বড় অবেলায় তুমি এলে পর্ব ২

#বড়_অবেলায়_এলে_তুমি,,
#পর্ব_2

অর্থী ঢাকায় এসেছে প্রায় সাত দিন। এই সাতদিনে প্রতিদিনই ইহান জান্নাতের বাসায় এসেছে কোন না কোন অজুহাতে। কেন এসেছে তা ইহান নিজেও জানে না। কিন্তু না আসলে তার কেমন জানি অস্থির লাগে। যেন জান্নাতের বাড়িটা একটা চুম্বক আর ইহান লোহা। সবসময় আকর্ষণ করতেই থাকে, আর এই আকর্ষণ উপেক্ষা করার শক্তি ইহানের নেয়। তাই বারবার এই ছুটে আসা।

আজ ভার্সিটি অফ। তাই ইহান আজ সকালের দিকেই এসেছে তার ঘুমপরীকে দেখতে। হুম ঘুমপরীই তো। যতদিন থেকে ইহানের জীবনে এসেছে, ওর রাতের সকল ঘুম কেড়ে নিয়েছে এই মেয়েটা। তাই ইহান ওর নাম দিয়েছে ঘুমপরী। কতগুলো দিন যে জেগে জেগেই সারাটা রাত পার করেছে ইহান, বুঝতো তখন যখন ফজরের আযান কানে ভেসে আসত। আর ভাবত আজও একটা নির্ঘুম রাত পার করলাম। দিনে দিনে শুধু সেই নির্ঘুম রাতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে ইহানের।

ইহান সোফাতে বসে আরাফের সাথে দুষ্টুমি করছিল আর আড় চোখে তার ঘুমপরীকে খুজছিল। কিন্তু তার ঘুম পরীর কোন খবরই নেয়। ব্যাপারটা কি, গেল কই আমার ঘুমপরীটা? এসব ভাবতে ভাবতেই জান্নাতের কষ্ঠটা ভেসে আসল ইহানের কানে। এতোক্ষন সে তার ঘুমপরীতে মত্ত্য ছিল। ঘোর কাটিয়ে জান্নাতের দিকে তাকালো। ইহান তাকাতেই জান্নাত বলে উঠল,

– আজ তো তোর ভার্সিটি অফ। আমার বোনটাকে একটু ঘুরতে নিয়ে যা তো। এখানে এসেছে অবদি মেয়েটা বাড়িতেই। আমি ওকে নিয়ে যাওয়ার সময়ই পাচ্ছি না। বেচারী বেড়াতে এসেও ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে বসে আছে।

ইহান যেন এটাই চায়ছিল মনে মনে। মুহু্র্তের মধ্যে তার মনটা খুশিতে নেচে উঠল। ওর ঘুমপরীর সাথে বাইরে ঘুরতে যাবে ভাবতেই যেন একটা অন্য রকম অনুভুতি হচ্ছে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে তা ইহান জানে না। ও শুধু জানে ওর ঘুমপরীর সাথে সময় কাটাতে ভাল লাগে। ইহান মুহু্র্তেই রাজি হবে ভেবে আবার হয় না। একটু ভাব নিয়ে বলে,

– সারাটা দিন যে তোমরা বাড়িতে কি কর সেটাই বুঝি না। সারাদিন বসে বসে বোরিং লাগে না?

– বাড়িতে কি করি তা বিয়ে করলে বুঝতে পাড়বি। তখন বউয়ের আচলের নিচ থেকে বের হতেই চায়বি না।

– মোটেও আমি বউয়ের অচলের নিচে থাকার মত ছেলে না। বউ থাকবে আমার পকেটে, আমি বউয়ের আচলের নিচে নয়।

– আচ্ছা বিয়ে হলে তখন দেখব কি করিস।

– ইহান এক কথার ছেলে বুঝেছ। এই বউয়ের আচল ঘরে ঘুরার মত মিডিলক্লাস ন্যাকামু ইহানের আসে না।

– আচ্ছা ঠিক আছে। তোর সাথে তর্কে যেতে চায় না। এখন বল আমার বোন কে নিয়ে যাবি কিনা?

– ঠিক আছে রেডি হতে বল উনাকে। আমি অপেক্ষা করছি ।

জান্নাত সেখানে দাড়িয়েই অর্থীকে ডাক দিল। অর্থী ঘর থেকে বের হয়ে জান্নাতের কাছে আসল। জান্নাতের কাছে আসতেই দেখল ইহান আরাফের সাথে খেলছে। ইহানকে দেখেই অর্থীর মুখে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল। কেন তা সে জানে না কিন্তু ইহানকে দেখলেই তার মুখে একটা হাসি খেলা করে। ভালোবাসার মানুষকে চোখের সামনে দেখলে কি সবার এমনই হয় তা অর্থী জানে না। কিন্তু তার এক অসম্ভব শান্তির হাওয়া বয়ে যায় শরীরে। এতোক্ষন ইহানের দিকে তাকিয়ে এসব কথাই ভাবছিল। ঘোর কাটল জান্নাতের কথায়। অর্থী জান্নাতের দিকে তাকাতেই আবার বলল রেডী হতে। অর্থী জান্নাতের দিকে জিজ্ঞাষু দৃষ্টিতে তাকাতেই বলল ইহানের সাথে ঘুরতে যাবে। অর্থী ইহানের সাথে দেখে যেতে রাজী হয় না। এতে ইহানের একটু খারাপ লাগে। সে ভাবল হয়তো সে অর্থীর জন্য যেটা ফিল করে অর্থী তা করে না। না করতেই পারে সবার তো আর এক টেষ্ট না।

শেষ পর্যন্ত অর্থী গেল রেডী হতে। যেতে না চাইলেও জান্নাতের জন্য শেষ পর্যন্ত রাজী হতেই হলো ওকে। ইহানের অনেক ভালো লাগছে যে অর্থী ওর সাথে ঘুরতে যেতে রাজী হয়ে গেছে।

প্রায় আধা ঘন্টা পর অর্থী রেডী হয়ে বের হয়ে এলো। ইহান তখন আরাফের সাথে খুনসুটিতে ব্যস্ত ছিল, অর্থীর দিকে তাকাতেই আর চোখ সরাতে পারল না। যেন এক পরী তার সামনে স্বয়ন দাড়িয়ে আছে। কী মায়াবী মুখখানা। যেন একবার তাকালেই একটা ঘোর লেগে যায়। যেটা এখন ইহানের হয়েছে, ও বুঝতেই পারছে না তার আসেপাশে কি হচ্ছে। সে এখন শুধু অর্থীকে দেখায় ব্যস্ত। বেশী কিছুই করেনি অর্থী। একটা সাদা রঙের ড্রেস পড়েছে। চোখে গাড় করে কাজল, ঠোটে রেড কালারের লিপষ্টিক, হাতে একটা সিম্পল ব্রেসলেট। আর চুলগুলো খোলা। ব্যাস এতেই অর্থীকে একটা ছোট্ট পরীর মত লাগছে। অর্থী বেশী সাজগোজ পছন্দ করে না, আর ইহান অর্থীকে দেখে ভাবছে মেয়েদের বেশী সাজলে ভালো লাগে না এভাবেই অনেক সুন্দর লাগবে।

ইহানের ঘোর কাটে জান্নাতের কথায়। ইহান কিছুতেই বুঝতে পারে না ও অর্থীকে দেখলে কেন বারবার ঘোরের মধ্যে চলে যায়। জান্নাত অর্থীকে দেখেই বলতে লাগলো, “বাহ্ আমার বোনটাকে তো দেখতে অনেক মিষ্টি লাগছে।” অর্থী লজ্জায় মাথাটা নিচু করে নেয়। ইহান অর্থীকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল।

ইহান অর্থীকে নিয়ে প্রথমে একটা পার্কে গেল। পার্কগুলো এসময় একটু ফাঁকায় থাকে। এসময়ে কেউ পার্কে সেরম ঘুরতে আসে না। ওরা পার্কের ভিতরে যেতেই দেখল কিছুটা দুরে অনেকগুলো বাচ্চা একসাথে খেলা করছে। বাচ্চাগুলোকে দেখে অর্থী নিজেও কেমন যেন বাচ্চা বাচ্চা হয়ে গেল। সে দৌড়ে বাচ্চাগুলোর কাছে গেল আর তাদের সাথে খেলা করতে লাগল। বাচ্চাগুলোও অর্থীর সাথে সানন্দে খেলা করতে লাগল। ইহান আর সামনে এগেলো না। সেখানেই মাটির উপর বসে পড়ল। সে সামনে তাকিয়ে তার অর্থীর বাচ্চামোগুলো দেখতে লাগলো। সাথে মুখে একটা হাসির রেখা ঝিলিক দিচ্চে। মনে মনে বলছে পাগলী একটা। বাচ্চাদের সাথে যেন ওই বাচ্চা বাচ্চা হয়ে গেছে। পুরাই কিউটের ডিব্বা একটা। বলেই আবার একটা মুচকি হাসি দিল।

ইহান বসে বসে অর্থীর বাচ্চামোগুলো দেখছে আর ভাবছে একটা মেয়ের কতগুলো রুপ থাকতে পারে তা আমি এই পিচ্চিটাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। নাহ্ আমার জীবনে এই পিচ্চিটাকে অতিবই প্রয়োজন। আর তাকে জীবনে আনার ব্যবস্থাটাও আমাকেই করতে হবে। এসব ভাবছে আর ব্লাসিং করছে। ওর অর্থী ভাবতেই যেন একটা অন্যরকম অনুভুতি হচ্ছে।

গাড়িতে পাশাপাশি সিটে বসে আছে অর্থী আর ইহান। নেক্সট কোথায় যাবে তা এখনও ডিসাইড করা হয় নি। এমনি শহরের মধ্যে এলোমল গাড়ি চালাচ্ছে ইহান। ভালোই লাগছে অর্থীর। পাশে ভালোবাসার মানুষটা বসে থাকলে মনে হয় সবই ভালো লাগে। সেরকমই আজ ফিল করছে অর্থী। আজ তার ঢাকা শহরের জ্যামটাও অনেক ভালো লাগছে। আজ অর্থীর ইহানের কাছে একটা আবদার করতে ইচ্ছা করছে কিন্তু বারবার থেমে যাচ্ছে যদি ইহান কিছু মনে করে সেই ভেবে।

অন্যদিকে ইহান ভাবছে আজ যদি অর্থী নিজে থেকেই কোথাও যাওয়ার কথা না বলে তাহলে এভাবেই গাড়ি চালিয়ে ওকে বাসায় দিয়ে আসবে। কেন যেন অর্থীর ইহানের সাথে কথা কম বলাটা মোটেও সহ্য হচ্ছে না ইহানের। তার তো অর্থীর সাথে সবসময় কথা বলতে ইচ্ছা করে কিন্তু এই মেয়ে সবসময় তার ভাবনা নিয়েই ব্যস্ত। কি যে এতো ভাবে তা ইহান কিছুতেই বুঝতে পারে না। কেন যেন আজ অর্থীর উপর ইহানের অনেক অভিমান হচ্ছে। আর এই অভিমান থেকেই এই সিদ্ধান্ত।
হঠাৎ অর্থী বলে ওঠে,

– একটা কথা বলি?

– না।

– বলি। pleaseeeeee!

– নিশ্চুপ।

– আচ্ছা শোনা লাগবে না।

-আমার সাথে কথা বলার জন্য যদি অনুমতি নেওয়া লাগে তাহলে কিছু বলারই দরকার নেয়।( ইহানের অনেক রাগ লাগছে। অর্থী ওকে কিছু বলার জন্য অনুমতি নেবে কেন? শুধু শুধু বললে কি ইহান শুনবে না। কিন্তু অর্থী তো সেটা বোঝেই না উল্টে নিজেই রাগ করে বসে।)

অন্যদিকে ইহানের থেকে অনুমতি পেয়ে অর্থী মুখ খোলে। কিন্তু অনেক জড়তা কাজ করছে।

– আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাবেন? যেখানে এই শহরের কোন কোলাহল থাকবে না। একদন র্নিজন কোন নদীর ধারে।

ইহানের অনেক ভালো লাগছে ওর অর্থী এই প্রথম ওর কাছে কোন অবদার করেছে। so না করার কোন প্রশ্নই আসে না। অর্থী দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল ঠিক আছে।

মুখে শুধু ঠিক আছে বললেও মনে মনে অনেক ভালো লাগছে ইহানের। আর অর্থী জানালার দিকে তাকিয়ে একমনে কি যেন দেখায় ব্যস্ত। ইহান দ্রুত গাড়িটা ঘুরিয়ে অন্য রাস্তায় নেয়।

ওদের গন্তব্যে পোছাতে প্রায় এক ঘন্টা মত লাগে। পুরোটা সময় অর্থী জানালা দিয়ে বাইরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগে ব্যস্ত ছিল। আর ইহান ওর ঘুমপরীকে দেখতে।

ইহান গাড়িটা একটা সরিষাক্ষেতের সামনে দাড় করায়। এটা দেখে অর্থী পুরো অবাক হয়ে যায়। শহর থেকে এতো কাছে এতো সুন্দর একটা জায়গা আছে তা ওর জানা ছিল না। অর্থীর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সে অনেক খুশি হয়েছে। আর অর্থীকে এতো খুশি দেখে আজ ইহানের জীবন সার্থক মনে হচ্ছে।

ওরা গাড়ি থেকে নেমে সরিষাক্ষেতে মধ্যে দিয়ে হাটতে শুরু করে। অর্থী তো পুরাই বাচ্চাদের মতো করছে। সরিষা ফলগুলো একবার ছুয়ে দিচ্ছে। একবার সেগুলো নাকের সাথে নিয়ে ঘ্রান নিচ্ছে। যদিও ফুলের কোন ঘ্রানই নেয়। আর ইহান দুর থেকে দাড়িয়ে অর্থী একের পর এক ছবি তুলছে আর ভাবছে যদি ও ওই ফুলগুলো হতে পারত তাহলে অর্থী ওকে ও এভাবে ছুয়ে দিত। যদিও অনুমতি ছাড়া কারও ছবি তুলা উচিত না সেটা ইহান জানে কিন্তু অর্থীর অনুমতি চাইলে সে রাজী হবে না দেখেই লুকিয়েই ছবিগুলো তুলছে।

সরিষাক্ষেত পার হয়ে ওরা আসে একটা নদীর পাড়ে ।অনেক সুন্দর সে জায়গাটা।। অর্থীর মনে হচ্ছে ও এতো সুন্দর জায়গা ওর জীবনে আর কখনো দেখে নি। এর জন্য ইহানকে একটা thanks দেওয়া উচিত।। অর্থী ইহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

– thanks

– পছন্দ হয়েছে?

– অননননেনেনেককক! ঢাকার মধ্যে যে এতো সুন্দর একটা জায়গা আছে তা আমি জানতামই না।

– এটা আমার অনেক পছন্দের জায়গা। সবাইকে নিয়ে আসি না। শুধু আমার কাছের মানুষগুলোকেই নিয়ে আসি ।

– তাহলে আমাকে নিয়ে আসলেন যে?

ইহান মনে মনে বলল তুমি তো আমার সব থেকে কাছের মানুষ।
– তুমি বললে তাই ভাবলাম যে সেই কাটখোট্টা শহর ছাড়াও যে ঢাকার মধ্যে আরও অনেক কিছু অছে তা তোমাকে দেখানো প্রয়োজন।

– ওও। তা এই জায়গাটা চিনলেন কিভাবে?

– তোমার মতো আমারও কাটখোট্টা শহর একদম পছন্দ না। যখনই সেই শহুরে পরিবেশে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতাম তখনই গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরতাম একটু প্রান ভরে নিশ্বাস নেওয়ার জন্য। সেরকমই একদিন ড্রাইভ করতে করতে এদিকটাই চলে আসি আর এই জায়গাটা অনেক ভালো লাগে। তারপর থেকেই সেই শহরে পরিবেশে বিরক্ত লাগলে এখানে এসে সময় কাটায়।

একমনে নদীর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল ইহান। অর্থীও একমনে ইহানের দিকে তাকিয়ে ইহানের কথা গুনো শুনছিল। ইহানের কথা বলার ষ্টাইল, ভোকাল কর্ডের কম্পন সব যেন একটা ছন্দ আকারে চলছিল। অর্থী একমনে তা দেখছিল। ইহান আবার বলে ওঠে “চল নদীর পাড়টাই বসি।” বলেই নদীর পাড়ের দিকে হাটতে শুরু করে। অর্থীও পিছন পিছন যায়। ইহান গিয়ে নদীর পাড়ে বসে পড়ে। ইহানের পাসেই অর্থী বসে সেই সুন্দর জায়গাটা উপভোগ করতে থাকে।

ইহান আর অর্থী রাস্তা দিয়ে হাটছে। দুজনেরই অনেক খিদা লেগেছে। তাই খাবারের দোকান খুজছে। কিন্তু জায়গাটা এতোটা নির্জন যে আসে পাশে কোন খাবারের দোকানই দেখছে না তারা। নদীর পাড়ে অনেকটা সময় বসে থাকে তারা। বুঝতেই পারে না কখন এতোটা সময় পাড় হয়ে গেছে। আসলে পছন্দের মানুষ পাশে থাকলে পুরো পৃথিবী থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সবাই। কতোটা সময় তারা বসে ছিল জানে না। দুজনেরই ধ্যান ভাঙ্গে আজানের শব্দে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। বুঝতে পারে দুজনেরই খিদা লেগেছে। এখন শহরের দিকে যেতে গেলে অনেক দেরী হয়ে যাবে তাই এখানেই টুকটাক কিছু খেয়ে রওনা দেবে তারা।

অনেকটা দুর আসার পর তারা এরটা মুদির দোকান দেখতে পায়। কাছে গিয়ে দেখে খাবার মতো সেরম কিছুই নেয়। তাও তারা কিছু কলা আর পাউরুটি নিয়ে গাড়ির দিকে রওনা দেয়।

হালকা কিছু খেয়ে আবার তারা রওনা দেয় শহরের উদ্দেশ্য। শহরে অাসতে আসতে তাদের প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। তাই ইহান গাড়িটা হাতির ঝিলের দিকে নিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর হাতির ঝিলের সোন্দয্যটা বর্ণনা করার মতো নয়।

তারা ঝিলের একদম পাশেই দাড়িয়ে আছে। পাশের ব্রিজটাই নানান রঙয়ের লাইট জলছে যেন অন্যরকম একটা পরিবেশ। অর্থী একমনে সেগুলো দেখছে। পাশে অনেক কাপলরাও আছে। তারা একে অপরের হাত ধরে বসে আছে। ইহানেও ইচ্ছা করছে অর্থীর হাতটা ধরে দাড়াতে কিন্তু বলার মতো সাহস পাচ্ছে না। অর্থী আবার যদি কিছু মনে করে। দুজনেই চুপচাপ দাড়িয়ে আছে আর সেই পরিবেশটাকে উপোভোগ করছে।

পাশাপাশি গাড়িতে বসে আছে আবার তারা
। ইহান অর্থীকে বাসায় পৌছে দিয়ে তবেই বাসায় যাবে সে। হাতির ঝিল থেকে ওরা একটা রেস্টুরেন্টে গেছিল।। আজ সারাটা দিন তারা কিছুই খায় নি। অর্থীকে এভাবে না খাইয়ে সে রাখতে পারবে না তাই রেস্টুরেন্টে যাওয়া। যদিও অর্থী যেতে চায় নি কিন্তু ইহানের জেদের কাছে তাকে হার মানতেই হয়েছে।।

সারাটা দিন অর্থীর সাথে কাটিয়ে অনেক ভালো লাগছে ইহানের। আজকের দিনটা ওর জীবনে একটা শ্রেষ্ঠ দিনে পরিনত হলো। সারাটা দিন যেন ওর সপ্নের মতো কেটেছে।

গাড়িটা জান্নাতদের অ্যাপাটমেন্টের সামনে চলে এসেছে। অর্থীকে নামিয়ে দিয়েই ইহান ব্যাক করল। অর্থী ওকে বাসায় যাওয়ার জন্য বললেও ও যায় না। অনেকটা রাত হয়ে গেছে তাই তাততারি বাসায় চলে যায়। আর অর্থী আসতে ধীরে লিফটের দিকে এগোয়।

কেবলই বিছানায় গাটা এলিয়ে দিয়েছে অর্থী। আজ সে ভিষন ক্লান্ত। সারাটা দিন ইহানের সাথে ঘোরাঘোরি করে অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছে সে। হঠাৎ ই মনে পড়ল সেই কথাটা যার জন্য অর্থীর মেইনলি ঢাকায় আসা। মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা আবার যেন মোচর দিয়ে উঠল। কেন হল ওর সাথেই এমটা। ভালোই তো ছিল তবে কেন আবার আল্লাহ্ তাকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিল। নাহ্ আর আর এসব ভাবতে চায় না সে। তাকে আসল কাজটা অনেক তাড়াতাড়ি সারতে হবে। কিন্তু কিভাবে? তার জন্য তো বাড়ি থেকে বের হওয়া লাগবে তার।

সারাটা রাত ভেবে ভেবেই কাটিয়ে দিল অর্থী। সকালের দিকে একটু ঘুমিয়ে ছিল সে। ঘুম ভাঙ্গল জান্নাতের ডাকে। ফ্রেস হয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে গেল সে। টেবিলে বসে শুভ্র, জান্নাত আর আরাফ অপেক্ষা করে অর্থীর জন্য। টেবিলে বসে চুপচাপ খাবার নিয়ে খেতে শুরু করল অর্থী। মনে মনে শুধু ভাবছে কিভাবে জান্নাতকে বাইরে যাওয়ার কথাটা বলবে। একা তো ওকে জান্নাত কিছুতেই ছাড়বে না।

হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি এলো অর্থীর।ও জান্নাতের দিকে চেয়ে বলল,

– আপু আজ আমি আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাব। ঢাকায় এসেছি শুনে প্রত্যেক দিনই দেখা করার কথা বলছে ও।

– বেশ তো যাবি।

– আজকেই যেতে হবে। আজ তো আমার একটা মিটিং আছে। কাল গেলে হয় না।

– না আজই যেতে হবে। আর আপনি টেনশান নিবেন না আমি একাই যেতে পারব। শুধু অনুমতি দিলেই চলবে।

– না না। পাগল হয়েছিস তুই? ঢাকার পথঘাট কিছুই তো তেমন ভালো ভাবে চিনিস না তুই। আমি কিছুতেই তোকে একা ছাড়ব না।

অনেক কাঠখড় পুরিয়ে তবেই অর্থী জান্নাতকে রাজী করালো। তবুও শর্ত হলো অর্থী শুভ্রর গাড়িতে করে যাবে এবং সেটা নিয়েই যেখানে খুশি ঘুরবে এবং ফিরে আসবে। অর্থী এতে রাজী হয়ে গেল। আর কিছু বলার নাই এতে রাজী না হলে জান্নাত তাকে কিছুতেই বেড়োতে দেবে না। আর যাওয়াটা যে অর্থীর ভীষন প্রয়োজন। তাই কথা না বাড়িয়েই অর্থী রাজী হয়ে গেছে।

অর্থী রেডী হয়ে বেড়োলো সাড়ে দশটা নাগাদ। গেট দিয়ে বের হবে এমন সময় একটা মানুষকে দেখে সে থমকে দাড়াল। হ্যা সে আর কেউ না ইহান। কাল সারাটা দিন অর্থীর সাথে কাটিয়ে যেন তার একটা নেশা হয়ে গেছে। সকাল থেকে অর্থীকে না দেখে তার অনেক কষ্টে কেটেছে। অবশেষে আর না পেরে ক্লাস মিস দিয়ে ভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে পড়েছে সে। উদ্দেশ্য জান্নাতের বাড়ি গিয়ে এক পলক অর্থীকে দেখা।

ইহান কে দেখেই যেন প্রানে পানি ফিরে পেল জান্নাত। অর্থীর একা যাওয়াটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু অর্থীর জেদের কাছে হার মেনে রাজী হতে হয়েছিল। ইহান কে দেখে যেন সে একটু স্বস্তি পেল সে।

কিছু করার নেয় অর্থীর এখন ইহানের সাথেই যেতে হবে। আজ প্রথম বার ইহানের উপস্থিতি অর্থীর কাছে বিরক্তর কারন হলো। কথা না বাড়িয়ে অর্থী ইহানের সাথে রওনা দিল।

গাড়িতে বসে ইহান জিজ্ঞাষা করল কোথায় যাবে। অর্থী যা উত্তর দিল তাতে ইহানের চোখ বেড়িয়ে আসার মতো অবস্থা হলো। সাথে সাথেই গাড়িটা ব্রেক করে সে অর্থীর দিকে তাকালো। ইহানের চোখে মুখে প্রশ্নের ছাপ কিন্তু ও এতোটাই অবাক হয়েছে যে কোন প্রশ্নই করতে পারছে না। তবুও অনেক কষ্টে মুখ দিয়ে বের করল,

– are you sure?….. আহসানিয়া মিশন হসপিটাল। ওখানেই যাবে তুমি?

– হ্যা, আসলে ওখানে আমার এক ফ্রেন্ডের মা এ্যাডমিট আছে। তাই যাব ওর সাথেও দেখা হয়ে যাবে আর আন্টিকেও।

আচ্ছা বলে ইহান গাড়িটা আবার ষ্টাট দিল। যেন ও প্রান ফিরে পেল। যখন অর্থী মুখ থেকে হসপিটাল এর নাম শুনেছিনল তখন যেন ওর পায়ে নিচের মাটিটা সরে গেছিল। সে গাড়িটা হসপিটালের দিকে নিয়ে গেল। হসপিটালের কাছাকাছি আসতেই অর্থী হঠাৎ বলে উঠল,

– গাড়িটা থামান।

– এখানে কেন হসপিটাল আরও একটু দুরে চল গেটে গিয়ে নামবে।

– না না। আমি এখান থেকে একাই চলে যেতে পারব। আপনি এখানেই একটু ওয়েট করেন।

– আমি যায় তোমার সাথে।। ( মুখটা করুন করে)

– না আসলে আমার ফ্রেন্ড আর তার মা যদি আপনাকে দেখে কিছু মনে করে। আসলে কিছু মনে করবেন না আমি,,,( মুখটা করুন করে)

– আচ্ছা আপনি যান আমি এখানেই অপেক্ষা করছি।

ইহানের অনেক খারাপ লাগে অর্থীর ইহানকে নিয়ে ইতোস্থত করাটা। তাই আর কিছু বলতে না দিয়ে অর্থীকে যেতে দেয় সে। কালকের পর ইহান ভেবেছিল হয়তো অর্থীও ইহানকে নিয়ে কিছু ফিল করে। কিন্তু আজ অর্থী তা ভুল প্রমাণ করে দিল। ইহানের বুকের মধ্যে অনেক যন্ত্রণা করছে। ইচ্ছা করছে চিৎকার দিয়ে কান্না করতে। কিন্তু পারছে না কারন সে তো ছেলে। আর ছেলেদের তো কাদতে নেয়।

ইহান ঠায় গাড়ির পাশে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ছিল। আজ যেন সে নির্বাক হয়ে গেছে। কতোটা সময় ছিল তা সে যানে না। ঘোর ভাঙ্গে অর্থীর কথায়,

– অনেকটা সময় আপনাকে দাড় করিয়ে রাখলাম।। আসলে,

– it’s okk, গাড়িতে উঠ। লেট হয়ে যাচ্ছে। ( নির্লিপ্ত গলায় বলে ওঠে ইহান)

অর্থীও আর কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে পরে।যতোটা তাততারি পারে সে ইহানের সামন থেকে পালাতে চায়। ও আবার ইহানের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চায় না। কিন্তু ও তো জানেই না যে ইহান সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওকে আর কোন প্রকার প্রশ্ন করে বিভ্রান্ত করতে চায় না।

গাড়িটা জান্নাতদের অ্যাপাটমেন্টের সামনে এসে দাড়াতেই অর্থী নেমে পড়ে। ইহান গাড়িটা ঘুরিয়ে নেয়। সে জান্নাতদের বাসায় আর যায় না। মুখে কাজ আছে বললেও তার এখন কিছুটা সময় এটা কাটানো লাগবে বলেই চলে আসা। এখন তার মনে যা অবস্থা তাতে মুখে মিথ্যা হাসি ফুটিয়ে সে কারও সামনে ফরমালিটি রক্ষা করতে পারবে না বলেই পালিয়ে আসল।

ঘরের মধ্যে গিয়ে সোজা দড়জাটা লাগিয়ে ইহান বারান্দার দিকে পা বাড়াল। নিচ দিয়ে আসার সময় ভাবী আর মায়ের সাথে দেখা হয়েছিল তার। তারা মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছে যে ইহানের কিছু একটা হয়েছে। তাই হাজাড়টা প্রশ্নের বান ছুড়ে দিচ্ছিল ইহানের দিকে। ইহান তাদের কথার কোন উত্তর না দিয়েই ঘরের চলে এসেছে। এখন তার কারও সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না। ভালোবাসার মানুষের অবহেলাটা যে এতোটা কষ্টদায়ক তা আজ ইহান বুঝতে পারছে। আগে ফ্রেন্ডদের নিয়ে মজা করলেও আজ ওর বুকের ভেতরটা ছিড়ে যাচ্ছে ব্যাথায়।

বারান্দায় গিয়ে চুপচাপ দোলনায় বসে পড়ে সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের কষ্টটা কমানোর চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল ইহান। আজ ওর অর্থী ওকে অনেক বেশী কষ্ট দিয়ে ফেলেছে যে।

অন্যদিকে অর্থীরও অনেক খারাপ লাগে ইহানের সাথে এমন ব্যবহার করে কিন্তু সে বাধ্য। ওর যে আর কিছু করার ছিল না। ইহান যদি হসপিটালের মধ্যে যেত তাহলে যে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত। তাই তো এতোটা কঠোর ভাবে সে ইহানকে ট্রিট করেছে। কিন্তু এখন নিজেকেই শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে অর্থীর। কেন আজ ও ইহানের সাথে এতো খারাপ বিহেব করল। সে বিছনার উপর বসে মুখটাকে দুই হাটুর মধ্যে ঢুকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।

এভাবেই অনেকটা সময় কেটে যায় দুজনের। মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে দুজনেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।

চলবে,,,,,

#জাকিয়া_সুলতানা
Repost

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here