ভালোবাসার রাত পর্ব ১৬+১৭

ভালোবাসার-রাত
#রোকসানা রাহমান
পর্ব (১৬+১৭)
.
পর্ব (১৬)
তিল মুখটা ভেংচি কেটে কানে হাত দিয়েই দাড়িয়ে রইলো। রিদ কলটা রিসিভ করে কথা শেষ না করেই তিলকে রেখে বেড়িয়ে পড়লো,
“” কোথায় যাচ্ছেন?””
তিলের কথার উত্তর দেওয়ারও যেন সময় নেই!
রিদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো তিল। তখনো কানদুটো ধরে আছে। হুট করে কে কল দিলো যে এভাবে চলে গেলো? খারাপ কিছু নাতো?? তিল পিছু পিছু আসতে চেয়েও কেন জানি আসলোনা।
পড়ায় কিছুতেই মন বসছেনা। বারবার ঘড়ির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। পড়া কমপ্লিট না হলে যদি উনি বকেন সে ভয়ে বইয়ে মুখ গুজে আছে। ঘড়ির কাটা ঘুরতে ঘুরতে ১১ টায় ঠেকলো। আম্মুর ডাকে খাবারের টেবিলে চলে গেলো তিল।
ভাতের প্লেটে হাত রাখতে রাখতে জানতে পারলো সিজাতের আব্বু হুট করেই অসুস্থ হয়ে গেছে। হসপিটালে ভর্তি। সেখানেই নাকি গিয়েছে রিদ। সবাইকে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলেছে,আসতে লেট হবে!
বড় আব্বুর কথা শুনে কিছুটা সস্তি পেলেও খাবারটা কেন জানি খেতে পারলোনা তিল। মনে হচ্ছে রিদ ভাইয়াকে ছাড়া এই প্রথম সে খেতে বসেছে। অথচ এতোটা বছর তো উনাকে ছাড়াই খাওয়া দাওয়া হয়েছে তাহলে আজ এমন লাগছে কেন??? এতো বেশি একা একা লাগছে কেন? ভাতের দু তিন দলা মুখে দিয়ে খাবার ছেড়ে উঠে পড়ে তিল। কিছু ভালো লাগছেনা। এক অস্থিরতা ভর করছে শরীরে। মনে হচ্ছে হঠাৎ করেই শরীরের ওজনটা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিল শোওয়ার জন্য বিছানা ঝারতে ঝারতে ঘড়ির দিকে তাকালো। ১২ টা বেজে ২৫। সিজারের আব্বু কি খুব বেশি অসুস্থ এখনো এলো না যে?? উনি কি ডাক্তার যে উনাকে ওখানেই থাকতে হবে???
তিলের মেজাজ গরম হতে লাগলো। কয়দিন আগেই তো সিজারকে মেরে বাসা থেকে বের করে দিলো এর মধ্যেই সব ঠিক হয়ে গেছে যে এখন উনাদের জন্য উনি আমাকে টেনশনে মেরে ফেলতে চাচ্ছেন??? ইশ! কিছু ভালো লাগছেনা!
তিল বিছানায় শুয়ে শুয়ে এপাশওপাশ করছে,চোখে ঘুমের কোনো দেখা নাই। বারবার মনের ভেতর খারাপ চিন্তারা উকি দিচ্ছে। এমনি এমনি তো দিচ্ছেনা। ঐদিনের ঐ খারাপ স্বপ্নটা দেখার পর থেকেই কেমন জানি খারাপ চিন্তাভাবনা মাথায় ঘুরঘুর করে। আচ্ছা উনার সাথে খারাপ কিছু ঘটবেনা তো???
তিলের শরীর ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে। বিছানা ছেড়ে ফ্যানটা ফুল স্পিডে ছেড়ে দিয়েছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলো একটা কল দিয়ে দেখবে নাকি। পরক্ষনেই মনে হলো ওর কাছে তো রিদানের নাম্বার নাই তাহলে কিভাবে কল দিবে???
সামান্য একটা নাম্বারও আমার কাছে নাই?? এতোকিছু ঘটে গেলো অথচ নাম্বারটাই নেওয়া হলোনা??? রিদ ভাইয়া ঠিকই বলে আমার মাথায় আসলেই বুদ্ধীর ছিটেফোটাও নেই। থাকলে নিশ্চয় উনার নাম্বারটা আমার ফোনে থাকতো। একটা নাম্বার যে কতটা ইম্পর্ট্যান্ট হতে পারে তিল এখন বুঝতে পারছে। নিজের ফোনটা ঢিল মেরে বিছানায় ফেলে দিলো।
অবশ্য নাম্বারের প্রয়োজন কখনো পড়েইনি তাহলে নিবে কিভাবে??? তিলের প্রয়োজন অপ্রয়োজন সবসময় তো উনাকে পাশেই পেয়েছে। ফোনে কখনো কথা বলার প্রয়োজন পড়েনি। রিদও তো কখনো ওকে কল দেয়নি তাহলে নাম্বারটা আসবে কিভাবে??? আচ্ছা উনার কাছে কি আমার নাম্বার আছে???
হঠাৎই করেই তিলের মনে পড়লো রিদের সাথে তাদের কখনো ফোন প্রেম হয়নি। ইশ! কি মিসটাই না করেছে। শুনেছি ফোনে কথা বলার সময় নাকি রোমান্টিকতার ছোয়া থাকে কন্ঠে। সেটাতো তিল পেলোইনা। এই ব্যাপারটা মাথাতে কখনোই আসেনি। তিলের আবার মন খারাপ হয়ে গেলো। তার রিদ ভাইয়ার সাথে সে ফোনে একটুও প্রেমালাপ করলো না! তিলের ইচ্ছে হলো এখনি যদি একটু উনার ফোন ভয়েস শুনতে পারতো!
ভাবনায় ভাবনায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৩ টা বেজে ৫। মাঝরাত! রিদ ভাইয়াতো এখনো আসলোনা। তিলের ভেতরের অস্থিরতা এখন দ্বিগুনগুনে বাড়ছে। কি করবে না করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। উনি কি একটুও বুঝতে পারছেননা আমি কতটা চিন্তায় আছি?? আমাকে একটা কল দিলে কি এমন হয়???
তিল কাথা নিয়ে শুয়ে পরে আবার। ঘুমানোর চেষ্টা করে। হয় তো ঘুম ভেংগে দেখবো উনি আমার পাশে! এমন তো প্রতিরাতেই হয়। আজ কেন হবেনা? আজকেও হবে। উনি ঠিক আমার পাশে আসবেন। এসে বলবেন, তুই পড়া শেষ করিসনি কেন? যা কানে ধরে উঠবস কর। নাহলে বিয়ে ক্যানসেল।
এতো টেনশনে কি ঘুম আসে? আর ঘুম না আসলে রিদ ভাইয়া কিভাবে আসবে??? তিল আবার বিছানা ছেড়ে আম্মু আব্বুর রুমের সামনে চলে যায়। হালকা টুকা দিতেই রহমত আলী ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলে দিলেন।
“” তুই এখনো ঘুৃুমুসনি মা? কিছু হয়েছে?””
বাবার কথার উত্তর না দিয়েই টুপ করে ভেতরে ঢুকে পড়ে তিল। আব্বুর ফোনটা নিয়ে রিদের নাম্বার খুজতে থাকে।
“” কি হয়েছে,তিল?””
“” কিছুনা,আব্বু। তুমি ঘুমাও। আব্বু তোমার মোবাইলটা একটু নিতে পারি?””
তিল নিজের রুমে এসে একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছে রিদের নাম্বারে। প্রথম কয়েকবার রিং বাজলেও ঐদিক থেকে কোনো রেসপন্স আসেনি। তিল পুনরায় কল করতে গিয়ে দেখে ফোন সুইচঅফ! তিলের ভয় হচ্ছে,সাথে খুব খারাপভাবে কান্না পাচ্ছে। কিন্তু সে এখন কাঁদবেনা৷ মনে হচ্ছে কাঁদলেই খারাপ কিছু ঘটবে। তিল নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করে নিজের আব্বুর ফোন থেকে নাম্বারটা নিজের ফোনে টুকে নিলো।নিজের নাম্বার থেকে কল দিয়েও যখন ফোনটা অফ পেলো,তিলের হাত পা কাঁপুনি উঠে গেলো। কিছুতেই আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছেনা। বারবার শুধু কল দিয়ে যাচ্ছে।
সকালে বড় আব্বুর চিৎকার শুনে লাফিয়ে উঠে তিল। কাল রাতে রিদকে কল দিতে দিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তা তার জানা নেই। কিন্তু বড় আব্বু এভাবে চিল্লাচ্ছে কেন? উনি তো সচরাচর এমন চিল্লাচিল্লি করেনা। আর বাড়ি ভর্তি মেহমান সেখানে তো প্রশ্নই উঠেনা। রিদ ভাইয়ার কিছু হয়নি তো??? তিল দৌড়ে বড় আব্বুর রুমের কাছে চলে আসে।
“” বিয়ে হবেনা মানে? তোর মাথা কি ঠিক আছে রিদ? আজ তোদের গায়ে হলুূদ। বাড়ি ভর্তি মেহমান আর বলছিস বিয়ে হবেনা???””
রিদ চিৎকার করে বাবার উদ্দশ্যে বললো,
“” বিয়ে হবেনা সেটা কখন বললাম আব্বু? আমি বলেছি এখন হবেনা। তিলের পরীক্ষার পরে হবে!””
রিদের কথায় আমির সাহেব প্রচন্ড ক্ষেপে যান।
“” তোর কাছে কি বিয়েটা ছেলেখেলা মনে হচ্ছে? তুই যখন চাইবি তখন বিয়ে হবে? তোর ইচ্ছেতেই সব? আমাদের ইচ্ছের কোনো মুল্য নেই?””
রিদ নিজের সামনে থাকা শোকেসটায় লাথি মেরে বললো,
“” হ্যা, হ্যা,হ্যা, আমার ইচ্ছেতেই সব। আমার যখন ইচ্ছে হবে তখন বিয়ে হবে। বেড়িয়ে যাও আমার রুম থেকে এখখুনি!””
রাগে আমির সাহেবের শরীর কাঁপছে। বাসা ভর্তি মেহমান। একটু পরেই গায়ে হলুদের আয়োজন শুরু হয়ে যাবে। বিয়ের কনে আর বর যেহেতু এই বাসারই সেহেতু আয়োজনটাও সেরকমই করা হচ্ছে। তার উপর এই বংশের একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা, যাকে পেয়েছেন তাকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। যাদের সাথে কোনোদিন যোগায়োগ ছিলোনা তাদেরও দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ৬০% মেহমান অলরেডি চলে এসেছে। অনেকেই রাস্তায় আছে। গায়ে হলুদ শুরু হতে হতে চলেও আসবে। আর এখন কিনা বলছে বিয়ে হবেনা। এটা কি হাতের মুয়া যে যখন তখন চিবিয়ে খেলে ফেলবে? আমির সাহেবের ইচ্ছে হলো ছেলেকে কয়েক গা বেত দিয়ে পিটাতে। নিহাত এতো বড় হয়েছে বলে এখনো নিজেকে বশে রেখেছে। সেই ছোট্ট রিদ হলে এতক্ষনে পিঠের ছাল তুলে বিয়ে পড়িয়ে দিতো।
আমির সাহেব ছেলেকে কঠিন কথা শুনাতে গিয়ে থেমে গেলেন। তিল সামনে এসে দাড়িয়েছে। চোখের ইশারায় বুঝাতে চাচ্ছে,বড় আব্বু আপনারা রুমে যান আমি দেখছি উনার কি হয়েছে!
রিদ তখনো উল্টো হয়ে দাড়িয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। তিল ঠিক বুঝতে পারছে খুব রেগে আছে। খুব বেশিই মনে হয়। তিল গুটি গুটি পায়ে রিদের দিকে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। তাতে রিদের উপর যেন প্রভাবই পড়লোনা। তিল আদুরী গলায় বললো,
“” কি হয়েছে আপনাল? কাল বাসায় আসেননি কেন? জানেন আমার কত কষ্ট হচ্ছিলো? এতো কলে কল দিলাম ধললেনও না। আবাল এখন বলছেন বিয়ে কলবেননা। কি হয়েছে বলুননা, আমি কি কিছু ভুল কলছি? তাহলে আমাকে শাস্তি দিন!””
“” তিল,ছাড় আমাকে!””
“” না,আগে বলুন আপনাল কি হয়েছে? এমন কলছেন কেন? আল বিয়েটাই বা কেন কলবেননা?””
তিলকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তিলের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো রিদ। সাথে সাথে তিলের চোখ ভিজে এলো।
“” আমি কেন বিয়ে করবো না তোর কাছে জবাবদিহি করতে হবে? তুই কি জবাবদিহির প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছিস? করবোনা আমি বিয়ে কি করবি তুই? আমাকে পুলিশে দিবি? ফাঁসিতে ঝুলাবি??? একটু ভালোভাবে কথা বলেছি দেখে খুব সাহস বেড়ে গেছে না? এখন আবার জবাবও চাস? আর তোর না কিছুদিন পর পরীক্ষা? তুই এখানে কি করছিস? যা পড়তে যা। খবরদার যদি আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখি তাহলে তোর বই খাতা সব ছিড়েছুড়ে তোকে খায়িয়ে দিবো। পরীক্ষা রেখে বিয়ে করার জন্য লাফাচ্ছে। পা কেটে ফেলে দিবো তখন দেখবো তুই কিভাবে এতো লাফাস। এখনো যাসনি তুই? আরেকটা চড় খাবি?””
আজ অনেকদিন পর রিদকে এমন আচরন করতে দেখে তিল শকড হয়ে যায়। কাল রাতেও তো ঠিক ছিলো। হঠাৎ করে কি এমন হলো?
তিল গালে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে এলো।
নিজের জেদী ছেলের কাছে হার মানতেই হলো আমির সাহেবের। লজ্জায় যেন মাথা কাটা যাচ্ছে। সবার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চেয়ে বিদেয় করেছেন। নতুন করে বিয়ের কার্ড ছাপানো হচ্ছে। সব কিছু ঠিক থাকলেও শুধু বিয়ের ডেটটা চেন্জ হয়েছে ১৭ মার্চের জায়গায় ৩ মে। রিদ কেন এমন করলো কেউ জানতে পারলোনা। অনেকবার জিজ্ঞেস করেও তার দিক থেকে কোনো উত্তর আসেনি। শুধু এটাই বলেছে তিলের পরীক্ষার পরেই বিয়ে করবে।
এদিকে তিল পড়ার থেকে বেশি কান্নাতে মনোযোগ দিচ্ছে। আজ কয়েক দিন যাবত রিদের সাথে তার কোনো কথা হচ্ছেনা,শুধু কথা বলা বললে ভুল হবে সেদিনের থাপ্পড় খাওয়ার পর থেকে তার সাথে দেখাও হচ্ছেনা। রুম থেকে বের হচ্ছেনা,যা লাগে সব রুমেই দিয়ে আসা হচ্ছে। সবাই ঐ রুমে যেতে পারলেও তিলের যাওয়া মানা। খুব কঠিন করে মানা করা হয়েছে!
রিদকে ছাড়া তিলের পড়ায় মন বসেনা,ঘুম আসেনা,খাওয়ার স্বাাদ আসেনা। মাঝরাতে ঘুম ভেংগে যখন রিদকে নিজের পাশে পাইনা তখন হুহু করে কেঁদে উঠে। আপনি আমাকে মারেন,কাটেন,বকেন যা খুশি তাই করেন তবুও এভাবে দুরে ঠেলে রাখবেননা প্লিজ,আমি যে আপনার বিরহ নিতে পারছিনা। আপনার মতো আমারও বুকে চিনচিন করে ব্যথা হচ্ছে। এ কেমন ব্যথা রিদ ভাইয়া? আবার কোন খেলায় আপনি আমাকে নামিয়েছেন?? কোন নেশায় আমাকে ডুবিয়েছেন? আমি যে ডুবে মরে যাচ্ছে,নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কেন এমন করছেন???
চলবে
.
ভালোবাসার-রাত
#রোকসানা রাহমান
পর্ব (১৭)
রিদকে ছাড়া তিলের পড়ায় মন বসেনা,ঘুম আসেনা,খাওয়ার স্বাাদ আসেনা। মাঝরাতে ঘুম ভেংগে যখন রিদকে নিজের পাশে পাইনা তখন হুহু করে কেঁদে উঠে। আপনি আমাকে মারেন,কাটেন,বকেন যা খুশি তাই করেন তবুও এভাবে দুরে ঠেলে রাখবেননা প্লিজ,আমি যে আপনার বিরহ নিতে পারছিনা। আপনার মতো আমারও বুকে চিনচিন করে ব্যথা হচ্ছে। এ কেমন ব্যথা রিদ ভাইয়া? আবার কোন খেলায় আপনি আমাকে নামিয়েছেন?? কোন নেশায় আমাকে ডুবিয়েছেন? আমি যে ডুবে মরে যাচ্ছে,নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কেন এমন করছেন???
কালকে পরীক্ষা অথচ তিলের মনে হচ্ছে সে কিছুই পারেনা। যত পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে তত মনে হচ্ছে এগুলো তার পড়া হয়নি। তার মধ্যে রিদ ভাইয়াটারও কোনো খেয়াল নাই। কি হয় এসে একটু পড়ালে উনি সামনে বসলেই তো আমার সব পড়া হয়ে যাবে। ট্রেন যেমন রেললাইনের উপর দিয়ে গড়গড় করে ছুটে চলে যায় সেও তো রিদ ভাইয়ার সামনে গড়গড় করে সব পড়া বলতে পারবে!
তিল মনের দুঃখে বই,খাতা,কলম নিয়ে বাইরাবাইরি করতে থাকে। হঠাৎই নিজের ফোন বেজে উঠলো, অচেনা নাম্বার,এতো রাতে তাকে কে কল দিবে?? অনেকটা বিরক্ত নিয়েই তিল কলটা রিসিভ করে কানে ধরলো,
“” তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে,আমার রুমে একটু আসবি?””
“” লিদ ভাইয়া!””
রিদের কন্ঠ পেয়ে তিল চোখটা বুঝে ফেলে। খুশিতে ফোন কান থেকে নামাতেও ভুলে গেছে। এতোদিন পর উনার কন্ঠ শুনে মনে হলো উনার কন্ঠ শোনার জন্য কত দিনের তৃষ্ণা ছিলো তা এখন বুঝতে পারছে।
আপনি ডেকেছেন আর আমি আসবোনা এটা হয়?? তিল তখনি বই খাতা সব ফেলে উঠে পড়ে। ছুটে যেতে গিয়ে থেমে যায়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে নিজের চুলটা একটু আচড়িয়ে নিলো। আজ কত দিন বাদে রিদ ভাইয়া তার তিলকে দেখতে চাচ্ছে একটু ফিটফাট নাহলে চলে???
রিদের দরজার সামনে যেতেই তিলের পা থমকে গেলো। বুকের ভেতরে কিছু একটা চলাচলের শব্দ পাচ্ছে। খুব বেশি নার্ভাস লাগছে। হাতদুটো মুঠো করে নিজের জামাটা কুচকিয়ে ধরে জোরে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে নিলো। হঠাৎ এমন নার্ভাস লাগার কারন খুজে পাচ্ছেনা। দরজায় হাত রাখতেও কেমন একটা লাগছে। তাহলে ভেতরে গিয়ে রিদ ভাইয়ার সামনা সামনি হবো কি করে??? কেন এমন অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে? অনেকদিন বাদে দেখা হচ্ছে বলে? নাকি অনেকদিন বাদে কাছে যাচ্ছি বলে???
“” কি হলো,বাইরে দাড়িয়ে আছিস কেন? তোকে কি পালকি দিয়ে বয়ে আনতে হবে??””
রিদের কথায় তিল হালকা কেঁপে উঠে,শেষ একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে দরজাটা ঠেলে দেয়।
পুরো রুমটা অন্ধকারে ঢাকা। এতো অন্ধকার কেন? বিদ্যুৎ কি চলে গেছে?? আমার রুমে তো ঠিকই ছিলো তাহলে এখানে কি হলো??? তিল পা বাড়িয়ে ভেতরে এগুতেই রিদ বললো,
“” ভয় পাচ্ছিস?? দাড়া!””
রিদ নিজের ফোনটার টর্চটা জ্বালিয়ে তিলের দিকে আলো ফেলে বললো,
“” তোর হাতের ডানদিকে ছোট টেবিলটায় দেখ মোম আর ম্যাচ আছে। মোমটা জ্বালিয়ে নে। তাহলে আর ভয় পাবিনা।””
রিদের কথা মতো তিল মোমটা জ্বালিয়ে রিদের কাছাকাছি এসে দাড়ায়। আজো উনি কম্বলটা মুড়ি দিয়েই শুয়ে আছে। রুমের ফ্যানটা অফ! এই গরমে উনি এভাবে থাকেন কিভাবে? উনার সব অদ্ভুত কাজের মধ্যে এটা বেশি অদ্ভুত যা তিলকে বারে বারে ভাবায়!
“” তুই কি মোম হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকার চাকরি নিয়েছিস? ওখানে রেখে আমার মাথার কাছে এসে বস।””
রিদের প্রত্যেকটা কথায় তিলের কাছে কেমন যেন ঠান্ডা বরফের ছোয়া লাগছে। এতো রাগী লোকটার ঝাঝালো কন্ঠ হঠাৎ এমন নিয়িয়ে গেলো কিভাবে? কথার ধরন না পাল্টালেও সেই আগের মতো ঝাঝটা আর নেই। কি হয়েছে উনার? উনি কি ভেতরে ভেতরে কোনো জিনিস নিয়ে খুব বাজে ভাবে ভুগছেন???
তিল রিদের মাথার কাছে বসতেই রিদ নিজের মাথাটা তিলের কোলে তুলে দিলো।
“” মাথাটা খুব ধরেছে,একটু চুলটা টেনে দেতো।””
তিল চুলে হাত দিতেই ওর হাতটা চেপে ধরে রিদ। হাতটা নিজের গালে ছুয়িয়ে নিয়ে বললো,
“” কেমন আছিস রে?””
রিদের অতি সাধারন প্রশ্নটাও যেন তিলের বুকের ভেতর ঝড় তুলে দিলো। কেমন আছে এটার উত্তর কি দিবে?? ভালো আছে? কিন্তু ও কি আসলেই ভালো আছে??
“” কিছু বলছিস না যে? রাগ করেছিস আমার সাথে??””
তিল এবার আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারলোনা। ঠুকরে ঠুকরে কেদে উঠে, অভিমানে কন্ঠে বললো,,
“” আপনি খুব পঁচা খুব।””
রিদের মাথাটা সড়িয়ে তিল অভিমান করে উঠে চলে যেতে নিলে তিলের হাতটা চেপে ধরে নিজের বুকে।
“” সরিরে। এই দেখ কানে ধরেছি। এবার তো ক্ষমা করে দে। দেখতো তোর লিদ ভাইয়াকে কানে ধরে কেমন হনুমানের মতো লাগছে??””
তিল রিদের হাতটা কান থেকে সরিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো,
“” আমাল লিদ ভাইয়াকে যেমন খুশি তেমন দেখাক আপনাল কি? খবলদাল যদি আলেকবাল আমাল লিদ ভাইয়াকে হনুৃমান বলছেন তো””
“” তো কি করবি শুনি তুতলি রানী!””
“” আপনি এমন অন্ধকালে শুয়ে লয়েছেন কেন? আপনাল কি হয়েছে? আমাল খুব ভয় লাগছে।””
তিলের কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা রিদ। তিলের হাতটা বুক থেকে সরিয়ে চোখের সামনে আনলো। অনামিকা আঙুলটা দেখে হালকা শুকনো হাসি নিয়ে বললো,
“” ডায়মন্ডের সাথে স্বর্নের এমন হলদে কালারটা মানাচ্ছেনা। দেখি খুলে দেতো আমায়।””
রিদ আংটিতে হাত দিতেই তিল ঝটকা দিয়ে হাতটা টেনে সরিয়ে নিলো।
“” আপনি আমার বাবুকে আলাদা কলছেন কেন?'”
“” তোর বাবু মানে? আংটিকে তুই বাবু বানিয়ে দিলি? বেশি পড়ার চাপে তোর মাথাটা কি গেলো?””
তিল হাতের আংটিটা ঠিক করতে করতে লাজুক হয়ে বললো,
“” আপনিই তো বাবুল গন্ধ নিয়ে পলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন বাবাল কাছ থেকে যেন সন্তানকে না সলায় তাহলে এখন সলাচ্ছেন কেন? বাবাল থেকে আলাদা কলছেন দেখলে কি ও কেঁদে উঠবেনা?””
তিল নিজের কথা শেষ করে রিদের দিকে তাকাতেই বুঝলো উনি তার দিকেই চেয়ে আছে। মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে, যে চাহনিতে কোনো কামুকতা নেই,কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই,কোনো চাওয়া নেই,রয়েছে শুধু মুগ্ধতা আর প্রাপ্তি।
রিদের এমন চাহনিতে তিলের লজ্জা যেন আরো প্রখর হলো। ঠোটে হালকা হাসি ফুটে উঠেছে।
“” তুই কেন বড় হলি তিল?””
“” আপনাকে বিয়ে কলাল জন্য!””
রিদ তিলের কাছ থেকে সরে এসে নিজের বালিশটাতে শুয়ে বললো,
“” অনেক রাত হয়েছে, রুমে যা। কাল তো আবার পরীক্ষা। ঠিক মতো সব পড়েছিস তো?””
তিল মনে মনে বললো আপনাকে ছাড়া কি আমার পড়ায় মন বসে রিদ ভাইয়া?
“” হুম।””
“” গুড,রেজাল্ট খারাপ হলে কিন্তু খুব বকবো।””
“” হবেনা। আপনি পলিয়েছেন তো।””
রিদ আবার কিছু বলতে যাবে কিন্তু নিজের গলাটা ভার হয়ে গেছে বুঝতে পেরে কিছু বললোনা।
তিল তখনো রিদের মাথার কাছেই বসে আছে। আমার আপনাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে রিদ ভাইয়া। একটু জড়িয়ে নিবেননা? আপনি হঠাৎ এতো শান্ত হয়ে গেছেন কেন? আপনার এই শান্ত টা যে আমার ভেতরে অশান্তের সৃষ্টি করছে।
“” এখনো বসে আছিস যে?””
তিল মন খারাপ করে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে নিলেই পেছন থেকে রিদ ডেকে উঠে,
“” বউ!””
ইশ! বউ ডাকের মধ্যেও বুঝি এতো ভালোবাসা থাকে?? ইচ্ছে করছে সময়টাকে এখানেই বেধে রাখি!
“” এদিকে এসো।””
আজ যেন লজ্জারা সব পন করেছে তিলকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা।
তিল মাটির দিকে তাকিয়ে গুটি গুটি পায়ে আবার রিদের কাছে এগিয়ে যেতেই রিদ উঠে বসে পড়ে।
তিলের গালে নিজের ডান হাতটা ছুয়িয়ে কপালে চুমু খেতে গিয়েও থেমে যায়। কিছু একটা ভেবে কপাল থেকে ঠোটগুলো সরিয়ে তিলের বা গালে চুমু একে দিলো। ঠোটের কোনের তিলটা নিজের বা হাতের বৃদ্ধা আংগুল দিয়ে হালকা করে হাত বুলিয়ে বললো,
“” বেস্ট অফ লাক!””
তিল চলে যেতেই রিদ হুহু করে কেঁদে উঠে। যেখানটাই আমি নেই সেখানটাই ছুয়ে কি হবে????
রিদ ভাইয়ার কাছ থেকে এতো এতো আদর পেয়েও কি পরীক্ষা খারাপ হতে পারে? কখনোই না। তিল লুজের পর লুস পেজ নিয়ে লিখেই যাচ্ছে। কলমের কালি শেষ তো কি হয়েছে? আরেকটা নতুন কলম দিয়ে লিখা শুরু করে।
“” এখনি ঘুমাবি?””
কালকেই তার শেষ পরীক্ষা,তারপর গায়ে হলুদ অবশেষে বিয়ে। খুশিতে আজ তিলের পড়াই হচ্ছিলোনা। তবুও রিদ ভাইয়াকে সে রাগাবেনা বলে অনেক কষ্টে এতক্ষন পড়ায় মুখ গুজে রেখেছিলো। কিন্তু এভাবে কতক্ষন? তাই বই গুছিয়ে সবেই বিছানায় উঠে কাথাটা মেলছিলো। আর তখনি রিদ ভাইয়ার আগমন।
রিদের দিকে তাকিয়ে তিলের বুকটা কেঁপে উঠলো। উনাকে এতো অগোছালো লাগছে কেন? চোখের নিচটা এতো ফুলে গেছে,মনে হচ্ছে কালচে দাগ ও পড়েছে। মাথার চুলগুলোতেও অনেকদিন চিরনি চালানো হয়নি,গালে খোচা খোচা দাড়িগুলো এখন আর খোচা নেই অনেকটাই বড় হয়ে গেছে।
তিলকে অবাক করে দিয়ে রিদ ওর বুকের উপর শুয়ে খুব গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো। অস্পষ্টট সুরে বললো,
“” ভালোবাসি তোকে,খুব বেশি ভালোবাসি রে বউ!””
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here