#ভালোবাসার_রঙ_কালো🖤
Chadni Noor Lamiya
১৩ এবং শেষ পর্ব
————————————————–
.
সেই বাড়ি এবং মিহির ভাইকে ছেড়ে চলে আসার এক মাস পেরিয়ে গেছে। এই ব্যস্ত শহরের সরু গলিতে গড়ে উঠা নতুন একটি বহুতল ভবনের চার তালায় আরও একটি পরিবারের সাথে ভাগাভাগি করে ভাড়া উঠেছি আমরা। সেই পরিবারে স্বামী স্ত্রী দুজন মাত্র। স্বামীর নাম জোবায়ের আর স্ত্রীর নাম শামীমা। তাদের কোনো ছেলেপুলে নেই। থাকবে কীভাবে নতুন বিবাহিত দম্পতি তারা। সবেমাত্র কয়েক মাস নাকি পেরিয়েছে তাদের বিয়ের। স্বামী শহরে চাকরি করার সুবাদে স্ত্রীকেও সাথে করে শহরে নিয়ে এসেছেন তার থাকা খাওয়ার সুবিধার জন্য। তিনটি বেড রুমের দুটি আমরা নিয়ে একটি তাদেরকে দেওয়া হয়েছে। এবং রান্নাঘরের দুইদিক দুই পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ড্রইংরুমে দুই পরিবারের আসবাবপত্র রাখা আছে। নিজ নিজ প্রয়োজনে সবাই সেগুলো ব্যবহার করতে পারে। মোট ভাড়ার এক তৃতীয়াংশ দেওয়ার চুক্তিতে তারাও আমাদের সাথে এই ভাড়া বাড়িতে থাকবে। এক মাসেই শামীমা ভাবী এবং জোবায়ের ভাইয়ের সাথে খুব ভাব হয়ে গেছে আমাদের। জোবায়ের ভাই দেখতে সুন্দর হলেও ভাবী দেখতে ততটা সুন্দরী নন। কিন্তু তারপরও তাদের সংসারে সুখের কোনো কমতি নেই। তাদের দুইজনকে দেখে প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তারা বুঝি প্রেম করে একে অপরকে পছন্দ করে নিজেদের ইচ্ছেতেই বিয়ে করেছেন। কারণ এখনকার বেশির ভাগ মায়েরা কোনো অসুন্দরী মেয়েকে তাদের ছেলের বউ করতে রাজী হোন না। তারা পুত্রবধূ হিসেবে সুন্দরী গুনবতী ধনী এবং লাস্যময়ী কোনো মেয়ের সাথেই ছেলের বিয়ে দিতে চান। কিন্তু তাদের সাথে কথা বলার পর এটা জেনে অবাক হই, জোবায়ের ভাইয়ের মা নাকি নিজে ভাবীকে পছন্দ করে তার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছেন! এমনকি বিয়েতে তিনি কোনো যৌতুকও দাবী করেননি। কিন্তু ভাবীর বাবা আর ভাই নিজেদের ইচ্ছেতে খুশিমনে বিয়ের পর তাদের নতুন সংসারের জন্য কয়েকটি আসবাবপত্র কিনে দিয়েছেন। সেইগুলোও ভাবীর শ্বাশুড়ি তাকে জোবায়ের ভাইয়ের সাথে শহরে পাঠিয়ে দেওয়ার সময় জোর করে সাথে দিয়েছেন। ভাবীর শ্বাশুড়ির মতো কিছু ভালো শ্বাশুড়িও আছেন; যারা পরের মেয়েকে আদর আর ভালোবাসা দিয়ে নিজের মেয়ের মতোই মমতার বাহুডোরে যত্নের সাথে আগলে রাখেন।
.
আকাশটাকে বড্ড উদাসীন আর শান্ত লাগছে। উদার আর বিলাষীর রূপ ধরে ধরণীকে আগলে রেখেছে যেন। সমস্ত আসমান জুরে নীলের বেষ্টনীকে ভেদ করে সফেদ আফসানাগুলো অল্প বয়সী কিশোরীর ন্যায় লাজুক ভঙিতে বারংবার নিজেদের আড়াল করে লুকোচুরি খেলছে আর আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। এক ঝাঁক শুভ্র ধবল দূর আকাশের বুকে ডানা ঝাপটে উড়তে উড়তে সেই আফসানগুলোকে ছুঁয়ে দেওয়ার প্রতিযোগীতায় নেমেছে। একটি উড়োজাহাজ আকেশের বুক চিড়ে লম্বা দাগ টেনে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে উড়ে চলে যাচ্ছে। আমি অলস মনে স্থির দৃষ্টিতে সেই সব অবলোকন করছি। যদিও আব্বা আমাকে চাকরি করার অনুমতি দিয়েছেন; কিন্তু আপাতত সেটার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। আব্বা নতুন করে ছোটখাট একটা ব্যবসা শুরু করেছেন। আর নোমান আব্বার সাথে ব্যবসায় শ্রম দিচ্ছে। আর তা থেকেই ঘর ভাড়া সহ আমাদের সাংসারিক যাবতীয় খরচের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
” আরজু ভেতরে আসবো?
একটি মেয়েলি কণ্ঠে আকাশ দেখার মতো অলস কর্মে বাঁধা পড়ায় আমি বিরক্ত হয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকালাম। মোটা পাড়ের টকটকে লাল শাড়ি পরে শামীমা ভাবী হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাসির জবাবে আমিও হালকা হেসে বললাম,
” আসেন।
ভাবী অনুমতি পাওয়া মাত্র ভেতরে এসে খাটে আমার পাশে বসে বললেন,
” তোমাকে একটা কথা বলবো?
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই ভাবী কিছুটা দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” তুমি কী কারোর জন্য অপেক্ষা করছো?
তার প্রশ্নে অবাক হলেও আমি শান্ত ভাবে জবাব দিলাম,
” না।
” তাহলে খালু আর খালাম্মা তোমার ছোট দুই বোনকে তোমায় রেখে আগে বিয়ে দিয়েছে কেন?
আমি আগের মতোই শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলাম,
” আমি কালো বলে আমার বিয়ে হচ্ছিলো না; তাই আমিই আব্বাকে ওদের দুইজনের বিয়ে দিতে বলেছি।
আমার জবাব শুনে ভাবীর চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে। আহত সুরে বলেন,
” তোমার মনে অনেক কষ্ট তাই না আরজু?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে জোর করে হাসলাম। কারণ সব কথা সবাইকে বলা যায় না। কিছু কথা একান্ত নিজের হয়। তাই আমি ভাবীকে আর কিছু না বলে আবার আকাশ দেখায় মন দিলাম। ভাবীও কিছুক্ষণ চুপ করে আমার পাশে বসে থেকে উঠে চলে গেলেন।
.
রাতে শামীমা ভাবী আর জোবায়ের ভাই সহ আমরা সবাই একসাথে খেতে বসেছি। রান্না আলাদা হলেও দুই পরিবারের সবাই সকাল আর রাতের খাবার একসাথেই খাই।
খাওয়ার মাঝখানে জোবায়ের ভাই আব্বাকে বললেন,
” খালু আপনার সাথে আরজুর বিয়ের ব্যাপারে কিছু কথা বলার ছিল।
বিয়ের কথা শোনামাত্র আমি খাওয়া বন্ধ করে সেখান থেকে উঠে চলে আসলাম। ওরা সবাই হয়তো ভাবছে আমি লজ্জায় চলে এসেছি। কিন্তু আমি জানি, বিয়ের কথা শুনতেই আমার কলিজায় কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। আগে কখনো বিয়ে সংসার এইসব নিয়ে না ভাবলেও, মিহির ভাইকে ভালোবাসার পর থেকে মনে মনে তাকেই নিয়েই আমার সব স্বপ্ন সাজিয়ে ছিলাম। তার সাথে সুখের সংসার করার স্বপ্নও দেখে ফেলেছিলাম। আর এসবে নিজের মনকেও বাঁধা দেইনি আমি। শাসন না পেয়ে দুরন্ত আস্ফালনে আমার মন তাকে নিয়ে সুখে ঘর কন্না করার আশার জাল বুনে ফেলেছিল। কিন্তু আমার “ভালোবাসার রঙ কালো” বলেই মাকড়সার জালের মতো ক্ষণস্থায়ী সেই সুখের কল্পনা বাস্তবতার তীব্র আঘাতে ভেঙে ছারখার হয়ে গেছে!
জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার দুই চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছে। নিজেকে সামলাতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বেহায়া মনটা আমার অবাধ্য হয়ে সকল জড়তা ভুলে মিহির ভাইয়ের কাছে ছুটে যেতে চাইছে! আনমনে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি,আচ্ছা মিহির ভাই কী আমাকে একেবারেই ভুলে গেছেন? আমার অনুপস্থিতিতে কী তার হৃদয়ে ভালোবাসার শূন্যতা সৃষ্টি হয়নি! আমার মন উত্তর দেওয়ার আগেই আব্বা আমার পিছনে এসে দাঁড়ালেন।
” আরজু।
আব্বাকে দেখে আমি অবাক হলাম না। আব্বা কী বলতে এসেছে সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। অবিবাহিত মেয়ের বোঝা কাঁদে বয়ে বেড়ানো যেকোনো বাবার জন্যই কষ্টের এবং হতাশার।
আব্বা কিছু বলার আগেই আমি মাথা নিচু করে আস্তে করে বললাম,
” আমার কিছু বলার নেই আব্বা। তুমি যা ভালো মনে করবে তাই কোরো।
আব্বা খুশি হয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন,
” আমি দোয়া করছি, তুই অনেক সুখী হবি। যে গায়ের রঙের জন্য জীবনে অপমান আর কান্না ছাড়া কিছুই পাসনি। সেই গায়ের রঙ নিয়েই একদিন তুই গর্ব করবি।
আম্মা আর নোমানও আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আম্মা আমার কাঁধে হাত রাখতেই আমি আম্মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মনে মনে পণ করলাম, আজকের পর থেকে আর কখনো মিহির ভাইয়ের জন্য কাঁদবো না। যে ভালোবাসা কাউকে সাহসী করে তুলতে পারে না; সেই ভালোবাসার জন্য আর কখনো আফসোস করবো না।
.
জোবায়ের ভাই যে পাত্রের সমন্ধ এনেছেন তিনি না কি তার অফিসেই চাকরি করেন। পাত্রের নাম শাকিল, পরিবারে মা বাবা আর ছোট একটি ভাই আছে। বেতনও নাকি বেশ ভালো পান। শাকিল জোবায়ের ভাইকে পাত্রী খুঁজে দিতে বললে তিনি আমার কথা বলেন। তারপর আব্বার সাথে পরামর্শ করে তাদেরকে শুক্রবারে আসতে বলেছেন। জোবায়ের ভাই আব্বা- আম্মাকে আশ্বস্ত করেছেন, তিনি শাকিলকে আমার ব্যাপারে সবকিছু বলেছেন। সব শুনার পরেও নাকি তিনি আমাকে দেখতে চেয়েছেন। আর আমাকে পছন্দ হলে শুক্রবারেই আংটি পরিয়ে যাবেন। এসব শুনে আম্মা খুশি হয়ে কিছু টাকা হাতে গুজে দিয়ে একটা সবুজ রঙের শাড়ি আর কিছু কসমেটিকস কিনতে বলে আমাকে জোর করে ভাবীর সাথে মার্কেটে পাঠিয়েছে। নিধির কাছ থেকে মিহির ভাইয়ের পছন্দ জানতে পেরে সেদিন আম্মার একটা সবুজ শাড়ি যখন পরেছিলাম, সেটা বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরে এসে আম্মা আমার পরনে দেখেছিল। আম্মা তখনি বলেছিল, সবুজ রঙ আমাকে ভালো মানায়। আর তাই আমাকে যেন পাত্রপক্ষ পছন্দ করেন সেই চেষ্টায় আম্মা আমাকে মার্কেটে কেনাকাটা করতে পাঠিয়েছে। আম্মার জোড়াজুড়িতে শামীমা ভাবীকে নিয়ে এসে তো পড়েছি, কিন্তু শাড়ির দোকানে এত শাড়ির মধ্যে কোনটা কিনবো সেটাই ঠিক করতে পারছি না। দোকানদার একের পর এক সবুজ রঙের বাহারী শাড়ি বের করে দেখাচ্ছে। আর আমার চোখে সবগুলোই সুন্দর লাগছে! আমাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে অবশেষে শামীমা ভাবীই একটা শাড়ি পছন্দ করে দিলেন। শাড়ি কেনার পর ম্যাচিং চুড়ি কেনার জন্য একটি চুড়ির দোকানে ঢুকে চুড়ি দেখতে লাগলাম আমরা। দোকানটা বেশ বড় হওয়ায় চারপাশে ঘুরে ঘুরে সব রকমের চুড়ি দেখতে দেখতে এক গোছা কাচের চুড়িতে আমার চোখ আটকে গেল। দোকানীকে বলে সেই চুড়িগুলো নিয়ে হাতে পড়তে গেলেই হঠাৎ করে নিধি এসে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ওর আচমকা জড়িয়ে ধরায় আমার হাত থেকে কয়েকটি চুড়ি নিচে পড়ে ভেঙে গেল। তা দেখে দোকানদার কর্কশ কণ্ঠে বলল, এই চুড়ির দাম পুরোটাই না কি দিতে হবে। নিধি কিছু বলতে গেলে আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে টাকা দিতে চাইলে, পিছন থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠ বলে ওঠল,
” আপনার দোকানে যত কাচের চুড়ি আছে সব নিয়ে আসুন। ও ভাঙবে আর আমি তার দাম পরিশোধ করে দিবো।
সেই কণ্ঠস্বর আর বলার ভঙি শুনেই আমি বুঝতে পেরেছি কে কথাগুলো বলেছেন। আমি পিছনে না ফিরেই দুটো একশো টাকার নোট দোকানিকে দিয়ে বড় বড় পা ফেলে দ্রুত দোকান থেকে বেরিয়ে আসলাম। আমার পিছু পিছু নিধিও আসতে লাগল।
” এই আরজুপু, তুমি এত দ্রুত হাঁটছো কেন? আমার জন্য একটু দাঁড়াও।
ওর ডাক কানে গেলেও আমি দাঁড়ালাম না। যদিও ওর সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু ওর সাথে মিহির ভাইও আছে, আর তার মুখোমুখি হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। তার উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্র আমার মনের মাঝে পুরনো চাপা অভিমানগুলো মাথা চাড়া দিয়ে জেগে ওঠেছে৷ হুট করেই তার প্রতি আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে! এই রাগের পিছনের কারণ কী, তিনি এতদিন আমার কোনো খুঁজ না নেওয়ার জন্য, নাকি সেদিন আমাকে চলে আসার সময় না আটকানোর জন্য হচ্ছে সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না। হঠাৎ হাঁটার মাঝেই কে যেন আমার হাত ধরে হেঁচকা টানে থামিয়ে দিল।
” এই আরজু কী হয়েছে তোমার? এত দ্রুত হেঁটে কোথায় যাচ্ছো? আর আমাকে দোকানে ফেলে এসে একা চলে যাচ্ছো কেন?
শামীমা ভাবী যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন নিধিও সেখানে চলে আসে। ওর পিছনে মিহির ভাইও এসেছেন, তবে আমাদের থেকে কিছুটা দুরত্বে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
” ওদিকটায় কি দেখো, আর চুপ করে আছো কেন?
আমি কিছু বলার আগেই নিধি বলে ওঠল,
” আপনি কে?
শামীমা ভাবী ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমি আরজুর প্রতিবেশী। কিন্তু তুমি কে?
নিধি হাসি মুখে বলল,
” আমি আরজুপুর ননদ।
ওর কথায় আমি আর ভাবী দুজনেই ওর দিকে বড় চোখ করে তাকালে ও জিবে কামড় দিয়ে আবার বলল,
” না মানে আরজুপু আর আমি খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী তো তাই মজা করে আমি ভাবী ডাকি আর কী।
শামীমা ভাবী কী বুঝলেন জানি না। তিনিও হাসিমুখে বললেন,
” তাহলে তো তোমার সাথে পরিচিত হয়ে ভালোই হয়েছে। তুমি শুক্রবারে বিকেলে তোমার বান্ধুবীর বাড়িতে চলে এসো।
নিধি জিজ্ঞেস করল,
” কেন?
” সুখবর পাবে তাই।
” কিসের সুখবর?
নিধির মুখ হা হয়ে গেছে প্রায়।
” শুক্রবারে তোমার আরজুপুকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। আর সব ঠিক থাকলে সেদিনই ওকে আংটি পরিয়ে বিয়ের দিনক্ষণ পাকা হয়ে যাবে।
কথাগুলো শুনে নিধি হজম করতে পারলো না। হঠাৎ করেই ও আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ওর এমন আচরণে আমি আর ভাবী দুজনেই হতবাক হয়ে গেলাম। নিধি ফুঁপিয়ে কেঁদে বলতে লাগল,
” আরজুপু তোমাকে ছাড়া ভাইয়া একটুও ভালো নেই। আর তুমি কি না এইদিকে বিয়ে করে নিচ্ছো! ভাইয়াতো কালকেই আমাদের সবাইকে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে যেতো। আর এইজন্যই তো আমরা আজকে বিয়ের জন্য কেনাকাটা করতে…..
নিধির কথার মাঝখানেই মিহির ভাই হুট করে এসে ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জোর করে ওর হাত ধরে নিয়ে টেনে যেতে লাগলেন। যাওয়ার আগে তার রাগী দৃষ্টিতে আমাকে ঝলসে যেতে ভুললেন না। আমি আর ভাবী দুজনেই হতভম্ব হয়ে তাদের যাওয়ার পানে চেয়ে রইলাম!
.
মাঝ রাতের দিকে ফোনের ভাইব্রেশনে ঘুমটা ভেঙে গেল। এত রাতে কে কল করেছে? তাও আমার ফোনে! ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা হাতে নিয়ে অপরিচিত নাম্বার দেখেও দরকারী ভেবে রিসিভ করে
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললাম,
” আস্সালামু আলাইকুম, কে বলছেন?
” আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে তুমি শান্তিতে ঘুমিয়ে আরেক জনকে বিয়ে করে সুখী হওয়ার স্বপ্ন দেখছো?
আমি অস্ফুটস্বরে বলে ওঠলাম,
” মিহির ভাই!
ওপাশ থেকে মিহির ভাই রাগী স্বরে ধমকে ওঠলেন,
” খবরদার, আমার নাম ধরে ভাই ডাকবে না। আমাকে ভাই ডেকে আর অন্যদের নাম ধরে ডেকেই বিয়ে করতে চাইছো সেটা আমি বুঝি না?
তার কথায় এবার আমারও রাগ উঠে গেলে বিরক্তি নিয়ে বললাম,
” একে তো মাঝরাতে বিনা দরকারে কল করে আমার ঘুম ভেঙে দিয়ে বিরক্ত করছেন। তার উপরে সালামের জবাবও দেননি। আর আমি কাকে ভাই ডাকবো, আর কার নাম ধরে ডাকবো সেটা কী আপনার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে?
মিহির ভাই থমথমে গলায় বললেন,
” তোমার সাহস খুব বেড়ে গেছে। পাখা গজিয়েছে তোমার পাখা! সেই পাখা ঝাপটিয়ে অন্যের আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখছো তুমি? ঠিক আছে, নতুন গজানো পাখা কীভাবে ছাঁটতে হয় তা আমার বেশ জানা আছে। আজকের মতন শান্তিতে ঘুমিয়ে নাও। এরপর আমার প্রতিটি নির্ঘুম রাতের হিসেব চুকাতে হবে তোমাকে। রাখি, ওয়া আলাইকুমু স্সালাম।
এই বলেই তিনি খট করে কলটা কেটে দিলেন। তার কথা শুনে আমি পুরো বোকা বনে গেলাম! যদিও তিনি প্রচণ্ড রেগে কথা বলছিলেন, তারপরও কেন জানি তার বলা কথাগুলো শুনে খুব শান্তি লাগছে মনে! কেমন যেন সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে। আমার মন বলছে আব্বার দোয়া তবে ফলেই গেল। এই বুঝি আমার কষ্টের দিন ফুরিয়ে আসছে! খুশি আর উত্তেজনায় বাকি রাতটুকু আর ঘুম হয়নি আমার। ভোরে আযান দিতেই ওযূ করে ফজরের নামায পড়ে কাল মার্কেট থেকে কিনে আনা সবুজ রঙের নতুন জামদানী শাড়িটা পরলাম। কাল সন্ধ্যায় ভাবী আর আমি বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। শামীমা ভাবী সরল মনের মানুষ। তিনি মার্কেটে নিধি আর মিহির ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়ার ব্যাপারে বাসায় কাউকে কিছু বলেননি। তাই অনেকটা নিশ্চিত ভাবেই শাড়ি পরে পরিপাটি হয়ে তৈরী হয়ে গেছি। বার বার মনে হচ্ছে আজ মিহির ভাই আসবেন; এবং আমার অস্তিত্বে তার নামের সীলমোহর লাগিয়ে আমাকে তার সাথে নিয়ে যাবেন!
শাড়ি পরে তৈরী হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে সকালের নাস্তা বানাতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরেই শামীমা ভাবী আর আম্মা রান্নাঘরে এসে আমাকে দেখে অবাক চোখ তাকিয়ে রইল।
আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম,
” কী ব্যাপার তোমরা দুজন অমন করে তাকিয়ে আছো কেন? আমাকে কী দেখতে খারাপ লাগছে? এই শাড়িটাই কী সুন্দর লাগছে না? এটা পালটে ফেলবো?
ভাবী আমার প্রশ্নের জবাব দিতে গেলেই কলিংবেল বেজে উঠলে দরজা খুলতে চলে যান। আম্মা তখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। খানিক বাদেই ড্রইংরুম থেকে ভাবীর গলা শুনা গেল। তিনি কাদের সাথে যেন কথা বলছেন। একসাথে অনেকগুলো মানুষের কথা শুনতে পেয়ে আমি আর আম্মাও ড্রইংরুমের দিকে পা বাড়ালাম। ড্রইংরুমে আসতেই নিধি ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি সামনের দিকে তাকাতেই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠলাম। আন্টি আংকেল নাহিদ রিধি আর ওর বর সবাই মুখ কালো করে সোফায় বসে আছেন। দেখেই বুঝা যাচ্ছে তাদের সবাইকে কিছুক্ষণ আগেই ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে জোর করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। আমার মতো আম্মাও তাদের সবাইকে দেখে ভীষণ চমকে গেছে। শামীমা ভাবী নিজ থেকেই কিছু একটা অনুমান করে আম্মার কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন,
” খালাম্মা, চলেন মেহমানদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করি।
আম্মা তখনো ঘোরের মধ্যেই আছে। তাই কাউকেই ভালো মন্দ জিজ্ঞেস না করে না করে ভাবীর সাথে আবার রান্নাঘরে চলে গেল। ততক্ষণে জোবায়ের ভাই, আব্বা আর নোমানও ড্রইংরুমে এসে উপস্থিত হয়েছে। তারা তিনজনেই মিহির ভাইয়ের পরিবারের সবাইকে দেখে প্রথমে চমকে গেলেও পরক্ষনেই নিজেদেরকে সামলে নিয়ে তাদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন।
আমি আড়চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে মিহির ভাইকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে না পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। নিধি এতক্ষণ আমাকেই লক্ষ্য করছিল। আমাকে এদিক সেদিক তাকাতে দেখে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে দুষ্টুমির সুরে আস্তে করে বলল,
” তোমার মিহির ভাই নিচে গাড়িতে অভিমান করে বসে আছে। আমি এত করে আমাদের সাথে আসতে বললাম কিন্তু কিছুতেই আসতে রাজী হলো না। জেদ ধরে গাড়িতেই বসে আছে। বাবা আর মাকে বলে দিয়েছে বিয়ের তারিখ একেবারে পাকা করে তারপরেই যেন যায়৷ বিয়ের পর নাকি তোমাকে উচিত শিক্ষা দিবে।
আমি চুপচাপ নিধির কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওকে বললাম,
” তোমরা সবাই এত সকালে আসলে কেন? পরেও তো আসতে পারতে? সবাইকে দেখে তো মনে হচ্ছে এক্ষুণি ঘুম থেকে উঠিয়ে হাত পা বেঁধে এখানে নিয়ে এসেছে।
নিধি খিলখিল করে হেসে ওঠে বলল,
” তুমি একদম ঠিকই ভেবেছো। আমাদের সবাইকে ভাইয়া ভোর বেলায় ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়েছে। তারপর আব্বু আর আম্মুকে বলেছে আর এক মূহুর্তও দেরি না করে তোমাদের বাড়িতে এসে ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়ের চূড়ান্ত কথা পাকা করতে। ভাইয়ার কথা শুনে আব্বু খুব রেগে যায়। ভাইয়াকে অনেক কিছু বলে। কিন্তু ভাইয়া সেসবে পাত্তা না দিয়ে আম্মুকে বলে, তোমাকে যদি পুত্রবধূ হিসেবে না মেনে নেয়, তবে ভাইয়া অন্য কাউকেই বিয়ে করবে না। সারাজীবন একাই কাটিয়ে দিবে। আমরা সবাই ভাইয়ার স্বভাব খুব ভালো করেই জানি। ভাইয়া যা বলছে তাই করবে। আর তাই আম্মু ঘাবড়ে গিয়ে আব্বুকে জোর করে রাজী করিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। আসলে কী জানো আরজুপু, আম্মু ভাইয়াকে আমাদের সবার চাইতে বেশি ভালোবাসে। তাই তো তোমাকে অপছন্দ করা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ভাইয়ার খাতিরেই এই বিয়েতে রাজী হয়ে গেছে! নিধির কথা শুনে আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম, তারমানে আংকেল আন্টি এখনো এই বিয়েতে রাজী না! তারা খুশিমনে এখানে আসেননি? শুধুমাত্র মিহির ভাইয়ের কথা রাখতেই তারা নিজেদের অনিচ্ছায় জোর পূর্বক এসেছেন!
.
ঘন্টা খানেকের মধ্যেই সকলের জন্য নাস্তা আয়োজন করে ফেলা হয়েছে। শামীমা ভাবী আর আম্মা দুজনে মিলে সবকিছু করেছেন। আমিও ফাঁকে ফাঁকে তাদেরকে সাহায্য করেছি। সবাইকে নাস্তার প্লেট দিয়ে একটু সরে আসতেই নিধি একটা প্লেট এনে আমার হাত ধরিয়ে দিয়ে বলল,
” ভাইয়াকে জোর করে নিচে থেকে এনে তোমার রুমে বসিয়ে রেখেছি। কাল বিকেলে তোমাকে মার্কেটে দেখার পর থেকে এখনো পর্যন্ত কিছুই খাইনি। যাও, ভাইয়াকে গিয়ে নাস্তা খাইয়ে দাও।
আমি লজ্জায় কুঁকড়ে ওর দিকে তাকালাম। মেয়েটা দেখতে যেমন সুন্দরী ওর মনটাও তেমন স্বচ্ছ!
.
নাস্তার প্লেট নিয়ে আমার রুমেই আসতেই দেখি মিহির ভাই হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে সকালে আমার ব্যবহৃত আধভেজা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছছেন। আমি তাকে সেটা রেখে দিতে বলে অন্য একটি পরিস্কার তোয়ালে দিতে চাইলে তিনি আগের তোয়ালেটা দিয়েই মাথা মুছতে লাগলেন। আমি নাস্তার প্লেটটা টেবিলে রেখে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর তার হাত থেকে তোয়ালে কেড়ে নিয়ে তার ভেজা চুলগুলো মুছে দিতে গেলেই তিনি খপ করে আমার দুই হাত তার একহাতের মাঝে বন্দি করে নিয়ে রাগী সুরে বলেন,
” আমার যত্ন করার অধিকার এখনো দেইনি তোমাকে।
তার গম্ভীর মুখ দেখে আমিও বললাম,
” ঠিক আছে, তাহলে আমি অন্য কারোর অধিকারের দায়িত্ব নিয়ে নিবো।
এই বলে আমি সেখান থেকে চলে আসতে চাইলেই মিহির ভাই হেঁচকা টানে পুনরায় আমাকে তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলেন,
” আমার পছন্দের রঙের শাড়ি পরে অন্যের অধিকারের দায়িত্ব নেওয়ার খুব শখ তোমার! আমার জিনিস আমি খুব শক্ত করে আগলে রাখতে জানি আরজু।
তার রাগে লাল হয়ে যাওয়া চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে আমি অভিমানের সুরে বললাম,
” আপনার উপর তো অধিকার দেখাতেই চেয়ে ছিলাম। কিন্তু আপনিই তো আমাকে সেই সুযোগ দেননি। নিজ থেকে অধিকার দিয়েও আবার নিজেই আমাকে বঞ্চিত করে দিয়েছেন।
আমার কথা শুনে মিহির ভাইয়ের রাগ কমতে শুরু করে। তিনি শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
কিন্তু আমার মনে বিদ্রোহ জেগে ওঠেছে। আমি তাকে একের পর এক প্রশ্ন করতে শুরু করলাম, কেন তিনি হুট করেই সেদিন এমন করেছিলেন? কেন আমাকে অন্যের সাথে বিয়ে দিতে রাজী হয়েছিলেন? আর কেন ই বা আমরা সেই বাড়ি ছেড়ে চলে আসার সময় তিনি তার অধিকারের জোরে আমাকে আটকাননি? কেন?
মিহির ভাই আমার প্রশ্ন বাণে জর্জরিত হতে থাকেন। আচমকায় তিনি ধপ করে খাটে বসে পড়েন। তারপর তার উষ্ণ দুই হাতে আমার দুটো হাত শক্ত করে চেপে ধরে আহত সুরে বলেন,
” ঐ দিন বিকেলে রিধি ছাদে তোমাকে আর আমাকে একসাথে দেখে ফেলেছিল। তারপর ও সেটা আব্বুকে বলে দিলে, আব্বু আমাকে তার রুমে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন আমি কাকে বেশি ভালোবাসি; তোমাকে নাকি আম্মুকে? তাঁর প্রশ্ন শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়ে ছিলাম। আমাকে নিশ্চুপ দেখে আব্বু বলেছিলেন, আমি তোমাদের দুজনের মধ্যে যেকোনো একজনকেই বেছে নিতে পারবো। এবং তারপর অন্য জনকে দূরে সরিয়ে দিয়ে ভুলে যেতে হবে। আমার অবস্থা তখন এমন ছিল, সামনে সাগর আর পিছনে কুয়া। আব্বু আমাকে হুমকি দিচ্ছিলেন, আমি যদি তার অমতে তোমাকে বিয়ে করি তবে তিনি আম্মুকে তালাক দিয়ে দিবেন! তবুও কোনো কালো মেয়েকে তার ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিবেন না।
এমন জঘন্য আর লম্পট চরিত্রের লোকটা আমার বাবা সেটা ভেবেই প্রচণ্ড ঘৃণা হচ্ছিল। আম্মুকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। মায়ের মৃত্যুর পর আম্মুই আমাকে তার প্রথম সন্তান হিসেবে বুকে আগলে নিয়েছিলেন। মাতৃ মমতায় তিনি আমাকে লালন পালন করেছেন। তোমার চেয়ে আম্মুই আমার কাছে বেশি মূল্যবান ছিল। তাই আমি তোমাকে রেখে আম্মুকেই বেছে নিই কারণ আমি আম্মুর কষ্টের উৎস হতে পারবো না।
মিহির ভাই কাঁদছেন। তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরছে। আমি আলতো করে তার চোখের পানি মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” তাহলে আজ সকালে আংকেলকে রাজী করালেন কীভাবে এখানে এসে আপনার সাথে আমার বিয়ের কথা পাকা করতে? আর তিনি আমাকে মেনে নিতে রাজীই বা হয়েছেন কেন?
মিহির ভাই রাশভারী কণ্ঠে বললেন,
” কাল সারা রাত এটাই ভেবেছি যে আব্বুকে কীভাবে রাজী করাবো। এবং ভোরের দিকে আমি আম্মুকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে আমাদের পুরো ঘটনা খুলে বলি। সব শুনে আম্মুও আব্বুর মতো তোমাকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে রাজী হলেন না। কারণ কালো রঙ আম্মারও খুব অপছন্দের। তারপর আর কোনো উপায় পেয়ে আমি আম্মুকে চিরদিনের জন্য বিয়ে না করার হুমকি দিলে, আম্মু ভয় পেয়ে যায়। আমি জানি আম্মু আমাকে তার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। আর তাই কোনো কিছুর বিনিময়ে আমাকে হারাতে চাইবে না। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে তখন সাথে সাথে আমার হুমকিতে কাজ হয়; আম্মু তখনি আব্বুকে সহ বাকি সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে এখানে নিয়ে এসেছে। যদিও আব্বু সারা রাস্তা বিড়বিড় করে এটা ওটা বলে আম্মুকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে; কিন্তু আম্মুর কাছে পাত্তা না পেয়ে তার কাজে সফল না হয়ে মন খারাপ করে আছে।
আমি মিহির ভাইয়ের পাশে বসে তার কাঁধে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনি আমাকে ভালোবাসেন মিহির ভাই?
মিহির ভাই আমার চোখের দিকে চেয়ে গম্ভীর সুরে বলেন,
” শেষ বারের মতো বলছি, আমাকে মিহির ভাই বলে ডাকবে না।
” কী বলে ডাকবো তাহলে?
” যেটা তোমার ইচ্ছা।
আমি দুষ্টুমি করে বললাম,
” কালো মিহির বলে ডাকবো।
এই কথায় তিনি মুচকি হাসলেন। কিন্তু কিছু বললেন না।
” কী হলো বলেন না কেন?
” কী বলবো?
” আমাকে ভালোবাসেন?
মিহির ভাই পুনরায় আমার চোখে চোখ রেখে মোলায়েম সুরে বললেন,
” বাসি! আমি ভালোবাসি তোমাকে আরজু; খুব ভালোবাসি।
এরপর দুজনেই নিশ্চুপ থেকে একে অপরের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে চোখে চোখে কথা বলতে লাগলাম। হঠাৎ মিহির আমার কানে ফিসফিস করে বলেন,
” বিয়ের পর কখনো কালো রঙের কাপড় পরবে না তুমি।
তার কথায় হুট করেই আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি আহত সুরে বললাম,
” কেন আন্টির অপছন্দ বলে?
তিনি ফিসফিস করে বললেন,
” নাহ, তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগে তাই।
তিনি কথাটা এমন ভাবে বলেছেন যে আমি লজ্জা পেয়ে তার দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারছি না।
” আমি জানি আমার পা দুটি সুন্দর। তাই বলে তুমি আমাকে রেখে এখন আমার পায়ের দিকেই তাকিয়ে থাকবে?
মিহির যে এত দুষ্টুমি করতে পারেন সেটা আজই প্রথম জানতে পেরেছি। লোকটার যে আর কত রূপ আছে কে জানে। আমার এখনো তার দিকে তাকাতে লজ্জা লাগছে।
মিহির নাস্তার প্লেট নিয়ে রুটি ছিড়ে নিজেও খেতে লাগলেন সাথে আমাকেও খাওয়াতে লাগলেন। খেতে খেতে তিনি আমাকে আমাদের বিয়ে নিয়ে তার সব পরিকল্পনার কথা বলতে লাগলেন। আমি চুপচাপ তার কথাগুলো শুনছি। সবকিছু আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে। এত সুখ কী সত্যিই আমার জন্য অপেক্ষা করছিল? মিহিরের খাওয়া শেষ হলে আমি পরম নির্ভরতার সাথে আমার দুইহাতে তার একহাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,
” আমাদের ভালোবাসায় যেন কারোর নজর না লাগে।
মিহির মুচকি হেসে আদর মাখা কণ্ঠে বলেন,
” তোমার আমার ভালোবাসায় কখনোই কারোর নজর লাগবে না; কারণ আমাদের “ভালোবাসার রঙ কালো”
.
#সমাপ্ত …..♥
.
.