#ভালোবাসা রং বদলায়
লেখক — #মাহমুদ
পর্ব — ১০
,
ঘরের প্রতিটা ওয়ালে ঝোলানো রয়েছে রূপার শতশত ছবি। সবক’টা ছবিতেই তার মিষ্টি হাসিটা আছে’ই। রূপা বেশ অবাক হল। ঘরের চারিদিকে ঘুরেফিরে দেখতে লাগল কিছুক্ষণ। নাহ! এখানে তার ছবি ছাড়া, কারোর ছবি নেই। জায়গাটাও বেশ অচেনা লাগছে তার কাছে। এখানে কখনও এসেছে বলেও মনে হচ্ছে না। তবে, তার এতশত ছবি কে টাঙালো দেয়ালে?
সবথেকে অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল, এই বাড়িটা একদম ফাকা। বাড়িটা খোলামেলা হলেও মানুষের আনাগোনা খুবই কম। কিন্তু সে এটাই বুঝতে পারছে না, এই বাড়িতে কীভাবে এল সে? একটু আগেই না সে বাজার করতে গিয়েছিল। তাহলে এখানে তো তার নিজেনিজে আসার কথা না। তার যতদূর মনে আছে, সে বাজার থেকে তরকারি কিনছিল। বাজার করা শেষ হলে বাড়ির ফিরছিল স্বাভাবিক ভাবে। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দে থেমে গিয়েছিল। এরপর আর কিছুই মনে নেই তার। যখন তার ঘুম ভাঙল, তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করল এই অচেনা বাড়িতে। কেউ কী তাকে কিডন্যাপ-টিডন্যাপ করেছে? কিন্তু কিডন্যাপ করলে তো তার হাত-পা বাঁধা অবস্থায় থাকত, এমন স্বাভাবিক ভাবেও থাকত না সে। তাহলে কিভাবে এল এই নির্জন বাড়িতে?(লেখক মাহমুদ)
কিছু সময় পর টুংটাং করে ঘড়ির শব্দ শোনা গেল। এখন ঘড়িডে ১২:০০ টা (AM) বাজে। তার মানে অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কিভাবে? সে তো আজ বিকালের দিকে বাজার করতে বেরিয়েছিল। এতটা রাত তো হওয়ার কথা না। তার মানে কী তাকে সত্যিই কিডন্যাপ করা হয়েছে?
হঠাৎ সরু গলায় কেউ একজন বলে উঠল,
– “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে মাই লাভ রূপা, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।”
সঙ্গে সঙ্গে সবাই মিলে চেঁচিয়ে উঠল। রূপা আতংকিত হয়ে পিছন ঘুরে তাকাল। দ্বীপকে দেখতে পেয়ে তার ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুঁটে উঠল। এখানে বেশির ভাগই তার কলেজ ফ্রেন্ডস। তার মানে এসব দ্বীপের প্লান ছিল?
দ্বীপ বলল,
– “কেমন লাগল সারপ্রাইজটা?”
রূপা মনে মনে বলল,
– “খুবউউউ ভাল লেগেছে। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা জন্মদিন এবং সেরা সারপ্রাইজ।”
কিন্তু মুখে বলল অন্যকিছু,
– “একদম ফালতু হয়েছে। তুমি আমাকে কিডন্যাপ করে এখানে আটকে রেখেছ। আমি কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম জানো? এটা আমার জীবনের মনে হয় সবচেয়ে ফালতু জন্মদিন।”
– “তাই নাকি? সত্যিই কী তাই? একটুও পছন্দ হয়নি?”
– “হুম, তাই।”
দ্বীপ হেসে ফেলল। বলল,
– “মাই লাভ বার্ড, এখনও তুমি সাজিয়ে-গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারো না দেখছি।”
– “আমি কোন মিথ্যা কথা বলি নাই। যা বলছি মন থেকে বলছি।”
তৎখানিক নিপা বলল,
– “উফফফ আপু! তুই এত্ত খারাপ কেন? জিজু কত্ত কষ্ট করে তোর জন্য এত্ত বড় রিক্স নিয়েছে। কোথায় তুই জিজুকে থ্যাংকস জানাবি, তা না করে ঝগড়া করছিস।”
– “তুই চুপ কর। এসব কিছুর নাটেরগুরু হচ্ছিস তুই। আমার তো মনে হয়, আমাকে কিডন্যাপ করার বুদ্ধিটাও তুই’ই দিয়েছিস।”
– “হ-হ্যা মানে….”
– “থাক, আর মানে-টানে শুনতে চাই না। আজ যে এত রাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরের আছি, মনে হয় আজ আমাকে মায়ের হাত থেকে কেউ বাচাতে পারবে না।”
– “আরে আপু, ভয় নাই। সবকিছুই আমি বন্দবস্ত করেই আসছি। তুই ওইসব নিয়ে টেনশন-ফেনশন করিস না তো।”
রূপা অবাক হয়ে বলল,
– “এএএএ, কী করেছিস তুই? আমার কিন্তু খুব ভয় পাচ্ছে।”
– “আছে আছে। বলা যাবে না।”
– “বল না রে আমার নিপামনি।”(লেখক মাহমুদ)
– “আচ্ছা আচ্ছা, বলছি। শোন, আজ বিকালে যখন তুই বাজার করতে গেছিলি তখন দ্বীপ ভাইয়া তোর নাম্বারে ফোন দিছিল। ভাইয়া বললেন,
– “ডুমুরিয়া ফুল, আমার একটা হেল্প লাগবে। আর এই হেল্পটা তুমি ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না।”
আমি তখন ভাইয়াকে বললাম,
– “আমি ছাড়া কেউ করতে পারবে না? আচ্ছা বলেন, আপনাকে কী হেল্প করতে পারি।”
– “বেশি কিছু করতে হবে না। তুমি শুধু আমার সাথে থাকলেই হবে।”
– “কেন? আজকে কী বিশেষ কিছু?”
– “কিভাবে বুঝলে?”
– “এটা তো আর নতুন কিছুই না। এর আগেও আপনি আমার কাছ থেকে হেল্প চেয়েছেন। আর বেশির ভাগই আপুকে নিয়ে চেয়েছেন। আমি নিশ্চিত আজও আপুর জন্যেই হেল্প চাইছেন। কী আমি ঠিক বলছি না?”
– “ওরে বাবাগো! ডুমুরিয়া ফুলের তো দেখছি, মাথায় খুব বুদ্ধি। হ্যা তুমি ঠিক ধরেছো। আজ বিশেষ দিন। আজকে না অবশ্য, রাত ১২ টার পরে রূপার জন্য বিশেষ কিছু অপেক্ষা করছে। সে পর্যন্ত তোমার আমার সাথেই থাকতে হবে। থাকবে তো?”
– “তা নয় থাকলাম। কিন্তু রাত ১২ টার পরে কী হবে?”
– “রাত ১২ টার পরেই তোমার আপুর বার্থডে। আর আমি চাই ওর বার্থডে, সবার আগে আমিই সেলিব্রেট করবো। অবশ্য ওর বার্থডে কখনও সেলিব্রেট করা হয়নি। তবে আজ হবে। অনেক বড় বার্থডে পার্টি হবে। তুমি ওর সব কয়টা ফ্রেন্ডকে ইনভাইট করো। আমি চাই আজকের দিনটা যেন ও কখনও ভুলতে না পারে।”
– “ওরেব্বাস! আজ আপুর বার্থডে, এটা আমি কিভাবে ভুলে গেলাম? জিজুউউউ… ইউ আর অ্যা গ্রেড! সত্যিই আপনার কোনো তুলনা হয় না। আর আমি আপনাকে হেল্প করবো। আপনি না চাইলেও করবো। আপুর জন্মদিন বলে কথা! ইয়াহু! আই অ্যাম সো সো হ্যাপি।”
– “হুম… এখন বলো তোমার আপুকে কিভাবে নিয়ে যাবো? ওকে কোনভাবে জানতে দেয়া যাবে না যে ওর জন্য আমরা সারপ্রাইজ প্লান করেছি। আর শোন, বাড়িতে এমন কিছু বলে আসবে যাতে তোমাদের মা কিছু বুঝতে না পারে।”
– “সমস্যা নাই, মাকে বলে দেব আমি আর আপু মুক্তি আপুদের বাসায় যাচ্ছি। মুক্তি আপু আমাদের কাজিন। আমরা এখানে গেলে মা কিছুই বলেন না। মাঝেমাঝে তো আমি আর আপু প্লান করে মুক্তি আপুদের বাড়িতে চলে যায়। মায়ের মারের হাত থেকেও বাঁচতে পারি। আজও তেমন কিছু একটা বলেই যাব। অনেক দিনই হয়েছে আপুদের বাসায় যাওয়া হয়নি। আজ না হয় মুক্তি আপুদের বাসার নাম করে ওইদিকে চলে আসব। আর চিন্তার কিছুই নেই, আপুকেও সাথে করে আনব। এমনিতে আপু তো এখন বাজারে গেছে। একটু পরে আসলেই ভুলিয়ে-ভালিয়ে পার্টিতে নিয়ে যাব। আচ্ছা, আপনি বুঝলেন কিভাবে, ফোনটা আমি ধরেছি? ”
– “কারণ আমি জানি, মহারানী এইসময় বাজার করতে যান। এজন্য, এসময় তোমার কাছে ফোন দিলাম। আচ্ছা ওকে কী অন্যকোন ভাবে আনা যায় না?”(লেখক মাহমুদ)
জিজুর কথাটা আমি কিছুক্ষণ ভাবতে লাগলাম। তারপর বললাম,
– “আইডিয়া! আপুকে কিডন্যাপ করলে কেমন হয়?”
– “কিডন্যাপ? আর ইউ ক্রেজি?”
– “আমি ঠিকই বলছি, আপুকে কিডন্যাপ করলেই আপনার সারপ্রাইজ সাকসেসফুল হবে।”
“এরপর ভাইয়াকে কোনমতে রাজি করিয়ে, তোকে কিডন্যাপ করিয়েছি। ওহ মাই গড!! আজ কী দখল নাই গেল আমার উপর দিয়ে।”
রূপা শুধু দাঁড়িয়ে শুনছিল। ওর জন্য দ্বীপ এতবড় সারপ্রাইজ প্লান করেছে? ইশশ! ভাবতেও লজ্জা লাগছে তার।
এবার কেক কাটার সময় চলে এল। রূপা-দ্বীপ দুজনই একইসাথে কেক কেটে একে অপরকে খাইয়ে দিল। গালে তুলে খাওয়ানোর মুহূর্তে নিপা বলল,
– “জিজু-আপু লুক অ্যাট দ্যা ক্যামেরা…”
রূপা মিষ্টি হাসি নিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকাল। নিপা বলল,
– “উফ আপুউউউ! হ্যাংলার মত ক্যামেরার দিকে না তাকিয়ে এএবার একটু জিজুর দিকে তাকা তো।”
রূপা দ্বীপের দিকে তাকাল। দ্বীপও রূপার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। ঠিক সেই সময়টাই নিপা ওদের জীবনের সেরা মুহূর্তটা ক্যামেরায় বন্দি করে নিল।
– “এহেম্মম!”
হঠাৎ কারো গলার কন্ঠে কল্পনার বেড়াজাল ছিড়ে বেরিয়ে এল রূপা। চোখ খুলে সে দেখতে পেল ধ্রুবকে। আশেপাশে তাকিয়েও দ্বীপকে খুজে পেল না সে। ধ্রুব বলল,
– “কিছু কী খুজছো?”
রূপা জবাব দিল না। তার মনটা এখন বিচলিত হয়ে পড়েছে, দ্বীপকে এক ছোয়া দেখবার জন্য। প্রায় এক বছর হয়েছে দ্বীপের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই তার। কোথায় আছে, কেমন আছে, কিছুই জানে না সে। এই এক বছরে একটা বারও দ্বীপ তার সাথে হয়তো যোগাযোগ করাও চেষ্টা করেনি। দ্বীপের প্রতি তার মনে একরাশ ক্ষোপ জন্মেছে। ছেলেটা ওকে এত কষ্টি দিচ্ছে কেন? রূপার কথা কী তার একটুও মনে পরে না?
– “তোমার কিছু লাগলে বল…”
রূপা বলল,
– “না, আমার কিছুই লাগবে না।”
– “তাহলে ওমনভাবে কী খুঁজছিলে?”
রূপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
– “কিছু না।”
– “ওকে। উঠেছো ভাল করেছো। এখন রাতের ঔষধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। কিছু খেয়ে ঔষধ খেয়ে নাও। সকাল থেকে তো মনে হয় কিছুই খাওনি। মুখ শুকিয়ে আম শক্ত হয়ে গেছে। এখন কী খাবে? ভাত খাবে? তাইলে ভাত এনে দেই?”
– “না, আমার ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না।”
– “তাহলে কি খাবে? রুটি এনে দেব?”
– “উহু…. আমার কিছুই খেতে মন চাইছে না। অনেক রাত হয়ে গেছে, ঘুমিয়ে পড়ুন। আমাকে নিয়ে আপনার এত চিন্তা করতে হবে না। আমি ঠিক আছি।”(লেখক মাহমুদ)
– “কচু ঠিক আছো। গায়ে এত জ্বর আর তুমি বলছো ঠিক আছো? কথা না বলে চুপচাপ ভাত খেয়ে নাও। নিচ থেকে আমি রুটি আনতে যাচ্ছি। তুমি এখানে শুয়ে থাকো। বিছানা ছেড়ে একটুও উঠবে না বলে দিলাম। আমি দুই মিনিটের মধ্যে আসছি।”
ধ্রুব চলে গেল। ঠিক ১০ মিনিটের মধ্যে রুটি নিয়ে চলে এল। বলল,
– “সরি… আসলে কোনো তরকারি ছিল না। তাই ডিম ভাজি করতে গিয়ে দেরী হয়ে গেছে। দেখি একটু উঠে বসে তো। আমি উঠিয়ে দেই?”
– “না থাক। আমি একাই উঠতে পারবো।”
ধ্রুব দেখল রূপা উঠার চেষ্টা করলেও উঠতে পারছে না। বার বার পড়ে যাচ্ছে। ধ্রুব বলল,
– “কচু উঠতে পারবা। এখনও তো হাতও নড়াতে পারছো না। দেখি… আমিই উঠিয়ে দিচ্ছি।”
রূপাকে বসিয়ে দিল ধ্রুব। খাওয়ানোর সময়ও রূপা বাধা দিল,
– “আমি একা খেতে পারব। আপনাকে কষ্ট….”
ধ্রুব ধমক দিল। বলল,
– “আর একটা কথা বললে গালে চড় বসিয়ে দেব। চুপচাপ খেয়ে নাও বলছি।”
ভয়ে রূপা খেয়ে নিল। কয়েক লোকমা খাওয়ার পরপরই গড়গড় করে ধ্রুবের গায়ে বমি করে দিল সে। ধ্রুব কিছু বলল না। রূপার গাঁ মুছে দিল সে। নিজেও স্বাভাবিক ভাবে মুছে ফেলল। যেন এটা তার কাছে কিছুই না। ধ্রুব আলমারি থেকে শাড়ি এনে বের করে দিল। বলল,
– “যাও চেঞ্জ করে আসো…”
রূপা কাপা কাপা গলায় বলল,
– “স-সরি আসলে আমি বুঝতে পারি নাই।”
– “সরি বলার মত কিছুই হয় নাই এখানে। যাও চেঞ্জ করে আসো। নাইলে জ্বর বেড়ে যেতে পারে।”
রূপা শাড়ি চেঞ্জ করে নিল। এরপর ধ্রুবও গিয়ে চেঞ্জ করে নিল। রূপা বেশ অবাক হয়ে আছে ধ্রুবের এমন কর্ম কান্ডে। মানুষটা একদিনে এতটা পাল্টে গেল কিভাবে? রূপা তো ভেবেছিল আজ সে গেছে। নিশ্চিত ধ্রুব তাকে মারবে, এমন একটা কল্পনা করে রেখেছিল সে। কিন্তু ধ্রুব জিনিসটাকে স্বাভাবিক ভাবে নিল। অনেক দিন আগে একবার মায়ের জ্বর হয়েছিল। বমি করে তিনি ঘর পাকিয়ে ফেলেছিলেন। তখন ধ্রুব নাক ছিটকে বলেছিল,
– “ছিঃ কি দূর্গন্ধ। আমি এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত থাকতে পারবো না। হারু চাচা, আমি যেন এসে দেখি এইসব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে। প্রতিটা ঘরে ঘরে রুম স্প্রে দেয়া হয় যেন। ঘরের ভিতরে যেন আমি কোনো বমির অস্তিত্ব না পাই।”
আর আজ সে কিনা কিছুই বলল না। রূপা বেশ অবাক হয়ে আছে। ধ্রুবের এমন পরিবর্তনের কারণটি ধরতে পারছে না সে। ধ্রুব এবারও বেশ স্বাভাবিক ভাবে বলল,
– “যদি আবারও বমি আসে, তাহলে আমাকে ডাক দিও। ধরো… এখন ঔষধটা খেয়ে নাও। ডক্টর বলেছেন, সময়মত ঔষধ না খেলে জ্বর ভাল হবে না।”
রূপা মাথা ঝাকিয়ে সায় দিল। বিনাবাক্য ঔষধটা খেয়ে নিল রূপা। এরপর আবারও বের করতে লাগল ধ্রুবের এমন পরিবর্তন হবার কারণটি। সবকিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছে তার কাছে। কোনোভাবেই ধ্রুবের পরিবর্তন হবার কারণটি ধরতে পারছে না রূপা।
চলবে,,,,,,
লেখকের অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ