বেলাশেষে পর্ব -০৩

#বেলা_শেষে। [০৩]

ব্যাগ প্যাকিং করে খাটের এক পাশে রেখে অন্যপাশে বসে আছে দিগন্ত। টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার। বাড়ি থেকে চলে যাবে বলে ব্যাগ তো প্যাকিং করে নিলো। কিন্তুু বের হবে কি করে? মাশহুদ তালুকদারকে জমের মতো ভয় পায় সে। সে যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায় । তখন কি করবে দিগন্ত। সে তো কিছুতেই যেতে পারবে না।বাবার কথার অবাধ্য হওয়ার সাধ্যি তার নেই। দুহাতে কপাল চেপে ধরে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে রইলো দিগন্ত। ওর উদ্দেশ্য মাশহুদ তালুকদার যখনি বাড়ি থেকে কোথাও যাবেন তখন দিগন্ত কাওকে কিছু না বলে চলে যাবে। ঢাকায় পৌঁছে গিয়ে তার মাকে কল করে জানাবে।

মাশহুদের হাতে চা দিয়ে আবার রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় ভূমিকা। মাশহুদ চায়ে এক চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধকরে চায়ের স্বাদ উপভোগ করে নিলেন। তারপর মৃদু সূরে ডাক দিলেন,

-বৌমা,,,,

ভূুমিকা পিছনের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। মাশহুদ আবারও বলে,

-দিগুটা সেই কখন তার ঘরে ডুকলো। এখন পর্যন্ত বাইরে বের ওইলো না। তুমি ওর কাছে যাও। জিগ্যাও গিয়া কিছু লাগবো নাকি? মনে হয় আমার উপর রাইগা আছে। জোর করে বিয়া দিছি তাই নিগ্যা। ভূমিকা মাথা নাড়ায়। তারপর হাতে এক কাপ চা নিয়ে চলে আসে দিগন্তের ঘরে। দিগন্ত তখন দু- হাতে মাথা চেঁপে বসে ছিলো। ভূমিকা দিগন্তের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

-আপনার কি মাথা ব্যথা করছে? ভূমিকার কন্ঠে শ্বর শুনে মাথা থেকে হাত নামিয়ে সামনে তাকায় দিগন্ত। অতঃপর ভূমিকা বলে,

-আমি অনেক ভালো মাথা ম্যেসেজ করতে পারি। আপনার মাথা টিপে দিবো।

ভূমিকার কথাগুলো দিগন্তের কাছে নেকামো ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। বেশ তিক্ত লাগছে তার। শক্তচোখে ভূমিকার দিকে তাকিয়ে বলল,

-বউ বউ আচরন করছো মনে হচ্ছে।

-এমা, বউয়ের মতো আচরন কেন করবো। আমি তো বউ ই তাইনা। ফটাফট কথা বলা ভূমিকার ছোট বেলার স্বভাব। ভূমিকার কথা শুনে কপালে ভাজ ফেলে ভ্রু কুচকিয়ে তাকালো দিগন্ত। মেয়েটা বেশ চঞ্চল এটা আগে শুনেছে কিন্তুু কতটা চঞ্চল হতে পারে সেটাই ধারনা করতে ব্যাস্ত এখন দিগন্ত।

-এই মেয়ে শুনো, আমার সাথে একদম নেকামো করবা না বলে দিলাম। আর হ্যাঁ ভুলেও আমার বউ হওয়ার চেষ্টা করো না। আমি মানি না এই বিয়ে।

-পরে মানিয়ে নিবেন।

এবার আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না দিগন্ত। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভূমিকার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে সেটা ফ্লোরে ছুঁড়ে দিলো। আচমকা চায়ের কাপে হাত দেওয়ার কারনে কিছুটা চা ভূমিকার হাতে পরে। কিন্তুু সেদিকে খেয়াল নেই ভূমিকার। তার দৃষ্টি এখন সামনে থাকা এই যুবকটার দিকে। কেমন ছেলে এটা একটু কথাই রাগ করে। অথচ ভূমিকা জানে ছেলেরা যেমন সহজে কাঁদে না। আবার রাগও করে না। কিন্তুু এই ছেলে সম্পূর্ণ বিপরীত মুখী আচরণ করছে।কথার কথায় রাগ দেখাচ্ছে আবার বিয়ে মানে না বলছে। বলুক তাতে কি যায় আসে। বিয়ে তো হয়েগেছে। ভূমিকা খেয়াল করলো দিগন্ত তার হাত শক্তমুঠি করে নিয়েছে। রাগে ফুসছে আর ঠোঁট কামড়াচ্ছে। ভূমিকার কেন যানি মনে হলে ব্ল্যাক মাম্বা সাপের মতো লাগছে দিগন্তকে। আচ্ছা সে কি এখন সাপের মতো ভূমিকাকে ছোবল দিবে। ঘাড় বাকা করে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবনায় ডুব দিলো ভূমিকা।

-এই মেয়ে, এই এভাবে তাকিয়ে আছো কেন হুম? ছেলে দেখনি কখনো??

ভূমিকার বলতে ইচ্ছে করছে, ছেলে আর বর এক হলো নাকি। আমি তো আমার বর কে দেখছি আপনি বাধা দিচ্ছেন কেন? কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করার সাহস হলো না ভূমিকার। দিগন্ত যে পরিমান রেগে আছে এখন কিছু না বলাই বুদ্ধিমতীর কাজ।

হাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো ভূমিকা। তারপর ফ্লোরে পরে থাকা ভাঙা চায়ের কাপের দিকে তাকানোর সময় বিছানায় দুটো ব্যাগ দেখতে পেলো। তার মধ্যে একটা জামা কাপড়ের ব্যাগ আর অন্যটাতে হয়তো ল্যাপটপ আছে। কিন্তুু দিগন্ত তার জামা কাপড় প্যাকিং ই বা করছে কেন?? গভীর প্রশ্ন ভূমিকার। নিজের কৌতুহল দমাতে না পেরে ভূমিকা আবারও তার মুখ খুলল,

-আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন??

-তোমাকে বলতে বাধ্য নই আমি???

-আমি আপনার স্ত্রী আমাকে বলবেন না তো কাকে বলবেন???

ভূমিকার বলা কথায় নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পাড়লো না দিগন্ত। দুহাতে ভূমিকার বাহু চেপে ধরে দাঁত কটমট করে বলল,

-এনাফ ইজ এনাফ। আর এক বার যদি নিজেকে আমার বউ হিসাবে উল্লেখ করছো তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেও হবে না। বুঝেছো। আমি মানি না এই বিয়ে। তোমাকে বউ হিসাবে মানি না। আমার বউ হবে তো মিমি। আমার মিমি।

মুহূর্তেই নিশ্চুপ হয়েগেলো ভূমিকা। দু-চোখের সামনে কেমন যেন সব কিছু ঝাপসা লাগছে। দিগন্তের বলা শেষ কথাটা এখনও ভূমিকার কানে বাজছে, আমার বউ হবে মিমি। আমার মিমি। দু- চোখ বন্ধকরে নিলো সে। বেশ গরম হাওয়া বয়ছে। হয়তো এক্ষুনি ঝড় উঠে আসবে। তারপর জড়ানো গলায় বলল,

– কে মিমি?

দিগন্তের হুস আসলো। সাথে সাথে ভূমিকাকে ছেড়ে একটু দূরে সরে দাঁড়লো। রাগের বসে কি সব বলেছে সে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে বড় করে শ্বাস নিলো।

-আমাকে সবটা বলতে পারেন। সাধ্যি থাকলে আপনাকে সাহায্য করবো? নিজের সুখের জন্যে অন্যকারো সুখ কেড়ে নেওয়ার অধীকার আমার নেই। আপনি কোন সংকোচ না করে আমাকে সত্যিটা বলতে পারেন। ভূমিকার কথা শুনে ভ্রু কুচকিয়ে তাকায় দিগন্ত। ভূমিকাকে কি সব সত্যি বলে দিবে। হ্যাঁ বলে দেওয়াই ভালো। পরে এই নিয়ে আর কোন কথা বলতে পারবে না সে। অতঃপর দিগন্ত বলতে শুরু করে,

-মিমি হলো আমার গার্লফ্রেন্ড। আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। পড়ালেখা শেষ করে বিয়ে করার সিদ্ধান্তও নিয়েছি। কিন্তুু তার আগেই আব্বা তোমার সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিলো। এখন মিমি যদি জানতে পারে আমি বিয়ে করেছি তাহলে ও নিজেকে শেষ করে দিবে। কি করবো বুঝতে পারছি না।

-এ কথা আগে বলেন নি কেন??

-বলার সুযোগ দিয়েছে কেও আমাকে। জল্লাদের মতো সবাই আমাকে ধরে বিয়ে দিয়ে দিলো।

ভূমিকা বড় করে শ্বাস ছাড়লো। তারপর বলল,

-আমি আপনাকে কি ভাবে সাহায্য করতে পারি। অতঃপর দিগন্ত তার বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা বলল। ভূমিকা সেটাও মেনে নেয় এবং বলে সে এদিকের সবটা সামলে নিবে।

সেদিন রাতে ভূমিকার সাহায্যেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় দিগন্ত। মাশহুদ ভূমিকার কাছে দিগন্তের ব্যাপারে জানতে চাইলে ভূমিকা জবাব দেয়। সে সবটা জানে। আর দিগন্তের কলেজ থেকে ফোন এসেছিল। তাই সে কাওকে কিছু না বলেই চলে গেছে।

দিগন্ত চলে যাওয়ার দুই মাস পর্যন্ত ভূমিকার সাথে কোন রকমের যোগাযোগ হয়নি। ভূমিকাও আগ বাড়িয়ে দিগন্তের সাথে যোগাযোগ করে নি। যেখানে সম্পর্ক থাকবে কি না তার কোন নিশ্চয়তা নেই সেখানে মায়া বাড়িয়ে নতুন সম্পর্ক তৈরী করারও কোন মানে নেই। এদিকে ভূমিকার রেজাল্ট ও বের হয়েছে। বরাবরের মতোই এবারও ভালো রেজাল্ট করেছে ভূমিকা। সেই খুশিতে চেয়ারম্যান পুরো গ্রাম মিষ্টি বিতরণ করেন।চলে যায় সময় দিগন্তের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছেদ এখন ভূমিকার। ভূমিকা কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। বাকি সব মেয়েদের মতো সে সমাজকে নিন্ম স্তরে পরে থাকবে না। সে প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশের একজন সু-প্রতিষ্ঠিত নাগরিক হয়ে সমাজে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে। মেয়েরা একা বাঁচতে পারে না এই প্রথা ভূল প্রমানিত করবে সে।

ভূমিকা তার লক্ষের পথেই এগোতে থাকে। আর এই সিদ্ধান্তে তার পাশে দাঁড়ায় তার শ্বশুড় মশাই মাশহুদ তালুকদার। মাশহুদ ভূমিকাকে সর্বোচ্চ সাপোর্ট করে। যদিও এই কাজে দিগন্তের মা বাধা হয়ে দাঁড়ায় কিন্ত মাশহুদের সিদ্ধান্তের কাছে তার কথা টিকে থাকে না। মাশহুদ ভূমিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-আমাদের এই কুলষিত সমাজ কে প্রমান করে নারীরা চাইলে সব করতে পারে। যে রাধে সে চুলও বাধে।

ভূমিকার বিয়ের তিন মাস চলছে। এখন সামনে ইলেকশন। মাশহুদ তালুকদার সেই নিয়ে ব্যাস্ত। যদিও ইলেকশন হতে আরো দু মাস সময় আছে। তবুও প্রিপারেশন বলে একটা কথা আছে। আজ সকালে বেলা মাশহুদ দিগন্তকে কল করে বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে আসতে। তিনি একা একা সব সামলাতে পারছে না।

বিকাল বেলা দিগন্তের চাচাতো বোন অদিতি এসে ভূমিকাকে বলে,
-ভাবি তুমি ভাইরে আইতে কও না কেন? নতুন বউ রাইখা কেও এত দিন দূরে থাকে। অদিতির কথা স্মিত হাসলো ভূমিকা। অদিতি মেয়েটা বড্ড সরল। সব সময় মুখে কথার ফুয়ারা ফুটে কিন্তু পড়ালেখায় ঘোড়ার ডিম। চার বছর ধরে ক্লাস এইটে পরে আছে। একবার একটা স্যার ওকে টুকলি করতে বলেছিলো। যাতে পাশ করে ক্লাস এইট পার করতে পারে। কিন্তু অদিতি যে অতি সৎ। সে কিছুতেই টুকলি করবে না। দরকার পরলে আরো চার বছর ক্লাস এইটে পড়বে। কিন্তু টুকলি করবে না।

-ভাবি তুমি ভাইরে চিঠি লেখো না ক্যান??

-তোমার ভাইয়ের চিঠি পড়ার সময় নেই। সে পড়াশুনা নিয়ে খুব ব্যাস্ত।

-আইচ্ছা। তারপর অদিতি আর ভূমিকা মিলে অনেক গল্পকরে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারে আকাশের ওই রুটির মতো চাঁদটাকে দেখছে। চাঁদের জ্যোৎস্নায় চারিদিকে মো মো করছে। পুরো গ্রাম স্তব্ধ। পৃথীবিতে রাত নামার সাথে সাথেই ক্লান্ত এই গ্রাম ঘুমিয়ে পরে। হঠাৎ করে বেল বাজার শব্দ শুনতে পায় ভূমিকা। কিন্তু এত রাতে কে আসলো সেটাই বুঝতে পারে না সে। এদিকে লোকটা বিরতিহীন ভাবে বেল বাজিয়ে যাচ্ছে। ভূমিকার ইচ্ছে করছে লোকটার হাতে চাপট মারলে। উহ কান ফেটে যাবে মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে এসে দরজা খুলে দেয় ভূমিকা। দরজার ওপাশে ব্যাক্তিকে দেখে ঠায় দাড়িয়ে থাকে সে।

চলবে,,,,,,,,

#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here