বেদনার রং নীল পর্ব -৩১+৩২

#বেদনার_রঙ_নীল
একত্রিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

রিকশায় আটসাঁট হয়ে বসে আছে সামির-তন্বি। সামির খুব স্বাস্থ্যবান হওয়ায় বসার জন্য তার জায়গা বেশি প্রয়োজন। তন্বি সেই তুলনায় শুকনো কাঠির মতো। তার অর্ধেকেরও কম জায়গা লাগে বসতে। ব্যালেন্স হয়ে যাওয়ার কথা। তবুও তন্বির মনে হচ্ছে, বেশি চাপাচাপি। সামিরের উরুর সাথে তার উরু ঘঁষা খাচ্ছে। কি বিশ্রী ব্যাপার! তন্বি অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল,” আস্তে চালান, মামা।”

সামির ভ্রু কুচকে বলল,” জোরেই চলুক। আমার কিছু ভালো লাগছে না। আজমীর হারা*মজাদাকে জুতাপেটা করতে পারলে ভালো লাগতো।”

তন্বি আহত কণ্ঠে বলল,” আপনি শান্ত হোন, প্লিজ।”

সামির স্বগতোক্তির মতো বলতে লাগল,” প্রণয় ছেলেটা ভদ্র। এতোকিছু হয়ে যাওয়ার পরেও বলছে মামলা তুলবে। অন্যকেউ হলে ঝামেলা করতো। আজমীর এইরকম ঘটনা আরও কতবার ঘটিয়েছে, জানো? এমন না যে এইটাই প্রথম। তার মানুষ মে/রে ফেলার খুব শখ। দিন দিন জানোয়ার হয়ে যাচ্ছে। বাবা তো এখন ওর পেছনে একটা পয়সাও খরচ করতে রাজি না। আমি এতোদূর থেকে কষ্ট করে এসেছিলাম ওকে বাঁচানোর জন্য। অথচ সে কি করল আমার সাথে দেখলে? বেইমান!”

তন্বির চোখ টলমল করছে। সামির খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে কথাগুলো বললেও তার বুকভরা ব্যথা উপলব্ধি করা যাচ্ছে। তন্বির কষ্ট হচ্ছে।

আজ প্রণয়ের সঙ্গে দেখা করতে তার বাড়িতে গিয়েছিল সামির আর তন্বি। তাদের সঙ্গে উকিলও ছিল। প্রণয় বলেছে সে আজমীরের বিরুদ্ধে মামলা উঠিয়ে নিবে। প্রিয়ন্তীকেও ডাকা হলো। এক্সিডেন্টের সময় প্রিয়ন্তীও সেখানে ছিল। তার কারণেই প্রণয় বেঁচে আছে। সে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। তারপর প্রণয়কে নিয়েই থানায় গিয়েছিল সবাই। অথচ আজমীরকে জেল থেকে বের করার পর সে আবার প্রণয়কে আক্রমণ করতে এগিয়ে এলো। তার এহেন দুঃসাহস দেখে সামির চড় মেরে দিল। আজমীর ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ধাক্কা মেরে সামিরের মাথা ফাঁটিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করল না। তন্বি এসব দেখে কয়েক মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল। বাজে একটা হুলুস্থুল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। প্রণয় যখন প্রথমে বলেছিল,” তোকে আমি মাফ করে দিয়েছি। ”

তখনি আজমীর তেড়ে এসেছিল তার দিকে। দুই-তিনজন কন্সটেবল তাকে থামাল। সে বাতাসে লাথি মেরে বলল,” তোর মাফের কোনো পরোয়া করি না আমি। তুলির থেকে দূরে থাকবি। খবরদার যদি ওর আশেপাশে যাওয়ার চেষ্টা করিস তাহলে জানে মেরে ফেলবো। এবার তোকে আমি অবশ্যই মারবো।”

প্রণয় চোখ গরম করে বলল,” তুলির নাম মুখেও আনবি না তুই। এমন ব্যবস্থা করবো যে সারাজীবন কারাগারে পঁচে মরবি।”

আজমীর অদ্ভুতভাবে হাসতে হাসতে বলল,” দেখি আমার কি করতে পারিস তুই।”

সামির আর তন্বি থানা থেকে বের হয়ে এলো। সামিরের শরীরটা ভালো লাগছিল না। জ্বর আসবে মনে হয় তার। তন্বি রিকশায় ওঠার পর ভাবল একবার সামিরের কপালে হাত দিয়ে দেখবে জ্বর আছে কি-নেই!

প্রণয় রুক্ষ মেজাজ নিয়ে থানা থেকে বের হলো। আজমীরকে সে চিনতে অনেক বড় ভুল করেছে। বন্ধু নির্বাচনে এতোবড় ভুল প্রণয়ের কখনও হয়নি। ওইদিন রাতে যখন সে আজমীরের আহ্বানে কার রেইসিং চ্যালেঞ্জে ছুটে গিয়েছিল তখন তার মাথায় চিন্তা ছিল আজমীর হয়তো তার সঙ্গে লড়তে চায়। কিন্তু তার ক্ষতি করতে চায় না। তারা কিছুক্ষণ যুদ্ধ করবে, ঝগড়া করবে, মারামারি করবে, তারপর একপর্যায় সব ঠিক হয়ে যাবে। আবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা হাসবে। তাদের মধ্যকার সকল ভুল বুঝাবুঝি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আজমীর যে তার জন্য মৃত্যুর ফাঁদ পেতে রাখবে সেটা কল্পনাও করেনি প্রণয়। মানুষ নিজে যেমন, অন্যকাউকে ভাবেও তেমন। আজমীরের জায়গায় প্রণয় থাকলে কখনও এমন করতে পারতো না। তাই সে আজমীরের থেকেও এমন ভয়ানক বিশ্বাসঘাতকতা আশা করেনি। তবুও সামিরকে দেখে প্রণয়ের মায়া হয়েছিল। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আজমীরকে ক্ষমা করবে। কিন্তু আজমীর তো ক্ষমারও অযোগ্য!

” আমি আগেই বলেছিলাম৷ আজমীরকে দয়া দেখানোর প্রয়োজন নেই। সে ভালো মানুষ না। তুই কখনও আমার কথা বিশ্বাস করিস না প্রণয়। আর সবসময় বিপদে পড়িস।”

প্রণয় দায়সারা কণ্ঠে বলল,” এখান থেকে আমি চলে যেতে চাই।”

প্রিয়ন্তী প্রণয়ের কাঁধে হাত রাখল। মৃদু সুরে প্রস্তাব দিল,” চল আমরা কোথাও গিয়ে বসি। একটু গল্প করি? ভালো লাগবে তোর। আর আমারও ভালো লাগবে।”

প্রণয়ের ফোন বাজল তখনি। রাইফার নাম্বার দেখে তার ঠোঁটে হাসি এলো। প্রিয়ন্তীর থেকে একটু দূরে গিয়েই ফোন রিসিভ করল সে।

” হ্যালো রাইফা!”

” গুড নিউজ প্রণয়। জানো কি হয়েছে?”

” ওয়েট, তুমি কি লাউড স্পিকারে কথা বলছো?”

” না। কিন্তু তুলি এই মুহূর্তে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর সে চল্লিশ লক্ষ টাকার লটারী জিতে গেছে! তুমি কি চিন্তা করতে পারছো? চল্লিশ লক্ষ টাকা!”

প্রণয় ঝলমলে দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে হাসল। রাইফা উল্লাসে চিৎকার দিয়ে বলল,” ইয়াহু! আমি তো অনেক হ্যাপি। আজকে তুলি বলেছে আমাকে ট্রিট দিবে। তুমিও চলে আসো। আমরা যমুনা ফিউচার পার্কে আছি। এড্রেস তোমাকে টেক্সট করছি। আসবে তো?”

প্রণয় তীব্র আনন্দ নিয়ে বলল,” কেন আসবো না? এমন একটা গুড নিউজ পাওয়ার পরেও কি না এসে থাকা যায়?”

” হুম, হুম, জলদি এসো। তুলি এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না কিছু। বোকার মতো তাকিয়ে আছে আমার দিকে।”

প্রণয়ের খুব ইচ্ছে করছে তুলির মুখ দেখতে। সে প্রশান্তিময় নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” আসছি আমি।”

ফোন রাখতেই পেছন থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ল প্রিয়ন্তী,” কিসের গুড নিউজের কথা বলছিস তুই?”

প্রণয় হাসি মাখা কণ্ঠে জানাল,” তুলি লটারীতে চল্লিশ লাখ টাকা জিতেছে।”

” হোয়াট?” প্রিয়ন্তী যেন বিশ্বাসই করতে পারল না। হঠাৎ কিভাবে সম্ভব? কিসের লটারী?
____
তুলিকে সবাই অভিবাদন জানাচ্ছে। তুলির মুখে হাসি নেই। তবে চোখ ছলছল করছে। সে জড়ানো কণ্ঠে সবাইকে উত্তর দিচ্ছে, “ধন্যবাদ।”

কোঁকড়ানো চুলের একটি মেয়ে বলল,” আপনার ড্রেসটা কিন্তু আমি প্রথমে নিতে চেয়েছিলাম। আপুটা আমাকে নিতে দেয়নি। কারণ আপনি নাকি আগেই বুক করে ফেলেছিলেন। ইশ, যদি আরেকটু আগে আসতাম তাহলে হয়তো লটারী আমিই পেয়ে যেতাম। যাইহোক, শুভকামনা আপনার জন্য। ভালো থাকবেন। কংগ্রেটস!”

” থ্যাঙ্কিউ। ” তুলির সেই মুহূর্তে মাথায় ব্যাপারটা এলো না। সে তো ড্রেস বুক করেনি। সেলস গার্ল তার হাতে যেটা তুলে দিয়েছে সেটাই সে নিয়েছে। এই মুহূর্তে তুলির মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সে চোখে ঝাপসা দেখছে আর সবার কথা আবছা শুনতে পাচ্ছে। রাইফা তার সামনে এসে চঞ্চল গলায় বলল,” এই তুলি, ড্রেসটা কি ট্রায়াল দিবি? এইটা তোর লাকি ড্রেস। সবাই বলছে এই ড্রেস পরে তোকে ছবি তুলতে হবে। সেই ছবি ব্যানারে টাঙানো হবে। আয়, আয়!”

তুলি ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে ছিল৷ রাইফা তাকে হাত ধরে টেনে ট্রায়াল রুমে নিয়ে এলো। তুলি আয়নায় নিজেকে দেখে থমকালো। তারপর এক ধ্যানে তাকিয়েই রইল। এখনও সবটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে তার। এই স্বপ্ন ভেঙে যাবে না তো? রাইফা জামাটা তুলির গায়ের উপর মেলে ধরল। অবাক বিস্ময়ে বলল,” ওয়াও, তোকে পরীর মতো লাগছে একদম!”

তুলি মৃদু হাসল। সাথে সাথেই বাম চোখ থেকে টুপ করে গড়িয়ে পড়ল একফোঁটা জল। রাইফা তার চোখের পানিটা মুছে দিয়ে বলল,” উফ, কাঁদার কি হলো? আগে সেলিব্রেশন। পরে কান্নাকাটি। জোরে একটা চিৎকার দে তো! বল ইয়াহু!”

তুলি ভাঙা কণ্ঠে বলল,” রাইফা তুই এখান থেকে একটু যা প্লিজ।”

রাইফা থামল। ক্ষণকাল নীরব থেকে সহজ গলায় বলল,” আচ্ছা যাচ্ছি। তুই কিন্তু ড্রেসটা পরেই বের হবি।”

সে বাইরে যেতেই তুলি দরজা আটকে দিল৷ তারপর আস্তে করে বসে পড়ল মেঝেতে। দেয়ালে পিঠ ঠেঁকিয়ে মুখ টিপে ধরল। বেরিয়ে এলো বহুদিনের জমানো সেই কান্না!

ঈদের আগের রাত। তুলির সৎ ভাই-বোনেরা হৈ-হুল্লায় ব্যস্ত। তারা সবাই নিজেদের পছন্দমতো জামা কিনেছে। তাই নিয়েই গল্প হচ্ছে৷ হাসি-আনন্দে মেতে উঠেছে সন্ধ্যা। এতো হাসাহাসির কি আছে ছোট্ট তুলি বুঝতে পারে না। ঈদ বলে কথা! ঈদের আগে বাবার হাত ধরে মার্কেটে গিয়ে নতুন জামা কেনার খুশি তুলি কি করে বুঝবে? তুলির বাবা নেই। তবে একজন আছে, সৎ ভাই-বোনেরা তাকে ‘বাবা’ বলেই ডাকে। তুলি তাকে কখনও ‘বাবা’ ডাকার সুযোগ পায়নি। কেন পায়নি তা সে বুঝতো না। মা রান্নাঘরে মুখে আঁচল চেপে বসে থাকতো। তুলি ভাবতো, মায়ের শরীর ভালো নেই। শরীর খারাপ লাগলেই মুখে আঁচল চেপে রাখে মা। কিন্তু আসলে শরীর খারাপ নয়। মনখারাপ হলেই মা মুখে আঁচল চেপে রাখে। এটা মায়ের কান্না আটকানোর প্রচেষ্টা ছিল। যা এখন তুলি বুঝতে পারে। তখন বুঝতো না। সবার আনন্দ দেখে তুলি যখন প্রশ্ন করল মাকে,” ওরা কি নিয়ে এতো খুশি মা?” তখন মা বলেছিল,” কাল ঈদ। তাই সবাই আনন্দ করে, মা।”

তুলি আগ্রহী কণ্ঠে জানতে চাইল,” আমাদের ঈদ নেই?”

” না। নেই।”

” কেন নেই?”

” আমাদের ঈদ মরে গেছে।”

তুলি তখন বুঝেনি, ঈদ মরে যাওয়া মানে কি? তবে এখন তুলি জানে, ঈদ মানে খুশি। আর তাদের ঈদ মরে গেছিল মানে তাদের খুশিগুলোই মরে গিয়েছিল!

দরজায় করাঘাতের শব্দ হলো হঠাৎ। রাইফা ফিসফিসানো গলায় বলল,” এতোক্ষণ ধরে কি করছিস তুলি? দ্রুত বের হো না!”

তুলি দুই হাতে চোখ মুছল। আরে, সে কি করছে এসব? তার খুশিগুলো সে আবার মরে যেতে দিবে না। আজ সে অনেক খুশি থাকবে। কারণ আজ তার খুশি হওয়ারই তো দিন! তুলি উঠে দাঁড়ালো। উপরে তাকিয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু আকাশ তো দেখা যাচ্ছে না! আচ্ছা, মা কি তাকে দেখতে পাচ্ছে? মা তাকে দেখতে পেলেই হলো। তুলি চোখ বুঁজে নরম কণ্ঠে আওড়ালো,” আমাকে কি তুমি দেখছো মা? আমি ভালো আছি। অনেক ভালো আছি! আমি বিজয়ের পথে হাঁটছি। আমার স্বপ্নগুলো পূরণ হয়ে যাচ্ছে মা। কিন্তু তুমি আমার পাশে কেন নেই? আমার খুব আফসোস হয়। কলিজা ছিঁড়ে যাওয়ার চেয়েও বেশি কষ্ট এই আফসোসে!”

সেলসগার্ল প্রণয়কে দেখেই ছুটে এলো। দুইহাত একত্র করে প্রফুল্লচিত্তে জানাল,” স্যার, আপনার আইডিয়াটা আমাদের অনেক ভালো লেগেছে। আমরা আপনাদের দু’জনের ছবি তুলে ওয়েবসাইটে পোস্ট করতে চাই।”

প্রিয়ন্তীও প্রণয়ের পাশে ছিল। সে এইসব কথার মানে বুঝতে পারছিল না। প্রণয় কঠিন গলায় বলল,” একদম না। আপনারা এই বিষয় নিয়ে কিছুই করবেন না। ব্যাপারটা এখানেই শেষ। তুলি… মানে লটারী বিজয়ী মেয়েটা যেন কখনও কিছু বুঝতে না পারে।”

প্রিয়ন্তী প্রশ্ন করল,” কোন ব্যাপার?”

সেলস গার্ল দমে যাওয়া কণ্ঠে বলল,” স্যরি স্যার। আসলে এভাবে প্রিয়জনকে সারপ্রাইজ দেওয়ার আইডিয়াটা খুব ইউনিক। তাই আমরা শেয়ার করতে চেয়েছিলাম।”

প্রণয় অনুরোধ করল,” এটা কোনো সারপ্রাইজ না। এটা সিকরেট। আপনাকে আগেও বলেছিলাম। গোপন রাখতে হবে। প্লিজ সবকিছু গোপন রাখুন! আমার নাম যেন কোনোভাবেই প্রকাশ না হয়।”

” ওকে স্যার। স্যরি এগেইন।”

প্রণয় হেসে আন্তরিকভাবে বলল,” বাই দ্যা ওয়ে আপনারা আমাকে অনেক হেল্প করেছেন এজন্য থ্যাংকস। আমি খুবই কৃতজ্ঞ আপনাদের কাছে। গ্র্যাটিটিউড!”

” আমাদেরও এতে যথেষ্ট লাভ হয়েছে। আপনার জন্য বেস্ট অফ লাক। দোয়া করি আপনার সাথে ম্যামের দ্রুত বিয়ে হোক।”

প্রণয় খুশি হয়ে বলল,” ম্যানি ম্যানি থ্যাংকস।”

প্রিয়ন্তীর মাথা ভনভন করছে। সে বিষমচিত্তে বলল,” প্রণয় তুই এটা কি করলি? মানে ফাজলামি নাকি? চল্লিশ লাখ টাকা!

” তুলির সামনে এসব উচ্চারণ করবি না, প্লিজ।”

প্রিয়ন্তী রাগে গজগজ করে অন্যদিকে তাকালো। তার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। এসব কি ধরণের পাগলামি? ভালোবাসা ভালো কথা তাই বলে এমন ন্যাকামো করতে হবে? চল্লিশ লাখ টাকার লটারী জিতিয়ে দিতে হবে!

গোলাপি আভার মিষ্টি রঙা জামাটিতে তুলিকে ঐশ্বরিক আভিজাত্যপূর্ণ কোনো রাজকন্যা মনে হচ্ছে। তার দেহের রঙের সাথে জামার রঙটা অসম্ভব মানিয়ে গেছে। প্রণয়ের দৃষ্টিতে মুগ্ধতা বিরাজ করছে। সে ভাবেওনি এই জামায় তুলিকে এতো ভালো লাগবে। তুলির চোখেমুখে খুশির জৌলুস। বিজয়ীনির মতো হাসি। এজন্যই কি তুলিকে অন্যদিনের চেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে আজ? প্রণয়ের তো ইচ্ছে করছে পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে তুলিকে নিয়ে কোথাও হারিয়ে যেতে৷ তারপর সারাক্ষণ একান্তে বসে তুলিকে দেখতে থাকবে সে।

” এহেম, এহেম, একটু এদিকেও তাকাও। মেন্যুবুকটা দেখো মিস্টার প্রণয়!”

প্রণয় চমকে তাকাল। রাইফা তার কথা শেষ করেই হাসছে। পাশে প্রিয়ন্তী গোমরা মুখে বসে আছে৷ প্রণয়ের মনোযোগ এতোক্ষণ তুলির দিকে ছিল। সে সামান্য বিব্রতবোধ করল। তারা যমুনার ফুডকোর্টে এসে বসেছে। তুলি মেন্যুবুক হাতে নিয়ে উল্লাসভরা কণ্ঠে বলল,” আজকে কোনো লিমিট নেই। যে যত ইচ্ছা অর্ডার করো। প্রয়োজনে পুরো ফুডকোর্ট কিনে ফেলবো। সব আমাদের!”

প্রিয়ন্তী ফিসফিস করে বলল,” ন্যাকা!”

তুলি কথাটা খেয়াল করেই ভ্রু কুচকে তাকাল। প্রণয় পাশ কাটানো গলায় বলল,” হ্যাঁ অবশ্যই। আজকে আমি সব আইটেম ট্রাই করে দেখবো। কিছু বেঁচে গেলে পার্সেল নিয়ে যাবো।”

তুলি হাসল। সে আজ অকারণেই হাসছে। মুখ থেকে হাসি সরছেই না৷ এতো সুন্দর কিভাবে হলো এই দিনটা? প্রিয়ন্তী উঠে বলল,” তোমরা খাওয়া-দাওয়া করো। আমি নিচে ওয়েট করছি।”

তুলি অবাক হয়ে জানতে চাইল,” কেন? তুমি আমাদের সাথে খাবে না আপু?”

” আমার ক্ষিদে নেই, কাজ আছে। তোমরা ইঞ্জয় করো।”

তুলি আর কিছু বলল না। প্রিয়ন্তী না থাকলেই ভালো। এভাবে সব অপছন্দের জিনিস চলে যাক। আজকের এই সুন্দর দিনটি শুধু তার! প্রিয়ন্তী চলে যেতেই প্রণয়ও উঠে দাঁড়ালো। ‘এক্সকিউজ মি’ বলে সেও কোথায় যেন চলে গেল। তুলি রাইফার হাত চেপে ধরে বলল,” আমার বিশ্বাস হচ্ছে না রাফু। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুই!”

রাইফা নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসল। তুলির খুশি দেখে সেও খুশিতে টইটম্বুর হয়ে যাচ্ছে আজ। প্রণয়কে ধন্যবাদ! এতো দারুণ একটা কাজ করার জন্য তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ!

প্রিয়ন্তী লিফটে উঠে যাচ্ছিল। প্রণয় হাত দিয়ে থামালো তাকে। দরাজ গলায় বলল,

” দাঁড়া প্রিয়ু, তোর সঙ্গে আমার জরুরী কথা আছে।”

প্রিয়ন্তী গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করল,” কি কথা?”

” তুই তুলির সামনে এমন মুখ ভার করে বসেছিলি কেন? আর এভাবে উঠে চলে এলি কেন? সে কি ভাববে?”

” তো আমার এখন কি করা উচিৎ? যাই গিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে নাচি?”

” অন্তত হাসি-খুশি ভাবে কথা বলতে পারতি ওর সাথে! একটা ভালো ঘটনা ঘটেছে। আর তুই এমন ভাব করছিস যেন ঈর্ষা করছিস।”

প্রিয়ন্তী হাসল। হাত ভাঁজ করে বলল,” এতোক্ষণে তুই লাইনে এসেছিস।”

” তোর প্রবলেমটা কি? এমন করছিস কেন?”

” কারণ তুই যেটা করেছিস সেটা একটা ধোঁকা। তোর কি মনে হয় খুব মহান কাজ করে ফেলেছিস?”

প্রণয় মৃদু হেসে বলল,” একটু ধোঁকার আশ্রয় নিয়ে যদি তুলিকে এতোখানি খুশি করা যায় তাহলে এমন ধোঁকা আমি সবসময় দিতে প্রস্তুত।”

প্রিয়ন্তী এবার তাচ্ছিল্য হাসল। ধারালো ছুরির ন্যায় আঘাত করা কণ্ঠে বলল,” কিন্তু দিনশেষে তুই হবি একটা ধোঁকাবাজ। যার সঙ্গে সারাজীবন কাটাতে চাইছিস তাকে মিথ্যা বলতে লজ্জা করে না? আমি তুলির জায়গায় হলে তোকে কোনোদিন মাফ করতাম না। ছি!”

প্রিয়ন্তী লিফটের বাটন চেপে ধরল। ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ প্রণয় তাকিয়ে রইল স্তব্ধ দৃষ্টিতে। অবাক চোখে। ঠিক এই সময় তুলির কণ্ঠ ভেসে এলো,” প্রিয়ন্তী আপু!”

চলবে#বেদনার_রঙ_নীল
বত্রিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

বুকের ভেতর দামামা বেজে উঠল। সচকিত দৃষ্টিতে প্রণয় তাকাল ডানদিকে। তুলি দৌড়ে আসছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য ভয়ংকর বিচলিত হয়ে উঠেছিল সে। কিন্তু তুলি যখন কাছে এসে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,” প্রিয়ন্তী আপু চলে গেছে?”

তখন প্রণয় হাঁফ ছেড়ে বলল,” হুম৷ কেন? কোনো কাজ আছে ওর সাথে?”

” আমি প্রিয়ন্তী আপুর সাথে একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম। স্যরি বলবো। হসপিটালে ওই বোকামিটা করার জন্য।”

তুলি মাথা নিচু করে ফেলল। তাকে অনুতপ্ত দেখাচ্ছে খুব। প্রণয় ব্যাপারটা পাশ কাটাতে চাইল। আলতোভাবে তুলির বাহুতে স্পর্শ করে বলল,” দরকার নেই। ও চলে গেছে।”

” দরকার নেই কেন? ও কোথায় গেছে বলেন? আমিও যাই?”

প্রণয় আমতা-আমতা করল,” অন্য আরেকদিন বললে হয় না? আজকেই কেন স্যরি বলতে হবে?”

তুলি হাস্যজ্জ্বল কণ্ঠে বলল,” আজকে আমার মন ভালো। তাই আমি সব ভালো কাজ করতে চাই।”

এই কথা বলেই তুলি লিফটের বাটন টিপল। তারপর আবদারের সুরে বলল,” বলুন না আপু কোথায় গেছে? কোন ফ্লোরে?”

প্রণয় অল্প হতাশ হয়ে বলল,” জানি না৷ তুমি ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারো।”

প্রণয় নিজের মোবাইল বের করে দিল। তুলি তুষ্ট কণ্ঠে বলল,” ওকে।”

প্রণয় ফুডকোর্টে গিয়ে রাইফার সাথে বসল। তাদের অর্ডার করা খাবার চলে এসেছে। প্রণয় ভাবলেশহীন হয়ে জুসে চুমুক দিল। রাইফা রেগে বলল,” আরে, কি করছো? এটা আমার জন্য, প্রণয়। দাও।”

প্রণয় নিজের কপালে মালিশ করতে করতে বলল,” প্লিজ রাইফা। চিৎকার কোরো না। চুপ থাকো।”

রাইফা একটু কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইল,” কিছু হয়েছে নাকি তোমার? তুলি কোথায়?”

প্রণয় ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল,” প্রিয়ন্তীর সাথে গেছে। তাকে স্যরি বলবে।”

” ও। এজন্যই ওইভাবে দৌড়ে গেল? বুঝেছি। যাক ভালো!”

প্রণয় নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল। মনের শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে তার।

প্রিয়ন্তী ব্যাগ আর জুতোর কালেকশনে ঢুকেছে। তুলি তার পাশাপাশি হাঁটছে। প্রিয়ন্তী মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল,” তুমি কি বলতে এসেছো?”

তারপর দায়সারাভাবে বলল,”যা বলার দ্রুত বলে এখান থেকে চলে যাও।”

তুলি অনুরোধ করল,” এইভাবে না। একটু এইপাশে আসো!”

প্রিয়ন্তী বিরক্ত হয়ে ওইপাশে গেল। তুলি ইতস্তত বোধ করছে। তীব্র অপরাধ বোধ নিয়ে উচ্চারণ করল,” স্যরি।”

” কেন?” আগ্রহহীন কণ্ঠে প্রশ্নটা করেই অন্যদিকে চাইল প্রিয়ন্তী। তার ভালো লাগছে না তুলির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। তুলিকে সহ্যই হচ্ছে না। তুলি আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করল।

” আমি একটা অন্যায় করেছিলাম৷ হসপিটালের বাথরুমে সেদিন ওই বাজে কাজটা আমিই করেছিলাম।”

প্রিয়ন্তী চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল আবারও। সে সবই জানে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” ওকে। বুঝেছি। এজন্য স্যরি বলতে এসেছো? যাও, মাফ করে দিলাম।”

এই কথা বলে প্রিয়ন্তী চলে যেতে নিল। তখন তুলি নরমভাবে বলল,” না হয়নি। আমি জানি তুমি রেগে আছো আপু। ব্যাপারটা অবশ্যই রাগার মতো। তোমার জায়গায় আমি হলেও সেইম রিয়েক্ট করতাম। আসলে আমি ভুল করেছি। তাই আজকে আমি সব ঠিক করে ফেলতে চাই। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও!”

” তুমি আমার থেকে পাঁচ-ছয়বছরের ছোট হয়েও আমাকে থাপ্পড় মেরেছো। আর এখন বলছো মাফ করে দিতে? খুবই ভালো ব্যাপার।”

তুলি মনখারাপের কণ্ঠে বলল,” আমার খুব রাগ হয়েছিল আজমীর ভাইয়ের উপর। নিজের ভাগ্যের উপর। সবকিছুর উপর। আর তুমিও প্রণয়ের সাথে…”

প্রিয়ন্তী ঠাস করে বলল,” সহজ ভাষায় বলি? আমার সাথে প্রণয়ের ফ্রেন্ডশীপ তোমার সহ্য হচ্ছিল না। তাই না? আচ্ছা, প্রবলেম নেই। তোমার জায়গায় হলে আমিও জেলাস করতাম। কোনো সুন্দরী মেয়ে আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঢলাঢলি করবে এটা তো মানা যায় না। কিন্তু তুমি আমাকে বুঝিয়ে বললেই পারতে। এমন অদ্ভুত একটা ইন্সিডেন্ট ঘটানোর প্রয়োজন ছিল না।”

তুলি আহত হলো। খানিক রাগ নিয়ে বলল,” তুমি ভুল ভাবছো। আমি এটা জেলাস থেকে করেছি তা ঠিক। কিন্তু তোমারও দোষ ছিল।”

প্রিয়ন্তীর চোখ দু’টি অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠল এবার। অনেকটা উচ্চস্বরেই সে বলল,” আচ্ছা তাই? আমারও দোষ ছিল? কোনটা দোষ আমার? প্রণয়ের জান বাঁচানো, তাকে প্রটেক্ট করা, তার টেইক কেয়ার করা নাকি তার সাথে ফ্রেন্ডশীপ করাই আমাদের দোষ? ”

সবাই অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। তুলি ফিসফিসিয়ে বলল,” এইভাবে সিন ক্রিয়েট করার কিছু হয়নি। আমি ঝগড়া করতে আসিনি।”

প্রিয়ন্তী রাগে তুলিকে ধাক্কা মেরে বলল,” তাহলে কেন এসেছো আমার কাছে? কি ভেবেছো স্যরি বললেই আমি জড়িয়ে ধরে তোমাকে চুমু দিবো? চাইলেই যতগুলো থাপ্পড় আমাকে তুমি সেদিন দিয়েছিলে তার দ্বিগুণ ফিরিয়ে দিতে পারি এখন। কিন্তু আমি এটা করবো না। কারণ আমি তোমার মতো না।”

তুলি বিস্মিত হয়ে তাকাল। ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল তার শান্ত মন। তবুও বোঝানোর চেষ্টা করল,” তোমার হঠাৎ এমন রাগের কারণ আমি জানি না। কিন্ত আমার মনে হয় হসপিটালে সেদিন তুমি আমাকে জ্বালানোর জন্য প্রণয়ের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করছিলে। এই কারণে আমি তোমাকে মেরেছিলাম। হ্যাঁ জানি কাজটা অন্যায়। আমি অন্যায় করেছি। আর এজন্যই স্যরি বলতে এসেছি। কিন্তু এখন তুমি যেই বিহেভটা করলে তাতে আমি হতাশ।”

” আহ! তোমার হতাশায় আমার কি যায়-আসে?”

তুলি আর কিছু না বলে চলে এলো সেখান থেকে। প্রিয়ন্তী রাগে বাতাসে লাথি মারল। অসম্ভব অসহ্যবোধ হচ্ছে তার। প্রণয় এই মেয়েটিকে কি দেখে এতো ভালোবাসে?

সন্ধ্যাটি আনন্দময় ছিল। তুলি প্রিয়ন্তীর ব্যাপারটি মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দিল পুরোপুরি। আজকে সে সব খারাপ স্মৃতি ভুলে থাকতে চায়। কিন্তু শুধু মায়ের মৃত্যুর স্মৃতিটা ভুলতে পারছে না। কারণে-অকারণে শুধু মায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ইশ, এই আনন্দমুখর সময়ে মা যদি তার পাশে থাকতো! রাইফা, তুলি আর প্রণয় রাত নয়টা পর্যন্ত বাইরে কাটাল। তারা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাঘুরি করল। তিনজনের মাঝে আজ সবচেয়ে বেশি কথা বলেছে তুলি। সবচেয়ে বেশি হেসেছেও সে। রাইফা আর প্রণয় অন্যদিনের তুলনায় একটু চুপচাপই ছিল। যদিও সেটা তুলির নজরে পড়ল না। কিন্তু একটা ব্যাপার সে ঠিকই লক্ষ্য করল। প্রণয় প্রেম বিষয়ক কোনো কথা বলছে না তার সঙ্গে। এই লটারী পাওয়ার ঘটনায় প্রণয়ের তো এই বিষয় নিয়েই সবার আগে লাফানো উচিৎ ছিল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, সে এই বিষয়ে তুলিকে কিছুই বলল না!

বাড়ি ফিরে এসে রাইফা আর তুলি ভেবেছিল সবাইকে সারপ্রাইজ দিবে। কিন্তু বাড়িতে সারপ্রাইজ দেওয়ার মতো কেউ নেই৷ সূচি বিছানায় শুয়ে পড়েছেন। তার নাকি মাথাব্যথা। রাইফা আর তুলিকে শুধু বললেন, খাবার ফ্রীজে আছে। ওভেনে গরম করে খেয়ে নিতে। অথচ তারা ভরপেট খেয়ে এসেছে! সামির আর তন্বিও এখানে নেই। এতোরাত হয়ে গেল। তারা বাড়ি ফেরেনি কেন?

রাইফা মোবাইল হাতে নিল তন্বিকে ফোন করার উদ্দেশ্যে। তুলি নিজের টাকায় কেনা নতুন ফোনটি দেখছিল। সে আজ তার প্রয়োজনীয় অনেক জিনিস কিনেছে। তন্বির জন্যেও উপহার কিনেছে। আর মামা-মামীর জন্যেও। বাকি টাকা সে ব্যাংকে তুলে রাখবে। তারপর আস্তে-ধীরে চিন্তা করবে এই টাকা দিয়ে কি করা যায়!

রাইফা হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল,” ওহ মাই গড!”

তুলি হালকা কেঁপে উঠল। রাইফা তন্বির সাথে কথা বলতে বলতে বারান্দায় চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে বের হয়েই এভাবে চিৎকার করেছে সে। তুলি প্রশ্ন করল,” তোর কি হয়েছে?”

রাইফা তাঁক লেগে দেয়ালের দিকে চেয়ে থেকে বলল,” তন্বি চলে গেছে।”

” কোথায়?”

” সামির ভাইয়ের সাথে তোদের গ্রামে।”

” কি? হঠাৎ গ্রামে কেন গেল? ”

রাইফা এবার জোরে চিৎকার দিয়ে বলল ” কারণ তারা বিয়ে করে ফেলেছে!”

তুলি এমনভাবে আৎকে উঠল যে তার হাতের নতুন ফোন প্রথমদিনই হাত থেকে পড়ে গ্লাস প্রটেক্টর ফেঁটে গেল। রাইফা মোবাইলটি মেঝে থেকে তুলতে তুলতে বলল,” ওদের মধ্যে প্রেম ছিল নাকি?”

তুলি স্তব্ধ কণ্ঠে বলল,” আমি জানি না। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।”

” তুই কি তন্বির সাথে কথা বলবি একবার?”

” আমার অদ্ভুত লাগছে খুব। ওরা তো আজমীর ভাইকে থানা থেকে ছাড়াতে গিয়েছিল, তাই না? তাহলে বিয়ে কিভাবে হলো?”

রাইফা দাঁতে দাঁত পিষে উচ্চারণ করল,” সেটা তো আমারও প্রশ্ন।”

“তুই ওকে জিজ্ঞেস করিসনি?”

” ও আমাকে কিছুই বলছে না। রহস্য করছে। শুধু বলছে বিয়ের দাওয়াত রইল। গ্রামে এলে সব জানাবে। আজরাতেই চলে যেতে বলল। কি অদ্ভুত মশকরা!”

তুলি কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ থেকে হাতে চুটকি বাজিয়ে বলল,” আমরা এখনি যাবো।”

” কোথায়?”

” আমার গ্রামের বাড়ি। তুইও যাবি আমার সঙ্গে।”

রাইফা বিষমচিত্তে আওড়ালো,” পাগল হয়ে গেছিস? আমাদের না কোচিং-এ ক্লাস আছে? ”

তুলি খোঁচা মারার উদ্দেশ্যে বলল,” ক্লাস করা নিয়ে তুই আবার কবে থেকে এতো সিরিয়াস হয়ে গেলি?”

রাইফা মাথায় হাত চেপে ধরল। তার অনেক অস্বাভাবিক লাগছে। বোধগম্য মনে হচ্ছে না কিছুই। কিন্তু তুলি এতো ঠান্ডা কিভাবে আছে? সে কি তন্বি-সামিরের বিষয়ে আগে থেকেই কিছু জানতো? তুলি তার নতুন মোবাইলে সিম ভরে প্রণয়কে ফোন করল।

” হ্যালো।” প্রণয়ের সরল কণ্ঠ ভেসে এলো। তুলি লাজুক হাসি দিয়ে বলল,” চিনতে পেরেছেন?”

” তুলি!” প্রণয় আদুরে কণ্ঠে উচ্চারণ করল নামটি। তুলি খিলখিল করে হেসে উঠে প্রশ্ন করল,” কিভাবে চিনলেন?”

” চিনবো না কেন? তোমার কণ্ঠস্বর আমার অস্থি-মজ্জায় মিশে আছে।”

” ইশ, খালি ডায়লগ! জরুরী কথা বলার জন্য ফোন করেছি।”

প্রণয় একটু মনমরা হয়ে বলল,” ও আচ্ছা। হুম সেটাই ভাবছি আমাকে হঠাৎ কেন ফোন করবে প্রয়োজন না হলে?”

তুলি ঠোঁট চেপে হাসল। প্রণয়ের অভিমানকে পাশ কাটিয়ে বলল,” আমরা বরিশাল যাচ্ছি।”

” হঠাৎ?”

” হুম…পদ্মাসেতুর উপর দিয়ে যাবো। আপনি কি আমাদের নিয়ে যেতে পারবেন?”

প্রণয় প্রফুল্ল সজীব হাসি দিয়ে বলল,” নিশ্চয়ই। এটা তো আমার সৌভাগ্য! তুমি আর কে?”

” আমি আর রাইফা যাবো।”

” এখনি যাবে নাকি সকালে?”

” আপনার যখন সুবিধা হয় তখন গেলেই হবে। এখনি যেতে পারলে ভালো। ”

প্রণয় ব্যস্ত হয়ে বলল,” আচ্ছা, আমি কি বাসায় আসবো?”

তার এতো উৎসাহ দেখে তুলি হেসে ফেলে বলল,” আসুন।”

রাইফা মুখে হাত ঠেঁকিয়ে বসে আছে। তুলি ফোন রাখতেই সে চিন্তিত কণ্ঠে বলল,” কি করতে চাইছিস তুই?”

” প্রণয়কে ফোন করেছি। সূচি আন্টিকে বলবো মামা অসুস্থ। তাই দেখতে যেতে হবে। প্রণয় আমাদের নিয়ে যাবে। এইভাবে যদি বলি তাহলে কি যেতে দিবে না?”

রাইফা নিশ্চিন্তে বলল,” আম্মুকে নিয়ে সমস্যা নেই। আম্মু আমাকে এমনি ঘুরতে যেতে চাইলেও যেতে দিবে। কিন্তু এই রাতে যেতে দিতে রাজি হবে কি-না বুঝতে পারছি না। তন্বির বিয়ে হয়ে গেছে বললে শক খাবে। তারপর হয়তো যেতেও দিবে।”

” আচ্ছা নাহলে কি আমি প্রণয়কে ফোন করে বলে দিবো সকালে আসতে?”

” থাক লাগবে না। আমরা এখনি যাবো। আমার খুব এক্সাইটিং লাগছে।”

তুলি হাসিমুখে বলল,” আচ্ছা চল।”

সূচি প্রথমে আপত্তি করলেন। তারপর প্রণয়ও তাদের সঙ্গে যাবে শুনে নিশ্চিন্তবোধ করলেন। দু’টো মেয়ে একা যাওয়ার থেকে একজন ছেলে সঙ্গে যাওয়া ভালো। রাইফা তৈরী হতে হতে বলল,” প্রণয়কে ফোন দিয়ে ভালোই করেছিস। বাই দ্যা ওয়ে, তোরা কিন্তু চাইলে এবার হানিমুন সেরে ফেলতে পারিস। ”

তুলি বিছানায় বসে চুল আঁচড়ে নিচ্ছিল।রাইফার উক্তি শুনে সজোরে চিরুনীটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল,” অসভ্য মেয়ে! বিয়ের আগে আবার কিসের হানিমুন? মুখে লাগাম দে!”

রাইফা খোঁচা মেরে বলল,” ও আচ্ছা। তার মানে বিয়ের পর হানিমুন হবে? এর মানে তুই শিউর ওকেই বিয়ে করবি?”

তুলি চুপ করে একটু ভাবতে লাগল। তারপর আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,” হয়তো করবো। যদি আমার স্বপ্নটা পূরণ হয়… ”

” অন্তত প্রেমটা শুরু কর। বেচারা অপেক্ষায় আছে। তুই তো অর্ধেক বড়লোক হয়েই গেছিস। লাখ টাকার মালিক এখন তুই।”

তুলি রাশভারী কণ্ঠে বলল,” রাইফা, শুধু পয়সাওয়ালা হওয়াই আমার মূল উদ্দেশ্য না। আমি প্রতিষ্ঠিত হতে চাই। উপযুক্ত সম্মাননা পেতে চাই। অনেক বড় মানুষ হতে চাই। আর তুই তো সবই জানিস। তুই কি ভাবছিস শুধু প্রণয়কে বিয়ে করার জন্যই আমি বড়লোক হতে চাই?”

রাইফা আয়নার দিকে তাকাল। মলিন দৃষ্টিতে বলল,” না। আমি জানি তুই কেন বড়লোক হতে চাস। তোর বাবাকে জবাব দেওয়ার জন্য..”

ফোন বেজে উঠল। তুলি চোখ মুছে ফোন রিসিভ করে বারান্দায় চলে গেল। প্রণয় দাঁড়িয়ে আছে নিচে। তার গায়ে সাদা জ্যাকেট, কালো জিন্স। গাড়ি থেকে বের হয়ে মাথা তুলে চাইল। তুলি মুচকি হেসে বলল,” অপেক্ষা করুন। আমরা নামছি।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here