#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – ৩০
‘আম্মা, দ্রুত তৈরি হও। ঊষাদের বাড়ি যাব বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।’
সাহেদা চোখ চড়কগাছ করে চেয়ে আছেন ইয়াহিয়ার দিকে। ইয়াহিয়ার চোখ ভীষন লাল। শান্ত অথচ রাগে যেমন ভোসভোস করছে। কুসুম এগিয়ে এল। মাকে ছুঁয়ে বলল,
‘আম্মা?’
সাহেদা নিজেকে স্বাভাবিক করলেন। বললেন,
‘ওরা যদি আবার তোকে অপমান করে? তোর বাবা নেই। আমাদের মূল্য ওদের কাছে এখন আগের ন্যায় নেই। আর এই কান্ড পর ওরা আমাদেরকে এখন চোখেই দেখবে না।’
‘না দেখুক। মেয়ে না দিলে, ছিনিয়ে আনব। তোমার কোনো আইডিয়া আছে, ওরা ঊষার সঙ্গে কি করছে? জানোয়ারও এর চেয়ে ভালো। টাকার গরমে ফুপা অন্ধ হয়ে গেছেন। উনার অন্ধগিরি আমি ছুটাচ্ছি আমি। তুমি আগে তৈরি হও। কুসুম, যা তৈরি হয়ে আয়। আমি যা যা গিফট লাগে, কিনে আনছি।’
কুসুম মায়ের দিকে তাকাল। সাহেদা বুঝতে পারছেন, ঊষার হয়ত কিছু হয়েছে। নাহলে তার শান্ত ছেলে এমন ভয়ংকর রণমূর্তি হয়ে যাবার কথা না। সাহেদা রাগান্বিত ছেলের দিকে একপল চেয়েই নিজের রুমে ছুটলেন।
____________________________
‘বাবা? প্লিজ! দয়া করো আমার উপর। এই বিয়ে করতে পারব না আমি। বেচে থাকতে জিন্দা লাশ বানিয়ে দিও না আমাকে। প্লিজ!’
ঊষার বাবা মিষ্টির প্যাকেট টেবিলের উপর রেখে রক্তচোখে তাকালেন মেয়ের দিকে। ঊষা বাবার এমন চাওনি দেখে ভয়ে দু কদম পিছিয়ে গেল। ছলছল চোখে চেয়ে দেখল পাশে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাকে। মায়েরও যে কিছু করার নেই। বাবার উপর এই বাড়িতে কেউই কথা বলতে পারে না। ঊষা পাথরের ন্যায় হেলেদুলে নিজের রুমে গেল। দরজা বন্ধ কর মেঝেয় বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সব শেষ, সব কেমন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এক নিমিষে। ঊষা আরেক পুরুষের ঘরে যাবে, তার সাথে শুবে, তার ছোঁয়া সমগ্র দেহে নিয়ে ঘুরবে! এসব কিছু ভাবতেই ঊষার পেট বিতৃষ্ণায় গুলিয়ে আসছে। অন্য পুরুষের ছোয়া দেহে লাগার আগেই ঊষা ছেড়ে দেবে এই দুনিয়া। ইয়াহিয়া…. ওর ইয়াহিয়া এখন কেমন অবস্থায় আছে কে জানে? ঊষা দ্রুত মেঝে থেকে উঠল। লাগেজ বের করে বহু আকাঙ্ক্ষিত একটা কাগজ বের করে। কাগজটা ওর কাছে বড্ড অদ্ভুত!
শক্ত কাগজের চতুর্দিকে ঊষার লিপস্টিকের দাগ। মাঝখান কালো ছোপছোপ দাগ। সেখানে ইয়াহিয়ার সবসময় ব্যবহৃত পারফিউম স্প্রে করা। ঊষা কাগজটা নাকের কাছে নিয়ে পারফিউমের ঘ্রাণ শুঁকল। সেদিনের কথা মনে আছে তার। ঊষার সঙ্গে বাড়ির বাইরে তৃতীয় দেখা হয় ইয়াহিয়ার।
ঊষাকে অনেকবার চুমু খাওয়ার রিকোয়েস্ট করলে, ঊষা বারবার ফিরিয়ে দিয়েছিল ইয়াহিয়াকে। ইয়াহিয়া এতে মুখে কিছু না বললেও মনেমনে মনক্ষুন্ন ছিল। ঊষা তা বুঝতে পেরে সান্তনাস্বরূপ একটা শক্ত কাগজে তার ঠোঁটের ছাপ বসিয়ে গিফট হিসেবে কাগজ ইয়াহিয়াকে দেয়। কাগজের এক পাশে গ্লিটার পেন দিয়ে লেখা,
‘শখের তোলা আশি টাকা। আমাদের সকল শখ বিয়েতেই পূর্ণতা নেবে! আমি অপেক্ষায় সেদিনের। ঠোঁটচুমু না খাও, কাগজচুমু দিলাম প্রাণ ভরে। গ্রহন করো এবং আমার অসংখ্য চুমুর ভালোবাসা নিও। ভালোবাসি! জানি তুমিও বাসো! তাই জিজ্ঞেস করলাম না।’
ঊষা হাত বাড়িয়ে গ্লিটার পেনে লেখাগুলো ছুঁয়ে দিল। চোখ উপচে জল গড়িয়ে কাগজে পরছে। ঊষার মনে আছে, সেদিন ইয়াহিয়া ঊষার এই ব্যাপারে খুব হেসেছিল। ঊষা তো লজ্জায় প্রায় আধমরা। ইয়াহিয়া হেসে তার সবচেয়ে পছন্দের পারফিউম কাগজে স্প্রে করে বলেছিল,
‘আমি যেমন তোমার ঠোঁটচুমুর পাগল, তেমন তুমিও আমার এই পারফিউমের দেওয়ানা। লুকিয়ে লুকিয়ে পারফিউমের গন্ধ শুকবে না। যখন ইচ্ছে করবে এই কাগজের ঘ্রাণ শুকে নিবে। আমিও লুকিয়ে লুকিয়ে হাসব না আর। ভালোবাসি! জানি তুমিও বাসো। তাই আর জিজ্ঞেস করলাম না।’
ঊষা ইয়াহিয়া হাতের লেখা ছুঁয়ে দিল। কান্নাভেজা কণ্ঠে আউড়াল,
‘বাস্তবে তোমার বুকের সঙ্গে মিশে বোধহয় আর কখনো তোমার পারফিউমের গন্ধ নেওয়া হবে না। আমাকে মাফ করে দিও। আমি আমাদের বিয়ের ওয়াদা রাখতে পারিনি।’
____________________________
ঊষাকে পাত্রপক্ষের সামনে বসান হল। সকল নিয়ম পূরণ করে কাজি ঊষাকে কবুল বলতে বললেন, ঊষা বলছে না। বেশ সময় পেরিয়ে গেলেও ঊষার মুখে একটা শব্দও বের হচ্ছে না। ঊষার বাবা লজ্জিত চোখে ছেলেপক্ষের দিকে চেয়ে আবারও গরম চোখে ঊষার দিকে তাকালেন। ঊষা বাবার চাওনি দেখে দমে গেল। কিন্তু এখনও কবুল বলছে না। তার চোখ লেগে আছে সদর দরজার দিকে। প্রিয় মানুষটা আসার অপেক্ষায় এখনো সে বসে, প্রহর গুনছে। ছেলের বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘মেয়ের প্রথম প্রেমিক ভুলে নাই এখনো? এমন হলে বিয়ের এই নাটক কেন সাজিয়েছিস? আমাদের বোকা বানাতে?’
ঊষার বাবার এবার রক্ত গরম হয়ে গেল। সোফা ছেড়ে উঠে চপাট করে মেয়ের গালে থাপ্পড় বসাবেন উদ্যত হলেন, তার আগেই ঊষা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। অস্ফুট স্বরে বলল,
‘ইয়হিয়া?’
ইয়াহিয়ার অতৃপ্ত চোখ নিবদ্ধ ঊষার দিকে। ঊষার চোখে অবিশ্বাস। এতক্ষণ আটকে রাখা চোখের জল বাঁধ ভেঙে টুপ করে গড়িয়ে পরল। ঊষার বুকটা মুচড়ে উঠল যেমন। ইয়াহিয়া এগিয়ে আসল। সাহেদা সকল উপহার ঊষার মায়ের কাছে তুলে দিলেন। অনেক আশা নিয়ে সুধালেন,
‘আমরা ইয়াহিয়ার জন্যে ঊষার হাত চাইতে এসেছি আপা।’
ঊষার মা সাহেদার দিকে ছলছল চোখে চেয়ে পুনরায় স্বামীর দিকে তাকান। ঊষা এখনো চেয়ে আছে ইয়াহিয়ার দিকে। ইয়াহিয়ার তীক্ষ্ম নজর ঊষার পাশে বাঁকা হেসে বসে থাকা ঊষার হবু স্বামী উল্লাসের দিকে। ঊষা আড়চোখে বাবার দিকে তাকাল। ঊষার বাবা ইয়াহিয়াকে দেখে তেতে উঠলেন। তেড়ে আসলেন,
‘তুমি কি করো এখানে? খবরদার আমার মেয়ের বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করলে তোমাকে আমি পুলিশে দেব। এটুকু ক্ষমতা আছে আমার।’
ইয়াহিয়ার চোখ এবার সোজা নিক্ষেপ হল ঊষার বাবার দিকে। সে শান্ত স্বরে উত্তর দিল,
‘আমরা এখানে কি জন্যে এসেছি আম্মা বলেছেন আপনাদের। এবার আপনাদের সিদ্ধান্ত জানান। আমরা অপেক্ষা করছি।’
ঊষার বাবা দায়ছাড়া ভাবে উত্তর দিলেন,
‘আমি আমার মেয়ে তোমার কাছে নিয়ে দেব না। চাকরি করে ক টাকা পাও? হাজার কয়েক? এতেই আমার মেয়ের হবে? পোষাবে ওর? আমি যার কাছে আমার মেয়ে বিয়ে দেব সে লাখপতি হতে হবে আমার মত। নাকি তোমার মত পথেঘাটে থাকা কোনো ছেলে?’
ইয়াহিয়া হাসল খানিক। হেসে বলল,
‘এই পথেঘাটে থাকা পরিবার থেকেই আপনি নিজের জন্যে বৌ এনেছেন ফুপা। তখন এসব মাথায় আসেনি?’
ঊষার বাবা দমলেন খানিক। আড়চোখে স্ত্রীর দিকে চেয়ে পুনরায় তেজ নিয়ে বললেন,
‘হ্যাঁ এনেছি। কারণ আমি পুরুষ মানুষ। আমার ইনকামে ঘর চলে নাকি তোমার ফুপুর ইনকামে? আমার মেয়েও তার স্বামীর ইনকামে চলবে। তাই তার যেখানে বিয়ে হবে সেও আমার মত টাকা পয়সার দিক থেকে অন্যতম থাকবে। এটাই নিয়ম।’
ইয়াহিয়া উত্তর দিল,
‘আমার ক্ষেত্রে নিয়মটা আলাদা ফুপা। ঊষা মেধাবী ছাত্রী। আমি তাকে ঘরে বন্দি রেখে তার এতদিনের মেধার পরিচয় আটকে রাখব না। আমি তাকে সাবলম্বী বানাব। যেন ভবিষ্যতে তার উপর কেউ আঙুল তুলে না বলে, তার স্বামীর ইনকামে তার ঘর চলে, তার নিজের ইনকামে না। এবং আমি তার পাশে থাকবে, সর্বদা, সবসময়।’
ঊষার বাবা বুঝতে পারলেন, ইয়াহিয়া তাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলেছে। নিজের স্ত্রী মেয়েকে ছোট করে দেখার বিষয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ঊষার বাবা আর উপায় না পেয়ে বললেন,
‘যাই হোক। বড়বড় বাণী না ছেড়ে আমার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাও। আমি তোমার কাছে যেকোনো মূল্যে আমার মেয়ের বিয়ে দেব না।’
ইয়াহিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘শিউর? আপনি সত্যি রাজি হবেন না?’
ঊষার বাবা রাগ নিয়ে তাকালেন। ইয়াহিয়া যা বোঝার বুঝে গেল। সে মৃদু হাসল। ঊষার বাবার সামনে থেকে চলে গেল। এগিয়ে গেল স্বয়ং ঊষার দিকে। ঊষা এতক্ষণ ওদের ঝগড়া দেখছিল। ইয়াহিয়া ঊষার সামনে এসে দাড়াল। ঊষার হাত আলগোছে নিজের হাতে নিয়ে বলল,
‘আমাকে চাও তুমি? হ্যাঁ বা না উত্তর দিবে!’
ঊষা উত্তর দিল, ‘চাই,অনেক চাই।’
‘বিয়ে করবে আমাকে?’
ঊষা আড়চোখে বাবার দিকে তাকাল। ঊষার বাবা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে চেয়ে। ঊষা ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল, ‘বিয়ে করব।’
‘ সংসার করার জন্যে আমি এবং আমার পরিবার যথেষ্ট তোমার জন্যে? বাবাকে ছেড়ে আমার কাছে একেবারে চলে আসতে পারবে? ভয়ে ভয়ে নয়, আমি চাই তুমি নিজের উপর বিশ্বাস রেখে চারপাশ পরোয়া না করে উত্তর দিবে! তোমার উত্তরকে আমি সম্মান করব।’
ঊষা বাবার দিকে ছলছল চোখে তাকাল। কি উত্তর দিবে সে? ঊষার বাবা চুপ করে মেয়ের দিকে চেয়ে আছেন। মেয়ের উত্তর শোনার জন্যে তিনি মুখিয়ে। ঊষা চুপ করে চেয়ে আছে বাবার দিকে। একসময় বলল,
‘আমার তোমাকে চাই, তোমার পরিবার চাই, সঙ্গে চাই আমার নিজের পরিবারও। এটা কি আদৌ কখনো সম্ভব হবে? আমি দোষ করিনি কিছু, তাহলে কোন দোষের এতবড় শাস্তি পাচ্ছি বলতে পারো?’
ইয়াহিয়া শুনে। ঊষার হাতে হাত রেখে বসে থাকে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ। ঊষা কেঁদে উঠে। ইয়াহিয়া ঊষার কান্না চুপ করে চেয়ে দেখে। ঊষা ইয়াহিয়া হাত নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। এগিয়ে যায় বাবার দিকে। কিছুক্ষণ বাবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়।তারপর হঠাৎ আচমকা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। কাদতে কাদতে বলে,
‘বাবা, আমাকে এতবড় শাস্তি দিও না প্লিজ। আমি তোমাদের ছাড়া বেচে থাকতে পারব না। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি বাবা। ওকেও ঠিক তোমার মত করেই ভালোবাসি আমি। আমি কোথায় যাব বাবা, কার কাছে যাব? কার কাছে আমার দুঃখ বলব? বাবা, আমার দুঃখ শুষে নাও তুমি। আমাকে পর করে দিও না। আমি বেচে থাকতে পারব না বাবা, পারব না।’
ঊষার বাবার চোখে জল জমেছে। মেয়ে তাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে সেটা তিনি বুঝতে পারছেন। নাহলে মেয়ের উপর এ কদিন যে পরিমাণ অত্যাচার তিনি করেছেন, তাতে ইয়াহিয়ার এক ডাকে ঊষার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার কথা। সেখানে মেয়ে এখনো লেগে আছে তাকে মানানোর পেছনে। ছোটবেলায় যেমন বায়না করলে পাঞ্জাবি চেপে ধরে ঝুলে থাকত, তেমন বড় হয়েও আজকে নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ণ বায়না ধরেছে। আর আগের মতোই ঝুলে আছে তার বুকের সঙ্গে। ঊষার বাবা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পরলেন। একপর্যায়ে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে মেয়ের কথা ভেবে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘আমার পছন্দ করা ছেলে থেকে ইয়াহিয়া তোকে বেশি সুখী রাখবে বোধহয়। আমার আর কিছু বলার নেই। তুই সুখি থাকলেই আমি সুখি। এটুকুই আমার চাওয়া শুধু।’
#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – ৩১
ঝমকালো বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে কুসুমদের বাড়িতে। চারপাশে এত শোরগোল, কোলাহলে কান ঝিম ধরার উপক্রম। এত আয়োজনের ভিড়ে ইয়াহিয়ার নিজের বিশ্বাস হচ্ছে না, সে ঊষাকে পেয়ে যাচ্ছে! অবিশ্বাস্য চোখে যখন বাড়িতে বিয়ের তুলকালাম কান্ড সরজমিনে দেখে ঠোঁটে মৃদু হাসি ছড়িয়ে যায়। নিজেকে নিজেই প্রবোধ দেয়,’ধুর ব্যাটা, সত্যি সত্যি বিয়ে হচ্ছে তোর।’
ভাইয়ের বিয়েতে স্বাভাবিকভাবে কুসুম মহা ব্যস্ত সময় পাড় করছে। এ বাড়ি, ও বাড়ি ঘুরে ফিরতেই দিন শেষ তার। সময় তার লাগাম ছুটে পালিয়েছে। একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতে উচ্ছ্বাসকে সময়টুকু দেওয়া হচ্ছে না তার। তবে উচ্ছ্বাসের এ নিয়ে আফসোস নেই। সে জানে, বুঝে! সময়টাই এখন এমন।
আগামীকাল হলুদের সমস্ত আয়োজন করে মাত্রই বাড়ি ফিরেছে কুসুম। রুমে এসে দেখে উচ্ছ্বাস ল্যাপটপে কাজ করছে। কুসুমকে দেখে উচ্ছ্বাস কুসুমের দিকে চায়। মৃদু হেসে বলে,
‘কেমন কাটল দিন, মিস বৌপ্রিয়া?’
কুসুম ক্লান্ত নজরে চাইল। ক্লান্তিতে কুসুমের দু চোখ ভেঙে আসছে। উচ্ছ্বাসের আশকারা পেয়ে কুসুম হেঁটে এসে উচ্ছ্বাসের পাশে সোফায় বসে তার কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে। কুসুমের শান্তি দরকার এই মুহূর্তে। আর তা দিতে পারবে শুধুমাত্র উচ্ছ্বাস। কুসুম এসে কোলে শুলে, উচ্ছ্বাস বুঝতে পেরে ল্যাপটপ সরিয়ে ফেলল। আলতো হাতে কুসুমের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
‘ভেজা চুল আবারও বেঁধে রেখেছিলে? বিকেলে গোসল করেছ, এখনো চুল ভেজা। চুলের যত্ন নাও, কুসুম। তোমার এই চুল আমার ভীষন প্রিয়।’
কুসুম উচ্ছ্বাসের কোলে মাথা রেখে চোখ খুলে ঠিক উচ্ছ্বাসের চোখে চোখ রাখল। মিষ্টি হেসে বলল,
‘ক্লান্ত ছিলাম সারাটাক্ষণ। আপনাকে দেখে সকল ক্লান্তি মুছে গেছে।’
উচ্ছ্বাস মৃদু হাসল। কুসুম দু চোখ জুড়িয়ে শুধু চেয়েই রইল উচ্ছ্বাসের পানে। উচ্ছ্বাস হাত বাড়িয়ে কুসুমের খোঁপা খুলে দিয়ে চুল মেলে দিল। কুসুমের চুলে উচ্ছ্বাসের হাঁটু ঢেকে পা অব্দি ছড়িয়ে গেল চুল। কুসুমের এত লম্বা চুল যে উচ্ছ্বাস মাঝেমধ্যে কিছু ব্যাপারে এই চুল নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পরে। এই যেমন, সারা রাত ভালোবাসায় কাটানোর পর সকালে গোসলের পর কুসুম প্রায় কেদেই ফেলে চুলের ঝামেলায়। লম্বা চুল শুকাতে চায় না, হেয়ার ড্রায়ার উচ্ছ্বাস ব্যবহার করতে দেয়না। তারপর বিকেল অব্দি এই ভেজা চুল নিয়ে ঘরময় হেঁটে বেড়াও। কেমন বিচ্ছিরি অবস্থা তৈরি হয় ভেবেই কুসুমের গলা শুকিয়ে যায়। উচ্ছ্বাস কুসুমের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কালকে আবার যাবে?’
‘হ্যাঁ, ভোরের দিকে যাব।’
ক্লান্তিতে অবসন্ন কুসুম উত্তর দেয়। উচ্ছ্বাস বলল,
‘রাতের দিকে ফ্রি থাকবে? হলুদের অনুষ্ঠান তো বিকেলের দিকে।’
‘তা থাকব। কিন্তু কেন বলেন তো?’
‘ডেইটে যাব, ক্যান্ডেল লাইট ডিনার। যাবে?’
কুসুম উচ্ছ্বাসের কথা শুনে চমকে তার দিকে তাকাল। পরপরই হেসে বলল, ‘এত শখ?’
উচ্ছ্বাস মুখ এগিয়ে এনে কুসুমের কপালে গাঢ় চুমু বসাল। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বুড়ো হলেও তোমাকে নিয়ে আমার শখ মিটবে না, বৌপ্রিয়া!’
কুসুম খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। এমন হৃদয় চুরমার করা হাসিতে উচ্ছ্বাসের হৃদয় ছিন্নভিন্ন হল। ঘোরলাগা দৃষ্টি ছেয়ে গেল উচ্ছ্বাসের চোখে। কুসুমের চোখ পরল উচ্ছ্বাসের চোখে। চোখে চোখ আটকে গেল। কুসুম উচ্ছ্বাসের চোখের দৃষ্টি বুঝল। কুসুমের নিজের মধ্যেও অনুভূতি কাজ করছে। কুসুম ভাঙা স্বরে বলল,
‘গো-স-ল করে আসি? ঘা-মে ভি-জে আছি।’
উচ্ছ্বাস মিষ্টি হাসল। কুসুমকে পাঁজাকোলা তুলে নিয়ে বিছানার দিকে এগুতে এগুতে বলল, ‘সকালের একসঙ্গে ফ্রেশ হওয়াটা তুমিও ভালোবাসো কুসুম, শুধু স্বীকার করতে কৃপণতা করো।’
কুসুম লুকিয়ে হাসল। লজ্জায় জমে নিজেকে গুটিয়ে নেয় উচ্ছ্বাসের প্রশস্ত বুকে।
—-
হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। ইয়াহিয়াকে জোরপূর্বক লুঙ্গি-সেন্ডো গেঞ্জি পরিয়ে রাখা হয়েছে। ইয়াহিয়া নিজের রুমে বসে ঊষার সঙ্গে কথা বলছে। ঊষার কণ্ঠে খুশি উপচে পরছে যেমন। মেয়ে খুশি আটকে রাখতে পারছে না। দম বন্ধ করে বিয়ের পরে নিজে পরিকল্পনা একে একে বলছে ইয়াহিয়াকে। ইয়াহিয়া খুব ধৈর্য্য নিয়ে শুনছে এসব। মাঝেমধ্যে হেসে তাল মেলাচ্ছে। ঊষাকে ডেকে নেওয়া হল বাইরে। ঊষা কল রাখলে ইয়াহিয়া বেরিয়ে আসে ঘর ছেড়ে। হলুদ ছোঁয়ানো হয় তাকে। কুসুম ইয়াহিয়ার হলুদ মাখা মুখের ছবি তুলে ঝটপট ঊষাকে পাঠিয়ে দেয়। ঊষা উত্তর দেয় ছবির,
‘বিশ্রী লাগছে তোর ভাইকে।’
কুসুম হেসে উঠে। ফিরতি উত্তর দেয়, ‘কি আর করার,এই বিশ্রী ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে আপা।’
ঊষা বারবার ইয়াহিয়া হলুদে মাখা ছবি দেখে যাচ্ছে। চোখের পাতা কাপছে তার। মানুষটা এত সুন্দর কেন? ঊষার বুকের ভেতরটা তাকে দেখে বারবার ছটফট করছে। ঊষা আলগোছে চুমু খায় ইয়াহিয়ার ছবিতে। ফিসফিস করে আওড়ায়,
‘আমাদের প্রথম ঠোঁট চুমুর খুব করে অপেক্ষায় আমি, ইয়াহিয়া। কবে কাছাকছি আসব আমরা? কবে এত অপেক্ষার অবসান ঘটবে? আমার সময় যাচ্ছে না যে আর।’
হলুদের অনুষ্ঠানে উচ্ছ্বাসকে দেখা যায় ভীষন ব্যস্ত রুপে। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে মেহমানদের খাতিরদারি সকল বিষয়ে তার কড়া নজরদারি। কুসুম একবার এসে উচ্ছ্বাসকে মিষ্টি খাইয়ে দিয়ে গেছে। ক্ষুধার্ত উচ্ছ্বাসের তখন এই জিনিসটা সবচেয়ে দরকার ছিল। বহু সময় পর কুসুম যখন উচ্ছ্বাসের কাছে এলো, উচ্ছ্বাস ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের কথা ভুলে যেও না। বিকেলটা তোমার, কিন্তু আজকের রাত আমাকে দিবে। মনে থাকে যেন।’
কুসুম উচ্ছ্বাসের দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসল। ওখানেই কুপোকাত হলেন ডাক্তারসাহেব।
—-
রাত অনেক হয়েছে। অথচ এখন অব্দি উচ্ছ্বাস বাড়ি ফিরেনি। না কোনো কল, নাইবা ছোট্ট মুঠোবার্তা। না জানিয়ে উচ্ছ্বাস কোথায় গেছে কুসুম জানে না। আজকে তাদের ডেইটে যাবার কথা ছিল। অথচ সে হারিয়েছে কোন অজানায়! কুসুম বারবার কল করছে উচ্ছ্বাসকে। উচ্ছ্বাসের ফোন বন্ধ আসছে এবার। কুসুম রাগে ফোন ছুঁড়ে ফেলল বিছানায়। শরীরের সকল সাজসজ্জা খুলে, মাথার চুল খামচে ধরে বসে থাকল বিছানায়। রাগ হচ্ছে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি চিন্তা হচ্ছে। কোথায় গেল সে? বলে যায়নি যে কুসুমকে।
উচ্ছ্বাস যখন ফিরেছে তখন ভোর চারটা বাজে। কলিং বেল বাজায় নি সে। কুসুমকে কল করে বলেছে দরজা খোলার কথা। উচ্ছ্বাসের কল পেয়েও একপ্রকার ছুটে নিচে গিয়ে দরজা খুলে কুসুম। দরজার ওপাশে আহত অবস্থায় উচ্ছ্বাসকে দেখে পিলে চমকে যায় কুসুমের। হেলে পরতে গিয়েও নিজেকে সামলায় কুসুম। দ্রুত এগিয়ে এসে উচ্ছ্বাসকে ধরে। এ কি অবস্থা হয়ে গেছে তার? কপালে ব্যান্ডেজ, ব্যান্ডেজের উপরে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ! শার্টের হাতাতেও তেমন করেই রক্তের দাগ ভেসে আছে। কুসুমের চোখ জল ছলছল করছে। উচ্ছ্বাসকে কোনরকম ধরে উপরে রুমে নিয়ে আসল। দৌড়ে গিয়ে শরবত করে এনে উচ্ছ্বাসের হাতে ধরাল। উচ্ছ্বাস শরবত খেল না। বরং হাত বাড়িয়ে কুসুমের হাত চেপে দুর্বল কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
‘অ-পে-ক্ষা;য় ছিলে? আ-মি খুব স-রি! ঠি-কসময় আসতে পা-রিনি।’
কুসুম উত্তর দিল না। চুপ করে ড্রয়ার থেকে ফার্স্ট এইড বক্স এনে বসল উচ্ছ্বাসের পাশে। উচ্ছ্বাসের ডান ভ্রুয়ের ঠিক উপরে একটা লম্বা কা/টার দাগ। কুসুম ক্ষ/ত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। চোখ-মুখ অশ্রুতে টুইটুম্বর। উচ্ছাস শান্ত চোখে কুসুমের কান্না দেখে যাচ্ছে। আসার পর থেকে কুসুম এখন অব্দি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে কোনরূপ কথা-বার্তা বলে নি। সেটা ঠিক হজম হচ্ছে না উচ্ছাসের। উচ্ছ্বাসের ক্ষতে ব্যান্ডেজ করা শেষ করে কুসুম ফার্স্ট এইড বক্স ড্রয়ারে রেখে উঠে দাঁড়ায়। চলে যেতে উদ্যত হলে পেছন থেকে উচ্ছ্বাস কুসুমের হাত টেনে ধরে। কুসুম থমকে দাঁড়ায়। পেছন ফেরে না তাকিয়েই বলে, ‘হাত ছাড়ুন, নিচে যাব।’
উচ্ছ্বাস হাত ছাড়ে না। বরং হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে টেনে বলে, ‘এদিকে তাকাও, কথা আছে।’
কুসুম তাকায়। কুসুমের কান্নায় ভেসে যাওয়া মুখ দেখে উচ্ছ্বাস হতভম্ব হয়ে যায়। কণ্ঠে অশ্রুর জলছাপ এঁকে কুসুম বলে, ‘কার কথা শুনব আমি? যার অপেক্ষার এই মাঝরাত্রি অব্দি দরজা খুলে বসে ছিলাম, সে ভোর সকালে এসেছে আমার কাছে। তাও সুস্থ হয়ে নয়। ক্ষ/তের দাগ নিয়ে। এমন মানুষের সঙ্গে আমার কোনো কথা থাকতে পারে না। ছাড়ুন আমায়।’
উচ্ছ্বাস শান্ত ভঙ্গিতে সব শুনে বলে, ‘ পাঁচ মিনিট শান্ত হয়ে আমার কথা শুনো। তারপর অভিযোগ করবে, কুসুম। আমি বাঁধা দেব না। জাস্ট ফাইভ মিনিট’স! ‘
কুসুম থামে। চুপ করে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে উচ্ছ্বাসের থেকে কিছুটা দূরে বিছানায় বসে।
#চলবে