বেদনার রং নীল পর্ব -৩৯+৪০

#বেদনার_রঙ_নীল
ঊনচল্লিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

প্রণয়ের সিদ্ধান্ত এক নিমেষে সবাইকে হতাশ করে দিল। হেলাল সাহেব রাতের খাবার খেয়ে চলে যেতে বললেন কাজী সাহেবকে। বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন হচ্ছে না। সবার চেহারায় দুঃখের ছাপ সৃষ্টি হলো। যেন বিয়ে না হওয়াটা মানুষ মরে যাওয়ার মতো কঠিন ব্যাপার। প্রণয়কে ব্যালকনিতে দাঁড়ানো দেখে হেলাল সাহেব গম্ভীর চিত্তে বললেন,” তুমি এই কাজটা একদম ঠিক করোনি। আমি যে তোমাকে বিশ্বাস করে ভুল করেছি সেটা তুমি প্রমাণ করে দিলে। আর কখনও আমার সামনে এসো না।”

প্রণয় মাথা নত করে উত্তাল কণ্ঠে জানাল,”তুলিকে বিয়ে করতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি যে কোনো অবস্থাতেই তুলিকে বিয়ে করতে রাজি। কিন্তু তুলি এখন বিয়ের জন্য প্রস্তুত না। এই বিয়ে যদি ও করে তাহলে বাধ্য হয়ে করবে। আমি ওকে বাধ্য করতে চাই না।”

হেলাল সাহেব কোনো প্রতিউত্তর করলেন না। ভেতরের ঘর থেকে তুলি সেই কথা শুনতে পেয়ে একটু পর বেরিয়ে এলো। প্রণয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সে বিরস মুখে বলল,” বিয়ে যদি করতেই না হয় তাহলে রাজি হয়েছিলেন কেন?”

” ভুল হয়েছে।” সহজভাবে স্বীকারোক্তি দিল প্রণয়। তুলি ছলছল দৃষ্টি মেলে চাইল। ভেজা কণ্ঠে বলল,” তাহলে আরও একটা ভুল করুন।”

” মানে?”

” মানে আমি চাই বিয়েটা হোক। আপনি আমাকে বিয়ে করুন।”

” ভেবে বলছো?”

” আর ভাবার কিছু নেই।”

রাত ঠিক বারোটায় প্রণয় আর তুলির বিয়ে হয়ে গেল। পরদিন সকালে তারা রওনা হলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। তুলির মামা-মামী খুশি মনে তাদের বিদায় জানালেন। গ্রামে বিয়ের খবর ছড়িয়ে গেল। আজমীর অবশ্য এই নিয়ে কোনো ঝামেলা পাকানোর সুযোগ পেল না। সকাল হতেই তুলিরা গ্রাম ছেড়ে দিয়েছিল। রিসব চলে গেল তার গন্তব্যে। আর তুলিরা ফিরে এলো ঢাকায়। সবকিছু আগের নিয়মেই চলতে লাগল। রোজ রাইফা আর তুলি কোচিং-এ যায়। মন দিয়ে লেখাপড়া শুরু করেছে তারা। তুলি ভীষণ চেষ্টা করছে ভালো কোথাও চান্স পাওয়ার জন্য। এডমিশন টেস্ট আসতে খুব বেশি দেরি নেই। প্রণয় তার বাড়িতে কাউকে এখনও বিয়ের কথা জানাতে পারেনি। তুলিই নিষেধ করেছিল। লটারীর সেই ঘটনা নিয়ে তুলি কিঞ্চিৎ রাগান্বিত। সে প্রায় পঞ্চান্ন হাজার টাকা খরচ করে ফেলেছে। বাকি ঊনচল্লিশ লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা সে প্রণয়কে ফিরিয়ে দিয়েছে। বাকি টাকাও খুব শীঘ্রই ফিরিয়ে দিবে। এইতো সেদিন শানকে পড়াতে এসেছিল তুলি। মিষ্টি তার হাতে বেতন তুলে দিতে নিলেই সে বলল,” আগামী কয়েক মাস আমি বেতন নিবো না আপু। ”

মিষ্টি অবাক হয়ে জানতে চাইল,” ওমা কেন? বেতন কেন নিবে না?”

প্রণয় তাদের কথা শুনতে পেয়ে সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে গেল। তুলি আঁড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল,” আমি প্রণয় ভাইয়ার থেকে কিছু টাকা ধার করেছিলাম। সেই ধার শোধ দেওয়ার জন্যই বেতন নিবো না।”

কৌতুহলী হলো মিষ্টি। প্রশ্ন করল সবিস্ময়ে,” তাই নাকি? কত ধার নিয়েছো?”

” প্রায় পঞ্চান্ন হাজারের কাছাকাছি। যতদিন ওই টাকা শোধ না হচ্ছে, আমি শানকে এমনিই পড়াবো। বেতন দিতে হবে না।”

তুলি এই কথা বলে চলে আসতে নিলেই প্রণয় দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নামল। তুলির পথ রোধ করে বলল,” এখন তোমার টাকা শোধ দেওয়ার দরকার নেই তুলি। সময় হলে দিও।”

তুলি মৃদু হেসে বলল,” স্যরি, আমি অপেক্ষা করতে চাই না। বেশি দিন কারো কাছে ঋণী থাকতে আমার ভালো লাগে না।”

প্রণয় মিষ্টির সামনে আর কিছু বলতে পারল না সেদিন। তবে তুলি যে তাকে এখনও ক্ষমা করেনি এইটুকু বুঝতে পেরেছিল সে ভালো করে। ইদানিং তুলি প্রণয়ের ফোনটাও ধরে না। ঘটনাচক্রে দেখা হলেও এড়িয়ে যায়।তাদের বিয়ে হয়েছিল এই ব্যাপারটা যেন তুলি মানতেই পারছে না। একটা মানুষকে ঠিক যতভাবে অবহেলা করা যায়, তার চেয়েও বেশি অবহেলা করছে তুলি প্রণয়কে।

রাইফা তুলির হাব-ভাব বুঝতে পারছে না। মেয়েটা কিছুদিন ধরে খুব অদ্ভুত আচরণ করে। আগে সে রাইফার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাতো। দুইদিন ধরে তুলি আলাদা থাকতে চাইছে। রাইফা প্রশ্ন করেছিল,” তোর কি সমস্যা? আমার সাথে ঘুমাতে কি প্রবলেম হয়?”

তুলি মলিন মুখে বলেছিল,” সামনে এডমিশন টেস্ট। তাই আমি রাত জেগে পড়াশুনা করি। আলো জ্বালানো থাকলে তোর ঘুম আসবে না। এজন্যই আলাদা ঘরে থাকছি।”

” আলো জ্বালানো থাকলেও আমার ঘুমে প্রবলেম হবে না। তোর আলাদা থাকার কোনো দরকার নেই।”

তুলি তবুও শোনেনি। ত্যাড়া গলায় বলেছে,” নিশ্চয়ই দরকার আছে। আর এই বিষয়ে তোর সাথে নেক্সট টাইম তর্ক করতে চাই না।”

রাইফা অবাক হয়ে গেছিল। তার মনে সন্দেহের সৃষ্টি হলো। সেই সন্দেহ থেকেই একদিন রাতে সে তুলির ঘরে আড়ি পেতে লক্ষ্য করল, তুলি কাঁদছে। হাউমাউ করে কাঁদছে! রাইফা বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল। কি হয়েছে তুলির? হাসি-খুশি মেয়েটা হঠাৎ এমন ভেঙে পড়ল কিভাবে? তাছাড়া আগে তো তুলি তার জীবনের সব গোপন কথা রাইফার সাথে শেয়ার করতো। এখন কিছুই বলে না। সব নিজের মধ্যে চেপে রাখে। আর গভীর রাতে এভাবেই বুক ভাসায়। তুলির ব্যাপারটা কি? রাইফা তদন্ত শুরু করল। তুলির প্রতিটি পদক্ষেপ সে খেয়াল করতে লাগল। সকালে যেদিন কোচিং থাকে না সেদিন রাইফা অনেক বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। আজও কোচিং এ ক্লাস ছিল না। কিন্তু রাইফার ঘুমটা ভেঙে গেল। সে ভাবছিল বাথরুম থেকে এসে আবার ঘুমাবে। তখনি পাশের রুম থেকে শব্দ শুনল, তুলি কোথায় যেন যাচ্ছে। রাইফা বের হয়ে ঘুমো ঘুমো চোখে জিজ্ঞেস করল,” কই যাচ্ছিস তুলি?”

হঠাৎ রাইফার আগমনে তুলি যেন আৎকে উঠল কিছুটা। চোরের মতো আমতা-আমতা করে বলল,” একটা কাজে।”

” এতো সকালে তোর কি কাজ? আটটা বাজে মাত্র।”

” জরুরী একটা কাজ আছে। ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি।”

” ডাক্তার মানে? তুই কি অসুস্থ?”

তুলি পাশ কাটানো কণ্ঠে বলল,” তেমন কিছুই না। মেয়েলী সমস্যা। তুই বুঝবি না।”

রাইফা নাছোড়বান্দার মতো বলল,” আমি কেন বুঝবো না? আমি কি মেয়ে না?”

তুলি উত্তর দিল না। ব্যস্ততা দেখিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেল। তাড়াহুড়োয় সে তার মোবাইলটা ফেলে গেছিল। রাইফার খুব সন্দেহ লাগায় সে মোবাইল চেক করল। তুলির মোবাইলের পাসওয়ার্ড সে জানতো। তাই অসুবিধা হলো না। ম্যাসেজ অপশনে কিছুক্ষণ আগেই একটা নতুন ম্যাসেজ এসেছে। সেই ম্যাসেজটি পড়েই রাইফার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল৷ পায়ের পাতা কাঁপতে লাগল। ধপ করে বসে পড়ল সে বিছানায়। শিরা দপদপ করে লাফাচ্ছে। ম্যাসেজটিতে স্পষ্ট লেখা যে তুলি প্রেগন্যান্ট।আর সে এখন হসপিটালে যাচ্ছে এবোর্শনের জন্য! রাইফা আর এক মুহূর্ত দেরি না করে প্রণয়কে ফোন দিল। কিন্তু প্রণয় ফোন ধরল না। অধৈর্য্য হয়ে রাইফা বেরিয়ে যেতে নিচ্ছিল। তখনি তুলি আবার ঘরে ঢুকল। সে মোবাইল খুঁজতে এসেছে।

” রাইফা, আমার মোবাইলটা দেখেছিস?”

রাইফা কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তুলি আবার প্রশ্ন করল,” কিরে, আমার ফোন? দ্রুত একটু খুঁজে দে না! আমার দেরি হচ্ছে।”

রাইফা পেশী টানটান করে বলল,” তুই কোথায় যাচ্ছিস বল আগে?”

” বললাম তো, ডাক্তারের কাছে।”

রাইফা কয়েক কদম এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল,” তুই কি প্রেগন্যান্ট?”

হঠাৎ এই প্রশ্নে খানিক থতমত খেল তুলি। শুকনো গলায় বলল,” মানে? কি যা-তা বলছিস?”

রাইফা ধমক দিয়ে উঠল,” খবরদার মিথ্যা বলবি না আমার সাথে। আমি তোর ফোনে ম্যাসেজ দেখেছি। তুই এবোর্শন করাতে যাচ্ছিস?”

তুলি জবাব দিল না। ভয়ে তার মুখ কাঁচুমাচু। রাইফা প্রায় চেঁচিয়ে বলল,” এটা তুই কি করতে যাচ্ছিস? কাউকে কিছু না জানিয়েই এবোর্শন করে ফেলবি? প্রণয় কি এসব জানে? সে কি তোকে এই অনুমতি দিয়েছে?”

তুলি শক্ত গলায় বলল,” তার অনুমতির কোনো প্রয়োজন নেই আমার। এই সিদ্ধান্ত আমি একা নিয়েছি। এই মুহূর্তে এসব হ্যান্ডেল করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি কোনো বাচ্চা জন্ম দিতে পারবো না।”

রাইফা হতভম্ব কণ্ঠে জানতে চাইল,” তাই বলে বাচ্চা মেরে ফেলবি? কোনো মা কি পারে? আচ্ছা, তোর মা যদি জন্মের আগে তোকে মেরে ফেলতো…”

রাইফাকে বাক্য শেষ করার সুযোগ না দিয়েই গর্জে উঠল তুলি,” খুব ভালো হতো, খুব। আমার মা যদি আমাকে জন্ম না দিয়ে আগেই মেরে ফেলতো তাহলে দুনিয়ার সবচেয়ে সঠিক কাজ হতো। খুব ভালো হতো।”

তুলি কথা শেষ করেই কাঁদতে কাঁদতে রাইফার হাত থেকে নিজের মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে চটজলদি বের হয়ে গেল। রাইফা বিড়বিড় করে বলল,” তুই একা এতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারিস না। প্রণয়কে জানানো উচিৎ। ”

রাইফা পুনরায় প্রণয়কে ফোন করতে লাগল। এ যাত্রায় ফোনটা ধরল প্রণয়।

” হ্যালো।”

” প্রণয়, কোথায় আছো তুমি?”

” এইতো ক্লাসে। তুমি কি ইম্পোর্ট্যান্ট কিছু বলবে?”

” অবশ্যই। অনেক বেশি ইম্পোর্ট্যান্ট। আমি তোমাকে একটা হসপিটালের এড্রেস দিচ্ছি। প্লিজ দ্রুত সেখানে চলে এসো।”

” হসপিটালে মানে? কি হয়েছে?”

” তুলি হসপিটালে আছে।”

” হোয়াট?”

” তুমি তাড়াতাড়ি সেখানে আসো। তারপর বাকি কথা বলবো। রাখছি।”

প্রণয়কে আর প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে রাইফা ফোন কেটে দিল। তারপর প্রায় বাতাসের গতিতে তৈরী হয়ে গাড়ি নিয়ে বের হলো। তুলির আগেই যদি হসপিটালে পৌঁছানো যায় তাহলে সবথেকে ভালো হবে। ট্রাফিক জ্যামের কারণে রাইফা খুব দ্রুত বের হলেও দ্রুত পৌঁছাতে পারল না। পথিমধ্যে সে কেবল আল্লাহকে ডাকতে লাগল। তুলি যেন কিছুতেই এই কাজ করতে না পারে। রাইফা অবিরত তুলির মোবাইলে ফোন দিতে লাগল। কিন্তু নাম্বার ব্যস্ত দেখাচ্ছে। হয়তো প্রণয়ও একই সময় তুলিকে ফোন করছিল।

রাইফা হসপিটালে পৌঁছে দেখল প্রণয় আগেই সেখানে চলে এসেছে।গ্রাউন্ড ফ্লোরের করিডোরে খুব অস্থিরচিত্তে পায়চারী করছিল সে। রাইফাকে দেখতে পেয়েই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল,” রাইফা, তুলি কোথায়? ওর কি হয়েছে?”

রাইফা আশেপাশে তাকিয়ে বলল,” আমাদের তুলিকে খুঁজে বের করতে হবে প্রণয়। ও এখানে এবোর্শনের জন্য এসেছে।”

প্রণয়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। স্তব্ধের মতো উচ্চারণ করল,” কিহ!”

সে কথাটা বিশ্বাসই করতে পারল না। তুলি যে প্রেগন্যান্ট এই খবরটাই তো সে জানে না! তুলিকে পাওয়া গেল দুইতলার একশো বারো নাম্বার ওয়ার্ডের সামনে। ওয়েটিংরুমে ঝিম ধরে বসে আছে সে। চোখমুখ বিষণ্ণ। রাইফা ছুটে যেতে নিলেই প্রণয় তাকে থামিয়ে বলল,” তুমি এখানেই দাঁড়াও। আমি ওর সাথে কথা বলছি।”

রাইফা নরম কণ্ঠে বলল,” আচ্ছা যাও। কিন্তু বেশি বোকো না। ও হয়তো এক্সামের জন্য..”

প্রণয় তাকাতেই চুপ হয়ে গেল রাইফা। সে এটা কেমন যুক্তি দিচ্ছে? একটা নিষ্পাপ প্রাণের কাছে এক্সাম কোনো বিষয় না। তুলি যেটা করছে সেটা অন্যায়। রাইফা সেই অন্যায়কে ডিফেন্ড করতে পারে না। প্রণয় ধীরপায়ে তুলির দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ প্রণয়কে দেখে চমকে উঠল তুলি। বসা থেকে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল। একটু দূরে লিফটের কাছে রাইফাকে দেখেই সে বুঝতে পারল, প্রণয় এখানে কিভাবে এসেছে! তুলি নিজেকে প্রস্তুত করে শক্ত ভঙ্গিতে বলল,” কি ব্যাপার? আপনি এখানে কেন এসেছেন?”

প্রণয় বরফের মতো শীতল গলায় বলল, ” নিচে চলো। বাইরে গিয়ে কথা হবে।”

তুলি দৃঢ় কণ্ঠে বলল,” উহুম। আমি কোথাও যাচ্ছি না।”

” মানে?”

” আমার এখানে একটা কাজ আছে।”

” তুমি কি বুঝতে পারছো তুমি কি বলছো?”

” হ্যাঁ। আমি সব বুঝতে পারছি। ”

প্রণয় কপালে ভাঁজ ফেলে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,” আমি এখানে সিন ক্রিয়েট করতে চাই না। প্লিজ নিচে চলো।”

তুলি স্বাভাবিক স্বরে বলল,” সিন ক্রিয়েট করার কিছু হয়নি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। এই বিষয়ে আপনি কোনো ইন্টারফেয়ার করবেন না। প্লিজ।”

” আর ইউ স্টুপিড? আমি ইন্টারফেয়ার করবো না মানে? এটা কি আমার ব্যাপার না? তুমি আমাকে না জানিয়ে আমার বাচ্চা মেরে ফেলবে আর আমি ইন্টারফেয়ার করবো না?”

প্রণয় বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তুলি রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,” আমি ওকে জন্ম দিতে চাই না।”

কথাটা একটু শব্দ করেই বলে ফেলেছিল সে। এর পরের মুহূর্তেই প্রণয় ঠাস করে তুলির গালে একটা চড় মারল। রাইফা দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে স্তব্ধীভূত। উপস্থিত সকলের মনে আতঙ্ক জাগিয়ে তোলার জন্য এই ঘটনা যথেষ্ট। দৃষ্টিতে কৌতুহল নিয়ে তাকাল সবাই। কি হয়ে গেল এটা? একটি ছেলে কি পারে এমন জনবহুল জায়গায় কোনো মেয়ের গালে চড় মারতে?

চলবে#বেদনার_রঙ_নীল
চল্লিশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

থমথমে নীরবতাকে পাশ কাটিয়ে প্রণয় অনুতাপসূচক কণ্ঠে বলল,” স্যরি।”
তুলি অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে গাঁট হয়ে বসে আছে। গাড়ির পেছনের সিটে রাইফা। সে প্রণয় আর তুলির ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার নিমিত্তে বলল,” আমি বাইরে ওয়েট করছি। তোমরা কথা বলো।”

রাইফা উঠে গিয়ে নিজের গাড়ির সামনে দাঁড়লো। তুলি সেদিকে তাকিয়ে রইল চুপচাপ। প্রণয় আবার নরম কণ্ঠে বলল,” কথাও কি বলবে না আমার সাথে?”

তুলি এই পর্যায়ে খিটমিটে স্বরে বলল,” যে জনসম্মুখে আমার গায়ে হাত তুলতে পারে তার সাথে আমি কথা বলার প্রয়োজনবোধ করি না।”

” বললাম তো স্যরি। ভুল হয়েছে আমার।”

তুলি কোনো জবাব দিল না। গাড়ির দরজা খুলে সে বেরিয়ে যেতে নিলেই প্রণয় শক্তহাতে তাকে থামালো। তুলি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে চিৎকার করে বলল,” ডন্ট টাচ মি।”

প্রণয় তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,” আচ্ছা ইনাফ, আমি টাচ করছি না তোমাকে। কিন্তু যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করছো তুমি। আমার উপর দয়া হয় না বুঝলাম৷ তাই বলে কি একটা নিষ্পাপ বাচ্চার উপরেও দয়া হয় না তোমার? কি করে ওকে মেরে ফেলার কথা ভাবলে? তুমি না ওর মা?”

তুলি রাগত স্বরে চেঁচালো,” হ্যাঁ ঠিক। আমি ওর মা। তাই আমার বাচ্চার সাথে আমি যা ইচ্ছা করবো। নান অফ ইউর বিজনেস। আপনি এখানে ইন্টারফেয়ার করার কেউ না বুঝেছেন?”

প্রণয় নির্বাকচিত্তে তাকিয়ে থেকে একটু পর বলল,” তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? মানে কি বলছো এসব? তুমি ওর মা হলে ওর বাবা কে? আমার কি কোনো অধিকার নেই ওর উপর? রাইফা আমাকে না জানালে তো আমি জানতেও পারতাম না কিছু। তাছাড়া আমি এখনও বুঝতে পারছি না যে এটা কিভাবে হলো? তুমি প্রেগন্যান্ট কবে থেকে? ”

তুলি শান্ত কণ্ঠে বলল,” দুইমাস রানিং। আমি জানতে পেরেছি দুইদিন আগে।”

প্রণয় তাচ্ছিল্য হেসে করুণ কণ্ঠে বলল,” এই দুইদিনেই তাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলে? একবার আমার সাথে আলোচনা করতে পারতে। আমি তো ভাবতেও পারিনি যে এমন কিছু হয়ে যাবে। মাত্র একরাতেই এটা কিভাবে সম্ভব?”

শেষ বাক্যটি প্রণয় বিড়বিড় করে আওড়ালেও তুলি শুনে ফেলল। রুঢ় কণ্ঠে বলল,

” এজন্যই আপনাকে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু আপনি আমার কথা শোনেননি। যদি সেদিন আমার কথা শুনতেন তাহলে আজকে এমন কিছুই হতো না!”

” আচ্ছা ওয়েট, আমি কখন তোমার কথা শুনিনি?”

তুলি বিস্ফারিত চোখে তাকাল। প্রণয় কি ভুলে যাওয়ার ভাণ ধরছে নাকি আসলেই ভুলে গেছে? যে রাতের কথা তুলি এক মুহূর্তের জন্যেও মাথা থেকে বের করতে পারেনি সেই রাতের কথা প্রণয় এতো দ্রুত ভুলে গেল? তুলিকে নিশ্চুপ দেখে প্রণয় আন্দাজ করে বলল,” তুমি কি আমাদের বিয়ের রাতের কথা বলছো?”

” হ্যাঁ।” সলজ্জে জবাবটি দিয়েই অন্যদিকে নজর ঘুরালো তুলি। প্রণয় চোয়াল শক্ত করল। সামান্য রাগী কণ্ঠেই বলল,” সেদিন কি আমি কোনোভাবে তোমাকে ফোর্স করেছিলাম?”

” হ্যাঁ করেছেন।”

” ইম্পসিবল। তোমারও কনসেন্ট ছিল এখন মিথ্যা বলো না।”

তুলি দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল,” আমি তখন বুঝতে পারিনি। যদি জানতাম এমন কিছু হবে তাহলে আপনাকে অবশ্যই আটকাতাম।”

” তুমি এমনভাবে বলছো যেন আমি সব জানতাম! এটা একটা এক্সিডেন্ট। আমাদের কারোই কিছু করার ছিল না। তাই বলে তুমি আমাকে কিছু না জানিয়ে একা এতোবড় সিদ্ধান্ত নিতে পারো না। আমি তোমাকে কোনোভাবেই এটা করতে দিবো না। কি আশ্চর্য ব্যাপার! আজকে রাইফা সব ধরতে না পারলে হয়তো আমার অজান্তেই আমার বেবিটা মরে যেতো। কোনোদিন জানতেও পারতাম না যে আমার একটা সন্তান পৃথিবীতে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু তার নিষ্ঠুর মা সেটা হতে দেয়নি।”

তুলি রুক্ষভাবে বলল,” একদম ঠিক বলেছেন। আমি নিষ্ঠুর, সেলফিশ৷ নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বুঝি না৷ তাই এই বাচ্চা আমি জন্ম দিতে পারবো না৷ ও জন্মালে আমার জীবনটা কঠিন হয়ে যাবে। আমি মাথা তুলে দাঁড়ানোর আগেই মুখ থুবড়ে পড়বো। মা হওয়া আমার জীবনের লক্ষ্য না প্রণয়। আপনার যদি এতোই সন্তানের জন্য দরদ উতলে উঠে তাহলে আরেকটা বিয়ে করে তারপর বাচ্চা জন্ম দিন। আমার কাছে এসব কিছু এক্সপেক্ট করবেন না।”

প্রণয় ক্ষণে ক্ষণে বিস্মিত হচ্ছে। তুলির এমন রূপ তার ধারণার বাইরে ছিল। সে গমগমে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” আমি এতোকিছু বুঝতে চাই না৷ আমার বাচ্চাকে আমি মারতে দিবো না। তোমাকে এই বাচ্চা জন্ম দিতেই হবে। কথা এখানেই শেষ। ”

তুলি আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকালো।

” কি বললেন আপনি? এখন কি আপনি আমাকে জোর করে বাচ্চা জন্ম দেওয়াবেন?”

” অবশ্যই। আমি আমার বেবিকে চাই। ওর গায়ে যেন ফুলের টোকাও না লাগে। বি কেয়ারফুল।”

তুলি উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল,” আপনি কি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন?”

” ধরে নাও তাই। আমার বেবির কিছু হলে তোমাকে আমি ছাড়বো না তুলি।”

তুলি মুখে হাত ঠেঁকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসল। ক্রোধপূর্ণ গলায় বলল,” ইম্পসিবল। আমি ওকে জন্ম দিতে গিয়ে নিজের ক্যারিয়ার ভাসাতে পারবো না।”

প্রণয় ভারী আওয়াজে বলল,” আই ফা*/ক ইউর ক্যারিয়ার। আমি শুধু আমার বাচ্চাকে চাই।”

প্রণয়ের মুখে এমন জঘন্য শব্দ শুনে তুলি ড্যাবডেবে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। একটু পর নিজেকে শান্ত করে বলল,” ঠিকাছে। আপনি শুধু বাচ্চাকে চান তো? নিশ্চয়ই পাবেন। আমি ওকে জন্ম দিবো। কিন্তু এরপর আপনার সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। রাজি?”

হঠাৎ এমন কথা শুনে ভ্রু-তে কুঞ্চন সৃষ্টি হলো প্রণয়ের। সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল সে,” এর মানে?”

” মানে ওর জন্মের পর আমি আপনার থেকে ডিভোর্স নিবো।”

প্রণয় তুলির শীতল বাক্য শুনে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল। কপালের কুঞ্চন মিশে গিয়ে পেশী টানটান হয়ে উঠল। বলার মতো কোনো শব্দ আর খুঁজে পেল না সে। তুলি তার সিদ্ধান্ত জানিয়েই গাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। প্রণয় বসে রইল নিথরের মতো। এটাই কি তবে হওয়ার ছিল?

বাড়ি ফিরে আসার পর থেকে তুলি বারান্দায় বসে আছে। সে অবিরত কাঁদছে। রাইফা কয়েকবার তাকে ডাকল। তুলি শুনেও জবাব দিচ্ছে না। বিরক্ত হয়ে রাইফা বারান্দায় ঢুকল।

” তোর কি হয়েছে আমাকে বলবি না? এইভাবে কেন কাঁদছিস? ঠিকাছে তোর এবোর্শন করার এতো ইচ্ছা থাকলে আয় সকালে আমিই তোকে নিয়ে যাবো। প্রণয়কেও এই ব্যাপারে ম্যানেজ করবো। খুশি এবার?”

তুলি দুইপাশে মাথা নাড়ল। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে এসেছে তার। একহাতে চোখের জল মুছে সে হাতের মোবাইলটি রাইফার দিকে বাড়িয়ে দিল। রাইফা অবাক হয়ে বলল,” কি?”

” দ্যাখ।”

রাইফা মোবাইলের স্ক্রিনে দেখল প্রণয়ের ম্যাসেজ। সে লিখেছে,” আই নিড মাই বেবি। সেজন্য যদি তোমাকে হারাতেও হয়, আই ডন্ট কেয়ার। তুমি ওকে জন্ম দেওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করছি।”

ম্যাসেজটি পড়ার পর রাইফা বিস্মিত গলায় বলল,” বুঝলাম না। এখানে ডিভোর্সের কথা আসছে কেন? তোদের কি হয়েছে?”

” আমিই ওকে বলেছিলাম। যদি বাচ্চা জন্ম দিতেই হয় তাহলে আমি ওকে ডিভোর্স দিবো। ও রাজি হয়ে গেছে!”

” ও ডিভোর্সের জন্য রাজি হয়ে গেছে বলে তুই কাঁদছিদ নাকি বাচ্চা জন্ম দিতে হবে বলে কাঁদছিস?”

তুলি চোখ মুছতে মুছতে বলল,” দুটাই।”

আক্ষেপ নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রাইফা। সামান্য হেসে বলল,” তুই কি চাস? প্লিজ আমাকে বুঝিয়ে বল।”

তুলি অভিযোগ করার উদ্দেশ্যে বলল,” ও আমাকে সামান্য পরোয়াও করে না রাইফা। ওর শুধু ওর বাচ্চাকেই চাই। আমি মরলাম কি বাঁচলাম তাতেও ওর কিছু যায়-আসে না। ধর বাচ্চাটা জন্ম দিতে গিয়ে যদি আমার কিছু হয়ে যায়, যদি এমন একটা ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন তৈরী হয় যে কেবল একজনকেই বাঁচানো সম্ভব, তাহলে হয়তো প্রণয় তার বাচ্চাকেই বাঁচাতে চাইবে৷ আমাকে নিয়ে তার একদম মাথাব্যথা নেই।”

” ধূর, এসব কি বলছিস? তুই কি এখন এইটা ভেবে কাঁদছিস?”

তুলি শুকনো গলায় বলল,” আমি শুধু ভাবছি এটা কেমন মানুষকে বিয়ে করলাম? যে আমার একটুও পরোয়া করে না! তার সমস্ত চিন্তা শুধু তার নিজেকে নিয়ে আর নিজের বাচ্চাকে নিয়ে।”

” নিজের বাচ্চার জন্য চিন্তা করা কি অন্যায়? বরং তুই অন্যায় করেছিস। মা হয়েও বাচ্চার কথা ভাবছিস না। শুধু ক্যারিয়ার পেছনে ছুটছিস। যেই ক্যারিয়ারের জন্য একটা নিষ্পাপ শিশুকে মেরে ফেলতে হয় সেই ক্যারিয়ার দিয়ে হবেটা কি?”

” তোর নিজের বাচ্চা হলে বুঝতি৷ ক্যারিয়ার তো শুধু একটা বাহানা। আমি ওর ভালো চাই বলেই ওকে পৃথিবীতে আনতে চাই না। হয়তো ওর কপালটাও আমার মতো হবে। কারণ আমি যখন জন্মেছিলাম তখন আমার বাবা-মায়ের বিয়ে হয়নি। আমার মা বাবাকে বিশ্বাস করেই আমাকে জন্ম দিয়েছিল কিন্তু তারপর কি হলো দ্যাখ? আমি পোড়া কপালি হয়ে পৃথিবীতে বেঁচে রইলাম। কিন্তু মা আমাকে ছেড়ে চলে গেল। বাবাও আর আমাকে চায় না। ”

” কিন্তু প্রণয় তো ওকে চায়। তোর বাচ্চার কপাল তোর মতো হবে না৷ কেন এতো ভাবছিস? প্রণয় দেখবি তোদের দু’জনকেই খুব ভালো রাখবে।”

তুলি কোনো কথা বলল না। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর থেকে সে এই পৃথিবীর কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারে না। তার খুব ভয় হয়। রাইফা তুলির কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বলল,” এখন বুঝতে পারছিস না। কিন্তু বাচ্চা অনেক ইম্পোর্ট্যান্ট। আর এবোর্শন খুব রিস্কি কাজ। এমনও হতে পারে যে একবার এবোর্শনের পর তোর আর বাচ্চা জন্ম দেওয়ার এবিলিটিই থাকবে না। তখন কি করবি? আফসোস ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।”

তুলি আঁড়চোখে তাকিয়ে বলল,” তুই এমনভাবে বলছিস যেন তোর এই বিষয়ে খুব অভিজ্ঞতা! কয়বার এবোর্শন করিয়েছিস?”

রাইফা ফিক করে হেসে বলল,” এমন সিচুয়েশন অনেক দেখেছি তো। তাই মুখস্ত হয়ে গেছে। আচ্ছা বাই দ্যা ওয়ে, আমি কিন্তু এখনও বুঝতে পারলাম না। এই অঘটন ঘটল কখন?”

” অঘটন মানে?”

” মানে তুই প্রেগন্যান্ট কিভাবে হলি?”

তুলি গরম কণ্ঠে বলল,” এইটা আবার কি ধরণের প্রশ্ন। তোকে কি ডিটেলস বলতে হবে?”

” আরে না, মানে আমি শুধু টাইমিং জানতে চাইছি। কিভাবে হলো এসব? ঢাকায় ফেরার পর থেকে তো তুই প্রণয়ের মুখও দেখিসনি। তাহলে বাচ্চা..”

তুলি আড়ষ্ট গলায় বলল,” সব তো তোর বাড়াবাড়ির ফসল। এখন নাটক করছিস কেন? গ্রামে থাকতে বাসর ঘর সাজানোর আইডিয়া তো তুই-ই দিয়েছিলি। তুই তখন মুখ না খুললে এসব কিছুই হতো না বেয়াদব।”

রাইফার এবার মনে পড়ল। প্রণয় আর তুলির বিয়ের পর বাসর ঘর সাজানোর বুদ্ধিটা সে নিজেই দিয়েছিল। কিন্তু সেজন্য যে এতো কাহিনী ঘটবে সেটা কে জানতো? রাইফা জীভ কেটে বলল,” স্যরি। কিন্তু মাত্র একরাতেই ঘটনা ঘটে গেল? এটা কিভাবে সম্ভব?”

তুলি রাগান্বিত ভঙ্গিতে বলল,” এই ব্যাপারে আর একটা প্রশ্ন করলে তুই আমার হাতে থাপ্পড় খাবি। অসভ্য, সর সামনে থেকে।”

তুলি বারান্দা ছেড়ে বের হয়ে গেল। রাইফা সাথে সাথেই প্রণয়কে ফোন করল।

” হ্যালো।”

” প্রণয়, কোথায় তুমি?”

” বাইরে আছি। কেন?”

” তুমি কি সত্যি তুলিকে ডিভোর্স দিচ্ছো?”

” জানি না। ” প্রণয়ের কণ্ঠে উত্তাপ। রাইফা তরল গলায় বলল,” তুলি বেচারি তো কেঁদে ভাসাচ্ছে। এইরকম কেন করছো তুমি?”

” কাঁদুক৷ ডিভোর্সের কথা ও নিজেই বলেছে। এখন কাঁদলে আমার কি?”

” এতো দায়সারা হওয়া ঠিক না। ও তো রেগে বলেছে। তোমার উচিৎ ওর রাগ ভাঙানো।”

প্রণয় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,” শুধু কি ওরই রাগ করার অধিকার আছে? আমার রাগ নেই? ও যেটা করেছে সেজন্য ওকে গুণে গুণে একশোটা চড় দেওয়া উচিৎ ছিল। আমি তো মাত্র একটা দিয়েছি৷ এখনও আমার হাত নিশপিশ করছে। ওকে বলবে আমার সামনে যেন না আসে।”

” ওরে বাবা, এতো রাগ দিয়ে কি জীবন চলে? একজন রাগলে অপরজন রাগ ভাঙাবে এটাই তো নিয়ম। কিন্তু তোমরা দু’জনেই ফুলে ঢোল হয়ে আছো। তাহলে কিভাবে চলবে?”

” তো আমি আর কি করবো বলো? ও আমার বাচ্চা মেরে ফেলতে নিয়েছিল। এখন আবার বলছে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর আমাকে ডিভোর্স দিবে। এসব কথা শোনার পর মাথা কিভাবে ঠিক রাখা যায়?”

” মাথা ঠিক রাখতে হবে। আচ্ছা শোনো আমি বলি কি করতে হবে। কালকে সকালে বাসায় আসো।”

পরদিন সকালে তুলির যখন ঘুম ভাঙল, সে দেখতে পেল তার পুরো ঘর বাচ্চাদের ছবি দিয়ে ভর্তি। একটা ছবিতে বাচ্চা হাসছে, আরেকটা ছবিতে খেলছে, আরেকটায় বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে, আরেকটা ছবিতে দুষ্টমি হাসি। তুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকয়টি ছবি দেখতে লাগল। হঠাৎ দরজার কাছে চোখ পড়তেই দেখল লম্বা দু’টি পা। তুলি উপরে তাকাতেই দেখল প্রণয়কে। তার হাতে বিরাট একটি বাক্স। বাক্সটি নিয়ে তুলির সামনে রেখে বলল,” গুড মর্ণিং।”

তুলি হঠাৎ এমন কিছু আশা করেনি। তাই খুব অবাক হয়ে কথা বলতে পারল না। প্রণয় কাগজের বাক্সটি খুলতেই বেরিয়ে এলো দুই পাউন্ডের একটি চকলেট কেক। কেকের মাঝে প্যাঁচানো অক্ষরে লেখা,” হ্যাপি টু মান্থ এনিভার্সেরী।”

তুলি লেখাটি পড়ে কৌতুহল নিয়ে তাকাল। প্রণয় বলল,” আগামী নয়মাস ধরে প্রত্যেক মাস আমরা এভাবেই কেক কেটে সেলিব্রেট করবো। নাও, এখন ফার্স্ট কেক কাটো।”

প্রণয় ছুড়ি এগিয়ে দিতেই চোখ ভরে এলো তুলির। ভেজা গলায় সে বলল,” আই এম স্যরি। সত্যিই ভুল করতে যাচ্ছিলাম আমি। প্লিজ আমাকে মাফ করে দিন।”

প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” ঠিকাছে। কিন্তু একটা শর্ত।”

তুলি নিচের দিকে তাকিয়ে আওড়াল,” কি?”

” ডিভোর্স আর এবোর্শন, এই দু’টো শব্দ কখনও মুখে আনা যাবে না।”

তুলি চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে উচ্চারণ করল,” আচ্ছা।”

প্রণয় একহাতে তাকে কাছে এনেই জড়িয়ে ধরল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here