বেদনার রং নীল পর্ব -৪৯+৫০

#বেদনার_রঙ_নীল
উনপঞ্চাশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

লোডশেডিং নিয়ে একটু আগেও সবাই অতিষ্ট ছিল৷ সেই সমস্যা আপাতত ঠিক হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে কারেন্ট যাচ্ছে না৷ সবাই আবার মনোযোগী হলো অনুষ্ঠানে। সাউন্ড বক্সে মিউজিক চলছে। তুলি আর তন্বির একসাথে নাচার কথা ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে তুলিকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। রাইফা ভেবেছিল রিসবকে একটা সারপ্রাইজ দিবে। তুলি থাকলে সারপ্রাইজটা জমজমাট হতো। তন্বি অনেক খুঁজেও তুলিকে কোথাও পেল না৷ অবশেষে রাইফার কাছে এসে জানাল,” তুলিকে পাচ্ছি না।”

রাইফা ফিসফিস করে বলল,” প্রণয় কোথায়?”

” সেও তো নেই। দু’জন একসাথে গায়েব হয়ে গেছে মনে হয়। ”

রাইফা এই কথা শুনে হাসল। মনে মনে চিন্তা করল, তাদের মনমালিন্য বোধ হয় ঠিক হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই দু’জন একসাথে কোথাও সময় কাটাচ্ছে। সেরকম হলে অযথা তাদের বিরক্ত করার মানেই হয় না।

রাইফা বলল,” তুই একাই পারফর্ম কর তন্বি। তুলিকে ডাকার দরকার নেই।”

তন্বি ভয় পেয়ে বলল,” আমি? কিন্তু আমি তো ভালো করে নাচটা শিখিওনি। আর শেষদিকে কথা ছিল আমি আর তুলি তোকে স্টেজ থেকে তুলে নিয়ে যাবো। তারপর বাকি নাচ তুই নাচবি। তুলি না এলে সেটা কিভাবে হবে?”

” অন্য একজন নাচের পার্টনার খুঁজে নে ভাই। তুলিকে এখন বিরক্ত করা যাবে না। সে ব্যস্ত আছে।”

তন্বি বেশ বিরক্ত হলো। রেগে-মেগে বলল,” তোদের ঢং আমার ভালো লাগে না। সবসময় শুধু আমাকেই ফাঁসতে হয়। ধ্যাত আমি তুলিকে ফোন করছি।”

_________

নড়াচড়া করতে পারছে না তুলি। আজমীর শক্ত বাহুবলে তাকে বন্দী করে রেখেছে। হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল। তুলির প্রাণপাখি যেন একটু আশার আলো খুঁজে পেল। কিন্তু মোবাইলটা সে রিসিভ করবে কি করে? আজমীর তার মাথায় বন্দুক ঠেঁকিয়ে রেখেছে। প্রণয় তুলির ফোনের আওয়াজ অনুসরণ করে বাথরুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। আজমীর তা টের পেয়েই বলল,” ফোন সাইলেন্ট করো তুলি। দ্রুত!”

তুলি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,” করছি। কিন্তু প্লিজ আমাকে কিছু করবেন না। প্লিজ।”

প্রচন্ড ভয়ে তুলির হাতের আঙুলগুলো কাঁপছে। আজমীর মধুর সুরে বলল,” আমার কথা শুনলে তোমার গায়ে আঁচও লাগতে দিবো না পাখি। কিন্তু যদি অবাধ্যতা করো তাহলে ভয়ংকর বিপদ আছে।”

তুলির গলা শুকিয়ে কাঠ। দ্রুত হাতে মোবাইল সাইলেন্ট করতে নিতেই প্রণয় দরজায় আঘাত করল,” তুলি, তুমি কি ভেতরে আছো?”

ভয়ে তুলির হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেল। আজমীরও যথেষ্ট হকচকিয়ে গেল। দরজার বাইরে প্রণয় দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা ঘাবড়ে যাওয়ার মতোই। সে সচেতন কণ্ঠে তুলিকে বলল,” খবরদার, শব্দ করবে না। একদম চুপ।”

তুলি কোনো কথা বলল না। কিন্তু প্রণয় অবিরত দরজা ধাক্কাচ্ছে।

” তুলি, এটলিস্ট সাড়া তো দাও! আমার টেনশন হচ্ছে, প্লিজ।”

তুলির কান্না পেল। প্রণয় এতো কাছে, তবুও সে প্রণয়ের কাছে সাহায্য চাইতে পারছে না৷ হোটেলের বাথরুমগুলো একটির সাথে অন্যটি লাগানো। উপরে স্পেস থাকায় সহজেই দেয়াল টপকে ওইপাশে যাওয়া যায়। আজমীর প্রথমে ফ্লাশের উপর ভর দিয়ে তারপর সহজেই দেয়াল টপকাতে পারল। কিন্তু যাওয়ার আগে সে বলে গেল,” প্রণয়কে বিদায় করো। আর খবরদার কোনোরকম চালাকি করবে না। তাহলে দু’জনকেই মরতে হবে।”

আজমীর চলে যেতেই তুলি দ্রুত হাতে দরজা খুলে প্রণয়কে জাপটে ধরল শক্তভাবে। আকস্মিক এই ধাক্কায় প্রণয় কয়েক পা পিছিয়ে গেল। তারপর মৃদু হেসে বলল,” কি হয়েছে তুলি? একা একা বাথরুমে ভয় পাচ্ছিলে নাকি?”

তুলি কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” প্রণয়!”

তার বুক ধুকপুক করছে। তার কণ্ঠ শুনে প্রণয় অবাক হয়ে গেল। বিচলিত গলায় জানতে চাইল,” কি হয়েছে তোমার?”

তুলি ইশারায় প্রণয়কে বোঝাতে চাইল যে পাশের বাথরুমে আজমীর আছে। কিন্তু প্রণয় বুঝতে পারল না৷ তুলির অবস্থা দেখে সে ভয় পেয়ে গেল। তুলি ফিসফিস করে বলল,” আজমীর ভাই এসেছে। আমাকে মেরে ফেলবে।”

” হোয়াট! এসব কি বলছো?”

তারপর খুব বিকট একটি শব্দ হয়। আজমীর বন্দুক দিয়ে সজোরে আঘাত করেছে প্রণয়ের মাথায়। তুলি চিৎকার দিয়ে উঠতে নিলেই পেছনে থেকে অন্যকেউ তার মুখ চেপে ধরে। প্রণয় পেছনে ঘুরে আজমীরকে দেখেই তার গলা চেপে ধরল। আজমীর হাঁটু দিয়ে আঘাত করল প্রণয়কে। প্রণয় শক্তি হারিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খেল। আজমীর প্রণয়ের মাথার আঘাতকৃত জায়গায় বারংবার আঘাত করতে করতে প্রায় থেতলে দিল। প্রণয় অচিরেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তুলি ছটফট করে গলাকাটা মুরগির মতো। হাত-পা ছুড়তে থাকে পাগলের মতো। আজমীর তার গালে চড় মারে। তুলির চোখমুখ অন্ধকার হয়ে আসে। কিছুক্ষণ পরে সেও জ্ঞান হারিয়ে গেলে। আজমীর তার সহযোগীকে নির্দেশ দেয় তুলিকে সাবধানে বাইরে নিয়ে যেতে। আর সে নিজে প্রণয়ের দেহটা বাথরুমের হাই কমোডের উপর বসিয়ে ফ্লাশারের সাথে বেঁধে রেখে চলে যায়।

টিনা, মীরা আর অবনী দলীয় নাচে অংশগ্রহণ করে৷ তাদের নাচ শেষ হতেই চারদিকে করতালি শুরু হয়। এবার তন্বি একা নামে। তুলিকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে তাকে একাই নাচতে হবে। এটা শুনে টিনাও এলো। সে নাচে খুব ভালো। তাদের নাচ যখন শেষ পর্যায়ে তখন রাইফাকে মঞ্চ থেকে তুলে আনা হয়। তখন মিউজিক প্লেয়ারে গান বেজে উঠল,” মেরি সাইয়্যা সুপারস্টার।”

রাইফা এই গানে এমনভাবে নাচতে লাগল যেন তার অনেকদিনের অনুশীলন। একটা সানগ্লাসও কেনা হয়েছিল এই নাচের জন্য৷ কিন্তু সানগ্লাসটা তুলির ব্যাগে আছে। টিনা তার নিজের সানগ্লাস বের করে রাইফাকে দিল। প্রত্যেকে মুগ্ধ হয়ে বিয়ের কনের নাচ দেখছে। রাইফা খুশিমনে উজাড় হয়ে নাচছে। নিজের বিয়েতে কোনো বউকে এতো খুশি আগে কেউ দেখেনি যেন। নাচের এক পর্যায় রাইফা সানগ্লাস নামিয়ে রিসবকে চোখ মারল। রিসব লজ্জা পেয়ে গেল। বিয়েতে জামাই কম লজ্জা পায়। কিন্তু রাইফার মতো বউ যাদের থাকবে সেই হতভাগাদের মিনিটে মিনিটে লজ্জা পেতে হবে।

_______
খাওয়া-দাওয়ার সময়ও প্রণয় আর তুলির কোনো হদিশ পাওয়া গেল না। মিষ্টি অনবরত প্রণয়ের নাম্বারে ফোন করছে। কিন্তু মোবাইলটা বন্ধ। এইরকম করলে দুশ্চিন্তা হওয়াই স্বাভাবিক। রাইফা যখন রিসবের সাথে টেবিলে খেতে বসেছে তখন মিষ্টি তার কাছে এসে চিন্তিত স্বরে বলল,” প্রণয় আর তুলিকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে রাইফা। তুমি কি ওদের ব্যাপারে কিছু জানো?”

রাইফা মৃদু হেসে বলল,” চিন্তা কোরো না আপু৷ ওরা নিশ্চয়ই আলাদা কোথাও টাইম স্পেন্ড করছে। ওদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে তো!”

মিষ্টি এই কথা শুনে খুশি হলো। উৎসাহী কণ্ঠে বলল,” তাই নাকি? ঝগড়া সেরে গেছে? তাহলে তো ওদের ডিস্টার্ব না করাই ভালো। ”

” হ্যাঁ আমিও তাই বলি।”

বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ পর্যায়। বিদায় পর্ব শেষ করে গাড়িতে উঠল সবাই। এর মাঝে অজান্তা জিজ্ঞেস করলেন,” মিষ্টি, প্রণয় আর তুলি কোথায়?”

মিষ্টি হাসিমুখে বলল,” তারা হয়তো কোথাও ঘুরতে গেছে। অনুষ্ঠানের শুরু থেকেই তাদের খবর নেই।”

চিন্তার রেখা ফুটে উঠল অজান্তার কপালে। কেন যেন মন শান্ত হচ্ছে না। তিনি প্রণয়কে ফোন করতে লাগলেন। কিন্তু প্রণয়ের মোবাইল বন্ধ। তুলির ক্ষেত্রেও এক অবস্থা। তারা যদি আসলেই একসাথে কোথাও গিয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই জানিয়ে যাওয়া উচিৎ। তাছাড়া মোবাইল বন্ধ রাখার ব্যাপারটাও কেমন! ছেলে-মেয়েগুলোর কি কখনও আক্কেল-জ্ঞান হবে না?

__________
” রাইফা, আমি কখন থেকে তোমার প্রেমে পড়েছি সেটা কি তুমি জানো?”

বাসর ঘরে ঢুকেই সবার আগে এই প্রশ্নটি করে রিসব। রাইফা মিষ্টি হেসে বলল,” না জানি না। কবে?”

রিসব দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেঁকায়। হাত ভাঁজ করে ভাবুক স্বরে জবাব দেয়,” যেদিন প্রথম আমি চলে যাওয়ার সময় তুমি কাঁদতে কাঁদতে এই বাড়িতে ছুটে এসেছিলে তখন তোমার চোখে, কণ্ঠে, মুখে এমন একটা টান ছিল যেটা আমি ইগনোর করতে পারিনি। তুমি চলে যাওয়ার পর হয়তো এজন্যই তোমার ফেলে যাওয়া ওরনা আলমারিতে তুলে রেখেছিলাম।”

রাইফা একটু অভিমানের স্বরে বলল,” আহারে, এতো মায়া লেগেছিল আপনার? তবুও রুড বিহেভ করলেন কেন?”

রিসব বিছানায় বসতে বসতে দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ” কারণ আমি তখনও নিজের মনের কথা বুঝতে পারিনি। আমি তোমার প্রেমে তখনি পড়েছিলাম৷ কিন্তু রিয়েলাইজ করেছিলাম। অনেক পরে। কবে জানো?”

রাইফা লাজুক মুখে হাসল। আগ্রহী হয়ে বলল,” কবে?”

” যেদিন তুমি কাঁদতে কাঁদতে কফিশপ থেকে বের হয়ে গেলে! সেদিন থেকে আর এক মুহূর্তের জন্যেও কিন্তু তোমাকে ভুলতে পারিনি। তোমার বড় বড় চোখ আমাকে খুব জ্বালাতো।”

রাইফার শ্যামলা মুখ আরক্ত হলো। চোখের দৃষ্টি নত করে আবদার করে বসল একটা,” একটা কথা বললে রাখবেন?”

” এখন থেকে তোমার সব কথা রাখবো।”

রাইফা এবার উতলা কণ্ঠে বলল,” তাহলে কথা দিন যে আপনি কখনও যাবেন না।”

এই কথা বলেই সে হাত চেপে ধরল রিসবের। যেন এখনি রিসব পালিয়ে যাচ্ছে। রিসব সামান্য হেসে জিজ্ঞেস করল,” কোথায়?”

“পাহাড়ে ।”

রিসব একটু চমকে গেল। তারপর রাইফার হাত ছাড়িয়ে অন্যদিকে ঘুরে হতাশ গলায় বলল,” পাহাড় তো আমার প্রথম স্ত্রী। তার কাছে যেতেই হবে।”

রাইফা থতমত খেল। পর মুহূর্তেই রেগে অন্যদিকে চাইল। রিসব হেসে তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে? রাগ করলে?”

” আমি কারো লাইফের সেকেন্ড প্রায়োরিটি হয়ে থাকতে চাই না।”

তার দৃষ্টি থেকে তপ্ত অভিমানের বিচ্ছুরণ ঘটল। রিসব হেসে উঠল ঘর কাঁপিয়ে। মসৃণ কণ্ঠে বলল,” উমম.. ঠিকাছে। কিন্তু ফার্স্ট প্রায়োরিটি হওয়ার জন্য তো তোমাকে পরিশ্রম করতে হবে। আমার এতোদিনের স্বপ্ন আমি এমনি এমনি তোমার জন্য ভুলে যাবো? এটা কিভাবে হয়?”

রাইফা ভ্রু কুচকে বলল,” এর মানে? আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না। আমাকে কি করতে হবে?”

রিসব আড়মোড়া ভেঙে খুব আদুরে কণ্ঠে বলল,” তোমাকে এমন কিছু করতে হবে যেন আমার আর পাহাড়ে যেতে ইচ্ছেই না করে। ইচ্ছে করা তো দূর, পাহাড়ের কথাই মনে না পড়ে। ঘর থেকেও যেন বের হতে ইচ্ছে না করে। এমনকি এই রুম থেকেও। পারবে নাকি এমন কিছু করতে?”

রাইফা কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে রইল। তারপর যখনি বুঝতে পারল কথার অর্থ তখনি চোখ ফিরিয়ে হেসে দিল। হাত দিয়ে মুখ ঢাকল। হাসির দমকে তার শরীর কাঁপছে। লজ্জায় কাঁপছে বুক। রিসব আচমকা তাকে এক টানে নিজের দিকে ঘুরালো। চমকে উঠল রাইফা। চোখ বড় বড় হয়ে গেল। রিসব ঘায়েল হলো। রাইফার এই বিস্ফারিত দৃষ্টিতেই তো মরেছিল সে। আলতো করে খুব যত্নে সে চুমু দিল রাইফার ঠোঁটে। রাইফার চোখের কার্নিশ ভিজে এলো। অব্যক্ত অনুভূতিরা মুক্ত হলো। জীবনের প্রথম ভালোবাসার পরশ শিহরণ জাগাতে এলো অনেকটা সুখ নিয়ে।

________

তুলির দুই হাত উঁচু করে একটা কালো কাপড় দিয়ে গাড়ির ছাদের সাথে বাঁধা। মুখে স্কচটেপ। শরীর অসম্ভব দূর্বল লাগছে। একটু নড়েচড়ে বসার ক্ষমতাটুকুও হচ্ছে না। জ্ঞান ফেরার পর নিজের এই অবস্থা আবিষ্কার করে খুব চমকে উঠে সে। প্রণয়ের কথা মনে পড়তেই ছটফট করে হৃদয়। কেমন আছে সে? কোথায় আছে? প্রচন্ড জোরে ব্রেক কষে গাড়ি থামল একটি অপরিচিত জায়গায়। অনিশ্চয়তায় তুলির শরীর কাটা দিচ্ছে। হৃদয়ের উথাল-পাথাল বাড়ছে বৈ কমছে না। তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে? পাশে বসে থাকা লোকটি তুলির গায়ে স্পর্শ করছে বিশ্রীভাবে। তুলির ঘৃণায় চোখমুখ কুচকে আসে। আজমীর সামনের আয়না থেকে তা দেখতে পেরেই গাড়ি থামিয়েছে। পাশের ছেলেটিকে গাড়ি থেকে বের করে এলোপাতাড়ি চড়-ঘুঁষি মারতে শুরু করল। বাকিরা আজমীরকে থামানোর জন্য চেঁচায়। আজমীর ধাক্কা মেরে লোকটিকে সরিয়ে নিজে বসল তুলির পাশে। আলতো করে তুলির গায়ে হাত রাখতেই তুলি কেঁপে উঠল। আজমীর বলল,” ভয় পেয়ো না তুলি। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। আর কাউকে ক্ষতি করতেও দিবো না।”

তুলির চোখ দিয়ে কেবল জল গড়ায়। কিছু বলতে পারে না মুখ দিয়ে।
#বেদনার_রঙ_নীল
পঞ্চাশতম পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

স্নিগ্ধ সকাল। রাইফা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলে রোদ মেখে নিচ্ছে। এমন সময় দরজায় খটখট শব্দ হলো। রাইফার মনে হয়, অনেকক্ষণ ধরেই দরজায় এই শব্দটা হচ্ছিল৷ সে এতোক্ষণ বাথরুমে ছিল বিধায় টের পায়নি। দ্রুত পায়ে হেঁটে দরজা খুলতে যাওয়ার সময় বিছানায় ঘুমন্ত অবস্থায় রিসবকে দেখা গেল। খালি গায়ে বুকের উপর ভর দিয়ে বিভোর হয়ে ঘুমাচ্ছে সে। এক চিলতে রোদের আলোয় তাকে খুব নিষ্পাপ দেখাচ্ছে৷ রাইফার ইচ্ছে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেয়ে থাকতে। দরজা খোলার তাড়া না থাকলে সে তাই করতো।

মিষ্টি হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। রাইফা স্তব্ধ প্রায়। মিষ্টির চেহারা অশ্রু ভেজা। চোখ দু’টি ফুলে লাল। মনে হচ্ছে সে ভয়ংকর কোনো দুঃসংবাদ শুনে এসেছে। একটু ধাতস্থ হতেই বলল,” রিসব কোথায়? রাইফা, রিসব কোথায়?”

থতমত খাওয়া কণ্ঠে রাইফা উত্তর দিল,” ঘুমাচ্ছে, আপু। কেন?”

মিষ্টি রুদ্ধশ্বাসে বলল,” ওকে ঘুম থেকে তোলো৷ আমাদের এখনি বের হতে হবে।”

” কোথায়?”

” হসপিটালে।”

রাইফা অস্থিরচিত্তে জিজ্ঞেস করল,” অজান্তা আন্টির কিছু হয়েছে?”

” না। ছোটমা ঠিকাছে। কিন্তু প্রণয় আর তুলি কালরাতে বাড়ি ফেরেনি।”

রাইফা আৎকে উঠল। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে উচ্চারণ করল,” কি? ওরা কোথায় ছিল?”

” জানি না। হসপিটাল থেকে ফোন এসেছে। প্রণয়কে হোটেলের বাথরুমে আহত অবস্থায় পাওয়া গেছে।”

রাইফা যেন দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলল। কপালে হাত রেখে স্তব্ধচিত্রের মতো বলল,” ওহ মাই গড।”

চেতনা ফিরে পাওয়ার পর থেকে ডাক্তার, নার্স সকলকে একটি প্রশ্ন করেই পাগল করে তুলছে প্রণয়। তার প্রশ্নটি হলো,” তুলি কোথায়?”

হোটেলের বাথরুমে তাকে ছাড়া অন্যকাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই বিষয়ে তাকে অসংখ্যবার অবগত করার পরেও সে মানতে নারাজ। মিষ্টিরা হাসপাতালে এসে প্রণয়কে খুঁজে পেল না। কারো অনুরোধ তোয়াক্কা না করেই সে বহু আগে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেছে। তার প্রধান উদ্দেশ্য তুলিকে খুঁজে বের করা। সবাই অস্থির হয়ে উঠল দুশ্চিন্তায়। অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রণয় কোথায় চলে গেল? তুলিটাই বা কোথায়?
____________
তিনদিন কেটে গেছে। এই তিনদিনে এমন কোনো মুহূর্ত নেই যে মুহূর্তে তুলি চোখের পানি ফেলেনি। শেফালী নামের একজন রুক্ষভাষী মহিলা তুলিকে দেখা-শোনার জন্য চব্বিশ ঘণ্টা পাশেই থাকছে। তুলিদের গ্রামেরই সে। অতীতে একবার তার চোখে ধুলো দিয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছিল তুলি। সেই ঘটনার প্রতিশোধ এখন সে নিচ্ছে ভিন্নভাবে। তুলিকে সর্বক্ষণ কড়া পাহারায় রেখেছে। তুলি বাথরুমে গিয়ে পাঁচমিনিট দেরি করলেও শেফালী দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করে। যদি আবার ভেন্টিলেটর দিয়ে পালিয়ে যায়! এই পর্যন্ত অনেক বার তুলি শেফালীর হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করেছে। বলেছে,” শেফালী আপা, আমায় ছেড়ে দাও। আমার কষ্টটা কি তুমি বুঝতে পারছো না? তুমিও তো একজন মেয়ে।”

শেফালী রুক্ষ গলায় বলেছে,” আগের বার আমার পাছায় লাথি মেরে পালায় গেছিলা। তখন কম অত্যাচার সহ্য করি নাই। ওহন তুমি আবার পালাইলে আমি খতম হয়া যামু।”

” কেন এদের সাথে কাজ করো তুমি? ভালো কাজ করতে পারো না?”

” ভালো কইরা কি হইবো? আগে তো ভালো কামই করতাম। কিন্তু ভালো চলতে পারতাম না। এখন খারাপ কাম করলেও ভালোমতো চলি।”

” আমি কথা দিচ্ছি, আমি তোমাকে ভালো কাজ দিবো। অনেক টাকা দিবো। জানো, আমার স্বামী অনেক বড়লোক।”

” জানি সবই। কিন্তু কিছু করার নাই। তোমারে পালাইতে দিলে আমার মরণ নিশ্চিত। আমারে এসব অনুরোধ কইরা লাভ নাই। আমি কিছু করতে পারুম না।”

তুলি সারাদিনই কপাল চাপড়ে কাঁদে। খাওয়া-দাওয়া সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু তাতে দয়া হয়নি কারো। অন্ধকার গহ্বরের মতো বাড়িটিতে আর কিছুদিন এভাবে বন্দী থাকলে হয়তো দম আটকেই মরে যাবে তুলি। শারীরিক দূর্বলতার কারণে সে বিছানা ছেড়েও উঠতে পারে না। ভাবতে অবাক লাগে, এভাবেই কি শেষ হবে জীবন? তার মৃত্যুটা কি তবে এই বিছানাতেই হবে? শেষ বারের মতো প্রণয়কে দেখতেও কি পারবে না সে? হায়, কত কথা বলার ছিল তাকে। কত স্বপ্ন দেখার ছিল তার সাথে। কত সময় কাটানোর কথা ছিল তাকে নিয়ে। সব অপূর্ণই থেকে গেল। কখনও মুখ ফুটে তুলি বলতে পারল না, সে প্রণয়কে কি ভীষণ ভালোবাসতো!

মাঝরাতে আজমীর এলো। তুলি বিছানায় শুয়েছিল। ধরাম শব্দে দরজা খুলে যায়। তুলি আৎকে উঠে। শোয়া থেকে উঠে বসতে চায়। কিন্তু নড়তেও পারে না। মাথা চক্কর দিচ্ছে। অন্ধকারেও চোখে ঝাপসা দেখতে পায়। অজস্র কিছু ধোঁয়াটে রেখা যেন জমাট বেঁধে আছে দৃষ্টিসীমায়। তুলি বিছানার চাদর খামচে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদল। নেশাগ্রস্ত আজমীরকে অবচেতন দেখায়। হেলে-দুলে সে তুলির সামনে এসে বসল। তুলি আর্তনাদ করে বলল,” আমাকে ছেড়ে দাও। প্লিজ, যেতে দাও আমাকে। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও।”

তুলির আর্তনাদ আজমীর কানে তোলে না। তার বুকভাঙা কান্না দেখেও দেখে না। সে কেবল তাকিয়ে থাকে তুলির ছিপছিপে নরম দেহের ফরসা ভাঁজে। চকচক করে তার চোখের দৃষ্টি। তীব্র কামনার আকর্ষণে শরীরে শিহরণ তৈরী হয়। আজমীরের দানবীয় হাতের স্পর্শ পেতেই শিউরে উঠল তুলি। তার চিৎকারে কেঁপে উঠে দালানের প্রতিটি কণা। সীমাহীন এই বর্বরতার বিরুদ্ধে যেন আন্দোলন করছে সারা ভবন।

___________

মাসের পর মাস কেটে যায়। কিন্তু তুলির হদিশ মেলে না। আজমীরও লাপাত্তা। প্রথমদিকে প্রণয় দিন-রাত এক করে হন্যি হয়ে তুলিকে খুঁজতো। তবে আজ-কাল সে বড় অসাড় হয়ে পড়েছে। দিনের বেশির ভাগ সময়টা বাইরেই কাটায়। কিন্তু ঘরে এলে নিশ্চুপ মূর্তির মতো হয়ে যায়। কারো সঙ্গে কথা বলে না। তার আচরণ গম্ভীরের চেয়েও গম্ভীরতর। রাইফাও বিষয়টা লক্ষ্য করেছে। ইদানীং প্রণয়ের সাথে কথা বলতে তার ভয় লাগে। প্রণয়ের সামনে দাঁড়াতেও ভয় লাগে। তুলির হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি সে নিজেই এখনও মেনে নিতে পারেনি। সেখানে প্রণয়ের কি অবস্থা হওয়ার কথা? এসব ভাবতেও রাইফার হাহাকার লাগে। আজ সকালেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। প্রণয়ের ঘরের পাশ দিয়ে রাইফা যাচ্ছিল। তখন খেয়াল করল প্রণয় কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। রাইফা অবাক হয়ে ঘরে ঢুকতেই প্রণয় রেগে বলল,” আপনি কে?”

রাইফার হাউমাউ করে কান্না পেয়ে গেল। মুখ চেপে এক দৌড়ে সে নিজের ঘরে চলে এলো। রিসব তার অবস্থা দেখে অবাক। প্রশ্ন করতেই রাইফা বলল,” প্রণয় খুব অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। একা একা কার সঙ্গে যেন কথা বলছিল। আমি ঘরে ঢুকতেই আমাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করল। আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না রিসব।”

রিসবকে আশাহত এবং ক্লান্ত দেখায়। রাইফার মাথাটা বুকে নিয়ে সে সান্ত্বনার সুরে বলল,” প্রণয়ের সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে কথা হয়েছে। তার কাউন্সিলিং প্রয়োজন। কিন্তু মা আর মিষ্টি আপু তো ওকে হাসপাতালে দিতে রাজিই হচ্ছে না।”

রাইফা রাগী গলায় বলল,” আমিও রাজি না। তুলি এলে প্রণয় এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। ওকে হাসপাতালে পাঠানোর কোনো প্রয়োজন নেই।”

” আর যদি তুলি কখনোই না আসে?”

রিসবের নিষ্ঠুর প্রশ্নে রাইফা ক্ষেপে গেল। রিসবকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল,” কেন আসবে না? তুলি নিশ্চয়ই আসবে। ওর কোনো ক্ষতি হয়নি। বুঝেছো তুমি? ওর কিছু হয়নি। ও আবার ফিরে আসবে।”

রিসব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” আচ্ছা স্যরি, তুলি আবার ফিরে আসবে।”

রাইফা একদিন প্রণয় আর তুলির ঘর গোছাতে এসে তুলির ব্যবহৃত ওয়্যারড্রোব আর পড়ার টেবিল ঘেঁটে কিছু ব্যক্তিগত জিনিস উদ্ধার করল। কিছু জিনিস সে নিজের কাছে রাখে। আর কিছু জিনিস প্রণয়কে দিবে বলে ঠিক করে। তার মধ্যে বিশেষত একটা ডায়েরী ছিল। সেই ডায়েরীতে তুলির প্রায় একশোটির মতো অপূর্ণ ইচ্ছের কথা লেখা। রাতে প্রণয় বাড়ি ফিরলে রাইফা সেই ডায়েরীটা প্রণয়ের হাতে তুলে দেয়। প্রণয় ঘরে এসে দরজা আটকেই ডায়েরী খুলে বসে। পর্যায়ক্রমিকভাবে ভেসে ওঠে তুলির ফেলে যাওয়া অপূর্ণ ইচ্ছেগুলোর কথা।

ইচ্ছে নাম্বার- ১: আমি একদিন অনেক বড়লোক হবো। আমার বাবার চেয়েও দ্বিগুণ টাকা থাকবে আমার।

ইচ্ছে নাম্বার- ২: বড়লোক হওয়ার পর আমার প্রথম কাজ, বাবাকে খুঁজে বের করা। তিনি কোথায় আছেন? নিশ্চয়ই সুখে আছেন। কিন্তু আমি তাকে সুখে থাকতে দেবো না৷ সে আমার মায়ের খুনী! তিলে তিলে মায়ের আত্মাকে হত্যা করেছে সে। আমার দেখা সবচেয়ে বর্বর পুরুষ, আমার বাবা।

ইচ্ছে নাম্বার- ৩: মায়ের নামে একটা বৃদ্ধাশ্রম খুলবো।

ইচ্ছে নাম্বার- ৪: আমি চাই, বাবা যেভাবে আমাকে আর মাকে অবহেলা করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ঠিক সেভাবেই একদিন তাকেও তার ছেলে-মেয়েরা বাড়ি থেকে তিরস্কার করবে। সে হয়ে পড়বে সম্বলহীন। তখন আমি তাকে মায়ের নামে তৈরী করা সেই আশ্রমে ঠাঁই দিবো। শেষ বয়সে তার মৃত্যু হবে অনুশোচনায়। এটাই তার একমাত্র শাস্তি।

প্রণয়ের দিন কেটে যায় তুলির ইচ্ছেগুলো পড়তে পড়তে। তারপর একদিন হঠাৎ করেই তার আজমীরের একজন সহযোগীর সাথে দেখা হয়। প্রণয়কে দেখেই সে উল্টোদিকে দৌড়ে পালাতে নিচ্ছিল। তাই দেখে প্রণয়ের সন্দেহ হয়৷ তারপর মনে পড়ে যায় এই ছেলেটিকে অনেকবার আজমীরের সাথে দেখেছে সে। একে ধরলেই আজমীরের কাছে পৌঁছানো যাবে। প্রণয় তাকে ধাওয়া করতে শুরু করে। তারপর শেষমেষ ধরে ফেলল। রাস্তার মাঝেই ধুমধাম তাকে মারতে শুরু করলে সে গড়গড় করে বলে দেয় সবকিছু। প্রথমেই উঠে আসে তৈমুরের নাম। তৈমুর নামের একটি লোককে বেশ কিছুদিন আগে চুরির অভিযোগ প্রণয়দের বাড়ি থেকে পুলিশে দেওয়া হয়েছিল৷ প্রণয় ভাবে এই ঘটনাটি কেবলই কাকতালীয়। কিন্তু এখন বোঝা যায়, সবই পরিকল্পিত। প্রণয় দ্রুত আজমীরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল। ছেলেটি তখন বলল,” আজমীর বাংলাদেশে নেই। ইউরোপের একটি দেশে গা ঢাকা দেয়ার উদ্দেশ্যে পালিয়ে গেছে। ”

” তাহলে তুলি কোথায়?”

প্রণয়ের এই প্রশ্ন শুনেই ছেলেটি চুপ হয়ে যায়। প্রণয় শক্ত হাতে তার চোয়াল চেপে ধরল। তখন দম আটকে আসা গলায় সে বলল,” তুলি বেঁচে নেই।”

বাক্যটি শোনা মাত্রই প্রণয়ের বাহুর সমস্ত শক্তি ক্ষয়ে গেল৷ নিশ্চল হয়ে পড়ল শরীর। ছেলেটি ছাড়া পেয়েই ছুটে পালায়। কিন্তু প্রণয় নিথরের মতো বসে পড়ে রাস্তার মাঝে। মুহূর্তেই যেন অন্ধকারে ছেঁয়ে যায় সবকিছু। পুরো পৃথিবীটা লাগে নিস্তব্ধ, নীরব।

চলবে
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here