#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৫
সময় বিকাল চারটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। সূর্যের আলো ধীরে ধীরে মলিন হয়ে আসছে৷ হিম শীতল বাতাসে শরীর কেঁপে ওঠছে। সিটে মাথা রেখে জড় বস্তুর মতো পড়ে ছিল হৈমী৷ কখন যে চোখ লেগেছে টেরও পায়নি। রুদ্রকে তার বাবা ফোন করেছিল। বাবার সাথে কথা বলার পর ফোন এসেছে রাদিফের। রাদিফের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা চলছিল। কথার ফাঁকে হৈমীর দিকে নজর পড়তেই আঁতকে ওঠে সে। হড়বড়ে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলে হৈমীকে। ঘুমের ঘোরে গা ছেড়ে দিয়েছিল মেয়েটা। আর একটু হলেই মাথাটা গিয়ে জানালার কাঁচে লাগত! ভাগ্যিস সে দেখেছিল। সংবিৎশক্তি ফিরে পেয়ে দুর্বল চোখে তাকাল হৈমী। রুদ্র রাখছি বলে রাদিফের সঙ্গে কথার সমাপ্তি ঘটাল। রাশভারি কণ্ঠে হৈমীকে বলল,
-” ঘুমাচ্ছ কেন? ”
কিঞ্চিৎ নড়ল হৈমী৷ কিন্তু উত্তর দিল না। রুদ্র ধরে রাখা বাহু ছেড়ে দিলে সে পূর্বের ন্যায় সিটে গা এলিয়ে দিল। রুদ্র মুখ ফিরিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে রইল। হৈমীর চোখ মুখের অবস্থা দেখে অস্বস্তি হচ্ছে তার। হৈমী আবারো ঘুমে ঢুলুঢুলু। মাথা সিট থেকে বার বার পড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। অবস্থা বুঝে চিন্তা হলো রুদ্রর। ফিরে তাকিয়ে কাছে টেনে আনল ছোট্ট, নরম, দুর্বল শরীরটাকে। বুকের কাছটায় মাথা রেখে ভরাট স্বরে বলল,
-” এভাবে থাকো। ”
হৈমী কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। চুপচাপ পড়ে রইল। শীত লাগছে তার শরীর মৃদু কাঁপছে। রুদ্রর বক্ষস্থলের উষ্ণতায় আরাম পেল বেশ৷ সে আরামে
এক সময় বিভোর ঘুমে তলিয়েও গেল। চারদিকে যখন মাগরিবের আজান ধ্বনি শোনা গেল, তখন রুদ্রর ফোনে কয়েকটি একটি ম্যাসেজ এলো। ম্যাসেজগুলো সূচনার। সে লিখেছে,
-” ভাইয়া তুমি হৈমীকে নিয়ে ঢাকা যাচ্ছ? যেখানেই যাও মাথা ঠান্ডা রেখ, মেজাজ শান্ত করো। হৈমীকে বুঝিয়ে কাছে রেখ। ও অনেক সহজসরল, শান্তভাবে বুঝিয়ে বললে সব শুনবে৷ রেগে বললে ভয় পাবে। মাহের খুব চিন্তা করছে, মায়েরও প্রেশার বেড়ে গেছে৷ প্লিজ তুমি হৈমীর খেয়াল রেখ৷ এমনিতেই বয়স কম তারওপর অতিরিক্ত বোকা। এমন একটা মেয়েকে যখন তুমি নিজের সঙ্গে জড়িয়েছ তখন তোমাকেও ধৈর্য্যশীল হতে হবে৷ বুঝিয়ে, শুনিয়ে, গুছিয়ে নিতে হবে। ইমম্যাচিওর মেয়ে বিয়ে করে প্লিজ তুমি ম্যাচিওরিটি আশা করো না। পারলে ম্যাচিওর করে নাও। একটা ছোট্ট বাচ্চাকে যেমন কোলেপিঠে করে মানুষ করতে হয় ধরে নাও হৈমীকেও তোমায় ওভাবে বুঝদার মানুষ করে নিতে হবে। আমাদের কালো অতীতের প্রভাব যেন ওর ওপর না পড়ে ভাইয়া। মাথায় রেখ ও আমার স্বামীর আদরের বোন। ওর কিছু হলে তার প্রভাব আমার ওপরও পড়বে৷ যতই আজ মা রেগে থাকুক কাল অবশ্যই মেয়ের দিকে ফিরে তাকাবেন। ভালো থেক তোমরা, রাগটা কমিও। মেয়েটা সকালে ঠিকভাবে খায়নি, ও আবার বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারে না। খেয়াল রেখ ওর নিজের খেয়ালও রেখ। আমি সময় করে ফোন দিব আল্লাহ হাফেজ। ”
________
রুদ্রর ডাকে ঘুম ভাঙল হৈমীর। চোখ মেলে রুদ্রর মুখটা দেখে চমকে ওঠল, হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে চোখ কচকালো। মাথা চেপে ধরে চারদিকে সচেতন দৃষ্টি বুলাল। মনে পড়ে গেল তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা। সেই সাথে খেয়াল করল সে রুদ্রর কোলে শুয়ে আছে। শুনতে পেল গুরুগম্ভীর মানুষটার শান্ত কণ্ঠস্বর,
-” আমাদের পৌঁছাতে আরো সময় লাগবে। খাবার আনিয়েছি হাত, মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও। ”
ধীরেধীরে ওঠে বসল হৈমী। অমনি গায়ে জড়ানো শাড়ির অর্ধেক পড়ে গেল নিচে। বিস্মিত হয়ে দু’হাতে শাড়ি চেপে ধরল। রুদ্রর দিকে কাচুমাচু হয়ে একবার তাকিয়ে নিজের সিটে গিয়ে বসল। রুদ্র খেয়াল করল হৈমীর শাড়ির কুঁচি পুরোটাই খুলে গেছে। ঠিকঠাক হওয়ার জন্য চোখ ফিরিয়ে নিল সে বিরবির করে বলল,
-” ঘুমের ঘোরে এত যুদ্ধ করার পরও আঁচল টুকু ঠিক আছে এটাই মাথা সমান। এতেই আমি ধন্য! ”
শাড়ির বেহাল দশা দেখে হৈমী ত্বরান্বিত হয়ে খুলে যাওয়া কুঁচি কোনরকমে কোমরে গুঁজে দিল। রুদ্র অন্যপাশে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল,
-” সব ওকে? ”
হৈমী মৃদুস্বরে জবাব দিল,
-” হুম। ”
গাড়ির ডোর খুলে ঝিনুককে আসতে বলল রুদ্র। ঝিনুক এক লিটারের পানির বোতল এগিয়ে দিল। রুদ্র সেটা নিয়ে হৈমীকে দিল বলল,
-” ডোর খোলার প্রয়োজন নেই। জানালা দিয়ে মাথা বের করে মুখে পানি দাও। ”
মাথা নাড়িয়ে সম্মত হলো হৈমী৷ রুদ্র তার হাতে বোতল দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ডোর আটকাতে উদ্যত হলো। শঙ্কিত হয়ে হৈমী বলল,
-” কোথায় যাচ্ছেন! ”
চোখ বন্ধ করে আবার মেলে তাকাল রুদ্র। দৃঢ় স্বরে বলল,
-” এখানেই আছি। ”
-” দরজা খোলা থাকুক। ”
ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল রুদ্র। এত ভয়! সিগারেট খাওয়ার জন্য কিছুটা দূরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু যাওয়া হলো না। খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়েই দ্রুততার সঙ্গে সিগারেট ফুঁকতে হলো। হৈমীও রুদ্রকে চোখে চোখে রেখে হাত, মুখ ধুয়ে বলল,
-” শেষ। ”
রুদ্র ঝিনুককে ইশারায় টিস্যু বক্স দিতে বলল। ঝিনুক টিস্যু বক্স এগিয়ে দিলে হৈমী তা নিয়ে হাত, মুখ মুছে চুপ করে বসে রইল। দু’টো সিগারেট শেষ করে পনিরের হাত থেকে খাবারগুলো নিল সে। বলল,
-” আশপাশে ঘুরে আয়। ফোন করলেই চলে আসবি।”
ওরা চলে যেতেই সে খাবারের প্যাকেট নিয়ে গাড়িতে বসল। ডোর লক করে হৈমীর দিকে খাবারের প্যাকেট দিয়ে বলল,
-” খেয়ে নাও। ”
অতিরিক্ত খিদে পাওয়াতে গা গুলাচ্ছিল হৈমীর। তাই খাবার পেয়ে আর টু শব্দটিও করল না। ভদ্র মেয়ের মতো খাবার নিয়ে খেতে শুরু করল। অর্ধেক খাওয়ার পর রুদ্রর দিকে তাকাল। নরম সুরে জিজ্ঞেস করল,
-” আপনি খাবেন না? ”
রুদ্র আড়চোখে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-” না। ”
-” আমি এতগুলো কীভাবে খাব? আপনি এই প্যাকেট নিন। ”
-” খাও তুমি। ”
-” খাবারের সাথে রাগ করতে নেই। জানেন টিশার জামাই খেতে না চাইলে টিশা জোর করে করে, গল্প শুনিয়ে, ছড়া কেটে খাওয়িয়ে দেয়। ”
দীর্ঘ একটা সময় পর হৈমীর মুখে কথা ফুটেছে। ফলশ্রুতিতে রুদ্রর বিরক্ত লাগল না। বেশ ভালোই লাগল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
-” ওকে খাচ্ছি। ”
ঈষৎ হাসল হৈমী। খাওয়া শেষ করে জিজ্ঞেস করল,
-” ভাবি ফোন করেছিল? ”
খেতে খেতে রুদ্র জবাব দিল,
-” না। ”
মনটা আবারো বিষন্ন হয়ে গেল হৈমীর। বলল,
-” আমি কবে আসব? ”
-” জানি না। ”
আর কোনো প্রশ্ন করল না সে। চুপসে গেল পূর্বের মতোই। ঢাকা পৌঁছাতে রাত সাড়ে দশটা বাজল। হৈমী তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রুদ্র বুঝল, লম্বা জার্নি করার অভ্যাস নেই ওর। পুরো পথ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল। এবার ঘুম ভাঙাতে হবে। তাই ডাকল, একবার, দু’বার, তিনবার। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। ঝিনুককে ডেকে চাবি বের করে দিল। বলল,
-” গেট খুলে চারতালায় চলে যা। লক খুলে রাখ। ”
ঝিনুক চলে গেল পনির ড্রাইভিং সিটে বসেই গুণগুণ করে গান গাইছে। রুদ্র সন্তর্পণে হৈমীকে পাঁজাকোল করে নিয়ে গেটে ভিতরে প্রবেশ করল। মুখোমুখি হলো, দোতলার ভাড়াটিয়া আংকেলের সঙ্গে। লোকটার মুখে ভয়ের ছাপ। রুদ্র বুঝতে পেরে এগোতে এগোতে বলল,
-” আংকেল বউ নিয়ে এলাম। লং জার্নিতে শরীর খারাপ করেছে তাই ঘুমে ডিস্টার্ব করলাম না। ”
এবার লোকটার চোখ, মুখের আকৃতি পরিবর্তন হলো। বিস্ময় নিয়ে বলল,
-” বিয়ে করেছ কই কিছু শুনলাম না তো। ”
বাঁকা হেসে রুদ্র বলল,
-” আস্তেধীরে শুনে যাবেন, আসি। ”
________
রুদ্র যখন ঢাকায় আসে একাকী সময় কাটাতে উত্তরার এই বাসাতেই থাকে। তেরো শতাংশ জায়গা জুড়ে নির্মিত পাঁচতলা বিশিষ্ট বিল্ডিং। চারতলা ব্যাতীত বাকি সবগুলোই ভাড়া দেয়া। নিজের ফ্ল্যাটটি আগে থেকেই বেশ সাজানো গোছানো। তবে সংসার করার মতো সাজানো গোছানো নয়। এবার একটা ছোট্ট সংসার তৈরি করতে হবে । হৈমীকে নিজের বেডরুমে শুইয়ে দিয়ে ঝিনুক আর পনিরকে দায়িত্ব দিল আগামীকালকের ভিতরেই একটা সংসারে যা যা লাগে সব কিছুর ব্যবস্থা করতে। ওরা ব্যবস্থা করে ফেলবে এই নিশ্চয়তা দিয়ে জড়তার সঙ্গে জিজ্ঞেস করল,
-” বস ফুলের দোকান খোলাই আছে। আপনি বললে ঘন্টা খানিক সময়ের মধ্যেই বাসর ঘর সাজিয়ে ফেলব! ”
হকচকিয়ে গেল রুদ্র। চাপাস্বরে ধমক দিল ওদের। বলল,
-” বিয়ে করেই আধমরা বানিয়ে ফেলেছি, বাসর করে পুরোপুরি মেরে ফেলব নাকি! যা ফোন রাখ। ”
ফোন কেটে চাপা হাসল রুদ্র। বিরবির করে বলল,
-” বিয়ে করেছি মনের খোরাক মেটাতে ব্যস। ”
শীতের রাত তবুও লম্বা সময় নিয়ে গোসল করল রুদ্র। বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় ঘুমন্ত হৈমীকে দেখে মনে পড়ল, ওরও গোসল করা উচিৎ। লম্বা জার্নি, ধুলাবালিতে অবস্থা শোচনীয়। গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে হৈমীকে ডাকতে গেল সে। ডাকতে ডাকতে বিরক্ত হয়ে বেশ কড়া গলায় ডাক শুরু করল। একটা মানুষের ঘুম এত গভীর কী করে হয়! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেও মেয়েটার ঘুম ভাঙাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে! শেষে বিরক্ত হয়ে ধৈর্য ধরতে না পেরে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত হৈমীকে একটানে বসিয়ে দিল। মুখ দিয়ে অল্প শব্দ করে ঢুলুঢুলু চোখে তাকাল হৈমী। রুদ্র একহাতে ওর কাঁধ ধরে বসল। বলল,
-” আমরা পৌঁছেছি অনেকক্ষণ। যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। ”
কর্ণে স্পষ্ট গুলো শব্দ ঢুকতেই ঘুম ছেড়ে গেল। চোখ বড়ো বড়ো করে প্রথমে সদ্য গোসল করে আসা রুদ্রকে দেখে স্থির হলো দৃষ্টিজোড়া। দীর্ঘ আকৃতির সুঠাম দেহখানা দেখে এক ঢোক চিপল। উন্মুক্ত বক্ষে দৃষ্টি পড়লে নিমিষেই লজ্জায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। মনে মনে রুদ্রকে নির্লজ্জ বলে গালি দিল৷ এরপর পূর্ণ দৃষ্টিতে পুরো রুমটা নিরীক্ষণ করল। ধবধবে সাদা দেয়াল, সাদা টাইলস, বিশাল বিছানা, ডানপাশে কাউচ, বামপাশে কাভার্ড, ছোট্ট একটি টেবিল বেলকনির দরজা, দু’টো জানালা, সবমিলিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সাদা সাদাতে আলোকচ্ছটা চোখে বিঁধল খুব। রুদ্র তার চাহনি খেয়াল করে বলল,
-” এসব দেখার অনেক সময় পাবে। যাও গিয়ে শাওয়ার নাও এবার। ”
পায়ের কাছে কম্বলটা টেনে গায়ে জড়িয়ে সে বলল,
-” ওমা কী বলছেন! এই শীতে রাত করে শাওয়ার নিব কেন? ”
-” বাইরের ধুলাবালি মাখিয়ে বিছানা নষ্ট করেছ। বেডশিট পাল্টাতে হবে। পরিষ্কার বেডশিটে ময়লা শরীরে থাকতে দিব না! ”
সর্বনাশ! এই লোক বলে কী? তাহলে সে কোথায় থাকবে? বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল সে। রুদ্র আবারো বলল,
-” সময় নষ্ট করো না গরম পানি আছে গোসল করে নাও। ”
হৈমী ঠোঁট উল্টে কিছুক্ষণ বসে থেকে হঠাৎ বলল,
-” কিন্তু আমি কী পড়ব! আমার জামাকাপড়… ”
সহসা চৈতন্য ফিরল রুদ্রর। সত্যি তো এতকিছুর মাঝে এদিকটা তো খেয়ালই করা হয়নি! চিন্তান্বিত হয়ে ওঠে দাঁড়াল সে। বিব্রত মুখে কয়েকবার তাকাল ঘড়ির দিকে। রাত অনেক হয়েছে এ সময় শপিংমল গুলোও খোলা নয়। তার চিন্তান্বিত গম্ভীর মুখ দেখে হৈমী বলল,
-” আজ থাক কালকে না হয় জামাকাপড়ের ব্যবস্থা করে লম্বা গোসল দিব। ”
ভ্রু কুঁচকে তাকাল রুদ্র। হৈমীর ঠোঁটে ভর করল দুষ্টু হাসি। রুদ্র সে হাসি দেখে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
-” অপরিচ্ছন্ন মানুষ আমি পছন্দ করি না। ”
বলতে বলতেই কাভার্ডের সামনে গিয়ে কপাট খুলে টিশার্ট ঘাটতে লাগল। বেশ সময় নিয়ে খুঁজে খুঁজে হলুদ রঙের একটি লম্বা হাতা টিশার্ট, সাদা রঙের ট্রাউজার বের করল। টের পেল ঐ দেড় ফিট শরীরে এসব ফিটিং হবে না৷ তবুও রাত আর সকাল টুকু এগুলো দিয়েই পার করতে হবে। হৈমীকে ওগুলো দেয়ার পর সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
-” আপনি আর কত নিষ্ঠুর হবেন? এই রাতে এভাবে আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন? ”
-” শাস্তি! সেটা তো শুরুই হয়নি। ”
থতমত খেয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে টিশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে বাথরুমে চলে গেল হৈমী। রুদ্র বাঁকা হেসে বেডশিট পাল্টালো। গোসল শেষ করে ঢোলা পোশাকগুলো পড়ে, ভেজা চুলে কাঁপতে কাঁপতে বের হলো হৈমী। রুদ্র ফোন থেকে দৃষ্টি ওঠিয়ে একবার দেখল ওকে। বেছে বেছে সবচেয়ে ছোটো টিশার্ট বের করেছিল সে, যেটা তার কোমরের ওপর থাকে, অথচ হৈমীর কোমর ছেড়ে হাঁটুর একটু উপর পর্যন্ত হয়েছে। তা দেখে রুদ্র হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। হৈমীর মুখটাও দেখার মতো হয়ে আছে। একদিকে টি-শার্টের লম্বা হাতা টেনে হাত বের করতে বেগ পেতে হচ্ছে। অপরদিকে ইয়া লম্বা ট্রাউজার পরে পা বের করতে মুশকিল হচ্ছে। খুব কষ্টে পা টিপে টিপে এগিয়ে আসছিল সে৷ রুদ একটি কাজে ঘরের বাইরে যেতে উদ্যত হয়েছে। এমন সময় হৈমীর মৃদু আর্তনাদ ‘না’! শুনতে পেল। চমকে ওঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে যা দেখল এতে তার ছোটোখাটো এট্যাক হলো।
হৈমীর পরিহিত সাদা ট্রাউজার খুলে নিচে পড়ে গেছে। হাঁটু থেকে গোড়ালি অবধি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হাঁটুর একটু উপরে ধবধবে ঊরুর একটু অংশও দৃশ্যমান। হতভম্ব, আতঙ্কিত হৈমী লজ্জিত হয়ে কী করবে বুঝে ওঠতে না পেরে লম্বা টিশার্ট নিচের দিকে টেনে হাঁটু মুড়িয়ে বসে পড়ল। কাঁদো কাঁদো মুখে একবার তাকাল রুদ্রর দিকে আবার তাকাল নিজের করুণ অবস্থার দিকে। এহেন দৃশ্য দেখে আকস্মাৎ রুদ্রর যেন কী হয়ে গেল। সে বাম হাত বুকে ভাঁজ করে ডানহাতে চোখজোড়া চেপে ধরে উচ্চশব্দে হেসে ওঠল। ক্রমেই তার হাসির মাত্রা এতটা বেড়ে গেল যে হাসির শব্দেই হৈমীর হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল রুদ্রর। বুঝবান হবার পর থেকে এভাবে কোনোদিন হাসেনি সে। এ প্রথম নিজের এমন হাসি পাওয়া দেখে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেল। অনেক সময় পর তার হাসি থামল। বেচারি হৈমী তীব্র লজ্জায় ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে আরম্ভ করেছে। মনে মনে হাজারবার রুদ্র সম্পর্কে মন্তব্য করেছে,
-” লোকটা কত খারাপ, কত নির্দয়! ”
#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৬
ভোরবেলা মাহেরকে ডেকে তুলল সূচনা। চোখ দু’টো খুললেও ওঠে বসল না মাহের। তাই সে নম্র সুরে বলল,
-” আজ আপনার ফার্স্ট ক্লাস আছে না? ”
মাথা নাড়াল মাহের। ধীরেসুস্থে ওঠে বসে চিন্তান্বিত কণ্ঠে বলল,
-” সূচনা কয়েকমাস পরই হৈমীর এইচএসসি। আপনি রুদ্রর সাথে কথা বলে ওর বইপত্রগুলো পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। ”
ইস! বড্ড মায়া হলো সূচনার। মানুষটা বোনকে নিয়ে কতটা দুঃশ্চিতায় ভুগছে। ঘুম ভাঙতেই বোনকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা। সে ভরসা দিল বলল,
-” আপনি চিন্তা করবেন না আমি ভাইয়াকে ফোন দিব আজ। সব খবর নিয়ে, কথা বলে আপনাকে জানাব। এবার ওঠুন আমি কফি বানাই গিয়ে। ”
রান্নাঘরে যেতেই দেখল হামিদা সবজি কাটছে। সূচনা অবাক হয়ে বলল,
-” একি মা আপনি ওঠেছেন কেন? আপনার শরীর খারাপ রেস্ট করুন আমি সব করে নিব। ”
হামিদা নিজের মতোই সবজি কাটতে লাগল। সূচনার কণ্ঠ তার কর্ণকুহরে পৌঁছেছে কিনা বোঝা গেল না। সূচনা কয়েক পল সময় চুপচাপ শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। দুরুদুরু বুকে চাপা নিশ্বাস ফেলে মাহেরের জন্য কফি বানিয়ে বলল,
-” উনাকে কফি দিয়ে আসছি আমি। ”
মাহেরকে কফি দিয়ে সূচনা এলো রান্নাঘরে। হামিদা সবজি কেটে ধুয়ে এক বাটি মাছের টুকরায় লবণ ছিটাল। সূচনা পাশে দাঁড়িয়ে নরম সুরে বলল,
-” মা আপনাকে চা করে দিই? আপনি খান রান্নাটা আমি করে ফেলি। ”
বিয়ের পর থেকে বেশিরভাগ সূচনাই রান্না করে। যেহেতু আজ ভার্সিটিতে তার ক্লাস নেই সেহেতু তারই করার কথা। কিন্তু হামিদা তার সাথে না কথা বলল আর না কোনো কাজে হাত লাগাতে দিল। সূচনা তবুও সরলো না, শাশুড়ির পাশে দাঁড়িয়েই ওটা, সেটা এগিয়ে দিতে লাগল। এক পর্যায় বিরক্ত হয়ে হামিদা বলল,
-” তোমার উপস্থিতিতে আমি খুশি নই বুঝতে পারছ না? ”
আর কিছু বলতে হলো না। চোখদুটো টলমল হয়ে বুক ভার হয়ে গেল সূচনার। ধীরেধীরে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো সে। চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ওড়নার কোণা দিয়ে সে অশ্রু মুছে মাথা নিচু করে রুমে গেল সে। মাহের তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল মুছতে ব্যস্ত। সদ্যই গোসল সেরে এসেছে সে। সূচনার এ সময় রান্নাঘরে ভীষণ রকম ব্যস্ত থাকার কথা। তাই তার উপস্থিতি দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল মাহের। বলল,
-” ফিরে এলেন যে? ”
সূচনা জোরপূর্বক হাসি টেনে অযথা বিছানা ঠিক করতে করতে বলল,
-” মা রান্না করছে। ”
তোয়ালে রেখে সেন্ডো গেঞ্জি পড়ল মাহের। সূচনার দিকে সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে এগিয়ে এলো। বলল,
-” মায়ের শরীর খারাপ সূচনা, আপনি তাকে রেস্ট করতে বলুন গিয়ে। ”
মাথা নিচু করে জবাব দিল সূচনা,
-” বলেছিলাম। ”
-” শোনেনি? একে নিয়ে আর পারি না আপনি যান হেল্প করুন। ”
মাহের কাভার্ড থেকে শার্ট বের করতে উদ্যত হয়ে আবার পিছনে তাকাল। নত মাথায় ঠাঁই বসে সূচনা। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বলল,
-” আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন না? ”
ভিতরের কান্না গুলো হঠাৎই ওগরে দিল সূচনা। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেঁদে দিল সে। মেয়েটা ভীষণ নরম প্রকৃতির। শান্তশিষ্ট, নরম এবং সুন্দর মনের মানুষ সে। সারাজীবন কাছের সবার থেকে স্পেশাল একটা যত্ন পেয়েছে। যত্নটা বেশি হওয়ার কারণ সে মা হারা মেয়ে। জীবনে কখনো মায়ের ভালোবাসা পায়নি। তাই সবাই একটু বেশি আদর, ভালোবাসা দিয়েছে তাকে। এই শাশুড়ি মা, সে কি শুধু শাশুড়ি নাকি? সে তো তার মা। বিয়ে করে এ বাড়ি আসার পর থেকে এ মায়েরও কম ভালোবাসা পায়নি। এই মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার লোভেই তো সর্বপ্রথম এই বিয়েটায় রাজি হয়েছিল সে। মাহেরের মতো চমৎকার মানুষটার সঙ্গে তো অনেক করে পরিচয় ঘটেছে। আজ হঠাৎ সেই মায়ের অযত্ন মাখা আচরণ পেয়ে হজম করতে কষ্ট হয় না বুঝি? হচ্ছে তো ভীষণ কষ্ট৷ এই কষ্টের কথা কীভাবে বলবে মাহেরকে?
আচমকা সূচনায় কান্নায় হতভম্ব হয়ে গেল মাহের। পাশে বসে আহত চোখে তাকাল সে। বলল,
-” কী হয়েছে সূচনা? আপনি ঠিক আছেন? দেখি এদিকে ঘুরুন, অ্যাই মেয়ে কী হয়েছে বলুন আমায়। ”
দু’হাতে সূচনার কাঁধ ধরে নিজের দিকে ঘুরালো মাহের। সূচনা সহসা কান্না থামিয়ে দিল। মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” কিছু হয়নি কিছু হয়নি। ”
দু’হাতে চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল সে। কিন্তু পারল না ক্ষণেই চোখ দুটো লাল হয়ে টলমল। মাহের রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। দু’হাতের আঁজলে সূচনার কোমল গালদ্বয় চেপে ধরে দৃঢ়স্বরে প্রশ্ন করল,
-” কী হয়েছে? মা কিছু বলেছে? ”
সূচনা সমানে মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” না না। ”
-” সত্যি বলবেন নাকি মা’কে গিয়ে জিজ্ঞেস করব কিছু বলেছে কিনা? ”
আঁতকে ওঠল সূচনা। ঘনঘন মাথা নেড়ে বলল,
-” প্লিজ না। ”
মাহের আদুরে ঠোঁটে সূচনার ললাট ছুঁয়ে দিল। বলল,
-” তাহলে আপনার এই কান্নার কারণটা শেয়ার করুন। ”
-” মা মনে হয় আমার ওপর একটু রেগে আছে। ”
মৃদু হাসল মাহের। বলল,
-” তা আছে কিন্তু বিনাদোষে। ”
সূচনা নিশ্চুপ হয়ে মাথা নত করে বসে রইল। মাহের পুনরায় তার গালদুটো আগলে ধরে বলল,
-” কী বলল? ”
-” আমার উপস্থিতি সে সহ্য করতে পারছে না। ”
ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকালো সূচনা। মাহেরের প্রচণ্ড খারাপ লাগল এবার। কোনো মানে হয়? এই মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ? দু’হাতের বুড়ো আঙুলে চোয়াল বেয়ে চলা অশ্রু মুছে মাহের বলল,
-” রাগ করে বলেছে সত্যি সত্যি বলেনি। মেয়ের রাগ ছেলে বউয়ের ওপর দেখাচ্ছে। আপনি এটা নিয়ে কাঁদবেন না প্লিজ। ”
-” যদি আমায় বাড়ি থেকে চলে যেতে বলে উনি তো আমায় সহ্য করতে পারছেন না। ”
অবাক হয়ে মাহের বলল,
-” আশ্চর্য এটা বলবে কেন? আরে বাবা বউ আপনি আমার। বেশি ভাবছেন সেরকম কিছুই বলবে না। ভয় পাচ্ছেন কেন? ”
শেষ প্রশ্নটা করে হেসে ফেলল মাহের। ওঠে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকে বলল,
-” মাঝে মাঝে আপনি সত্যি বাচ্চা হয়ে যান একদম অবুঝ। ”
অভিমানী মুখে সূচনা ওঠে দাঁড়াল। কাভার্ডের দিকে এগিয়ে গিয়ে কপাট খুলে মাহেরের জন্য শার্ট, কোট বের করে বিছানায় রাখল। মাহের তার কার্যকলাপ দেখে স্থির হয়ে বলল,
-” কী এত ভাবছেন বলুন তো? মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কী যেন গভীর চিন্তা। ”
-” কিছু না। ”
ম্লান মুখে কথাটা বলে তাকে পাশ ফিরাতে চাইল সূচনা৷ কিন্তু মাহের চট করে ধরে ফেলল। দু’হাতে কোমর জড়িয়ে মুখোমুখি হলো ওর। সূচনা থতমত খেয়ে গেল। ঢোক গিলে বলল,
-” আমি ঠিক আছি মাহের। ”
-” একদম ঠিক নেই আপনি। কী ভাবছেন বলুন? ”
মুখ ফস্কে সে বলেই ফেলল,
-” আমার খুব ভয় হচ্ছে আপনাদের হারিয়ে ফেলার।”
-” ভয়টা অযথা। আমরা বিয়ের মতো একটা সম্পর্কে জড়িয়ে আছি আপনি এটা বুঝতে পারছেন না কেন। হঠাৎ এত অবুঝতা কেন? মা একটু রাগ দেখিয়েছে তাই? ”
-” জানি না। ”
-” জানতে হবে না। আসুন একটু আদর করে দিই। মন ভালো হয়ে যাবে। সারাদিন বসে আমাদের হারানোর ভয় না করে এই মুহুর্তটুকু অনুভব করবেন।”
কথাগুলো বলতে বলতেই কোমরে চেপে রাখা হাতদুটো সন্তর্পণে ওপরে উঠালো মাহের। একহাতে সূচনার গাল স্পর্শ করে অপরহাতে ঘাড় চেপে ধরল। নিজের পুরুষালি ওষ্ঠজোড়ায় অত্যন্ত দরদি ভাবে কোমল অধর চুম্বন করল। নিমিষেই শিউরে ওঠল সূচনার সর্বাঙ্গ। চোখ বেয়ে পড়ল দুফোঁটা নোনাপানি। যা দেখে মাহেরের স্পর্শন গাঢ় হলো। অদ্ভুত এক অনুভূতিতে আবিষ্ট হয়ে মাহেরের পৃষ্ঠদেশ খামচে ধরল সূচনা।
____________
হৈমীর হাতে একটি নোটপ্যাড আর কলম দিয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছে রুদ্র। বলা হয়েছে নিজের প্রয়োজনীয় যা কিছু আছে সবকিছু লিখতে। একটু পর কেনাকাটা করতে বের হবে সে। সময় দিয়েছিল দশমিনিট। অথচ পঁচিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। তার লেখা শেষ হয়নি। পনেরো মিনিট যখন পার হলো রুদ্র জিজ্ঞেস করেছিল,
-” এত সময় লাগছে কেন? কী এত ভাবছ তাড়াতাড়ি লিখ। ”
হৈমী ভেঙচি কেটে উত্তর দিয়েছে,
-” শুনুন সবকিছুতে তাড়াহুড়ো করবেন না। আমাকে দিয়ে বিয়েটা তাড়াহুড়োয় করেছেন বলে ভেবে বসবেন না আমাকে দিয়ে আপনার জীবনের সবকিছুই তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। ”
চোখ গরম করে চিবিয়ে চিবিয়ে রুদ্র বলল,
-” যতক্ষণ বকবক করছ ততক্ষণে অনেক কিছু লেখা যেত। ”
হৈমী হকচকিয়ে গিয়ে চঞ্চলিত কণ্ঠে বলল,
-” অ্যাই অ্যাই সব সময় মারতে আসবেন এমন ভাব করবেন না। আমি তাড়াহুড়োয় কিছু করতে পারি না। আর দরকারের সময় আমার মাথা কাজ করে না। একটু সময় নিয়ে লিখি। ”
একথা শুনে দাঁতে দাঁত চেপে বিরবির করে রুদ্র বলল,
-” দরকারে মাথা কাজ করবে কেন? অদরকারী সম্পদ তো তুমি। ”
-” কী বললেন আমি কিন্তু শুনেছি। আমি অদরকারী সম্পদ! এত বড়ো অপমান! আপনি জানেন? আমাকে ছাড়া আপনি আব্বু ডাক শুনতে পারবেন না? আমি আপনার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সম্পদ মাথায় রাখবেন। ”
এ পর্যায়ে রুদ্র একটা কঠিন ধমক দিল। ব্যস হড়বড় করে সকল প্রয়োজনীয় জিনিসের নাম পড়ে গেল তার। লিখতেও শুরু করল এক এক করে সবটা।
লেখা শেষে পুরো ফ্ল্যাটে হৈমীকে একা রেখে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে গেল রুদ্র। শুরুতে হৈমী ভয় না পেলেও পরবর্তীতে ভীষণ ভয় পেতে লাগল। তারমধ্য মনে পড়ল রুদ্রর দেয়া সেই শর্তের কথা। রুদ্র তো বাবাই হতে চায় না তাহলে সে কীভাবে প্রয়োজনীয় সম্পদ হবে? রুদ্র বাবা না হলে সে কী করে মা হবে? ছোট্ট বেলা থেকে তার কত শখ মা হবে। সারাজীবন পুতুলদের মা হয়ে, পুতুলকে মেয়ে বানিয়েই কাটিয়ে দিল। এবার তো বিয়ে হয়েছে রক্তে, মাংসে গড়া মানুষদের মা হতেই পারে। রুদ্র যাই বলুক সে পুরুষ মানুষ একবার না একবার ঠিক কাছে আসবে। আর কাছে আসা মানেই তার শর্ত ভাঙা। রুদ্র যদি কাছে এসে তার শর্ত ভাঙে সেও কনসিভ করে রুদ্রর শর্ত ভেঙে দিবে! উফফ দারুণ বুদ্ধি। তাছাড়া টিশার কাছে শুনেছে বিয়ের ক’টা মাস ওর স্বামীও ওকে কাছে টানেনি৷ পরবর্তীতে দিব্যি কাছে টেনে বাচ্চার মা বানিয়ে দিয়েছে। ক’দিন পরই তার কোল আলো করে বাচ্চা আসবে। সকল ভাবনাচিন্তার মাঝেই সে একটি বড়োসড়ো দোয়া করল,
-” হে আল্লাহ টিশার যেন একটা ছেলে হয়। যাতে আমার মেয়েকে ওর ছেলের কাছে বিয়ে দিতে পারি। বেয়াই হয়েছে জামাই, খালাত বোন হবে বেয়ান। ব্যাপারটা খুবই দারুণ। ”
___
সকালে বাইরে থেকে খাবার এনে খাওয়া হয়েছে। দুপুরেও বাইরের খাবার কিনে বাসায় ফিরল রুদ্র। শহরে একজন বিশ্বস্ত কাজের মানুষ পাওয়া খুবই কঠিন। রুদ্রর একজন কাজের মহিলা বা মেয়ে প্রয়োজন। পেয়েছে কয়েকটা কিন্তু বিশ্বস্ত নয়। যেহেতু বিষয়টাতে হৈমী জড়িয়ে সেহেতু বেশ ভেবেচিন্তেই মেয়ে ঠিক করতে হবে। যা হাবাগোবা বউ তার। একে যে কেউ যে কোনো মুহুর্তে কিনে বেচে দিলেও টের পাবে না৷ তাই নো রিস্ক! পনির, ঝিনুক এক গাড়ি ভর্তি কেনাকাটা করে সব ড্রয়িং রুমে রেখে চলে গেল। রুদ্র ফ্রেশ হয়ে হৈমীকে প্রশ্ন করল,
-” তুমি রান্না পারো? ”
হৈমী ভীষণ উৎসুক হয়ে বলল,
-” ভাত পারি, ডিম ভাজি পারি, আর নুডলস, চা, কফিও পারি। ”
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল,
-” এগুলো চার বছরের বাচ্চারাও পারে৷ আমি জিজ্ঞেস করেছি মানুষকে রেঁধে বেড়ে খাওয়ানোর মতো যোগ্যতা তোমার আছে? ”
-” আপনি আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন! ”
বিরক্ত হয়ে রুদ্র রুম থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। বলে গেল,
-” গোসল করে নিজের পোশাক গুলো পরে নাও। কার্টুনের বেশ দ্রুত ছাড়ো! ”
আঁতকে ওঠে হৈমী বলল,
-” আপনি আমাকে কার্টুন বললেন! ”
________
বিকেলের দিকে বেডরুমে হৈমীকে আঁটকে রাখা হলো দু’ঘন্টা। দু’ঘন্টা পর তাকে বদ্ধ ঘর থেকে বের হাওয়ার পারমিশন দিল রুদ্র। হৈমী কতক্ষণ চ্যাঁচামেচি করল, বকাঝকা করল রুদ্রকে। পাশাপাশি ফ্ল্যাট জুড়ে ঘুরাঘুরি করল। এক মিনিটও স্থির হয়ে থাকতে পারে না মেয়েটা। রুদ্র রুমে বসে ফোনে জরুরি কথায় ব্যস্ত। হৈমী তার থেকে খুব একটা পাত্তা এ মুহুর্তে পাচ্ছে না। তাই সেও মহাবিরক্ত হলো। রুম ছেড়ে বেরিয়ে পাশের রুমের খোলা দরজার পানে ক্ষণকাল তাকিয়ে রইল। রজনীগন্ধা ফুলের ঘ্রাণ পাচ্ছে সে। কিন্তু ফুল কি করে এলো? কৌতূহলী হয়ে পাশের রুমটায় পা বাড়াল। আর গিয়ে যা দেখল এতে তার শরীর অদ্ভুত ভাবে কেঁপে ওঠল। হায় হায় এত ফুলশোভিত বিছানা! বাসরঘরের মতো! ও আল্লাহ আজ তার বাসররাত হবে নাকি? হায় হায় হৃৎপিণ্ড তো ছটফটিয়ে ওঠল। সহসা বুকের বা পাশে হাত চেপে ধরল হৈমী। অদ্ভুত এক অনুভূতিতে গলা শুঁকিয়ে গেল তার। ঢোক গিলে বিরবির করে বলল,
-” বেয়াইমশায় থুরি বেয়াই ওরফে স্বামীমশায় আমি কিন্তু একটুও ভয় পাচ্ছি না। ”
#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৭
ড্রয়িংরুমে স্তব্ধীভূত হয়ে বসে আছে হৈমী। ক্ষণে ক্ষণে তার হৃৎযন্ত্রটা লাফিয়ে ওঠছে। এক ছুটে পালিয়ে যেতে মন চাচ্ছে দূরে কোথাও। কিন্তু যাবে কোথায়? তার কি আর কোথাও ঠাঁই হবে? একজন গুমরা মুখো রাক্ষসের বউকে কে ঠাঁই দিবে? তার আম্মু তো বলে দিয়েছে সে তার কাছে মৃত! মা’য়ের বলা এ কথা মনে পড়ে এতক্ষণের হওয়া অনুভূতি মিলিয়ে গেল। মুখটা থমথমে হয়ে গেল আচমকা। বুক ভার হয়ে কান্না পেল খুব। রুদ্র ফোন কানে ড্রয়িংরুমে এসে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল হৈমীর দিকে। ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
-” সূচনার সাথে কথা বলো। ”
সূচনার নাম শুনতেই তড়াক করে ফোনটা নিল সে। কানে দিয়েই একের পর এক প্রশ্ন শুরু করল,
-” ও ভাবি তুমি ফোন দিয়েছ! আম্মু ফোন করতে বলেছে তাই না? আমিত জানি আম্মু আমার ওপর খুব বেশিক্ষণ রেগে থাকতে পারে না। আর ভাইয়া সেও রাতে ঘুমাতে পারেনি তাই না। ইস ভাইয়া যে কী টেনশন করে আমাকে নিয়ে। ও ভাবি তুমি আম্মু আর ভাইয়াকে টেনশন করতে না করে দিও। ও ভাবি তুমি একটু আমার হয়ে সরিও বলে দিও ওদের প্লিজ। ”
-” হৈমী, হৈমী শান্ত হও। আমরা সবাই তোমাকে খুব মিস করছি। তুমি চিন্তা করো না। কেউ তোমার ওপর রেগে নেই। শুধু একটু অভিমান করে আছে এটাও ঠিক হয়ে যাবে। ”
-” তুমি একটু উনাকে বলো আমাকে বাড়ি দিয়ে আসতে। এখানে আমার ভালো লাগছে না, মানুষ নেই, আলো, বাতাস কিছু নেই। উনি যেমন গুমোট এই বাসাটাও গুমোট দম বন্ধ লাগে আমার। ”
-” আচ্ছা আচ্ছা বলব। এবার খুশির খবর শোনো, টিশার ছেলে হয়েছে। মা আর মাহের এখন হসপিটালে। একটু পর মাহের আমাকে নিতে আসবে। টিশা আর বাবুর ছবি তুলে পাঠিয়ে দিব তোমাকে। ”
চোখ বড়ো বড়ো করে লাফিয়ে ওঠল হৈমী। টিশার বাবু হয়েছে! ছেলে বাবু! খুশিতে লাফাতে শুরু করল মেয়েটা। সূচনা বলল,
-” আচ্ছা এবার রাখি তুমি ভালোভাবে থেকো। মন খারাপ করো না এদিকে সব ঠিক আছে। মনে করো তোমরা বিয়ের পর ঢাকা বেড়াতে গিয়েছ কেমন? ”
সূচনা ফোন রেখে দিল। অতিরিক্ত খুশিতে হৈমীর হাত, পা কাঁপছে। রুদ্র ফোন নিতে হাত বাড়ালেও সে ফোন দিল না৷ রুদ্র জোরপূর্বক ফোন নিতে চাইলে যে হাতে ফোন সে হাত পিছনে নিয়ে গেল৷ বাচ্চাদের মতো করে বলল,
-” দিব না৷ বাবুর ছবি দেখব আমি। ”
রুদ্র নিরাশ হয়ে রুমে চলে গেল। কয়েক মিনিট পরই বেজে ওঠল কলিং বেল। হৈমী তখন রুদ্রর ফোন ঘাটতে ব্যস্ত। কলিং বেলের শব্দ পেয়ে রুদ্র বেরিয়ে এসে হৈমীকে আপাদমস্তক দেখল। পরনে সাদা রঙের ল্যাগেন্সের সাথে হালকা গোলাপি কামিজ। গায়ে ওড়না নেই তবে কটি পরা আছে। ফলশ্রুতিতে
চেস্ট স্ট্রাকচার বোঝা যাচ্ছে না। তবুও গম্ভীর স্বরে সে হৈমীকে আদেশ করল,
-” রুমে গিয়ে ওড়না পরো। ”
হৈমী চমকে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্র ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
-” আমার বন্ধু আর তার ওয়াইফ এসেছে। মাথায় ওড়না রাখবে ওদের সামনে। ”
হৈমী বুঝতে পেরে বাধ্য মেয়ের মতো রুমে গেল। রুদ্র তার জন্য এত এত শপিং করেছে সেখানের ওড়নার সংখ্যাই বাইশটা। বাইশটা ওড়না থেকে বেছে বেছে পরিহিত জামার সাথে মিলিয়ে হালকা গোলাপি রঙেরই একটা ওড়না বের করে মাথায় দিল। মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খেল রুদ্রর কোন বন্ধু এসেছে? শুনেছে পনির আর ঝিনুক টাঙ্গাইল রওনা দিয়েছে। তাহলে এই বন্ধু কে? এই প্রশ্নের মাঝে আবার মনে পড়ে গেল পাশের রুমটার কথা! আজ যে তার বাসররাত! পুরো মুখশ্রী ভয়ে থমথম করতে লাগল তার। ডাক পড়ল রুদ্রর,
-” হৈমী বাইরে এসো। ”
ধীরপায়ে রুম থেকে বের হতেই দেখতে পেল পরিচিত মুখ। হ্যাঁ ছেলেটার নাম আবির, রুদ্রর বন্ধু। আবির হাসি হাসি মুখে লম্বা এক সালাম দিল তাকে,
-” আসসালামু আলাইকুম ভাবি। ”
হকচকিয়ে গেল সে। সালাম ফিরিয়ে আবিরের পাশে তাকাতেই অবাক হলো। আবিরের পাশে একটি সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটির পরনে অনেক সুন্দর একটি শাড়ি, হালকা গহনা, হালকা সাজে দারুণ লাগছে। মেয়েটা হাসি হাসি মুখে বলল,
-” কেমন আছো? আমি আদ্রিতা। ”
রুদ্র বলল,
-” আবিরের বউ। ”
পরিচয় পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল হৈমী,
-” ভালো আছি, তুমি কেমন আছো? না মানে আপনি কেমন আছেন? ”
রুদ্র ওদেরকে বসতে ইশারা করল। ওরা বসল। আদ্রিতা শান্ত এবং মিষ্টি গলায় বলল,
-” আমাকে তুমি বলতে পারো সমস্যা নেই। ”
খুশিতে আটখানা হয়ে গেল হৈমী। রুদ্র ওকে চাপা স্বরে বলল,
-” কিচেনে ফল কাটা আছে, ফ্রিজে জুস আছে নিয়ে এসো। ”
হৈমী মাথা নাড়িয়ে গেল। রুদ্র ওদের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল৷ বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও হৈমী এলো না। দেরি হচ্ছে বলে রুদ্র আবিরকে বলল,
-” তোরা কথা বল আমি দেখে আসি। ”
কিচেনে গিয়ে সে দেখল ট্রেতে কয়েকরকম ফল কেটে রাখা। সে ফ্রিজ থেকে জুসের গ্লাসগুলো রাখল। এরপর সেটা হাতে নিতে গিয়ে আবার রেখে দিল। কয়েক পল তাকিয়ে থেকে কি যেন গভীর চিন্তা করল। রুদ্র এসে তাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
-” কী ব্যাপার ইডিয়টের মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? এই সামান্য কাজটুকুও তুমি পারছ না? ”
-” ট্রেটা অনেক ভারী আমি নিতে ভয় পাচ্ছি যদি পড়ে যায়? ”
উদাস গলায় হৈমী কথাটা বলতেই রুদ্র বিরবির করে ওকে বকল। এরপর নিজেই ট্রে হাতে বেরিয়ে গেল৷ পিছন পিছন হৈমীও এলো৷ আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে বলল,
-” অনেক ভারী ছিল, আমি আনতে পারছিলাম না। ”
মুচকি হেসে নিচু স্বরে আদ্রিতা আবিরকে বলল,
-” সো সুইট! এই বাচ্চা টাইপ মেয়েটাকে কথায় পেল রুদ্র ভাইয়া। ”
আবির বলল,
-” বন্ধু আমার এতবছর পর এরে দেখেই পিছলা খাইছে। কিছু তো স্পেশালিটি আছেই। ”
-” তা তো আছেই অমিতাভ বচ্চন আর জয়া বচ্চনের মতোন। ”
_________
ভয়াবহ রকমের ছ্যাঁকা খেয়ে হৈমী স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ, বিরস মুখে রুমে বসে আছে। কারণ কিছুক্ষণ পূর্বেই সে জানতে পেরেছে বাসরঘরটা আবির আর আদ্রিতার৷ বিয়ের ক’টাদিন আদ্রিতার মাস জনিত কারণে আবিরের সঙ্গে বাসর হয়নি। যেহেতু তারা একে অপরের পূর্ব পরিচিত। দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল সেহেতু জোরাজোরির ব্যাপারটাও ছিল না। আনুষ্ঠানিক ঝামেলা শেষ হলো, আদ্রিতাও সুস্থ হয়ে ওঠল। চারদিন পর তার আবার ছুটিও শেষ। দূরে কোথাও হানিমুনেও যেতে পারবে না। তাই রুদ্র তাকে অফার করেছিল ঢাকায় বেড়াতে আসার জন্য । বাসর না হয় ঢাকায় রুদ্রর নিরিবিলি ফ্ল্যাটেই হবে। অফারটি পছন্দ হয় আবিরের। তাছাড়া শুনেছে হৈমী রান্নাবান্না কিছু জানে না। একেবারে ইমম্যাচিওর মেয়েটা। আর আদ্রিতা ম্যাচিওর। তার রান্নার হাতও বেশ ভালো। যদি ক’টাদিন তারা এসে থাকে পাশাপাশি হৈমীকেও আদ্রিতা বড়ো বোন হয়ে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে যায় মন্দ হয় না। তাই দুই বন্ধু মিলে প্ল্যান করেই এতসব আয়োজন করে। সব শুনে হৈমীর মনটা ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেছে। একদিকে যেমন গোপন ভয় কেটেছে অপরদিকে বড়ো দুঃখও পেয়েছে। কারণ টিশার ছেলে হয়েছে অথচ তার মেয়ের খবর নেই! মনে মনে হাসল হৈমী। আসলে সে যতই দুষ্টুমি করুক রুদ্রর সঙ্গে তার বাসর ব্যাপারটা ভাবলই ভয়ে দু, তিনবার মরে যেতে ইচ্ছে করে। চোখ বন্ধ করে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলল সে। মনে মনে কয়েকবার শুকরিয়া জানালো উপরওয়ালাকে। সে রুদ্রকে চায় অবশ্যই চায় কিন্তু একটু রয়েসয়ে। আগে নিজেকে তার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। মানুষটার কঠিন হৃদয়ে একটু মায়া জাগাতে হবে। ভালোবাসা সে তো দু’জনেরই আছে। নেই শুধু মায়া আর বোঝাপড়া।
রুদ্র কাউচে বসে ল্যাপটপে কিছু জরুরি কাজ করছে আর একটু পরপর হৈমীর দিকে তাকাচ্ছে। তার চোখমুখে স্পষ্ট দুষ্টু হাসি খেলা করছে। কারণ হৈমীর মনোভাবনা টের পেয়েছে সে। বাসরঘরটা যে তার ভেবেছিল ঠিক বুঝতে পেরেছে সে। অনেকক্ষণ স্থবির হয়ে বসে থাকার পর রুদ্রর হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকল হৈমী। সূচনা বাবু আর টিশার অনেকগুলো ছবি দিয়েছে। সে ছবিগুলোই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। এমন সময় কারো মৃদু কান্নার শব্দ শুনল! কান খাড়া করতেই বুঝতে পারল পাশের রুম থেকে আসছে শব্দটা। ক্ষণকাল পেরোতেই আবার শব্দটা মিলিয়ে গেল। রুদ্র পরিস্থিতি বুঝে হৈমীর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাল। মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
-” ওদিকে কী? নিজের কাজ করো। ”
হৈমী ভ্রু কুঁচকে তাকাল রুদ্রর দিকে। সে পুনরায় নিজের কাজে মগ্ন হয়েছে। বুঝে অট্যানশন পেতে প্রশ্ন করল,
-” মনে হলো কেউ কাঁদছে। ”
-” ভুল শুনেছ। ”
-” না ভুল শুনিনি ঠিক শুনেছি। ”
ল্যাপটপ অফ করে রুদ্র এগিয়ে এলো বিছানার দিকে। গম্ভীর স্বরে বলল,
-” ওদের ফার্স্ট নাইট আজ আশা করি বাকিটা বোঝাতে হবে না৷ ”
-” ফার্স্ট নাইট হলেই কাঁদতে হবে কেন? এখানে কান্নার কী আছে? ”
ঢং করে প্রশ্নটা করল হৈমী। অথচ সে সবই বুঝতে পারছে৷ বিয়ের পর একটি মেয়ের ফার্স্ট নাইট সম্পর্কে টিশা তাকে ভালোই জ্ঞান দিয়েছে। তবুও রুদ্রর সঙ্গে মশকরা করল সে। তার মশকরাকে অবুঝতা ভেবে অধৈর্য্য হয়ে গেল রুদ্র। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” এসো কান্নার কারণটা তোমাকে প্র্যাক্টিকেলি বোঝাই? ”
লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ল হৈমী। ভীত স্বরে বলল,
-” অ্যাই একদম না। আমাদের মধ্যকার শর্তটা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। ”
রুদ্র বিরবির করে কি যেন বলে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। হৈমী এলোমেলো কিছু ঘুরাঘুরি করল। রুদ্র চোখ বুজে। ঘুমিয়ে গেল নাকি? তার তো ঘুম পাচ্ছে না। সময় কাটাতে রুদ্রর ফোনটা নিল স্ক্রিনে রুদ্রর ছবি ভেসে ওঠতেই সে ছবিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে গুনগুন করে গাইল,
-” আমার হৃদয় একটা আয়না, এই আয়নায় তোমার মুখটি ছাড়া কিছুই দেখা যায় না ”
বদ্ধ চোখ সহসা খুলে থম মেরে তাকিয়ে রইল। বলল,
-” চুপচাপ এসে শুয়ে পড়ো। ”
হৈমী চুপচাপ তার পাশে বসল। বলল,
-” একটা প্রশ্ন করি? ”
ভ্রু কুঁচকে রাশভারি স্বরে রুদ্রর অনুমতি,
-” হুম ”
হৈমী উৎসুক হয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
-” শাবনূর বেশি সুন্দরী নাকি আমি? ”
বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়াল রুদ্র। কিয়ৎকাল তাকিয়ে রইল হৈমীর মুখ পানে। বিছানা থেকে মাপলার ওঠিয়ে গলায় পেঁচিয়ে
ছোট্ট করে নিশ্বাস ছাড়ল। কোনো প্রকার উত্তর না দিয়েই পাশ কাটিয়ে চলে গেল বেলকনিতে। হৈমী মুখভার করে বসে রইল বিছানায়। বিরবির করে আওড়াল,
-” কী একটা যন্ত্রমানব আমার জামাই হলো! একটুও রসকষ নেই, ভাল্লাগে না ধ্যাৎ। ”
নিমিষেই চোখদুটো টলমল। আকস্মাৎ রুদ্রর আগমন। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দীর্ঘাকৃতির শরীরটা ঝুঁকে এলো তার ওপর। হৈমী ঢোক চিপে বিছানায় দু-হাত ভর করে পিছনদিকে কিঞ্চিৎ হেলে গেল। রুদ্রও হৈমীর দু’পাশে দু-হাত ভর করে যতটা সম্ভব ঝুঁকে রইল। বরাবরের কঠিন দৃষ্টিজোড়ায় অন্যরকম ভাব। কী ভীষণ প্রগাঢ়তা ঐ দু’টি ছোটো ছোটো চোখে। হৈমীর হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। সে স্পন্দনকে আরো বেশি কাঁপিয়ে তুলতে রাশভারি কণ্ঠে মাদকতার সুরে বলল,
-” আমি কাকে বিয়ে করেছি? শাবনূর না হৈমী? ”
চোখ বড়ো বড়ো করে কম্পিত কণ্ঠে হৈমী বলল,
-” হৈমী, হৈমীকে। ”
-” তাহলে কে বেশি সুন্দরী হলো? ”
এ পর্যায়ে হৈমীর হাত, পা শিউরে ওঠল। মাথা ভনভন করছে তার। রুদ্র মুহুর্তেই পরিবেশ অন্যরকম করে দিতে বাঁকা হাসল। গলায় ঝুলিয়ে রাখা দুপাশে দুহাত দিয়ে মাপলার টেনে ধরে বলল,
-” যাকে অর্ধাঙ্গিনী করেছি নিশ্চয়ই সে… ”
বাকিটুকু আর বলল না। নিজ দায়িত্বে বুঝে নেয়ার ইঙ্গিত করে পুনরায় বেলকনিতে চলে গেল। ঘুম তারও আসছে না। অদ্ভুত এক অস্থিরতা শরীরের শিরা-উপশিরা বিষিয়ে তুলছে। শ্বাসরোধ হয়ে আসছে। মস্তিষ্ক ওলটপালট হচ্ছে। অনুভূতিরা হয়ে পড়ছে বড্ড বেসামাল।
চলবে…