ভালোবাসার উষ্ণতা পর্ব ৯+১০

#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#৯ম_পর্ব

প্রাপ্তি এক মিনিট দেরি না করে অয়নের রুমের দিকে রওনা হয়। সেখানে যা দেখতে পায় তাতে মূহুর্তে হাত পা জমে যায় তার। অয়ন তখন একটা ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে। ডান হাত থেকে টুপ টুপ করে রক্ত পড়ছে। ইজি চেয়ারের পাশে কালচে রক্তগুলো জমাট বেধে রয়েছে। লোকমান কাকা একমূহুর্ত দেরি না করে ডাক্তার ডেকে আনলেন। ডাক্তার হাতের রক্ত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে, সাথে ঘুমের ঔষধ খাওয়িয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। চলে যাবার সময় যাতে ডান হাতে পানি না লাগে সেদিকে খেয়াল করতে বলেছেন। অতিরিক্ত এলকোহলের নেশায় ভাঙ্গচুর করতে করতে হাতটা বাজে ভাবে কেটে গেছে অয়নের। প্রাপ্তির এরুপ রুঢ় আচরণ যেন একদম মেয়ে নিতে পারে নি অয়ন। অয়নের এই দুইটা দোষ, ওর রাগ আর ওর জিদ। এই দুইটায় অন্ধ হয়ে জীবনে কতো এ ভুল করেছে তার হিসেব হয়তো জানা নেই। প্রাপ্তি নিজের রুমের দিকে যেতে নিলে লোকমান কাকা তাকে থামিয়ে দেয়,
– মা, তোমাকে কিছু বলার আছে আমার।
– কি হয়েছে লোকমান কাকা?
– আজ তোমাকে কিছু কথা বলব। কথাগুলান আগেই বলা উচিত ছিলো। কিন্তু অয়ন বাবার জন্য বলতে পারি নাই। হয়তো কথা গুলো শুনলে তুমি অয়ন বাবার উপর আরো রাইগে যাবা। কিন্তু কথা গুলো না বললে পরে ব্যাপারটা ঘোলাটেই থাকবে।
– কি কথা কাকা?
– তোমার বিয়া, বড় বাবার সাথে হয় নাই। হইছে অয়ন বাবার সাথে।
– জ্বী?? আপনি কি উল্টা পাল্টা কথা বলছেন?
– আমি উল্টা পাল্টা কথা বলি নাই মা, এটাই সত্যি। মা তোমাকে কিছু কথা কই, মন দিয়া শুনবা। তারপর তোমার যদি মনে হয় অয়ন বাবার ভুল আছে, তুমি ওরে যা শাস্তি দিবা অয়ন বাবা তাই মাইনে নিবে।
-…….
– বড় বাবা আর অয়ন বাবা আপন ভাই না। অয়ন বাবাকে দত্তক নিছিলেন ম্যাডাম। তারপর, একটা এক্সিডেন্টে সাহেব আর ম্যাডাম মারা যান। এর পর বড় ম্যাডাম মানে তাগোর দাদীজানই আবরার বাবা, আবীর বাবা আর অয়ন বাবাকে দেখাশুনা করেন, বড় করেন। আবীর আর আবরার বাবার বয়সের তফাৎ ২ বছর। বড় হইলে আবরার বাবাকে সিকদার কোম্পানীর সি.ই.ও বানানোর সিদ্ধান্ত নেন বড় ম্যাডাম। অয়ন বাবা পালিত বলে তারে কোনোদিন তাদের মধ্যে গুনতো না উনি। এই কারণে আবরার বাবাই অয়ন বাবার সব কিছু ছিলো। যেদিন আবরার বাবারে সব কিছুর দায়িত্ব দেবার চান বড় ম্যাডাম সেই দিন অয়ন বাবা মনে মনে খুব খুশি হইছিলেন। কিন্তু এই খুশি টিকলো না, আবীর বাবা হিংসার কারণে আবরার বাবার নানা রকম ক্ষতি করার কথা চিন্তা করেন। সেটার শাস্তি অবশ্য অয়ন বাবা তারে দিছে। তারপর সাত মাস আগে আবরার বাবা একটা মাইয়ার সাথে দেখা করার জন্য গাড়ি নিয়ে বাইর হইছিলো। তারপর আর কি আবীর বাবার কথায় একটা ট্রাক তার গাড়িরে এক্কেবারে পিসে ফালায়। তার ফলাফল তোমার সামনে। ছয় মাস আবরার বাবা কোমায় ছিলো। এতো চিকিৎসা কোনো কাজে আসে না। এগুলো শুধু বড় ম্যাডাম আর অয়ন বাবা জানতো। বড় ম্যাডাম সিদ্ধান্ত নেয়, আবরার বাবার এই ঘটনা ধামাচাপা রাখবেন। তাই উনি অয়ন বাবাকে বিভিন্ন মেক আপ এর দ্বারা আবরার বাবার মতো সাজায়ে সবার সামনে আনেন। সবাইরে জানান আবরার বাবার শুধু মুখটা পুইড়া গেছে আর হাটতে পারতেছেন না, পড়ে ঠিক হইয়া যাবে। এবং এই নাটকটারে আরো ও বাড়াইতে আবরার বাবার বিয়ের ঘোষণা দেয়। এই নিয়ে অয়ন বাবা আর বড় ম্যাডামের অনেক কথা কাটাকাটি হয়। নিজের সব সম্পত্তি আর উত্তরাধিকারীর ভালোর জন্য অয়ন বাবারে ঢাল বানাইয়ে রাখে বড় ম্যাডাম। বিয়ে করবে অয়ন বাবা, এমনকি বিয়ের পর বাচ্চাটাও তারই হবে কিন্তু সবাই জানবে আবরার বাবার বিয়ে হইছে, বাচ্চাটাও তার। তোমার সামনে আবরার বাবা যতবার দাঁড়াইছে সেটা অয়ন বাবা ছিলো। জানি বিশ্বাস করতে তোমার একটু কষ্ট হইতেছে কিন্তু এটা সত্যি। আর আবরার বাবা যখন ভালা হইয়ে যাবে তখন একটা ডিভোর্স এর একটা নাটক করতো। এই কারণেই ছোট পরিবারের একটা মেয়ে খুইজে বাইর করতে অয়ন বাবাকে আদেশ দিছিলেন। অয়ন বাবা বাধ্য হইছে এগুলা করতে। তবে ওর দোষ ছিলো, নিজের জিদের বসে তোমারে এই গোলকধাঁধাঁয় রাখছিলো। ও ভাবছিলো তুমি টাকার লোভে তারে বিয়ে করছিলা। ওই ছোট বেলা থেকে ভালোবাসার জন্য ছেলেটা ক্ষুধার্ত ছিলো। সে চাইছিলো, তুমি যাতে তারে ভালোবাসো। তার সাথে বিয়া হইছে বা তার টাকার জন্য তার কাছে যাতে তুমি না থাকো। আমি জানি এতোদিন এই ব্যাপার গুলা তোমার কাছে লুকায়ে কাম ডা ভালা করে নাই অয়ন বাবা। কিন্তু বড় ম্যাডামের কথার উপর কথা বলার সাহস বা অধিকার কিছুই নাই তার। এখন তুমি একটু ভাইবে দেইখো তুমি কি করবা।

লোকমান কাকা কথাগুলো বলে রুমের বাইরে চলে গেলো। প্রাপ্তি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখের পানি যেন থামতেই চাচ্ছে না। অয়নের সেই কাজগুলো করার কি দরকার ছিলো! তাহলে দুজনকেই এতোটা কষ্ট পেতে হতো না। আজ হয়তো তাদের ও একটা সুখের সংসার থাকতো। একদিকে ভালোই হয়েছে, এতোদিনের দোটানার অবসান ঘটলো। মনটা হয়তো একারণেই এই মানুষটার দিকে ঘুরতো। এই মানুষটার কথা সারাক্ষণ ভাবতে চাইতো বেহায়া মনটা। শুধু সম্পর্কের মার প্যাঁচে নিজেকে শিটিয়ে রাখতো প্রাপ্তি। আজ এই ধোঁয়াশাও পরিষ্কার হয়ে গেছে। কিন্যু এতো সহজে এই লোকটাকে ক্ষমা করে দিলে তো হবে না, শাস্তিতো পেতেই হবে। প্রাপ্তি মনে মনে ফন্দি আঁটে কিভাবে অয়নকে শাস্তি দেয়া যায়! এখন শুধু সকালের অপেক্ষা।

সকাল ৯টা,
মুখে পানির ছিটা পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় অয়নের। পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখে কালো শাড়ি পড়ে এক নারী দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। এই শাড়িটি কাল রাতে কিনে এনেছিলো অয়ন। খুব নিপুন করে চুল মুছছে সে। সকালের শুভ্রতা যেন নারীটি প্রতিটি কণায় জড়িত। নারীটি আর কেউ নয় তার মায়াবতী, তার প্রাপ্তি। প্রথমে মনে হয়েছিলো এটা হয়তো কল্পনা। ঘুমের ঔষধ আর এলকোহলের ঘোরে মিষ্টি স্বপ্ন দেখছে সে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগছে ঘাড়ের গাঢ় কালো তিলটি। খুব ছুয়ে দিতে মন চাচ্ছিলো, পরক্ষণে রাতের ঘটনাগুলো মনে পড়তেই মনটা ছোট হয়ে গেলো। চোখ কচলে সামনে তাকালে দেখতে পায় রাগী রাগী চোখে প্রাপ্তি তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই বলে উঠে,
– কি ভেবেছিলেন, সুইসাইডের নাটক করলে আমি পটে যাবো??
– তুমি কল্পনা নও?
– কল্পনা হতে যাবো কেনো? সশরীরে দাঁড়িয়ে আছি। সকাল সকাল নেশা করেছেন নাকি?? উঠুন, উঠুন। বেলা হয়ে এসেছে, নবাব এখানে ভস ভস করে ঘুমোচ্ছে।
– আমার ক্ষুদা লেগেছে।
– ফ্রেশ হয়ে নিচে আসুন, খাবার রেডি।
– প্রাপ্তি, তোমাকে কিছু বলবো
– আমি কিছু শুনবো না, এখনই ফ্রেশ হয়ে নিচে নামেন।

বলেই নিচে চলে আসে প্রাপ্তি। পেছনে ঘুরে তাকালে হয়তো অয়ন হতবাক চেহারাটা চোখে পড়তো। খুব হাসি পাচ্ছে তার। অপরদিকে প্রাপ্তির বদলে যাওয়া অয়নের মনে শত প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটাচ্ছে। ফ্রেশ হয়ে নিচে যেতেই চক্ষু চোরাকগাছ, আজ সকালের নাস্তা সব অয়নের পছন্দের। লোকমান কাকার দিকে চোখ পড়তেই তিনি না সূচক মাথা নাড়লেন। তার মানে প্রাপ্তি এসব রান্না করেছে। মা মারা যাবার পর থেকে লোকমান কাকা ছাড়া অয়নের পছন্দ না পছন্দ কেউ খেয়াল রাখে নি।
– কি হলো, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
– এগুলো তুমি করেছো?
– না, আসমান থেকে ডেলিভারি এসেছে।
– সোজা কথার সোজা উত্তর দিতে কি হয় তোমার?
– কিছুই হয় না, বসুন বেড়ে দিচ্ছি।

আজ বহুদিন পর তৃপ্তি করে খাবার খেয়েছে অয়ন। কালরাতের ঘটনার পর, প্রাপ্তিকে এভাবে দেখবে আশা করে নি। খাওয়ার মাঝে ফোনটা বেজে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই “রাইসা আপু” নামটা ভেসে উঠে। ফোন রিসিভ করতেই উত্তেজিত হয়ে পড়লো অয়ন। অপরপাশ থেকে শুনতে পেলো…..
#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#১০ম_পর্ব

ফোন রিসিভ করতেই উত্তেজিত হয়ে পড়লো অয়ন। অপরপাশ থেকে শুনতে পেলো রাইসা ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। অয়ন উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলো,
– হ্যালো, হ্যালো। কেউ কি শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো!

কিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে উত্তর দিলো,
– আপনি কি অয়ন? রাইসার হুট করে পেইন উঠেছে। আমি ওর বান্ধবী, আপনি কি একটু উত্তরা ১১ নম্বরে আসতে পারবেন? ওকে হসপিটালে নিতে হবে হয়তো।
– আচ্ছা আমি আসছি।

ফোনটা রেখেই তড়িঘড়ি করে বের হয়ে যাচ্ছিলো অয়ন, পেছন থেকে প্রাপ্তি হাতটা টেনে ধরে বললো,
– কোথায় যাচ্ছেন?
– একটা কাজ পড়ে গেছে, আমার হয়তো আসতে দেরি হবে।
– আচ্ছা
– আচ্ছা শুনো?
– জ্বী
– খেয়ে নিও ঠিক মতো, আমি চলে আসবো।

বলেই অয়ন বেরিয়ে গেলো। প্রাপ্তির মুখে না বললেও মনে মনে বড্ড চিন্তায় পড়ে গেলো কারণ অয়নের এভাবে হুট করে বেরিয়ে যাওয়াটা বড্ড অস্বাভাবিক লেগেছে প্রাপ্তির কাছে।

রাত ৮টা,
আজ সারাদিন অয়নের একটা খোঁজ পায় নি প্রাপ্তি। নিজ থেকেও ফোন করে নি, এই ভেবে যে ও ব্যস্ত আছে হয়তো। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে নিজ মনে স্কেচ করতে করতে অয়নের কথাই ভাবছিল সে। বেশ কিছুক্ষণ পরে, খেয়াল করে দেখলো নিজের আনমনে অয়নের চেহারাই এঁকেছে সে। প্রথম যে দিন অয়নকে দেখেছিলো তখন সে সবে মাত্র এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে। তখন জানতো না অয়ন তার স্বামী। ভুল বশত অয়নের রুমে ঢুকে পড়ায় কি ঝাড়িটাই না খেলো। তখন অয়নকে বড্ড বেশি ভয় পেত। ভয়ে কুকড়ে থাকতো এই বুঝি কি না কি বলবে! কিন্তু ধীরে ধীরে সেই ভয়টা অভিমানে পরিণত হলো। অভিমানটা কখন ভালোলাগা তারপর ভালোবাসায় পরিণত হলো কে জানে। মনের বন্ধ দরজা ভেদ করে ধীর পায়ে ভালোবাসার বীজ বুনে দিলো লোকটা। লোকটার কথা বড্ড মনে পড়ছে তার। একটিবার ফোন দিলে কি খুব মন্দ হবে! হয়তো না, তাই লোকমান কাকার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ফোন লাগালো অয়নের নাম্বারে। বেশকিছুক্ষণ বাজার পর যখন ধরলো না প্রাপ্তির মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আচ্ছা, লোকটার কি সত্যি তার কথা মনে নেই!!

রাত ১১টা,
ডাইনিং টেবিলে খাবার নিয়ে বসে থাকতে থাকতে হাতের উপর ঘুমিয়ে পড়েছে প্রাপ্তি। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে যায় তার। চোখ কচলিয়ে দরজা খুলে দেখে অয়ন দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো উসখো খুসখো, বড্ড বেশি ক্লান্ত লাগছে তাকে। সারাদিনে পেটে দানা পড়েছে কিনা সন্দেহ। প্রাপ্তিকে দেখেই বলে উঠলো,
– বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। একটু খাবার বেড়ে দিও প্লিজ।

বলেই রুমের দিকে চলে যায় অয়ন। প্রাপ্তির খানিকটা রাগ ও হলো। সারাদিন একটা খোঁজ নিলো না লোকটা। কি এমন জরুরি কাজ ছিলো! একটাবার ফোনটাও ধরা যায় না? রান্নাঘরে খাবার গুলো গরম করে ডাইনিং টেবিলে দেয় সে। ততক্ষণে অয়নও চলে আসে। খাবার বেড়ে দিতে দিতে বললো,
– সারাদিন কিছু খাওয়া হয় নি নাকি?
– না, আর বলো না সারাটাদিন একবিন্দু বসার সুযোগ পাই নি।
– এতো জরুরি কাজ ছিলো বুঝি?
– তাতো ছিলোই।
– জানা যাবে কি? কি এমন করছিলেন?
– তুমি খেয়েছো রাতে?
– কথা পাল্টাচ্ছেন?
– উহু, তুমি না খেলে প্লেট আনো। একসাথে খেতে খেতে বলছি।
– আমার ক্ষুদা নেই।
– তা বললে তো হবে না, যাও প্লেট আনো একটা।
– জোর করছেন কেন? ক্ষুদা নেই বললাম তো।
– আচ্ছা বাবা সরি, আর এমন করবো না। কি কাজে গিয়েছিলাম শুনলে তুমিও রাগ করতে পারবে না।
– তাইলে বলেন সারাদিন কি এমন কাজে ব্যস্ত ছিলেন যে ফোন করেও আপনাকে খুজে পাই নি।
– আমার এক আপু, প্রেগন্যান্ট ছিলো। হুট করেই লেবার পেইন উঠেছে সাথে ব্লিডিং শুরু হয়। ও বান্ধবীর সাথে থাকতো, তাই আমাকে ফোন করেছে। প্রেগ্ন্যাসির আট মাস চলছিলো। হুট করে লেবার পেইন উঠায় ঘাবড়ে গিয়েছিলো। তারপর হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, কমপ্লিকেশন ছিলো অনেক। ডক্টর ভেবেছিলো বাচ্চাটাকে বাঁচানো যাবে না। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ ছেলে হয়েছে। এখন আপুকে রুমে দিয়েছে। বাচ্চাটাকে প্রিম্যাচ্যুরিটির জন্য আই.সি.উ তে রাখা হয়েছে। এখন ৭২ ঘন্টা অবজারভেশনে রেখেছে। তুমি বলো, ফোন কিভাবে ধরতাম?
– উনার পরিবারের কেউ নেই? আর উনার স্বামী?
– ভালোবাসা খুব বাজে জিনিস, মাঝে মাঝে ভুল মানুষকে ভালোবাসলে জীবনটা নরক হয়ে যায়। আর ভালোবাসায় ধোকাটা মানুষকে জীবন্ত মেরে ফেলতে সক্ষম। আপুর ক্ষেত্রে ও তাই। এই বাচ্চাটা না বাঁচলে আপুর বাঁচার আশাটুকু শেষ হয়ে যেত।
– আমাকে নিয়ে যাবেন তার সাথে দেখা করাতে?
– কি সম্পর্কে যাবে তুমি?
– যেটা আমাদের সম্পর্কের সত্যতা, সেটা তো বদলানো যাবে না। সেই সম্পর্কেই যাবো।
– আচ্ছা, আমাদের সম্পর্কটা ঠিক কি প্রাপ্তি?
– মানে?
– আমি দুই সপ্তাহ আগে তোমার কাছে কিছু চেয়েছিলাম। তুমি কালকে সেটার উত্তর দিয়ে দিয়েছো। এর পরে আমাদের মাঝে ঠিক সম্পর্ক আছে প্রাপ্তি?
– আমাকে সত্যিটা বলে দিলে হয়তো আমি এতো কঠোর হতাম না। আপনার কি মনে হয়না কোনো সম্পর্কের ভিত্তি হয় সেই সম্পর্কের সত্যতা। আমাদের সম্পর্কটা একটি মিথ্যে জালে জড়িত ছিল। আমি এতোদিন আপনাকে একজন পরপুরুষ ভাবতাম। কাল লোকমান কাকা যদি আমায় সত্যিটা না বলতো তবে আজও আমি সেই মিথ্যের আড়ালে থাকা সত্যিটুকু জানতে পারতাম না। এবার বলুন আমি কি আমার দিকে ভুল ছিলাম? আমি কিভাবে আপনার প্রেম নিবেদনের উত্তর দিতাম?
– তুমি জানো সব? তুমি কি আমায় ক্ষমা করে দিয়েছো?
– বেহায়া মনটার সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত আমি। বাড়ে বাড়ে আপনাকেই চায়, বাড়ে বাড়ে আপনার রঙে নিজেকে রাঙাতে ব্যস্ত সে। কি করবো বলুন?

প্রাপ্তির কথাটুকু শুনে চেয়ার ছেড়ে প্রাপ্তির সামনে এসে দাঁড়ায় অয়ন। হাটু গেড়ে নিচে বসে প্রাপ্তির হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নেয় সে। চোখে তার সুখের অশ্রুধারা, এ যেনো জানান দিচ্ছে তার ভালোবাসা জিতে গেছে, আজ সে পরাজিত নয়। প্রাপ্তির চোখে চোখ রেখে বলে,
– আমায় ক্ষমা করে দাও প্রাপ্তি। তোমায় অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাই না। বিশ্বাস করো ভরসা পাই নি, পরিস্থিতি আমাকে একটা গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়েছিলো। আজ আমার সামনে সব যেনো পানির মতো পরিষ্কার। এই অয়নটা খুব খারাপ, খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে তোমায়। কথা দিচ্ছি, আর দিবে না। আমার মায়াবতীকে সব বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রাখবো দেখো। কোনো কষ্টের ছিটা তোমার গায়ে লাগতে দিবো না। ভালোবাসি যে, বড্ড ভালোবাসি। আমার এই একলা দুনিয়াতে আমার সঙ্গী কি হবে তুমি?
– আমিও যে এই জেদি, রাগী, খারাপ ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেছি। আমার হাতে যে কিছুই নেই। যে মায়ায় জড়িয়ে আছি তা থেকে যে আমার নিস্তার নেই। বড্ড ভালোবাসি, এই দুনিয়ায় আমি বড্ড একা। আমার কষ্ট সহ্যশক্তি খুব কমে গেছে, কথা দিন আর আমাকে জ্বালাবেন না। আমাকে একা করে দিবেন না। কথা দিন?
– কথা দিলাম মায়াবতী। আমি তোমাকে পৃথিবীর সব সুখ এনে দিবো। আমাকে তুমি পরিবারের সুখটা কি দিবে?
– আমার সকল সুখ আপনার, আপনার সকল দুঃখ আমার।

বলেই অয়নকে জড়িয়ে ধরলো প্রাপ্তি। অয়ন ও খুব যত্নে তাকে আগলিয়ে নিয়েছে। আজ দুটি হৃদয় একই সুতোয় বাঁধা পড়েছে। অয়ন পরম যত্নে প্রাপ্তিকে কোলে তুলে নেয়। নিজের রুমে বিছানার উপর বসিয়ে পরম আদরে প্রাপ্তির কপালে ভালোবাসার উষ্ণ ছোয়া দেয় সে। দুটি দেহ আজ তাদের মিলনে ব্যস্ত। দুটি হৃদয় আজ তাদের প্রাপ্য সুখ কুড়াতে ব্যস্ত। এতোদিনের মান, অভিমান, রাগ, কষ্ট গুলো যেন সুখের তরীতে ভেসে যাচ্ছে। থাক না সাক্ষী হয়ে ঘরের সাদা দেয়াল, আকাশের ওই উজ্জ্বল চাঁদ আর নিঝুম রাত তাদের মিলনের, তাদের ভালোবাসা পাক না পূর্ণতা।

আযানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙ্গে প্রাপ্তির। চোখ খুলতেই নিজেকে অয়নের বাহুডোরে পায় সে। ক্লান্ত হয়ে চারটার দিকে ঘুমিয়েছে সে। নিজের বরটাকে আজ বড্ড বেশি সুন্দর লাগছে তার কাছে। আচ্ছা, সে কি আসক্ত হয়ে পড়ছে এই মানুষটার প্রতি। হলেও ক্ষতি কি! মানুষটা যে তার একান্ত নিজের। অয়নের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে গোসল করে নেয় সে, ফজরের নামাযের সাথে দু রাকাত নফল নামায পড়ে নেয় সে। এতো সুখ আবার হারিয়ে যাবে নাতো! ধরে রাখতে পারবে তো!! সুখের সময়টা খুব ক্ষণস্থায়ী, আসছে সময় সম্পর্কের কি রুপ নেয় তা হয় তো কারোর জানা নেই।

সকাল ১০টা,
বোর্ড মিটিং এ বসে আছে অয়ন। আবীর বোর্ড মিটিং দেখেছে, আজ ভোট হবে তাতে নির্ধারিত হবে সিকদার কোম্পানির সি.ই.ও কে হবে? অয়নের মুখ শক্ত হয়ে আছে। রাগে গা রি রি করছে। সকালবেলায় রিয়াদ ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে আবীরের পরিকল্পনা। প্রাপ্তিকে কিছু না বলেই চলে আসতে হয়েছে তাকে। আবরার না থাকায় বাধ্য হয়ে মহিমা সিকদার অর্থাৎ আবরারের দাদীজান অয়নকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। অনেক কথা কাটাকাটির পর বাধ্য হয়েই এই সিদ্ধান্তে রাজি হয় অয়ন। এখন শুধু ফলাফলের অপেক্ষা। রিয়াদ আগ থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। আজ আবীরের সকল খেলার পর্দা উম্মোচিত হবে। দরজায় নক করেই রুমে প্রবেশ করে রিয়াদ। ফলাফল তার হাতে, আবীরের মুখে বিজয়ের হাসি কারণ সব মেম্বারদের টাকার লোভ দেখিয়ে কিনে নিয়েছে সে। রিয়াদ বলতে লাগলো,
– এখন আমার হাতে সকল ভোটের গণনা রয়েছে, সিকদার কোম্পানির নতুন সি.ই.ও হলেন…..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি
চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here