বেদনার রং নীল পর্ব -৩৫+৩৬

#বেদনার_রঙ_নীল
পঁয়ত্রিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

সকালেই ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে নিল রিসব। আজই চলে যাচ্ছে সে। শান তার সঙ্গে দেখা করবে না বলে ছাদে গিয়ে বসে আছে। তার খুব অভিমান হচ্ছে। ভাইয়া বলেছিল এবার নাকি একমাস থাকবে। কিন্তু এক সপ্তাহ না হতেই চলে যাচ্ছে। শানের কি মনখারাপ হওয়া সাজে না? রিসব নাস্তা করতে বসে মিষ্টির কাছে জানতে পারল শান ঘরে নেই। সে নাস্তা খেতেও আসবে না৷ রাগ করে বের হয়ে গেছে। মিষ্টি নিশ্চিত কণ্ঠে বলল,” ছাদেই গেছে।”

রিসব খাওয়া ছেড়ে বের হলো। শানকে মানাতে হবে। ছেলেটা ইদানিং বড্ড জ্বালাতন করে!দরজা থেকে বের হতেই গায়েবী শব্দ শুনে পা থেমে গেল রিসবের। কাঁদো কাঁদো স্বরে কেউ বলছে,” আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবেন, প্লিজ?”

রিসব একটু ভড়কালো। হকচকিয়ে পেছনে চাইলো। কেউ তো নেই! কিন্তু কণ্ঠ অবিকল রাইফার মতো। আবারও আওয়াজ শোনা গেল,” আমার ভয় লাগছে। আপনাকে হারানোর ভয়।”

রিসব এবার নিজেই ভয় পেয়ে যায়। পাঁচ বছর ধরে নানান পর্বত শৃঙ্গ জয় করা যুদ্ধময় এই জীবনে এবার প্রথম সে ভয় পাচ্ছে। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠল রাইফার মায়াবী সেই মুখ। কিন্নর কণ্ঠে বলা শব্দ,” আপনি খুব রুড।”

গতরাতে কফিশপে রাইফা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,” আপনি আমার ওরনা কেন নিয়েছেন?”

রিসব অবাক হয়ে বলল,” মানে? কোন ওরনা?”

” আমি আমার একটা রঙিন ওরনা তুলির কাছে পেয়েছি। তুলিকে ওরনাটা শান দিয়েছিল। সে নাকি পেয়েছে আপনার আলমারিতে।”

রিসব জবাব দিল না। নিশ্চুপ হয়ে গেল। রাইফা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল উত্তরের আশায়। রিসব অনেক ক্ষণ পরে বলল,” হয়তো মিষ্টি আপু ভুল করে রেখেছিল৷ আমি তো নিজের ঘরে থাকিই না। আমার ঘর-দোর মিষ্টি আপু গুছায়।”

রাইফা অভিমানী কণ্ঠে বলল,” আপনি মিথ্যা বলছেন। শান নাকি ওরনাটা আপনার হাতেও দেখেছে।”

রিসব সরাসরি প্রশ্ন করল,” তুমি কি বলতে চাও রাইফা?”

রাইফা চুপসে গিয়ে বলল,” আমি আবার কি বলতে চাইবো? কিছু না!”

” তুমি কিছু একটার ইঙ্গিত দিতে চাইছো।”

” হ্যাঁ। আমার জন্য কি আপনার কোনো ফিলিংস নেই? সত্যি কথা বলুন।”

রিসবের জানি কি হলো। সে খুব শক্তভাবে বলে দিল,” একদম নেই। এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।”

রাইফা আশ্চর্য হয়ে তাকাল। আহত হয়ে উঠল তার চেহারা। রক্তিম হলো মুখমণ্ডল। রিসব গম্ভীর হয়ে বলল,” আমাকে নিয়ে তুমি বেশি চিন্তা করো বলেই তোমার এইসব মনে হয়।”

রাইফা প্রায় স্তব্ধীভূত হয়ে যাওয়ার আগে জানতে চাইল,” আপনি বলতে চান, আমাকে আপনার কখনোই পছন্দ হয়নি?”

” তোমাকে পছন্দ হবে কেন? এইসব তোমার চিন্তাই করা উচিৎ না।”

রাইফা মাথা নিচু করে কয়েক মুহূর্ত বসে থেকে হঠাৎ উঠে চলে গেল। কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বেরিয়ে গেল কফিশপ থেকে। এর কিছুক্ষণ পরেই প্রণয় এসে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে রিসব?”

রিসব তখনি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিল, এখানে সে আর থাকবে না। রাইফার সামনেই আর থাকা যাবে না। তাই প্রণয়কে ট্রেনিং-এর মিথ্যা বাহানা দিয়ে চলে এসেছিল। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও সে স্বস্তি পাচ্ছে না। স্থির হয়ে কোথাও বসতে পারছে না। তার কেমন দমবন্ধ লাগছে।

শান ছাদে দাঁড়িয়ে তুলির নাম্বারে ফোন করল। এই নাম্বারটা সকালে মিষ্টির কাছে পেয়েছে সে। তুলি নাকি তাকে কিছুদিন পড়াতে আসবে না৷ সে গেছে গ্রামের বাড়ি। তাই শান ফোন করেছে খোঁজ নিতে। কিন্তু ফোনটা রিসিভ করল রাইফা,” হ্যালো, কে বলছেন?”

শান যান্ত্রিক স্বরে বলল,” মিস কিউটিপাই কোথায়?”

রাইফা নাম্বারটা একবার দেখে নিয়ে বলল,” কে তুমি? শান?”

” এটা তো মিস কিউটিপাইয়ের নাম্বার। কিন্তু তুমি ধরলে কেন? তার ফোনের কাছে তুমি কি করছো স্টুপিড?”

রাইফা হতভম্ব বনে গিয়ে বলল,” আমি স্টুপিড? আমি তোমার কয়বছরের বড় জানো? তুমি আমাকে স্টুপিড কিভাবে বললে?”

” আমি রাখছি। মিস কিউটিপাই এলে বলবে আমি ফোন করেছিলাম।”

” তোমার মিস কিউটিপাই এখানে নেই। সে রান্নাঘরে কাজ করছে। আর আমি মোটেও কিছু বলতে পারবো না।”

” প্রবলেম নেই। আমি আবার ফোন করবো।”

রাইফা মজা করে বলল,” মাত্র একদিন পড়াতে আসেনি। আর তাতেই এতো ফোন? মিস কিউটিপাইয়ের প্রেমে পড়েছো নাকি?”

শান মৃদু হেসে বলল,” তুমি সবসময় এমন স্টুপিড কথা-বার্তা বলো। আমি কেন তোমাকে স্টুপিড বলি.. এবার বুঝতে পেরেছো?”

অপমানে নাকের ডগা ফুলে লাল হয়ে গেল রাইফার। সে কটমট করে বলল,” তুমি আমার দেখা সবচেয়ে ফাজিল ছেলে!”

ফোনের ওই পাশ থেকে এবার শব্দ এলো,” শান, কি করছিস এখানে?”

কণ্ঠটা রিসবের৷ তা বুঝতে পেরেই রাইফার বুকের ভেতর খচ করে উঠল। শান ততক্ষণে ফোন কেটে দিয়েছে। রাইফার চোখ অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। সে প্রণয়ের থেকে শুনেছিল রিসব নাকি ট্রেনিং-এ চলে গেছে। অথচ সে বাড়িতেই আছে! মিথ্যা বলেছিল তাহলে। রাইফাকে সহ্য করতে পারছিল না বলেই কি মিথ্যা বলে চলে গিয়েছিল?

প্রণয় দিঘীর সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। তুলির তো আসার কথা এখানে। এখনও সে কেন আসছে না? নিচে থেকে একটা পাথর তুলে পানিতে ছুঁড়ল প্রণয়। মাটি অনেক পিচ্ছিল। পাথর ছোঁড়ার সময় পা পিছলে গেল। আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল প্রণয় তখনি কেউ হাত চেপে ধরল পেছন থেকে। প্রণয় কৃতজ্ঞ হেসে উচ্চারণ করল,” থ্যাংকস।”

তারপর মানুষটির মুখের দিকে চাইতেই সে বিস্মিত হলো। আজমীর!

আজমীর প্রণয়ের হাতটা ধরে থেকে বলল,” ছেড়ে দিলেই পড়ে যাবি। তুই তো সাঁতারও জানিস না। তোর বাঁচা-মরা এখন আমার হাতে।”

প্রণয়ের দৃষ্টি কঠিন হয়ে গেল। চোয়াল হলো শক্ত। আজমীর এখানে কি করছে? তার তো জেল থেকে বের হতে পারার কথা নয়। অবশ্য এটা বাংলাদেশ। ক্ষমতাশীল বাবা থাকলে কি-না সম্ভব! প্রণয় ধিক্কারের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” তোর হাতে বাঁচার থেকে মরে যাওয়া আমার জন্য ভালো। ”

আজমীর বাঁকা হেসে বলল,” তাহলে মরে যা!”

প্রণয়ের হাত ছেড়ে দিল সে। তাল সামলাতে না পেরে প্রণয় উল্টে পড়ে গেল দিঘীর জলে। এতো অল্প পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণ নেই। প্রণয় কয়েক ঢোক পানি খেয়ে ভেসে উঠল। একহাতে চুল আর মুখ মুছে গরম দৃষ্টিতে আজমীরের দিকে চাইল। আজমীর পকেটে দু’হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে শয়তানি হাসি। প্রণয় আস্তে-ধীরে পাড়ে উঠে এলো। ঠান্ডায় গা কাটা দিচ্ছে। সকাল সকাল ভিজতে হলো। রাগ উঠছে প্রচন্ড। তুলি তখনি এলো দিঘীর সামনে। তাদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখে সে অবাক হয়ে বলল,” এখানে কি হয়েছে?”

আজমীর হাস্য মুখে তাকাল তুলির দিকে।

” কি অবস্থা? ভালো আছো?”

তুলি রাগী গলায় বলল,” আপনি প্রণয়কে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিয়েছেন তাই না?”

আজমীর এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে টুশকি মারতে বলল,” তোমার মুখ দেখার জন্য কত যুদ্ধ করে এখানে এসেছি জানো? এইভাবে কথা বলছো কেন আমার সাথে? প্লিজ, একটু সুন্দর করে কথা বলো!”

তুলির মেজাজ খারাপ হচ্ছে। দাঁত খিঁচে বলল,

” আপনি এখানে কিভাবে এলেন? আপনার তো জেলে থাকার কথা।”

” তোমার টানে চলে এসেছি ডার্লিং….”

কথা শেষ করার আগেই চোয়ালে ঘুঁষি খেয়ে আজমীর উল্টে পড়ল। তুলি আতঙ্কগ্রস্ত গলায় বলল,” প্রণয়, কি করলেন এটা?”

আজমীর উঠে প্রণয়ের দিকে তেড়ে আসতে নিচ্ছিল। তুলি সঙ্গে সঙ্গে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। প্রণয়কে নিজের পেছনে আড়াল করে বলল,” খবরদার আসবেন না।”

প্রণয় সজোরে তুলিকে সরিয়ে বলল,” এখান থেকে যাও তুলি, প্লিজ।”

” আমি যাবো না। আজমীর ভাই আপনি চলে যান। খবরদার আর কখনও আমাদের বাড়ির আশেপাশে আসবেন না।”

আজমীর হিংস্র কণ্ঠে বলল,” তুমি ওকে বিশ্বাস করলে ভুল করবে তুলি। ওকে তুমি একটুও চেনো না। ও কত মেয়ের লাইফ নষ্ট করেছে, জানো? তোমার লাইফও হেল করবে। ও একটা ক্যারেক্টারলেস।”

এবার প্রণয় তেড়ে যেতে নিচ্ছিল। তুলি তাকে থামিয়ে আজমীরের দিকে চেয়ে বলল, ” একদম চুপ। আমি আপনার কাছে প্রণয়ের ক্যারেক্টর সার্টিফিকেট জানতে চাইনি। আপনি বরং নিজের চরকায় তেল দিন। প্রণয়কে আমি অবশ্যই আপনার চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাস করি। ”

প্রণয়ের ঠোঁট হেসে উঠল। হৃদয়ে যেন কেউ শীতলতা ঢেলে দিল। শান্তি! আজমীর ক্রোধসিক্ত কণ্ঠে আওড়ালো,” ভুল করছো তুলি, বিরাট বড় ভুল।”

” আপনি যান প্লিজ। আপনাকে সহ্য করতে পারছি না এই মুহূর্তে। ”

আজমীর কাছে এসে কিছু বলতে নিলেই তুলি নিচে থেকে পাথর কুঁড়িয়ে নিল। সতর্ক করে বলল,” সাবধান, কাছে এলেই মেরে দিবো কিন্তু।”

তুলির দেখাদেখি প্রণয়ও পাথর কুঁড়িয়ে নিল এবং সে কোনোরূপ সতর্ক বাণী না দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুঁড়ে মারল। পাথর আজমীরের কপালে গিয়ে ঠেঁকলে সে চিৎকার করল, ” আহ!”

তুলি বলল,” যান এখান থেকে । নয়তো আমিও মারবো।”

আজমীর উপায়ন্তর না দেখে চলে গেল। কিন্তু দমে গেল না। সে এখানে এসেছেই একটি কু-মতলব নিয়ে। কয়েক দিন ধরেই পরিকল্পনা আঁটছিল। আজ সে তা বাস্তবায়ন করবে। তুলিকে অপহরণ করবে। কিন্তু প্রণয়ও এখানে আছে। তাই তার কাজ কিছুটা কঠিন হয়ে গেল।

আজমীর যেতেই তুলি প্রণয়ের দিকে চেয়ে সামান্য বিচলিত গলায় বলল,” দেখি ভেতরে চলুন। আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে তো! মাথা মুছতে হবে।”

প্রণয় তৃপ্ত কণ্ঠে বলল,” সত্যি আমাকে এতো বিশ্বাস করো তুমি?”

” আপনাকে অবিশ্বাস করবো কেন?”

প্রণয় অকপটে বলল,” আমরা যাকে ভালোবাসি তাকেই বিশ্বাস কর‍তে পারি।”

তুলি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” এটা কি আপনার আবিষ্কৃত থিউরি? মানে পৃথিবীতে যত মানুষকে আমরা বিশ্বাস করি সবাইকেই ভালোবাসি?”

” তুমি একটু ভেবে দেখো। কথাটা কিন্তু সঠিক।”

” এতো ভাবাভাবির সময় নেই। আপনি ভেতরে চলুন নাহলে ঠান্ডা লাগবে।”

তুলি এতোক্ষণ রান্নাঘরে ছিল। তাই তার শরীর অনেকটাই উষ্ণ। মুখ লাগছে তৈলাক্ত আর মায়াবী। প্রণয় স্থির দৃষ্টিতে তুলির ঠোঁটের দিকে চেয়ে বলল,” আমি একটা জিনিস চাইবো। যদি দাও তাহলে ভেতরে যাবো নাহলে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো।”

তুলির মুখ লাল হয়ে গেল লজ্জায়। সে সচকিত দৃষ্টিতে এপাশ-ওপাশ দেখে বলল,” এই খোলা জায়গায় এসব? ছিঃ!”

প্রণয় হেসে ফেলে জিজ্ঞেস করল,” তুমি কি করে বুঝলে যে আমি যেটা চাইবো সেটা খোলা জায়গায় দেওয়া যাবে না?”

তুলি হতচকিত হয়ে তাকাল। তৎক্ষণাৎ কি বলবে বুঝতে পারল না। প্রণয় খুব জোরে হাসতে লাগল৷ তুলি অস্বস্তি মেশানো কণ্ঠে বলল,” আপনি আসলে আসুন। না আসলে নেই। আমি যাচ্ছি।”

প্রণয় এবার হাসি থামিয়ে তুলির হাত চেপে ধরল। তুলিকে থামতেই হলো। কিন্তু মাথা নুইয়ে রাখল সে। প্রণয় তার চিবুক উপরে তুলে বলল,” তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে তুলি।”

তুলি প্রণয়ের চোখের দিকে চাইল না। যথাসম্ভব দৃষ্টি নিচু রেখে বলল,” থ্যাংকস।”

প্রণয় মনের আবেগকে প্রশ্রয় দিল। তুলির সম্মতি আছে জেনেই তার টসটসে মিষ্টি ঠোঁটে টুপ করে এঁকে দিল প্রলম্বিত গভীর চুমু। তুলি একহাত দিয়ে নিজের কামিজের কাপড় খামচে ধরল। তার কপাল ঘেমে গেল। ঠকঠক করে কাঁপছে শরীর।

সন্ধ্যায় উঠানের সামনের ব্যালকনিতে জমল চায়ের আসর। সামিরও এসেছে। তন্বি চা ঢালতে ঢালতে হাসিমুখে বলল,” আপনার এখন দুইজন বড়লোক শালি, জানেন? তুলি কিন্তু অনেক টাকার মালিক হয়ে গেছে।”

হেলাল সাহেব আর আশা আগেই সব শুনেছেন। তাই তন্বির কথায় অবাক হলেন না তারা। সামির চোখ বড় বড় করে চাইল,” কিভাবে?”

তুলি মিষ্টি হেসে বলল,” লটারী পেয়েছি সামির ভাই।”

সামির উল্লাসী কণ্ঠে চিৎকার করল,” দারুণ ব্যাপার! কিভাবে পেলে? কত?”

তুলি আগ্রহ নিয়ে গল্প শুরু করল৷ লটারীর গল্প বলার সময় তার চোখের দৃষ্টি হয়ে উঠল চকচকে, মুখে উপচে পড়তে লাগল খুশির ঝিলিক। তার এই আনন্দ দেখে প্রণয়ের ভালো লাগছে খুব। রাইফা ইশারায় প্রণয়কে ডাকছিল। তার অবস্থান ভেতরের ঘরে। প্রণয় আধ খাওয়া চায়ের কাপ রেখে ভেতরের রুমে গেল। সবাই তুলির গল্প শুনছিল তাই কেউ খেয়াল করল না ব্যাপারটা। রাইফা প্রণয়কে নিয়ে আলমারির আড়ালে এসে বলল,” আমাকে একটা হেল্প করতে পারবে?”

প্রণয় হতাশ গলায় বলল,” রিসবের ব্যাপারে?”

” হ্যাঁ।”

” তার আগে বলো কি হয়েছিল কালরাতে? তুমি তো ওই ব্যাপারে কিছুই বললে না। কিভাবে বুঝবো যে তোমাদের মধ্যে কি চলছে?”

” তেমন কিছু না। জাস্ট তোমার ভাই আমাকে রিজেক্ট করেছে।”

রাইফা তার কথা শেষ করে ব্যথিত দৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। প্রণয় বিস্মিত হয়ে বলল,” হোয়াট? তুমি প্রপোজ করেছিলে নাকি?”

” প্রপোজ করার তো প্রয়োজন নেই। তোমার ভাইয়া ভালো করেই বোঝে আমার ফিলিংস। তাই আকার-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে যে সে আমার প্রতি একদম ইন্টারেস্টেড না।”

” কিন্তু মিষ্টি আপু আর ছোটমা তো তোমাদের বিয়ের কথা ভাবছে!”

রাইফা আক্ষেপ নিয়ে বলল,” লাভ কি? তোমার ভাই তো আমাকে পছন্দ করে না।”

প্রণয়ের বিশ্বাস হচ্ছে না। সে নিজের ভাইকে চেনে। রিসবের আচরণটাই এমন রুক্ষ। কিন্তু সে অবশ্যই রাইফাকে পছন্দ করে। এই ব্যাপারে প্রণয় নিশ্চিত। সে বলল,” কি হেল্প চাও বলো।”

” রিসবকে ফোন করে বলো আমি মরে গেছি।”

প্রণয় হেসে ফেলল। রাইফা রেগেমেগে বলল,” হাসবে না। আমি সিরিয়াস।”

” মানে?”

” ওকে বলো আমি প্রচন্ড অসুস্থ। ডাক্তার বলেছে বেশিদিন বাঁচবো না। শেষ ইচ্ছা হিসেবে ওকে দেখতে চাইছি। তারপর যদি ও এখানে আসে।”

” সত্যি? এই কথা বলবো?”

” অবশ্যই।”

” আচ্ছা, বলবো। সেজন্য আমাকে অনেক অভিনয় করতে হবে। কাজটা সহজ না।”

” একটু অভিনয়ও করতে পারবে না? তোমার জন্য তো আমি দিন-রাত অভিনয় করছি তুলির সামনে।

তুলি হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়ল। রাইফা আর প্রণয়কে একসাথে দাঁড়ানো দেখেই সন্দেহী কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” কি ব্যাপার? তোরা এখানে কি করছিস?”

রাইফা আর প্রণয় দু’জনেই একটু থতমত খেল। রাইফা তড়িঘড়ি করে জবাব দিল,” কিছুই না। তুই কি কিছু বলবি?”

” মামী ডালের বড়া বানিয়েছে। তোদের খাওয়ার জন্য ডাকছে।”

” আচ্ছা যা। আমরা আসছি।”

তুলি ঘর থেকে বের হলো। তারপর তার ইচ্ছে করল রাইফা আর প্রণয়ের কথাগুলো শুনতে। কারণ তুলি খেয়াল করেছিল, রাইফা তার বিষয়েই কিছু বলছে। কি বলছে? এই ভেবে সে আবার ভেতরে ঢুকল। প্রণয় তখন বলছিল,” আচ্ছা রাইফা, তোমার কি মনে হয় আমরা ভুল করেছি?”

” কোন ব্যাপারে বলছো? লটারীর ব্যাপারে?”

” হুম।”

” একদমই সেটা মনে হচ্ছে না। আমরা যা করেছি সব তুলির খুশির জন্য। তুমি দেখছো না লটারী পেয়ে সে কত খুশি হয়েছে?”

” এইটা দেখেই তো ভয় বেশি লাগছে। লটারী পেয়ে সে এত্তো খুশি হয়ে গেছে কিন্তু যখন জানবে সব আমি করেছি তখন আবার দুঃখী হয়ে যাবে নাতো?”

” আমরা ওকে সত্যিটা কখনও জানতেই দিবো না প্রণয়। এটা ঠিক যে সত্যিটা জানলে তুলি অনেক কষ্ট পাবে। তার সব খুশি এক নিমেষে শেষ হয়ে যাবে। ”

তুলি এতটুকু শোনার পর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। এক দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ব্যালকনি পেরিয়ে যাওয়ার সময় আশা তাকে ডাকলেন,” আরে, আরে, কই যাচ্ছিস?”

তুলি জবাব দিল না। রাইফা বিরস মুখে প্রণয়কে বলল,

” আচ্ছা প্রণয়, তুলি কেন বড়লোক হতে চায় সেটা কি তুমি জানো?”

” জানি। কারণ সে আমাকে টেক্কা দিতে চায়।” এই কথা বলে প্রণয় হাসল। রাইফা বলল, ” একদমই না। তোমাকে টক্কর দিতে সে বড়লোক হতে চায় এটা ভুল। সে আসলে তার বাবাকে টক্কর দিতে চায়। তার বাবার থেকেও বেশি বড়লোক হতে চায়।”

প্রণয় হালকা বিস্মিত গলায় উচ্চারণ করল,” তুলির বাবা?”

” হুম। ওর বাবা অনেক বড় ব্যবসায়ী, অনেক টাকার মালিক। কিন্তু এই কথা তুলি কাউকে বলে না। সবাই জানে তার বাবা মৃত। কিন্তু আমাকে সে সত্যিটা বলেছে। তার বাবার সাথে তার মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছিল টাকার জন্য। তুলির মা গরীবের মেয়ে ছিল। তাদের বিয়েটা ছিল প্রেমের। তুলির মা তার বাবার সাথে পালিয়েছিল। জন্মের পর থেকেই তুলি দেখতো তার বাবা বিভিন্ন কথায় তার মাকে অপমান করে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। তুলির যখন বয়স মাত্র চার তখন তুলির মা জানতে পারে তুলির বাবার আরেক জায়গায় সংসার আছে। তিনি এসব নিয়ে ঝামেলা শুরু করলে তুলির বাবা আগের সংসার ঘরে এনে তুলি আর তুলির মাকে ত্যাগ করে দেয়। কিন্তু তুলির মা পালিয়ে এসেছিল তাই ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। তাদের যাওয়ারও কোনো জায়গা ছিল না। কাজের লোকের মতো ওই বাড়িতেই থাকতে হতো। তারপর একদিন তার মা মারা গেল। আর তুলিকে তার মামা নিয়ে এলো। ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্টের জীবন দেখেছে মেয়েটা। এজন্যই তার ভাগ্যের প্রতি এতো জেদ। সে বড়লোক হয়ে একদিন তার বাবাকে জবাব দিতে চায়। কিন্তু সে যদি কখনও বুঝতে পারে তুমি তাকে লটারী জিতিয়ে দিয়েছো তাহলে হয়তো তোমাকেও সে তার বাবার মতোই ঘৃণা করতে শুরু করবে। ভাববে তুমি তাকে দয়া দেখিয়েছো কিংবা অবমূল্যায়ন করেছো। এজন্য বলছি, কখনও তাকে এটা জানিয়ে দিও না। ও এখন যেভাবে খুশি আছে, সারাজীবন এভাবেই খুশি থাকুক।”

প্রণয় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে বলল,” চিন্তা কোরো না। আমি কখনও ওকে এটা বুঝতেই দিবো না।”

তন্বি হঠাৎ ঘরে ঢুকল। রাইফাকে দেখতে পেয়েই বলল,” আচ্ছা, তুলির সাথে কি তোর কিছু হয়েছে রাইফা?”

রাইফা ভ্রু কুচকে বলল,” নাতো,কেন?”

” তুলি হঠাৎ দৌড়ে কোথায় জানি চলে গেল। তাকে এখন কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

” হোয়াট?” প্রণয় গর্জন করল। তন্বি ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল,” মামা আর সামির বের হয়েছে খুঁজতে…”

প্রণয় বিনাবাক্যে বড় বড় কদম ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। কোথায় আছে তুলি? এই অন্ধকার রাতে সে কোথায় যেতে পারে? অশান্ত মনটা প্রণয়কে ভাবাচ্ছে খুব।

চলবে#বেদনার_রঙ_নীল
ছত্রিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

বাড়ি থেকে বের হয়েই হেলাল সাহেব বললেন,” তুমি ঘরে ফিরে যাও বাবা। তুলি আর যাবে কোথায়? বকুলদের বাড়ি আছে হয়তো৷ আমি ডেকে আনছি।”

” বকুলটা কে?” সামির জিজ্ঞেস করল কৌতুহল নিয়ে। হেলাল সাহেব উত্তরে বললেন,” আমাদের প্রতিবেশী। দুপুরে এলো যে! এইতো সামনেই তাদের বাড়িটা।”

সামির সামান্য বিভ্রান্তিবোধ নিয়ে বলল,” কিন্তু তন্বি যে বলছিল তুলি রাগ করে বের হয়ে গেছে?”

” রাগ করে বকুলদের বাড়িতেই বোধহয় গেছে।”

” আমিও যাই আপনার সাথে চাচা। চলেন।”

” আচ্ছা চলো।”

প্রণয় দৌড়ে এদিকে এলো। অস্থিরতা আর কৌতুহল মেশানো গলায় জিজ্ঞেস করল,” তুলিকে পাওয়া গেছে?”

হেলাল সাহেব পুনরায় একই উত্তর দিলেন,” বকুলদের বাড়িতেই বোধহয় গেছে। আমরাও সেখানে যাচ্ছি। ”

প্রণয় আর কিছু না বলে দৌড়ে বকুলদের বাড়িতে ঢুকল। দুপুরে তুলির সাথে সে এই বাড়িতে এসেছিল বলে বাড়িটা তার চেনা। বকুল রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়েছিল। প্রণয়কে দেখতে পেয়েই সে হাসল। সালাম দিল,” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”

প্রণয় ভেতরের ঘরে উঁকি দিয়ে বলল,” তুলি এসেছে নাকি?”

” এসেছিল। মাত্রই চলে গেল।”

” কোথায় গেছে?”

” তা বলতে পারবো না। কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে গেছে।”

” কাঁদছিল কেন?” প্রণয় উদ্বিগ্ন, ব্যাকুল। বকুল ছোট্ট করে বলল,” জানি না।”

একটু পর আবার বলল,” ওর সাথে নাকি সবাই প্রতারণা করেছে। আমি নুডলস রেঁধেছিলাম। খেল না। কয়েকবার সাঁধলাম। সে শুধু কেঁদেই যাচ্ছিল। আপনাদের মধ্যে কি কিছু হয়েছে? প্রতারণার ব্যাপারটা কি বলে গেল বুঝলাম না..”

প্রণয় দ্রুত পায়ে বের হয়ে যেতে নিল। দরজার সামনে দাঁড়ানো সামির এবং হেলাল সাহেব। সামির প্রশ্ন করল,” তুলি নেই?”

প্রণয় মাথা নাড়ল কেবল। মুখ দিয়ে কিছুই বলল না। তার এলোমেলো লাগছে সব। তুলি নিশ্চিত তাদের কথা শুনেছে। নাহলে প্রতারণার কথা বলবে কেন?

দিঘীর সামনে একটি সিমেন্টের আসনে বসে কাঁদছে তুলি। তার চোখে টর্চের আলো পড়ল। কেউ দূর থেকে টর্চ মারছে। দুইহাতে চোখ ঢেকে আবার তাকাল সে। এখন আর টর্চের আলো আসছে না। হুট করে কিছু একটা ছুটে গেল। কি হচ্ছে এখানে? তুলি দেখার জন্য পা বাড়াতে নিলেই পেছন থেকে ডাকল প্রণয়। তুলি ত্বরিতে পেছনে চাইল। প্রণয়কে ছুটে আসতে দেখেই সবেগে জমিন থেকে পাথর কুঁড়িয়ে নিল সে। প্রণয় আরও কাছে আসতেই ছুঁড়তে লাগল একের পর এক পাথর। প্রণয় নিজেকে বাঁচাতে সরে সরে যাচ্ছিল। এক ফাঁকে বলল,” প্লিজ তুলি থামো। আমাকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দাও প্লিজ?”

তুলি চিৎকার করল ক্রোধসিক্ত কণ্ঠে,” আপনার থেকে কোনো এক্সপ্লেনেশন শুনতে চাই না আমি। এখান থেকে চলে যান। আজকে আজমীর ভাইয়ের কথা বিশ্বাস না করে আমি সত্যিই ভুল করেছি। আপনাকে এতো বিশ্বাস করলাম আর আপনি এই প্রতিদান দিলেন?”

প্রণয় অসহায়ভাবে তাকিয়ে করুণ কণ্ঠে বোঝানোর চেষ্টা করল,” বিশ্বাস করো আমি শুধু তোমাকে খুশি দেখতে চেয়েছিলাম। আমার এই চাওয়াটা কি অন্যায়? তুমি একটু বোঝো আমাকে। কোনো খারাপ ইনটেনশন ছিল না আমার।”

তুলি বজ্রকণ্ঠ ধমকালো,” এখনও কাছে আসছেন আপনি? খবরদার, চলে যান বলছি। আমি আপনাকে দেখতেও চাই না আর আপনার কোনো কথা শুনতেও চাই না।”

” তোমাকে অবশ্যই আমার কথা শুনতে হবে তুলি। আর শুনতে না চাইলেও আমি বলবো।”

তুলি দুই হাতে কান চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। এখন আর প্রণয়কে দেখতেও হবে না আর তার কথাও শুনতে হবে না। সে প্রণয়ের উপস্থিতিটুকুও সহ্য করতে পারছে না এই মুহূর্তে। কিন্তু প্রণয় হলো নাছোড়বান্দা। সে ঠিকই তুলির কাছে এলো। তুলি তাকে অগ্রাহ্য করতে চোখ বন্ধরত অবস্থাতেই আরও পিছিয়ে গেল। তখনি পা হলকে ফট করে উল্টে পড়ল দিঘীর জলে। প্রণয় চিৎকার করে ডাকল,” তুলি!”

তুলি চিৎকার করল আরও জোরে,” সাপ, সাপ! এখানে সাপ আছে, আমাকে বাঁচান প্লিজ।”

” আমার হাত ধরে উঠে এসো।”

প্রণয় বাড়িয়ে দিল তার হাতটা। তুলি ধরতে নিয়েও থেমে গেল। প্রণয় সহাস্যে বলল,” এখন অন্তত সব ভুলে যাও। পাঁচ সেকেন্ডের জন্য!”

তুলি আড়ষ্টভাবে হাত বাড়ালো। প্রণয় তাকে ইচ্ছে করেই হেঁচকা টান দিল। তুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আছড়ে পড়ল প্রণয়ের গায়ে। প্রণয় তাকে শক্ত করে ধরতেই সে রেগেমেগে প্রায় লাফিয়ে উঠল। ধাক্কা মেরে প্রণয়কে সরিয়ে দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রণয়ের টি-শার্ট ভিজে গেছে তুলির চুলের পানিতে।সে টি-শার্ট ঝাড়তে ঝাড়তে আঁড়চোখে তুলির দিকে চাইল। তুলির মুখ থমথমে। কিন্তু ভেজা চুল আর ভেজা গায়ে তাকে অসম্ভব আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তুলির কাছে গেল। তার মুখটা নিজের আঁজলায় নিয়ে কোমনীয় কণ্ঠে বলল,” প্লিজ তুলি, এইরকম কোরো না। আমি যদি বুঝতাম তাহলে এটা করতাম না। ভুল হয়েছে আমার। অনেক বড় ভুল। স্যরি।”

তুলি চোখ মেলে তাকিয়ে ক্লান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” কিভাবে এতো সহজে ক্ষমা করে দেই আপনাকে? আপনি হলে পারতেন?”

প্রণয় থমকে গেল। তৎক্ষণাৎ দেওয়ার মতো কোনো উত্তর খুঁজে পেল না বলে জীভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। তুলি অবজ্ঞাসূচক হাসি দিয়ে আবার একই প্রশ্ন করল,” আমার জায়গায় আপনি হলে কি করতেন? বলুন এখন!”

প্রণয় দুই পাশে মাথা নেড়ে বলল,” জানি না আমি। কিন্তু তোমাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি, বিশ্বাস করো।”

তুলি নির্মম কণ্ঠে বলল, ” আমার চোখের দিকে চেয়ে বার-বার মিথ্যা বলেছেন আপনি। আর এখন ভালোবাসার দোহাই দিচ্ছেন? ভাবছেন আপনাকে আমি ক্ষমা করে দিবো? স্যরি, এতো মহান আমি না। আমি পারবো না আপনাকে এতো সহজে ক্ষমা করতে। আমার চোখের সামনে থেকে আপনি চলে যান। প্লিজ চলে যান!”

” আচ্ছা, যাবো। তার আগে তুমি ঘরে চলো। ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাকে তোমার দেখতে ইচ্ছে না হলে আমি ঘরে ঢুকবো না।”

” আমার ঘরেও যেতে ইচ্ছে করছে না। রাইফার চেহারাও আমি দেখতে চাই না। সে একটা বিভীষণ! ও যেন কখনও আমার সামনে না আসে।”

” আচ্ছা আসবে না। তুমি ঘরে চলো।”

প্রণয় হাত ধরতে নিলেই তুলি চোখ রাঙিয়ে বলল,” যান এখান থেকে। গেট লস্ট!”

প্রণয় হার মেনে চলে যেতে লাগল। তুলি কিছুটা স্বস্তি নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেই না ছাড়তেই আবার ফিরে এলো প্রণয়। এবার তুলি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে কোলে উঠিয়ে নিল তুলিকে। ডাঙায় তোলা মাছের মতো অবিরাম চার হাত-পা ঝাপটাতে লাগল তুলি। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,” এসব কি করছেন আপনি?”

প্রণয় নির্বিকার কণ্ঠে বলল,” কথা না শুনলে তো এসবই করতে হবে।”

” পাগল আপনি। এখনি ছাড়ুন আমাকে।”

” ঠিক বলেছো। আমি পাগল। এজন্যই ছাড়বো না।”

” মামা-মামী দেখলে কি ভাববে? আচ্ছা, ঘরে যাচ্ছি আমি। দয়া করে আমাকে নিচে নামান।”

প্রণয় এই কথা শুনে তাকে ছাড়ল। কোল থেকে নামিয়ে বলল,” গুড গার্ল।”

তুলি গটগট করে হেঁটে যেতে লাগল। এমনভাবে জমিনে পা ফেলছে যেন মাটি ফেঁটেই যাবে। প্রণয় হাসিমুখে মাথা নিচু করে তার পিছু হাঁটছে। দরজার কাছে আসতেই আশা জিজ্ঞেস করল,” হনহন করে কই গেছিলি?”

তুলি খিটমিট করে বলল,” জাহান্নামে।”

” ওমা, ভিজলি কিভাবে?”

তুলি মামীর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রাগী দৃষ্টিতে প্রণয়ের দিকে চাইল। প্রণয় হাসি চাপিয়ে বলল,” দিঘীতে ঝাঁপ দিয়েছিল আন্টি।”

” হঠাৎ ঝাঁপ দিতে গেল কেন?”

” রাগ একটু বেশি তো, তাই!”

” কার উপর এতো রাগল?”

প্রণয় অভাগার মতো বলল,” আমার উপর।”

” তুমি আবার কি করলে?”

” সেটা তো ও জানে!”

আশা এবার উত্তরের আশায় তাকাল তুলির দিকে। তুলি গজগজ করে বলে উঠল,” গরম পানি দাও। গোসল করবো। উনার ফালতু কথা শোনার দরকার নাই।”

এই শীতল সন্ধ্যায় গোসল করতেই হলো তুলিকে। সে গোসল শেষ করে দরজা আটকে ঘরে ঢুকে পড়ল। রাতে খাওয়ার জন্যে তাকে যখন ডাকা হলো, সে জবাব দিল না। রাইফা ভয়ে ভয়ে গেল। দরজার কাছে এসে ঠকঠক করে বলল,” তুলি, দরজা খোল প্লিজ।”

তুলি নীরবতা ভেঙে খেঁকিয়ে উঠল,” তুই এখান থেকে যা হারামি। তোর এই বিশ্বাসঘাতকতা আমি সারাজীবন মনে রাখবো।”

” প্লিজ অন্তত আমার সাথে এমন করিস না। আমি জাস্ট তোকে হ্যাপি দেখতে চেয়েছিলাম।”

” কেন চাইবি তুই? প্রণয়ও একই এক্সকিউজ দিল।পৃথিবীর সব মানুষ খালি আমাকে হ্যাপি দেখতে চায়। বাহ, ওয়ান্ডারফুল! হ্যাপি করার জন্য আমাকে তোরা ধোঁকা পর্যন্ত দিয়ে ফেললি। কেন আমাকে হ্যাপি দেখার এতো শখ তোদের? আমি কি আনহ্যাপি ছিলাম?”

” তুলি তুই দরজাটা খোল! আমাকে একবার কথা বলার সুযোগ দে!”

” এই দরজা আমি সকালের আগে খুলবো না। তুই বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু আমি উনিশ-বিশ কিছু একটা করে ফেলবো। তখন বুঝবি। যা এখান থেকে।”

রাইফার ফোন বেজে উঠল। নাম্বারটা দেখেই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ল। তার ফোনে রিসবের অনেকগুলো নাম্বার সেইভ করা। সে দরজা থেকে সরে ফোনটা রিসিভ করল আগে। তবে এই মুহূর্তে তার মনটা একদম ভালো ন্য। তাই বিরস গলায় শুধু বলল,” হ্যালো।”

ওই পাশ থেকে ভেসে এলো রিসবের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ,” তুমি কোথায় রাইফা? দেখা করতে পারবে?”

আচমকা এমন প্রশ্নে চমকালো রাইফা।

” দেখা করবো মানে? কোথায়?”

” আমি ফরাজগঞ্জ এসেছি। তোমাদের জায়গার নাম কি? বলো?”

রাইফা হত বিস্ময়ের সুরে বলল,” এই রাতে আপনি ফরাজগঞ্জ চলে এসেছেন? আনবিলিভেবল! কোথায় আছেন আপনি?”

” এইতো, এটা একটা ঘাঁট। যেখানে লঞ্চ থামে। ঘাঁটের নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না। কি যেন! ”

” বুঝেছি, বুঝেছি। আপনি ওখানেই থাকুন আমি দ্রুত আসছি।”

রাইফা ফোন রেখেই কয়েকবার অযথা লাফ দিল। তারপর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল সে। এতো খুশিতে গদগদ হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। রিসব কফিশপে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল৷ সে কি ওই কথা এতো সহজে ভুলে যাবে? কিন্তু রাইফা নিজের আবেগকে দমাতে পারছে না। তার এতো ভালো লাগছে কেন? তুলির দরজায় আবার করাঘাত করল সে।

” তুলি, দরজাটা খোল প্লিজ। জানিস কি হয়েছে?”

ওই পাশ থেকে কোনো জবাব এলো না। রাইফা কিছুক্ষণ একাই বকবক করে থেমে গেল৷ তন্বিকে ব্যালকনিতে যেতে দেখে সে ডাকল,” এই তন্বি দাঁড়া। আমার সঙ্গে একটা জায়গায় যাবি?”

” এইরাতে? কোথায় যাবি?”

রাইফা লাজুক কণ্ঠে বলল,” রিসব এসেছে।”

অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও কেউ আর ডাকতে আসছে না। দরজাতেও চপোটাঘাত পাওয়া যাচ্ছে না। তুলি ঘড়ির দিকে চাইল। রাত এগারোটা বাজে। সবাই কি ঘুমিয়ে পড়েছে? তুলি ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাইরে তাকাল। আশেপাশে কেউ নেই। বাড়ি পিনপতন নীরবতায় খাঁ খাঁ করছে। তুলি নিশ্চিত হলো যে সবাই শুয়ে পড়েছে। তার বাথরুমে যাওয়া প্রয়োজন। তাই সে বাথরুমে চলে গেল। দশমিনিট পর ফিরে আসতেই দেখল প্রণয় শুয়ে আছে তার বিছানায়। তাকে দেখেই আৎকে উঠল তুলি। ইচ্ছে করল জোরে চেঁচাতে। কিন্তু মামা-মামী দেখলে কি ভাববে? এই কথা চিন্তা করে আর চেঁচালো না। বিছানার কাছে গিয়ে কটমটে দৃষ্টিতে ফিসফিস করল,” এখানে কি করছেন আপনি?”

প্রণয় চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভং ধরে আছে। তুলি তাকে ধাক্কা দিল। প্রণয় কোনো সাড়া প্রদান করছে না৷ তুলি রেগে এবার ঘুষি মারল তার বুকে। প্রণয়ের হাসি চলে এলো। চোখ খুলেই তুলির হাত দু’টো চেপে ধরে বলল,” আই এম স্যরি।”

তুলি ইস্পাতের মতো কঠিন মুখভঙ্গি নিয়ে বলল,” বের হয়ে যান।”

” না গেলে কি করবে?”

তুলি চোখ বড় করে চাইল। ডানপাশে তাকিয়ে মশা মারার ব্যাটটা দেখিয়ে বলল,” ওটা দিয়ে মাথা ফাঁটিয়ে দিবো আপনার।”

প্রণয় হেসে উঠল। তুলি গম্ভীর গলায় নিষেধ করল,” হাসবেন না।”

হাসি থামিয়ে প্রণয় সিরিয়াস গলায় বলল,” আচ্ছা, মানলাম আমি একটা ভুল করেছি। তাই বলে তুমি এমন করবে? আমরা দু’জন চুপচাপ বসে আলোচনা করলেই কিন্তু ঝামেলাটা ফিক্স করে নিতে পারি। ”

” আপনার সাথে বসার কোনো ইচ্ছা নেই আমার।”

” তাহলে কি শুয়ে পড়বে?”

তুলি গরম চোখে তাকাল। প্রণয় হাসি মুখে বলল,” বিছানাটা খুব আরামদায়ক। উই শ্যুড ট্রাই।”

তুলি এবার মশার ব্যাটটা উঠিয়ে প্রণয়ের পিঠে আঘাত করতে লাগল। প্রণয় ব্যথা সূচক শব্দ উচ্চারণ করেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ” স্যরি, স্যরি, আচ্ছা দাঁড়িয়ে কথা বলবো। শোয়া ক্যান্সেল।”

তুলি প্রণয়ের হাত ধরে দরজা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,” আমি আপনার সাথে কোনো কথা বলবো না। আপনি এখনি এই ঘর থেকে বের হবেন। নাহলে আমি এমন চিৎকার করবো যে গ্রামবাসী এসে আপনাকে পেটাবে।”

প্রণয় বেশ অবাক হয়ে বলল,” তাই নাকি?”

” আপনি যাবেন না?”

আচমকা হেলাল সাহেবের কাশির শব্দ ভেসে এলো। সাথে দরজা খোলার খটমট। নিশ্চয়ই হেলাল সাহেব ঘর থেকে বের হচ্ছেন। তুলি দ্রুত প্রণয়কে টেনে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দিল। তারপর ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখল মামা সত্যিই বের হচ্ছে কি-না। প্রণয় খুশি খুশি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” তোমার মামা দেখলে কি হতো? আমাকে বাঁচালে কেন?”

” আমি আপনার কথা ভাবিনি। নিজের কথা ভেবে আপনাকে বাঁচিয়েছি৷ মামা এইসময় আপনাকে আমার রুমে দেখলে আমাকেই জেরা করবে। আপনাকে কিছু বলবে না।”

হেলাল সাহেব জড়ানো কণ্ঠে ডাকলেন,” তুলি, তন্বি, তুলিরে…”

তুলি ঘরের ভেতর থেকে জবাব দিল না। আশা বের হয়ে বলল,” কাদের খুঁজছো? ওরা তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ”

হেলাল সাহেব বিচলিত কণ্ঠে আওড়ালেন,” তন্বি আর সামির তো ঘরে নেই। এইতো ঘরের দরজা খোলা। ওরা কি তুলির ঘরে শুয়েছে?”

আশা বলল,” মনে হয়।”

” তুলির ঘরের দরজা তো আটকানো। ওরা তুলির ঘরে শুয়ে থাকলে তুলি কই গেল?”

” আমি তো জানি না। আচ্ছা, তুমি ঘরে চলো। আমি দেখছি।

” আরে থামো, আমি ঘরে যাবো কেন? মেয়েগুলো কই গেল দেখতে হবে না? রাইফাকেও তো পাওয়া যাচ্ছে না। প্রণয়ই বা কোথায়?”

প্রণয় তুলির হাত ধরে বলল,” তুলি চলো আমরা বরং কাঁথার নিচে ঢুকে ঝামেলাটা ফিক্স করি।”

তুলি ঝারি মেরে হাত ছাড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে বলল,” খবরদার আমাকে আরেকবার শোয়ার কথা বললে আপনাকে মার্ডার করে দিবো।”

হেলাল সাহেব তখনি দরজা ধাক্কাতে লাগলেন। এতো জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছেন যে না খুলেও উপায় নেই। তুলি তার মামাকে চেনে। সে ঘুমের ভাণ ধরে পড়ে থাকলে মামা দরজাই ভেঙে ফেলবেন। আর প্রণয়কেও লুকানোর জায়গা নেই এই ঘরে। ঘরটা খুব ছোট। খাট আর ড্রেসিংটেবিল ছাড়া কিছু নেই। এগুলোর মাঝে প্রণয়কে লুকানো সম্ভব না। তুলি ভাবছিল কি করবে কিন্তু এর আগেই দেখা গেল প্রণয় নিজেই বিছানায় শুয়ে পুরো শরীর কাঁথা দিয়ে ঢেকে ফেলছে। তুলির দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে সে একবার বলল,” এজন্যই শোয়ার কথা বলেছিলাম। দেখলে তো, এখন শুতেই হচ্ছে!”

তুলি বিরবির করে বলল,” আপনি এই ঝামেলা ফিক্স করার কথা বলেছেন?”

” তুমি কি ভেবেছো?”

তুলি মনে মনে সূরা ইখলাস পড়ে দরজা খুলে দিল। হেলাল সাহেব হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে বললেন,” তোরা কি মরার ঘুম দিয়েছিস?”

তুলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,” কি হয়েছে হঠাৎ? ”

আশা মলিন মুখে বলল,” তন্বি, সামির, প্রণয়, এদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

হেলাল সাহেব জহুরী চোখে বিছানার দিকে চেয়ে বললেন,” এটা কে?”

তুলি জবাব দিতে গিয়ে হিঁচকি তুলে ফেলল,” রাইফা।”

হেলাল সাহেব ভ্রু কুঁচকে স্বগতোক্তি করলেন,” এতো লম্বা লাগছে কেন রাইফাকে?”

তুলি প্রশ্ন করল,” কোথায় লম্বা? ঠিকই তো আছে। ও আবার সাথে কোলবালিশও নিয়েছে।”

” নাক-মুখ ঢেকে ঘুমাচ্ছে কেন? ওকে বল মুখ থেকে কাঁথা সরাতে।”

তুলির কলিজার পানি শুঁকিয়ে এলো।

” ও তো ঘুমাচ্ছে মামা! বললেও শুনবে না।”

হেলাল সাহেব স্ত্রীর দিকে চেয়ে বললেন,” আশা, কাঁথাটা সরাও তো দেখি।”

তুলি সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় শুয়ে পড়ল আর বলল,” আমরা ঘুমাচ্ছি। প্লিজ আমাদের বিরক্ত কোরো না। যাও তোমরা এখান থেকে। ধ্যাত!”

” তুই কার সাথে ঘুমাচ্ছিস? ওইটা তো রাইফা নাও হতে পারে।”

তুলি চোখ বড় বড় করে তাকাল। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বলল,” তোমাকে কে বলল যে এটা রাইফা না?”

আশা হেসে বলল,” ধূর, তোর মামার মাথার ঠিক নাই। এই চলো তো তুমি। তন্বিরা কই গেল দেখি। ওরা ঘুমাক।”

হেলাল সাহেব বের হতে নিলেই প্রণয় হাঁচি দিল। তুলির আত্মা ছলাৎ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে হেলাল সাহেব তাকালেন।

” রাইফা জেগে আছে নাকি? এই রাইফা তুমি কথা বলছো না কেন?”

তুলি তড়িঘড়ি করে বলল,” ওর ঠান্ডা লেগেছে মামা। ঘুমের মধ্যেই কাশছে।”

” আরে আগে বলবি না? কাশির ঔষধ ছিল তো।”

” ঔষধ লাগবে না।”

” কেন লাগবে না? সর্দি আছে নাকি? একটা ড্রপ দিয়ে দে। আশা, আমার ঘরে যে নাকের ড্রপটা আছে ওইটা এনে দাও। কাশির ঔষধও এনো।”

” এখনি আনছি।”

তুলি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যে বলল,” তন্বিরা কোথায় মামা? ওদের খুঁজতে যাচ্ছো না কেন?”

তখনি দেখা গেল তন্বি আর সামির হাসিমুখে গল্প করতে করতে ঢুকছে। হেলাল সাহেব তুলির ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেই তাদের প্রশ্ন করলেন,” এই, তোমরা এই রাতে কই গিয়েছিলে?”

সামির জবাব দিল,” তন্বির একটু হাঁটতে ইচ্ছে করছিল। তাই ওকে নিয়ে হেঁটে এলাম।”

” বাইরে অনেক ঠান্ডা। এতো হাঁটাহাঁটির দরকার নেই। একজন তো জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছে।”

তন্বি জিজ্ঞেস করল,” কে জ্বর বাঁধিয়েছে? তুলি?”

” না। রাইফা।”

তন্বি প্রস্তুরীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে তো রাইফাকে রিসবের সাথে বাইরে রেখে এসেছে। সে তো সুস্থই আছে! তন্বি তুলির ঘরে ঢুকেই হতভম্ব হয়ে গেল। সত্যিই তুলির পাশে কাঁথা গায়ে কে যেন শুয়ে আছে! এটা রাইফা হতে পারে না। তাহলে কে? তুলি করুণ দৃষ্টিতে তন্বির দিকে তাকাল। আশা ঔষধ আর কুসুম গরম পানি নিয়ে ঘরে ঢুকল। শান্ত গলায় বলল,” রাইফাকে ডাক, ঔষধটা খেয়ে নিক।”

তুলি অনুরোধের স্বরে বলল,” আমি পরে খাইয়ে দিবো। রেখে যাও।”

হেলাল সাহেব সরু দৃষ্টিতে বললেন,” এখনি খাওয়াও। ওকে ডাকতে সমস্যা কি? আর এই মেয়ে বয়রা নাকি? এতো চিৎকার-চেঁচামেচি হচ্ছে তাও ঘুম ভাঙে না!”

তুলি সামান্য রেগে বলল,” উফ, তোমরা এমন করছো কেন? সামান্য একটা হাঁচিই তো দিয়েছে ও৷ এজন্য একদম ঘুম থেকে তুলে ঔষধ খাওয়াতে হবে? আদিখ্যেতারও শেষ নেই একদম। যাও আমার ঘর থেকে প্লিজ। আমি ওকে পরে ঔষধ খাওয়াবো।”

তুলি সবাইকে ঠেলে-ঠুলে বের করে দিতে লাগল। তন্বি এতোক্ষণে সব বুঝে গেছে। হেলাল সাহেব আশ্চর্য গলায় বললেন,” তুই এতো ক্ষ্যাপছিস কেন?”

” আমার ভালো লাগছে না তাই। সরো তোমরা।”

তুলি সবাইকে বের করে দরজা আটকে দিতেই শেষ অঘটনটা ঘটল। রাইফা সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। সবাইকে বসার ঘরে দাঁড়ানো দেখে সে চিন্তিত মুখে বলল,” কি হয়েছে?”

রাইফার উপস্থিতি সবাইকে বিমূঢ় বানিয়ে দিল। হেলাল সাহেব বড় বড় চোখে রাইফার দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ গর্জন করলেন,” তুমি এখানে মানে? তাহলে তুলির ঘরে কে? এই তুলি, দরজা খোল!”

গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলেন হেলাল সাহেব। তুলির প্রাণ তখন ঠোঁটের আগায়। প্রণয় উঠে বসেছে। চোখে হাত রেখে হাসছে। তুলি বিরবির করে বলল,” সব দোষ আপনার। তবুও কিভাবে হাসছেন? লজ্জা করে না?”

চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here