনে নেই!”
” তোর মনে থাকবেও না। অকৃতজ্ঞ একটা।”
” সিরিয়াসলি মনে পড়ছে না। তুই তো আমার সঙ্গে বসিসওনি।”
” মাঝরাতে সিট চেঞ্জ করে আমি তোর কাছে এসেছিলাম৷ ”
” কেন?”
” তুই ম্যাসেজ করেছিলি।”
প্রণয় কনফিউজড হয়ে তাকিয়ে রইল,” কি আবোল-তাবোল বলছিস? ফ্লাইটে কি নেটওয়ার্ক থাকে? আমি তোকে ম্যাসেজ কিভাবে করবো?”
তুলি ফোঁড়ন কেটে বলল, ” আমার মনে হয় প্রিয়ন্তী আপু স্বপ্নে দেখেছিল।”
রাইফা এই কথায় অনেক জোরে হেসে উঠল। প্রিয়ন্তী কিছুক্ষণ চুপ থেকে রিসবের দিকে চেয়ে বলল,” তোর ট্রেনিং কবে দোস্ত?”
রিসবের আবার এদিকে খেয়াল নেই। সে একটা নন-ফিকশন পিডিএফ পড়ছিল। প্রিয়ন্তীর কথায় তার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলে সে ভ্রু কুচকে বলল,” এইতো, নেক্সট মান্থ। তোকে বললাম না একবার!”
প্রিয়ন্তী বাচ্চাদের মতো আহ্লাদী আবদার করল,” আমিও তোর সঙ্গে যাবো।”
এবার রাইফার মুখের হাসি উধাও। দৃষ্টি কটমট।
” তুই কেন যাবি?” রিসব হাসার চেষ্টা করল। প্রিয়ন্তী বলল,” তোর সঙ্গে পাহাড় ভ্রমণ করবো। প্রণয়কেও নিয়ে যাই? আমরা তিনজন একসঙ্গে যাই। কি বলিস প্রণয়?”
প্রণয় অবজ্ঞার স্বরে উত্তর দিল,” মাথাখারাপ!”
” প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ!” এই বলে একহাতে প্রণয়ের চুল ঘেঁটে দিতে লাগল প্রিয়ন্তী। এবার তো আর সহ্য হয় না! তুলি রাইফার দিকে তাকাল চোখমুখ কুচকে। যার অর্থ- ” প্লিজ কিছু কর!”
রিসব হাসিমুখে বলল,” পাহাড় ভ্রমণের জিনিস না ষ্টুপিড। আরোহণ করতে হয়। তোর দ্বারা হবে না। প্রণয় চাইলে কিন্তু যেতে পারিস।”
প্রণয় বালিশে হেলে চোখ বন্ধ রেখে বলল,” নেভার।”
প্রিয়ন্তী কোমরে হাত গুঁজে বলল,” আমার দ্বারা হবে না কেন রিসব?”
রিসব সকৌতুকে বলল,” তোর সোনাবরণ গায়ের রঙ ঝলসে যাবে না?”
প্রিয়ন্তী আহ্লাদে আটখানা হয়ে রিসবের গাল টেনে ধরল।
” সো সুইট! কিন্তু আমাকে নিয়ে এতো চিন্তার কিছু নেই। তুই পারলে আমিও পারবো।”
প্রিয়ন্তী চোখ মারল। রিসব হাসছে ফোনের স্ক্রিনে চেয়ে।রাইফা তড়াক করে দাঁড়িয়ে তুলির দিকে চেয়ে বলল,” এদিকে আয়।”
এই কথা বলেই সে বের হয়ে গেল। তুলি উঠে তার পেছন পেছন এলো। রাইফা কেবিন থেকে বের হয়েই রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য খুব জোরে শ্বাস নিল। ক্রোধান্বিত কণ্ঠে স্বগতোক্তি করল,” ডাকিনী একটা! তোর মুখের হাসি গায়েব করতে না পারলে আমার শান্তি হবে না।”
” কিন্তু করবিটা কি?” তুলি প্রশ্ন করল ফিসফিসিয়ে। রাইফা তুলির হাত শক্ত করে ধরে জানতে চাইল,” তুই কি আমার সাথেই আছিস?”
তুলি নির্দ্বিধায় বলল,” অবশ্যই আছি। কি করতে চাস সেটা বল খালি।”
” আমি একটা ভয়ংকর কান্ড ঘটাবো আজ। তুই কিন্তু সবক্ষেত্রে আমাকে সাপোর্ট করবি। বল রাজি?”
রাইফার চোখে ক্রোধানল জ্বলছে। তুলি মাথা নেড়ে বলল,” হুম। তুই যেটাই করবি আমি সেটাতেই রাজি।”
” ঠিকাছে। চল তাহলে।”
হসপিটালের গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছে ‘কিডস ওয়ার্ল্ড।’ সেখানে বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র পাওয়া যায়। এছাড়া বড়দের কিছু টপস, ল্যাগিংস, ওরনাও বিক্রি হয়৷ রাইফা তুলিকে নিয়ে কাঁচের দরজা ঠেলে শপে ঢুকল। তারপর দু’টো ওরনা, দু’টো মাস্ক আর দু’টো সানগ্লাস কিনে ফেলল। তুলি তাকে এসব নিতে দেখে হাসতে হাসতে বলল,” আমার কিন্তু খুব কিউরিওসিটি হচ্ছে রাফু। তুই কি করতে চাইছিস প্রিয়ন্তীর সাথে?”
” শশশ! চুপচাপ দেখে যা। তোকে উপযুক্ত সময়ে সবকিছু বলা হবে।”
রাইফা চোখ টিপল। তারপর কি ভেবে যেন দু’টো টপস আর ল্যাগিংসও কিনে নিল।
” আমাদের এখন ড্রেস চেঞ্জ করতে হবে তুলু।” শপ থেকে বের হয়েই রাইফা এই কথাটি বলল। তুলির চোখ মার্বেলের মতো বড় হয়ে গেল তা শুনে। তবে পরবর্তীতে কি হবে সেটা নিয়েও খুব রোমাঞ্চবোধ করছিল সে। তাই উচ্চবাচ্য না করে রাইফার কথামতো কাজ করল।
প্রণয় ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রিয়ন্তী তার পাশে বসে গুণগুণিয়ে গান গাইছে। একজন নার্স এসে প্রিয়ন্তীকে ডাকল,” ম্যাম, কথা শুনে যান।”
” আমাকে বলছেন? প্রিয়ন্তী ভ্রু কুচকে বেরিয়ে এলো। নার্স বললেন,” মিষ্টি আপু আপনাকে ডেকেছে।”
” কোথায় মিষ্টি আপু?”
” আমার সাথে চলুন।”
নার্সের হাতে ঔষধের শিশির মতো কিছু একটা ছিল। জিনিসটির মুখ খোলা। ভেতরে তরল পদার্থ। নার্স ইচ্ছাকৃতই হোঁচট খেয়ে সেই তরল ফেলে দিল প্রিয়ন্তীর গায়ে। তারপর দুঃখিত গলায় বলল,” ওপসস, স্যরি ম্যাম!”
প্রিয়ন্তী চেহারা বিকৃত করে জানতে চাইল,” এটার মধ্যে কি ছিল?”
নার্স অপরাধী গলায় জবাব দিল,” একজনের ইউরিন ছিল।”
প্রিয়ন্তি প্রায় চেঁচিয়ে উঠল,” ওহ নো, ওহ গড! কি করলে এটা?”
নার্স বলল,” এক্সট্রিমলি স্যরি। চলুন আপনাকে বাথরুমে নিয়ে ওয়াশ করে দিচ্ছি।”
প্রিয়ন্তী দৌড়ে বাথরুমে ছুটতে লাগল। নার্স বাঁধা দিয়ে বলল,” ওদিকে যাবেন না ম্যাম। ওখানে ভীড় বেশি। যেখানে ভীড় কম সেখানে নিয়ে যাচ্ছি চলুন।”
প্রিয়ন্তী পড়িমরি করে বলল,” হ্যাঁ চলো। দ্রুত।”
ওয়াশরুমে এসে দরজা আটকে দিয়ে চলে গেল নার্স। তার কাজ এখানেই শেষ। প্রিয়ন্তী অবশ্য দরজা আটকানোর ব্যাপারটি খেয়াল করল না। তার পুরো শরীর গিনগিন করছিল। বমি আসছিল। সে কোনোমতে কল ছেড়ে নিজের জামা পরিষ্কার করতে লাগল। ঠিক তখনি পেছন থেকে কেউ মুখ চেপে ধরল তার। আলো নিভিয়ে দেওয়া হলো। প্রিয়ন্তী কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে ধুমধাম মারতে শুরু করল চারটি হাত। কে বা কারা এমন করছে, প্রিয়ন্তী জানে না! সে মূর্ছা গেল। রাইফা আর তুলি ভয়ে ছেড়ে দিল। তুলির অবশ্য মন চাইছিল তখনও মারতে। তার রাগ কমেনি একফোঁটাও। রাইফা তো তুলির আচরণ দেখে নিজেই হতবাক। তুলির মতো শান্ত মেয়েও যে কাউকে এইভাবে মারতে পারে সেটা তার ধারণাতেই ছিল না। সে সতর্ক গলায় বলল,” এইটা কি করলি তুলি? এইবার কি হবে?”
তুলি প্রশ্ন করল,” মরে গেছে নাকি?”
” না। এইটুকু মারে কেউ মরে না। তবে ভয় পেয়ে বেহুশ হয়ে গেছে মনে হয়।”
তুলি উত্তেজিত গলায় বলল,” তাহলে হুশ ফেরার আগে আরও কয়েকটা দেই।”
রাইফা তড়িঘড়ি করে তুলিকে থামাল,” এই না, না, থাক! বেচারির যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। চল আমরা চলে যাই।”
” এটাকে এভাবেই রেখে চলে যাবো?”
” তো আর কি করবো? জ্ঞান ফিরলে সে নিজেই উঠে আসবে।”
” ও আমাদের চিনতে পারেনি তো?”
” কিভাবে চিনবে? আমরা নিজেরাই নিজেদের চিনতে পারছি না!”
বাথরুম থেকে বের হয়েই সানগ্লাস আর মাস্ক খুলে মুখে হাসি আনার চেষ্টা করল রাইফা। তুলি ইতস্তত করে বলল,” আমরা কি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেললাম?”
প্রশ্নটা করে সামনে তাকাতেই আত্মা ছলাৎ করে উঠল তার। তুলিকে থতমত খেতে দেখে রাইফাও সামনে তাকাল। রিসব দাঁড়িয়ে আছে তাদের সামনে। তাকে দেখে আৎকে উঠে মুখ চেপে ধরল রাইফা। তুলির গলা শুকিয়ে গেল। রিসব জেনেছে মানে প্রণয়ও জানবে এবার!
চলবে
সারাদিন আজকে ব্যস্ত ছিলাম। তাই লেখার সময়ই পাইনি। ছোট বলে কেউ অভিযোগ করবেন না প্লিজ। ক্লান্ত শরীরে লিখেছি।