ভালোবাসার রংমশাল পর্ব-০৪

#ভালোবাসার রংমশাল
#পর্ব-৪
#সিফাতী সাদিকা সিতু

সাম্য তখন সবে তারুণ্য পেরিয়ে যৌবনে পর্দাপন করেছে।সাম্যর ছোট বেলা থেকেই বাগান করার শখ। সেদিন সকাল থেকেই ছিলো ঝুম বৃষ্টি। সাম্য ছাতা মাথায় নিয়ে বাগানের টব গুলো সরিয়ে রাখছিলো।কলিংবেলের আওয়াজে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিলো।সেদিন বড় বাবা,বড় মার সাথে বৃষ্টি ভেজা এক ষোড়শী তরুণীকে দেখে অবাক হয়েছিল! গোলগাল বৃষ্টি ভেজা ফ্যাকাসে মুখ,ফোলা চোখের মেয়েটিকে দেখে হৃদয়ে অদ্ভুত শিহরণ জেগেছিল। সেদিন বিকেলে তার বাগানে এসেও চমকে গিয়েছিল। তার বাগানের এক কোণে বসে মেয়েটি নিঃশব্দে কাঁদছে! মেয়েটির গালে নোনা অশ্রুর দাগ পরে আছে।সাম্যর সেদিন কি হয়েছিলো সে বুঝতে পারেনি। শুধু মনে হয়েছিলো,বাগানটা তার রাজ্য,সে এই বাগানের রাজা আর মেয়েটা তার দুঃখী রানী।খুব আপন মনে হয়েছিলো তার।যেন মেয়েটির সাথে তার হৃদয়ের যোগসূত্র আছে।তার দুঃখী রানীর কষ্টে তার হৃদয় সেদিন ব্যাথাতুর হয়ে উঠেছিল। পরে জানতে পেরেছিলো মেয়েটির বাবা -মা তাকে একা রেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। সেদিন মনে মনে সে শপথ করেছিলো সারাজীবন সে তার দুঃখী রানীর পাশে থাকবে। ধীরে ধীরে সে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলে নিঝুমকে তবে তা কখনো প্রকাশ করেনি।নিঝুম যখন তাকে সাম্য ভাইয়া বলে ডাকতো তখন খুব রাগ হতো। তাইতো কারনে অকারণে ধমক দিতো,শাস্তি স্বরুপ সারাদিন ধরে অংক করতে বসিয়ে রাখতো।এভাবেই কাটছিলো কয়েকমাস। এরপর রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেলে তাকে চলে যেতে হয়।খুব কষ্ট হতো দূরে থাকতে তার হৃদয়ের রাণীকে ছেড়ে।মাঝে মাঝে যখন বাড়িতে আসতো তার ঈদের মতো আনন্দ হতো।মন ভরে দেখতো নিঝুমকে।সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো কিন্তু হঠাৎ করেই সব এলোমেলো হয়ে যায়।তার বিশ্বাস ভেঙে যায়।ভালোবাসা রূপ নেয় ঘৃণায়।এক বছর আগের সেইদিনটি যে কষ্টদায়ক ছিলো তা সারাজীবন মনে থাকবে তার।

নিঝুম শুকনো কাপড় পরে নিয়ে বারান্দায় আসলো ভেজা কাপড় গুলো মেলে দিতে। বৃষ্টি থেমে গেছে।আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে আছে। সাদা মেঘের শুভ্রতায় ছেয়ে আছে গোটা আকাশটা।সাম্যকে দেখে চমকে উঠলো সে। কাপড় গুলো নিয়ে আর এগোতে পারলো না। ফিরে এসে কাপড় গুলো রেখে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।নিঝুম চলে যাওয়ার পর সাম্যর উঠে আসলো রুমে। নিঝুমের উপস্থিতি সে অনুভব করতে পারে সহজেই। বিছানায় শুয়ে পরতে চাইলেও কি যেন ভেবে নিঝুমের ভেজা কাপড় গুলো নিয়ে বারান্দায় মেলে দিলো।

শান্তা আনমনে ভেবেই চলেছে সাম্যর কথা।সাম্যকে নিয়ে দিনরাত ভাবলেও তার বিরক্ত লাগে না।কত সুন্দর সময় কাটাতো ওরা।সব ফ্রেন্ডরা মিলে কত মজা করতো,ঘুরতে যেতো।শান্তা সবসময় সাম্যর আশে পাশে থাকতো।কলেজে ওঠার পর সে বুঝতে পারে সাম্যকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু সাম্য শুধু মাত্র তাকে বন্ধু হিসেবেই ভালোবাসে কখনো অন্যচোখে দেখেনি।শান্তা গ্রাজুয়েশন শেষে সাম্যকে তার মনের কথা জানাবে ভেবেছিলো।কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে।মারুফের কারণে কিছুই আর বলা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সাম্য নিঝুমকে বিয়ে করে নিলো সেটা নাকি নিঝুমকে কষ্ট দিতে!সাম্য অবশ্য বলেছে তার বড় বাবাকে সব জানিয়ে এই বিয়ে থেকে বেরিয়ে আসবে।এরপর শান্তা নতুন আশায় বুক বেধেছে।সাম্য নিঝুমকে স্ত্রী হিসেবে কখনো মর্যাদা দিবে না।তাহলে সাম্যকে তার মনের কথা জানাতে বাঁধা নেই।সে ঠিক করলো যতদ্রুত সম্ভব সাম্যকে সব জানিয়ে দেবে।সাম্যকে নিজের করে পেতে আর অপেক্ষা করবে না সে।সাম্য তাকে কখনো ফিরিয়ে দিতে পারবে না।শান্তা, সুমিকে ফোন করলো।সুমি ওর খালাতো বোন।এই মেয়েটা প্রেম,ভালোবাসা বিষয় গুলো সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান রাখে।সাম্যকে কি করে সব কথা বলবে তার একটু ধারণা নেয় দরকার!

-বুবু,আমি এইসব কি শুনতাছি?সাম্য বাবায় নাকি নিঝুমরে বিয়া করছে?তুমি তোমার কথা রাহো নাই বুবু!

-আমি কি করবো বলতো?তোর দুলাভাই তো সবকিছু নষ্ট করে দিলো।নিঝুমের বিয়ে তো ভেঙে গিয়েছিলো সেই জন্য নিজের ছেলেকে দিয়ে বিয়ে দিলো।আমার কথা কি সে শুনে।

-এহন আমি কি করুম বুবু,তোমার কতায় মাইয়্যাটার কোনো প্রস্তাব ধরি নাই।তুমি কও আমার মাইয়্যাডার কি হইবো?

-কিছু হবে না।আমি যখন কথা দিয়েছি তোর মেয়ে আমার ছেলের বউ হবে তখন সে কথা আমি রাখবো।নিঝুমকে আমি আমার ছেলের বউ হিসেবে মানি না।আমার মনে হয়,সাম্যও নিঝুমকে পছন্দ করে না।বাপ,চাচাদের মুখের ওপর কথা বলতে না পেরে এ বিয়েটা করেছে।আমায় কিছুদিন সময় দে সব ঠিক হয়ে যাবে।

-ক্যামনে কি হইবো।দুলাভাই যদি তোমার কতা না শুনে?

-সে ব্যবস্থা আমি করবো।সাম্য যদি সংসার করতে না চায় তখন তোর দুলাভাইয়ের কিছু করার থাকবে না।আমি সাম্যর সাথে কথা বলবো ডিভোর্সের ব্যাপারে।

-ঠিক আছে, আমি তোমার কতায় শেষ ভরসা করলাম।আমার মাইয়্যাডার কপাল নষ্ট কইরো না।

-চুপ কর তো ভাই, কিসের কপাল নষ্ট হবে।তোর মেয়ে আমার ছেলের বউ হলে রাজকন্যা হবে দেখিস তুই।আমার সাম্যর মতো ছেলে তুই খুঁজে পাবি না।শুধু নিঝুমকে ছেলেটার ঘাড় থেকে নামাতে হবে।

কোহিনূর বেগম ফোন রেখে চিন্তায় পরলেন।কোথা থেকে কি করবেন ভেবে পান না।যৌথ পরিবার হওয়ায় বিয়ের পর থেকেই তিনি ঝামেলায় আছেন। সাম্যর বাবা ভাই, বোনদের অনুমতি, পরামর্শ ছাড়া এক চুলও নড়েন না।বেশিদিন নিঝুমকে সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।খুব তাড়াতাড়ি তাকে সাম্যর সাথে কথা বলতে হবে এবং সেটা সময় সুযোগ বুঝে।
***********

নিঝুম বই নিয়ে বসেছে।অল্প কিছুদিনের মধ্যে তার পরিক্ষা শুরু হবে।মন, মানসিকতা মোটেও ভালো নেই তার।এতোদিন দুঃখের সাথে সুখ ছিলো,শান্তি ছিলো।সাম্যর সাথে জীবন জড়িয়ে যাওয়ার পর থেকে সে শান্তি পাচ্ছে না।জীবন আজ তাকে কোথায় এনে দাড় করিয়েছে! সাম্যর হাতের পুতুল হয়ে গেছে সে।এতোদিন সাম্যর রাগ,অভিযোগ গুলোকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি। সাম্য তাকে মিথ্যা দোষারোপ করলেও সেসব আমলে নিতো না বরং সাম্যর করা আচরণে ধীরে ধীরে সাম্যর প্রতি ঘৃণা জন্মেছে। অথচ সেই সাম্য আজ তার স্বামী! মামনির সাথে এ বাড়িতে আসার পর সাম্যকে কখনো এমন মনে হয়নি।সেই সাম্য ছিলো অন্যরকম।তাকে পড়াশোনায় হেল্প করা,বাগানে ঢোকার অনুমতি দেয়া,মাঝে মাঝে সুপ্তি,অহনা এবং তাকে নিয়ে ফুচকা, আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে যেত।সাম্য যখন বাড়িতে আসতো কতো মজা হই, হট্টগোল হতো!পিকনিক করতো ওরা সবাই মিলে।হঠাৎ সেই চেনা সাম্য কেমন অচেনা হয়ে উঠলো।সব অন্যরকম হয়ে গেলো। আচ্ছা,সাম্য তাকে কেন বিশ্বাস করতে পারলো না?কেন তাকে মিথ্যাবাদী মনে করলো?

সাম্য ঘরে ঢুকে দেখলো নিঝুম বই খোলা রেখে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। সাম্যর কেন যেন রাগ হলো, এভাবে পরতে বসে অন্যমনষ্ক হয়ে আছে কেন নিঝুম?পড়াশোনা করার ইচ্ছা না থাকলে বই নিয়ে বসেছে কেন?
সে ঘরের লাইট অফ করে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিলো।নিঝুম ভয় পেয়ে গেছে হঠাৎ এভাবে লাইট অফ হয়ে যাওয়াতে।সাম্যকে দেখে রেগে বললো,”আপনার কি হুশজ্ঞান নাই,দেখছেন না আমি পড়ছি?”

সাম্য তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললো,”বই খোলা রাখলেই পড়া হয়ে যায়না।নিজের হুশ জ্ঞান নেই, অন্যকে বলতে এসেছে! ”

“আমার বই আমি আমি খুলে পড়বো নাকি বন্ধ রেখে পরবো সেটা আমার ব্যাপার।আপনি লাইট কেন বন্ধ করলেন? ”

“আমার ঘর,আমার লাইট, আমি যা খুশি করবো সেটাও আমার ব্যাপার।তোমার ভালো না লাগলে,ইউ ক্যান লিভ।”

“এটা আমারও ঘর। আপনার একার সম্পত্তি নয়।”আপনি যা খুশি তাই করতে পারেন না?

“বড্ড বাড় বেড়েছ দেখছি!এতো সাহস আসে কোথা থেকে তোমার? বউ তো পুরুষ মানুষের নিজের সম্পত্তি হয়,তাহলে আমি তো তোমার সাথে যা খুশি তাই করতেই পারি,তাই না?”

নিঝুমের প্রচন্ড রাগ হলো।অসভ্যের মতো কথা বলতে শুরু করছে সাম্য। রেগে বললো,”নিজের সীমার মধ্যে থাকেন।না হলে খুব খারাপ হবে।”

“এই মেয়ে তুমি আমাকে আমার সীমা চেনাতে এসো না।নিজের বিবেক কে একবার প্রশ্ন করে দেখো নিজে কতটুকু সীমার মধ্যে ছিলে।”

নিঝুম এবার দমে গেলো।সেই সাথে বুকটা ভারী হয়ে আসলো।সাম্য এখনো তাকে দোষী ভাবে!শীতল গলায় বললো,”আমার বিবেকের কাছে আমি স্বচ্ছ। সেটা আপনার মনে নাও হতে পারে।অবশ্য আপনার মতো মানুষ যারা অন্যকে অন্যায় ভাবে কষ্ট দেয় তারা এসব বুঝবেও না।”

সাম্যর রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো।রেগে বললো,”তেমার নাটক বন্ধ করো।আর একটা কথা বললে,মেরে মুখ ভেঙে দেবো একদম!বলে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।”

নিঝুম কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো।কান্না আটকাতে পারলো না সে,নিঃশব্দে কাঁদলো।

সাম্য একটা কাজে নিঝুমের ভার্সিটির কাছে এসেছিলো।কাজ সেড়ে বেরিয়ে দেখলো রাস্তার এক পাশে জটলা বেধেছে।কৌতূহল বশত এগিয়ে গেলো সে
ভীড় ঠেলে এগিয়ে যা দেখলো তাতে সে স্থীর হয়ে গেলো।সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে তার!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here