ভালোবাসিনী….
লেখিকা – রুবি আক্তার
পর্ব – ২
ওরা আর সেদিন বেশি থাকলো না। শিউলি , সীমা ওরা যুথিকে খ্যাপাতে খ্যাপাতে নিয়ে চললো কলেজ গেটের দিকে। বসে থেকে আমি শুধু আমার কয়েক মিনিটের ভালোবাসার চলে যাওয়া দেখছিলাম। আর বিড়বিড় করে আল্লাহর কাছে এটাই চাইছিলাম,”আল্লাহ, আর কত প্রেমে পড়ার আগেই ছ্যাঁকা খাবো? একটা তো ব্যবস্থা করে দেও।” রাফি আমার দিকে দাঁত কেলিয়ে আছে। পেটের ভিতর ওর হাসির বোমা। দেখলেই বোঝা যায়। আমি আর কিছু না বলে তার দিকে খালি আমার নিরিহ চোখের অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। আর কি? গেলো বোমাটা ফেটে। রাফি হাসতে হাসতে এখন মেঝেতে গড়াগড়ি খাওয়ার উপক্রম। হাসুক, আমার মতো ছেলে আহা!
কম্পিউটারের দিকে মনোযোগ দিলাম। আজকে ক্লাস আছে তাই অল্পতেই দোকান থেকে বেরিয়ে সোজা কলেজের ল্যাবে গিয়ে ঢুকলাম। ঢুকতেই দেখি শর্মী মেয়েটা হাতে গ্লাভস পড়ছে। ইস্, এই মেয়েটাও আমার ক্রাশ ছিল। কিন্তু যখন জানতে পারলাম…..। ঘোর কাটলো শর্মীর ডাকে,” কিরে দোস্ত, কই ছিলি? স্যার কিন্তু এখনি এসে পড়বে। সবাইকে যদি না পায় বোঝোই তো কি করবে।”
আমি বললাম” কি আর করবে? এসে কতোক্ষণ লেকচার দিবে। আচ্ছা, তোমরা এটাকে কি ল্যাব মনে করো না? মেডিক্যাল না বলে কি এখানে কিছুই নেই? এই ল্যাবে যা আছে অন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে তা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো।” হুবহু স্যারের মতো করে কথাগুলো বলাতে শর্মী হেসে উঠলো। আর শুনতে পেলাম দরজার কাছ থেকেও তিন-চার জন ও হাসছে। আমার ফ্রেন্ড সব আসছে। আমি সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে দেখছি স্যার আবার আসলো নাকি। এটা আমাদের নিত্যদিনের ঘটনা । বিভিন্ন স্যার ম্যাডামকে নকল করে মিমি বানানো। দুইএকদিন ধরাও খেয়েছি। তার বদলে অনেক গুলো উপদেশ মূলক কথা শুনেছি। স্যারেরা ও কম যায় না। এরা জানে ধমক না শিক্ষার্থীদের কিছু উপদেশ মূলক কথা শুনালে এটা রিমান্ডে নেওয়ার চাইতে কম না। আসলেই স্যারেরা একেকটা কঠিন বস্তু বটে।
স্যার, আসলো। আমরা হাতে হাতে করলাম সব। তারপর প্রায় দুই ঘন্টা বাদে ক্লাস শেষ। প্রতিদিন ক্লাস শেষ হলে আমরা তিন চার জন বন্ধু কথা বলতে বলতে কলেজ গেটের দিকে যাই। আজকেও ব্যতিক্রম না। কিন্তু আজকের ঘটনা ব্যতিক্রম। আমি গেটের কাছে এসে দেখি সেই পিচ্চি শিউলি দাঁড়িয়ে। আমি ভয় পেলাম। মেয়েটা এখানে আমাকে দেখলে আবার কি না কি শুরু করে। আমি আমার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পিছনের গেটের দিকে গেলাম। আর যাওয়ার আগে দেখলাম ওর চোখ গেটে যাওয়া আসা মানুষ জন পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। ধুর, এই মেয়েটার জন্য আমার কলেজ লাইফ শেষ হয়ে যাবে তো। চলে গেলাম পিছনের গেট দিয়ে বাড়ি। হয়তো আমাকে না পেয়ে পিচ্চি ও চলে যাবে। কিন্তু কালকে ঠিক কম্পিউটার শিখতে আসবে। সমস্যা নাই হেনাও খারাপ না। লাইন করতে ওদের কম্পিউটার শিখানোই যায়..।
পরেরদিন সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে একটু ফুলবাবু সেজে দোকানে গিয়ে বসলাম। যথারীতি এগারোটা বাজলো আর পিচ্চি ও আসলো। বাকি দুইজন আসে নাই। আমি তো হতাশ। শরম লজ্জা ভেঙ্গে আমি জিজ্ঞেস করলাম” আর দুইজন কই? আসে নাই এখনো।”
পিচ্চি সাদা দাঁত গুলো বের করে বললো”ভাইয়া, ওরা তো আসবে না।” আমি এই কথাটা শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। মানে কি আসবে না! কালকেই না বলল ওরা কম্পিউটার শিখবে? তাইলে আজকে আবার কি হলো। আমি নিজেকে কোনো রকমের শান্ত রেখে বললাম” তারমানে তুমি একলা শিখবে? আমি তো তোমাকে একলা শিখাবো না। আমার সময়ের অনেক মূল্য আছে। প্লিজ তুমি আসতে পারো।” বলেই ছোট বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে কম্পিউটারের মনিটরে তাকিয়ে থাকলাম। ওখানে ওয়ালপেপার ছাড়া আর কিছুই নেই। তবুও নিজের উপর নিজের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। জীবনটা কি এমনি রসকষহীন যাবে। না একটু টুইস্ট আসবে। পিচ্চি যে এতোক্ষণ আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল জানতাম না।
আমার গাল ফুলানো দেখে একটু আশ্চর্য হলো আর আজকের গেট আপ মনে হয় ভালো করে খেয়াল করে বলল” আচ্ছা, ভাইয়া? আপনি তো এমনিতেই কিউট কিন্তু আজকে আপনাকে এতো কিউট লাগছে কেনো? কি যেন একটা পরিবর্তন হয়েছে আপনার মধ্যে। দাঁড়ান ,কি সেটা আমি বের করি।” বিজ্ঞের মতো কতোক্ষণ আমাকে জরিপ করলো। আমি তো পড়লাম বেশ অস্বস্তিতে। আসলেই আমার এই লুকটা আজকে কোনো কাজের না। কারণ একটাও প্রেম আর করতে পারলাম না।
-“আজকে তো আপনাকে নায়কের মতো লাগছে। এমন ড্রেস পড়লে কিন্তু আপনাকে খুব ভালো লাগে। এখন থেকে এমন পোশাকই পড়বেন। ঠিক আছে..।” এমনভাবে বললো যে আমার বাপের ফ্যাশন হাউস আছে প্রতিদিন একেকটা পড়ে আসব। এই মেয়েটা কি পাইছে?
যাই হোক, নিজেকে শান্ত রেখে একটা মেকি হাসি দিয়ে তাকে বললাম” দেখো আপু আমার তো আজকে ক্লাস আছে। তোমার একার জন্য তো আর আমি ক্লাস মিস করতে পারবো না। আর তাছাড়া আমি তো তিনজনকে শিখিয়ে যা পাইতাম তা তো আর পাবো না। তাইলে আর শিখাবো না।”
-“অ্যা! ভাইয়া আমি তো বলি নাই ওরা আর আসবে না। ওদের আজকে একটা জরুরী কাজ আছে তাই তারা আর আসে নাই। ও ভাইয়া, আমার কিন্তু ওদের মতো কোনো কাজ থাকে না।” বলেই হো হো করে হেসে উঠলো। আমি ভেবে পাই না কি এমন হাসির কথা ছিল যে ও এভাবে হেসে উঠলো। সেদিনের মতো কম্পিউটার এর বেসিক কিছু শিখিয়ে নিজের ক্লাস করতে বের হলাম। ক্লাস করে আমি আর শর্মী এক সাথে হেঁটে যাচ্ছি। আমি শর্মী কে বললাম” দোস্ত, চটপটি খাবি ?”। শর্মী বললো” নারে, আজকে আমার খাওয়া বারণ। তুই খা না।”
আমি একটু অভিমানের ভঙ্গি নিয়ে বললাম” তুই কোনো সময় আমার দেয়া কিছু খাস না। তুই একটা সুচিবাই।” আমার কথা শুনে শর্মী হেসে বলে ” নারে দোস্ত আমি খাবো না। সত্যি আজকে খাওয়া বারণ।”
আমরা কথা বলছি তার মধ্যে হঠাৎ শুনি পিছন থেকে কেউ বলছে”ভাইয়া”….” অয়ন ভাইয়া” ….। ব্যস হয়ে গেল। আবার সেই পিচ্চি শিউলি। কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে একদম আমার ঘাড়ের কাছেই। পিছন ফিরতেই দেখি সত্যি প্রায় মেয়েটা আমার ঘাড়ের উপর । আমাকে পিছন ফিরতেই দেখে একটু সরে দাঁড়িয়ে বলদের মতো হাসি দিয়ে বললো” ভাইয়া , কি করেন?”
শর্মী আমার দিকে এক রাশ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি তো আর পৃথিবীতে নাই। তারপরে যে কথাটা বললো তা শুনে আমি শুধু বলতে ছিলাম ধরণী তুমি কৃপা হয় আমি তোমার মাঝে পতিত হয়ে ধন্য হই। কথাটা ছিল” ভাইয়া, আপনি চটপটি খাবেন? আসেন ভাইয়া আমিও খাইতাম। একা একা ভালো লাগেনা। তাই দেখলাম আপনি আপুটাকে বলছেন খাইতে সে তো খাবে না। আমি খাওয়াবো। সমস্যা নাই আমি টাকা দিবো।”
কি একটা অবস্থা! একটা মেয়ে যে কিনা আমার ছোট। সে আমাকে চটপটি খাওয়ার অফার করে । তাও বলে বিল সে দিবে। শর্মী আমাকে কৌতুকে ভরা কণ্ঠ নিয়ে বলল,” কি… ভাইয়া? চটপটি খাবেন? টাকা তো ও দিবে। কোনো সমস্যা নাই আপনি খান ভাইয়া। আমার কাজ আছে।”
-“আরে না..। আমি খাবো না তো। আমারো কাজ আছে দোস্ত খাঁড়া।” বলেই ওর পিছু পিছু দিলাম দৌড়।
পিচ্চি শিউলি ও আমার পিছনে পিছনে দৌড়ায় আর বলছে” ভাইয়া, দাঁড়ান, দাঁড়ান। চটপটি খাবেন না..?
আমাকে কি আর পায়। আমি তো আজও দৌড় কালো দৌড়।
(চলবে)