“আমি কি নিচে শোবো??”
বহু পরিচিত কন্ঠস্বর পেয়ে আয়ানের সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছে না। তড়িঘড়ি করে বিছানার ওপর থাকা মেয়েটার দিকে তাকালো। মেয়েটা উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে আয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চোখদুটো তে আয়ানের চোখ আটকে গেল৷ ঠিক যেন সেই চোখ জোড়া।
– কিছু বললেন আপনি?
– হ্যাঁ। বলছিলাম যে আপনি বিছানায় শোবেন। এখানে আমি থাকলে আপনার প্রবলেম হবে। তাই আমি কি নিচে শোবো?
আয়ান এইবার রীতিমতো শক খেল। মেয়েটার কথা বলার ধরন আর কন্ঠস্বর পুরোটাই তার পরিচিত। একটা মানুষের সাথে আরেকটা মানুষের কণ্ঠ এতটা মিল থাকতে পারে সেটা আয়ানের ধারণাতীত ছিলো। তাও আবার সেই মানুষ টার সাথে যাকে সে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,
– না ঠিক আছে। আপনি পাশেই শুয়ে পড়ুন।
অবনীকা আর কোন কথা না বলে চুপচাপ পোশাক বদলে ফ্রেশ হয়ে এসে আয়ানের পাশে শুয়ে পড়লো। আয়ানের ঘুম আসছে না কিছুতেই। উঠে গিয়ে বারান্দায় পাতা চেয়ারে বসে সিগারেট টানতে লাগলো।
আজ আয়ান এর বিয়ে হয়েছে৷ তবে প্রথম বিয়ে নয়। এটা আয়ান এর দ্বিতীয় বিয়ে। বিয়েটা আয়ানের অনিচ্ছায় হয়েছে। ওর প্রথম স্ত্রী অবনীর মৃত্যু হয়েছে দুই বছর হলো। তিন বছরের প্রেমের পরে অনেক বাঁধা কাটিয়ে বিয়ে করেছিলো ওরা। খুব সুখেই কাটছিলো ওদের জীবন। কিন্তু সেই সুখ আর বেশিদিন কপালে সইলো না৷ বিয়ের এক বছরের ভেতরই অবনী আয়ান কে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যায় সারাজীবনের জন্য। বিষয় টা আয়ান মেনে নিতে পারে নি। ট্রমা থেকে বেরোতে বেশ খানিকটা সমত লেগেছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ জীবনে আর কাউকে জড়াবে না। কিন্তু বাবার হার্ট এটাকের কারণে আবার ও বিয়ে করতে হলো সম্পূর্ণ অনিচ্ছায়।
আয়ান উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। দেখতে যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। যে কোন মেয়ে এক দেখাতেই প্রেমে পড়ে যাবে। কিন্তু অবনী মারা যাওয়ার পরে আয়ান জীবন প্রায় শেষ হয়ে গেছে। দুবার সুইসাইড করার চেস্টা করে কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। তাই ওর বাবা ওকে বিয়ের জন্য প্রেশার দিতে থাকে। যাতে জীবন টাকে নতুন নতুন সাজাতে পারে। কিন্তু আয়ান কোনভাবেই রাজি হয়না। অবশেষে হার্ট এটাকের নাটক করে ছেলেকে বিয়ের জন্য রাজী করে এবং আয়ান কে কথা দেয়ায় যে আয়ান ওর জীবন টাকে আরো একটা সুযোগ দিবে। বিয়ের আগে অবনিকা কে একবারো দেখে নি আয়ান। অবনিকা সবকিছু জেনে শুনেই বিয়ে করেছে আয়ান কে। সে জানে আয়ান এর জীবনে কত বড় ঝড় বয়ে গেছে। তাই সবকিছু মেনে নিতে কিছুটা সময় লাগবে।
পুরনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন সিগারেট শেষ হয়ে হাতে আগুনের ছ্যাঁকা লাগে। মনের খেয়ালে উহহ করে উঠতেই কে যেন হাত থেকে সিগারেট টা নিয়ে ফেলে দিলো। তাকিয়ে দেখে অবনিকা দাঁড়িয়ে আছে।
– আপনি এখানে কেন? ঘুমান নি?
– না আসলে নতুন জায়গা তো তাই কেমন যেন একটু নার্ভাস ফিল করছি। ঘুম আসছে না। আপনিও এখানে এসে বসে আছেন।
– ওহ আচ্ছা। কিছুদিন থাকলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন গিয়ে আপনি শুয়ে পড়ুন।
– আ, আপনিও আসুন না। আমার একা ভয় করে।
– আচ্ছা ঠিক আছে, চলুন।
আয়ান অবনী ছাড়া কাউকে মন থেকে মানতে পারবে না। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে ঘর থেকে বের করে দিতে। কিন্তু ওর জীবনে যা হয়েছে তার জন্য তো এই মেয়েটার কোন দোষ নেই। তাহলে শুধু শুধু মেয়েটার সাথে খারাপ ব্যবহার কেন করবে?? আয়ান নিজেও চায় জীবন টাকে আরেকটা সুযোগ দিতে। ও চায় অবনীর স্মৃতি থেকে বের হতে। তবে ওর জায়গা টা কাউকে দিবে না। মনের মধ্যে কোথাও একটা অবনী থেকেই যাবে। হয়তো এই মেয়েটা স্ত্রী হিসেবে থাকবে। স্বামীর দায়িত্ব গুলোও হয়তো পালন করবে আয়ান। কিন্তু অবনীর ভালোবাসা টা কখনোই কেউ পাবেনা।
আয়ান এসে অবনিকার পাশে শুয়ে পড়লো। তবে দুজনে বিছানার দু প্রান্তে। অবনিকা আয়ান এর সাথে ইচ্ছেমতো বকবক করে যাচ্ছে। আয়ান শুধু হু হা বলে উত্তর দিচ্ছে। মেয়েটা অতিরিক্ত কথা বলে। আয়ান যথেষ্ট বিরক্ত। তবে প্রকাশ করছে না। আয়ান স্বভাবে শান্ত আর চুপচাপ ধরনের ছেলে। সহজে রাগ বা বিরক্তি প্রকাশ করে না। আর অল্পতে চেচামেচি করাও ওর পছন্দ নয়। তাই অবনিকা কে চুপচাপ সহ্য করে যাচ্ছে। তবে অবনিকার সাথে অবনীর অনেক মিল। নামে মিল, কথা বার্তার ধরন, কন্ঠস্বর, আর সবথেকে বেশি মিল চোখদুটো তে। আয়ান একবার তাকিয়ে কেন যেন চোখ সরাতে পারে নি। তাই আর তাকানোর সাহস হয়নি। আয়ান মনে মনে ভাবছে, “আচ্ছা দুটো মানুষের মধ্যে এত মিল থাকতে পারে? কি জানি! হতেও পারে। পৃথিবীতে এত সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে সেখানে এ আর এমন কি বড় ব্যাপার!” তবে একটা অমিল আছে। সেটা হলো অবনী বেশ শান্ত ছিলো। কথা কম বলতো, তবে মুখে সবসময় মুচকি একটা হাসি লেগেই থাকতো। কিন্তু অবনিকা মেয়েটা যথেষ্ট চঞ্চল আর কথা বেশি বলে, এটুকু সময়ে অন্তত এটা বুঝতে পেরেছে আয়ান।
পরদিন সকালে অবনিকা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার সাথে ভাব জমিয়ে ফেললো। মেয়েটা অনেক মিশুক। বিয়ের আনুষঙ্গিক আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে গেলে আয়ান বাবার অফিসে জয়েন করলো। এ কয়েকদিনে অবনিকা ও সবার মন জয় করে নিলো।
বিয়ের এক সপ্তাহ পরে একদিন সকালে অবনিকা রান্নাঘরে রান্না করছিলো। তার শাশুড়ী ও তার সাথে রান্না ঘরে নাস্তা বানাচ্ছিলো। হঠাৎ অবনিকা হাতে চাকু নিয়ে বললো,
– আচ্ছা মা আপনি কি কখনো মানুষের কাঁচা রক্ত খেয়েছেন?
– কি? কি কি বলছো এসব তুমি?
– ও খান নি? আচ্ছা তাহলে এটা বলুন তো কাউকে চাকু দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে মারলে কেমন লাগে?
এবার আয়ান এর মা ভয় পেয়ে গেলেন। অবনিকা আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে শাশুড়ীর মুখের কাছে চাকু টা নিয়ে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। আয়ান এর মা মিরা এইবার আরো ভয় পেয়ে কয়েকবার ঢোক গিললেন। তার চোখমুখের অবস্থা দেখে অবনিকা জোরে হেসে দিলো।
– মা আপনি ভয় পান? আমি তো মজা করছিলাম। আর আপনি সিরিয়াস হয়ে গেলেন?
– এসব কি রকম মজা মা? আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম। আর একটু হলেই প্রান টা বেড়িয়ে যেত।
– কি যে বলেন না মা। আমি সবসময় হরর মুভি দেখি। সেখানে এসব তো খুবই কমন। আর আপনি এটুকুতেই ভয় পেয়ে গেলেন।
বলেই আবার হাসতে লাগলো। মিরা রহমান নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেস্টা করলেও ভয়ের রেশ টা এখনো কমে নি।।
পরদিন রাতে আয়ান বাসায় ফিরলে অবনিকা গিয়ে তার পাশে দাঁড়ায়।
– কিছু বলবেন?
– আচ্ছা আপনি কি অশরীরী বিশ্বাস করেন?
– মানে হলো, ভূত প্রেতে বিশ্বাস করেন আপনি? মানে মৃত্যুর পরে কেউ ফিরে আসে এটা আপনি মানেন?
– হঠাৎ করে এ ধরনের উদ্ভট কথা?
– আহা বলুন না?
– না আমি এসব ফালতু বিষয় একদমই মানি না।
– ও তাহলে তো ঠিক আছে। আপনি তাহলে ভূতে ভয় পান না।
আয়ান আর কথা বাড়ালো না। মেয়েটা মাঝে মাঝে এরকম উদ্ভট কথা বলে। তবে এবার একটু অবাক লাগলো। কারণ ঠিক এভাবেই অবনী একবার জিজ্ঞেস করেছিলো আয়ান কে। তবে অতটা মাথা ঘামালো না। ব্যাপার টা কাকতালীয় হতে পারে। প্রায় সব মেয়েরই ভূত প্রেতে ইন্টারেস্ট থাকে। তাই এই প্রশ্ন করা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
গভীর রাতে হঠাৎ করে আয়ান এর ঘুম ভেঙে যায়। আয়ান অনুভব করলো অবনিকা ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁপছে। আয়ান তাড়াতাড়ি করে লাইট অন করলো। অবনিকা কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দেখলো কপালের সাইডে কিছুটা কেটে গেছে। রক্ত জমাট বেঁধে আছে।
– কি হয়েছে আপনার? মাথা কাটলো কিভাবে?
– বা বা বাথরুমে কেউ আছে।
– মানে? কি বলছেন আপনি? বাথরুমে কে থাকবে?
– জানিনা। হঠাৎ করে নূপুরের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি শব্দ টা অনুসরণ করে হাটতে হাটতে বাথরুমে যেতেই কেউ একজন আমাকে ধাক্কা মেরে বেসিনের ওপর ফেলে দেয়। আমি কাউকে দেখতে পাইনি। দৌড়ে রুমে চলে আসি। আমার খুব ভয় করছে।
– কই দেখি কে আছে।
– না না আপনি যাবেন না। প্লিজ আমাজে একা রেখে যাবেন না, আমার খুব ভয় করছে।
এটা বলেই অবনিকা আয়ান কে জড়িয়ে ধরে। আয়ান কোনমতে নিজেকে ছাড়িয়ে বাথরুমের দরজা খুললো। ফ্লোরের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো! এটা কি??
[চলবে……)
#ভ্রম_নাকি_তুমি!(১ম পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda .