ভালোবাসিনী…..
লেখিকা – রুবি আক্তার
পর্ব – ৩
দৌড় তো দিয়েছিলাম কালকে। আজকে কি করবো? দোকানে যাচ্ছি আর ভাবছি। পিচ্চি যদি আজকে জিজ্ঞেস করে’ভাইয়া, কালকে ওমন করে দৌড় দিলেন কেনো?’ মুখটা তখন আমি কোথায় রাখবো তাই ভাবছি। কারণ সেখানে হেনা, সীমা, রাফি আরো অনেক কাস্টমার থাকবে। এই মেয়েটার মুখে কোনো লাগাম তো নাই।
হতাশ ভঙ্গিতে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি। যে কেউ দেখলে ভাববে আমি ছ্যাঁকা খাইছি। গিয়ে দেখি দোকানে আজকে বেশ কাস্টমার আছে। সেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। “আল্লাহ, আজকে পিচ্চি যেন কিছু না বলে” বলেই দোকানে ঢুকলাম। রাফি আর ভাইয়া একা সামলাতে পারছে না তাই আমি তাড়াতাড়ি কাজে বসলাম। একটু পরে আমার এক পরিচিত ছোট বোন আসলো। আমার সাথে টুকটাক গল্প করছে আর আমি ওর কাজটা করে দিচ্ছি। ও এবার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। ওদের ফরমফিল আপ শুরু হয়ে গেছে। তাই এতো ভীড়। তো ওর সাথে আমি হেসে হেসেই কথা বলছি। হঠাৎ দেখি পিচ্চি এসে টুলের কাছে দাঁড়িয়েছে। মুখটা একটু থমথমে। বুঝতে পারলাম না কেনো? কালকের ঐ দৌড়ের জন্য না তো। আমি সেই ছোট বোনটার ছবি এডিট করছি। আর বলছি ” তুমি তো এমনিতেই অনেক সুন্দর। ছবি এডিট না করলেও চলবে। ”
হঠাৎ পিচ্চি শিউলি কঠিন কিন্তু শীতল গলায় বললো” আপু, ওটা আমার টুল। আপনি কি দয়া করে উঠে অন্য কোথাও বসবেন।”
আমি আর মেয়েটা দু’জনেই খুব অবাক হলাম। টুল “ওর” কথাটা শুনে। আর আমি ভয় ও পেলাম। কারণ আমার এই পরিচিত মেয়েটা তার নাম মিতু ও আবার একটু রগচোটা ঠোঁট পাতলা টাইপ। যাকে যা খুশি বলে দেয়। আমি পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছি।
ঠিক তখনি মিতু বললো” তাই বুঝি! তাইলে একটু দাঁড়াও আমার হয়ে গেলে আমি উঠে যাবো। তারপর তোমার টুলে তুমি বসো।”
মিতুর আজকের কথা শুনে আমি একটু অবাকই হলাম। সাধারণত এমন শান্ত গলায় কারো সাথে কথা বলে না। তবে এটা যে ঝড়ের পূর্বাভাস তা আগে জানতাম না।
তখনি পিচ্চি বলে উঠলো” না , আপনি অন্য কোথাও গিয়ে বসুন।অয়ন ভাইয়ার কাজ হলে আমি আপনাকে বলবো।” বলে মিতুর হাতটা ধরে উঠিয়ে দিতে চাইলো। ব্যস, আর কি, যা হওয়ার তাই হলো। ছুটলো মিতুর তীক্ষ্ণ ফলা ওয়ালা কথার উত্তর।
” আচ্ছা ,এটা যে তোমার টুল বলছো কোনো প্রমাণ আছে? অয়ন ভাই আজকাল দোকানে মেয়ে কর্মচারী ও রাখেন নাকি। রাখেন তো ভালো কথা । কাস্টমার কিভাবে হেন্ডেল করতে হয় তা জানে না?”
বলেই মিতু শিউলির দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। আমি তো স্তব্ধ বিমূঢ় হয়ে গেছি। দোকানে অনেক লোক। কি আর করা। সবাই ওদের কথা কাটাকাটি দেখছে। শিউলি এতোক্ষণ চুপ করে সবটা শুনেছিল।
মিতু থামতেই বলে উঠলো” ভাইয়া, আপনি কি কিছু বলবেন..? থাক আমিই বলি। না, ভাইয়া কর্মচারী রাখে নাই। কিন্তু কয়েকজন কম্পিউটার শিখানোর স্টুডেন্ট রাখছে। এবং আমি তার একজন স্টুডেন্ট।আর এই টুলে বসে আমি কম্পিউটার শিখি।”
মিতুও কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। ও থামতেই বললো” কম্পিউটার না শিখে আগে ম্যানার শিখো। বড় আপুদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তা শিখো। আর হ্যাঁ, অয়ন ভাই, আপনার দোকানে দেখি আর আসা যাবে না। এসব খ্যাত মেয়েরা এসে আপনার দোকানের পরিবেশটা নষ্ট হয়ে গেছে।” বলেই দোকান থেকে গটগট করে বের হয়ে গেল। ছবি জিনিস পত্র কিছুই নিলো না। দোকানে বেশ ভীড়ও জমেছে। ভাইয়া এর মধ্যে এসে মধ্যস্ততা করতে গেলো। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। মিতু যাওয়ার সাথে সাথে পিচ্চি শিউলি তার সিংহাসনে বসে পা নাড়াতে লাগলো। আমি খালি দেখলাম। তারপর একটা পিচ্চি, শুকনা ,ভ্যাবলা মেয়ের কাছে এভাবে অপমান আর নিতে পারলাম না। আমিও হাঁটা শুরু করলাম দুচোখ যেদিকে যায়।
পিছন থেকে শুনলাম পিচ্চি শিউলি বলছে” ভাইয়া, ও ভাইয়া, কই যান। কম্পিউটার শিখাবেন না।
আর আমার ভাইয়ার গলা। সে বলছে” এই মেয়ে বের হও দোকান থেকে। আজকে অনেক কাস্টমার। আর ডিস্টার্ব করো না! ” এলোমেলো পায়ে হেঁটে হোস্টেলে ঢুকলাম। বন্ধু থাকে এক। নাম নাঈম। ওর কাছে গিয়ে এখন একটু পড়বো। নাহলে মাথা ঠিক থাকবে না।
মাথা আমার ঘোলা হয়ে আছে। শুনেছি ছেলেরা মেয়েদের বিরক্ত করে। এখানে দেখি উল্টা। ঐ একরত্তি মেয়ের জন্য আমার এখন দৌড়ের উপর থাকা লাগে। কয়েকদিন দোকানে গেলাম না। নিজেকে সামলানো প্রয়োজন। কিন্তু তার মধ্যে অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসা শুরু করে দিয়েছে । ধরলে কথা বলে না। খালি “সরি ” বলে কেটে দেয়। একটা মেয়ের গলা। আমি তিনবারের সময় শিওর হলাম ও পিচ্চি। আমার মাথা তো গেলো আরো গরম হয়ে। আমি ফোন ও অফ করে রাখলাম।
একদিন ভাইয়ার কাছে শুনি পিচ্চি আর ওর সাথে আরো তিনজন নাকি এসে দোকানে প্রতিদিন বসে থাকে। বলে, কম্পিউটার শিখবে ,ভাইয়া তো শিখানোর কথা বলছিলো। এখনো আসে না কেন?
নাহ, এভাবে চোরের মত পালিয়ে থাকা যায় না। তাই চিন্তা করলাম যা হয় হোক। আমি এবার ওদের সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলবো। তাই পরের দিন থেকেই দোকানে গেলাম। পিচ্চি আর ওর বান্ধবীদের আসা চলতেই ছিল। আমাকে দেখে তো ওরা অনেক খুশি।
আরেকটা চিন্তা ও করে রাখছি। যতক্ষণ পিচ্চি থাকবে এই টুল ওকেই দিবো। আর তামাশা চাই না।
প্রতিদিনই আমাকে ফুসকা বা চটপটি খাওয়ার অফার করে আমি বিনয়ের সাথে না করে দেই। এর মাঝে আমার ফেসবুক আইডি ও জানার জন্য উঠে পড়ে লাগলো পিচ্চিরা। আমি অবশেষে দিলাম। আমাকে ওরা বললো না ওদের আইডি কোনটা। তার পরের দিন একটা আইডি দিয়ে রিকোয়েস্ট আসলো । প্লাস একটা মেসেজ “ভাইয়া, রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেন। আমি আপনার ছাত্রী”। এখন কোন ছাত্রী তা ভাবার বিষয় তখনকার মতো আর কিছু করলাম না। তবে পরেরদিন দোকানে ওদের জিগ্গেস করলাম” আচ্ছা, তোমাদের মধ্যে কেউ আমাকে রিকোয়েস্ট দিছো?”
কথাটা শুনে দেখলাম তিনজনের মধ্যে একটা হাসির রোল পরে গেল। হেনা বললো,” ভাইয়া, সমস্যা কি একসেপ্ট করে নিন না। কথা বললেই তো জানতে পারবেন।”
আমি সেদিনের মতো অন্ধকারে রয়ে গেলাম। ওদের কম্পিউটার বেসিক শিখানো শেষ। এর মাঝে আমার টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়ে যাওয়ায় আর শিখানো হলো না। ওদের ও পরীক্ষা। তাই আর পিচ্চির জ্বালা কমছে। কিন্তু পরীক্ষা শেষ হলেই আবার মেয়েটা আঠার মতো লেগে থাকবে আমার পিছে। ভালোই লাগে না।
(চলবে )