ভালোবাসার রং কালো পর্ব ৫

#ভালোবাসার_রঙ_কালো 🖤
#চাঁদনী_নূর_লামিয়া
পর্ব-৫
—————————————
.
মিষ্টি একটি সকাল। ভোর কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। গাছে গাছে পাখিদের মেলা বসেছে; কিচির-মিচির শব্দে প্রকৃতিকে মাতাল করে তুলছে। কিছুদূর পর পর হকাররা ফুটপাতে নিজেদের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে। উদ্দেশ্য সকাল বেলা হাঁটতে বের হওয়া স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের কাছে জিনিসপত্র বিক্রি করা। টুথব্রাশ, চিরুনী থেকে শুরু করে থেকে গৃহস্থালি ছোটখাটো অনেক জিনিসপত্রই রয়েছে এদের কাছে। পিচ ঢালা রাস্তায় দুই একজন করে মানুষের আনাগোনা দেখা গেলেও ধীরে ধীরে সেই সংখ্যা বেরে চলেছে। কেউ জগিং সুট পরে কেউ বা নিজস্ব পোশাকেই সকালে হাঁটতে বেরিয়েছে। উঠতি বয়সের একটি ছেলে পত্রিকা বিলি করার জন্য সাইকেলে চড়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। এক জোড়া নব-দম্পতি একে অপরের হাত ধরে ধীরপায়ে চলতে চলতে নিজেদের সুখগল্প করাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই সকাল আর চারপাশের নৈসর্গিক অপরূপ প্রকৃতি সবকিছুই ভীষণ সুন্দর, সুবাহান আল্লাহ! আমি আব্বা আর আম্মা একসাথে রাস্তায় হেঁটে চলেছি। আমি সকালের মন মাতানো শুদ্ধ বাতাস নিঃশ্বাসের সাথে দেহ মনে মিশিয়ে নিচ্ছি। আমার পাশেই আব্বা আর আম্মা নিরবে হেঁটে চলেছে। যদিও আব্বা আম্মার সাথে কথা বলার জন্য অনেক্ষণ যাবত উশখুশ করছে, কিন্তু আম্মা আব্বার সাথে কথা না বলে একমনে হেঁটে চলেছে। আমি বুঝতে পারছি আম্মার মন খারাপ৷ মন খারাপের কারণ দুটি। আর আশ্চর্যজনক ভাবে সেই দুটি কারণের মূলেই আমি রয়েছি। ভোরে নোমান কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ওর বন্ধুদের সাথে বাসে করে রওয়ানা দিয়েছে। ওরা কীভাবে কক্সবাজার যাবে সেটা জানি না। তবে কয়েক ক্রোশ পথ যাওয়ার পরে ওদের নাকি আবার বাস বদল করতে হবে। সেটাই নোমান আর ওর বন্ধুরা সবাই বলাবলি করছিল। আব্বা আম্মার সাথে আমিও নোমানকে এগিয়ে দিতে এসেছিলাম। আমরা আধাঘণ্টার মতো বাস স্টপে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নোমানদের আকাশী রঙয়ের বাসটা আমাদের চোখের আড়ালে উধাও হয়ে যাওয়ার পরে আমরা সেখান থেকে হেঁটে বাড়ির পথ ধরি। নোমানের কক্সবাজারে পিকনিকে যাওয়ার চাঁদার পুরো টাকাটা আব্বাই দিয়েছে। আম্মার ঘোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আব্বা নোমানকে আরও দুই হাজার টাকা বাড়িয়ে মোট পাঁচ হাজার টাকায় দিয়েছে। ছেলে মানুষ জীবনের প্রথম কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে ওর কিছু হাত খরচ তো লাগতেই পারে। কিন্ত আম্মা নোমানকে একা যেতে দিতে রাজী হচ্ছিলো না। কারণ আজকাল রাস্তাঘাটে দূর্ঘটনার হার বেড়ে যাওয়ায় আম্মার ভীষন ভয় করে। তার উপরে একসাথে এতগুলো টাকাও অপ্রয়োজনে খরচ করার কী দরকার। আম্মার যুক্তিগুলো জোরালো হলেও আব্বা নোমানকে কক্সবাজার যাওয়ার অনুমতির সাথে পাঁচ হাজার টাকাও দিয়েছে। আর এই পুরো ব্যাপারটা আমার হস্তক্ষেপে সম্পন্ন হয়েছে বিধায় আম্মার মন খারাপের পিছনে আমার পরোক্ষভাবে হাত রয়েছে। আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আম্মার বলার পরেও আমি আব্বাকে মুদি দোকানদারকে বিয়ের জন্য মানা করিনি। মিহির ভাইয়ের মা উনার এক দূর সম্পর্কের গরীব আত্নীয়াকে গৃহস্থালি কাজ কর্মের জন্য গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন। সেই মহিলার নাম শাহানা। তাকে আমি শাহানা বুবু বলে ডাকি। কারণ তিনি আন্টি আর আম্মা দুই জনকেই খালাম্মা বলে ডাকেন। তাই আমি তাকে বুবু বলেই ডাকি। আপা বলে ডাকা নাকি তার পছন্দ না। শাহানা বুবু খুব মজা করে কথা বলেন। রিধির বিয়ে নিয়ে যখন দুই পক্ষের মধ্যে কথা বার্তা চলছিল তখন একদিন মুখ বাঁকিয়ে সুর করে বলেছিলেন, ” আবিয়াত্তা মাইয়া হইল বুড়ি (বড়ই) গাছের মতন। সবাই লোভ করে৷ যে খাইতে পারবো সেও গাছে ঢিল মারে। আর যে না খাইতে পারবো সেও একবার ঢিল দেওয়ার চেষ্টা করে!
তার এই কথাটা একবার আম্মাকে বলে দেখা উচিত৷ কথাটা শুনার পরে আম্মার মুখের আদলটা দেখতে কেমন হবে কে জানে! আমি যখন এইসব উথাল-পাথাল চিন্তায় ডুব আছি তখনি আব্বা আমাকে আর আম্মাকে নিয়ে রাস্তা থেকে অনেকটা দূরে নিরিবিলি একটা জায়গায় বেঞ্চিতে বসে পড়ল। আব্বার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে আমি মনে মনে হাসলাম। আসলে আম্মার সাথে কথা বলার জন্যই আব্বা আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। আমাকে মাঝখানে রেখে তারা দুজন দুইপাশে বসে পড়ে। আম্মা অন্যদিকে মুখ করে বসলে আব্বা প্রথম কথা বলতে শুরু করে,
” শারমিন তোমার মন খারাপ হয়ে আছে কেন?
আম্মা আব্বার কথার জবাব না দিয়ে মৌনতা পালন করতে লাগল।
” কী ব্যাপার তুমি আমার সাথে কথা কেন বলছো না?
” কী কথা বলবো আমি তোমার সাথে? তুমি বা তোমার ছেলে মেয়ে কেউ আমার একটা কথাও শোনো? না আমাকে কোনো দাম দাও তোমরা?
আম্মার কথা শুনে আব্বা অনেকটা চুপসে গেছে। বুঝাই যাচ্ছে আম্মা খুব রেগে আছে। তবে আব্বাও দমে যাওয়ার পাত্র নন। আম্মার রাগ ভাঙিয়েই ছাড়বে। এদিক সেদিক তাকিয়ে হুট করেই আব্বা আমাদেরকে রেখে সেখানে থেকে উঠে চলে গেল। কয়েক মিনিট পরে কাগজে মোড়ানো কি যেন নিয়ে ফিরে আসলো। আব্বা কাগজের ঠোঙা থেকে চ্যাপা শুটকির ভর্তা মাখানো চিতই পিঠা কিনে নিয়ে এসেছে আমাদের জন্য। আস্তে আস্তে শীত পড়তে শুরু করেছে। তাই রাস্তার মোড়ে মোড়ে, ফুটপাতে সিজনাল ব্যবসায়ীরা ছোট ছোট খুপরিতে পিঠার দোকান দিয়ে বসেছে। ভর্তা মাখানো চিতই পিঠা দেখে আমার জিবে জল এসে পড়েছে। আমি আব্বার হাত থেকে পিঠা নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। আব্বা সবগুলো পিঠা আমার জন্য রেখে একটা পিঠা আম্মার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
” নাও গরম গরম পিঠা খেয়ে নাও।
জবাবে আম্মা গরম চোখে তাকালে আব্বা এই পিঠাটাও আমার জন্য রেখে দিলেন। আমার মনে হচ্ছে তাদের দুজনকে একা কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিত। তাই আমি একটা পিঠা খেতে খেতে সেখান থেকে উঠে চলে যেতে চাইলেই আম্মা আমার হাত ধরে টান দিয়ে আবার তাদের মাঝখানে বসিয়ে দিলো। আর তা দেখে আব্বার মুখটা ছোট হয়ে গেল। এর দ্বারা আম্মা আব্বাকে বুঝিয়ে দিয়েছে আম্মার রাগ এখনো কমেনি। স্বামী স্ত্রীর মনো- মালিন্যের মাঝে নাকি তৃতীয় পক্ষ হয়ে থাকতে নেই। তাই আমি তাদের দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে পিঠা খাওয়ায় মন দিলাম। আহা পিঠাগুলো খেতে দারুণ মজা। আব্বা আর আম্মার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে না দেখে আম্মা বলল,
” তুমি ওদেরকে আসতে নিষেধ করে দাও।
আব্বা জিজ্ঞেস করল,
” কাদের আসতে নিষেধ করে দিবো?
” ঐ মুদি দোকানদার ছেলের পরিবারকে। যেখানে তাদের সাথে আত্নীয়তায় করবো না, সেখানে মেয়ে দেখাবো কেন?
” এমন করে বলছো কেন? মুদি দোকানদাররা কি বিয়ে করে সংসার করছে না? তাদের কি সুখী জীবন হয় না?
” হ্যাঁ করছে। কিন্তু তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী মেয়েকেই বিয়ে করছে।
” শারমিন তুমি ভুলে যাচ্ছো আমাদের মেয়েরও কিন্তু একটি দূর্বলতা আছে। আর তাছাড়া মানুষকে কাজ দিয়ে না বরং তার চরিত্র এবং ব্যবহার দিয়ে বিচার করবে। আমি ছেলের সম্পর্কে সব খুঁজ খবর নিয়েছি। ছেলেটা ভদ্র আর মার্জিত। আর ও নিজেও মাস্টার্স পাশ। পরিবারও ভালো। সবকিছু জেনে শুনেই আমি এই ব্যাপারে এগিয়েছি। ছেলে দেখতে শুনতে ভালো আর সুন্দর। তাহলে তুমি ছেলেকে না দেখেই কেন আগে থেকে এই বিয়ের জন্য না করছো?
আব্বার এত গোছালো কথা শুনেও আম্মা মত পালটালো না। বরং জোর গলায় বলল,
” আরজু মাস্টার্স পাশ করেছে। চাইলেই ভালো একটা চাকরির ব্যবস্থা করে নিজের ভর পোষনের দায়িত্ব ও নিজেই নিতে পারবে। তাও আমি কোনো মুদি দোকানদের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিবো না ব্যস।
আব্বা আম্মাকে বুঝানোর উদ্দেশ্যে কোমল কণ্ঠে বলেন,
” কাউকে ছোট করে দেখো না শারমিন। কখন কার অবস্থার পরিবর্তন হয় তা কেউ বলতে পারে না৷ এই আমাকেই দেখো না। এক সময় তো আমারও কোনোকিছুর অভাব ছিল না। বিয়ের পরে আমার সংসারে তোমার গা ভর্তি গয়না আর বিরাট বড় সংসার সবই ছিল। কিন্তু এখন তোমার কানের দুল আর নাকে নাকফুল ছাড়া আর একটা গয়নাও নেই। আমার এত টাকা পয়সা ধন সম্পদ ছিল। কিন্তু আজ তোমাদেরকে নিয়ে অন্যের বাড়িতে তাদের আশ্রিত হয়ে থাকতে হচ্ছে। ছেলের বাবারও এককালে অবস্থা ভালো ছিল। কিন্তু এখন আর তাদের সেই আগের অবস্থা নেই। তাই সংসারের হাল ধরতে সে চাকরি খোঁজার পাশাপাশি মুদির দোকান দিয়ে বসেছে। আর আমি তো এতে ভুল কিছু দেখছি না৷ কারণ ব্যবসা করা তো হালাল। তাহলে তুমি কোন যুক্তিতে এই বিয়ের জন্য না করছো। হতে পারে আজ সে মুদি দোকানদার কিন্তু পরে হয়তো বড় ব্যবসায়ীও হয়ে যেতে পারে। আল্লাহপাক কখন কাকে কীভাবে পরীক্ষা করেন কেউই জানে না। আর রইল আরজুর চাকরি করার কথা। ও যদি চাকরি করতেই চাই তবে বিয়ের পরে স্বামীর অনুমতি নিয়ে করতে পারে৷ কিন্তু যতদিন আমার ঘরে থাকবে ততদিন ওকে কাজ করার অনুমতি কখনওই দিবো না আমি। আর এই ব্যাপারে আরও অনেক আগেই বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল আমাদের মধ্যে। আরজুও আমার ইচ্ছে মেনে নিয়েছে। ও তো চাকরি করতে চাইছে না। তাহলে তুমি কেন ওকে জোর করছো? শিক্ষিত বলেই যে আমার মেয়ে নিজ যোগ্যতার চেয়ে নিচে বিয়ে না করে চাকরি করে নিজের ভরণ পোষণ করার দায়িত্ব নিয়ে সারাজীবন বিয়ে না করে চিরকুমারী থাকলে সুখী হবে সেটা শতভাগ নিশ্চিত করে বলতে পারবে তুমি? ভাগ্যের উপরে কারোর জোর চলে না। তাই ভাগ্যে যা থাকে সেটা হাসিমুখে মেনে নেওয়ায় বুদ্ধিমানের লক্ষণ। আর এতেই প্রকৃত সুখী হওয়া যায়।
আব্বার এত সুন্দর আর যুক্তি নির্ভর কথাগুলো শুনে আম্মার মন কিছুটা নরম হলো। আব্বা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলে আমি তাঁর কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে রইলাম। আব্বার কাঁধটা আমার জন্য পরম নির্ভরতার স্থান। আমার একপাশে আম্মা আর অন্যপাশে আব্বার মমতার বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে আছি আমি। এই মূহুর্তে নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। কে বলেছে সুখী হতে অনেক কিছু লাগে? এই যে আমি শূন্য হাতেও পৃথিবীর হাজার হাজার মানুষের চাইতে অনেক বেশি সুখী আছি! আলহামদুলিল্লাহ।
.
বাড়িতে আসতেই মিহির ভাইয়ের মায়ের সাথে দেখা হয়ে গেল আমাদের। আন্টিকে দেখে আব্বা হাসিমুখে তার ভালো মন্দ কৌশলাদি জিজ্ঞেস করে ভেতরে চলে গেলেন। আমিও আব্বাকে অনুসরণ করে তাঁর পিছনে যেতে যেতে শুনি আন্টি আম্মাকে জিজ্ঞেস করছে,
” কি গো নোমানের মা, এত সকালে সবাই মিলে কোথায় গিয়েছিলে?
আম্মা উত্তরে কি বলেছে সেটা শুনতে পাইনি। ততক্ষণে আমার রুমের সামনে এসে পড়েছি। মিহির ভাইয়ের মা যেমন আমাকে অপছন্দ করেন৷ ঠিক তেমনি আমিও তাকে কিছুটা অপছন্দ করি। তার আমাকে অপছন্দ করার কারণ না জানলেও আমি তাকে একটি কারণে অপছন্দ করি। তিনি যখন আম্মাকে ইসরাতের মা বলে না ডেকে নোমানের মা বলে ডাকেন। তখন আমার খুব রাগ হয়। তিনি যেন ইচ্ছে করেই আম্মার পুরনো ক্ষত মনে করিয়ে দিতেই নোমানের মা বলে ডাকেন। কারণ আম্মার অতীত কিছু কষ্টের কথা তারা যখন আমাদের বাড়িতে ছিল, তখন আম্মা আন্টিকে বলেছিল। আর সেই কথাগুলোই আজ আম্মার জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রুমে ঢুকেই জানালার কাছে চলে আসলাম। যদিও জানালা দিয়ে আশেপাশের বিল্ডিং ব্যতীত কিছুই দেখা যায় না৷ তাও আমার জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কল্পনায় আকাশ দেখতে ভালো লাগে। কিছুটা অন্যমনষ্ক হয়ে অতীতের স্মৃতিতে ডুব দিলাম।
পর পর চার মেয়ের জন্ম দেওয়ায় দাদু আম্মার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁর এতবড় ব্যবসা আর বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে নাতির আশা করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার একমাত্র পুত্রবধূ যখন ছেলের বদলে চারটি মেয়ের মা হলেন, তখন থেকে দাদু আম্মাকে আর সহ্য করতে পারছিলেন না। দাদু আম্মাকে আব্বার নাম নিয়ে আমিনূরের বউ বলে ডাকতেন। কিন্তু আমাদের চার বোনের কারোরই নাম নিয়ে আম্মাকে ডাকতেন না। আমাদের দেশে অঘোষিতভাবে একটি রীতি চালু আছে। সেটা হলো প্রথম সন্তানের জন্মের পর সেই সন্তানের নামেই মাকে ডাকা হয়। কিন্ত কেউ যখন আম্মাকে ইসরাতের মা বলে ডাকতো সেটা দাদুর অপছন্দ ছিল। দাদুর শক্ত ব্যবহারে আম্মা খুব কষ্ট পেতো। আর অনেকটা মানসিক চাপের মধ্যেও থাকতো। অবশেষে দাদুর ভবিষ্যৎ বংশধরকে নিয়ে চিন্তার অবসান ঘটিয়ে নোমান আসে আম্মার কোল আলো করে। নোমানের জন্মে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন দাদু। নোমানের আকীকার পর থেকেই দাদু আম্মাকে নোমানের মা বলে ডাকতেন। দাদুর সেই ডাকে আম্মার কোনো আনন্দ হতো না বরং কষ্ট হতো। দাদুর ধারণা ছিল, একমাত্র ছেলের নামেই বাবা-মাকে ডাকতে হয়। কারণ মেয়েরা তো অন্যের আমানত থাকে। সঠিক সময়ে সব মেয়েরাই বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু ছেলে সন্তান আজীবন মা- বাবার সাথেই থাকে। দাদুর এমন স্বার্থপরের মতো চিন্তাধারা আম্মার ভালো লাগত না। আর এই কথাটাই আম্মা মিহির ভাইয়ের মাকে বলেছিলেন। কিন্তু তখন তিনি আম্মার মনো কষ্ট শুনে সান্ত্বনার বাণী শোনালেও এখন তিনিই আম্মাকে নোমানের মা বলে ডেকে আম্মাকে সেই পুরনো কষ্ট মনে করিয়ে দেয়! আমরা মানুষেরা কত অদ্ভূত! যেখানে আমাদের নিজেদের জীবনেই দুঃখ-কষ্ট আর অপূর্ণতার কোনো শেষ থাকে না। সেখানে আমরা অন্যদেরকে তাদের দূর্বলতাগুলো নিয়ে খুঁচিয়ে কষ্ট দিতে পৈশাচিক আনন্দ পাই! যেই সম্পদ আর ব্যবসা দেখাশোনা করার কথা ভেবে দাদু তাঁর বংশধর আর আব্বার পরে তাঁর সবকিছুর উত্তরাধিকারের আশায় ছিলেন। সেই সম্পদ আর ব্যবসা জীবদ্দশাতেই তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায়! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দাদু একটা ঘোরের মধ্যেই বেঁচে ছিলেন। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতেন না তাঁর এত সম্পদ এখন আর নেই! আমরা মানুষেরা কিসের ভিত্তিতে এত বড়াই করি? যেটা নিয়ে অন্যের তুলনায় নিজেদের বড় ভাবি সেটাই তো যেকোনো সময় আমাদের কাছ থেকে চলে যেতে পারে! সময় আর পরিস্থিতি জীবনভর এক রকম থাকে না। কিন্তু কৃতকর্মগুলো ঠিকই থেকে যায়। তা ভালো হোক কিংবা খারাপ!
.
মিহির ভাইয়ের ওয়ালেট হাতে নিয়ে তার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দরজাটা ভেতর থেকে লাগানো। দরজায় টোকা দিবো কি না সেটাই ভাবছি। আচ্ছা আমি কি তাকে ভয় পাচ্ছি? আমি তো কোনো অন্যায় করছি না। তার দেওয়া দয়া তাকে ফিরিয়ে দিতে এসেছি। আমি কেন তার ওয়ালেট নিজের কাছে রাখবো? আর কেনই বা এর থেকে নোমানকে টাকা দিবো? নোমান আমার ভাই তার না। তাহলে কেন আমার এত সংকোচ হচ্ছে। এসব ভাবতেই ভাবতেই আমি দরজায় টোকা দিলাম। এখন যদি কেউ বিশেষ করে আন্টি আমাকে তার ছেলের রুমের সামনে তারই ওয়ালেট হাতে দেখে ফেলেন, তবে আমার চরিত্রের যে পোস্টমর্টেম করে ছেড়ে দিবেন সেটা আমি ভালো করেই জানি। আন্টির কথা ভাবতেই ঘামতে শুরু করলাম। আশ্চর্য! আমি ভয় পাচ্ছি কেন? আর আন্টি দেখলেই বা কী হবে? আরজু তুই ঐ মহিলাকে খুব বেশি পাত্তা দিয়ে ফেলছিস। এদের মা ছেলেকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। মনে মনে নিজেকে একদফা শাসন করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলাম। পুরো রুম খালি পড়ে আছে। মিহির ভাইকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। তার রুমটাও অনেক বড় সাথে বড়সড় বেলকনিও আছে। শাহানা বুবুর থেকে শুনেছি তিনি নাকি প্রায়ই রাত জেগে বেলকনিতে ফ্লোরে গদি বিছিয়ে তাতে বসে অফিসের কাজ করেন। আর তখন শাহানা বুবুকেই তাকে একটু পর পর চা বানিয়ে দিতে হয়। তিনি নাকি কফি খান না। চিনি ছাড়া চা খান। আমি একবার পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিলাম। একটি ডাবল বেড তাতে আরাম দায়ক বিছানা পাতা। তার পাশে ছোট একটি টেবিল। আরেক পাশে আলমারি তার পাশেই ড্রেসিং টেবিল। ফুল সেট সোফা সব মিলিয়ে সম্পূর্ন রুমটা খুব সুন্দর। রুম সাজানোর ব্যাপারে মিহির ভাইয়েররুচির তারিফ করতে হয়। অতঃপর তার ওয়ালেটটা ব্যাড সাইড টেবিলে রেখ চলে আসতে যেই না দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম, তখনি পিছনে থেকে মিহির ভাইয়ের রাশভারী কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম,
” যা একবার দিয়ে দেই সেটা আর ফেরত নেই না আমি। আর যদি কেউ ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, তবে তাকে এর উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করতে হয়!
.
#চলবে ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here