ভালোবাসার রং কালো পর্ব ১০+১১

#ভালোবাসার_রঙ_কালো 🖤
#চাঁদনী_নূর_লামিয়া
পর্ব-১০-১১
——————————————–

#পর্ব -১০
.
“তোমার আর দুলাভাইয়ের ভালোবাসার রঙ কী আপু?
” কী সব প্রশ্ন করিস আরজু? ভালোবাসার আবার রঙ হয় নাকি?
” হয় তো! কারোর ভালোবাসার রঙ লাল হয়, কারোর নীল, সবুজ, হলুদ কিংবা সাদা, আবার কারোর ভালোবাসার রঙ কালোও হয়!
আমার কথা শুনে ফোনের ওপাশে ইসরাত আপু খিলখিল করে হেসে ওঠল!
” হাসছো কেন! আমি কী হাসির কথা বলেছি?
আপু একনাগাড়ে হেসেই চলেছে। এইদিকে আমি যে ফোন কানে চেপে ধরে বসে আছি সেটা মনে হয় আপু ভুলেই গেছে। আমি বুঝতে পারছি না এখানে হাসার কী আছে? আপু আর দুলাভাইয়ের ভালোবাসার রঙ কী সেটা জানতে চেয়েছি; আর এতে এত হাসার কী হলো? মিনিট কয়েক অপেক্ষা করে আপুর হাসি থামার কোনো লক্ষণ না দেখে আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
” আপু তুমি কী হাসতেই থাকবে না কি আমি কল কেটে দিবো?
আমার হুমকিতে কাজ হয়েছে। আপু হাসি থামিয়ে হেয়ালির সুরে বলল,
” হ্যাঁ রে আরজু, তা সে কে? আমি কী তাকে চিনি?
” কী বলছো তুমি, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না?
” আহা এখন কিছুই বুঝিস না। ঐদিকে তো ঘিয়ের মাঝে দুই হাত কবজি পর্যন্ত ঠিকই ডুবিয়ে রেখেছিস।
” আপু!
” আপু আপু না করে আগে বল সে কে?
” কার কথা জিজ্ঞেস করছো?
” যে তোকে ভালোবাসার রঙ দেখিয়েছে।
আপুর কথায় আমি ভীষণ লজ্জা পেলাম। ইশ, আপু কী সবটা বুঝে ফেলল?
” কি’রে কথা বলছিস না কেন?
” আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও?
” কী?
” তোমার আর দুলাভাইয়ের ভালোবাসার রঙ কী?
আপু ক্ষাণিক ক্ষণ চুপ থেকে লজ্জা আর আবেগ মিশ্রিত স্বরে বলল,
“তুই তো সবই জানিস আরজু; তোর দুলাভাই আমাকে কতটা যতন করে। তার ছোঁয়া এবং মুগ্ধ চোখের চাহনিতে আমি সুখ অনুভব করি। তার সংস্পর্শে নিজেকে পরিপূর্ণ লাগে। তাকে পেয়ে নিজেকে বড় ভাগ্যবতী মনে হয়। তার ভালোবাসার রঙ কী আমি জানি না; তবে এটা জানি সে ভালোবাসা বড় পবিত্র!
আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আপুর কথা শুনছিলাম। স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়, সুখময় আর পবিত্র!
” কি’রে চুপ করে আছিস কেন?
” তোমার বলা কথাগুলোই ভাবছি।
” ভেবে কী পেলি?
” এটাই যে, তোমার আর দুলাভাইয়ের ভালোবাসার রঙ সাদা। কারণ তোমাদের ভালোবাসা পবিত্র; আর সাদা হচ্ছে পবিত্রতার রঙ!
আমার কথা শুনে আপু পুনরায় খিলখিল করে হেসে ওঠল! হাসতে হাসতেই বলল,
” আচ্ছা তোকে এসব কে বলেছে বল তো? ভালোবাসারও যে রঙ হয় সেটা তুই কীভাবে জানলি?
” আমিও তো আগে জানতাম না, কিন্তু কেউ একজন আমার স্বপ্নে এসে বলেছে তার ভালোবাসার রঙ কালো!
আপু হাসির মাত্রা আরও বাড়িয়ে বলল,
” আরজুরে তুই তো প্রেমে শুধু হাবুডুবু খাচ্ছিস না, সাথে সাঁতারও কাটছিস। এখন বল তোর সেই প্রেমিক পুরুষটা কে?
আমি কখনওই ইসরাত আপুর কাছে কিছু লুকোয়নি। আপুও তার সবকিছু আমাকে বলে। আমরা বোন কম বান্ধবী বেশি। তাই আপুর কাছে কিছু লুকানোর প্রশ্নই আসে না।
“এই আরজু, চুপ করে আছিস কেন, বল?
আপুর তাড়া পেয়ে আমি নিঃশ্বাস আটকে বলে ফেললাম,
” মিহির ভাই!
ছোট দুইটি শব্দ বলেই আমার ঘাম ছুটে গেছে। আমি ফোস করে চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দিলাম।
আপু প্রায় চেঁচিয়ে ওঠল,
” মিহির! তুই কী নিধির ভাই মিহিরের কথা বলছিস?
আমি ফোনের এপাশে মাথা নেড়ে বললাম,
” হ্যাঁ।
” মিহির কী তোকে ভালোবাসে বলেছে?
হুট করেই আপুর গলার স্বর‍টা পাল্টে গেছে। আমি মনের মাঝে অভিমান চেপে রেখে জবাব দিলাম,
” না।
” সে যদি তোকে ভালোবাসে সেটা না বলে থাকে, তাহলে তুই কিসের ভিত্তিতে তোর মনের মাঝে এমন ধারণা পুষছিস? তুই কী মিহিরকে পছন্দ করিস?
আমি এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলাম। আপু আবার জিজ্ঞেস করল,
” মিহিরকে কী তুই ভালোবাসিস বলেছিস?
আমি ক্ষীণস্বরে জবাব দিলাম,
” হু।
এরপর আপুও চুপ হয়ে গেল। আমরা দুজনেই দুই প্রান্তে ফোন কানে চেপে ধরে চুপ করে আছি। একটু পর আপু হতাশার সুরে বলল,
” তোর মতো শক্ত মনের একটি মেয়ে কীভাবে এমন ভুল করতে পারিস আরজু?
আমাদের ভাইবোনের মধ্যে তুই অন্তত মানুষ চিনতে ভুল করিস না সেটাই আমার ধারণা ছিল।
মিহির ভাইয়ের নাম শুনে আপু এমন চুপসে গেল কেন? আপু কী মিহির ভাইকে পছন্দ করে না, না কি অন্য কোনো কারণ আছে? আমার মাথায় নানান ধরনের প্রশ্নেরা এসে ভীড় করতে লাগল। আমার ভাবনার মাঝেই আপু মন খারাপ করে বলতে লাগল,
” মিহির তোর জন্য সঠিক মানুষ না আরজু। ও হচ্ছে একজন আত্ন-অহংকারী ছেলে। মিহিরের মা-বাবা কিংবা ওর পরিবারের কেউই তোকে ওর স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবে না। আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুন, মিহির হচ্ছে সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী গাছের উঁচু শাখা, যার শেখরে পোঁছানোর ইচ্ছে বা স্বপ্ন থাকলেও যোগ্যতা কিংবা ক্ষমতা কোনোটাই তোর নেই! তোকে এর চেয়ে সহজ ভাবে বুঝাতে হবে না আশাকরি। তাই আমি তোকে সাবধান করছি, ওর থেকে দূরে থাক। ওদের সাথে কখনওই আমাদের মিলবে না। আব্বারও এক সময় ওদের মতো প্রভাব প্রতিপত্তি সবই ছিল। কিন্তু সেটা এখন শুধুই অতীত। আর মিহিরের নিজের এবং ওর বাবার বংশগত প্রভাব প্রতিপত্তি হচ্ছে বর্তমান। তাই অতীত দিয়ে বর্তমানকে পাওয়ার চেষ্টা করা হবে বোকামি। আরেকটা কথা, তুই হয়তো ভুলে যাচ্ছিস আব্বা তোদেরকে নিয়ে মিহিরদের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে থাকছেন। আর কোনো পরিবারই একজন আশ্রিতের মেয়েকে তাদের ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে চাইবে না। আর মিহিরের বাবা-মা তো না’ই! তোর মতো বাস্তববাদী মেয়ে কী করে এমন একটি ভুলের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেললি! যেখানে মিহির এখনো নিজের মুখে তোকে ওর ভালোবাসার কথা বলেনি?
.
মধ্য দুপুর। গভীর মনোযোগ দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের বেলকনির জোড়া কবুতরের সংসার দেখতে ব্যস্ত আমি। যোহরের নামায পড়ে সোজা জানালার কাছে চলে এসেছি কিছু একটা দেখার জন্য। আমার হৃদয়ের গহীনে মিহির ভাইয়ের ভালোবাসার যে ঝড় উঠেছে সেটাকে শান্ত করার একটাই উপায় আছে; আর তা হলো আমার সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া। ইসরাত আপু তো সরাসরি বলেছে, মিহির ভাইকে পাওয়ার কোনো যোগ্যতাই আমার নেই। আপুর কথার বাইরে গিয়ে আমি যদি আমার অযোগ্যতা নিয়েই মিহির ভাইকে পাওয়ার আশা করি, তবে কী সেটা ভুল হবে? আর তার উত্তরটাই এই কবুতর দম্পতির মাঝে পাওয়া যাবে। শুরু থেকেই দেখছি দুটি কবুতরের মধ্যে একটি কবুতরের একটি ডানা অপরিপক্ব, যার কারণে সেটা উড়তে পারে না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে অপর কবুতর টাকেও উড়তে দেখি না আমি। হয়তো সেটা উড়ে তবে তা আমার নজরে পড়েনি। যেখানে একটি কবুতর স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরেও, উড়তে পারার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অন্য কবুতরটিকে ভালোবাসার খাতিরে নিজের পাখি সত্তাকেই একপাশে সরিয়ে দিয়েছে; ডানা মেলে উড়ার সুখকে বিসর্জন দিয়েছে, সেখানে আশ্রিত এবং দরিদ্রতার দোহাই দিয়ে মিহির ভাই নিশ্চয় আমার ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করবেন না। তিনিও যদি আমাকে ভালোবেসে থাকেন তবে অবশ্যই আমার সকল অগুন এবং দূর্বলতাকে মেনে নিয়েই আমাকে গ্রহণ করে নিবেন। আর যদি সেটা না করেন তবে আমি নিজেই এই নামহীন সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যাবো। কখনওই তার কাছে তাকে নিয়ে আমার মনের গভীর অনুভূতি গুলোকে প্রকাশ হতে দিবো না। বরং নিজেকে যথা সম্ভব তার থেকে গুটিয়ে নিবো। আমার ভালোবাসার দাবী কখনওই তার কাছে চাইবো না। এখন আমার শুধু একটাই উদ্দেশ্য, আমাকে নিয়ে মিহির ভাইয়ের মনের অনুভূতি কী সেটা জানা। তিনি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেন কি না সেটা নিশ্চিত হওয়া!
.
#ভালোবাসার_রঙ_কালো
#পর্ব_১১
.
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল আমার। চারপাশে মুয়াজ্জিনের সুমধুর কণ্ঠে ফজরের আযান শুনা যাচ্ছে। গতকাল ইসরাত আপুর সাথে ফোনে কথা হওয়ার পর থেকে আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। আর সেজন্য রাতেও ভালো ঘুম হয়নি। একরাশ অস্থিরতা ঘিরে রেখেছে আমাকে। এসব চিন্তা থেকে মনকে দূরে রাখার চেষ্টা করে আযানের জবাব দিচ্ছি তখনি আম্মার ডাক শুনতে পেলাম। আম্মা আমার রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে আমাকে ডাকছে।
” আরজু এই আরজু, এখনো ঘুম থেকে ওঠিসনি? জলদি উঠ, নামাযের আওয়াল ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে যে।
আম্মা একই ভাবে ডেকে যাচ্ছে। আমি বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। আম্মা হাসিমুখে রুমের ভেতরে ঢুকে বলল,
” নামাজ পড়ে নে। এরপর গোসল করে তৈরী হয়ে নিস। তোকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। তারা সকালের নাস্তা এখানে এসেই খাবেন। এইটুকু বলে আম্মা আর এক মূহুর্তও দাঁড়ালো না৷ যেমন হাসিমুখে এসেছিল তেমন হাসিমুখেই আবার চলে গিয়েছে। আমি আম্মার কথা শুনে পুরোটা না বুঝলেও এটা বুঝতে পেরেছি, আজকে সেই মুদি দোকানদার এবং তার পরিবার আমাকে দেখতে আসছে হয়তো। ওহ মিহির ভাইয়ের চক্করে পড়ে এই ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম আমি। তাই তো আব্বাকে এই বিয়ের জন্য মানা করে দিতেও মনে নেই। আর আব্বা তো এইদিকে তাদেরকে এই বাড়িতে এসে সকালের নাস্তা খাওয়ার দাওয়াতও দিয়ে ফেলেছে। যাক, এই সুযোগে আমি মিহির ভাইয়ের মনের কথাটাও জেনে ফেলতে পারবো। তিনি যদি সত্যিই আমাকে পছন্দ করেন, তবে কিছুতেই এই বিয়ে হতে দিবেন না৷ যেকোনো মূল্যে বিয়েটা আটকাবেন। তবে পাত্রপক্ষ আমাকে অপছন্দ করার নিশ্চয়তা বেশি। আমি চাচ্ছি তারা না করে দেওয়ার আগেই যেন মিহির ভাইয়ের মনের কথাটা জানতে পারি। আর এতে আমাকে কিছুই করতে হবে না৷ সব আপনা আপনিই হয়ে যাবে। কথাগুলো ভাবতেই আমার মনটা খুশিতে নেচে ওঠল। খুশি মনে ওযূ করে এসে নামায পড়ার প্রস্তুতি নিলাম।
.
সকাল সাড়ে আটটা বাজে। এত সকালে কেউ পাত্রী দেখতে আসে কি না আমার জানা নেই। তবে কখনো শুনিনি যে পাত্রপক্ষ সকাল সকাল পাত্রীর বাসায় চলে এসেছে সকালের নাস্তা খেয়ে মেয়ে দেখবে বলে! এসব ভেবে মনে মনে হাসলেও বাহিরে বেশ গম্ভীর ভাব ধরে রেখেছি। সাদা আর গোলাপি রঙের মিশেলের নরম সুতি কাপড়ের একটি সাধারণ সালোয়ার কামিজ পরেছি আমি। এর ওড়নাটাও বিশাল বড়। সেটা দিয়েই মাথা সহ মোটামুটি অর্ধেক শরীর ঢেকে রেখেছি। সাদা আর গোলাপি রঙ দুটো আমার গায়ের কালো রঙের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে চেপে বসেছে। নাকে সাদা পাথরের একটি নাকফুল পরেছি। সেটা হয়তো একটু আলোর ছোঁয়া পেয়েই চিকচিক করছে। সব মিলিয়ে আমাকে দেখতে অদ্ভূত লাগছে। তবুও আমি খুশি এটা ভেবে যে, মিহির ভাই আমার এই রূপটাকেই পছন্দ করেছেন। আমার মন বলে তিনিও আমাকে ভালোবাসেন। তার হৃদয়ের অনুভূতিগুলো চোখের ইশারায় আমার হৃদয়ের অনুভূতির কাছে চিঠি লিখেছে। আমার চোখ দিয়ে তার চোখের শব্দহীন সেই অনুভূতির চিঠি পড়েই আমাকে নিয়ে তার ভাবনার কথা জানতে পেরেছি। আর সেটাই তার মুখ থেকে শুনতে চাই আমি। এবং আমি জানি আমার ধারণা ভুল নয়। মিহির ভাই স্বপ্নে আমাকে বলেছিলেন, তিনি আমার দু’চোখের পাতায় ঘুম হয়ে মিশে যেতে যান। আমার হৃদয়ে তার নামের ঝড় তুলতে চান। আমিও তাকে বলতে চাই, তিনি আমার দু’চোখের পাতায় স্বপ্ন হয়ে মিশে গেছেন। আমার হৃদয়ে তার নামের ঝড় তুলে আমাকে তার মাঝে বিলীন হতে বাধ্য করেছেন!
.
আম্মা রান্নাঘরে মেহমানদের জন্য কয়েক পদের রান্না করছে। আব্বা দামী রেস্টুরেন্ট থেকে নাস্তা আনতে গেছেন। মেহমানদের আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখতে চান না তিনি। আর নোমান রান্নাঘরে আম্মাকে এটা ওটা এগিয়ে দিয়ে তার কাজে সাহায্য করছে। কিন্তু আম্মা আমাকে রান্নাঘরের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দিচ্ছে না। আমি সাহায্য করতে গিয়ে ছিলাম। আমাকে দেখেই আম্মা ধমকের সুরে বলল,
” তুই যা আমি একা সব করে নিবো। সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ পরে বিধবা সেজেছিস কেন? আর এই সাদা পাথরের নাকফুল কেন নাকে পরেছিস? তোর আক্কেল আর কবে হবে আমাকে বল তো? সবকিছু সাদা পরে তোর গায়ের কালো রঙটাকে আরও বেশি করে কেন ফুটিয়ে তুলেছিস? তুই তো বিধবা না যে স্বামী মারা যাওয়ায় এসব পরে শোক পালন করছিস। আজকে বিয়ের জন্য তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে। আর তুই কি না এমন ভুত সেজে তৈরী হয়েছিস? যা এক্ষুণি গিয়ে এইসব পালটে অন্য সালোয়ার কামিজ পরে সুন্দর করে সেজে আয়। চোখে কাজল আর ঠোঁটে গাঢ় রঙের লিপিস্টিক লাগাবি। তুই না পারলে নিধিকে ডেকে বল ও তোকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিবে। তোর বাবার মুখে শুনেছি ছেলে নাকি দেখতে খুব সুন্দর। তাই সুন্দর করে সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে থাক, যেন পাত্রপক্ষের সকলেই তোকে পছন্দ করে।
আম্মার আদেশ পেয়ে আমি রান্নাঘর থেকে চলে আসলেও আমার সাজ বদল করিনি। যেগুলো পরেছিলাম সেভাবেই আছি। আমার রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবকিছু লক্ষ্য করছি আর আম্মার কথাগুলো ভেবে মনে মনে হাসছি। হঠাৎ কী মনে করে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মিহির ভাইয়ের রুমের দিকে তাকিয়ে সাথে সাথেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। রিধি আর নিধি মিহির ভাইয়ের রুম থেকে বেরিয়ে আসছে। আমি সামনে ফিরে গেলেও রিধির দৃষ্টি আমাকে এড়ালো না। ও আমার কাছে এগিয়ে এলো। ওর পিছনে নিধিও এসে হাজির হলো।
” কী ব্যাপার আরজু এখনো তৈরি হওনি? শুনলাম তোমাকে না কি আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে।
আমি মুচকি হেসে বললাম,
” আমি তো তৈরী হয়েই আছি।
রিধি আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
” এই বেশে পাত্রপক্ষের সামনে গেলে তারা তোমাকে দেখে পছন্দ করলেই হয়। আসলে হয়েছে কী, আমার বিয়ের তো প্রায় সাত মাস পেরিয়ে গেল। এর মধ্যে শ্বশুরবাড়ির অনেক আত্নীয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ পেলেও পরিচিত কারোরই বিয়ের দাওয়াত পাইনি। কীভাবে পাবো বোলো, পরিচিত কারোরই তো বিয়ে হচ্ছে না। তোমারও তো কবে থেকে বিয়ের কথা বার্তা চলছে; কিন্তু সুসংবাদ তো পাচ্ছি না। আর কত এইবার অন্তত বিয়ে শাদী করে আমাদেরকে তোমার বিয়ের দাওয়াত খাওয়ার সুযোগ দাও।
রিধির হাসিমুখে খোঁচা দিয়ে চিবিয়ে বলা কথাগুলো সহজ ভাবে হজম করে নিলাম। ও যে ইচ্ছে করেই বিয়েতে বিলম্ব হওয়া নিয়ে আমাকে ছোট করতে চাইছে, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমি। কিন্তু ওর কথার প্রতিত্ত্যুরে মুচকি হাসি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই বলিনি। রিধি আরও কিছু বলার জন্য মুখ হা করতেই নিধি ফট করে বলে দিল,
” তোমাদের বিবাহিত মহিলাদের এই এক সমস্যা আপু, তোমাদের নিজেদের বিয়ে হয়ে গেছে বলে অবিবাহিতা মেয়েদের দেখলেই খোঁচানো শুরু কোরো। যেন বিয়ে করে কী এমন পাহাড় জয় করে ফেলেছো তোমরা। আর বিয়েটা কী মানুষের হাতে নাকি? জোড়া মিলানোর মালিক তো একমাত্র আল্লাহপাক। কিন্তু তোমরা কিছু বিবাহিত মহিলারা আল্লাহপাকের কাজে নাকও গলাও আবার হস্তক্ষেপও কোরো। এমন একটা ভাব করো যেন, বিবাহিত জীবনে তোমরা কত সুখে আছো। অথচ সবক্ষেত্রে কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন হয়। আর তুমি যে আরজুপুর বিয়ে হয়নি বলে ওর বিয়ে খেতে চাইছো, কই আমাকে তো একবারও বলোনি যে আমার বিয়ে খেতে চাও। আরজুপুর মতো আমারও তো বিয়ে হচ্ছে না। আব্বু আর ভাইয়াও তো তোমার বিয়ের পর থেকেই আমার জন্য পাত্র খুঁজছে তাও তো বিয়েটা হচ্ছে না আমার।
নিধির কথায় রিধি রেগে মুখ কালো করে ধমকের সুরে বলল,
” তুই আর আরজু কী সমান নাকি? তোর জন্য এত ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসে যে, আব্বু আর মিহির ঠিক করতে পারছে না কারটা রেখে কার প্রস্তাব গ্রহণ করবে! আর আরজুর বিয়ের জন্য আংকেল ঘটকের কাছে পাত্র খুঁজে বেড়ান!
নিধি ওর কথার জবাবে কিছু বলতে গেলে আমি ওদের দুইজনকে রেখে সেখান থেকে চলে আসলাম। পিছন থেকে দুই বোনের তর্কাতর্কির আওয়াজ কানে আসছে। কাল ইসরাত আপুর সাথে কথা বলার পরে সারাদিন আমার মনটা খারাপ ছিল। সেই মন খারাপ নিয়েই রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম। তারপর সকালে ঘুম থেকে উঠার পরে মিহির ভাইয়ের কথা ভাবতেই মন খারাপ চলে গিয়ে অনেকটা খুশি খুশি লাগছিল। কিন্তু রিধির কথায় আবার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি চেষ্টা করছি মন খারাপ না করতে। আমার চেষ্টা সফল হলেই হয়।
.
অনেক্ষণ যাবত মিহির ভাইদের ড্রইংরুমে মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছি। আমার ঠিক সামনে দুইজন মহিলা আর দুই জন পুরুষ বসে আছেন। পুরুষ দুই জনের মধ্যে একজন জোয়ান ছেলে। সম্ভবত তিনিই পাত্র, আর মহিলা দুইজনের মধ্যে একটি কম বয়সী মেয়ে আছে৷ আমি মাথা নিচু করে বসে আছি বিধায় সবার পা দেখতে পারছি। আর পা দেখেই অনুমান করছি সব। আমার একপাশে নোমান এবং আরেক পাশে আব্বা বসে আছে। আম্মাকে আশেপাশে কোথাও দেখছি না। হয়তো রান্নাঘরে মেহমানদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত। শিলা একটু পর পর বড় ট্রেতে করে নানান রকমের নাস্তার প্লেট এনে সবার সামনে বড় টি-টেবিলে রাখছে। নোমান আমার কানে কানে এটা ওটা বলে দিচ্ছে। এই যেমন ছেলের বাবা-মা আর ছোট বোন এসেছে। ওদের সাথে ঘটকও আছে। ছেলেটা দেখতে বেশ সুন্দর। গায়ের রঙ ধবধবে সাদা আর মাথার চুলগুলো কোঁকড়ানো। ঘটক লোকটা একসাথে তিনটি বিস্কুট মুখে পুরে দিয়েছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই নোমান অন্য মনস্ক হয়ে পড়ছে। তারপর আমার কুনুইয়ের গুঁতো খেয়ে আবার চারপাশের খবর বলতে থাকে। আমি বেশ বুঝতে পারছি, ও পাত্রের বোনকে দেখে অবাক হয়ে গেছে। তাই তো মাঝে মাঝে চুপ হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ও মনে করেছে আমি কিছুই বুঝি না। হটাৎ নোমান আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল,
” আপু, আংকেল আর মিহির ভাইও এসেছে। মিহির ভাই পাত্রের পাশেই বসে তার সাথে হ্যান্ডশেক করছে।
মিহির ভাইয়ের নাম শুনেই আমার বুকের ভেতরে ধুকপুকানি বেড়ে গেল। আমি ঘোমটার আড়াল থেকে আড়চোখে তার দিকে তাকালাম। নীল রঙের সুতোর কাজ করা বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবীতে তাকে অপূর্ব লাগছে! পাঞ্জাবীটা তাকে দারুণ মানিয়েছে। কেন জানি আমার চোখে আজ মিহির ভাইকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। প্রেমে পড়লে মানুষ বদলে যায় জানতাম; কিন্তু বেহায়াও হয়ে যায় সেটা এখন টের পাচ্ছি! চোখের লজ্জা ভুলে আশেপাশের সবাইকে তুচ্ছ করে ঘোমটা সরিয়ে আড়চোখে মিহির ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। কে কী ভাবছে সেসবের পরোয়া করছি না। ইশ তাকে আজ কেন এত সুন্দর লাগছে? শুনেছি মেয়েরা নাকি বিয়ের আগে সুন্দরী হয়ে যায়। কিন্তু ছেলেদের হুট করে সুন্দর হয়ে যাওয়ার পিছনের রহস্য কী? আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মিহির ভাইকে দেখে চলেছি। বাসন্তী রঙের ঢিলেঢালা পাঞ্জাবীটার বুকের দুটো বোতাম খুলে রেখেছেন। মাথা ভর্তি ঘন কালো চুলগুলোকে আড়াআড়ি ভাবে আচরে পরিপাটি করে রেখেছেন। পায়ে অ্যাপেক্সের স্যান্ডেল আর হাতের দামী ঘড়িটা কবজি পর্যন্ত এসে খসে পড়ার অবস্থায় আটকে আছে। মাত্র এতটুকুতেই তাকে এত আকর্ষণীয় লাগছে! অবশেষে জোর করে তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে মনে মনে নিজেকে শাসন করতে লাগলাম। কেন আমি এতক্ষণ যাবত একনাগারে তার পানে চেয়ে রইলাম? সবাই কী ভাবছে? আমি যখন নিজেকে মনে মনে শাসন করতে ব্যস্ত তখনি মিহির ভাই বলে ওঠলেন,
” কখন থেকে তো আমরাই কথা বলে যাচ্ছি। পাত্র পাত্রী দুইজনকেও তো আলাদা করে কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিত। বিয়েটা যেহেতু ওরাই করবে, তাই ওদের একে অপরের সাথে আলাপ করে নিজেদের পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে জেনে নেওয়া ভালো। তারপর ওদের সিদ্ধান্ত জেনেই না হয় এই বিষয়ে আগানো যাবে।
আমি বিস্মিত দৃষ্টিতে মিহির ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তিনিও আমার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। তারপর আমার তাকানোকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আবার বললেন,
” আংকেল আপনারা অনুমতি দিলে আমি নোমানকে বলি ওদের দুইজনকে ছাদে নিয়ে যেতে। সেখানেই দুজন আলাপ করে নিবে।
তার কথা শেষ হতেই আব্বা এবং পাত্রের পাশে বসা লোকটি হাসিমুখে অনুমতি দিলেন।
মিহির ভাই নোমানকে বললেন,
” নোমান, তুমি ওদের দুইজনকে নিয়ে ছাদে যাও। ওরা নিজেদের মতো করে কথাবার্তা বলে নিক।
আমি তখনো অবাক চোখে মিহির ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। এসব কী বলছেন তিনি? আমাকে আলাদা করে পাত্রের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিচ্ছেন! কিন্তু কেন? তবে কী তিনি আমাকে ভালোবাসেন না? গত কয়েকদিন তার চোখে আমার জন্য যে ভালোবাসা দেখেছি সেটা কী তবে ভুল ছিল? তবে কী এই বিয়েতে কী মিহির ভাইয়ের কোনো আপত্তি নেই? তিনি সত্যিই আমাকে পছন্দ করেন না বলে এমনটা করছেন; না কি এর পিছনে অন্য কোনো কারণ আছে?
আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিহির ভাই মাথা নিচু করে ফেললেন। তিনি কী আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছেন?
নোমান আমাকে আর পাত্রকে ওর সাথে যেতে বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আমি অবিশ্বাস্য চোখে মিহির ভাইয়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে নোমানকে অনুসরণ করে ধীরপায়ে ওর পিছনে হাঁটতে লাগলাম!
.
#চলবে ….
.
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here