ভালোবাসার রং কালো পর্ব ৮+৯

#ভালোবাসার_রঙ_কালো🖤
#চাঁদনী_নূর_লামিয়া
পর্ব-৮-৯
——————————————-

.
পর্ব-৮
.
রাতে আব্বা নোমান আর আম্মাকে নিয়ে তাঁর বন্ধুর বাসাতেই থেকে যান। বিয়ে বাড়িতে কত কাজ থাকে, তারপর মেয়ের বিদায়ের পরে তাদের মনের অবস্থাও ভালো ছিল না। তাই আব্বা আর আম্মা আজকের রাতটা সেখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আব্বা অবশ্য নোমানকে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু আমিই ওকে পাঠাতে নিষেধ করে দিয়েছি। নোমানটা সচরাচর এসব অনুষ্ঠানে খুব কম যায়। এইবার যখন গেছে তখন থাকুক না একরাত বিয়ে বাড়িতে। আব্বা আম্মা আর নোমানের সাথে কথা বলে আমি নিধির রুমের দিকে পা বাড়ালাম। আজকের রাতটা ওর সাথেই থাকবো বলে ঠিক করেছি। আজ এই বাড়িতে অনেক মেহমানরা আছে। রিধির বর আর ওর শ্বশুড়বাড়ির দুই একজন আত্নীয় রয়ে গেছে। ছোট আরজুকে ওর মা অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় এসে নিয়ে গেছে। ওর মাকে দেখে আমি ভীষণ অবাক হয়েছি। আরজুর সাথে ওর মায়ের কোনো মিল নেই। আরজুর মা চোখ ধাঁধানো সুন্দরী; অথচ আরজু দেখতে কালো। শুধু কালো না, আমার মত কুচকুচে কালো ওর গায়ের রঙ! ওর মাকে দেখলে মনে হয় না আরজু তার মেয়ে। ছোট আরজু আর ওর মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে হুট করেই অন্য একটি কথাও আমার মাথায় ঘুরতে লাগল। মিহির ভাইয়ের গায়ের রঙ কালো কিন্তু আংকেল আর আন্টি দুজনেরই গায়ের রঙ ফর্সা। রিধি নিধি আর নাহিদের গায়ের রঙও ফর্সা এবং ওরা সবাই দেখতে আন্টির মতো সুন্দর হয়েছে। মিহির ভাই যদিও ফর্সা নন কিন্তু আংকেলের সাথে তার চেহেরা এবং শরীরের আদল অনেকটাই মিলে। কিন্তু আন্টির সাথে তার কোনো মিল নেই! রিধি নিধি আর নাহিদ তো আংকেল আর আন্টি দুজনের মতোই দেখতে হয়েছে। তাহলে মিহির ভাই একা আংকেলের মতো দেখতে হলেন কেন? তার মাঝে আন্টির কোনো আদলই নেই কেন? তিনি তো তাদের বড় ছেলে, তাহলে দুজনের আদল না পেয়ে শুধু একজনের মতো দেখতে হলেন কেন?
” কি গো আরজুপু, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এত গম্ভীর হয়ে কী ভাবছো?
নিধির কথায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম। মিহির ভাইয়ের কথা ভাবতে ভাবতে কখন ওর রুমের সামনে চলে এসেছি টেরই পাইনি।
” আসলে তোমাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম,আজকের রাতটা কী আমি তোমার রুমে থাকতে পারি?
নিধি ডান চোখের ভ্রু নাচিয়ে বলল,
” সত্যিই কী শুধু থাকতে চাও নাকি অন্য কোনো মতলব আছে তোমার?
এই মেয়েটা কি মনের কথা পড়তে পারে নাকি? আমি তো মনে মনে অন্যকিছু চিন্তা করেই আজকে রাতে ওর সাথে থাকবো বলে ঠিক করেছি। নিধিটা আসলেই খুব চালাক। ওর সাথে ভেবে চিন্তে কথা বলতে হবে। আমি ওর সন্দেহকে উড়িয়ে দিতে বললাম,
” কিসের অন্য মতলব? আমি তোমার সাথে আজকে থাকতে চাইছি বলেই কী তুমি এটা বললে?
নিধি দরজা থেকে সরে গিয়ে আমাকে ভেতরে যেতে ইশারা করলে আমি রুমের ভেতরে ঢুকে পড়ি। ও দরজা লাগিয়ে পিছনে ঘুরে বলল,
” আরজুপু আমি আগেও বলেছি, তোমার আর আমার বয়সের তফাৎ কিন্তু খুব বেশি না। সেই হিসেবে আমি তোমার বান্ধুবীর মতো। আর এক বান্ধবী অপর বান্ধুবীর মনের কথা বুঝতে পারার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। তাই আমিও তোমার মনের কথা বুঝে ফেলেছি।
ওর কথায় আমি কাশি দেওয়ার ভান করতেই ও সেদিনের মতো করে আবার আমার মাথায় আর পিঠে হাত বুলাতে থাকে।
” তোমাকে না বলেছি আমার সামনে এসব না করে, যার সামনে কাশলে লাভ হবে তার সামনে কাশবে। সে অতি যতনে তোমার কাশি থামানোর ব্যবস্থা করবে।
বলেই ও আমাকে চোখ টিপ মারল। এই মেয়ে খুব সাংঘাতিক। এর সাথে থাকা মানে সর্বক্ষণ আতংকের মধ্যে থাকা, কখন জানি আবার কী বলে বসে।
.
নিধি আমাকে খুব আপ্যায়ন করছে। আমি আজকে ওর সাথে থাকবো বলে আলমারি থেকে নতুন একটা বিছানার চাদর বের করে আগের চাদরটা তুলে ফেলে নতুন চাদরটা খাটে বিছিয়ে দিয়েছে। রান্নাঘর গিয়ে সেদ্ধ ডিম, কফি,পাউরুটি, চিকেন ফ্রাই আর কী কী যেন একের পর এক ট্রেতে করে নিয়ে এসেছে। ওর পড়ার ছোট টেবিলটার উপরে মাঝারি সাইজের তিনটা ট্রে ভর্তি খাবার দেখে আমি জিজ্ঞেস করি,
” আমাদের সাথে কী অন্য কেউ থাকবে নাকি?
নিধি গরম পানির ফ্লাস্কটা টেবিলের এক কোণে রেখে বলল,
” অন্য কেউ থাকবে না। আমার রুমে আমি কাউকে থাকার অনুমতি দেই না।
” তাহলে আমাকে থাকার অনুমতি দিলে যে?
” ওহো আরজুপু, তুমি হচ্ছো বিশেষ মানুষ। এই রুমে থাকতে হলে তোমাকে আমার থেকে অনুমতি নিতে হবে না৷ এই পুরোটা ফ্ল্যাটই তো তোমার।
” কী বলছো! এই পুরো ফ্ল্যাট আমার মানে?
নিধি চালাকির সাথে কথা ঘুরিয়ে ফেলে বলল,
” আহা আরজুপু তুমি এখন এসব নিয়ে পড়লে কেন? তোমার এমনটা কেন মনে হলো যে আমাদের সাথে অন্য কেউও থাকবে?
” তোমার এত খাবারে আয়োজন দেখে ভেবেছি। তুমি এত খাবার কার জন্য নিয়ে এসছো?
আমি বিছানায় বসে ছিলাম। নিধি আমার মুখোমুখি হয়ে চেয়ারে বসে বলল,
” আমাদের দুজনের জন্য এনেছি। আর এত খাবার কই দেখলে তুমি? মাত্রই তো সামান্য কিছু এনেছি। শিলা ঘুমিয়ে গেছে। নয়তো আরও দুয়েকটা পদ ওকে দিয়ে নতুন করে রান্না করিয়ে নিয়ে আসতাম।
ওর কথা শুনে আমার মুখ হা হয়ে গেল! বলে কী এই মেয়ে, এতগুলো খাবার ওর কাছে মাত্র সামান্য মনে হচ্ছে?
আমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিধি হিহি করে হাসতে শুরু করল।
” আরজুপু ভাইয়ার দিকেও বুঝি তুমি এমন হা করেই তাকিয়ে থাকো?
আমি লজ্জা পেয়ে মুখ বন্ধ করে ফেললাম।
” ইশ কী লজ্জা তোমার! ভাইয়ার কথা তুলতেই একেবারে লজ্জায় মজে গেলে।
” এত খাবার যে নিয়ে আসলে এগুলো খাবে কে?
” বুঝেছি কথা ঘুরাতে চাইছো তাই তো? কে খাবে আবার, তুমি আর আমিই খাবো। এই বাড়িতে আসার পর তুমি এই প্রথম আমার রুমে থাকতে এসেছো, তোমাকে আপ্যায়ন করতে হবে না? তাই এই অল্প আয়োজন করেছি।
নিধিটার মন বিশাল বড়। যেখানে মিহির ভাই ছাড়া এই বাড়ির অন্য কেউ আমাদের এখানে থাকাটা পছন্দ করে না; এমনকি রিধি আর নাহিদও না। সেখানে নিধি আমাকে এত খাতির করছে! মেয়েটার মধ্যে অহম বলতে কিছু নেই। একে তো সুন্দরী তার উপর ধনীর আদুরের দুলারি। তাও ওর মাঝে অহংকারের ছিটেফোঁটাও নেই।
” তুমি আবার ভাবতে বসলে? আচ্ছা সারাক্ষণ এত কী ভাবো তুমি বোলো তো?
নিধির কথায় আমি ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম।
” কই কিছু ভাবি না তো। আচ্ছা ঘুমাবে কখন? রাত তো অনেক হলো?
” কই অনেক রাত হলো? মাত্র তো এগারোটা বাজে।
ওর জবাব শুনে আমি মনে মনে হাসলাম। এরা ভাইবোন দুইটার কাছেই রাতের এগারোটা মাত্র মনে হয়!
” আর তাছাড়া তুমি কী আসলেই শুধু ঘুমাতে এসেছো না কি আমার থেকে কোনো তথ্য জানতে এসেছো?
ওফ! নিধিটা যে কীভাবে মনের কথা সব জেনে ফেলে সেটাই বুঝতে পারি না। ওর থেকে কিছুই লুকাতে পারবো না। তাই ও আমার পেট থেকে সবকিছু খুঁচিয়ে বের করে ফেলার আগে আমারই ওকে বলে দেওয়া উচিত। আমি আমতা আমতা করে ওকে মিহির ভাইয়ের কথা বলতে গেলে ও আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
” এইভাবে না, আগে আসো খেয়ে নেই। তারপর কফি খেতে খেতে তোমার আর ভাইয়ার প্রেম কাহিনী শুনবো।
নিধির মুখে মিহির ভাইয়ের কথা শুনতেই আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। ও পুনরায় আমাকে চোখ টিপ মেরে মিষ্টি করে হেসে ট্রে থেকে খাবারের প্লেটগুলো নামিয়ে বিছানায় রাখতে শুরু করল।
.
নিধি আর আমি মুখোমুখি বসে আছি। দুজনের হাতেই ধোঁয়া উঠা গরম কফির মগ। যদিও আমি কফি খেতে পছন্দ করি না; কিন্তু নিধি খেতে বলাতে না করিনি। কেউ আদর করে কিছু দিলে বা আপ্যায়ন করলে তা প্রত্যাখ্যান করা অভদ্রতা। তাই আমিও আর ওকে জানায়নি যে আমি কফি খেতে পছন্দ করি না। একবার নিজের অপছন্দের কিছু খেলে তেমন অসুবিধে হবে না। কিন্তু কফির মগ মুখের সামনে ধরতেই গন্ধ নাকে গিয়ে পেটে মোচড় দিয়ে ওঠল। কফির গন্ধ সব সময় আমার কাছে অসহ্য লাগে। গন্ধটা কেমন উৎকট মনে হয়। চোখমুখ শক্ত করে কফির মগ মুখের সামনে ধরে আছি। নিধি মনে হয় এবারও আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছে। তাই কফির মগটা আমার হাত থেকে নিয়ে টেবিলের উপরে ট্রেতে রেখে দিয়ে বলল,
” কফি খেতে পছন্দ করো না সেটা আমাকে বোলোনি কেন? মনের কথা চেপে না রেখে মুখে বলে দিবে বুঝেছো। ওর টিপ্পনী বুঝতে পেরে আমি লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে বললাম,
” মনের কথা চেপে রাখিনি, আজ বিকেলে বলে দিয়েছি।
আমার কথা শুনে নিধির গলায় কফি আটকে গেল। ও কেশে উঠলে ওর মুখের কফির কিছু ছিটা এসে আমার মুখেও পড়লো।
” ইশ, সরি সরি আরজুপু এটা আমি ইচ্ছে করে করিনি। আসলে তুমি এমন কথা বললে যে কফি আমার গলাতেই আটকে গিয়েছিল, ঢুক গিলতে পারিনি। তাই কাশি উঠে যায় আর তুমি সামনে থাকায় তোমার মুখে এসে পড়ে।
আমি ওড়নায় মুখ মুছে ওকে শান্ত করতে বললাম,
” আমি কিছু মনে করিনি তুমি অস্থির হয়োও না।
নিধি কফির মগ রেখে আমার একটা হাত চেপে ধরে আহ্লাদী সুরে বলল,
” তুমি একটু আগে যেটা বললে সেটা সত্যি?
আমি মুচকি হেসে জবাব দিলাম,
” হ্যাঁ।
” কীভাবে বললে সবটা বোলো আমাকে।
আমি ওর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললাম,
” তার আগে তুমি বোলো, তুমি কীভাবে জানলে তোমার ভাই আমাকে পছন্দ করে?
” এই প্রশ্নটার উত্তর তোমার জানায় আছে আরজুপু।
ওর ইশারা বুঝতে আমার অসুবিধে হয়নি। তবুও আমি ওকে জিজ্ঞেস করি,
” কিন্তু তুমি মনের কথা কীভাবে বুঝতে পারো?
” কীভাবে বুঝতে পারি সেটা আমি নিজেও জানি না। তবে কী করে যেন বুঝে যাই। বিশেষ করে কারোর মুখের দিকে তাকালেই তার মনের কথা বুঝতে পারি।
” কী সাংঘাতিক! তোমার সামনেই তো থাকা বিপদ দেখছি।
” আরে বিপদ হবে কেন। আমি তো আর কাউকে বলি না যে আমি তার মনের কথা বুঝতে পারছি।
” তাহলে আমাকে বললে কেন?
” তুমি বিশেষ তাই বলেছি।
” এটা তো তাহলে তোমার একটা দূর্লভ ক্ষমতা।
” হতে পারে।
” আমি ছাড়া আর কেউ জানে না তোমার এই ক্ষমতার ব্যাপারে? তোমার পরিবারের কেউ জানে না?
” মিহির ভাই জানে। আর এখন তুমি জানলে।
” তাহলে তুমি সেদিন এটাও বুঝে ফেলেছিলে যে আমি মিহির ভাইকে আমার স্বপ্নে দেখেছিলাম?
” হ্যাঁ। আর তাই তো তোমাকে ভাইয়ার মনের কথাটাও বলে দিয়েছিলাম।
” মিহির ভাই আমাকে পছন্দ করলে সেটা কবে জানতে পারলে তুমি?
” কখন থেকে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছো আরজুপু। তুমি ভাইয়াকে কীভাবে তোমার মনের কথা বললে সেটা বোলো।
নিধির কণ্ঠে বিরক্তি আর অভিমান দুটিই মিশে আছে। আমিও আর ওকে প্রশ্ন না করে আজকের বিকেলের কথা বলতে শুরু করলাম। সবটা শুনে ও উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি ভাইয়াকে এটা বলে দিয়েছো যে আমি বলেছি ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসে?
” হ্যাঁ বলেছি।
” ইশ আরজুপু এটা কী করলে?
” কেন?
” আরে ভাইয়া আমাকে নিষেধ করেছিল এই কথা তোমাকে জানাতে। কিন্তু আমি তোমার মন খারাপ দেখে তোমাকে বলে দিয়েছি।
” এখন কী সেজন্য মিহির ভাই তোমার উপরে রাগ করবেন? উনার যা রাগ!
” রাগ করবে না৷ শুধু সামান্য বকে দিবে। সেটা আমি সামলে নিবো। তুমি বোলো ভাইয়াও কী তোমাকে ভালোবাসে সেটা মুখে বলেছে?
” না বলেনি।
” কেন?
” উনি কিছু বলার আগেই সেখানে রিধি চলে আসে। আমি ওর ননদের মেয়ে আরজুকে নিয়ে ছাদে গিয়েছিলাম। রিধি ওকে আনতেই ছাদে গিয়েছিল। মিহির ভাই কিছু বলার আগেই রিধির ডাক শুনে আমি আরজুর কাছে চলে যায়। তারপর ওকে নিয়ে লিফটের কাছে যেতেই দেখি রিধি লিফটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মিহির ভাইকে ছাদে রেখেই আমি আরজুকে নিয়ে রিধির সাথেই ছাদ থেকে চলে আসি।
নিধি আফসোসের সুরে বলল,
” ইশ! আপু কী আর একটু সময় পরে ছাদে যেতে পারল না। তাহলেই তো আজ ভাইয়াও তোমাকে সেই বিশেষ তিনটা শব্দ বলে দিতো!
নিধির কথায় ব্যাকুলতা ঝরে পড়ে।
.
পর্ব- ৯
.
গাঢ় সবুজ রঙের একটি সুতি শাড়ি পরেছি আমি। আঁচলটাকে বেশ লম্বা রেখে খোলা ছেড়ে দিয়েছি। আঁচলের একটা অংশ ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কাল রাতে নিধির কাছ থেকে জানতে পেরেছি মিহির ভাইয়ের সবুজ রঙ ভীষণ পছন্দ। আর তাই আমি আম্মার একটা সবুজ শাড়ি পরেছি। যে উদ্দেশ্যে কাল রাতে আমি নিধির সাথে ওর রুমে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। আমার সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। আমার কিছু জিজ্ঞেস করতে হয়নি। নিধি নিজ থেকেই গটগট করে একের পর এক মিহির ভাইয়ের সব পছন্দ অপছন্দগুলো আমাকে বলতে থাকে। মেয়েটা বড্ড ভালো। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা দুজনে গল্প করি। তারপর শেষ রাতের দিকে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ি।
শাড়ির কুচি ঠিক করে চুলগুলো বেণী করে কাঁধের একপাশে ফেলে রেখে আমি রুম থেকে বেরিয়ে আসি। আব্বা সকালে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে আম্মা আর নোমানকে নিয়ে দুপুরের পরেই চলে আসবে। রান্নাঘরে গিয়ে চা বানিয়ে রুমে আসছিলাম৷ ড্রইংরুমে আসতেই রিধির সাথে দেখা হয়ে গেল। ও কেবল ঘুম থেকে উঠেছে মনে হয়। আমাকে দেখে চোখমুখ কুঁচকে তাকিয়ে রইল। ও এমন করে তাকিয়ে আছে কেন? কাল দুপুরেও তো কত সুন্দর করে হাসিমুখে কথা বলছিল আমার সাথে। কিন্তু এখন আমাকে দেখে চোখমুখ কুঁচকে রেখেছে কেন? তবে কি কাল ওর শ্বশুড়বাড়ির লোকজন সামনে ছিল বলে আমার সাথে ভালো করে কথা বলেছিল; নাকি ও ছাদে আমাকে আর মিহির ভাইকে একসাথে দেখে ফেলেছে?
আমি হেসে ওকে চোখের ইশারায় চায়ের কাপ দেখিয়ে বললাম,
” গরম গরম চা করেছি তুমি খাবে?
রিধি আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে ড্রইংরুমে সোফায় বসে সাহানা বুবুকে ডেকে চা দিতে বলল। ওর আচরণে আমি অপমানিত বোধ করলেও কিছু না বলে হাসিমুখে সেখান থেকে চলে আসলাম। অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে থাকলে হাসিমুখে সব অপমান মেনে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়। যেটা নোমান ব্যতীত আব্বা আম্মা আমি অভ্যাস করে নিয়েছি। কিন্তু নোমানকে কিছুই বুঝানো যায় না। ওরা কেউ ওকে কিছু বললেই ও মুখের উপরে জবাব দিয়ে দেয়। কাউকেই ছেড়ে কথা বলে না। এমনকি আন্টিকেও না! তবে বড়দের সাথে অসভ্যতা কিংবা অভদ্রতা কোনোটাই করে না। মুখের ভাষা সংযত রেখেই তাদেরকে উচিত জবাব দিয়ে দেয় ও।
গরম চায়ে চিনি আর মাখন মাখানো টোস্ট বিস্কিট ভিজিয়ে খাচ্ছিলাম। তখনি নিধি আমার রুমে এসে হাজির হলো। এসেই আমার হাত থেকে বিস্কিট আর চায়ের কাপ কেড়ে নিয়ে খেতে শুরু করলো।
” আমার এঁটোটা খাচ্ছো কেন নিধি? তুমি বললে তো তোমার জন্য আরেক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসতাম আমি।
নিধি চায়ে ভেজানো নরম টোস্টটে কামড় দিয়ে খেতে খেতে বলল,
” আমি তোমার এঁটো না খেলে তুমি ভাইয়ার এঁটো খাওয়ার সুযোগ পাবে কী করে?
” মানে?
” মানে হলো ভাইয়া আমার রুমে বসে চা খাচ্ছে। জলদি আমার রুমে যাও। গিয়ে তুমিও আমার মতো ভাইয়ার থেকে চা কেড়ে নিয়ে খেতে শুরু করো। তোমাদের ভালোবাসা বাসির সুযোগ করে দিয়ে এসেছি। যাও যাও।
বলেই চোখ টিপ মারল।
ও আমাকে আর মিহির ভাইকে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এসব করেছে। আমি নিধির মাথায় হালকা করে একটা টোকা দিয়ে ওর রুমের দিকে পা বাড়ালাম।
.
মিহির ভাই নিধির রুমের খাটে এক পা ভাঁজ করে বসে অন্য পা ফ্লোরে রেখে চা খেতে খেতে মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছেন। আমি রুমে ঢুকে পা টিপে টিপে খাটের কাছে গিয়ে তার হাত থেকে চায়ের কাপটা কেড়ে নিলাম। আচমকা আমাকে দেখে তিনি চমকে ওঠলেন! আমি তার থেকে একটু দূরে বসে চায়ে চুমুক দেওয়া শুরু করলাম। তিনি এখনও হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কয়েক চুমুকে চা শেষ করে কাপটা টেবিলে রেখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
” মুখ বন্ধ করেন।
আমার কথায় তিনি মুখ বন্ধ করে আবার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তার তাকিয়ে থাকাতে আমার লজ্জা লাগছে। আমি তার সামনে থেকে উঠে চলে আসতে চাইলে মিহির ভাই পিছন থেকে খপ করে আমার চুলের বেণী ধরে টান দিলেন। আমি ব্যথায় চিৎকার দিতে গিয়েও মুখে হাত চেপে ধরলাম। মিহির ভাই বসা থেকে উঠে আমার পিছনে এসে দাঁড়ালেন। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার উন্মুক্ত কাঁধে আছড়ে পড়ছে! আমি শাড়ির আঁচলটা টেনে কাঁধে দিতে গেলে মিহির ভাই আমার চুলের বেণী ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালেন। আমি আঁচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে কাঁধও ঢেকে ফেললাম। মিহির ভাই আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
” এই রঙের শাড়ি পরেছো কেন?
আমি মাথা নিচু করে উত্তর দিলাম,
” নিধি বলেছিল আপনার সবুজ রঙ খুব পছন্দ। আমার এই রঙের কোনো সালোয়ার কামিজ নেই। তাই আম্মার শাড়িটা পরেছি।
” শুধুমাত্র আমার পছন্দ বলেই পরেছো?
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।
” আমার সবুজ রঙ কেন পছন্দ সেটা জানো?
আমি তখনো মাথা নিচু করে রেখে পুনরায় মাথা নাড়ালাম। মিহির ভাই তার হাতের মুঠোয় আমার থুতনি ধরে মুখটা উপরে তুলে বললেন,
” কারণ এই রঙ আমার মায়ের খুব পছন্দের ছিল।
ছিল মানে! তার কথায় আমি জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকালে তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন,
” আম্মু আমার জন্মদাত্রী নয়। তিনি আমার ছোট খালা। আমার মা ছিল কালো। আমি মায়ের মতো দেখতে কালো হয়েছি। মায়ের সবুজ রঙ খুব পছন্দ ছিল। মাকে তো আর বেশিদিন কাছে পাইনি। তাই মায়ের সব পছদ অপছন্দকেই নিজের পছন্দ অপছন্দ হিসেবে মানিয়ে নিয়েছি।
আন্টি মিহির ভাইয়ের আপন মা না? তিনি মিহির ভাইয়ের খালাম্মা!
মিহির ভাই নরম সুরে বলেন,
” আব্বু যখন মাকে পাত্রী হিসেবে দেখতে যান, তখন ছোট খালাকে দেখে পছন্দ করে ফেলেন। কারণ আব্বু দেখতে সুন্দর ছিল আর গায়ের রঙও ফর্সা। কিন্তু মায়ের গায়ের রঙ ছিল ঠিক আমার মতো কালো। আর অন্যদিকে আন্টির গায়ের রঙও ফর্সা আর দেখতেও সুন্দরী ছিল। তাই আব্বুর আন্টিকেই পছন্দ হয়। কিন্তু দাদু আর দীদার মাকে পছন্দ হলে তাদের ইচ্ছেনুযায়ী আব্বু মাকেই বিয়ে করেন। আমি যখন বড় হলাম অনেক কিছু বুঝতে শিখলাম, তখন দেখতাম মা প্রায় সময় লুকিয়ে কাঁদতো। কান্নার কারণে মায়ের চোখ দুটো ফোলা আর লাল হয়ে থাকতো। আব্বু সব সময় মাকে এটা সেটা বলে অপমান করতো। মায়ের গায়ের রঙ কালো বলে খোটা দিত। মা মাঝে মাঝে রাগ করলেও সব মেনে নিয়ে এসব সহ্য করে নিতো। তারপর একদিন বৃষ্টির সময় ছাদ থেকে শুকনো কাপড় নিয়ে ফিরে আসার সময় সিঁড়িতে ভেজা পা পিছলে মাথা ফেটে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে হাসপাতালে নেওয়ার পরই মা মারা যায়। তখন আমার সবে নয় বছর। মায়ের শরীরের গন্ধ তখনো আমার শরীরে মিশে ছিল। এরপর মাস তিনেক না পেরোতেই আমাকে দেখাশোনার দায়ভার দেখিয়ে আব্বু ছোট খালাকে বিয়ে করে আনেন। ছোট খালা আমাকে তাকে আম্মু বলা শিখালেন। আম্মুও আমাকে খুব ভালোবাসে। আমাকে তাঁর প্রথম সন্তান হিসেবেই খুব আদর করে। তাই আমি আম্মুর অছন্দ অপছন্দেরও খেয়াল রাখি। আম্মুর কালো রঙ পছন্দ না। এই কারণেই তোমাকে আমি কালো রঙের কাপড় পরতে নিষেধ করি। যেন আম্মু তোমাকে কালো রঙের কাপড়ে দেখে অপছন্দ না করেন। এই কালো রঙের জন্যই মায়ের ভালোবাসার কোনো মূল্য ছিল না আব্বুর কাছে। ভালোবাসি বলা সহজ কিন্তু ভালোবেসে যাওয়া কঠিন। আর সেই কঠিন কাজটাই মা বিয়ের এগারোটা বছর ধরে করে গিয়েছিল।
মিহির ভাইয়ের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে! কথা বলার মাঝখানে তিনি ফুঁপিয়ে ওঠছিলেন। কতটা কষ্ট তিনি তার বুকের মাঝে লুকিয়ে রেখেছেন সেটা তাকে দেখলে কেউই বুঝতে পারবে না৷ কাল রাতেও আমার মাথায় এই প্রশ্নটা এসেছিল, মিহির ভাই কেন আংকেল আন্টির মতো ফর্সা হলেন না৷ যেখানে তার অন্য তিন ভাইবোন সবার গায়ের রঙ ফর্সা আর ওরা দেখতেও আন্টির মতো সুন্দর হয়েছে। আসলেই কারোর বাহিরের রূপ দেখে তার ভেতরের কষ্টগুলো অনুভব করা যায় না। কে বলতে পারে, সব সময় হাসিখুশী থাকা মানুষটার মনেও হয়তো অনেক কষ্ট জমা থাকে বুকের গভীরে। কে বুঝতে পারবে মিহির ভাইয়ের মতো রগচটা আর গম্ভীর স্বভাবের মানুষটার মনেও এত কষ্ট জমে আছে! আমার শাড়ির আঁচলে মিহির ভাইয়ের চোখে পানিগুলো মুছে দিলাম। তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। পানি মুছা শেষ হলে আমি হাতটা তার মুখ থেকে নামিয়ে আনতেই তিনি আমার হাতটা তার দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে বলতে লাগলেন,
” মা আব্বুকে ভীষণ ভালোবাসতো আরজু। একজন স্ত্রী তার স্বামীকে যতটা গভীর ভাবে ভালোবাসতে পারে, তার চাইতেও কয়েকগুন বেশি মা আব্বুকে ভালোবাসতো৷ আব্বুর জন্য মায়ের ভালোবাসা এতটাই গভীর ছিল যে, মা সব সময় ফর্সা হওয়ার জন্য দোয়া করতো। মায়ের কেবল একটাই চেষ্টা ছিল, কীভাবে আব্বুর চোখে নিজেকে একটু ভালো লাগানো যায়। কীভাবে সাজলে আব্বুর পছন্দ হবে। কোন রঙের কাপড় পরলে আব্বুর চোখে মাকে সুন্দরী লাগবে। কিন্তু আমার বোকা মা এটা বুঝতে পারেনি যে আব্বুর চোখে তখনো আন্টির গায়ের ফর্সা রঙের নেশা লেগেছিল। তাই আব্বুর জন্য মায়ের বুক ভরা ভালোবাসা, গায়ের কালো রঙের দোহায় দিয়ে ভালোবাসা না পাওয়ার হাহাকার কিছুই আব্বুর নজরে পড়তো না। ভালোবাসার শূন্যতায় ঘেরা মায়ের দুটি চোখ কখনোই আব্বুর সন্ধানী দৃষ্টির আওতায় পড়তো না। হতাশায় ডোবা মায়ের আহত হৃদয়ের করুণ আর্তনাদ কখনও আব্বুর কান অবধি পোঁছাতো না। কালো হয়ে জন্মানোর অপরাধে স্ত্রী হয়েও মা আব্বুর কাছে অবহেলিত ছিল। আব্বুর একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মা বিয়ের এগারোটা বছর ধরে ছটফট করে গেছে। আব্বুকে ভালোবাসার কোনো অধিকার আমার মায়ের ছিল না আরজু; কারণ মায়ের #ভালোবাসার_রঙ_কালো ছিল!
.
#চলবে …
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here