#বেলা_শেষে। [০২]
-যৌতুকের টাকা না দিতে পারলে এই বিয়ে হবে না। বিশ হাজার টাকা বের করার ক্ষমতা নাই, মেয়েকে আবার বড় ঘরে বিয়ে দিতে চাইছেন। রাকিব উঠে আয়।হবে না এই বিয়ে। ভূমিকার হবু বর তার বাবার কথায় বিয়ের আসর ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ভূমিকার বাবা তাদের হাত পায়ে ধরে অনুরোধ করতে থাকে। যাতে তারা এই বিয়ে ভেঙে চলে না যায়। নিজের শেষ সম্বল দিয়ে মেয়ের বিয়ের যোগাড় যন্ত্ করেছিলেন তিনি।এখন যদি বিয়েটাই ভেঙে যায় তাহলে অর্থিক ও মানুষিক ভাবে শেষ হয়ে যাবেন তিনি। তাছাড়া আমাদের সমাজ বড়ই নিঠুর, এই সমাজে বিয়ে ভাঙা সংসার ভাঙা, বিধবা মেয়েদের স্থান সর্ব নিম্ন। এখন বিয়ে ভেঙে গেলে ভূমিকার ভবিষ্যৎ এর কি হবে। সমাজ তাকে কোন চোখে দেখবে। আধো কি এই সমাজে জায়গা হবে ভূমিকার।নাকি সমাজ তাকে কলঙ্কিত নারী উপাধি দিবে।অথচ ইসলাম যৌতুক কে না করেছে। ইসলামের প্রথা অনুযায়ী ছেলে পক্ষে হতে কনের জন্যে দেনমোহর ধার্য করেছে। প্রত্যেকটা স্বামি তার স্ত্রীকে সম্পূর্ণ দেনমোহর দিয়ে তবেই তাকে স্পর্শে করতে পারবে। তবে যদি স্ত্রী স্ব ইচ্ছায় তার স্বামির দেনমোহর মৌকুফ করে দেয় সেটা অন্য বিষয়।
যৌতুকের কারনে আমাদের দেশের শতশত মেয়ে বিয়ের পর ফিরে আসছে তার বাবা বাড়ি। আবার কেও কেও সুইসাইড এর মতো পথ বেছে নেয়।প্রত্যেক বাবা তার মেয়েকে বিয়ে দেয়, বিক্রি করে না। তার জন্যে ধর দামের কেন প্রয়োজন হয়।এটাই বুঝতে পারে না ভূমিকা। ভূমিকা অসহায় চোখে তার বাবার দিকে তাকালো। তিনি তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হয়তো যৌতুকের টাকা যোগার করতে না পারার কারনে সংকোচ বোধ করছেন। ভূমিকা ধীর পায়ে তার বাবার পাশে দাঁড়ায় গিয়ে। তারপর তার হাতে হাত রেখে বলে,
-তুমি ওনাদের চলে যেতে দাও বাবা। আমি এই বিয়ে করবো না।
-এসব তুই কি বলছিস মা। বিয়ে করবি না মানে। ওনারা চলে গেলে তোর কি হবে বুঝতে পারছিস??
-হ্যাঁ বাবা। আমি সব বুঝতে পারছি, কিন্তুু কি বলোতো বাবা। যারা ছেলের বিয়ে দিতে এসে দরদাম করে তাদের বাড়ির ছেলেকে বিয়ে করে সংসার করবো কি করে। বিয়ের পর এরা যখন বলবে তোমার বাবার বাড়ি থেকে কিছু টাকা নিয়ে এসো। তখন কি হবে, আমার বাবা তো টাকা দিতে পারবে না। তখন যে এরা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে না তার কোন গ্যারান্টি আছে বাবা।
ভূমিকার কথার কি জবাব দিবে তার বাবা। মেয়েটা তো সত্যিই বলছে। এমটা তো হতেই পারে। তিনি মুদ্ধ চোখে তার মেয়েকে দেখছে। কতটা বড় হলে মানুষ এমন কথা বলতে পারে।মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন ভূমিকার বাবা। ভূমিকা মৃদু হেসে বলল,
-আমাকে নিয়ে কোন চিন্তা করো না বাবা। আমি মাস্টার মশাইয়ের মেয়ে। শারিরিক শ্রম নাই দিতে পারি। আমার বাবার মতো মানুষিক শ্রম দিয়ে নিজের ব্যাবস্থা করে নিবো। তুমি স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের ঞ্জান বিতরণ করবে। আর আমি বাড়িতে বসে করবো। দরিদ্রকে যারা অবহেলা করে তাদের বিয়ে করার কোন প্রশ্নই উঠে না। ভূমিকার কথায় তার বাবা হেসে উঠলো। আর হবু বরের বাড়ির সকল আত্নীয় অপমানে রাগে চলে যায় বিয়ের আসর থেকে। যাওয়ার আগে বলে, আমরাও দেখি এমন বেয়াদব মেয়ে কার বাড়ির বউ হয়। এই মেয়ে যার সংসারে যাবে তার সংসার একদম শেষ হয়ে যাবে। বড়দের এই এক সমস্যা, তাদের কথার মুখ্য জবাব দিলেই বলবে বেয়াদব। তাতে ভূমিকার কিছু যায় আসে না। সে কারো কথার কর্ণোপাত করলো না। সবাই চলে যাওয়ার পর ভূমিকা বাড়িতে চলছে পিনপতন নিরবতা।
ভূমিকার বিয়েতে উপস্থিত ছিলো ওদের গ্রামের চেয়ারম্যান মাশহুদ তালুকদার। বিয়েতে তিনি ভূমিকার বাবাকে আর্থিক ভাবে সাহায্য করেছেন। তাই ভূমিকার বাবার অনুরোধে তিনি এসেছেন। সে বিয়ের আসরের এক কোনে দাঁড়িয়ে ভূমিকার কথা শুনছিলেন। আর ভূমিকাকে বিচক্ষণ করছিলেন। ভূমিকার কথা আর ওর সিদ্ধান্ত দেখে মুদ্ধ হন তিনি।এমন একটা মেয়েই তো চেয়ারম্যান বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্য। মাশহুদ ঠিক করে ফেললেন এই মেয়েকে তিনি তার ছেলের বউ করে নিয়ে যাবেন। ভূমিকাই হবে চেয়ারম্যান বাড়ির যোগ্যবউ।
বিয়ের বাড়ির পিনপতন নিরবতা ভেঙে মাশহুদ তালুকদার বলে উঠলেন,
-বিয়া ওইবো। মাস্টার মশাই আপনার মেয়ের বিয়া ওইবো, এবং আজই ওইবো। চেয়ারম্যানের কথা শুনে সবাই শকড্। বিয়ে হবে মানে কি। বর ছাড়া বিয়ে হবে নাকি। চেয়ারম্যান তার চেলা সোনামিয়াকে ডেকে বললেন,
-দিগন্তকে ডাকো।
-দিগন্তকে ডেকে কি করবেন??
-দিগন্তের সাথে মাস্টার মশাইয়ের মাইরার বিয়া ওইবো। ওকে যেখানে পাও যে অবস্থায় পাও ধইরা নিয়া আসো। আজ এই আসরেই দিগন্তের লগে ভূমিকার বিয়া ওইবো।
-এটা আপনি ঠিক করছেন না চেয়ারম্যান সাহেব। দিগন্ত বাবাজি এখনও ছোট। ওর এডুকেশন এখনও শেষ হয়নি আর আপনি ওর বিয়ের কথা বলছেন??
-পড়ালেখা বিয়ার পরেও করবার পারবো। কিন্তুু এমন রত্ন হারিয়া গেলে আর পাওন যাইবো না। যাও দিগন্তকে ধইরা নিয়ে আসো। অতঃপর সোনামিয়া চলল দিগন্তকে ডাকতে।
প্রায় আধঘণ্টা পর সোনামিয়া দিগন্তকে নিয়ে বিয়ে বাড়ি উপস্থিত হয়। বেচারা মনে হয় ঘুমিয়ে ছিলো চোখ মুখ কেমন ফুলা ফুলা লাগছে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। টি শার্ট শরীরের সাথে লেপ্টে কুচি ধরে আছে। দিগন্ত বুঝতে পারেনা তাকে এইভাবে ধরে আনার কারন কি? উহঃ কি সুন্দর ঘুমাচ্ছিললাম। আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে এখানে নিয়ে আসলো।
-কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু কইরা দেন। আমার পুত এইসা পড়ছে। চেয়ারম্যানের কথা শুনে বিষম্মের দৃষ্টিতে তাকায় দিগন্ত।
-এক মিনিট আব্বা। বিয়া পড়াইবো মানে। কার বিয়া??
-তোর আর মাস্টার মশাইয়ের মাইয়ার বিয়া। খুব ভালো মেয়ে বুঝলি দিগু। এক্কেবারে চেয়ারম্যান বাড়ির যোগ্যবউ। বলেই অট্টহাসি দিলেন চেয়ারম্যান। দিগন্তের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। সে তো পারবে না এই বিয়ে করতে। সে যদি বিয়ে করে তাহলে মিমির কি হবে।সে তো মিমিকে কথা দিয়েছে।এখন বিয়ে হলে মিমির কি হবে। মিমি এই কষ্ট সহ্য করতে পারবে না।
-আমি এই বিয়া করতে পারুম না আব্বা।
চেয়ারম্যান মৃদু হেসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল।
-বাচ্চা মানুষ। পড়াশুনা এখনও শেষ হয়নাই। শহরে থাইক্যা পড়াশুনা করে তো।তাই শহরের মতো হইয়া গেছে।এখন বিয়া করতে চাইছে না। আমার পোলা কিন্তু পড়াশুনায় একশো তে একশো।
-আব্বা আপনি আমার কথা শুনেন।
-এখন তোর কথা শুনোনের টাইম নাই। আগে বিয়াটা হোক তারপর শুনবো। দেখ কত দেরী হইয়া গেছে। কাজি সাহবে জলদি বিয়া পরানো শুরু করেন।
-আমারে মাফ করেন আব্বা। আমি এই বিয়া করুম না।
– তুই করবি না তোর বাপ বিয়া করবো। বস ওখানে।
-তাইলে আফনেই করেন বিয়া। আমি আম্মারে নিয়া ঢাকায় চইলা যাইতাছি। চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই চেয়ারম্যান তার চেলা পেলাগো চোখের ইশারায় দিগন্তকে আটকাতে বলে। যার ফলো চেয়ারম্যানের চেলারা দিগন্তকে আটকিয়ে বিয়ের আসরে বসিয়ে দেয়।
দিগন্তের ঘরে বউ সেজে বসেআছে ভূমিকা। হ্যাঁ ওদের বিয়েটা হয়েগেছে। চেয়ারম্যান বাড়ির সকলেই ভূমিকাকে বউ হিসাবে মেনে নিয়েছে। মানতে পারেনি শুধু দিগন্ত। দিগন্তের মা হাসি মুখে ভূমিকাকে বরণ করে ঘরে তুলে। ভূমিকাকে রেখে সেই চলে গেছে দিগন্ত এখনও বাড়ি ফেরার কোন নাম নেই। ভূমিকা দিগন্তের পুরো ঘরটাকে নিরক্ষণ করেনিলো। পুরনো ডিজাইনের একটা খাট। তার পাশে একটা পড়ার টেবিল।টেবিলের উপর বইয়ের পাহার। তার উপর দেয়ালে টানানো আছে কঙ্কালের ছবি, ব্যাঙের ছবি। আরো ছোট ছোট কয়েকটা কাগজ। খাটের অপজিট পাশে একটা আলমারি আর একটা ড্রেসিংটেবিল দিয়েই সাজানো হয়েছে দিগন্তের ঘরটা।পুরো ঘরটা দেখা শেষ ভূমিকার চোখ পড়লো দেয়ালের উপর সাঁটানো ঘড়ির দিকে। রাতের প্রায় এগারোটা বাজতে চলল অথচ দিগন্ত আসছে না তার ঘরে। ভূমিকা বিছানায় বসে দিগন্তের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো।ভূমিকা তার দাদী নানীর মুখে শুনেছে, বাসর রাতে নাকি স্বামিকে সালাম করতে হয়। তারপর তাকে পান দুধ খাওয়াতে হয়। বাসর ঘর না সাজালেও পান আর দুধ ঠিকই রেখেছে। কিন্তুু এগুলো খাওয়াবে কাকে। দিগন্ত তো তার ঘরে আসে নি। তাই বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলো ভূমিকা ।
আযানের শব্দে ঘুম ভাঙে ভূমিকার। অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। আখি খুলতেই সে নিজেকে একটা অপরিচিত ঘরে দেখতে আবিষ্কার করে। সদ্য ঘুম থেকে বুঝতে পারেনা সে কোথায় আছে। পরক্ষনেই মনে পড়ে কালকে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা। সে তো তার স্বামির জন্যে জন্যে অপেক্ষা করছিলো। ওহ শিট, সে ঘুমিয়ে পড়ছিলো। এটা ঠিক হয়নি। দিগন্ত কি ভাবছে এখন। সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখতে পেল সে যে অবস্থায় ঘুমিয়েছিল ঘরটা সে রকমই আছে। লাইটটাও এখনও জ্বালানো, তাহলে কি দিগন্ত আজ বাড়ি ফিরে নি। তাহলে কোথায় আছে দিগন্ত।
সমস্ত ভাবনা চিন্তা বাদদিয়ে ওয়াশরুমে চলল ভূমিকা। আযান দিয়েছে। অজু করে নামায পড়ে নিল। এখন কি করবে। সকাল হতে এখনও কিছু সময় বাকি আছে। ওর বাড়িতে থাকলে এই সময় বসে বসে কোরআন তেলাওয়াত করতো।এখানে তো কোরআন নেই তাই রুমটা গুছিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো ভূমিকা। সূর্য উদয়ের সময়টা মনে হয়সারাদিনের সব থেকে বেস্ট সময়। অন্ধকারের রেশ কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠা। মোরকের ডাকে সকলের ঘুম ভেঙে বাহিরে দাঁড়ালেই দেখতে পাওয়া যায় কিভাবে পাখিরা খাদ্যের সন্ধানে চলছে। সকালের মিষ্টি রোদ বেশ উপকারি।
সকাল দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরে দিগন্ত। ভূমিকা তখন সকলের জন্যে চা বানাচ্ছিল। দিগন্তকে দেখেই ভূমিকার বুকের ভেতরটা ছেদ করে উঠে। এ কেমন অবস্থা হয়েছে তার। মনে হচ্ছে সারা রাত না ঘুমিয়ে কান্না করছে।ভূমিকা তাকিয়ে আছে দিগন্তের দিকে কিন্ত সেদিকে দিগন্তের কোন খেয়ালই নেই। বাড়ি ফিরো কারো সাথে কোন কথা না বলে সোজা চলে যায় তার ঘরে। এবং সেখানে গিয়ে নিজের সমস্ত জিনিসপত্র প্যাকিং করতে থাকে।
চলবে,,,,,,,
#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা ।