বেদনার রং নীল পর্ব -২৭+২৮

#বেদনার_রঙ_নীল
সাতাইশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

একঝাঁক মানুষ রাইফাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। এলোমেলো নিশ্বাস ছেড়ে রাইফা নিজের মাথায় হাত চেপে ধরল। কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু চোখের পলকে ধ্বংসাত্মক একটা এক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারতো। সেই কথা ভেবেই শিউরে উঠছে মন। বৃদ্ধা একজন রাইফার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” ঠিকাছো তুমি মা?”

রাইফা মাথা নাড়ল। তারপর গাড়িতে উঠে সবাইকে উপেক্ষা করে চলতে শুরু করল। সবাই তড়িঘড়ি করে সরে যাচ্ছিল। রাইফার চোখে পানি জমছে। আজ তার কি হয়ে গেছে? সে কি খুশিতে আত্মহারা নাকি বিষণ্ণতায় গোবেচারা?

প্রণয়দের ডুপ্লেক্স ভবনে গাড়ি থামল। রিসবের ঘরের ঝুল বারান্দায় কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে রাইফা ভেতরে প্রবেশ করল।বেল চাপতেই দরজা খুলে দিল একটি কিউট মেয়ে। রাইফা অল্প অবাক হলো।

” কে তুমি?”

মেয়েটি জবাব না দিয়ে পেছনে তাকাল। শান বেরিয়ে এলো। ভ্রু কুচকে বলল,” তুমি এইখানে এইসময় কি করছো?”

রাইফা কোমরে হাত গুঁজে শাসনের ভঙ্গিতে বলল,” তোমাকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে?”

” অফকোর্স! আমার বাড়ি!”

” ইশ, আসছে আমার বাড়িওয়ালা!”

শানকে উপেক্ষা করে ভেতরে প্রবেশ করল রাইফা। আরও কিছু ছেলে- মেয়ে এখানে আছে। সবাই থ্রিডি দেখছে। ঘরের অবস্থা নাজেহাল। রাইফা কয়েকবার হোচট খেল। বোঝাই যাচ্ছে বাড়িতে কেউ নেই। সে কপালে হাত ঠেঁকিয়ে বলল,” কি নোংরা! সবাই কোথায় গেছে শান?”

শান উত্তরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,” আমি জানি না। তুমি এখান থেকে চলে যাও।”

” যাবো। আগে বলো তোমার ভাইয়া কোথায়?”

” বাইরে আছে। ঘরে নেই। তাই ঘরে খুঁজে লাভ নেই।”

শানের কথার ঢং-এ সবাই মৃদু হাসল। রাইফা ক্ষেপে বলল,” তাহলে বাইরে কোথায় আছে সেটা বলো!”

শান বলতে নিয়েও থেমে গেল। সরুদৃষ্টিতে তাকাল” তুমি জেনে কি করবে? ভাইয়াকে তোমার কেন দরকার?”

রাইফার এবার মেজাজ খারাপ হলো খুব। সারারাত না ঘুমানোর কারণে মাথা ধরে আছে এমনিতেই। মেজাজটাও একশো ডিগ্রী। সেন্টার টেবিল থেকে প্রিংগেলস চিপসের বয়ম তুলে বলল,” এইটা দিয়ে তোমার মাথা ফাটিয়ে দিবো যদি না বলো।”

শান চটপট করে উত্তর দিল,” এটা আমার মাথায় মারলে এটাই ফাটবে। আমার মাথায় কিছু হবে না। কিন্তু তুমি চিপস ফেলে দিয়েছো। আগে চিপস তুলে রাখো তারপর বলবো।”

রাইফা নিচে তাকিয়ে দেখল প্রিংগেলসের অনেকগুলো চিপস নিচে পড়ে গেছে। রাইফার মাথা গরম থাকলেও শানের সাথে এই নিয়ে তর্ক করতে গেল না সে। শানের সাথে তর্ক করা মানেই ব্যর্থতা নিশ্চিত। রাইফা বাধ্য হয়ে চিপস কুঁড়াতে লাগল। সব উঠানোর পর হাঁফ ছেড়ে বলল,” নাও তুলেছি। এখন বলো, তোমার ভাইয়া কোথায়?”

শান দুষ্ট হাসি দিয়ে বলল,” বলবো। তার আগে আমাদের সাথে একটা গেমস খেলতে হবে।”

সবাই আবারও হেসে উঠল। রাইফা দাঁতে দাঁত পিষল। আঙুল উঁচু করে ধমকাল,” এবার বেশি হচ্ছে শান। বলো নাহলে আমি তোমার থ্রিডি গ্লাস ভেঙে ফেলবো।”

” ভেঙে ফেললেও গেইম খেলতে হবে।” শানের কথায় পাশের মেয়েটি খিকখিক করে হাসল৷ রাইফার চোখে রাগের আগুন ধিকধিক করে জ্বলে উঠল। তবুও স্বার্থের খাতিরে নিজেকে শান্ত রেখে বলল,” কি গেইম?”

” ট্রিজার হান্টিং।”

” সেটা আবার কি?”

” এই ঘরে একটা জিনিস লুকানো আছে। সেইটা খুঁজে বের করতে হবে। যদি পারো তাহলে ভাইয়া কোথায় আছে বলে দিবো। আর না পারলে চুপচাপ তুমি এখান থেকে চলে যাবে। টাইম টেইন মিনিটস অনলি।”

রাইফা বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকাল। না পারতে বলল,” জিনিসটা কি?”

শান তার আইপ্যাড থেকে জিনিসটির ছবি বের করল৷ একটি স্পিনার। রাইফার দিশেহারা লাগছে। এই ছোট্ট স্পিনার এতোবড় ঘরে সে কিভাবে খুঁজে পাবে? ভালোই মুশকিল কাজ। কিন্তু করতেই হবে।

মনে মনে শানকে গালি দিয়ে সে জিনিসটি খুঁজতে শুরু করল। বেশ কিছুক্ষণ পর সেটি পাওয়া গেল ভারী ডিপ ফ্রীজের নিচে। রাইফা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,” ফাজিল ছেলে, ওই জায়গায় কেউ রাখে? আমার জানটা বের হয়ে গেছিল ফ্রীজ সরাতে গিয়ে।”

শান হাসিমুখে বলল,” এটা আমি রাখিনি। হারিয়ে গেছিল। অনেকদিন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই আজ সুযোগ পেয়ে তোমাকে দিয়ে খুঁজিয়ে নিলাম। থ্যাংকস!”

রাইফা বেকুব হয়ে গেল এমন কথা শুনে। শান স্পিনারটা হাতে নিয়ে চুমু দিল৷ এটা তার প্রিয় জিনিসগুলোর একটি। হাসির রোল পড়ে গেল ড্রয়িং রুমে। রাইফা তেজস্বী কণ্ঠে বলল,” সবাই চুপ একদম। সবকয়টা ফাজিল তোমরা। আর শান, তুমি তো ফাজিলদের সর্দার! বিচ্ছু কোথাকার! বলো, তোমার ভাইয়া কই?”

শান স্পিনার পকেটে ভরতে ভরতে বলল,” ওয়েল, ভাইয়া কোথায় আছে আমি জানি না। তুমি ভাইয়ার ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করতে পারো। সে চলে আসবে।”

রাইফা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল,” এই কথাটি তাহলে আগে বললে না কেন? বেকার বেকার খাটলাম আমি!”

” আগে বললে তো বেকার বেকার খাটতে না। তাই আগে বলিনি।”

শানের বন্ধুরা আবার হাসতে লাগল। রাইফা রাগে কটমট করে উপরে উঠে গেল। রিসবের ঘরে এসে প্রথমেই ধরাম করে দরজা বন্ধ করল। তবে ভেতর থেকে লক করল না। ক্লান্তি নেমেছে তার শরীরে। এই ঘরে একটা পারফিউমের ঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে। নিঃসন্দেহে রিসবের পারফিউম। রাইফা বিছানায় বসল। অজান্তেই তার চোখ বুজে আসল ঘুমে। সে যে কখন ঘুমিয়ে গেল তা নিজেই টের পেল না!

তুলি রিকশা থেকে নেমে রিকশা ভাড়া মেটানোর সময় খেয়াল করল প্রণয় গাড়িতে নেই। প্রণয়ের গাড়ি আগে থেমেছিল। সে কি গাড়ি থেকে নেমেছে নাকি দেখেনি তুলি। খানিক চিন্তা লাগছে। তখনি হুট করে একটি কাঁচের কোকা কোলার বোতল তুলির সামনে বাড়িয়ে ধরা হলো। তুলির বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এটা প্রণয়। তাই সে মুখের দিকে না তাকিয়েই রিকশা ভাড়া মিটিয়ে সামনে হাঁটতে লাগল। প্রণয় তার পেছনে আসতে আসতে বলল,” কি ব্যাপার? তোমার না ঝাল লেগেছিল খুব? এইটা খাও, ভালো লাগবে।”

তুলি মুখ টিপে হাসল৷ প্রণয় আশ্চর্য হলো,” আরে, হাসছো কেন?”

” ঝাল কি কাঁঠালের আঠা যে এখনও জিভে লেগে থাকবে? কখন চলে গেছে!”

” ও আচ্ছা। চলে গেছে তাই না?”

” হুম।”

” তাই বলে কি কোকা কোলা খাওয়া যাবে না?”

” না। আমি কোকা কোলা খাই না। এটা আপনিই খান।”

“ওকে। তাহলে তুমি কি খাও?”

” আমি খাই আঠারো টাকার মোজো।”

তুলি এই কথা বলেই একটা মুদির দোকান থেকে আঠারো টাকা দিয়ে মোজো কিনল। বিশ টাকার নোট দেওয়ার পর যেই দুইটাকা ফেরত পেল সেটা দিয়ে কিনল দুইটা কফি চকলেট। একটা প্রণয়কে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,” কফি খাবেন?”

প্রণয় নাক কুচকে বলল,” এটা তো কফি না। ক্যান্ডি জাস্ট।”

তুলি হাসতে হাসতে চকলেটটা নিজের ব্যাগে ভরল। প্রণয় বলল,” না,না, আমি খাবো। দাও।”

” উহুম। এই দুইটাকার কফি আপনার খাওয়ার জিনিস না। আপনি খাবেন দুইশো টাকার কফি। কি যেন বলে? ক্যাপাচিনো। আলিশান রেস্টরন্টে বসে গরম ক্যাপাচিনোতে চুমুক দিতে দিতে পাঁচশো টাকার নোট বিলবুকে রেখে ওয়েটারকে গম্ভীরমুখে বলবেন, কীপ দ্যা চেঞ্জ।”

প্রণয় অদ্ভুতভাবে হাসল। হালকা অপ্রস্তুতও হলো।

” তোমার আজকে কি হয়েছে তুলি? আমাকে এইভাবে খোচাচ্ছো কেন?

” খোচালাম কই? সত্যিই তো বলছি। শন পাপড়ি খাবেন?”

প্রণয় উত্তর দেওয়ার আগেই তুলি ছুটে গেল ফেরিওয়ালার থেকে শন পাপড়ি কিনতে। প্রণয় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। সে তুলির মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছে না আজ। তুলি ফিরে এসে বলল, ” এটা কিন্তু আপনাকে খেতেই হবে। হাঁ করুন।”

প্রণয় এই যাত্রায় হাঁ করল। তুলি প্রণয়কে শন পাপড়ি খাইয়ে দিল। তারপর প্রশ্ন করল,” কেমন খেতে?”

প্রণয় আঙুল দেখিয়ে বোঝাল,” ওয়ান্ডারফুল।” তারপর কি একটা ভেবে বলল,” এগুলো সুপার শপেও পাওয়া যায়। এখান থেকে কেনার দরকার ছিল না।”

তুলি এমনভাবে হাসল যেন সে জানতো প্রণয় এটাই বলবে!

” আচ্ছা, তুমি এখানে আসলে কেন? মানে আমি ভেবেছিলাম তুমি বাড়িতেই যাবে এই সময়।”

” এখন আমি বাড়ি যাবো না। আপনাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাবো।”

প্রণয় উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,” ওয়াও, আমার সৌভাগ্য!”

তারপর সে তার গোটা বামহাত এমনভাবে বাড়িয়ে দিল যেন তুলি তার হাতটা আঁকড়ে ধরতে পারে। কিন্তু তুলি ধরল না। সে হাসতে হাসতে সামনে গেল। প্রণয় পিছু পিছু এসে বলল,” সবসময় কি আমি তোমার পিছুই করে যাবো? কখনও তোমার পাশাপাশি হাঁটতে দিবে না?”

তুলি হালকা গম্ভীর হয়ে বলল,” সত্যি পাশাপাশি হাঁটতে চান?”

প্রণয় তুলির হাত ধরে তাকে থামিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল৷ গাঢ় কণ্ঠে বলল,” নিশ্চয়ই চাই।”

তুলি হেসে নিজের হাত ছাড়াতে চাইল। কিন্তু প্রণয় ছাড়াতে দিল না। সে দৃঢ় গলায় বলল,” আমি সিরিয়াস তুলি। এতো সিরিয়াস আমি আগে কোনো বিষয়ে হইনি।”

তুলি জবাব না দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল।প্রণয়ও জবাবের অপেক্ষা করার অবকাশ পেল না। ছেড়ে দিল তুলির হাত। তারপর মাথা নিচু করে তুলির পেছনে হাঁটতে লাগল আবারও। তারা যেখানে এসেছে সেটি একটি কাশবন। সামনে দিয়ে বয়ে গেছে ঝিল। তুলি ঝিলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে পড়ল। প্রণয় দাঁড়িয়ে রইল তার পাশে। তুলি হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,” আরে বসুন না! ”

প্রণয় ইতস্তত করল,” এখানে নোংরা অনেক।”

তুলি হাসার ভাণ ধরে বলল,” ওহ স্যরি, ভুলেই গেছিলাম। আপনি কেন এই নোংরা ঝিলের পানিতে পা ভেজাবেন? আপনার জন্য তো দামী সুইমিংপুল আছে। ক্লোরিন মেশানো নীল জল ছাড়া আপনার পা…”

তুলির কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রণয় তার পাশে বসে গেল। ঝিলের পানিতে পাও ভেজালো। তারপর কোমল দৃষ্টিতে তুলির দিকে চেয়ে বলল,” এবার খুশি?”

তুলি নিশ্চুপ হয়ে গেল। স্বচ্ছ পানির তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই আনমনা হয়ে উঠল। প্রণয় এই সুযোগে তুলির হাতের উপর হাত রাখল। তুলি চমকে উঠে সেই হাত সরিয়ে নিল দ্রুত। প্রণয় অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” স্যরি।”

” না, ইটস ওকে।” তুলি হাসল হালকাভাবে। কিন্তু তার মুখে দেখাচ্ছে করুণ ফ্যাকাশে। প্রণয় পরিষ্কার কণ্ঠে অনুরোধ করল,” তোমার আজ কি হয়েছে তুলি? প্লিজ টেল মি..”

তুলি মৃদু কণ্ঠে বলল,” আমি একটা জিনিস চাইবো আপনার কাছে। দিতে পারবেন?”

” তুমি শুধু বলো কি চাও?”

তুলি কথাটা বলতে সময় নিল। প্রণয় ধৈর্য্য ধরে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল তখন। কিছু একটা ভেবে তুলি হঠাৎ বলল,” আচ্ছা থাক, পরে চাইবো। তার আগে আপনার কাছে আমি কিছু কনফেস করতে চাই।”

” কি কনফেস করবে?”

তুলি ঢোক গিলে এক নিশ্বাসে বলল,” প্রিয়ন্তী আপুকে আমি মেরেছিলাম।”

প্রণয় চট করে ধরতে পারল না কথাটা। চোখ কুচকে বলল,” কি?”

তুলি বড় করে শ্বাস ছেড়ে আস্তে-ধীরে আবার বলল,” আমি প্রিয়ন্তী আপুকে বাথরুমে নিয়ে মেরেছিলাম।”

প্রণয়ের চোখ বড় হয়ে গেল। ঠোঁটদ্বয় আলাদা হয়ে গেল। হাঁ করে বোকার মতো চেয়ে থেকে সশব্দে বলল,” মানে ওই চড়, থাপ্পড়, লাথি, এসব তুমি মেরেছো?”

” হুম।” তুলি মাথা নাড়ল। প্রণয় বিষমচিত্তে প্রশ্ন করল,” কেন?”

” আইডিয়াটা রাইফার ছিল। তবে আমিও তাকে সঙ্গ দিয়েছি। আর মারার সময় আমিই বেশি মেরেছি। রাইফা রিসব ভাইয়ের সাথে প্রিয়ন্তী আপুর ভাব সহ্য করতে পারছিল না। এজন্য সে এমন করেছে।”

প্রণয় আগ্রহভরা দৃষ্টিতে জানতে চাইল,” আর তুমি?”

তুলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,” আমি আবার কি?”

প্রণয় হেসে দিল জোরে। তুলি আরও ভড়কে গেল। প্রণয় হাসছে তো হাসছেই৷ তার হাসি থামার নাম নেই। তুলি আশ্চর্য হয়ে বলল,” আপনি আমার উপর রাগ করবেন না?”

প্রণয় উত্তরও দিতে পারল না। কারণ তার হাসিই থামছে না।

রাইফা চোখ মেলে দেখল রিসব তার দিকে তাকিয়ে আছে। নিষ্পলকভাবে। তার ঘুমন্ত মুখটাই দেখছিল হয়তো৷ রাইফার ঠোঁটে হাসি মিশল। সে জিজ্ঞেস করল আদুরে কণ্ঠে, “আপনি আমাকে দেখছেন?”

রিসব সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে বলল,” কই না তো!”

রাইফার ঠোঁটের হাসি দীর্ঘ হলো। সে শোয়া থেকে উঠে বসে রিসবের কাঁধে হাত রেখে বলল,” মিথ্যা বলবেন না। আপনি আমাকেই দেখছিলেন। আমি জানি। বলুন দেখছিলেন কি-না?”

রিসব আড়ষ্টভাবে মাথা নেড়ে বলল,” হুম।”

রাইফা খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। মুখে হাত চেপে বলল,” আমাকে ভালোবাসেন?”

রিসব হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল। রাইফা সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল রিসবকে। রিসব টাল সামলাতে না পেরে বিছানা থেকে পড়ে গেল৷ রাইফাও পড়ল ধাম করে। তার ঘুমটাও ছুটে গেল। উপলব্ধি হলো, সে এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্ন দেখেই বিছানা থেকে পড়ে গেছে। এই মুহূর্তে সে আছে রিসবের ঘরে৷ তার হাতে বালিশ, সেটাও রিসবের কোলবালিশ। রাইফার ভীষণ লজ্জা করতে লাগল। তখনি দরজায় খটরখটর আওয়াজ হলো। কেউ কি ভেতরে ঢুকছে? রিসব নয়তো? সে রাইফাকে এই অবস্থায় দেখলে কি ভাববে?

কাদের বেশি পছন্দ? প্রণয়-তুলি নাকি রিসব-রাইফা?

চলবে#বেদনার_রঙ_নীল
আঠাশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

রাইফা খুব দ্রুত মেঝে থেকে উঠে বিছানায় বসে গেল। কোলবালিশ জায়গামতো রেখে চুল আর গায়ের কাপর সব ঠিক করতে উঠে-পরে লাগল। এমনভাবে থাকতে হবে যেন তাকে দেখে বোঝা না যায় যে সে ঘুমিয়ে ছিল।

রিসব ভেতরে ঢুকে রাইফাকে দেখে যারপরনাই বিস্মিত হলো।

” আরে, তুমি এখানে কি করছো?”

রাইফা আমতা-আমতা করতে লাগল। কত সাহস নিয়ে এসেছিল সে এখানে। ভেবেছিল ওরনাটা রিসবের মুখের সামনে ধরে চনমনে কণ্ঠে প্রশ্ন করবে,” এই মিস্টার রুড, আপনি আমাকে ভালোবাসেন তাই না? খবরদার মিথ্যা বলবেন না! ভালো না বাসলে আমার ওরনা আপনার আলমারিতে কি করে?”

কিন্তু রিসব সামনে এসে দাঁড়ানোর পর রাইফা উপলব্ধি করেছে যে সে এসব কিছুই বলতে পারবে না৷ কারণ তার এতো সাহস নেই। এই মানুষটির সামনে এলেই সব স্বাভাবিক ব্যাপার অস্বাভাবিক হয়ে যায়। রাইফা আর নিজের মধ্যে থাকে না। লজ্জাবতীর গাছের মতো লুটিয়ে পড়ে অচিরেই।

রিসব এখনও ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়। রাইফা বসা থেকে উঠে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে অকপটে মিথ্যা বলল,” মিষ্টি আপুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। বাসায় শান আর তার বন্ধুরা ছাড়া কেউ ছিল না৷ তাই আমি এখানে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম…”

কথা শেষ করে রাইফা হাসার চেষ্টা করল। রিসব তার হাসিতে তাল মিলালো না। গম্ভীরমুখে এগিয়ে গেল আলমারির দিকে। তার কাঁধে ঝুলছিল ব্যাডমিন্টনের ব্যাট। সে এগুলো আলমারিতে তুলে রাখছে। তারপর তোয়ালে বের করল। রাইফার দিকে চেয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,” তুমি কি আমাকে কিছু বলবে?”

অন্য সময় হলে রাইফা বলতে পারতো। কিন্তু এই মুহূর্তে রিসবের মেজাজ ঠিক লাগছে না। তাই ভালোবাসা বাসির বিষয়ে কথা বলার প্রশ্নই আসে না৷ রাইফা খুব ইতস্ততবোধ করছিল। রিসব তার উত্তরের অপেক্ষাও করল না। সে গোসলের উদ্দেশ্যে বাথরুমে ঢুকে যেতে নিলেই রাইফা শ্বাস আটকে বলল,” আপনি কি আমার উপর এখনও রেগে আছেন?”

প্রশ্নটা শুনে রিসব থামল। রাইফার বুকে তখন সে কি তোলপাড়! ধুপধাপ কিছু ছুটে চলার আওয়াজ হচ্ছে। রিসব পেছনে তাকিয়ে বলল,” অপেক্ষা করো। এসে কথা বলবো।”

তারপর সে বাথরুমের দরজাটা আটকে দিল। রাইফা মুখে হাত চেপে ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। এক ঘণ্টা ধরে দৌড়ালেও হার্টবীট এতো দ্রুত হবে না। যতটা দ্রুত এখন হচ্ছে! রাইফা নিজেকে ধাতস্থ করতেই পারছে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না রিসব বাথরুম থেকে বের হচ্ছে ততক্ষণ রাইফার এই হার্টবীটের উর্ধগতি কমবে বলে মনে হয় না।

___________

তুলির মেজাজ তিরিক্ষ রূপ ধারণ করল। কিছুটা শব্দ করেই বলল,” থামবেন আপনি? এটা হাসির কোনো কথা না।”

প্রণয় মুখে হাত দিয়ে নিশ্চুপ হলো। তুলি অন্যদিকে চেয়ে কিছু একটা বলতে নিলেই খেয়াল করল প্রণয় এখনও মুখে হাত রেখে চাপা শব্দে হাসছে। তুলি রেগে তাকালেই সেই হাসির মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেল। উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়ে তুলি কপালে হাত ঠেঁকিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে বলল,” আপনার সমস্যা কি? কেন এতো হাসছেন?”

প্রণয় অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে জবাব দিল,” মার খাওয়ার সময় প্রিয়ন্তীর অবস্থা কল্পনা করেই আমার হাসি পাচ্ছে। শোনো তুলি, প্রিয়ু যদি মেয়ে না হয়ে বাই চান্স ছেলে হতো তাহলে অনেক আগেই ওকে মেরে আমি হসপিটালে পাঠাতাম। কিন্তু সেই কাজটা তুমিই করে দিলে। ও মাই গড! আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। মানে সত্যি নাকি স্বপ্ন? আচ্ছা বেহুশ হলো কিভাবে ও? ক্লোরোফরম দিয়েছিলে নাকি?”

তুলি প্রণয়ের এইসব কথা শুনে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারল না। তারও হাসি পেয়ে যাচ্ছে। একটু পর তাদের হাসি কমে এলে তুলি বলল,” ক্লোরোফরম দেইনি। আমাদের প্ল্যান ছিল তাকে কয়েকটা চড় মেরে পালিয়ে যাবো। তারপর আলো নেভানো থাকবে তাই সে কিছু বুঝবে না। কিন্তু বেহুশ হয়ে যাবে এটা চিন্তাও করিনি।”

” এর মানে ও নিজেই বেহুশ হয়েছে?” প্রণয় বিস্মিত হলো এবং কিছুটা সিরিয়াস। তুলি অপরাধী কণ্ঠে বলল,” না, না, মার খেয়ে বেহুশ হয়নি। আমার মনে হয় ভয় পেয়েই বেহুশ হয়ে গেছিল। আর আমরা এতোটাও জোরে মারিনি যে একেবারে বেহুশ বানিয়ে ফেলবো। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল তাকে একটু ভয় দেখানো। একটু টাইট দেওয়া।”

প্রণয় আবার হেসে উঠল। তুলি মাথা নিচু করে বিরস কণ্ঠে বলল,” তারপর বাথরুম থেকে বের হয়েই রিসব ভাইয়ের কাছে ধরা পড়ে গেছি।”

” তাই? কিভাবে?”

” জানি না। উনি কোত্থেকে যে এলেন! রাইফা কি করেছিল শুনবেন? কেউ যেন আমাদের আইডেন্টিফাই করতে না পারে সেজন্য মাস্ক, সানগ্লাস, ওরনা, এসব কিনে ডাকাতের মতো সেজেছিল, মানে আমরা দু’জনেই সেজেছিলাম৷ কিন্তু বাথরুম থেকে বের হয়েই সে সব খুলে ফেলেছে। রিসব ভাইয়া তাকে দেখেই অবাক। পরে বিষয়টা আমরা কাটিয়ে দিয়েছিলাম। তাও রিসব ভাইয়া বুঝে ফেলেছেন। তারপর রাইফাকে আড়ালে মিয়ে জেরা করেছেন।”

” উমম..বোঝারই কথা! রাইফা কি কি করতে পারে তা সব রিসবের মুখস্ত।”

তুলি অবাক হয়ে বলল,” তাই?”

” হুম। রিসব রাইফাকে ভালো করেই চেনে।”

” আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলুন তো? রিসব ভাইয়া কি রাইফাকে ভালোবাসেন?”

প্রণয় দুষ্ট হাসি দিয়ে বলল,” তুমি কেন জানতে চাও এটা?”

তুলি কাতর গলায় অনুরোধ জানাল,” প্লিজ বলুন! রাইফার জন্য আমার খুব টেনশন হয়।”

প্রণয় জবাব দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। দুষ্ট হাসি বজায় রেখে বলল,” বলতে পারি। কিন্তু এর আগে আমারও যে একটা প্রশ্নের উত্তর চাই!”

তুলির মুখ আরক্ত হলো। সে প্রণয়ের চোখ দেখেই আঁচ করতে পারছে যে প্রণয় কি জিজ্ঞেস করবে এখন! তুলি লাজুক গলায় বলল,” আপনি আবার কি প্রশ্নের উত্তর চান? আমার কাছে কোনো উত্তর নেই।”

তুলি বিপরীত দিকে মাথা ঘুরালো। প্রণয় তার কাছে এসে হালকা গলায় বলল,” তোমার কাছে উত্তর আছে।”

তুলি চট করে এদিকে তাকাতেই প্রণয়ের গালের সাথে তার গাল ঘঁষা খেল। লজ্জায় পড়িমরি অবস্থা হলো তুলির। প্রণয় এতো কাছে চলে আসবে সে ভাবেনি। মানুষ দেখলে কি মনে করবে? দ্রুত উঠে দাঁড়ালো সে। সামনে এগোতে নিলেই প্রণয় হাত টেনে ধরল। তুলির মনে হলো কেউ তার কলিজা ধরেই টান মেরেছে যেন। সে হাত ছাড়ানোর জন্য অস্ফুট স্বরে বলল,” প্লিজ!”

প্রণয় তীব্র গলায় বলল,” আগে উত্তর।”

” আমি এভাবে বলতে চাই না।”

” তাহলে কিভাবে বলতে চাও?”

তুলি চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল,” আপনার গাড়ি কোথায়? সেখানে চলুন।”

প্রণয় চোখ বড় করে তাকাল,” গাড়ির ভেতরে ঢুকে বলবে? মানে..”

প্রণয় আর কিছু বলার আগেই তুলি ঘুঁষি মারল তার পেটে। আৎকে উঠল প্রণয়। তুলি আছড়ে আছড়ে পা ফেলে চলে যেতে লাগল রাগী গতিতে। প্রণয় দৌড়ে তার পেছনে এসে বলল,” স্যরি, স্যরি, আই সুয়্যার আমি নেগেটিভ কিছু মিন করিনি। আচ্ছা চলো গাড়িতেই যাই।”

প্রণয় হাত ধরতে এলেই তুলি কড়া গলায় বলল,” খবরদার আমাকে ধরবেন না।”

প্রণয় কিছুটা তেজ নিয়ে বলল,” আচ্ছা, ধরবো না।” এই কথাটা বলেই সে দায়সারাভাবে সামনে হাঁটতে লাগল৷ তুলি মাথা মুড়িয়ে তার পেছন পেছন গেল।

____
বাড়িতে কেউ নেই। তন্বি শুধু একা। সূচি কলেজে গেছেন। আর রাইফা-তুলি কোচিং-এ। তন্বি বসে পড়াশুনা করছিল। আগামীকালই তার কোচিং-এ পরীক্ষা আছে। মাঝে ক্ষিদে পাওয়ায় সে রান্নাঘরে ঢুকল কিছু বানাতে। ঘরে নুডলস আছে। রান্না করার জন্য সবজি কাটতে বসল। তখনি কলিংবেল বাজল। তন্বি ঘড়ি দেখে ভাবল তুলিরা চলে এসেছে। তাই লুকিং গ্লাসে না তাকিয়েই দরজা খুলল এবং আকস্মিক হতভম্ব হলো। সামির দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। হাসিমুখে বলল,” কি খবর? ”

তন্বি চোখ বড় করে আওড়াল,” সামির ভাই! আপনি হঠাৎ কোনো খবর না দিয়ে চলে এলেন?”

সামির ভেতরে প্রবেশ করল। তার হাত ভরা জিনিস। মিষ্টি, দই, আইসক্রিম এনে হুলুস্থুল অবস্থা। তন্বির মাথায় কিছু ঢুকছে না। সামির চারপাশের নীরবতা লক্ষ্য করে বলল,” বাসায় কেউ নেই নাকি?”

” না। সবাই কাজে ব্যস্ত। তুলিরা কোচিং-এ। একটু পরেই চলে আসবে।”

” ও আচ্ছা।”

সামির সোফায় এসে বসল। তন্বির মাথায় প্রশ্ন ভো ভো করছে। কিন্তু সে সব প্রশ্ন অন্যপাশে রেখে জরুরী গলায় বলল,” চা খাবেন নাকি সামির ভাই?”

” নিশ্চয়ই খাবো। আনো চা!”

তন্বি চায়ের সাথে দই আর মিষ্টি পরিবেশন করল। সামির চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল,” আমি কেম হঠাৎ এসে গেলাম জানতে চাইলে না যে?”

তন্বি মসৃণ গলায় বলল,” এটা আবার জানতে চাইবো কেন? আপনি আমাদের বড়ভাই না? তাই নিশ্চয়ই আমাদের দেখতে এসেছেন!”

সামির তন্বির উত্তর শুনে সন্তুষ্ট হাসি দিয়ে বলল ” হ্যাঁ তা অবশ্যই। কিন্তু আরেকটা কারণও আছে।”

” কি কারণ?”

” আজমীরকে যে পুলিশে ধরেছে এই ঘটনা তো জানো?”

তন্বির মাত্র মনে পড়ল। সে সিরিয়াস হয়ে বলল,” ও। হ্যাঁ! আজমীর ভাই তো প্রণয় ভাইকে..”

তন্বি কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই সামির বলল,” সেই ঝামেলা মিটাতেই এসেছি।”

” কি করবেন?” তন্বি একটু ভয় পেল। সামির সহজ হেসে বলল,” উকিল ঠিক করতে হবে। জামিনের ব্যবস্থা করবো না? সেজন্য আর কি! এর আগে প্রণয় ছেলেটার সঙ্গে একটু দেখা করবো। তার অবস্থা কি বেশি খারাপ?”

” না, না, প্রণয় ভাই ভালো আছে।”

” যাক, তাহলে আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কি তার বাসার ঠিকানা আমাকে দিতে পারবে?”

” তুলি আসুক। সে তো রোজই ওই বাড়িতে যায়। আজ আপনাকেও নিয়ে যাবে।”

_____

গাড়িতে এসে চুপচাপ বসে আছে প্রণয় আর তুলি।দু’জনেই রাগী দৃষ্টিতে একে-অন্যের দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে নিল। তুলি হঠাৎ বলল, ” আপনি আমার সঙ্গে প্রেম করতে চান কেন?”

” হোয়াট? এটা কেমন প্রশ্ন?” প্রণয় অবাক। তুলি চিকন হাসি দিয়ে বলল,” এটা জরুরী প্রশ্ন। আগে উত্তর দিন।”

প্রণয় ধৈর্য্য ধরে দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। তারপর কোমল দৃষ্টিতে চেয়ে মিষ্টি গলায় বলল,” কারণ আই লভ ইউ।”

তুলি থতমত খেল। সে ঘাঁয়েল হয়ে যাচ্ছে কেন? সামান্য ‘ আই লভ ইউ’ শুনেই ঘাঁয়েল হওয়া চলবে না। পরে যদি পস্তাতে হয়? সে কঠিনভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল,” কেন আমাকে ভালোবাসেন? কোনো ভ্যালিড রিজন?”

প্রণয় যেন মহা চিন্তায় পড়ে গেল। আকাশ-পাতাল ভেবে বলল,” মেইবি আমি তোমার কোম্পানি খুব ইঞ্জয় করি। তুমি সাথে থাকলে আমার সবকিছু কালারফুল মনে হয়। আনন্দিত অনুভব হয়। মর্ণিং এর সানশাইন যেমন সুন্দর আমার কাছে তোমার উপস্থিতিও তেমনই সুন্দর।”

তুলি জড়ানো গলায় বলল,” এসব লিটেরেসি টাইপ কথা বলে আপনি আমাকে গলাতে পারবেন না। আমি অন্যদের মতো না।”

” জানি। তুমি হাইব্রিড,ওয়ান পিস। এজন্যই তো তোমাকে আমার পছন্দ।”

” আচ্ছা তাই নাকি? আমার একটা শর্ত আছে।”

” কি বিষয়ে শর্ত?”

তুলি ইতস্তত করে বলল,” আমি যখন আপনার মতো অনেক টাকার মালিক হয়ে যাবো, তখন আমরা প্রেম করবো।”

” মানে?”হতভম্ব হয়ে গেল প্রণয়। তুলি হাসিমুখে বলল,” হ্যাঁ। এটাই আমি আপনার কাছে চাই। সময়। আমার মতে, প্রেম করা উচিৎ সমানে সমানে। ভালো তো যে কাউকে বাসা যায়। কিন্তু প্রেম, বিয়ে এসবের জন্য স্ট্যাটাস অনেক ইম্পোর্ট্যান্ট। আমি ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে এক্সেপ্ট করতে পারবো না যতক্ষণ না আপনার সমান হচ্ছি।”

প্রণয় হকচকিয়ে বলল,” ওয়েট, ওয়েট, তুমি কি বলছো এসব? আমার মাথায় ঢুকছে না।”

” খুবই সহজ। আমি আপনাকে ভালোবাসি।”

” কি?” প্রণয়ের চোখে খুশির ঝিলিক। তুলি তাকে শান্ত করে বলল,” হ্যাঁ ভালোবাসি কিন্তু ভালোবাসলেই প্রেম করতে হবে, বিয়ে করতে হবে এমন নিয়মে আমি বিশ্বাস করি না। ভালোবাসাটা মনের ব্যাপার। কিন্তু প্রেম, বিয়ে এসব সামাজিক ব্যাপার। মানুষ ভাববে আপনি বড়লোক তাই আমি আপনার গলায় ঝুলে পড়েছি। এসব শুনে আমি প্রেম করতে পারবো না।”

প্রণয় হেসে ফেলল ফিক করে। তুলি চোখ বড় করে তাকাল। প্রণয় বলল,” মানুষ কি বলবে না বলবে এইটা চিন্তা করে তুমি নিজের লাইফের ডিসিশন কেন নিবে তুলি? এটা খুবই অদ্ভুত চিন্তা তোমার।”

” একদমই অদ্ভুত না। এটা আমার এইম। আমার স্বপ্ন। আমি যাকে বিয়ে করবো সে আমার থেকে বড় হতে পারবে না। সমাজে আমাদের দু’জনের স্ট্যাটাস থাকবে সমানে-সমান। তাই আমি যতদিন অবধি আপনার সমান হতে না পারছি ততদিন প্রেমও করবো না, বিয়েও করবো না। গট ইট? আমার কথা শেষ। এখন আমি যাই।”

” তুলি…”

” প্লিজ আমাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করবেন না। আমি যা বলার বলে দিয়েছি। এখন আমি গেলাম।”

” কিন্তু আমাকে একটা নির্দিষ্ট টাইম তো দাও! কতদিন ওয়েট করতে হবে?”

” আমি নিজেও জানি না। আমার ভাগ্যের উপর ডিপেন্ড করছে। দোয়া করবেন যেন খুব দ্রুত বড়লোক হয়ে যেতে পারি। যখন আপনার মতো আমিও সমান সম্পত্তির মালিক হবো তখনি আমি আপনার প্রপোজ্যাল এক্সেপ্ট করবো। এর আগে প্লিজ ডন্ট ডিস্টার্ব মি। পড়াশুনা করতে দিন আমাকে।”

তুলি দ্রুত বের হয়ে গেল। প্রণয়ের মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ভনভন করে ঘুরছে। সে নিজের সম্পত্তির হিসাব কষতে লাগল। প্রণয়দের সমান সম্পত্তি যদি তুলি উপার্জন করতে যায় তাহলে আগে প্রণয়ের বাপ, তারপর দাদা তারপর বড়দাদা, সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে হবে। এতো এতো টাকা উপার্জন করতে যুগের পর যুগ কেটে যাবে। ততদিনে হয়তো প্রণয় মরে ভূত হয়ে যাবে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here