ভালোবাসিনী পর্ব ৮

ভালোবাসিনী….
লেখিকা – রুবি আক্তার
পর্ব – ৮

মহিলাও অনেক শুকনা ঠিক পিচ্চির মতো। এখন যেহেতু লোক এসেই পড়েছে। আমি চাইলাম বিদায় নিয়ে দোকানে যেতে। হেনাদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম ওরা যাবে কিনা। ওরাও যাবে। তাই একসাথে বের হবো ঠিক করলাম। শিউলির মা আমার কাছে এসে অনেক ধন্যবাদ দিলো। তারপর আমার ঔষধ বাবদ কতো খরচ জানতে চাইলে আমি বললাম এখন এই কথা না বলে ওর কি কি লাগবে তা দেখুন। আমি কোনো সাহায্য করতে পারলে অবশ্যই বলবেন।আর কথা না বলে ওদের সাথে বের হয়ে গেলাম। আমি হেনা কে বললাম” জানিও কি হয়?এখন আসি।”
মনের ভিতর হাজার প্রশ্ন। এভাবে হঠাৎ অসুস্থ হওয়ার মানে কি?

এরপর ও দুইদিন হাসপাতালে ছিল। আমার এক বন্ধু কে নিয়ে গেলাম রক্ত দিতে। ও এক ব্যাগ রক্ত দিল। আর বাকিটা তারাই যোগাড় করছে। তাই আর দেয়া লাগেনি। হেনারা আর দোকানে আসে না। টুলটা আমি সরিয়ে রেখেছি। কেনো তা বলতে পারবো না। তবে মন বললো সরিয়ে রাখতে, তাই।

একদিন হেনা এসে বললো” ভাইয়া, আমরা আর শিখবো না। শিউলি কে নিয়ে নাকি ঢাকা গেছে। ডাক্তার বলেছে ঢাকা মেডিকেল এ দেখাতে।‌ তাইলে ভাইয়া আজকে তাহলে আসি। আর হয়তো দেখা হবে না। ভালো থাকবেন। ”
এই কথাটা আমাকে অনেকটা নাড়িয়ে দিলো। কারণ এই কয় মাসে ওদের সাথে থাকতে থাকতে আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল ওদের সব খুনসুটি গুলোর কেন্দ্রে থাকতে। কারণ আমাকে নিয়েই তো সব।

আজ বেশ কয়েকমাস হলো ওদের সাথে দেখা হয় না। তার কিছু কারণও আছে। আমার ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। আর শিউলি নেই যে আমার জন্য এখানে এসে অকারণেই বসে থাকবে। আমার ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমার পরীক্ষা শেষ হলেই হবে। তাই অনেক উত্তেজনা কাজ করছে আমার ভিতর। তার মধ্যে ছোট্ট এক টুকরো মন কোথায় যেনো চিনচিন করে। “শুকতারা”আর মেসেজ করে না। লাস্ট একটা মেসেজ দিয়েছিল তা হলো” আমার বিয়ে আগামী কাল। আর হয়তো আপনার ঘড়ি হতে পারবো না। তাই দয়া করে নিজের ঘড়ি নিজেই হয়ে নামাজ পড়ে নিবেন।” এরপর থেকেই শুকতারা আইডিটা ডি এ্যাক্টিভেট দেখায়। আমার নিজেকে অনেক দুর্ভাগা মনে হতে লাগলো। কারণ আমার মতো একটা ছেলে কাউকে ভালো বা কারো হতে পারবো না। যেই আমার ভালো চাইলো সবারি ক্ষতি হলো। এটা কি নিয়তি। তাই আর কারো ভালো করবো না। সিদ্ধান্ত নিলাম আর কারো জীবনে জড়াবো না।

অনেকদিন পর পরীক্ষা শেষ ভাইয়ের বিয়েও হয়ে গেছে। এখন আমি ফোর্থ ইয়ারে। আমি আর শর্মী সব সময় কম্পিটিশন করি। হয় ও ফার্স্ট হয় নাহলে আমি। কিন্তু ডিপার্টমেন্টে আমরা এই দুই স্থান দখল করেই আছি বিগত তিনটা বছর। একদিন ক্লাস করছি। হঠাৎ দেখলাম কলেজের প্রিন্সিপাল আর আমার ডিপার্টমেন্টের স্যারেরা আমাদের ক্লাসে ঢুকছে। সাথে কিছু ছোট ভাই-বোন ও আছে। যারা ইন্টারে সাইন্স নিয়ে পড়ে। বুঝলাম কিছু একটা‌ বলবে। এসেই স্যার আমাদের কুশল বিনিময় করলো। তারপর সে যা বললো তার হলো:

আমাদের কলেজের এক মেধাবি ছাত্রী শিউলি আক্তার। যে আমাদের কলেজে সাইন্সে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে ভর্তি হয়েছে। তার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। তার আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। তাই তোমরা যে যা পারো সাহায্য করো। এভাবে একজন মেধাবী ছাত্রী আমাদের মাঝে থাকবে না ভাবতে পারছি না। তাই সবার আর্থিক সহযোগিতা কামনা করছি। কেউ দায়িত্ব নিয়ে টাকা তুলে আমার কাছে এসে দেখা করো। আমিও কোন জায়গা থেকে ডোনেশন পাবো আজকে। সব মিলিয়ে টাকাটা ওর এই ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিবো। ওকে স্টুডেন্ট পড়ো।

বলে স্যার থামলো। তারপর তার সহপাঠীরা বলতে লাগলো আরো কিছু কথা। আমি ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। ছেলেটা মনে হয় মাদ্রাসায় পড়ে। কারণ গেটআপ তাই বলে। মাথা নিচু করে আছে। বুঝতে পারছি ওর অবস্থা। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। শিউলি সাইন্স নিয়ে পড়তো। ও সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রী। আমি বিস্ময়ের চরমে পৌঁছে গেছি। আর কতো চমক আমি পাবো। তাই ভাবছি। তবে আমি ভাবছি। শিউলি যে কিনা প্রাঞ্জল ও দুরন্ত একটা মেয়ে। এখন সে মরণব্যাধি ক্যান্সার এর কাছে হার মানছে। আমি আর থাকতে পারলাম না। ক্লাস থেকে বের হয়ে হেনাকে কল দিলাম। ধরলো, কিন্তু গলাটা কেমন ধরা ধরা। মনে হয় অনেক চাপা কষ্ট তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। আমিও তেমন অনুভব করছি। কারণ একটা মেয়ে সে শত হলেও আমার ছাত্রী ছিল। আমার পিছনে লেগে থাকতো” ভালোবাসি, ভালোবাসি” বলে । সে আর বলবে না যে টুল তার। হেনাকে বললাম” আমাকে বলো নি কোনো?” ও এখন একটু ফোপাচ্ছে। ক্ষীণ স্বরে বলল” ও ঢাকা যাওয়ার আগে আমার কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল। আপনি যেনো কিছু না জানেন। এখন আর লুকিয়ে লাভ কি? সবই তো জানেন। একবার আপনাকেও দেখতে চেয়েছিল। হাসপাতালে থাকতে। কিন্তু আপনি তো ব্যস্ত ছিলেন। তাই বিরক্ত করিনি।”

-“কবে গিয়েছে ঢাকা?”

-“একমাস প্রায়। ওর ভাই একবছর হলো সিঙ্গাপুর গিয়েছে। তাই ওদের আর্থিক অবস্থা আরো খারাপ। কারণ অনেক ধারদেনা পড়ে গিয়েছে। তবু বেশ কয়েক জায়গা থেকে সাহায্য করে তার চিকিৎসা করাচ্ছে আন্টিরা।”

-” এখন অবস্থা কেমন?”

-” যতদূর জানি, ভালো না। ডাক্তার আর একমাস এর কথা বলেছেন। এখন খালি ওর ব্যাথা কমিয়ে ওর একটু হলেও কষ্ট কমাতে চাইছে সবাই। আসলে…”

আর বলতে পারলো না হেনা। ওপাশ থেকে একটু কান্নার আওয়াজ পেলাম। তারপর কুট করে কেটে গেল। আমার বুকটা অনেক ভার হয়ে গেছে। মাথা ভার হয়ে গেছে। বুঝলাম আমি কষ্ট পাচ্ছি। কেনো পাচ্ছি? মেয়েটাকে তো আমি ভালোবাসিনী। তবুও কেন এমন কষ্ট হচ্ছে আমার। কি এক অদৃশ্য সুতোর বাঁধনে আটকা পড়েছি আমি। তা এখন বুঝতে পারছি। আমি ঠিক করলাম ওর জন্য আর্থিক অনুদান আমি উঠাবো। তাই ক্লাসে গিয়ে আমি তার ভাইকে বললাম,”তুমি কবে যাবে ঢাকা।”

-“আ-আসলে আজকেই কিছু টাকা পাঠাতে হবে। আর আমি কাল পরশু যাবো। ওর জন্য নাকি রক্ত আর কি একটা ইনজেকশন কিনতে হবে। অনেক দাম । ভাইয়া দেখেন না যদি একটু আপনারা সাহায্য করতে পারেন?” ছেলেটার গলা ধরা ধরা।

-“ঠিক আছে চিন্তা করো না। আমি দেখছি।”

সেদিন সারাদিন আমি আর ওর ভাই টাকা উঠাতে খুব ব্যস্ত সময় কাটালাম। তার মধ্যে সময় করে ওদের ঢাকা কার বিকাশ নাম্বারে তিন হাজার টাকা মতো পাঠিয়ে দিলাম। আমি অনেক টাকা না উঠলেও প্রায় পনেরো হাজার টাকা উঠলো। কারণ সবাই কম বেশি টাকা দিয়েছিল। স্যারের কাছে গিয়ে আরো ত্রিশ হাজার টাকা পেলাম। আমি সব টাকা গুছিয়ে ওর ভাইকে বললাম” তুমি এই টাকা নিয়ে একা যেতে পারবে তো?”

ছেলেটা বললো” আসলে আমি ঢাকা জীবনে প্রথম যাবো। আফাকে নিয়ে গেছে আমি ছিলাম মাদ্রাসায়। এখন আমি যাবো। আমার আব্বা অনেক অসুস্থ সেও মেডিকেল এ ভর্তি। সে হার্টের রুগী। তাই আফার এই অবস্থা দেখে অসুস্থ হয়ে গেছে। তাই আমাকেই যেতে হবে।”

আমি বললাম”তাহলে এক কাজ করো তুমি কালকে সকাল সকাল কলেজে চলে এসো। আমি এখানে থাকবো। তারপর আমিও তোমার সাথে ঢাকা যাবো। ঠিক আছে। আর এই টাকা আজ আমার কাছে থাক। তোমার তো অনেক দূরের পথ। যদি কিছু হয়ে যায়।” ছেলেটা অনেক ধন্যবাদ জানালো যে আমি ওর সাথে যাবো তাই। কারণ এখন ওদের একটা শক্ত হাত চাই।
কেনো যেনো আমার খুব পিচ্চি কে দেখতে ইচ্ছে করছে। তাই আমিও যাবো বললাম। আর বড় কথা একটা রাত পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে যদি আরো কিছু টাকা যোগাড় করা যায়।

সেদিন চেনাজানা অনেক জায়গায় আমি যোগাযোগ
করলাম। আমিও তেমন ভালো অবস্থানে নেই যে অনেক টাকা দান করবো। তাও নিজের গাইড থেকে আমি পাঁচ হাজার যোগ করলাম। অনেকেই আমাকে টাকা দিবে বললো। কিন্তু রাতে না। বললো আমাগিকাল বা পরশু। তাই আমি তাদের আমার বিকাশ নাম্বার দিয়ে বললাম যদি পারে তাহলে যেনো তাড়াতাড়ি আমাকে টাকাটা পাঠিয়ে দেয়।
তারপর কল করলাম হেনাকে।
ওকে বললাম” হেনা তুমি কালকে থেকে কলেজে প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে গিয়ে টাকা তুলতে পারবে? আমি আমার এক বন্ধুকে বলে দেবো ও তোমার সাথে থাকবে। আমি কাল শিউলির ওখানে যাচ্ছি। ওর ভাই তো ছোট আর কখনো নাকি ঢাকা যায়নি। তাই আমি ওর সাথে যাচ্ছি। তুমি টাকা তুলে আমার বিকাশ নাম্বার এ পাঠিয়ে দিও। ঠিক আছে।”
হেনা ওপাশ থেকে সব শুনলো। তারপর বললো” ভাইয়া, ওকে বলবেন আমরা ওকে অনেক মিস করি। আর ও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।”বলেই আবার কাঁদতে লাগলো।
আমি এপাশে বসে মুখটা নিচু করে বসে রইলাম। নিজের অজান্তেই এক ফোঁটা জল আমার হাতের উপর পড়লো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here