বড় অবেলায় তুমি এলে পর্ব ৩

#বড়_অবেলায়_এলে_তুমি,,,
#পর্ব_3

সেই ঘটনার আজ নয় দিন হয়েছে। এই নয় দিনে একবারের জন্যও ইহান জান্নাতের বাসায় যায় নি। অর্থী বুঝতে পারছে যে ওর ওই বিহেবের জন্যই ইহান কষ্ট পেয়েছে আর সে জন্যই ইহান আর আসে না। কিন্তু অর্থীর আর কিছুই করার ছিল না। আর এটা জরুরী ছিল দুজনের জন্য। ইহানের আর না আসাতে অর্থীর ভালোই হয়েছে। ও আবার একটু একটু করে ইহানের মায়ায় জড়িয়ে পড়ছিল। যে ভালোবাসাটা ও তিন বছর ধরে বুকের মধ্যে চেপে রেখেছিল তা আবার বের হয়ে আসতে চাইছিল যে। অর্থী আবার সেই কষ্টটা ভোগ করতে পারবে না, আর না পারবে ইহানকে কষ্টে দেখতে। তাই দুজনেরই দুরে থাকাটা জরুরী। এতো দুজনেরই কষ্টটা কম হবে। তাই ইহানের আর এবাড়িতে না আসায় উচিত। অন্তত অর্থী যে কটা দিন আছে।

হাঠাৎ কলিংবেলটা বেজে ওঠে। জান্নাত গিয়ে দড়জাটা খুলতেই দেখল যে ইহান দাড়িয়ে আছে। এ কয়দিন যে ইহান এ বাড়িতে আসে নি তা জান্নাতও নোটিশ করেছে। তার মনেও খটকা লেগেছে ইহানের না আসাটা। তাই ইহানকে দেখে জান্নাত বলে ওঠে,

– কিরে তুই বেচে আছিস? এই কয়দিন তো তোর কোন দেখাই পাওয়া যায় নি। কোথায় উধাও হয়ে গেছিলি তুই?

– কোথায় আবার উধাও হব। আমার যাওয়া কোন যায়গা নেয়। আর দেখতেই তো পাচ্ছ বেচে আছি। ( ভাবলেসহীন ভাবে বলল)

– কি হয়েছে তোর বলবি কি?

– কই কিছু না তো। আচ্ছা আমাকে কি দড়জায় দাড়া করিয়ে রাখবে নাকি ভিতরে আসতে দিবে?

জান্নাত দড়জা থেকে সরে দাড়িয়ে ইহানকে ভিতরে ঢুকতে বলল। দড়জাটা লাগিয়ে আবার ইহানের কাছে এসে জিগ্গাষা করল,

– তা এতো দিন কই ছিলি? অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গেছিলি না কি।

ইহান একটু হেসে বলল, ওহ্ ভার্সিটিতে প্রজেক্টের কাজে একটু বিজি ছিলাম।

– তা তো বুঝলাম কিন্তু চেহারার একি হাল হয়েছে তোর। পুরাই শুকিয়ে গেছিস। চোখগুলো ঢুকে গেছে। খাওয়া দাওয়া করিস নি নাকি এ কয়দিন।

– বললাম না প্রজেক্টের কাজ ছিল তাই একটু ব্যস্ত ছিলাম। খাওয়া ঘুম কিছুই ঠিক মত হয় নি তাই।

জান্নাত বুঝতে পারছে যে এটা আসল ঘটনা না, বড় কিছু একটা হয়েছে। ইহানের মতো এতো হাসি খুশি একটা ছেলের মুখে এমন কালো মেঘ ভর করেছে তা স্বাভাবিক কোন বিষয় নয়। যে ছেলে সবাইকে মাতিয়ে রাখে তার কথার ফুলঝুরি দিয়ে আজ তার মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছে না। কষ্ট করে বলছে দুই একটা কথা তাও অনেক ভেবে। কিন্তু ইহান সেটা বলতে চায়ছে না। আর ইহানকে জিজ্ঞাষাও করা যাবে না। কারন ইহান যে লেভেলের ঘাড়ত্যাড়া ছেলে জিজ্ঞাষা করলে তো আরও কিছু বলবে না।তাই নিজে থেকেই কিছু বলবে এই আসায় জান্নাত ইহানের দিকে তাকিয়ে থাকল।

– ভাবী একটা রিকুয়েষ্ট ছিল।।

– বল।।

– তোমার বোনকে নিয়ে একটু বাইরে যেতাম। একটা কাজ ছিল তাই, বেশীক্ষন না এই ঘন্টা খানেক মত।

জান্নাত কিছুক্ষণ কি জানি ভেবে বলল আচ্ছা আমি অর্থীকে রেডী হতে বলছি।

ইহান কিছু না বলে ভাবলেসহীন ভাবে সোফায় বসে পড়ল। আজ তার অর্থীর সাথে কথা বলতেই হবে। সে যে আর পারছে না। এ কয়েকটা দিন ও ট্রাই তো কম করল না অর্থীর থেকে দুরে থাকতে কিন্তু পাড়ল তো না। তাই আজ অর্থীর সাথে কথা বলতেই হবে। অর্থী মেয়েটা যে কেন বুঝছে না ইহানকে । এ কয়টা দিন ইহানের কাছে এক একটা বছরের মত কেটেছে। মনে হচ্ছিল অর্থীকে ছাড়া ও মরেই যাবে। খাওয়া ঘুম কিছুই ঠিক মত হয় নি।এতোদিন ও নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রেখেছিল। জান্নাতকে যে প্রজেক্ট এর কথা বলল তাও মিথ্যা ছিল। এই কয় দিন ও কোথাও যায়নি। না গিয়েছে ভার্সিটিতে,, না গিয়েছে বন্ধুদের আড্ডায়। কিন্তু আর না পেড়ে আজ জান্নাতের বাড়িতে উপস্থিতি হয়েছে।

জান্নাত অর্থীর ঘরে গিয়ে ইহানের কথা বলল। অর্থী আজ অন্য দিনের মত না বলল না।অর্থীও যেতে চায় আজ ইহানের সাথে। আজ ইহানের সাথে ওর শেষ বোঝাপড়াটা করতে হবে। অর্থী বুঝতে পারছিল যে ইহানও ওর মায়ায় পড়ে যাচ্ছিল। তাই আজ সেই মায়টা চির তরে কাটাতে হবে। অর্থী কিছু না বলে রেডি হতে গেল।

ইহানের গাড়িটা এসে থামল বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনে। এটা জান্নাতের বাসার কাছাকাছি।। যেহেতু জান্নাতকে কথা দিয়েছিল যে বেশীক্ষন রাখবে না তাই দুরে কোথাও নিয়ে যায় নি ও অর্থীকে। গার্ডেনের ভিতর ঢুকে ওরা দুজন পাশাপাশি হাটতে থাকে কেউ কারও সাথে কোন কথা বলে না।

হাটতে হাটতে ওরা অনেকটা দুরে চলে এসেছে। এখানে মানুষের আনাগোনা অনেক কম।। হাটতে হাটতে অর্থী সামনে তাকিয়ে একটা কাপল দেখল। ছেলেটা একজন ফুলওয়ালীর কাছ থেকে ফুল কিনে মেয়েটাকে দিচ্ছে।। অর্থী কিছুক্ষন সেই দিকেই একমনে তাকিয়ে থাকল। দৃষ্টি এড়ালো না ইহানেরও। ও অর্থীর দিকে তাকাতেই দেখল অর্থী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের দিকে হাটতে লাগল।

অর্থী কিছু না বলে একমনে হেটেই যাচ্ছিল হঠাৎ দেখল ওর সামনে একটা ফুল। ফুলটা নিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলো ইহান হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে। অর্থী কিছু না বলে হাটতে লাগল, সাথে ইহানও। ইহান কিছুক্ষণ পর আর একটা ফুল বের করে ধরল অর্থীর সামনে। অর্থী কিছু না বলেই সেটা নিয়ে নিল। তার কিছুক্ষণ পর ইহান আবার সেই কাজটা করল। অর্থী সেটাও নিল। ইহান আবার অর্থীর সামনে ফুল ধরলে অর্থী দড়িয়ে পরে। দড়িয়ে ইহানের দিকে তাকিয়ে বলল আর কয়টা আছে বের করুন একসাথে। ইহান পিছন থেকে পুরো একতোড়া ফুল সামনে এনে ধরে। অর্থী হা হয়ে দড়িয়ে আছে। সেই ফুলওয়ালীর কাছে যতগুলো ফুল ছিল সবগুলোই ইহান নিয়ে এসেছে। এটা দেখে অর্থী হাসবে নাকি কাদবে বুঝতে পারছে না। ও হা করেই রইল ইহানের দিকে তাকিয়ে।

হঠাৎ ইহান হাটু গেড়ে বসে সেই সব গুলো ফুল অর্থীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

গল্পের সূচনা তোমাকে দিয়েই
উপসংহারেও রয়েছ তুমি,
মাঝখানে কিছু অবাক নিরবতা
আর কিছু কিছু পাগলামি।

তোমাকে দেখলে এলোমেলো হয়ে যায়
আমার কবিতার অন্ত্যমিল,
হটাত করেই বিবর্ণ হয়ে যায়
মধ্য আকাশের নীল।

অবুঝ স্বপ্নগুলো তোমায় ঘিরে
কল্পনাতেও তোমায় দেখি,
নির্ঘুম রাত্রিগুলো তোমার জন্য জাগা
তোমার ছবি হৃদয়ে আঁকি।
তাই তো তোমায় অনেক বেশী আমি ভালোবাসি।

বলেই ইহান তার হাতটা অর্থীর দিকে বাড়িয়ে দিল। এতোক্ষন অর্থী নিশ্চুপ হয়ে ইহানের দিকে তাকিয়ে ছিল। অর্থীর বুকের মধ্যে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছিল । ইহান হাত বাড়াতেই অর্থী দু পা পিছিয়ে গেল। ইহান উঠে দাড়াল। অর্থী ইহানের দিকে তাকিয়ে কঠিন ভাবে বলল sorry, but i don’t feel like anything for you…..

বলেই অর্থী দৌড়ে চলে গেল আর ইহান সেখানেই বসে পড়ল।

সেখানে বসেই ছিল ইহান। হঠাৎ অর্থীর কথা মনে পরতে উঠে দড়াল। বাইরে এসে দেখলো অর্থী রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আছে। ইহান জানে অর্থী ঢাকার কিছুই সেরম ভালো করে চিনে না। তাই এভাবে দাড়িয়ে আছে। ইহান অর্থীর কাছে গিয়ে বলল “গাড়িতে বস আমি পৌছে দিচ্ছি।” অর্থী ইহানের দিকে তাকালো। ইহান কথাটা অনেক স্বাভাবিক ভাবে বললেও ওর মনে যে কালো মেঘের ভেলা তা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অর্থী আর কিছুই বলতে পাড়ল না। তাই চুপচাপ গিয়ে গাড়িতে বসে পড়ল । ইহানও এসে ড্রাইভিং সিটে বসল। অর্থীর দিকে না তাকিয়েই বলল “সিট বেল্টটা বেধে নাও।” অর্থী নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল সত্যি ও সিট বেল্টটা লাগায় নি। কিন্তু এতে ওর কোন খেয়ালই ছিল না। কিন্তু ইহান ঠিক নোটিশ করেছে। অর্থীর এখন চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছা করছে, কেন তুমি আমাকে এতো ভালোবাসলে। কই যখন আমি ভালোবেসেছিলাম তখন তো ফিরেও তাকাও নি। কিন্তু আজ কেন? কেন আমাকে আবার মায়ায় জরিয়ে ফেলছ? ইচ্ছা করছে চিৎকার করে বলতে হ্যা ভালোবাসি তোমায় অনেক বেশী। কিন্তু অর্থী আজ নিয়তির কাছে পরাজিত। সে চাইলেও এখন কিছুই করতে পাড়বে না। তাই দুদিনের এই বিরহই ভাল, দুই দিন পর ইহান ভুলে যাবে হয়তো অর্থীকে ।

অর্থীর ভাবনায় ছেদ ঘটিল ইহানের গাড়ি ব্রেক করাতে। অর্থী গাড়ি থেকে নেমে সোজা বাসায় চলে যায়। ইহান সেখানে অনেকক্ষণ দাড়িয়ে ছিল যদি অর্থী ফিরে এসে বলে আমিও তোমায় ভালোবাসি। কিন্তু না অর্থী ফেরে নি। অর্থী বাসায় গিয়ে সোজা তার রুমে গিয়ে দড়জাটা লাগিয়ে দেয়। জান্নাত কিছু বলার আগেই অর্থী দড়জাটা লাগিয়ে দেয়। জান্নাতও আর ডাকে না অর্থীকে। অর্থী ওয়াসরুমে গিয়ে শাওয়ারটা ছেড়ে তার নিচে বসে পরে ধপ। তারপর চিৎকার করে কান্না শুরু করে।

প্রায় এক ঘন্টা পর অর্থী বের হয় ওয়াস রুম থেকে। তার পর বিছানায় শুয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না শুরু করে। সে রাতে আর অর্থী কারও সাথে কথা বলে নি। শুধু একবার গিয়ে জান্নাতকে জানিয়ে এসেছে যে কালই ও বাসায় চলে যাবে। জান্নাত ও আর নিষেধ করে নি। জান্নাতও অর্থীকে নিয়ে বেশ চিন্তিত কিন্তু কিছুই করার নেয়। ভাবল বাসায় গেলে হয়তো
ঠিক হয়ে যাবে তাই আর আটকায় নি।

পরের দিন সকানে শুভ্র অর্থীকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে আসে। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল একটা গল্পের আর আজ আবার এখানেই সেই গল্পটা আমি শেষ করে দিলাম। এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে এই গল্পটা এর বাইরে প্রকাশ পাবে না এই অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প। অর্থী ফিরে যায় ওর চিরচেনা শহরে।

আজ ঢাকা থেকে আসা পনের দিন হল। এখনও অর্থী ভুলতে পারছে না তার ইহানকে। মনে পরে যাচ্ছে সেই তিন বছর আগের স্মৃতি। অর্থীর চোখের পাতায় আবার ভেসে উঠল সেই তিন বছর আগের ঘটনা গুলো।

তিন বছর আগে,

তখন অর্থী কেবল এস.এস.সি পাশ করেছে। GPA অনেক ভালো হওয়ায় চান্স পেয়ে যায় শহরের একটি সনামধন্য কলেজে। অনেক ভালো সময় কাটছিল অর্থীর। ক্লাস, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, হাসি মজায় সে পার করছিল এক একটা দিন। অর্থী অনেক হাসি খুশি এবং মিসুক সভাবের মেয়ে ছিল। খুবই প্রানচঞ্চল, আর আড্ডার মধ্যমনি ছিল সে। খুব সহজেই সাবাইকে হাসাতে পারত। তাই ক্লাসের সবাই ওকে অনেক পছন্দ করত। তাই ক্লাসের প্রত্যেকটা student ই ছিল ওর ফ্রেন্ড। হঠাৎ সব এলোমেলো করে দিল একটা ছেলে এসে।

অর্থীরা যে বিল্ডিং এ ক্লাস করত ঠিক তার পেছনে একটা বড় মাঠ ছিল। একদিন অর্থী ক্লাস থেকে বের হওয়ার সময় শুনতে পেল কে যেন গিটার বাজাচ্ছে। অর্থী ক্লাস রুমের সামনের বারান্দায় দাড়াতেই দেখতে পেল সেই মাঠটি। সেখানে কেউ একজন বসে গিটার বাজাচ্ছে। ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে না কারন সে উল্টো দিক হয়ে বসে আছে। অর্থী সেখানে দাড়িয়েই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেই গিটার বাজানো শুনতে লাগলো। চারপাশের কোন কিছুতেই তার কোন মনোযোগ নেয়। হঠাৎ ঘোর কাটলো এক ফ্রেন্ডের ডাকে। তাড়াহুড়া করে মাঠের দিকে তাকাতেই দেখল যে চলে গেছে সেই গিটারিস্ট। অর্থী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার ফ্রেন্ডের সাথে চলে গেল।

সেখান থেকে ওরা ওদের আড্ডার জায়গায় গেল। কিন্তু আজ অর্থীর আড্ডায় কোন মনোযোগ নেয়। সকল মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে সেই গিটারিস্ট ছেলেটা। তাই অর্থী সেখানে বেশীক্ষন না থেকে বাসায় চলে আসল। বাসায় সবার সাথে সারাটা দিন আনন্দেই কাটাল।

কিন্তু রাতের ঘুমও যেন কেড়ে নিয়েছে সেই ছেলেটি। বারবার অর্থীর কানে শুধু সেই গিটারের আওয়াজটাই ভেসে আসছিল। এতো মিষ্টি করে অর্থী আর কখনও কাউকে গিটার বাজাতে দেখেনি। সারাটা রাত এপাশ ওপাশ করে সকালের দিকে একটু ঘুমাল অর্থী।

পরের দিন কলেজে প্রত্যেক দিনের মত ক্লাস করে বের হচ্ছিল অর্থী। আবার তার কানে সেই গিটারের সুরটা আসল। সে আবার বারান্দা দিয়ে মাঠের দিকে তাকালো। কালকের মতো করেই আবার কেউ একজন বসে গিটার বাজাচ্ছে। অর্থীর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এটা সেই ছেলেটাই। অর্থী আবার মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল সেই গিটারের সুর।

আজও অর্থী বুঝতে পারল না কখন ছেলেটি উঠে চলে গেছে। অর্থীর অনেক মন খারাপ হয়ে গেল। সে ওই ছেলেটার সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু ছেলেটার গিটারের সুর শুনলে অর্থী সব ভুলে যায় আর বারবার ছেলেটা তার ধরাছোয়ার বাইরে চলে যায়।

সেদিনও অর্থী আর আড্ডা না দিয়ে বাসায় চলে আসে। আর ভাবতে থাকে যে করেই হোক কাল সেই ছেলেটার সাথে কথা বলতেই হবে।

পরের দিন কলেজে গিয়ে খুজতে থাকে সেই গিটারিস্কে কিন্তু অর্থী তো ছেলেটার মুখই দেখে নি তাই আর খুজে পেল না। তাই সিধান্ত নিল আগে সেই ছেলেটা মুখ যে করেই হোক দেখতে হবে। তাই অপেক্ষা সেই সময়ের।

দেখতে দেখতেই সব ক্লাস শেষ হয়ে গেল আর অর্থী গিয়ে দাড়াল মাঠের একটা পাশে। ওখান থেকে পুরো মাঠটা দেখা যায় কিন্তু ওকে কেউ দেখতে পাবে না। অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়। আগমন ঘটে সেই নাম না জানা, অদেখা গিটারিস্টের। এসেই মাঠের মধ্যখানে বসে পড়ে। হাতে গিটারটা নিয়ে আবার বাজাতে শুরুকরে। আজ আবার গিটার বাজানোর সাথে গানও গাইছে। উফ কি সুন্দর গানের গলা। যেন মুক্তা ঝরছে গলা দিয়ে। অর্থীর ইচ্ছা করছে একছুটে গিয়ে সামনে বসে পড়ে। আর গাতে হাত দিয়ে সেই গিটারের সুর আর মনোমুগ্ধকর গান শুনতে শুনতে হারিয়ে যায় কোন সপ্নের রাজ্যে।

কিন্তু না আজ ভাবনার জগতে হারালে চলবে না। আজ যে করেই হোক কথা বলতে হবে সেই গিটারিস্টের সাথে। গানটা শেষ করে, গিটারটা ঘারে নিয়ে উঠে পরে সেই গিটারিস্ট। অর্থীর হাত পা কাপা শুরু দিয়েছে। আজ পর্যন্ত কোন মানুষের সাথে কথা বলতে ওর এমন হয় নি। খুবই ফ্রিকুয়েন্টলি কথা বলতে পারে ও সবার সাথে। কিন্তু আজ কেন এমন হচ্ছে।

ছেলেটা উঠেই হাটতে শুরু করে। অর্থী কি করবে না করবে ভেরবেই দৌড়ে গিয়ে ছেলেটার সামনে গিয়ে দাড়ায়। এভাবে তার সামনে কেউ দাড়িয়ে দেখে প্রথমে ছেলেটা ঘাবড়ে যায়। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে একটা হাসি নিয়ে বলে ওঠে, ইয়েস, কিছু বলবেন ?

কি সুন্দর সেই হাসি। এই হাসি দেখে অর্থীর সব উলপালট হয়ে যায় । হাসিটা গিয়ে অর্থীর একদম বুকের পাশে বিধে। অর্থী যা বলবে ভেবে এসেছিল সব ভুলে যায়। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এবার ছেলেটা অর্থীর সামনে একটা তুরি বাজিয়ে বলল “কিছু বলবেন আমায়? এভাবে দৌড়ে সামনে এসে দাড়ালেন যে।”

অর্থী কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

– হাই, আমি অর্থী। এবার এইচ. এস. সি প্রথম বর্ষের student…

– আমি ইহান। দ্বীতিয় বর্ষ।
আর কিছু??

– না মানে আপনি অনেক সুন্দর গিটার বাজাতে পারেন আর আপনার গানের গলাটাও অনেক সুন্দর।

– thanks….

– can we be friends??

– sorry?

– না কিছু না ভাইয়া। আসি।

– ওকে, আল্লাহ হাফেজ।

বলেই ইহান চলে গেল আর অর্থী নিজের মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল “কি বলতে এসেছিলি আর কি বললি এসব। কি ভাবলেন উনি কি জানি। অর্থী তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না” বলেই সেখানেই বসে পড়ল।

অর্থী অনেক হাসিখুসি আর পরোপকারী মেয়ে হওয়ার জন্য ও টিচারদের কাছেও অনেক পপুলার। প্রত্যেক টিচার ওকে মেয়ের মতো আদর করে। তাই অর্থী ওর ওই র্সোস দিয়ে ইহানের সকল ইনফরমেশন বের করে নেয়। কিন্তু তারপর থেকে ও আর কখনও ইহানের সামনে যেত না। ভয়, লজ্জা নাকি আরষ্ঠতা তা অর্থী জানে না। কিন্তু অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও যেতে পারে নি ও ইহানের সামনে।

প্রত্যেক দিন অর্থী সেই প্রথম দিনের জায়গাটাতে বসে বসে ইহানের গান শুনে। ইহানের গান শুনলে মনে হয় অনেক বড় বড় গায়কও ইহানের সামনে তুচ্ছ। কেন এমন মনে হতো তা অর্থী জানে না।

এভাবেই কাটতে থাকে দিন। পার হয় যায় মাস, বছর ঘনিয়ে আসে। কিন্তু আজও অর্থী ইহানের সামনে যাওয়ার সাহস যোগাতে পারে নি। কিন্তু এ কয়দিনে অর্থীএটা বুঝতে পারে যে ও ইহানকে ভালোবেসে ফেলেছে ভীষন ভাবে। যতোটা ভালোবাসলে একটা মানুষকে ছাড়া আর কিছুই ভাবা যায় না ঠিক ততোটা। অর্থীর কাছে ইহানই হয়ে ওঠে ওর পৃথিবী। যদি কোন কারনে ইহান কলেজে না আসে তো অর্থী অস্থির হয়ে যায়। মাঝে মাঝেই ইহানদের ক্লাসের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে থেকে ইহানকে দেখে। মাঝে মাঝে টিচারের কাছে ধরাও পরেছে। এটা ওটা বলে কাটিয়ে দিয়েছে। আর টিচাররাও অর্থীকে ভালো মেয়ে হিসেবে জানে তাই কিছু বলে না তেমন। এভাবেই ধিরে ধিরে অর্থী পাগলামো বাড়তে থাকে ইহানের প্রতি। কিন্তু ইহান এ সকল কিছু থেকেই ছিল অজানা।

ভালোই চলছিল অর্থীর দিন ইহানকে ঘিরে। কিন্তু সব সুখ সবার কপালে সই না। অর্থীরও সইলো না। কিংবা হয়তো ও অনেক দেরী করে ফেলেছি। ইহানের ফ্রেন্ড সার্কেলে একটা মেয়ে ছিল যে ইহানের অনেক ক্লোজ ছিল। অর্থীর ওকে নিয়ে কোন প্রবলেম ছিল না। মেয়ে ফ্রেন্ড থাকতেই পারে অর্থী শিক্ষিত একটা মেয়ে এসব লেম জিনিষ পত্র ওর মাথায় আসে না কিন্তু ওর ধারোনাটা ভুল প্রমানিত হলো।

অর্থী এর আগেও শুনতো ইহানকে ওর ফ্রেন্ডরা সেই মেয়েটাকে ( অবনী) নিয়ে পচাতো।। ইহান তাদের পাত্তা না দিয়ে সেই হাসিটা দিত যেটা একদম অর্থীর বুকের বা পাশে গিয়ে লাগে। অর্থী কোন কিছু মনে করতো না।

একদিন গিয়ে অবনি আর ইহানকে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখে অর্থী। আর ইহান তখন গান করছিল। ইহান গানটা অবনির চোখের দিকে তাকেয়ে করছিল। যেন ইহান অবনির চোখের মধ্যে হারিয়ে গেছে গান করতে করতে। আর অবনি অনেক লজ্জা পাচ্ছে। গান শেষ হতেই ইহানের ফ্রেন্ডরা আবার বলতে শুরু করে,

প্রথমজন: কি রে চোখের মধ্যে হারিয়ে গেলি নাকি?

দ্বীতিয়জন: তাহলে এতো দিন তুই অবনিকে ডেডিকেট করেই গান করতি, আজ এই রহস্য বুঝতে পারলাম।

তৃতীয়জন: ( একটু হেসে) দেখ এভাবে মজা নিস না। দেখছিস না দুজনেই কি পরিমাণ লজ্জা পাচ্ছে।

বলেই সবাই হাসতে শুরু করল। অর্থী তখন কিছু দেখতে পাচ্ছে না আর ওর চোখ দুটো পানিতে ঝাপসা হয়ে গেছে। বুকের মধ্যে মনে যেন কেউ ছুরি চালিয়ে দিল। এর মধ্যেই আর একজন বলে ওঠে,

অন্যজন: সত্যি তোদের দুজনকে না একসাথে অনেক সুন্দর মানায়।

আরেকজন: হুম, একদন যেন মেড ফর ইচ আদার।

অর্থী সেখানে আর এক মুহু্র্তও থাকতে পারলো না কাদতে কাদতে সেই স্থান ত্যাগ করল। বাসায় এসেও অনেক কাদল। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।

হঠাৎ ননে হলো ইহানকে কখনও বলতে শোনে নি যে ও অবনিকে লাইক করে। এটা তো সবার ভুল ধারনা হতে পারে। এটা ভেবে অর্থী একটু স্বস্তি পেল। সে ভাবল না আর দেরী করবে না। কালই ইহানকে ওর মনের কথটা জানাবে, তারপর ইহান ডিসাইড করবে ও অর্থীকে ফিরিয়ে দেবে না কি! ইহান যাই করুক না কেন অর্থী ইহানের ডিসিসানকে সম্মান করবে।

যেই ভাবা সেই কাজ। অর্থী পরের দিন কলেজে গিয়ে সেই যায়গায় চলে গেল যেখানে ইহান আর ওর ফ্রেন্ডরা বসে আড্ডা দেয়। হ্যা, অর্থী আজ সবার সামনেই ইহানকে ওর মনের কথাটা জানাবে।

সেখানে যেতেই অর্থী দেখতে পেল ইহান আর তার ফ্রেন্ডরা প্রত্যেকদিনের মতো গোল হয়ে বসে আছে। আজও ইহানের পাশেই অবনি বসে আছে। তারপর যা দেখল তা দেখার জন্য অর্থী মোটেও প্রস্তুত ছিল না।। ইহান একটা ফুল নিয়ে অবনিকে প্রপোজ করছে। আর ইহানের সব ফ্রেন্ডরা বসে হাততালি দিচ্ছে।

অর্থী সেখানে আর এক মুহু্র্তও থাকতে পারলো না। কাদতে কাদতে সোজা বাসায় চলে এলো। বাসায় এসেই রুমের দড়জাটা লাগিয়ে চিৎকার করে কাদতে লাগলো। আজ আর এই কান্না থামার নয়। এ যে সব কিছু হারানোর কান্না।

অর্থীর মা বাইরে থেকে অর্থীকে ডেকেই যাচ্ছে কিন্তু অর্থী কিছুতেই দড়জাটা খুলছে না। শেষে অর্থী মা না পেরে অর্থী বাবাকে কল করল। মেয়ের এ অবস্থা শুনে উনি অতি দ্রুত বাসায় চলে আসলেন। মেয়েকে অনেক ডাকার পর দড়জা খুলল কিন্তু মেয়েকে দেখে উনারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

অর্থী ওর বাবা মার এক মাত্র মেয়ে। ওর বাবা কোন দিন মেয়ের গায়ে ফুলের টোকাটাও লাগতে দেন নি। আর আজ তার মেয়ে কেঁদে কেঁদে কি অবস্থা করেছে নিজে। তাই তো মেয়ের এই অবস্থা দেখে তারা ও ঠিক থাকতে পারেন নি। অর্থীর মা অর্থীকে কিছু জিজ্ঞাষা করতে গেলে বাবা থামিয়ে দেয়।

অর্থীর বাবা তার মেয়েকে ফ্রেস করে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। অর্থীর মা অর্থীর বাবাকে বলে,

– তুমি কেন জিজ্ঞাষা করতে দিলা না যে কলেজে এমন কি হয়েছে যে ও এভাবে কান্না করছে।

– তুমি দেখতে পারছে না আমাদের মেয়ের অবস্থা। এ সময় ওকে কিছু জিজ্ঞাষা করা বৃথা। একটু স্বাভাবিক হোক। দেখবে ও নিজেই আমাদের সব বলবে। এই বিশ্বাসটুকু আমার মেয়ের উপর আমার আছে।

সে দিনের পর থেকেই অর্থী অনেক বেশী চুপচাপ হয়ে যায়। কারও সাথে প্রয়োজনের বেশী কথা বলে না। কলেজেও যায় না। সারাটা দিন ঘরের মধ্যে একা একা বসে থাকে। অর্থীর বাবা মেয়ে মুড চেন্জ করার জন্য ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার প্লান করে।

এভাবে কিছুদিন পর অর্থী একটু স্বাভাবিক হয়। তার কিছুদিন পর থেকে অর্থী কলেজে যাওয়া শুরু করে। ততোদিনে ইহান এইচ. এস. সি পরীক্ষা দিয়ে একটা ভার্সিটিতে এ্যাডমিশন নিয়েছে।

ইহান নেয় কিন্তু ইহানের স্মৃতি সারা কলেজময় ছড়িয়ে রয়েছে। আজও অর্থী সেই জায়গাটাতে গিয়ে বসে থাকে যেখানে বসে ইহান আর ওর ফ্রেন্ডরা আড্ডা দিত। জায়গাটা আজও আছে কিন্তু মানুষগুলো আর নেয়।

হঠাৎ অর্থীর ঘোর ভাঙ্গে ফোনের শব্দে। এতোক্ষন সে ওর অতীতে ডুবে ছিল। ফোনটা হাতে নিতেই দেখে যে একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল এসেছে। ধরবে ধরবে না ভাবতে ভাবতেই কেটে গেল কলটা। আবার কল আসল। এবার অর্থী ফোনটা ধরল।

– হ্যালো।।

– নিশ্চুপ।।।

– হ্যালো কে বলছেন??

– আবারও নিশ্চুপ।।

এবার অর্থী একটু রেগেই বলল,

-আরে আজিব কে বলছেন? কথা না বললে ফোন দিয়েথেন কেন? ( বলেই ফোনটা কাটতে গেলে ওপাশ থেকে বলে ওঠে)

– হ্যালো।।

– ইহান!!

– চিনতে পেরেছ তাহলে।

– আপনি আবার কেন ফোন দিয়েছেন?

– বেশী ডিসর্টাব করব না। just last বারের মতো একবার দেখা করতে চায়। please….

অর্থী ইহানের আকুতি মাখা আবদার ফেলতে পারে না। বলে ওঠে,

– কোথায় আর কখন দেখা করতে চান?

– জায়গাটা আর সময়টা টেক্সট করে দিচ্ছি আমি তোমাকে।

– আচ্ছা আল্লাহ্ হাফেজ।

– আল্লাহ্ হাফেজ।

অর্থী একটা নদীর পাড়ে বসে আছে। ইহানের জন্য অপেক্ষা করছে। ইহান এখনো আসে নি। অর্থী বসে বসে ভাবছে আবার কি বলতে চায় ইহান? কেন ওকে আবার দেখা করতে বলল? এসব ভাবছিল এমন সময় ইহান একটা ফাইল অর্থীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে “এটাই কি আমাকে রিজেক্ট করার আসল কারন।”

অর্থী ফাইলটার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। এই ফাইলটা ইহান কোথায় পেল?

চলবে,,,,,,,

#জাকিয়া_সুলতানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here