ভালোবাসার উষ্ণতা পর্ব ১+২

পেটে কারো স্পর্শ পেতেই গা শিরশির করে উঠলো প্রাপ্তির। চোখে ঘুমের সাগর এসে ভর করায় চোখ খুলতে পারছে না। রাত যে বেশ হয়েছে এটা বুঝতে বাকি নেই, এতো রাতে তার ঘরে কারোর আসা সম্ভব নয়। কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছে, কেউ তার ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে। চোখ খুলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না, চিৎকার করছে; কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। ব্যাক্তিটির হাত তখন প্রাপ্তির সারা শরীরে স্পর্শ করছে। একটা সময় পর তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। প্রাপ্তি আপ্রাণ চেষ্টা করছে নড়তে; এই বাঁধন থেকে বের হতে চাইছে কিন্তু পারছে না। অজানা ব্যক্তিটি কে?

সকাল ৭ টা,
ঘুম ভাঙলে প্রথমেই আশেপাশে নজর ঘোরালো প্রাপ্তি, নাহ কেউ ঢুকে নি তার ঘরে। দরজাটাও ভেতর দিয়ে বন্ধ। শুধু তার পাশের বিছানা চাদরটা খানিকটা কুচকানো, এই বাদে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা না। বেশ কিছুক্ষণ মাথাটা দু হাত দিয়ে চেপে বসে থাকলো, রাতে যা হয়েছে তা কি স্বপ্ন ছিলো! তবে কি সে ঘোরে ছিলো! মাথাটা বন্ধ বন্ধ লাগছে, সাওয়ার নিলে হয়তো ভালো লাগবে। ওয়াশরুমে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই আৎকে উঠলো প্রাপ্তি। খেয়াল করে দেখতে পেলো তার গলার খানিকটা নিচে বুকের ঠিক উপরে কিছুটা জায়গা লাল হয়ে আছে। এর মানে কি!! ভয়ে হাত পা জমে গিয়েছে। বাস্তব এবং স্বপ্নের ভেতরে নিজেকে যেন আটকে ফেলেছে প্রাপ্তি; কিছুতেই বের করতে পারছে না। এ নিয়ে এই সপ্তাহে তিন বার এমন হলো। শাওয়ার নেওয়ার পরও মনকে শান্ত করতে পারছে না কিছুতেই। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো ঘড়ির বড় কাঁটাটা আটটার উপর বসে আছে। আটটা বেজে গেছে, আবরারের খাবারের সময় হয়ে এসেছে। তার সামনে যেতে না পারলেও লোকটাকে প্রতিদিন খাবার নিজের হাতে বানিয়ে খাওয়ায় প্রাপ্তি।

সিকদার ভিলায় আজ তিন মাস হয়েছে বিয়ে হয়ে এসেছে সে। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে চাচাদের বাড়িতে মানুষ হয়েছে; আঠারো বছর হতে না হতেই চাচা-চাচীর ঘরে যেনো বোঝা হয়ে গিয়েছিলো। এই সিকদার বাড়ির বড় ছেলে আবরার সিকদারের সাথে তার বিয়ে হয় তিন মাস আগে। আবরার যেনো নামেই প্রাপ্তির হাসবেন্ড, এই পর্যন্ত প্রাপ্তি তাকে দেখি নি। কারণ সে বরাবরই অসুস্থ থাকে। প্রাপ্তি যতটুকু শুনেছে, একবার তার অনেক ভয়াবহ একটি এক্সিডেন্ট হয়, এক্সিডেন্টের পর থেকে আবরার আর হাটতে পারে নি, তার শরীরের বেশ খানিকটা অংশ এবং মুখের বেশ খানিকটা অংশ পুড়ে গেছে। বাসর রাতে প্রথম প্রাপ্তির সামনে এসেছিলো সে। সেদিন ঝড় বৃষ্টির রাত ছিলো, খুব জোরে জোরে আকাশ ডাকছিলো, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিলো। এমনিতেই বিদ্যুৎ চমকানো প্রাপ্তির ভয় লাগে। প্রচুর গা ছমছম করছিলো তার; তাই হুট করে আবরারকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিলো। তার পর থেকে প্রাপ্তির সামনে আসে নি আবরার। প্রাপ্তি তাকে ভালোভাবে দেখেও নি, বারবার ক্ষমা চেয়েছে কিন্তু তাতে তার রাগ পড়ে নি। যখনই প্রাপ্তির সাথে কথা বলে রুমের লাইট অফ করে তারপর কথা বলে যাতে প্রাপ্তি তাকে না দেখতে পারে। এতো কিছু জানা সত্ত্বেও প্রাপ্তি এই বিয়েতে রাজি হয়, না না রাজি হতে বাধ্য হয়। চাচার ব্যবসা ভালো চলছিলো না, প্রচুর টাকার প্রয়োজন ছিলো। উপরে প্রাপ্তি যেনো তাদের কাছে বোঝা হয়ে গিয়েছিলো। তাই এই বাড়ির ছোট ছেলে অয়ন সিকদার মোটা অংকের টাকা দিয়ে প্রাপ্তিকে নিজের ভাইয়ের দেখভালের জন্য কিনে নিয়েছে। ভদ্র ভাষায় তার ভাইয়ের সাথে বিয়ে করতে বাধ্য করেছে। এই বাড়িতে শুধু এই দুই ভাই আর অনেক কাজের মানুষ রয়েছে। প্রাপ্তি যতটুকু শুনেছে, আবরারের মা-বাবা খুব ছোটবেলায় মারা যান। আরেকটি ভাই ও আছে কিন্তু সে এখানে থাকেন না। এই পরিবারের সবকিছুই প্রাপ্তির অদ্ভুত লাগে, মনে হয় হাজারো রহস্য ঘিরে রয়েছে এই বাড়ির আনাচে কানাচে।

প্রাপ্তির হাতের ভুনা খিচুড়ি আবরারের খুব প্রিয়, আজ শুক্রবার তাই প্রাপ্তি ঠিক করলো সে খিচুড়ি রান্না করবে। রান্নাঘরে তিন-চারজন কাজের মানুষ আছে। বড়লোক হওয়ার এটাই উপকার, নিজেদের কিছুই করতে হয় না। কিন্তু প্রাপ্তির এই বিলাসিতা পছন্দ নয়। তাই নিজ হাতে সব করতে পছন্দ করে সে। রান্নার মাঝে মনে হতে লাগলো কেউ যেন ঘাড়ের উপর গরম নিঃশ্বাস ফেলছে। আচমকা এমনটা হওয়ায় ঘাবড়ে পেছনের দিকে সরে যায় প্রাপ্তি। পেছনে তাকিয়ে যা দেখলো তাতে আরো ভয়ে জমে গেলো সে। এতোক্ষন অয়ন খুব নিখুঁতভাবে প্রাপ্তিকে পর্যবেক্ষণ করছিলো, কখন যে ধীরে ধীরে প্রাপ্তির কাছে চলে আছে এটা নিজেও খেয়াল করে নি। প্রাপ্তির অয়নকে খুব ভয় লাগে। ওর চাহনি যেন বিপদের সংকেত দিতে থাকে, আবার নিজের দিকেও খুব আকর্ষণ করে। প্রাপ্তি কিছুতেই বুঝে উঠে না, এই লোকটার ভেতর কি এমন আছে যা প্রাপ্তিকে নিজের দিকে টানে। তুড়ির আওয়াজে ঘোর কাটে প্রাপ্তির। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর নীল টিশার্ট গায়ে, পকেটে হাত দিয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অয়ন। ধীরে ধীরে প্রাপ্তির দিকে এগুতে থাকলে প্রাপ্তি পেছাতে থাকে ওয়ালের দিকে। রান্নাঘরে ওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে প্রাপ্তি থেমে যায়, ওদিকে অয়ন খুব কাছে চলে আসে প্রাপ্তির। কোমরে হাত দিয়ে হ্যাঁচকা টানে নিজের একেবারে কাছে নিয়ে আসে প্রাপ্তিকে সে৷ ভয়ে প্রাপ্তির চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মনে একটা ধুকপুকানি লেগে আছে। ঠিক ভুলের মাত্রা হারিয়ে ফেলেছে। কানের কাছে মুখ লাগিয়ে অয়ন বলতে থাকে,
– এভাবে পেট দেখিয়ে চললে, কি পুরুষের মন জয় করা যায়? কে বলবে তোমার স্বামী মানে আমার ভাই অসুস্থ? তুমি কি ভাবো আমি বুঝি না, সকাল সকাল এতো রুপ দেখিয়ে কাকে বশ করতে চাইছো? তোমার মত মেয়েরা যদি ন্যাংটা হয়ে আমার সামনে হেটে বেড়ায় তাতে এই অয়ন সিকদার পটবে না।

বলেই একরকম ধাক্কা দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে পড়লো অয়ন। অয়নের এই খারাপ ব্যবহার গুলো একেবারে নিতে পারে না প্রাপ্তি, কি এমন পাকা ধানে মই দিয়েছে তার। সব কিছুতে শুধু কিভাবে প্রাপ্তিকে নিচু দেখাবে সেটাই যেন একমাত্র কাজ অয়নের। প্রাপ্তির চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে, নিজেকে শান্ত করতে চাইছে কিন্তু হয়ে উঠছে না। আজ হয়তো বাবা-মা থাকলে এগুলো তাকে সহ্য করতে হতো না।

অপরদিকে,
আবরারের রুমে বসে আছে অয়ন। অক্সিজেন লাগানো অবস্থাতে শুয়ে রয়েছে আবরার। দিন পাঁচেক শরীরের অবস্থাটা ভালো নেই তার। ডাক্তার ইহরাম হক বলেই দিয়েছে, আবরারের বেঁচে থাকার ইচ্ছে টুকু নেই। একারণে তার রিকোভারির চান্স খুব কম। আবরারের ডান হাত নিজের হাতের মুঠোতে নিয়ে চোখের পানি ফেলে দিলো অয়ন।
– ভাই তুমি কমে সুস্থ হবে? তুমি কি সত্যি সেরে উঠবে না?? আজ যাদের জন্য তোমার এই হাল আমি তাদের নাকানিচোবানি খাওয়েছি, এখন মৃত্যুর অপেক্ষা করছে কেবল তারা।
-….
– ভাই, আমার তুমি বাদে কেউ নেই, আবীর খুব প্রেসার দিচ্ছে বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের। ওর ধারণা ও চাইলেই কোম্পানি সি.ই.ও হয়ে যেতে পারবে। আমি তা কিছুতেই হতে দিবো না। যেটা তোমার সেটার তোমার ই থাকবে। আর সিকদার পরিবারের সামনের উত্তরাধিকার যাতে দ্রুত আসে আমি সেই ব্যবস্থাই করছি।
– অয়ন বাবা, মেয়েটা তো সত্যিটা জানেই না!

সিকদার বাড়ির বিশ্বস্ত লোকমান কথাটা বলতেই অয়নের চোখ মুখ কুচকে যায়। রাগে মাথার রগ ফুলে উঠেছে। কঠিন গলায় বলে,
– ওই দু টাকার মেয়ের সত্যিটা জানার প্রয়োজন ও নেই। ওর কাজ আমাদের উত্তরাধিকার দেওয়ার। যতদিন ভাইয়ের সুস্থতা প্রমান না হবে ততদিন মেয়েটার এই বাড়িতেই থাকতে হবে।
– কিন্তু, ও তো
– একটা বাচ্চা জন্ম দেওয়ার টুল মাত্র। আপাতত অনেক কিছু সামলাতে হবে। ওই টাকার লোভী মেয়েটাকে নিয়ে না ভাবলেও চলবে লোকমান কাকা।

দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে অয়ন চুপ করে যায়। বাইরে প্রাপ্তি দাঁড়ানো, হাতে সকালের নাস্তা।
– শুনছেন, আমি আপনার খাবার এনেছি। আপনার যা যা পছন্দ সব বানিয়েছি। শুনছেন।

প্রাপ্তির কথা শুনে লোকমান কাকাকে ইশারা করে অয়ন। দ্রুত লোকমান কাকা দরজাটা খুলে খাবার গুলো নিয়ে দরজা দিয়ে দেয়। প্রাপ্তিকে কোনো কথা বলার সুযোগ টুকু দেয় না লোকমান কাকা। দরজার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে নিজের রুমে চলে যায় প্রাপ্তি। এটা তার নসিব, তার ভাগ্যে হয়তো সুখটা থাকে না।

রাত ১০টা,
প্রাপ্তি বিছানা করে শুয়ে পড়েছে। সারাদিন অয়ন কিংবা আবরারের সাথে কথা হয় নি। একা একা রুমে কাটিয়েছে। দরজাটা আটকিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে প্রাপ্তি। এ বাড়ির রহস্যগুলো মাথায় যেন একেবারেই ঢুকে না; প্রাপ্তির মাঝে মাঝে পালিয়ে যেতে মন চায়। কিন্তু যাওয়ার জায়গাও নেই। এখানে তবু আরামে আছে, চাচার বাড়ি চাচির মার সহ্য করার থেকে ঢের ভালো। ভাবতে ভাবতেই ঘুমের জগতে পাড়ি দেয় প্রাপ্তি। মাঝ রাতে আবার কারোর উপস্থিতি অনুভব করতে লাগে প্রাপ্তি। কেউ তার গলায় স্পর্শ করছে, গরম নিঃশ্বাস যেন বুকের ভেতরটা পুড়িয়ে দিচ্ছে। খুব করে চাচ্ছে যাতে চোখটা খুলতে পারে কিন্তু কিছুতেই তা সম্ভব হচ্ছে না। অচেনা ব্যক্তিটি যখন পায়জামায় হাত দিতে নিয়েছে অমনি…
#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#২য়_পর্ব

অচেনা ব্যক্তিটি যখন পায়জামায় হাত দিতে নিয়েছে অমনি প্রাপ্তি নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ব্যক্তিটিকে একটি ধাক্কা দেয়। লোকটি নিজেকে সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে যায়, ঝমঝম করে কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনতে পেলো প্রাপ্তি। এখনো ঘোরের মাঝেই রয়েছে সে। চোখে অন্ধকার দেখছে, বাস্তবতা আর স্বপ্নের মধ্যে নিজেকে আলাদা করতে পারছে। খুব কষ্ট করে হাতে ভর দিয়ে উঠে বসে প্রাপ্তি। ভয় করছে খুব তার, এই লোকটা কি চাই! কেনো তাকে এভাবে মোলেস্ট করছে। তাই সবই তার কল্পনা। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না সে, বিছানাতেই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলো প্রাপ্তি।

সকাল ৯টা,
ডাইনিং টেবিলে অয়ন আর প্রাপ্তি মুখোমুখি বসা। কাল রাতের ঘটনাগুলো বারবার নিজেকে ভাবাতে বাধ্য করছে প্রাপ্তিকে৷ রাতে কাঁচ ভাঙার শব্দ পেলেও সকালে কোনো কাঁচের টুকরো তো দূরে থাক কিছুর অস্তিত্ব পায় নি। তবে কি ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে সে? নাকি আসলেই কেউ তাকে পাগল করার অদম্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। অয়ন মিটিমিটি হাসছে আর নাস্তা করছে। প্রাপ্তির গলা দিয়ে যেন খাবার নামছে না। সত্য মিথ্যার আড়ালে গুমড়ে গুমড়ে থাকছে সে। প্রাপ্তির অবস্থা দেখে মনে মনে বলতে লাগলো,
– আজ যাদের জন্য আমার ভাইয়ের এই হাল, তাদের সুদে আসলে ফেরত দিবো। তুই ও বাদ যাবি না। তোর মতো লোভী মেয়েদের কিভাবে শাস্তি দিতে হয় খুব ভালো করে জানা আছে।
প্রাপ্তিকে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখে অয়ন টিটকারি সুরে বলে,
– আগে তো শুনেছি পচা গলা খাবার খাওয়া হতো, এই দামী খাবার বুঝি গলা দিয়ে নামছে না??
-……
– বলে না কুকুরের পেটে ঘি সয় না। এখন তো দেখছি ভিখারিদের ক্ষেত্রেও তাই প্রযোজ্য।

এবার নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না প্রাপ্তি। চোখ জ্বলছে, এখনই যেন অশ্রুধারাগুলো চোখকে মুক্ত হয়ে ঝরে পড়বে। চিৎকার করে বলতে লাগলো,
– হ্যা, ভিখিরি তো। আমি ভিখিরি, সব জেনে শুনে কেনো এই ভিখিরিকে নিজের ভাইয়ের জন্য পছন্দ করতে গেলেন? কেনো আনলেন এই বাড়িতে? যদি আমাকে আপনার ভালো নাই লাগে তাহলে কেনো আমার সামনে আসেন বলেন! আর আমি তো আপনার কেউ না, আমি ভিখিরি না বড়লোক তাতে কি যায় আসে আপনার? আর একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নিন, আমি ভিখিরি বলেই একটা পঙ্গু মানুষকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। পারলে আনুন তো কোনো বড়লোক খুজে, দেখি সে আপনার ভাইকে বিয়ে করে কিনা।

কথাটা শুনতেই অয়নের মুখের ভাব বদলে গিয়েছে, মুখ শক্ত হয়ে গেছে। তড়িৎগতিতে এসে প্রাপ্তির গলা টিপে ধরে সে। অয়নের চোখে মুখে পশুত্ব যেনো ফুটে উঠেছে। এক পর্যায়ে প্রাপ্তির দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়। বাড়ির সব কাজের লোকগুলো দৌড়ে এসে অয়নের হাত থেকে প্রাপ্তিকে ছাড়ায়। আর কিছু সময় গেলে হয়তো ওখানেই দম আটকে মারা যেত প্রাপ্তি। অয়ন ছাড়ার পর কিছুক্ষণ বড় বড় নিঃশ্বাস নেয় প্রাপ্তি। একটা কাজের মেয়ে দ্রুত পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় তাকে। পানিটুকু এক নিমিষেই ঢকঢক করে খেয়ে নেয়। এখনো প্রাপ্তির গা কাঁপছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। অয়নের অগ্নিদৃষ্টি এখনো শান্ত হয় নি। রাগের বসে দেয়ালে কিছুক্ষণ ঘুষি মেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

সন্ধ্যা ৭টা,
প্রাপ্তি আজ সারাদিন কিছুই খায় নি। এ বাড়ির খাবার যেনো বিশ লাগছে, পানি টুকু খেয়ে দিন কেটেছে তার। বারংবার অয়নের কথাগুলো মনে করে চোখ থেকে পানি পড়ছে। অয়নের প্রতি ঘৃণাটা যেনো আরো বেশি বেড়ে গিয়েছিলো, নিজের ব্যাগ থেকে মা-বাবার ছবিটা বের করে বিলাপ করে কাঁদতে লাগলো প্রাপ্তি।
– আমি কি অপদার্থ মা? কেনো আমায় ছেড়ে চলে গেলে? কি অপরাধ ছিলো আমার? আচ্ছা আমি কি জীবনে সুখ পাবো না? আল্লাহ বোধহয় সুখের বীজটা আমার ভাগ্যে দেয় নি। কষ্ট নিতে নিতে আমি যে আর পারছি না।

বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙে দরজায় ধামধাম করে ধাক্কা দেওয়ার শব্দ। এতো জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে যেনো দরজাটাই ভেঙে ফেলবে। চোখ কচলাতে কচলাতে ঘড়ির দিকে তাকালে দেখে ঘড়ির কাঁটা ১১টার কাছাকাছি। এতো রাতে কে আসতে পারে! কৌতুহল নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ায় প্রাপ্তি। দরজা খুলতে না খুলতেই অয়ন ব্যালেন্স হারিয়ে প্রাপ্তির গায়ে ঢলে পড়ে। সারা গায়ে বিশ্রী গন্ধ, বোঝাই যাচ্ছে কোনো এলকোহল বাদ দেয় নি সে। মাতাল অবস্থায় এতো রাতে এই বান্দাকে নিয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না প্রাপ্তি। কাউকে ডাকতেও পারছে না এই ভেবে যে, মানুষ কি বলবে। দেবর রাত ১১টায় ভাবীর ঘরে ঢুকে ব্যাপারটা পাঁচ কান হলে সবাই প্রাপ্তিকেই দোষাবে। চরিত্র নিয়ে কথা তুলবে। তাই না পেরে নিজেই কোনো মতে অয়নকে বিছানা অবধি নিয়ে যায় প্রাপ্তি। কোনো মতে শুইয়ে দিয়ে সরে যেতে নিলেই, প্রাপ্তির হাত ধরে হ্যাচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে আসে অয়ন। মাতাল অবস্থাতেই বলতে লাগে,
– খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি না? তোমাকে দেখলে মূহুর্তের মধ্যেই আমার ভেতরে আগুন দাও দাও করে জ্বলতে থাকে। আবার তোমার কাছে এলে আগুনটা কেমন শীতল হয়ে যায়। আমার যখনই মনে হয় তুমি আমার না, ইচ্ছে করে একেবারে খুন করে ফেলি তোমাকে। আবার যখন ভাইয়ের কথা মনে করলে পাগল পাগল লাগে৷
– কি বলছেন? শুনছেন? আমি তো বুঝতে পারছি না কিছু। কি করেছি আমি?
– আচ্ছা, ভালোবাসা মানেই কি কষ্ট। তুমি আমার ধীর বিষ, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আমি পান করতে চাই। তোমার উষ্ণতার ছোয়ায় নিজেকে হারাতে চাই। পরমূহুর্তে তোমার আসল রুপটা মনে পড়লেই জ্যান্ত কবর দিতে ইচ্ছে হয়। তোমার মায়া চেহারার পেছনে কাল নাগিনীটা যে আমার চেনা।

অয়নের কথাগুলো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে প্রাপ্তির। অয়ন বিরবির করে আরো কিছু বললো যা প্রাপ্তির কানে আসলো না। প্রাপ্তি নিজেকে ছাড়িয়ে অয়নের গায়ে কম্বল দিয়ে দিলো। এসির পাওয়ারটা বাড়িয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ালো প্রাপ্তি। মাথায় অয়নের বলা কথাগুলো মাথায় ঝেঁকে বসেছে। উফফ! এই লোকটা বিয়ের পর থেকেই শুধু বিরক্ত করছে। কি সমস্যা এই লোকের? কি বলে না বলে ঠিক নেই। প্রাপ্তির দৃষ্টি তখন বাইরের দিকে। সোডিয়ামের লাইটে রাস্তার ওই পাশে একটা মহিলা তার একটা ছোট বাচ্চা নিয়ে শুয়ে আছে। উদবাস্তু হয়েও মা টা তার বাচ্চাকে আগলিয়ে রয়েছে। প্রাপ্তির মূহুর্তে নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়তে লাগলো, একটা সময় তার মাও তাকে এভাবে আগলিয়ে রাখতেন। কিন্তু এটা তার পোঁড়া কপাল, কারোর হাতে কিছুই নেই।

ফজরের আযানের সময় ঘুম ভাঙ্গে প্রাপ্তির, নিজেকে বারান্দায় আবিষ্কার করে সে। ধীর পায়ে উঠে রুমের দিকে রওনা দেয় সে। বিছানার দিকে নজর যেতেই খেয়াল করলো অয়ন বেঘুরে ঘুমাচ্ছে। কতোটা নিস্পাপ লাগছে ছেলেটাকে, যেনো নিজের সাদা মনে ধুলিক্ণাটাও জমতে দেয় নি। এই সুন্দর নিস্পাপ চেহারার পেছনে একটা শান্ত পশু লুকিয়ে থাকে কখন যে সেটা কাউকে শেষ করে দিবে কেউ বলতে পারে না। ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে নামায পড়তে যায় প্রাপ্তি।

সকাল ১০ টা,
মুখের উপর ছিটা পানি পড়ায় অয়নের ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ খুলতেই দেখতে পায় এক রমনী, পরণে বেগুনী শাড়ি, খুব নিপুনভাবে নিজের চুল মুছে যাচ্ছে। সকালের স্নিগ্ধতা যেনো চুয়ে চুয়ে পড়ছে। রমনীটা আর কেউ না, প্রাপ্তি। এক মূহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো, তারা স্বামী-স্ত্রী। প্রতিদিন সকালটা যদি এভাবে শুরু হতো। অজান্তেই ঠোঁটে একটা মুচকি হাসি চলে এসেছে অয়নের। সুখের মূহুর্তটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারলো না। ফোনের শব্দে ঘোর কাটে অয়নের। রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে কানে আসে,
– যা করার দ্রুত করতে হবে।

মূহুর্তেই অয়নের মুখ শক্ত হয়ে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে নিজের আর আবরারের ছবি আলোকিত হতেই, নিজের ভেতরের আশার কুড়িগুলোকে মেরে ফেললো অয়ন। নিজের মনকে নিজেই বলতে লাগে,
– ভাইয়ের আজকের পরিণতির জন্য ও দায়ী। ওর সম্মান নষ্ট করা আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। এক তীরে দুই পাখি মারাটাই আমার কাজ। আজ যেমন ভাই বাঁচার কোনো আশা খুজে পাচ্ছে না, এই কাল নাগিনীর জীবনেও এমন দিন আনাই আমার লক্ষ্য।
প্রাপ্তির তুড়ির আওয়াজে ঘোর কাটে অয়নের।
– শুনছেন?? কখন থেকে ডাকছি। উঠে যখন গেছেনই এখন নিজের ঘরে চলে যান। আমি চাই না, বাড়িতে আমাদের নিয়ে কোনো বাজে কথা উঠুক।
– যদি এতোই নিজের রেপুটেশন নিয়ে চিন্তা তাহলে, ঘরে ঢুকানো হলোই বা কেনো আর আমাকে রাখা হলোই বা কেনো। লোকমান কাকাকে বললেই হতো। সত্যি বলতে কি শরীরের চাহিদা মেটাতে হবে তো। এসব মেয়ে নিজের স্বার্থর জন্য কতো নিচে নামতে পারে না আমার ভালো করে জানা আছে।

বলেই গটগট করে করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো অয়ন। নিজের চোখে নিজেকে আরো ছোট মনে হতে লাগছে প্রাপ্তির। সত্যিই তো নিজেকে টাকার জন্য বিকিয়ে দিয়েছে সে। নয়তো এতো অপমানের পড়েও কেনো এই সিকদার বাড়িতে পড়ে রয়েছে। অয়নের বিকট চিৎকার শোনা যাচ্ছে বাহিরে। রুম থেকে বের হতেই দেখে সবাই ছোটাছুটি করছে, ডাক্তার ডাকা হচ্ছে। সবাইকে ব্যস্ত দেখে কলিজায় কামড় পড়ে প্রাপ্তির। আবরারের কিছু হয় নি তো!! ঠিক তখনই পাশ থেকে শুনে….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here