#বৈধ_সম্পর্ক
#সিজন_২
#পর্ব_৭
#Saji_Afroz
.
.
.
মুনিরার কথাটি শুনে সায়নীর বুকে তীরের মতো আঘাত করলো। আসলেই তো, কালই সীমা আক্তার বলেছিলেন মুনিরার মা বাবা আছে। আর আজই এমন একটা অঘটন ঘটে গেলো। মহিলাটির কথা মুনিরাকে বড্ড আঘাত করেছে।
.
আফজাল খান বললেন-
তোমরা দেখো মেয়েটাকে। আমি নিজের রুমে গেলাম। মনটা ভালো নেই।
..
আফজাল খান এগিয়ে যেতেই আফরানের দিকে তাকিয়ে সায়নী বললো-
তোমরা আজই চলে এলে কেনো? না মানে সেনোয়ারা আন্টির পাশে মুনিরার থাকাটা দরকার ছিলো।
.
আফরান কিছু বলার আগেই সায়নীর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মুনিরা বললো-
সেটাও আমার কপালে সইলো না আপু। এই সময়ে আমি আমার মায়ের পাশেও থাকতে পারলাম না। সকলে কথা শোনাচ্ছিলো আমাকে। আমার জন্যই নাকি আব্বা চিন্তা করতে করতে অপারে চলে গিয়েছেন।
এসব শুনে আম্মা আমাকে রাখলেন না তার সাথে। মায়ের দুঃখের সময়েও আমি তার পাশে নেই। এর থেকে অভাগী কেউ আছে দুনিয়াতে!
.
আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো মুনিরা।
মুনিরাকে এমন অবস্থায় কেনো যেনো আর দেখতে ভালো লাগছেনা আফরানের।
নিজের রুমের দিকে হনহনিয়ে এগিয়ে গেলো সে।
.
এদিকে মুনিরাকে নিয়ে সায়নী তার রুমে আসলো।
বিছানার উপরে বসিয়ে তার দুহাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো-
এভাবে কান্নাকাটি না করে আঙ্কেলের জন্য দোয়া কর। ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। কবরে শান্তি পায় মতো দোয়া কর।
.
শান্ত গলায় মুনিরা জবাব দিলো-
হু আপু কবরে শান্তি পাবে। আমার জন্য তো দুনিয়াতে শান্তির মুখ দেখলোনা!
.
.
.
আজ আমার জন্যই মুনিরার এই অবস্থা৷ সেদিন যদি ওকে বিয়েটা না করতাম তাহলে ওর এতো এতো কথা শুনতে হতোনা।
মুনিরার কি আসলেই এসবই প্রাপ্য!
.
নিজের মনে এসব বলে পায়চারী করে চলেছে আফরান।
সায়নী এসে তাকে এমন অস্থির দেখে বললো-
ঠিক আছো তুমি?
-না নেই। আমিই যত নষ্টের মূল। আমার জন্য মুনিরার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেলো। বেচারি কে সবাই এতো কথা শুনায় সে বলতেও পারেনা তার স্বামীর ভালোবাসা পেয়েছে সে। তুমিই বলো সায়নী? ওর এই পরিণতির জন্য আমিই দায়ী তাইনা? এমন একটা মুহুর্তে মায়ের পাশেও থাকতে পারলোনা মেয়েটা।
.
আজ অনেকদিন পর আফরানের চোখে পানি দেখলো সায়নী।
এটা কি অনুশোচনার জন্য নাকি শুধুমাত্র মুনিরার কষ্টের জন্য?
.
আফরানের পাশে এসে তার কাধে হাত রেখে সায়নী বললো-
এখন এসবের সময় নয় আফরান। মুনিরার পাশে থাকার সময় এখন। আমরা নিজেরাই যদি ভেঙ্গে পড়ি মেয়েটা শক্ত হতে পারবে কি?
.
সায়নীকে জড়িয়ে ধরে আফরান বললো-
হুম।
-আমি আজ মুনিরার সাথে থাকবো।
-তোমার নিজের শরীর ঠিক নেই সায়নী।
-এই সময় ওকে আমি একা ছাড়তে পারিনা আফরান। তোমার উপরও কম দখল যায়নি।
-হু।
-হাসিকে বলেছি খাবার তৈরী করতে। সবাই কিছু খেয়ে নিও।
-তুমি খেয়েছো?
-হু।
-সত্যি?
-হু।
-দেখো সায়নী এই সময় তোমার নিজের থেকে নিজেরই খেয়াল রাখতে হবে।
-রাখছি।
.
সায়নীর পেটে হাত দিয়ে আফরান বললো-
যত যাই হয়ে যাক, যে আসতে চলেছে তার যেনো অযত্ন না হয় আর তার মায়েরও।
.
.
.
কারো চাপা কান্নার শব্দে
ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো সায়নীর। মাত্রই চোখটা লেগে এসেছিলো তার।
উঠে বসে পড়লো সায়নী। বারান্দা থেকে ভেসে আসছে এই শব্দটি।
ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো সায়নী সেদিকে।
শাড়ির আঁচল মুখের উপর চেপে রেখে কেঁদে চলেছে মুনিরা।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সায়নী বললো-
চাপা কান্না নয়, প্রাণ খুলে কাঁদ, কাঁদতেই যদি হয়। হালকা লাগবে।
.
এতক্ষণ মুনিরার বকবকানির জন্য সায়নী ঘুমোতে পারেনি।
যেই তার চোখটা লেগে এসেছে মুনিরার নিজেকে একাএকা লাগছিলো। কিন্তু সায়নীর ঘুম ভাঙ্গার ইচ্ছে তার মোটেও নেই। তাই বারান্দায় এসে কান্না লুকোনোর বৃথা চেষ্টা করছিলো সে।
সায়নীর কাছে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলো মুনিরা।
এবার আর সায়নী তাকে আটকালো না।
কাঁদলেই যদি মেয়েটার মন হালকা হয় তাহলে কাঁদুক না সে!
.
.
.
সকাল ১০টা হয়ে গেলো।
সকলে জেগে থাকলেও কাল রাত থেকে মুখে কেউ কিছু নেয়নি।
ড্রয়িং রুমে আফরান বসে আছে তার বাবার সাথে।
সায়নী একটা ট্রে হাতে নিয়ে টেবিলে রেখে বললো-
এবার অন্তত খাও কিছু তোমরা।
.
দুজনেই জবাব দিলো-
ইচ্ছে নেই।
-ওহ তাই! না খেলে সব ঠিক হয়ে যাবে কি?
.
এবার দুজনেই চুপ হয়ে আছে। তাদের এমন নীরব দেখে সায়নী বললো-
ঠিক আছে। খেতে হবেনা কাউকে কিছু। আমিও খাবোনা।
.
ভ্রু জোড়া কুচকে আফরান বললো-
তার মানে তুমিও খাওনি এখনো!
তুমি এসব করবেনা বললাম, খেয়ে নাও।
-আমি এসবই করবো।
.
মৃদু হেসে আফজাল খান ট্রে এর উপর থেকে এক বাটি নুডলস নিয়ে বললেন-
এই মেয়ে বড্ড জেদি আফরান। খেয়ে নে। নাহলে নিজেও খাবেনা।
.
সায়নীর দিকে তাকিয়ে আফরান বললো-
এদিকে আসো। খেয়ে নাও।
-তুমি খাবে বলো আগে।
-হু খাবো।
.
সায়নী পাশে বসতেই আফরান তার দিকে বাটি এগিয়ে দিয়ে বললো-
নাও খাও।
-হু।
-মুনিরা খেয়েছে কিছু?
-না। রুমে রেখে এসেছি খাবার তবুও। কি করবো বলো? মুখে তুলছেই না কিছু। বলছে সে একা থাকতে চায় এখন। কাল আবার পরীক্ষাও আছে৷ এমন করলে পরীক্ষা দেয়ার শক্তি থাকবে মেয়েটার মাঝে!
-হুম।
.
.
দুপুর ২টা….
নিজেদের খাবার শেষে মুনিরার জন্য ভাত নিয়ে তার রুমে আসলো আফরান।
মেঝের উপরে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে মুনিরা।
মাথার চুলগুলো এলোমেলো। শাড়ির আঁচল টাও ঠিক নেই।
মুনিরাকে এমন অবস্থায় দেখে আফরানের সেই আগের কথা মনে পড়ে গেলো।
যেদিন অসাবধানতা বশত মুনিরার আঁচলটা সরে গিয়েছিলো আর আফরান তাকে বলেছিলো, শাড়ির আঁচল ঠিক করো। বেহায়ার মতো আমাকে শরীর দেখানোর প্রয়োজন নেই।
.
ইশ! কি কড়া কথাটায় না শুনিয়েছিলো সে মুনিরাকে।
.
মুনিরার পাশে বসে মেঝের এক পাশে প্লেট টা রাখলো আফরান।
নিজে তার আঁচল টা ঠিক করে দিলো।
আশেপাশে তাকিয়ে চিরুনী খুঁজতে লাগলো সে।
ড্রেসিং টেবিলের উপরে চোখ পড়তেই উঠে দাঁড়ালো আফরান।
চিরুনীটা হাতে নিয়ে আবারো মুনিরার পাশে বসে পড়লো সে।
-এই যে? বিছানার সাথে লেগে না থেকে মাথাটা আমার দিকে করো দেখি?
.
মুনিরা চুপচাপ তাই করলো।
আফরান সুন্দরভাবে তার চুলগুলো আছড়িয়ে দিলো।
তারপর তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো-
কিছু কথা বলি শোন৷ জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এই তিনটি আল্লাহ নির্ধারণ করে জানোই তো। তোমার বাবার হায়াত শেষ হয়ে গিয়েছে তাই আল্লাহ তাকে তুলে নিয়েছেন। এতে তোমার কোনো দোষ নেই। তাই নিজেকে দোষারোপ না করে দোয়া করো উনার জন্য। বুঝেছো?
-হু।
-আর কাল তোমার পরীক্ষা আছে। তোমার খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম করলে কি চলবে বলো?
না খেলে পড়ার জন্য শক্তি পাবে? আর না পড়লে পরীক্ষায় কি দিবে? পড়তে হবেনা?
-হু।
-এই তো ভালো মেয়ে। এবার খেয়ে নাও ভাত।
.
শান্ত গলায় মুনিরা বললো-
মন খারাপ থাকলে বাবা ভাত খাইয়ে দিতো। আজ আপনি কি আমাকে খাইয়ে দিবেন প্লিজ।
.
কোনো কিছু না ভেবেই মুনিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আফরান বললো-
হুম। হাত ধুয়ে আসছি আমি।
.
.
.
রাত হলে সায়নীর যেনো অস্থিরতা বেড়ে যায়।
চারমাসও হয়নি সে প্রেগন্যান্ট। এখন থেকেই এমন হলে সামনে আরো কি হবে ভাবতেই আরো খারাপ লেগে উঠে সায়নীর।
মুনিরাকে পড়িয়ে আফরান সায়নীর রুমে আসলো।
সায়নীর চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ দেখে আফরান বললো-
খারাপ লাগছে?
-হু। ঘুমের দরকার ভীষণ।
-তোমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে সায়নী। এমন হলে তো সমস্যা।
দেখি, চুপচাও ঘুমাও।
-কিন্তু মুনিরা?
-আমি খেয়াল রাখবো। তোমার মাঝে আরেকজন আছে এটাও ভুলে গেলে চলবেনা তোমার।
-হু।
.
সায়নী শুয়ে পড়লে আফরান তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
নিমিষেই ঘুমিয়ে পড়লো সায়নী।
.
আফরান বসে পড়লো তার ল্যাপটপ নিয়ে। অফিসের অনেক কাজ জমা পড়ে যাচ্ছে।
.
.
মায়ের নাম্বার ডায়েল করে ফোন দিলো মুনিরা।
একবার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ করে বললো-
হ্যালো?
-আম্মা ঠিক আছো তুমি?
-আর ঠিক রে মা! মনে হচ্ছে তোর আব্বা আমাকেও ডাকছে।
-এসব কি বলছো আম্মা তুমি! এসব বলতে নেই।
-মনে শান্তি নাইরে মা শান্তি নাই।
তোর বাবার সাথে আমাকে কেনো নিয়ে গেলোনা আল্লাহ!
-আম্মা! এসব বললে আমি আর কথা বলবোনা তোমার সাথে।
-কথা! এই সময় আমার পাশে থাকার কথা তোর। কিন্তু দেখ কেমন পোড়া কপাল। বাপ মাটিতে ঢোকার সাথে সাথেই তোকেও চলে যেতে হলো। আর কতো দুঃখ সইতে হবে বলতে পারিস আমাদের?
.
এপর্যায়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো মুনিরা। তার কান্নার শব্দ পেয়ে সেনোয়ারাও কাঁদতে থাকলেন।
.
.
হাতের কাজ শেষে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত দুটো বাজে।
সায়নী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
কিন্তু মুনিরার কি অবস্থা?
একবার দেখে আসা যাক।
ভেবেই আফরান এগুলো মুনিরার রুমের দিকে।
বিছানার উপরে বসে বই হাতে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে মুনিরা।
চোখ বেয়ে পড়ছে অঝর ধারায় পানি।
আফরান তার পাশে এসে বললো-
আর পড়তে হবেনা ঘুমাও।
.
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মুনিরা বললো-
আমার কিছু মনে থাকছেনা।
-লেখার সময় মনে পড়ে যাবে।
-আমি পারবোনা কিছু।
-পারবে তুমি।
-আব্বার মুখটা ভেসে আসছে চোখে বারবার। আর আম্মার কথা খুব মনে পড়ছে। আম্মার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে খুব বেশি। কিন্তু পোড়া কপাল, যেতেই পারবোনা আমি।
.
মুনিরার পাশে বসে আফরান বললো-
তোমার আম্মাকে নিয়ে তো আসতে পারবো। কি বলো?
.
ছলছল নয়নে আফরানের দিকে তাকিয়ে মুনিরা বললো-
সত্যি?
-হুম সত্যি। এবার ঘুমাও।
.
অনেকটা সংকোচ করে আফরানের কাছে মুনিরা আবদার করে বসলো-
আমি কি আপনার কোলে মাথা রেখে শুতে পারি? আমি ঘুমোলে না হয় চলে যাবেন আপনি।
-হুম আসো।
.
এই প্রথম আফরানের কোলে মাথা রেখে শুয়েছে মুনিরা।
আফরান তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।
এতো শান্তি আফরানের মাঝে জানা ছিলোনা মুনিরার। পরম শান্তিতে ধীরেধীরে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো সে।
.
.
সকাল ৬টা…
নিজের ঘুম ভাঙতেই আফরান দেখা পেলো মুনিরার।
মেয়েটা ঘুমিয়ে রয়েছে। তাই সে নিজের কোল থেকে খুব সাবধানে মুনিরার মাথাটা বালিশের উপরে রেখে উঠে পড়লো। এগুলো সায়নীর রুমের দিকে।
সায়নীও গভীর ঘুমে লিপ্ত।
সায়নীর মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রেখেছে অজানা নয় আফরানের।
আফরান তার মোবাইল টি নিয়ে এলার্ম বন্ধ করে দিয়ে এগুলো রান্নাঘরের দিকে।
.
.
৭টার দিকে ঘুম ভাঙলো সায়নীর।
পাশ ফিরে আফরান কে দেখতে না পেয়ে উঠে বসলো সে।
তার ডাকেই আফরানের ঘুম ভাঙ্গে। আজ কি এলার্মের শব্দেই ভেঙ্গে গেলো!
সে কেনো শুনলোনা। আর আফরানই বা কোথায়?
হঠাৎ মনে এলো সায়নীর, সে হয়তো মুনিরার কাছে গিয়েছে।
সায়নী উঠে তার চুলে খোপা করে নিলো।
ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে এগুলো রান্নাঘরের দিকে সকালের নাস্তা তৈরী করার জন্য।
.
রান্নাঘরে এসে আফরানকে দেখতে পেয়ে চমকে গেলো সায়নী।
চোখ জোড়া বড়বড় করে সে বললো-
কি করছো তুমি!
-ওহ তুমি উঠে গিয়েছো। এইতো শেষ আমার।
-কি শেষ?
-খিচুড়ি করেছি তোমাদের জন্য।
-আমাকে বললেই হতো।
-তোমাকে ঘুম থেকে তুলতে ইচ্ছে করেনি। গুটিসুটি হয়ে আরাম করে ঘুমোচ্ছিলে তো।
এখন এদিকে এসো। দেখো খিচুড়ি কেমন হয়েছে।
.
.
আফরান খিচুড়ি রেধেছে শুনে মুনিরার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটলো।
এই প্রথম সে আফরানের হাতে তৈরী খাবার মুখে দিলো।
মুনিরার উদ্দেশ্যে আফরান বললো-
কেমন হয়েছে?
-অনেক বেশি ভালো। আপনি দেখছি ভালো রান্নাও করতে পারেন।
-হু পারি তো।
-জানতাম না।
-ধীরেধীরে সবই জানবে।
.
খাওয়া শেষ হলে আফরান বললো-
যাও মুনিরা তৈরী হয়ে আসো। আজ পরীক্ষার সেন্টারে আমি নিয়ে যাবো তোমাকে।
-ঠিক আছে।
.
মুনিরা এগুতেই আফরানের দিকে তাকিয়ে সায়নী বললো-
নুরুল আঙ্কেল ভালো মানুষ ছিলেন। তার কথা মনে পড়লে আমারো খারাপ লাগে।
.
.
.
১৭দিন পর…..
সকাল সকাল ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো সায়নীর।
পায়চারী করছে সে রুমের মাঝে। তখনি ফোন এলো মিশিকার।
ফোন রিসিভ করতে ওপাশ থেকে বললো-
হ্যালো সায়নী? ভিডিও কলে কথা বলবো। তোকে মিস করছি।
-আচ্ছা অনলাইনে আয়।
.
ল্যাপটপ টা নিয়ে সায়নী ড্রয়িংরুমে চলে আসলো।
তাদের কথার শব্দে আফরানের ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে তাই।
.
সোফার উপর বসে অনলাইনে যেতেই মিশিকার ভিডিও কল আসলো।
-হাই সায়নী? কি অবস্থা তোর?
-ভালো রে। তোর কি অবস্থা?
-এইতো ভালোই। শুনেছি তোদের বাসা ডুপ্লেক্স করার প্লান করছিস?
-হ্যাঁ রে৷ কার থেকে শুনলি?
-আফরান ভাই পাবেলকে বলেছে। তা ডুপ্লেক্স করলে তুই কোথায় থাকবি? উপরে উঠবিনা?
-নারে। আমার এটাই পছন্দ। মূলত বাবার কথাতেই মুনিরার জন্য করা হচ্ছে এটা।
-কেনো রে? মুনিরারও বাচ্চা কাচ্চা হতে চলেছে নাকি? আলাদা হয়ে যাচ্ছিস।
-আলাদা কোথায়! উপর নিচেই তো। আর আফরানের সাথে ওর এমন কিছু এখনো হয়নি।
-তোকে হলেও কি বলবে! তাছাড়া হতে আর কতদিন! বাদ দে, তুই সুস্থ আছিস তো?
-হুম আছি।
-মুনিরা ঠিক আছে?
-আছে।
-মেয়েটার মনটা খারাপ হয়ে থাকতে দিস না। অনেক কান্নাকাটি করে শুনলাম।
-হুম। তবে আফরান ওর খেয়াল রাখে অনেক।
-ডিপ্রেশনের সময় সবসময় কারো পাশে থাকাটা জরুরী। নাহলে মনের উপর এফেক্ট পড়ে। আসলে মেয়েটার কথাও কি বলবো। বেচারী মুনিরা। অল্প বয়সে কত কিছু সহ্য করতে হচ্ছে।
-হুম।
-তোর ছেলে হলে কিন্তু আমার মেয়ের সাথে বিয়ে দেবো তার।
-ঠিক আছে দিস।
.
সায়নীর দিকে তাকিয়ে মুখটা ফ্যাকাসে করে মিশিকা বললো-
তোর জন্য মাঝেমাঝে বড্ড কষ্ট হয়রে আমার। কিভাবে পারছিস এসব সহ্য করতে! ভেবে দেখেছিস? মুনিরা না থাকলে হ্যাপি কাপল হতি তোরা। শুধু শুধুই কাবাবের মাঝে হাড্ডি হয়েছে সে। যদিও ওর ও কোনো দোষ নেই। তবুও তুই যেহেতু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, তোর কথা মনে হলেই খারাপ লাগে।
-ওসব ছাড় এখন। পাবেলের কি অবস্থা বল?
.
.
আড়াল থেকে এতক্ষণ যাবৎ সায়নী ও মিশিকার কথা শুনেছে মুনিরা।
মিশিকার কথার কোনো প্রতিবাদ সায়নী করলোনা কেনো!
তবে কি সায়নীও ভাবে, মুনিরা তাদের মাঝে দেয়াল হয়ে আছে?
আর আফরানের মনে কি আসলেই তার জন্য জায়গা তৈরী হয়নি? তবে এতোদিন যে আফরান তাকে আগলে রেখেছে, খেয়াল রেখেছে এসব কি? শুধুই মানবতা? কিন্তু এসবের জন্য যে সে আরো বেশি দূর্বল হয়ে পড়েছে আফরানের প্রতি।
আফরান কি সেটা বুঝেনা?
এভাবে সারাজীবন আফরানের পাশে থাকতে চায় সে। তবে তার চাওয়া পাওয়ার কি আদৌ মূল্য আছে!
.
.
সায়নী নিজের রুমে এসেই দেখলো আফরান ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়েছে।
সায়নীর দিকে এগিয়ে এসে সে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
আচমকা আফরানকে একটা প্রশ্ন করে বসলো সায়নী-
আচ্ছা আফরান? কখনো যদি আমার আর মুনিরার মাঝে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে বলি, কাকে বেছে নিবে তুমি?
.
সায়নীকে ছেড়ে তার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো আফরান। হাসতে হাসতেই বললো-
সকাল সকাল এমন আজব প্রশ্ন?
-এমনিতেই।
-ফ্রেশ হয়ে নাও।
.
আফরান ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।
সায়নী বিড়বিড় করে বললো-
আগে হলে কোনো কিছু না ভেবেই বলতে তোমাকে বেছে নিবো। এখন তুমি উত্তর টাও দিতে পারলেনা। মুনিরা শেষ অবধি তোমার মনে জায়গা পেয়েই গেলো। আমিও তো এটাই চেয়েছিলাম৷ তবুও আমার খারাপ লাগছে কেনো বলতে পারবে? মাঝেমাঝে মনেহয় মুনিরা না থাকলে তুমি, আমি আর আমাদের বাচ্চাটা কতো না সুখে থাকতাম!
.
.
.
সায়নীর রুমটা খানিকটা দূরে মুনিরার রুমের থেকে। তবে আজ আরো বেশি দূর লাগছে মুনিরার কাছে।
সে যেটা করতে যাচ্ছে এটা ঠিক কিনা জানেনা। তবে সে কারো সুখের সংসার নষ্ট করতে পারেনা৷ আসলেই তো! আফরান তো তাকে মনে জায়গা দিতে পারেনি। তবে এখানে কেনো পড়ে থাকবে সে!
থাক না দুটো ভালোবাসার মানুষ একসাথে। সে নাহয় দূর থেকেই তাদের ভালোবেসে যাবে।
.
রুমের মাঝে এসে সায়নীকে দেখতে পেলো মুনিরা।
সে তার পাশে এসে বললো-
আপু? আমি উনাকে ডির্ভোস দিবো। এবার আর আমাকে আটকাবে না প্লিজ। তোমাদের মাঝে আমি আর দেয়াল হয়ে থাকতে চাইনা। কোনো ক্ষোভ নেই তোমাদের জন্য আমার। আমার কপাল টাই হয়তো খারাপ তাই যেটা সম্ভব না সেটা আশা করে বসে ছিলাম।
.
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেলো মুনিরা।
ছলছল নয়নে সায়নী তাকিয়ে রইলো তার পথের দিকে।
মুনিরা কিভাবে বুঝতে পারলো তার মনে কি চলছে! তার কোনো আচরণে কি….
এ কি করে ফেললো সায়নী! সব কিছু এভাবে ভুলে গেলো সে!
এটা ঠিক করেনি সায়নী।
কিন্তু তারই বা কি করার আছে! তার মনে যে তুফান চলছে সে ছাড়া কেউ বুঝবেনা। এখন কি করা উচিত তার? চলে যেতে দিবে মুনিরাকে? নাকি আটকাবে তাকে? আর আফরান? সেইবা কি করবে? মুনিরার জন্য তার মনেতো জায়গা হয়েই গেলো। উফফ…! আর ভাবতে পারছেনা সায়নী। মাথাটা ভীষণ ধরেছে সায়নীর।
আলনা থেকে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায় সে। মাথাটা ভেজালে হয়তো ভালো লাগবে তার।
.
.
.
রান্নাঘরের দিকে মুনিরাকে এগুতে দেখে ডাক দিলো আফরান।
-কোথায় যাচ্ছো?
-নাস্তা তৈরী করতে।
-ওহ! তাহলে সায়নীকে বলে এসো রেস্ট করতে৷ তুমি বানিয়ে দিচ্ছো।
-ঠিক আছে।
.
আজ কথা বলার সময় আফরানের দিকে তাকালোনা মুনিরা। কষ্ট হচ্ছে তার ভীষণ।
কিভাবে ছেড়ে যাবে সে আফরানকে!
.
.
রুমের কোথাও সায়নীকে না পেয়ে ওয়াশরুমের দরজায় কড়া নাড়লো মুনিরা। কয়েকবার কড়া নাড়ার পরেও ভেতর থেকে কোনো শব্দ পাচ্ছেনা মুনিরা।
আতঙ্কিত স্বরে সে বললো-
আপু? ঠিক আছো তুমি?
.
না, কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা। তাড়াহুড়ো করে মুনিরা এগুলো আফরানকে ডাকার জন্য।
.
.
আজ সায়নী এমন একটা প্রশ্ন করলো কেনো?
কি চলছে সায়নীর মনে?
সে চেয়েছে তার মনে যেনো মুনিরার জন্য জায়গা হয়।
আচ্ছা, আসলেই কি তা হয়েছে?
তবে হিউম্যান সাইকোলজির ভাষায় একটা কথা আছে,
একটা মানুষ সবসময় তোমার আশেপাশে থাকলে মানুষটার প্রতি তোমার আবেগ, অনুভূতি ও মায়া জন্মাবে।
আফরানের ক্ষেত্রেও কি মুনিরার জন্য এমন ফিলিংস তৈরী হয়েছে?
নাহলে আজ সায়নীর প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারেনি কেনো!
তবে কি তার মনে জায়গা তৈরী করে ফেললো, মুনিরা নামের এই মায়াবতী?
.
(চলবে)