বেসামাল প্রেম পর্ব – ৪০+৪১+৪২

#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪০
মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে হৈমীর৷ রুদ্র এসব কী লিখেছে, কেন লিখেছে? সেই হিসেব কষতে ব্যস্ত সে। এলোমেলো ভাবে শাড়ি পরেছে৷ একহাতে শাড়ির কুঁচি জড়োসড়ো করে ধরা। অন্যহাতে কাগজের লেখাগুলো বারবার করে পড়ছে। দেনমোহরের এতগুলো টাকা সে কী করবে? এই প্রশ্নটাও মাথায় কিলবিল করছে৷ পরপর সাতবার রুদ্রর লেখাগুলো পরার পর একটা জায়গাতে আটকে গেল সে। যা কিছু হবে সব স্বাভাবিক। কোন হুশিয়ারী এটা, কী হবে? চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠল তার। পেপারগুলো গুছিয়ে নির্দিষ্ট জায়গাতে রাখল। এরপর রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল রুদ্রকে খুঁজতে। কয়েকবার হোঁচট খেয়ে খেয়ে পৌঁছাল ড্রয়িং রুমে। সোফায় বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে রুদ্র। এত কী চিন্তা করছে সে? চিন্তান্বিত রুদ্রের পাশে গিয়ে আলগোছে বসল হৈমী। কয়েক পল নিশ্চুপ থেকে সহসা বলল,

-” আমার দেনমোহর চাইই না। ”

চমকে তাকাল রুদ্র। যেন হুঁশে ফিরল সে৷ মাত্রই বন্ধু আবিরের সঙ্গে ফোনকলে কথার সমাপ্তি দিয়েছে। শেয়ার করেছে নিজের সিদ্ধান্তটির বিষয়ে। আবির তাকে সাপোর্ট করলেও সতর্ক বাণী দিয়েছে, যেন হৈমীকে মানিয়ে নিয়ে সবটা হয়৷ নয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে। আঠারোর ঘরে পা দেয়নি হৈমী। মানসিকতাও বাচ্চাদের থেকে কোনো অংশে কম নয়৷ তাই হুট করেই সব ধরনের কর্তৃত্ব ফলানো উচিৎ নয়৷ অন্তত ফিজিক্যালি এটাচমেন্টের ক্ষেত্রে সমঝোতা অনিবার্য। সে কথা স্মরণ করে চিন্তান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল রুদ্র। হৈমী থতমত খেল তার দৃষ্টি দেখে৷ শাড়ির আঁচল গুছিয়ে ভালোভাবে বসল সে। রুদ্র বলল,

-” এটাই নিয়ম। ”

-” থাকুক নিয়ম অতো গুলো টাকা দিয়ে আমি কী করব? চাইই না আমার। আমার কিচ্ছু চাই না। আমি শুধু আপনার বউ হয়ে থাকতে চাই। আমার যে বউ হয়ে থাকার অনেক শখ৷ সংসার করার অনেক স্বপ্ন।”

-” থাকো। ”

থমকানো সুর রুদ্রর৷ হৈমী কেঁদে ফেলবে এমন করে বলল,

-” তাহলে পাঠিয়ে দিচ্ছেন কেন? ”

-” একেবারে নয়। তোমার পরীক্ষা পর্যন্ত ব্যস। ”

চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠল হৈমীর। বলল,

-” সত্যি? ”

গম্ভীর উত্তর রুদ্রর,

-” হুম। ”

হঠাৎ তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠল হৈমী৷ ধপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল সে৷ বলল,

-” তাহলে এতক্ষণ কেন কাঁদালেন? আপনি খুব খারাপ আমি একেবারেই চলে যাব। ”

বলতে বলতে চলে যেতে উদ্যত হলো সে। অমনি খপ করে হাতটা টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দিল রুদ্র। বলল,

-” এমন ছটফট না করে স্থির হয়ে কিছুক্ষণ বসো। ”

ঠাণ্ডা সুরের ধমকটা একদম বুকে গিয়ে বিঁধল। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে তাকিয়ে রইল হৈমী৷ রুদ্রও তাকাল। সুগভীর সে দৃষ্টিজোড়ায় অদ্ভুত এক অসহায়ত্ব ফুটে ওঠেছে আজ৷ কী বুঝল কে জানে। আকস্মাৎ প্রশ্ন করে বসল,

-” কী হয়েছে? আপনি কি কিছু নিয়ে ভয় পেয়েছেন? মুখটা শুঁকনো লাগছে কেন অমন? ”

দ্বিধায় ভুগছিল রুদ্র। হৈমীর প্রশ্নে কিছুটা স্বস্তি পেল। বলল,

-” জীবনে প্রথমবার ভয় পাচ্ছি আমি। ”

মুখ হা করে হৈমী বলল,

-” ওরে বাবা আপনি ভয়! ওএমজি! আমিত বিশ্বাসই করতে পারছি না। হায় হায় এ কী দিন আসল, আমার জামাইও ভয় পায়। ”

-” শ্যাট আপ! ”

চমকাল হৈমী। বলল,

-” অ্যাঁ নিজে ভয় পাচ্ছেন বলে আমাকেও ভয় দেখাচ্ছেন। আচ্ছা শুনুন, আপনি কেন ভয় পাচ্ছেন? কেউ কি আপনাকে ভয় দেখিয়েছে? আমার আম্মু বা ভাইয়া? ”

গম্ভীর মুখটা নিমিষেই হাস্যজ্জ্বল হয়ে ওঠল৷ হাঁপ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

-” সত্যিই আমার কপালে জুটেছিল একটা। ”

কপট রাগ দেখিয়ে হৈমী বলল,

-” অ্যাঁ ঢং! মনে হয় সেধে এসে জুটেছি? আপনিই তো জুটিয়েছেন৷ তো এটা বলুন যে সত্যিই জুটিয়েছিলাম একটা। ”

হতভম্ব হয়ে গেল রুদ্র। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

-” তুমি কি একটু চুপ থাকবে? আমাকে কিছু বলতে দেবে নাকি থাপড়িয়ে কানের লতি লাল বানাবো কোনটা? ”

আঁতকানো কণ্ঠে হৈমী বলল,

-” বলুন বলুন আমি শুনছি। ”

হৈমী চুপ করার পর রুদ্র কয়েক পল কী যেন ভাবল। এরপর পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল হৈমীর দিকে। আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল,

-” ভালো লাগছে শাড়িতে। ”

খুশিতে হৈমীর মুখটা গদগদ করতে লাগল। রুদ্র পুনরায় বলল,

-” পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি আমার থেকে দূরে থাকবে৷ ওখানে যাওয়ার পর মন পরিবর্তন হয়ে যাবে তাই তো৷ আজ আমাকে ফেলে যেতে চোখের জল ফেলছ কাল নিশ্চয়ই ওখানে ফিরে ভুলে যাবে সব? তুমি খুব ইমম্যাচিওর তোমার দ্বারা এটা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু মাথায় রেখো আমার দ্বারা সব সম্ভব। আর আমি আমার বাবার মতোও নই। ”

হৈমীর কিছুটা রাগ হলো। এভাবে কেন বলছে রুদ্র? বিয়ের পর কি মানুষ বাপের বাড়ি যায় না? আর গেলেই কি মন পরিবর্তন হয়ে যায় নাকি? তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল সে৷ সে চাহনিতে পাত্তা না দিয়ে রুদ্র বলল,

-” আজ আমি তোমাকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করতে চাই। আশা করি তুমিও গ্রহণ করবে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের মনে এক রুদ্রই থাকবে এই প্রতিজ্ঞাও করতে হবে৷ ঠিক যখন প্রতিজ্ঞাটা ভেঙে যাবে তখনই তোমাকে আমি প্রমাণ করে দিব আমি সত্যিই আমার বাবার মতো নই। ”

ঠাণ্ডা স্বরের হুমকি গুলো শুনে হৈমীর গলা শুকিয়ে গেল। ঢোক গিলে বলল,

-” ভুল করার আগেই ভুলের শাস্তি দেবেন বলছেন? ”

রুদ্রর মনে হলো সহসা হৈমী বুদ্ধিমতী হয়ে গেছে। বাঁকা হাসল সে। বলল,

-” গুড। বুঝতে পেরেছ কী বুঝিয়েছি। ভুল করার আগে নয় শাস্তি ভুল করার পরই দিব৷ শুধু জানিয়ে রাখলাম আগে। ”

হৈমীর মুখটা চুপসে গেল৷ মাথা নিচু করে বসে রইল সে। রুদ্র কয়েক পল নিশ্চুপ থাকল। চিন্তা করল, সে কী অনেক বেশি রুড হয়ে বোঝাল? তাদের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে তো? জিজ্ঞেস করল,

-” আমি কী বলেছি বুঝেছ? ”

হৈমী তাকিয়ে রইল তার দিকে। কোনো উত্তর দিল না। তাই সেই বলল,

-” মাহের যখন আমাকে জানাল তোমাকে নিয়ে যেতে চায়। আমি রাজি হইনি। পরবর্তীতে তোমার ভালোর কথা ভেবেই রাজি হয়েছি। তাই গুটিকয়েকটা দিন কক্সবাজারে না কাটিয়ে তোমার সঙ্গে একান্তে এখানেই কাটাতে চাই। দু’জন একসঙ্গে বাঁচব। ঘুরাঘুরি করার সময় অনেক পাবো৷ কিন্তু এই দুদিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সময় আর পাবো না। ”

-” এই দুদিন এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? ”

-” এই উত্তরটা তুমি নিজে নিজেই পেয়ে যাবে। ”
___________
সূচনার মেজাজ বেশ ফুরফুরে। মাঝেসাঝে মুখ জুড়ে লজ্জার আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। তার সেই ফুরফুরে মেজাজ, আর লাজুকতাকে আরো বেশি উপভোগ করতে চাইল মাহের৷ তাই ধবধবে আরামদায়ক বিছানা থেকে এক প্রকার টেনেই তুলল। গায়ের ওপর থাকা সাদা রঙের শীতনিবারণ গাত্রাবরণ বিশেষ সরিয়ে বলল,

-” পরে আরাম করবেন, আসুন আমার সঙ্গে। ”

সূচনা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে নেমে দাঁড়াল। গায়ের ওপর উল চাদর জড়িয়ে মাহের সঙ্গে গিয়ে দাঁড়াল বেলকনিতে। বেলকনির কাঁচের দেয়াল ভেদ করে দৃষ্টিজোড়া চলে গেল সমুদ্র পাড়ে। কৃত্রিম আলোতে যতটুকু দেখল তাতেই মুগ্ধ হয়ে গেল সে৷ বিস্মিত হয়ে চোখ ফেরাল মাহেরের পানে৷ অধর কামড়ে হাসল মাহের। ভ্রু নাচিয়ে শুধালো,

-” আনন্দেঘেরা চোখ দু’টো ভীষণ সুন্দর আপনার। ”

ইস লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিল সে। সমুদ্রের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে রইল সে। আনমনে জিজ্ঞেস করে ফেলল,

-” কখন সকাল হবে? ”

আলতো হাসল মাহের। ধীরেধীরে সূচনার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। নিঃশব্দে জড়িয়ে ধরল স্ত্রীকে৷ চমকে গেল সূচনা। চোখ দুটো রুদ্ধ করে ঠোঁটজোড়া চেপে ধরল সে। রাতের বেলা ঘরে বসে সমুদ্র দর্শন পাশাপাশি প্রিয়জনের নরম আলিঙ্গন। বুকের ভিতরটা উথাল-পাতাল শুরু করে দিল সূচনা। তৃপ্তি ভরে শ্বাস নিল সে। অস্ফুটে বলল,

-” আমায় খুব ভালোবাসুন মাহের। আমি আপনার ভালোবাসার দহনে পুড়ে ছাড়খাড় হতে চাই। ”

নিঃশব্দে হাসল মাহের। নিঃশব্দে সূচনার টপস ভেদ করে শীতল হাতজোড়া ছুঁইয়ে দিল সূচনার উদরে। কম্পিত শরীরে আচমকা সরে গেল সূচনা৷ তীব্র লজ্জায় পালাই পালাই করে একছুটে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল সে৷ মাথা চুলকে মৃদু হাসতে হাসতে পর্দাগুলো মেলে দিল মাহের। এরপর সূচনার কাছে এসে কানে কানে বলল,

-” আমরা হানিমুনে এসেছি৷ লুকোচুরি খেলতে নয়। ”

সহসা ঘুরে তাকে জড়িয়ে ধরল সূচনা৷ বলল,

-” আজ আমরা গল্প করি প্লিজ। ”

নিরাশ চিত্তে মাহের বলল,

-” সে তো সব সময়ই করি। ”

-” আজো করব। আজকের রাতটা আমায় দিন কালকের রাতটা আপনাকে দিব। ”

ভ্রু উঁচু করে মাহের বলল,

-” সিরিয়াসলি? ”

লজ্জায় মুখ লুকাল সূচনা৷ বলল,

-” জানি না। ”
______________
রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। হৈমী বিছানায় চুপচাপ বসে৷ রুদ্র বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। কথা বলছে আবিরের সঙ্গে। আজ বন্ধুর সাথে একটু বেশিই কথা বলছে৷ ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হৈমী। সে কত কষ্ট করে শাড়ি পড়ল৷ বিনিময়ে শুধু ভালো লাগছে। ব্যস আর কিছুই পেল না। কী সব প্যাঁচানো কথা বলল। মনে হলো অনেক কিছুই৷ সেসবের কিছুই তো ঘটল না। নিরাশ হয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল সে। কিছু শাড়ি পরে ঘুমানো কঠিন। সিদ্ধান্ত নিল সেলোয়ার-কামিজ পরে ঘুমাবে৷ তাই ঝটপট কাভার্ড খুলে সেলোয়ার-কামিজ বের করল৷ ফোনে কথা শেষ করে রুদ্র রুমে ঢুকল। হৈমীর মতিগতি বুঝতে পেরে বলল,

-” এগুলো কী করবে? ”

-” পরব ঘুম পাচ্ছে আমার। শাড়ি পরে ঘুমানো যায় না। ”

ভ্রু কুঁচকে ফেলল রুদ্র। চোয়াল শক্ত করে বলল,

-” তুমি চেঞ্জ করবে না রাখো এগুলো। ”

-” কী আশ্চর্য! একশবার চেঞ্জ করব আমি। ”

রুদ্রর মেজাজ খারাপ হতে নিয়েও হলো না। সে ঠান্ডা মাথায় হৈমীর হাত থেকে কাপড় কেড়ে নিল। কাভার্ডে সেগুলো ঠিকভাবে রেখে আচমকা কোলে তুলে নিল মেয়েটাকে। বলল,

-” তুমি বোকা নাকি বোকা হওয়ার ভাণ করো? এত করে বোঝাচ্ছি বুঝছ না কেন? এবার কি সরাসরি খুলে বলতে হবে আজ আমাদের বাসর! শুনেছি হাজব্যন্ডরা বউদের একবার ইশারা করলেই ওরা বুঝে যায়। তুমি মেয়ে ইতিহাস শুনেও বুঝো না। ”

সহসা রুদ্রর এমন কথায় গা শিউরে ওঠল হৈমীর৷ লজ্জায় গায়ের গাল দুটো থমথম৷ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা চোখ দুটো নিমিষেই বন্ধ করে ফেলল। খামচে ধরল রুদ্রর বুকের কাছের টিশার্ট। মিনমিনে সুরে বলল,

-” আমি একটু একটু বুঝেছিলাম কিন্তু… ”

রুদ্র কিন্তুর পরের অংশটুকু শুনতে নারাজ৷ হৈমীও উত্তেজনায় আর বলতে পারল না৷ তার কেমন যেন লাগছে। মাথাটা ভনভন করছে, ক্রমশ নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠছে৷ মৃদু মৃদু কাঁপছে হাত, পা৷ রুদ্র হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল। ধীরপায়ে বিছানার কাছে এগুতে এগুতে বলল,

-” ভয় পেলে? ”

চট করে তাকাল হৈমী৷ রুদ্র তার চোখেতে তাকিয়ে। সে মাথা নাড়িয়ে না সূচক বোঝালো৷ সত্যি সে ভয় পাচ্ছে না৷ শুধু লজ্জা পাচ্ছে। কেমন লজ্জা? লজ্জা পেতেও লজ্জা অনুভব করার মতো লজ্জা। রুদ্র বাঁকা হাসল। মৃদু স্বরে বলল,

-” বাহ খুব সাহসী। তাহলে আমি অযথাই ভয় পাচ্ছি তাই না? ”

-” আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? ”

প্রশ্নটা শুনে থতমত খেল রুদ্র। কিন্তু বলল না কিছুই। নিঃশব্দে ওকে শুইয়ে দিল শুধু। এরপর ধীরেসুস্থে গিয়ে রুমের বাতি নিভিয়ে দিল। নিস্তব্ধ অন্ধকারে আচ্ছন্ন রুমটায় সাবধানতা অবলম্বন করে পৌঁছাল কাঙ্ক্ষিত মানুষটার কাছে। অনুভব করল মানুষটার শরীরের তীব্র কম্পন। যা তার পৌরুষ হৃদয়ে উষ্ণ উন্মাদনার জন্ম দিল। নিস্তব্ধ ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন রুমটা যেন গুমোট ধরে রইল কয়েক পল৷ এরপরই হঠাৎ সেই গুমোট ভেঙে গেল। দু’জোড়া মানব-মানবীর উষ্ণ নিঃশ্বাসের মিলন ক্রিয়ায় ঝংকার তুলল রুমজুড়ে৷ মিলনের সূচনাতে যে সুখ, যে অনুভূতিতে লুটোপুটি খাচ্ছিল হৈমী৷ সহসা সেই অনুভূতি যেন আঁধারে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল৷ রুমজুড়ে দোল খেল হৈমীর ক্রন্দনরত সুর। নখ দ্বারা একের পর এক আঁচড় লাগল রুদ্রর সারা পিঠজুড়ে। এ প্রথমবার হৈমীর দ্বারা শত আঘাত পেয়েও রাগ হলো না তার৷ বরং তৃপ্তিতাই অনুভব করল। সেই সঙ্গে ছটফট করা হৈমীকে কৃতজ্ঞতা সরূপ মোহনীয় স্বরে বলল,

-” আম প্রাউড অফ ইউ মাই জান। থ্যাংকিউ সো মাচ বউ। ”
#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪১
পরপর ছ’বার হাঁচি দিয়ে বুক ব্যথা হচ্ছিল হৈমীর। সাতবারের সময় কফির মগ হাতে রুমে ঢুকল রুদ্র। ছাই রঙা শর্ট প্যান্ট পরা সে৷ গলায় ঝুলছে সাদা তোয়ালে। সদ্য স্নান করা উন্মুক্ত বক্ষে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কালচে লোমগুলো। ধবধবে ফর্সা বুকে নিদারুণ এক সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ। কফির মগে শেষ দু’টো চুমুক দিল। ব্যস্তার সঙ্গে। এরপর আধখাওয়া মগটা এগিয়ে দিল হৈমীকে। এরই মাঝে কয়েকবার কাশিও হয়েছে মেয়েটার। তাই সে বলল,

-” এটা নাও। ”

ভোরবেলায় গোসল করাতে কিছুটা চটে আছে হৈমী। কতবার অনুরোধ করল অন্তত সাতটা, আটটার দিক করুক। রুদ্র শোনেনি৷ এখন তার যে ঠাণ্ডা লেগে গেল এর জন্য দায়ী রুদ্রই৷ তাই গায়ের সঙ্গে ভালোভাবে কম্বল জড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল সে। জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল আপনমনে। রুদ্র গিয়ে তার সামনে বসল। কফি এগিয়ে দিয়ে বলল,

-” নিতে বলেছি। ”

এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল হৈমী। রুদ্র মুখের কাছে মগ নিয়ে বলল,

-” হাত বের করতে হবে না৷ এভাবেই খেতে পারো। ”

চট করে চোখ তুলে আবার দৃষ্টি নত করে ফেলল সে। রুদ্র বাঁকা হেসে ঠোঁটের সঙ্গে মগ ছোঁয়াল৷ খুব একটা এনার্জি না থাকায় অবাধ্যতা করল না হৈমী৷ চুপচাপ বাকি অর্ধেক কফি খেল সে। রুদ্র জিজ্ঞেস করল,

-” কেমন ফিল করছ? আর ইউ ওকে? ”

উত্তর দিল না হৈমী। নিঃশব্দে হাঁটুতে থুতনি ভর করে বসে রইল৷ রুদ্র টের পেল তার লজ্জা, অস্বস্তি, কিঞ্চিৎ অভিমান। চোখ পড়ল ভেজা চুলগুলোতেও। যা তার ধবধবে সাদা বিছানা, কম্বল অনেকটাই ভিজিয়ে দিয়েছে। তাই নিজের গলায় থাকা তোয়ালে এগিয়ে দিল। বলল,

-” চুলের পানিতে বিছানা ভিজছে। চুলগুলো ভালোভাবে মুছে নাও। ”

সাড়া দিল না হৈমী৷ যেন সে শুনতেই পায়নি কিছু। রুদ্র আশ্চর্য হয়ে বসে রইল। এটাত বিপদ ঘটল। এই মেয়ে কথা বলে না কেন? তৎক্ষনাৎ সে মনে করার চেষ্টা করল শেষ কখন কথা বলেছিল হৈমী? আর কী কথা বলেছিল? তার মন, মস্তিষ্ক দু’টোই চলে গেল গভীর রাতে। নিবিড় আলিঙ্গনের মুহুর্তটুকুতে। সেই মুহুর্তে হৈমী কথায়, বাঁধায় এক বিন্দু গুরুত্বও সে দেয়নি। সত্যি বলতে দিতে পারেনি। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউকে আচমকা থামিয়ে দিতে পারেনি। ঐ ছোট্ট, নরম দেহের মাঝে খুঁজে নিয়েছিল তার পৌরুষ সত্ত্বার সমস্ত সুখ। বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল সে।
তাদের দুজনার বৈবাহিক সম্পর্কের পরিপূর্ণ রূপ দিতে। বেসামাল হয়ে ওঠেছিল সেই ঘনীভূত মুহুর্তটায়। শরীর জুড়ে কেবল চলছিল উত্তাল প্রেম। যেই প্রেমের উত্তাপে পুড়তে পুড়তে অসহনীয় হয়ে ওঠেছিল মেয়েটা৷ বেসামাল তাকে সামলে ওঠতে গিয়ে নিজেও হয়ে পড়েছিল পুরোদস্তুর বেসামাল।

রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল রুদ্র। নিজ উদ্যেগে হৈমীর চুলগুলোতে তোয়ালে পেঁচিয়ে দিল। বলল,

-” ঠিকঠাক ভাবে মুছে নাও। রিতুকে আসতে নিষেধ করে দিয়েছি আজ৷ ওর আসার প্রয়োজন নেই। তোমাকেও কিছু করতে হবে না। সাদা ভাত, ডিম পোজ দিয়ে সকালটা মানিয়ে নিই। দুপুরবেলা বাইরে থেকে খাবার আনাব। ”

খাওয়ার একদম রুচি নেই হৈমীর। তবুও রুদ্রর জন্য সাদা ভাত, ডিম পোজ করতে হবে ভেবে ওঠতে উদ্যত হলো সে৷ রুদ্র তার শারীরিক কন্ডিশন টের পেয়ে বাঁধা দিল। রুক্ষতা বর্জন করে স্বাভাবিক স্বরেই বলল,

-” তোমাকে কিছু করতে হবে না। আজকের জন্য আমি ম্যানেজ করে নিতে পারব। ”

সাতটার মধ্যেই ভাত, ডিম পোজ নিয়ে রুমে হাজির হলো রুদ্র। হৈমীকে বলল,

-” হাতটা ধুয়ে এসো৷ এখানে বসেই খাব। ”

কথা মতোন হৈমী ধীরেসুস্থে ওঠে দাঁড়াল। শরীরে একদম বল নেই তার। হঠাৎই কেন যেন ভীষণ কান্না পাচ্ছে খুব কষ্টে কান্না সংবরণ করল সে। পরনে তার লেডিস টিশার্ট আর প্লাজু। রুদ্র একবার তাকিয়ে দেখল তাকে। সম্মুখের এই পিচ্চি মেয়েটা তার বউ৷ গতরাতে এইটুকুন পিচ্চির সঙ্গে বাসর সেরে ফেলেছে। মনে মনে হাসল সে। ভাবল, পিচ্চিটাকে এবার বড়ো করতে হবে, আধপাগলাটে বউটাকে এবার মানুষ বানাতে হবে৷ শুধু একটাই প্রার্থনা তার মাথাটা যেন ঠান্ডা থাকে সুস্থ, স্বাভাবিক থাকে। সকল দুঃস্বপ্ন যেন সুস্বপ্ন হয়ে ধরা দেয়।

দুজনে আজ একসঙ্গে, এক প্লেটেই খাবার খেল। সে শুনেছে এতে স্বামী -স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা বাড়ে। সম্পর্কে গভীরতা সৃষ্টি হয়, সম্পর্ক মজবুত হয়৷ খাওয়া শেষে রুদ্র দু’টো টেবলেট সামনে ধরে গ্লাস এগিয়ে দিল হৈমীর। চুল আঁচড়াচ্ছিল হৈমী৷ সে জানত এমন একটা পরিস্থিতি তার আসবেই আসবে। তবুও অবুঝের মতো তাকিয়ে রইল। রুদ্র বলল,

-” একটা ব্যথার আরেকটা… ”

বাকিটুকু বলতে পারল না সে। কিন্তু হৈমী ঠিকি এবার কথা বলল,

-” এটা বার্থ কন্ট্রোল টেবলেট তাই তো? ”

কথাটা রুদ্রের বুকে অস্বস্তির তীর হিসেবে বিঁধল। চোখ, মুখ দৃঢ় করে সে উত্তর দিল,

-” হ্যাঁ। ”

-” সরি, আমি একটা ওষুধও খাব না। প্রয়োজন নেই। একদম ঠিক আছি আমি। ”

রুদ্রর মনে হলো হৈমী আচমকাই অনেক বেশি ম্যাচিওরড হয়ে গেল৷ তার কথা, মুখোভঙ্গি সেটা তীব্র ভাবে মনে করিয়ে দিল তাকে। সে দৃঢ়স্বরে বলল,

-” কথা না বাড়িয়ে ওষুধগুলো খাও। ”

-” আপনি শর্ত ভুললেও আমি ভুলিনি। শর্ত আপনি ভেঙেছেন আমিও ভাঙব। ”

শক্ত জবাব হৈমীর। সহসা রুদ্র অস্থির হয়ে ওঠল। সামান্য ক্রোধে তার চোয়াল দৃঢ় হলো। শক্ত চোখে তাকিয়ে পুনরায় ঠাণ্ডা মেজাজে বলল,

-” হৈমী আমায় রাগিও না। ”

হৈমী সরে গেল তার পাশ থেকে। গিয়ে বসল ডিভানে। তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলল,

-” আপনিও আমাকে রাগাবেন না। ”

রুদ্র ঘনঘন শ্বাস নিল। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করল প্রাণপণে। ওঠে এসে হৈমীর পাশে বসল। নমনীয় স্বরে বলল,

-” বাচ্চামো করছ। ”

-” আমার ভালো লাগছে না প্লিজ। আমার পাশ থেকে সরুন আপনি, আপনাকে এখন আর সহ্যই হচ্ছে না।”

-” সহ্য করতে হবে না শুধু এগুলো খাও। হা করো দেখি। ”

তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল হৈমী। সরে এসে বসল বিছানায়। দু’হাতে মাথা চেপে ধরল সে। বলল,

-” প্লিজ আমার সাথে এমন করবেন না। ”

আশ্চর্য হয়ে ওঠে এলো রুদ্র। সহসা ধমক দিয়ে বলল,

-” এবার সত্যি ফাইজলামি হচ্ছে কিন্তু। ”

-” তাই হলে সারারাত আপনিও আমার সাথে ফাইজলামি করেছেন। ”

অধৈর্য হয়ে পড়ল রুদ্র। মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে গ্লাস রাখল পাশে। হাত বাড়িয়ে হৈমীর মুখের কাছে ওষুধ গুলো নিল। জোরপূর্বক মুখে দেয়ার চেষ্টা করায় হৈমী ছিটকে গেল। বলল,

-” আমি ওষুধ খেতে পারি না৷ বমি হয় আমার প্লিজ। ”

রুদ্র গ্লাস সহ ওঠে দাঁড়াল। সাইট টেবিলে গ্লাস রেখে হৈমীর কাছে এসে জোর পূর্বক মুখে ওষুধ গুলো ঢুকিয়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। গ্লাস নিতে নিতে বলল,

-” নড়বে না, এই কথা শোনো নড়বে না তুমি। ”

বলতে বলতেই পানিটাও খাওয়িয়ে দিল। দূর্ভাগ্যবশত একটা টেবলেট পড়ে গেল বিছানায়। আরেকটা আচমকা গিলে ফেলল হৈমী। রুদ্র খেয়াল করে দেখল, ব্যথার টেবলেটটা পড়ে গেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। রাশভারি স্বরে বলল,

-” সব সময় এত বেশি বোঝো কেন? আমি যা করছি আমাদের ভালোর জন্য করছি। ব্যস আর কিছু না। ”

সহসা মুখ চেপে কেঁদে ওঠল হৈমী। বলল,

-” আপনি একটা সেলফিশ। ”

রুদ্র বিছানা পরিষ্কার করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তীব্র ক্রোধে এবার শব্দ করে কাঁদতে লাগল হৈমী। চিৎকার করে বলল,

-” জোর যার মুল্লুক তার তাই না। আর একবার আমার কাছে আইসেন, খু”ন করে ফেলব। ”

চট করে দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিল রুদ্র। অমায়িক ভাবে হেসে বলল,

-” জোর যার মুল্লুক সব সময় তারই হয় ডার্লিং। এই সত্যিটা মানতে শেখো। ”

হুহু করে কেঁদে হৈমী বলল,

-” আপনি খুব খারাপ, আপনি আমাকে কখনো ভালোবাসতে পারেন না কখনোই না। এটা ভালোবাসাই না। আপনি আমাকে ভালোই বাসেন না। ”

-” ভালোবাসা বিবৃতি করার জিনিস নয়, ভালোবাসা হচ্ছে অনুভূতি। যা একদিনে অনুভব করা যায় না৷ বছরের পর বছর যাবে ধীরেধীরে তুমি বুঝতে পারবে। কোনটাকে ভালোবাসা বলে। ”

কথাগুলো বলে আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না রুদ্র। দরজা লক করে কিছুক্ষণের জন্য বেরিয়ে গেল সে। হৈমী কাঁদতেই থাকল আর বার বার বলতে লাগল,

-” আপনি খুব স্বার্থপর। নিজের বেলায় সব সময় ষোল আনা উশুল করেন। আর আমার বেলায় দুআনাও রাখেন না। ”

চলবে….#বেসামাল_প্রেম
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪২
পড়ন্ত বিকেল৷ সমুদ্র পাড়ে পাশাপাশি হাত ধরে দাঁড়িয়ে সূচনা, মাহের৷ সূচনার পরনে ফিকে হলুদ রঙা ফিনফিনে শাড়ি। কটিদেশ মখমলের ব্লাউজে আবৃত। মাহেরের পরনে সাদা রঙের টি-শার্ট। গোড়ালি থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে জিন্স গোটানো। খালি পায়ে বালুচরে দাঁড়ানো। বালুকাবেলায় নোনাজলের ফেনিল ছাপ স্পষ্ট। থেকে থেকে
সমুদ্রের গর্জন ধেয়ে আসে কিনারে। আছড়ে পড়ে ঢেউ। পড়ন্ত বেলা বিধায় সূর্যটা পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে৷ এইতো কিছু সময়। এরপরই সূর্যাস্ত। বেলা ফুরোনোর সঙ্গে সঙ্গে শীতের তীব্রতা বাড়ছে৷
আকাশে পাখি আকৃতির লেজহীন ঘুড়ি চোখের আড়াল হচ্ছে। দিনভর তেজোদ্দীপ্ত সূর্যটা ম্রিয়মান সমুদ্রের জলে। ওদের আশপাশে অনেক মানুষের ঢল। সকালবেলা একসঙ্গে সূর্যদয়, সারা বিকেল প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ। এরপর পাশাপাশি হাত রেখে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দর্শন। সময়টা দারুণ উপভোগ্য ছিল সূচনা, মাহেরের জন্য৷ সূচনার ইচ্ছে করছিল না সমুদ্র পাড় থেকে ফিরে যেতে। মাহের জোরপূর্বক রিসোর্টে ফিরল। এতে সূচনা ভীষণ মন খারাপ করেছিল৷ মন ভালো হলো প্রিয়তম অর্ধাঙ্গ যখন শীতের কাপড় পরার পর পুনরায় তাকে নিয়ে সমুদ্র পাড়ে এলো৷ রাতে ডিনারের সময়টা বাদে পুরো সময়জুড়েই ওরা সমুদ্র বিলাস করল। ঘড়ির কাঁটা যখন এগারোটা বেজে ঊনষাট মিনিট ঠিক সে সময় আচমকা মাহের কোলে তুলে নিল সূচনাকে। উপস্থিত সকলের সম্মুখে, কনকনে শীতের রাতে, সমুদ্র পাড়ে প্রিয়তমাকে নিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠল সে৷ এরপর সহসা বালুকায় নামিয়ে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল মাহের। সূচনার একটি হাত আলতো ছুঁয়ে বলল,

-” শুভ জন্মদিন ডিয়ার। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আপনাকে ঘিরে বাঁচতে চাই। আই লাভ ইউ সো মাচ৷”

প্রেমময় বুলি আওড়ে সহসা হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেল। ধীরেধীরে ওঠে দাঁড়িয়ে সূচনাকে নিজের সামনে পিছমুখী হয়ে দাঁড় করাল৷ ঝটপট পকেট থেকে বের করল লকেট সহ একটি গোল্ডের নেকলেস৷ সেটি পরিয়ে দেয়ার পূর্বে লকেট ওপেন করে দেখাল একপাশে তাদের দু’জনে বিয়ের ছবি। সূচনার চোখ দুটি আনন্দাশ্রুতে ছলছল। বুকে চলছে তীব্র উত্তেজনা। অতি সুখে পাগলপ্রায় সে। হাত, পা কাঁপছে তার। ভালোবাসার ভারে শরীর ঢলে পড়তে চাইছে তার৷ নিজেকে প্রাণপ্রণে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল সে৷ মাহের সন্তর্পণে হারটা তাকে পরিয়ে দিল। আশপাশে থাকা যারা এই প্রগাঢ় প্রেমের শাক্ষি হলো সকলেই হাত তালি দিল। তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে রইল। শেষে সকলে তাদের বেস্ট উইশেষ জানিয়ে একান্তে সময় কাটাতে স্পেস দিল৷ মাহের সকলের প্রশংসা, শুভকামনা সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করল। পুরোটা সময়ই সূচনা নিশ্চুপ ছিল৷ তার এই নিশ্চুপতাকে প্রগাঢ় করতে সহসা পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরল সে৷ যত্নভরে গ্রীবাদেশে উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে বিগলিতচিত্তে অর্ধাঙ্গীর কম্পিত দেহটা পাঁজা কোল করে নিল। ধীরপায়ে এগুলো রিসোর্টের দিকে৷ সে সময়ই তার স্মরণ হলো, আজকের দিনে সূচনা তার কাছে কী চায় সেটাও জানা হয়নি। রুমে গিয়ে সর্বপ্রথম কাজ জন্মদিন উপলক্ষে বউ তার কাছে কী চায় তা গভীর মনোযোগ সহকারে জানা। যদিও তার বিশ্বাস এই মেয়েটা তেমন কিছুই চাইবে না৷ আর চাইলেও অতি সাধারণ কিছুই হয়তো চাইবে৷ কিন্তু সে খুব করে চায় এই মেয়েটা তার কাছে খুব অসাধারণ কিছু চাক। যা দিতে গিয়ে সে বারকয়েক হোঁচট খাবে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই দিতে পারবে। যা তার মনে এবং সূচনার মনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল।
________
সারাদিন খুব একটা ভালো কাটেনি হৈমীর। মানসিক, শারীরিক উভয় ক্ষেত্রেই তীব্র দুর্বলতায় নেতিয়ে পড়েছে মেয়েটা। হৈমী যতই রাগ করুক, অভিমান করুক রুদ্র পাত্তা দেয়নি৷ সে তার মতো সেবা করেছে বউয়ের৷ দুপুরবেলা খেতে চায়নি বলে জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। রাতের বেলায় যাতে কষ্ট করে রাঁধতে না হয় তাই রাতটাও বাইরের খাবার খেয়েছে দু’জন মিলে৷

ডিনার শেষে অফিসের খবরাখবর নিয়ে হৈমীর কাছে এলো রুদ্র। শতহোক পুরুষ মানুষ তো৷ গতরাতে যে সুখের ঠিকানা সে পেয়েছে সে সুখই তাকে তীব্র ভাবে আকর্ষণ করছিল। চৌম্বকের মতো টানছিল হৈমীর দিকে। আরো একবার তীব্র প্রণয়ের উত্তাল ঢেউয়ে যোগ দিতে মস্তিষ্কে আন্দোলন বেঁধে গেছে তার৷ শরীরে রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভূতিরা টগবগিয়ে ফুটতে শুরু করেছে৷ একবার সেগুলো দমন করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সে৷ অভিমানে স্তব্ধ হৈমীকে ছোঁয়ার চেষ্টা করল গভীর করে৷ কী জানি হঠাৎ কী বুঝে হৈমীও সায় দিল। দ্বিতীয় বারের মতো ঘনিষ্ঠ হতে উদ্যত হলো তার সঙ্গে। রুদ্র যখন উত্তপ্ত শ্বাস ফেলে উষ্ণ স্পর্শে তার দেহ কাঁপিয়ে তুলছিল৷ সেও সতর্কতার সঙ্গে তাকে সাড়া দিচ্ছিল৷ এক পর্যায়ে বলিষ্ঠ কাঁপা কাঁপা কাঁপা হাতটা তার পরিহিত বস্ত্র খুলতে উদ্যত হলো। পৃথিবীর আর কেউ রুদ্রকে এইরূপে হয়তো দেখেনি৷ হৈমী দেখেছে৷ রুদ্রর মতো কঠিন হৃদয়ের মানুষটারও হাত কাঁপে, গলা শুঁকিয়ে যায়। যা খুব গভীর হয়ে অনুভব করেছে শুধুই হৈমী। শুধু বুঝতে পারেনি মানুষটা ভেতরে ভেতরে তার কাছে কতটা দুর্বল। ঘন নিঃশ্বাস, বুকের ভিতর তীব্র উত্তেজনা একপাশে সরিয়ে পৈশাচিক ভাবে কিঞ্চিৎ হাসল হৈমী৷ সাহায্য করল স্বামীকে। পরনের লেডিস টি-শার্ট নিজে থেকেই খুলে দিল সে৷ রুদ্রর কী অতো কিছু খেয়াল করার বা হিসেব করার সময় তখন? সে প্রগাঢ় অনুভূতিতে ভেসে গিয়ে বউকে আদুরে স্পর্শে ভাসাতে চাইল কেবল৷ ছোট্ট নরম বক্ষ বিভাজনে উন্মত্ত ঠোঁটটা ডুবিয়ে দিল সন্তর্পণে। খুঁজে পেল ইহজন্মের সকল সুখ, সকল পূর্ণতা। গতরাতের সেই স্মরণীয় ক্ষণটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠল মুহুর্তেই৷ এক পলক তাকাল বদ্ধ চোখে, কম্পিত ঠোঁটে, বক্ষ তলে পড়ে থাকা হৈমীর পানে। রুমের ঝকঝকে বাতিটা নেভানো হয়নি। আজ আর ওঠে গিয়ে লাইট অফ করার তড় সইল না। ধীরেধীরে হাতটা নামিয়ে নিল উদর থেকে প্লাজুতে৷ অমনি খপ করে তার হাতটা চেপে ধরল হৈমী নিজের নমর হাত দ্বারা। চোখ খুলল বৈদ্যুতিক গতিতে। হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে তার বুকটা৷ সেদিকে তাকাতেই রুদ্রর পৌরুষ চিত্ত দৃঢ় উন্মাদ হয়ে গেল৷ পুনরায় আবারো চেষ্টা করল পরিধেয় শেষ বস্ত্রটুকু খোলার৷ কিন্তু হৈমী হিংস্র বাঘিনীর মতো ওঠে বসার চেষ্টা করল৷ শক্তিতে কুলোচ্ছিল না বলে সহসা রুদ্রর বুকের পাটায় শক্ত করে কামড় বসাল৷ রুদ্র ব্যথায় আহ সূচক শব্দ করে সরে গেল, ছেড়ে দিল তাকে। গায়ের ওপর কম্বল টেনে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে হৈমী মুখ খুলল,

-” একবার শর্ত ভেঙেছেন আপনি কিন্তু আমাকে ভাঙতে দেননি৷ তাই আমিও সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একবার যেই ভুল করেছি সেই ভুল দ্বিতীয় বার করব না। ”

রুদ্রর মন, মস্তিষ্ক জুড়ে ভয়ানক বিস্ফোরণ ঘটে যাওয়া অনুভূতি হলো৷ তার মুখের অবস্থা দেখে কম্বলের নিচে মুখ লুকিয়ে, ঠোঁট চেপে হাসল হৈমী। জোরে জোরে কতক্ষণ শ্বাস নিয়ে মাথা ঠান্ডা করল রুদ্র। আলগোছে কম্বল সরানোর চেষ্টা করল। ডাকল,

-” হৈমী, হৈমী। ”

কী নিরুপায় কণ্ঠস্বর। একমাত্র স্ত্রীর দ্বারাই বোধহয় সম্ভব স্বামীকে এভাবে চরম মাত্রার বেকায়দায় ফেলা। মনে মনে মায়াও হলো আবার আনন্দও পেল৷ মাথা তুলে দেখতে ইচ্ছে করল দা গ্রেট বেচারা রুদ্রকে৷ কিন্তু এখন মজা নেওয়ার সময় নয়। সময়টা খুবই সিরিয়াস। নিজেকে সংযত করল হৈমী। বলল,

-” আমি আপনার কোনো কথা শুনব না৷ এতে যদি আপনি জোর খাঁটিয়ে নিজের চাহিদা পূরণ করেন তাতে আমার সমস্যা নেই। শুধু সারাজীবন মনে রাখব আপনি শুধু খারাপ মানুষই না ভয়াবহ একজন ধ’র্ষ’কও! ”

-” হৈমী!!! ”

উচ্চরবে ধমকে ওঠল রুদ্র। কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে চুপসে গেল হৈমী৷ রুদ্রর কপালের রগ ফুলে ওঠল নিমিষেই। ক্রোধে হাত, পা কাঁপতে শুরু করল অবিরত। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে নিজের গালেই কষিয়ে এক থাপ্পড় বসাল৷ ফুঁসতে ফুঁসতে বিছানা থেকে নেমে চলে গেল রুমের বাইরে৷ দরজাটা তুমুল শব্দে লাগিয়ে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে সেখানেও এক লাত্থি বসাল। ড্রয়িং রুম থেকেও কয়েকটা জিনিস ভাঙচুর হওয়ার শব্দ পাওয়া গেল৷ ভয় হলেও নিজের জেদে অটুট থেকে এক সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল হৈমী৷

ড্রয়িংরুমের এক কোণে বসে সিগারেটের ধোঁয়ায় বুঁদ হয়ে পড়ে রইল রুদ্র। সারারাত নিদ্রাবিহীন কাটিয়ে দিল মানুষটা৷ দুটো চোখ রক্ত লাল। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। যে মেয়েটাকে সে ভালোবেসে আপন করে নিতে চাইল। বউয়ের স্বীকৃতি দিল। নিজের লাইফস্টাইলে অভাবনীয় পরিবর্তন আনল। আজ সেই কিনা তাকে ধ’র্ষ’ক উপাধি দিচ্ছে? তার অধিকারকে ধ’র্ষণের সমতুল্য বলছে? ক্রোধে আবারো নিয়ন্ত্রণ হারাল সে। সহসা জ্বলন্ত সিগারেটটা চেপে ধরল বুকের মাঝখানে। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বুঝে, জ্বলন্ত সিগারেট বুকে চেপে কাটিয়ে দিল পুরো রাত।

পৃথিবীতে এই মানুষ গুলো সবচেয়ে বেশি অসহায়। যারা নিজেকে, নিজের অনুভূতিকে বিশ্লেষণ করে বোঝাতে পারে না৷ ফলশ্রুতিতে তাদের বুকের ভিতর লালিত প্রগাঢ় অনুভূতি, সীমাহীন ভালোবাসা থেকে যায় আড়ালে আবডালে।
___________
রুমে এসে মাহের সূচনাকে জিজ্ঞেস করল,

-” জন্মদিন উপলক্ষে আপনার কী চাই সূচনা? ”

অকপটে জবাব সূচনার,

-” আমাদের সন্তানকে দ্রুত পৃথিবীতে আনতে চাই। খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে বাবা ডাক শোনাতে চাই মাহের। আর আমি হতে চাই মা। দেবেন তো এই উপহারটা? আমার জীবনের সেরা উপহারটা কিন্তু দিতেই হবে আপনাকে। দেরি কিন্তু সহ্য হবে না। ”

বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল মাহের৷ অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,

-” এমন অসাধারণ উপহার কীভাবে চাইলেন আপনি? ”

মাহেরের চোখে চোখ রেখে লাজুক স্বরে সূচনা বলল,

-” অসাধারণ মানুষের কাছে সাধারণ কিছু চেয়ে আমি আর বোকামি করতে রাজি নই মাহের। ”

চলবে….
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
চলবে…

রিচেক দিতে পারলাম না। ভুলগুলোর জন্য দুঃখীত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here