বেদনার রং নীল পর্ব -২৯+৩০

#বেদনার_রঙ_নীল
উনত্রিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

হালকা একটা স্নিগ্ধ সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সারা ঘর জুড়ে। রাইফা মোহিত হচ্ছে সেই সুগন্ধে ক্ষণে ক্ষণে। রিসব তার সামনে বসে কফি পরিবেশন করায় ব্যস্ত। এই মানুষটির কফি খাওয়া নিয়ে এতো ফেসিনেশন, যা রাইফার অনেক ভালো লাগে। আসলে মানুষটির সবকিছুই তো রাইফার ভালো লাগে! তবে তার লজ্জাও লাগছে। নিজের চোখ দু’টোকে মনে হচ্ছে চৌম্বক আর রিসবকে মনে হচ্ছে লোহা। কিছুতেই সে চোখ সরাতে পারছে না! রিসব কি ভাববে এমন ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকলে?

রাইফার দিকে কফি বাড়িয়ে রিসব বলল,” মিষ্টি আপু মায়ের সাথে নরসিংদী গেছে। আজকে নাও ফিরতে পারে।”

রাইফা একটু অবাক হয়ে তাকাল। তারপর কফিটা নিয়ে চুমুক দিতে দিতে প্রশ্ন করল,” এই কথা আমাকে কেন বলছেন? মিষ্টি আপু না এলে আমাকে কি কোনো কাজ করতে হবে? রান্না করতে হবে?”

রিসব মৃদু হেসে ফেলল। তারপর বলল,” তোমাকে এই কথা বললাম কারণ তুমি প্রথমে বলেছিলে মিষ্টি আপুর কাছে এসেছো! তাই জানালাম যে মিষ্টি আপু নেই।”

রাইফা জীভ কাটল। লজ্জায় অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” স্যরি। মিথ্যা বলেছিলাম।”

তারপর দ্রুত নিচের দিকে তাকিয়ে গেল সে। তার কান গরম হয়ে গেছে। রিসব হাসিমুখে বলল,” আমি জানি তুমি মিথ্যা বলেছো।”

” কিভাবে জানেন?” রাইফার গলা শুকিয়ে গেলো এবার।

” মিষ্টি আপুর সঙ্গে দেখা করতে এসে আমার ঘরে বসে আছো, ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত না?”

রাইফা লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা মুড়লো। অস্বস্তিতে শরীর কাটা দিচ্ছে আবারও। রিসব কেন সব বুঝে যায়? আজ পর্যন্ত এই মানুষটির সাথে সে কখনও মিথ্যা বলে পার পায়নি। রাইফা যেন মানুষটির কাছে ‘খোলা বই’ এর মতো। সে রাইফার দিকে চাইলেই চোখের পলকে সব বুঝতে পেরে যায়। সে এটাও জানে যে রাইফা তাকে কত ভালোবাসে! তার জন্য কত পাগল রাইফা! কিন্তু কখনও পাত্তা দিল না তো!

” আপনি আমার উপর কয়দিন রেগে থাকবেন এভাবে?” খুব অসহায়ের মতো প্রশ্নটা করে বসল রাইফা৷ রিসব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল এবং উত্তরে বলল,” আমি তোমার উপর রেগে নেই, রাইফা! কেন রেগে থাকবো?”

” তাহলে আগের মতো আমার সাথে হেসে কথা বলছেন না কেন? প্রিয়ন্তী আপুর ঘটনাটার পর থেকেই এমন করছেন আপনি।” রাইফা অভিযোগ জানিয়ে মুখ গোমরা করে তাকিয়ে রইল।

রিসব বোঝানোর মতো বলল,” তুমি যেটা করেছো সেটা অন্যায়। আমি জানি তুমি একটু পাগলাটে কিন্তু তাই বলে কারো সাথে অন্যায় করতে পারো না। এসব আমি তোমার থেকে এক্সপেক্ট করিনি। আমি শকড! কাউকে ধরে পেটানো কোনো ভালো কাজ না। তুমি ভেবেছো কেউ তোমাকে চিনতে পারবে না। কিন্তু তুমি নিজে তো নিজেকে চিনেছো! একবারও কি নিজের কাছে অন্যায় মনে হয়নি? এই কাজটা তুমি কি করে করলে?”

রাইফার চোখে অশ্রু টলমল করছে। রিসব আঙুল উঠিয়ে বলল,” দেখো, কাঁদবে না!”

রাইফা নিজেকে ধাতস্থ করল। তীব্র অভিমান নিয়ে আওড়ালো,” কাঁদবো কেন? একদম কাঁদছি না আমি।”

রিসব গম্ভীর মুখে বলল,” হুম।”

রাইফা নরম কণ্ঠে আগের মতো আবারও বলল,” স্যরি। কিন্তু আমার প্রিয়ন্তী আপুর উপর অনেক রাগ হচ্ছিল। আমি রাগের মাথায় এটা করেছি। কিন্তু তার ক্ষতি করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না, বিশ্বাস করুন! আমি শুধু তাকে একটু ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম। আর তুলিও তো আমাকে সাহায্য করেছে!”

রিসব হঠাৎ অন্য প্রসঙ্গ টেনে আনল,” একটা প্রশ্ন করি তোমাকে?”

” কি প্রশ্ন?”

রিসব কৌতুহলবশত জানতে চাইল,” তুলি আর প্রণয়ের মধ্যে কি সম্পর্ক? ”

” প্রণয় তুলিকে ভালোবাসে..”

” আর তুলি? সেও কি ভালোবাসে?”

রাইফা বিভ্রান্তি নিয়ে বলল,” তুলির ব্যাপারে আমি শিওর না।”

” হুম…” রিসব যেন একটা জটিল ভাবনায় ডুবে গেল। রাইফা একটু রেগে বলল,” এসব আপনি কেন জানতে চাইছেন? আমরা কি বিষয়ে কথা বলছিলাম?”

” কি বিষয়?”

রাইফা নাকের জল আর চোখের জল মুছে বলল,” আপনি কি করলে আমাকে ক্ষমা করবেন?”

” আমি তোমাকে ক্ষমা করার কেউ না। তুমি নিজের কাছে ক্ষমা চাও।”

রিসবের জায়গায় অন্যকেউ থাকলে রাইফা এই মুহূর্তে কাঁচের কফির কাপ ভেঙে ফেলতো। তার এতোই রাগ হচ্ছে! তার চেয়েও বেশি হচ্ছে কষ্ট। প্রিয়ন্তীকে সে এতো অপছন্দ করে, অথচ প্রিয়ন্তীর জন্যই রিসব তার সাথে শক্তভাবে কথা বলছে। এটা কি মেনে নেওয়া যায়? এই মানুষটির সামনে কোনোপ্রকার ধৃষ্টতা সে করতে পারবে না। তাই ব্যাগ নিয়ে চলে যাওয়ার সময় তীক্ষ্ণ গলায় বলল,” আমি একটা কাজে আপনার কাছে এসেছিলাম। যা আপনার জন্য না হলেও আমার জন্য খুবই জরুরী। এই কাজটি না করতে পারলে হয়তো মরেও শান্তি পেতাম না। এজন্যই বুঝি আল্লাহ আমাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন!”

রাইফার চোখে ভেসে উঠল আবার সেই ট্রাক এক্সিডেন্টের ঘটনাটি৷ রিসব কি সেই ঘটনার কথা জানে? আরেকটু হলেই যে রাইফা দুনিয়া থেকে চলে যেতো এই কথা শুনলে কি সে একটুও বিচলিত হবে না? নাকি তার কিছুই যায়-আসবে না? রাইফার মনের অবস্থা নিয়েও তো তার কিছুই যায়-আসে না। সে কখনও বুঝেনি। রাইফা কেন প্রিয়ন্তীকে আঘাত করেছে, সেটাও বুঝেনি। সে কি কোনোদিন বুঝবে না? নাকি বুঝতেই চায় না?

রিসব ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাল। রাইফা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। রিসব প্রশ্ন করল ভ্রু কুচকে,” কি বলতে এসেছিলে? আচ্ছা, বলে যাও।”

” থাক। আপনার শুনতে হবে না।”

এই কথা বলেই সে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। রিসব তাকে ডাকল না কেন? সে আর কখনও এই মানুষটির সামনে যাবে না, ধ্যাত!

______
তুলি রিকশা থেকে নামল। যথারীতি প্রণয়ও তাকে অনুসরণ করতে করতে এসেছে৷ সে দ্রুত গাড়ি থেকে বের হয়ে ডাকল,” তুলি দাঁড়াও।”

তুলির দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না। সে এক দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে যাওয়ার সময় প্রণয় হাত বাড়িয়ে তাকে থামাল। গেইটের দারোয়ান আগ্রহ নিয়ে এদিকে দেখছে। তুলি ক্ষীপ্ত কণ্ঠে বলল,” কি ব্যাপার? আপনি কেন সিন ক্রিয়েট করছেন?”

” তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে।”

” আমাদের কথা শেষ হয়ে গেছে। আমার যা বলার ছিল আমি বলে এসেছি। দেখা হবে বিজয়ের দিন!”

তুলির ঠোঁটে ঝকঝকে হাসি ফুটল। যেন সে নিশ্চিত, একদিন তার বিজয় হবেই! প্রণয় চোয়াল শক্ত করে নিজেকে ধাতস্থ রেখে বলল,” এটা সম্ভব না৷ আমরা বুড়ো হয়ে কবরে চলে যাবো তখন কি আমাদের নাতি-নাতনিরা বিয়ে করবে?”

তুলি কপাল কুচকে বলল,” কি বলছেন আপনি এসব? আপনার কি আমার উপর বিশ্বাস নেই? আমার কি কোনো যোগ্যতা নেই?”

” অবশ্যই আছে। কিন্তু এটা খুবই অদ্ভুত। বোঝার চেষ্টা করো, প্লিজ, প্লিজ!”

প্রণয় হাতজোড় করল৷ তুলি অনড় হয়ে বলল,” যা বলেছি তাই। অপেক্ষা করতে পারলে করুন নাহলে আপনি প্রিয়ন্তীর কাছে চলে যান৷ তাকে বিয়ে করে সুখে থাকুন৷ আর আমাকে বিয়েতে দাওয়াত করবেন অবশ্যই।”

তুলি এই কথা বলে চলে যেতে নিলেই প্রণয় তার হাতের বাহু টেনে ধরল। ব্যস্ত হয়ে বলল,” এই দাঁড়াও, দাঁড়াও। এখানে প্রিয়ন্তী কোথা থেকে এলো?”

তুলি আশেপাশে তাকিয়ে বলল,” আমার হাত ছাড়ুন।”

প্রণয় হাত ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর প্রশ্ন করল আবারও, ” প্রিয়ন্তীর কথা কেন বললে?”

” কারণ আমার মনে হয় প্রিয়ন্তী আপনাকে ভালোবাসে!”

” প্রিয়ন্তী জাহান্নামে যাক। আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছে। তুমি ওকে টেনে আনবে কেন এখানে?”

” আমাদের মধ্যে কথা শেষ। সমান না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করছি না আমি।”

প্রণয় আপাতত মেনে নিয়ে বলল,” আচ্ছা৷ আমি না হয় বিয়ের জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করবো। কিন্তু প্রেম করতে অসুবিধা কোথায়?”

তুলি কানের পিঠে চুল গুজে বলল,” যেই প্রেমে বিয়ের গ্যারান্টি নেই সেই প্রেম করে লাভ কি বলুন? আগে আমার ফিউচার গ্যারান্টেড হোক, তাহলেই প্রেম করবো। বিয়ের শপথ নিয়ে তারপর হবে প্রেম। আমি যেনো-তেনো প্রেম করতে রাজি না।”

প্রণয় মাথা চেপে ধরে বলল,” অদ্ভুত মেয়ে তুমি একটা! পাগল বানিয়ে ছাড়বে নাকি আমাকে?”

তুলি হাসতে হাসতে বাড়িতে ঢুকে গেল। প্রণয় চেঁচিয়ে বলল,” তোমার মত না বদলানো পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করবো।”

” এই মত কখনোই বদলাবে না। তাই অপেক্ষা করে লাভ নেই।” তুলি লিফটে উঠে গেল। প্রণয় রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল,” তাহলে অপেক্ষা করবো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। কি আর করার? তোমাকে না পেলে তো এমনিও মরতে হবে। তার চেয়ে তোমাকে পাওয়ার আশা নিয়ে জীবিত থাকাই ভালো। অন্তত আশা তো থাকল! ”

কলিংবেল বাজতেই তন্বি চঞ্চল কণ্ঠে বলল,” ওইতো, তুলিরা এসে গেছে।”

সামির হাসল। দরজা খুলতে উঠে গেল তন্বি। তুলি ভেতরে প্রবেশ করলেই সে বলল,” রাইফা আসেনি?”

তুলি অবাক হয়ে তাকাল,” মানে কি? রাইফা বাসায় নেই?”

” নাতো! ওর কোচিং ছিল না আজ?”

” ও তো কোচিং-এ যায়নি। ওর নাকি ঘুম আসছিল! তাই আমি ভাবলাম বাসায় চলে আসবে কিন্তু আসেনি?”

” একদম আসেনি।”

তুলি চিন্তিত হয়ে উঠল। এই মেয়েটা এমন করে কেন? খানিক অস্থিরতা নিয়ে বলল,” মোবাইল দে তন্বি। রাইফাকে ফোন করতে হবে।”

তন্বি নিচু গলায় বলল,” সামির ভাই এসেছে।”

” কি?”

তুলি ড্রয়িংরুমে এগিয়ে এলো। সামির সোফায় বসে আছে। আশ্চর্য হয়ে সামান্য হাসল তুলি।

” আরে সামির ভাই, কি খবর?”

” খবর ভালো না। আজমীরকে পুলিশ ধরেছে। আমি কিভাবে ভালো থাকি বলো?”

তুলির চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল আজমীরের কথা মনে হতেই। সে খিটমিটে মেজাজে বলল,” আপনার ভাই যা করেছে তাতে ওর ফাঁসি হলেও আমার আফসোস লাগবে না!”

” এভাবে বলছো কেন তুলি?”

তুলি হাতের ব্যাগ ছুঁড়ে সোফায় ফেলে চিৎকার করল,” তো আর কিভাবে বলবো? আপনি জানেন আপনার ভাই প্রণয়ের সাথে কি করেছে? প্রণয় মরেও যেতে পারতো!”

” জানি। আমি সবই জানি। সেজন্য আমি প্রণয়ের কাছে ক্ষমা চাইবো।”

তুলি তাচ্ছিল্য হাসল। তারপর তন্বির দিকে একবার তাকিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে গেল। সামির নিরাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল। তন্বি সামিরের পাশে বসে বলল,” কিছু মনে করবেন না সামির ভাই।”

সামির আফসোস করে বলল,” আজমীর খুব খারাপ একটা কাজ করেছে। কিন্তু কি করবো? শত হলেও ভাই হয়। তাকে তো এইভাবে ফেলে দিতে পারি না।”

তন্বি প্রশান্ত কণ্ঠে বলল,” আমি আপনাকে প্রণয় ভাইয়ের বাড়িতে নিয়ে যাবো৷ আমি চিনি ওই বাড়ি। কিচ্ছু চিন্তা করবেন না।”

______

তুলি ঘরে ঢুকে তার ডায়েরী হাতে নিল। তন্বি ঢাকায় আসার সময় তুলির সব প্রিয় জিনিস সঙ্গে এনেছিল। এই ডায়েরীটাও তুলির একান্ত প্রিয় জিনিসগুলোর একটি। সে ডায়রীর চিহ্নিত জায়গাটি খুলে সাদা কাগজে লিখল,” আমি বড়লোক হওয়ার পর আজমীর ভাইকে খু*/ন করবো।”

তারপর অন্য পৃষ্ঠায় লিখল,” প্রণয়কে বিয়ে করবো যদি ততদিন সে অপেক্ষায় থাকে। আর যদি সে আমার অপেক্ষায় না থাকে, তাহলে আমি কোনোদিন বিয়েই করবো না।”

এই লেখাটা লেখার সময় তুলির চোখ থেকে টুপ করে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। অশ্রুর ছাপ লেগে রইল সাদা কাগজে। তুলি ডায়রী বন্ধ করে গোসলে ঢুকল। তার ক্ষিদেও পেয়েছে খুব। মনখারাপ থাকলে বেশি বেশি ক্ষিদে পায় কেন?

চলবে#বেদনার_রঙ_নীল
ত্রিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

প্রণয় বাড়ি ফিরে দেখল রাইফা বসে আছে তার ঘরে। দুইহাত মুখে ঠেকিয়ে অবিরাম কেঁদে চলেছে মেয়েটা। প্রণয় ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে রাইফা?”

রাইফা রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। রাগে কড়মড় করে বলল,” আই হেইট ইউর ভাইয়া।”

প্রণয় হেসে ফেলল। হাতঘড়ি খুলে টেবিলে রাখতে রাখতে পরামর্শ দিল,” এটা রিসবের কাছে গিয়ে বলো। আমাকে শুনিয়ে লাভ কি?”

” হুম। বলবো। এই কথা শুনলে তো সে খুশিই হবে। সে আমাকে সহ্যই করতে পারে না। আর তোমরা কি-না আমার সাথে তার বিয়ের কথা ভাবছো?”

প্রণয় একটু চিন্তিত হয়ে কপাল কুচকাল। রাইফার পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করে ফেলল,” আবার কিছু হয়েছে নাকি?”

” আমি আর তুলি মিলে প্রিয়ন্তীকে উদুম কেলানি দিয়েছিলাম। হসপিটালের বাথরুমে। সেই ঘটনা তোমার ভাইয়া জানতে পেরে এখন আমার সাথে গম্ভীর হয়ে কথা বলে। রাগ দেখায়। তার কাছে প্রিয়ন্তী কেন এতো ইম্পোর্ট্যান্ট?”

প্রণয় হাসতে লাগল। রাইফা বিচলিত গলায় বলল,” তুমি প্রিয়ন্তীর কথা শুনে অবাক হলে না?”

” তুলি আজকেই আমাকে বলেছে ঘটনা। আমার খুব হাসি পেয়েছে। তোমরা কি করলে এটা? সো সিলি!”

” শাটআপ৷ একদম ঠিক করেছি। প্রিয়ন্তীর জন্য এটাই ঠিক আছে। ও তোমার ভাইয়ার নাক ধরে টানছিল। আমি কখনও পারবো? যেটা আমি পারবো না সেটা অন্যকেউ আমার চোখের সামনে করে বেড়াবে আর আমি সহ্য করবো? ওকে যে আমি মার্ডার করে দেইনি এটাই ওর সৌভাগ্য!”

” ওরে বাপরে! এতো রাগ? তুলিও কি এমন রেগেছিল?”

রাইফা সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” তুলি ওকে এমনভাবে মারছিল যা দেখে আমিই ভয় পেয়ে গেছি।”

প্রণয়ের মুখে স্বস্তির হাসি। চোখ দু’টি চিকচিক করছে। একটা অদ্ভুত গৌরব অনুভব হচ্ছে। তুলি তার ব্যাপারে সেন্সিটিভ, এই বিষয়টা প্রণয় খুব শান্তি দিচ্ছে। রাইফা খুঁচিয়ে প্রশ্ন করল,” তুমি এতোক্ষণ তুলির সাথে ছিলে নাকি?”

” হুম।”

” ওয়াও, তারপর কি হলো আজ?”

প্রণয় খানিকটা রাগ আর খানিকটা হতাশা নিয়ে বলল,” তোমার বেস্টফ্রেন্ড আমাকে পাগল না বানিয়ে থামবে না রাইফা!”

“তোমার ভাইয়াও আমাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে বাই দ্যা ওয়ে। আবার কি করেছে তুলি?”

” এখন সে বড়লোক হতে চায়।”

প্রণয় এই কথা বলেই বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। যেন খুব ক্লান্ত সে। রাইফা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। প্রণয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,” সে বড়লোক হতে চাইলে তোমার প্রবলেম কি? এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার!”

প্রণয় কাতর গলায় বলল,” ব্যক্তিগত ব্যাপার হলে ভালোই ছিল। কিন্তু সে আমার জীবন নিয়ে টানা-টানি করছে। ভবিষ্যতে আমি বেঁচে থাকবো কি-না, বিয়ে করতে পারবো কি-না, বাচ্চার বাপ হতে পারবো কি-না সব ডিপেন্ড করছে তুলির বড়লোক হওয়ার উপর৷ আমি ডিপ্রেসড হয়ে যাচ্ছি। দেখা যাবে তুলি বড়লোক হতে হতে আমি ডিপ্রেশনের পেশেন্ট হয়ে হাসপাতালে গড়াগড়ি করছি।”

রাইফা পুনরায় বিছানায় বসে গোমরা মুখে বলল,” বুঝিয়ে কথা বলো৷ মাথায় কিছু ঢুকছে না।”

প্রণয় ফট উঠে বসে বলল,” আমারও মাথায় কিছু ঢুকছে না। রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি কি বলতে পারো?”

” লটারী!”

প্রণয়ের মুখে চওড়া হাসি ফুটল। উৎফুল্ল কণ্ঠে উচ্চারণ করল সে,” গুড আইডিয়া! আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। কিন্তু তোমার হেল্প লাগবে রাইফা।”

রাইফা গালে হাত রেখে বলল,” ঠিকাছে হেল্প করবো। কিন্তু আমাকেও হেল্প করতে হবে।”

” ভাইয়ার ব্যাপারে? আচ্ছা, হেল্প করবো।”

” ওকে, ডিল ফাইনাল। আমরা দু’জনই দু’জনকে হেল্প করবো।”

______
সূচি বাড়ি ফিরে সামিরকে দেখে খুশিই হলেন। কিছুক্ষণ তাদের মাঝে কুশল বিনিময় হলো। আজমীরের ব্যাপারেও কথা হলো। লাঞ্চের সময় পেরিয়ে আসছিল। রাইফা তখনও ফেরেনি। সূচি মোবাইল হাতে নিল রাইফাকে ফোন করতে তখনি কলিংবেল বাজল। রাইফা চলে এসেছে। সূচি জিজ্ঞেস করলেন,” কোথায় ছিলে? তুলি বলল তুমি নাকি কোচিং-এ যাওনি?”

রাইফা হাই তুলে উত্তর দিল,” না৷ শরীর ভালো লাগছিল না। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম।”

তন্বি ফিসফিসিয়ে বলল,” ডাক্তারের নাম কি মিস্টার রিসব? পাহাড় থেকে পিএইচডি করে এসেছে যে?”

রাইফা চোখ বড় করে তাকাল। সূচি কথাটা পুরোপুরি শুনতে পেলেন না। কিন্তু সন্দেহ প্রকাশ করলেন,” তন্বি, কি বললে?”

তন্বি পাশ কাটানো গলায় বলল,” কিছু না আন্টি। এমনি পড়াশুনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিলাম৷ কোন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করা ভালো হবে?”

” এখন এডমিশনের প্রিপারেশন নাও। পিএইচডি অনেক দেরি আছে।”

তন্বি এবার রাইফার দিকে তাকিয়ে বলল,” বুঝেছিস? পিএইচডি অনেক দেরি। আপাতত এডমিশনের প্রিপারেশন নে।”

রাইফা রাগান্বিত গলায় বলল,” তোকে রিসবের ব্যাপারে কে বলেছে? তুলি?”

তন্বি উত্তর না দিয়ে ফিচেল হাসি দিল। রাইফা তার পিঠে চাপড় মারল। দুপুরে সবাই একসঙ্গে লাঞ্চ করছিল। তখন তন্বি বলল,” সামির ভাই প্রণয়ের সাথে দেখা করতে এসেছে। প্রণয় যদি কেইসটা তুলে নেয় তাহলে আজমীর ভাইকে ছাড়ানো সহজ হবে।”

তুলি উত্তর দিল না। গম্ভীর হয়ে ভাত খেতে লাগল। সূচি তুলির দিকে চেয়ে বললেন,” আজকে তুমি টিউশনে যাবে না তুলি? তখন সামিরকেও নিয়ে যেও।”

তুলি দ্রুত খাওয়া শেষ করে বলল,” আমি কোথাও যাবো না আজকে। আমার শরীর ভালো নেই। তাই আমি ঘুমাবো। এক্সকিউজ মি।”

সে ঘরে চলে গেল। সামির বুঝতে পারল তুলি তাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে ইচ্ছুক না৷ কিন্তু তন্বি বলল,” আমি আপনাকে সন্ধ্যায় নিয়ে যাবো। তখন প্রণয় ভাই বাসায়ই থাকে। নয়তো ফোন করে যাবো।”

সামির নরম হেসে বলল,” থ্যাঙ্কিউ তন্বি।”

রাইফা খেয়াল করল, তুলির আজ ভীষণ মনখারাপ৷ সামির এখানে এসেছে এই জন্য নাকি প্রণয়ের জন্য? বিকালে রাইফা তুলিকে শপিং-এ যাওয়ার প্রস্তাব দিল,” তুলতুলি, চল ঘুরে আসি।”

” কোথায় যাবো?”

” শপিং-এ। যমুনা ফিউচার পার্কে যাই চল।”

” না। আমার ভালো লাগছে না।”
” তুই এমন রোবটের মতো কথা বলছিস কেন আজকে? তোর গলার আওয়াজ কেমন যেন ভারী ভারী লাগছে। মনে হচ্ছে তুই এখনি কেঁদে ফেলবি।”

তুলি শোয়া থেকে উঠে বসল। রাইফার কাছে প্রকাশ করল তার মনের কষ্ট, ” আমি আজ প্রণয়কে আমার এইম লাইফের কথা বলে দিয়েছি রাফু।”

রাইফা মুচকি হাসল। সে তো আগেই জানে। প্রণয়ের থেকে সব শুনেই এসেছে। তবুও জিজ্ঞেস করল,” প্রণয় কি বলেছে? সে কি অপেক্ষা করবে?”

তুলি টলমল চোখে বলল,” জানি না। আমার মনে হয় অপেক্ষা করবে না। কিন্তু তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। আমি আমার লক্ষ্য পূরণ করবোই। একদিন দেখবি আমার অনেক টাকা হবে। আমি টাকার বিছানায় শুয়ে থাকবো। সবাই আমাকে সমীহ করবে। কেউ আঙুল তুলে কথা বলার সাহস করবে না কারণ আঙুল ভেঙে যাওয়ার ভয় থাকবে তাদের।”

তুলির চোখ অশ্রুপূর্ণ হলেও কণ্ঠ তেজস্বী। রাইফা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” তোর স্বপ্ন নিশ্চয়ই সত্যি হবে।”

______

সন্ধ্যায় তন্বি সামিরকে নিয়ে চলে গেল প্রণয়দের বাড়িতে। আর রাইফা-তুলি গেল শপিং-এ। যমুনা ফিউচার পার্কে ঢুকে তারা সর্বপ্রথম আইসক্রিম খেল৷ তারপর কিছুক্ষণ ছবি তোলাতুলি হলো। পরে তারা চলে গেল আড়ং-এর আউটলেটে। অনেক লেটেস্ট ডিজাইনের জামা-কাপর ঘুরে-ফিরে দেখছিল তুলি। যদিও এগুলো কেনার মতো সামর্থ্য তার নেই। কিন্তু একদিন সে সব কিনে ফেলবে এমন কল্পনা করেই দেখা। রাইফা অনেকগুলো জামা নিয়ে ট্রায়ালরুমে ঢুকেছে। সে কমপক্ষে চার-পাঁচটা কিনবেই। তুলির দৃষ্টি আটকে গেল একটি দৃষ্টিনন্দন পোশাকে। কামিজটি এতো এলিগ্যান্ট আর চমৎকার যে তুলির চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। সে কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে সরে যেতে নিলেই একজন সেলস গার্ল বলল,” ম্যাম, ড্রেসটা ট্রায়াল দিয়ে দেখবেন? আমাদের এক্সক্লুসিভ কালেকশন এটা। মাত্র পাঁচ পিস আছে।”

তুলি ইতস্তত হাসি দিয়ে বলল,” একদম না। এই ড্রেসের প্রাইজ নিশ্চয়ই অনেক বেশি হবে। আমার এতো টাকা নেই।”

মুখ মলিন করে কথাটা জানিয়ে তুলি চলে যেতে নিলেই সেলসগার্ল তার হাত চেপে ধরল৷ তুলি একটু অবাক হলো। বিব্রতবোধ করল। সেলসগার্ল উৎসাহী কণ্ঠে বলল,” আপনি চাইলেই এটা নিতে পারেন ম্যাম। আমাদের এখানে ‘লাক হান্টিং’ সেশন চলছে। এই এক্সক্লুসিভ পাঁচটি ড্রেসের মধ্যে একটা কিনলেই পেয়ে যেতে পারেন চল্লিশ লক্ষ টাকা।”

তুলি হকচকিয়ে বলল,” কি? চল্লিশ লক্ষ?”

তার গলা শুকিয়ে গেল। এতোটাকার কথা শুনতেও কেমন যেন লাগে। তবে শরীরে জোশ চলে আসে। তুলি একটু সাহস করে বলল,” ড্রেসটার দাম কত?”

সেলসগার্ল প্রাইজট্যাগ বের করে দেখালো। তুলির কিঞ্চিৎ উৎসাহটুকু সাথে সাথেই নিভে গেল দাম দেখে। হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে সে বলল,” বিয়াল্লিশ হাজার টাকা! এটা অনেক দামী। আমার উপযুক্ত নয়। আপনাদের এই ‘লাক হান্টিং’ সেশন বড়লোকদের জন্য। যে বিয়াল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে একটা ড্রেস কিনতে পারে তার কাছে তো চল্লিশ লক্ষ টাকা কোনো ব্যাপারই না।”

” ম্যাম, আপনি ট্রাই করে দেখুন। আপনার ভাগ্যে থাকতেও পারে! ”

” কিন্তু আমার কাছে বিয়াল্লিশ হাজার টাকা নেই!”

” ম্যাম আপনি যদি চল্লিশ লক্ষ টাকা জিতে যান তাহলে সেখান থেকে বিয়াল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে বিল পেমেন্ট করে দিবেন। আর বাকি টাকা আপনার! তাহলেই হয়ে গেল। দারুণ সুযোগ কিন্তু।”

তুলি তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলল,” আর যদি আমি টাকা না জিতি?”

সেলসগার্ল বিভ্রান্ত হয়ে তাকাল। তুলি আর কিছু না বলে চলে এলো। তখন রাইফা তার হাত টেনে বলল,” এই গাধী, অফারটা মিস করলি কেন? তোর না বড়লোক হওয়ার খুব শখ? একবার চেষ্টা করে দেখলেই তো পারিস!”

তুলি মনখারাপ নিয়ে বলল,” কিন্তু আমি টাকা না জিতলে পরে বিয়াল্লিশ হাজার টাকা কিভাবে দিবো? পুলিশ এসে আমাকে কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নিয়ে যাবে।”

” কেউ তোকে থানায় নিবে না। তুই না জিতলে বিয়াল্লিশ হাজার টাকা আমি দিয়ে দিবো। প্রয়োজনে আম্মুর কাছে চাইবো।”

তুলি মুখ শক্ত করে বলল,” আমি তোর টাকা কেন নিবো?”

” তোর নিতে হবে না। তুই লটারী না জিতলে এই ড্রেস আমাকে দিয়ে দিস। আমি পরবো। তাহলেই হয়ে গেল।”

” দরকার নেই রাইফা। আমি জানি এসবে কিছু হবে না। আমার মতো অভাগীর আবার লটারীতে ভাগ্য লাগবে? ইম্পসিবল!”

” নাথিং ইজ ইম্পসিবল!”

রাইফার জোরাজুরিতে অবশেষে তুলি জামাটা কিনতে রাজি হলো। তারপর তাদের রিসেপশনে ডাকা হলো। একটা স্ক্র্যাচ কার্ড লাগানো ছিল জামার সঙ্গে। সেই স্ক্র্যাচ কার্ড ঘঁষে নাম্বারটা মিলাতে হবে সাইনবোর্ডে দেওয়া নাম্বারের সাথে। আউটলেটে যত মানুষ ছিল, সবাই ভীড় জমিয়ে দাঁড়ালো। মুহূর্তেই একটি চাঞ্চল্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেল। তুলির দেখাদেখি আরও অনেকেই ড্রেসটা কিনল। পাঁচ পিস অনায়াসে বিক্রি হয়ে গেল। কিন্তু দূর্ভাগারা কেউ জানল না, এই লটারী কেবল নির্দিষ্ট একজনের জন্যেই বরাদ্দ ছিল৷ যে মেয়েটি তার ভাবনার চেয়েও অধিক ভাগ্যবতী ছিল।

_____

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here