ভ্রম_নাকি_তুমি পর্ব ৫

#ভ্রম_নাকি_তুমি (৫ম পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

অবনীকার এরকম স্বাভাবিক ভাবে থাকা দেখে আয়ান এর অস্বস্তি হচ্ছে কেন যেন। কারণ ওর মনে হয়েছিলো অবনী-ই হয়তো অবনীকা হয়ে এই বাড়িতে এসেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আয়ান এর সন্দেহ যথার্থ নয়। এখন আরো বেশি চিন্তা হচ্ছে আয়ান এর। যদি ও অবনী না হয় তাহলে এসব করার পেছনে ওর কোন হাত থাকার কথা না। তাছাড়া কাল রাতে যখন ও নূপুর এর আওয়াজ পাচ্ছিলো তখন তো অবনীকা ওর কাছেই ছিলো। আর ওর মায়ের সাথে যা হয়েছে তা অবনীকা কি করে করবে? ও তো তখন বাসাতেই ছিলো না। ওরা দুজন তো একসাথে বাসায় ফিরে এসেছে। তার মানে এসব অবনীকা করে নি। কিন্তু যদি ও না করে থাকে তাহলে এসব কে করছে? অবনী কি ফিরে এসেছে? না এসব কি ভাবছি? মৃত্যুর পরে কেউ ফিরে আসতে পারে নাকি? আচ্ছা এমন নয়তো যে অবনী বেঁচে আছে?? না তা কি করে হয়? ওর লাশ সবাই দেখেছে আর কবর ও দিয়েছে। তাহলে কি সত্যিই কোন অশরীরী আছে বাড়িতে??

আয়ান এর মনে কিছুটা ভয় আর দুশ্চিন্তা ঢুকে গেল। তবে অবনীকা কে কিছুই বুঝতে দিলো না। অবনীকা এমনিতেই অনেকটা ভয় পেয়ে আছে।

বাসায় গিয়ে দেখলো আয়ান এর মায়ের জ্ঞান ফিরে এসেছে। আয়ান গিয়ে ওর মায়ের মাথার পাশে বসলো। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই ওর মা চোখ খুলে তাকালেন।

– এখন কেমন আছো মা?

– ভালো আছি।

– আচ্ছা চিন্তা করো না। ডক্টর এর কথামতো ওষুধ গুলো ঠিকমতো খাও। দেখবে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।

আয়ান এর মা শুধু মাথা নাড়লেন। তখনই অবনীকা হাতে এক বাটি স্যুপ নিয়ে রুমে ঢুকলেন। অবনীকা কে দেখে আয়ান এর মা চিৎকার করে উঠলো।

– ওকে যেতে বল। ওকে আমার কাছে আসতে দিস না। ও আমাকে মেরে ফেলবে।

– রিল্যাক্স মা। ও অবনীকা। ভালো করে দেখো ও অবনীকা। ও তোমাকে কেন মেরে ফেলতে চাইবে?

– না না না। ও অবনীকা নয়। ও অবনী। ও আমাকে মেরে ফেলবে। তোদের ও মেরে ফেলবে। ও আমার রিয়ান কেও মেরে ফেলেছে।

– এসব কি বলছো মা? রিয়ান কে কখন মারলো? রিয়ান তো কক্সবাজার গেছে। দুপুরেই চলে আসবে।

– না ও নিজেই বলেছে ও আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আমি ওর হাতে চাকু দেখেছি। চাকুতে রক্ত লাগালো ছিল। ও আমাকেও মারার চেস্টা করেছে। ওকে তুই বাসা থেকে বের করে দে।

– মা তুমি প্লিজ শান্ত হও। ও অবনী নয়। আর অবনী হলেও তোমাকে মারতে চাইবে কেন বলো?

– কারণ আমি ওকে….

এইটুকু বলে থেমে গেলেন। আয়ান আর অবনীকা দুজনেই ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কি বলতে চাইছে মা??

– কারণ আমি ওকে পছন্দ করতাম না। আর ও আমাকে পছন্দ করতো না। তাই ও আত্মা হয়ে ফিরে এসেছে আমাকে মারার জন্য।

– কিসব বলো না মা। আমি নিজ হাতে তোমাকে স্যুপ খাইয়ে দিবো। তারপর ওষুধ খাইয়ে দিবো। তারপর লক্ষি মেয়ের মতো চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়বে। ওকে??

– না না আমি ওর হাতের স্যুপ খাবো না। ও বিষ দিয়েছে স্যুপ এর মধ্যে। আমি খাবো না।

আয়ান হতাশ হলো মায়ের এরকম আচরণ দেখে। এরপর নিজে খানিকটা স্যুপ খেয়ে নিলো মা কে দেখানোর জন্য।

– এই যে দেখো আমি খেয়েছি। আমার কিছু হয়েছে?? হয়নি তো? তাহলে এর মধ্যে কিছুই নেই। এবার তুমি খেয়ে নাও।

আয়ান অনেক জোরাজোরি করে ওর মাকে খাওয়ালো। বাবা দেশের বাহিরে গিয়েছে দশ দিনের জন্য। এদিকে রিয়ান ও বাসায় নেই। তাই সবকিছু আয়ান আর অবনীকা কে সামলাতে হচ্ছে। কিন্তু আয়ান এর মা অবনীকা কে ভয় পাচ্ছে। তাই অবনীকা ও শাশুড়ীর সামনে আসতে পারছে না। তাই মায়ের যত্ন এখন পুরোপুরি ভাবে আয়ান এর নিতে হবে।

অবনীকা নিজের রুমে গিয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরে আয়ান রুমে আসলো।

– অবনীকা?

– হুম।

– স্যরি!

– কেন?

– মায়ের জন্য। বেশ কয়েকদিন ধরে মা তোমার ওপর দোষারোপ করছে। তুমি কিছু মনে করো না। বুঝতেই পারছো তার মনের ভেতর দিয়ে কি যাচ্ছে! কতটা ভয় পেয়ে আছে! তাই এসব উল্টো পাল্টা বলছে। তুমি মায়ের ওপর রাগ করো না। কেমন?

– আরে না না। কি বলছেন আপনি? আমি বুঝতে পারছি। আর মায়ের জন্য আমার ও চিন্তা হচ্ছে। কিন্তু মায়ের এরকম হলো কি করে সেটাই তো বুঝতে পারছি না। বাসায় কেউ ছিলো না। তাই দরজা স্বাভাবিক ভাবে বন্ধ থাকার ই কথা। তাই না?

– হুম।

– তাহলে কেউ ঢুকলে তো সদর দরজা দিয়েই ঢুকবে। আর তার জন্য তাকে দরজা নক করতে হবে। আর সেই দরজা নিশ্চয়ই মা খুলে দিয়েছেন। তাই না?

– হ্যাঁ।

– তাহলে মা তাকে অবশ্যই দেখতে পাবেন। কিন্তু উনি বলছেন এসব আমি করেছি। কিন্তু আমি বাসায় ছিলাম না এটা তো আপনিও জানেন। তাহলে কে ছিলো?

– আমি জানিনা।

– আমি জানি।

– কি জানো? বলো!

– ওটা অবনীর আত্মা ছিল। হয়ত আমার রূপ নিয়ে এসেছে। ও চায়না আমি আপনার সাথে থাকি।

– উফফ আবার সেই কথা!

– তাহলে আর কি?? আর কোন ব্যাখা আছে আপনার কাছে?? বলুন আছে?

– আপাতত নেই। তবে আমি অবশ্যই খুঁজে বের করবো।

– আচ্ছা তাই করুন। এভাবে ভয়ে ভয়ে আর কতদিন বাঁচবো??

আয়ান চুপ করে রইলো। হয়তো কিছু ভাবছে।অবনীকা উঠে নিচে চলে গেল। রান্না করতে হবে। রান্নাঘরে গিয়ে একটা ভাঙা জগ চোখে পড়লো। অবনীকা জগ টা সরিয়ে রাখলো।

দুপুরের দিকে রিয়ান বাসায় আসলো। এসে মায়ের এই অবস্থা দেখে রিয়ান কেঁদে ফেললো।

– এসব কি করে হলো মা??

– অবনী ফিরে এসেছে। ও করেছে এসব।

– মানে? কি বলছো তুমি? এটা কি করে হতে পারে?

– হতে পারে না। এটাই হয়ছে। ও আমাকে বলেছে। ও তো এটাই বলেছিলো যে ও তোকে মেরে ফেলেছে। ও আমাদের কাউকে ছেড়ে দিবে না।

তারপর আতঙ্কিত হয়ে গতরাতের কথা সব খুলে বললো রিয়ান কে। রিয়ান এর মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মায়ের কথা গুলো বিশ্বাস করার মতো না। কিন্তু ফেলে দেয়ার মতো ও না। তবুও মাকে আশ্বস্ত করার জন্য বললো,

– মা এসব তোমার মনের ভুল। তুমি একটু বেশিই চিন্তা করছো তাই তোমার মাথায় অতিরিক্ত প্রেশার পড়ার কারণে এসব হচ্ছে।

– আমিও তো মাকে এসব বোঝাচ্ছি কখন থেকে। কিন্তু সে বুঝতেই চাইছে না।

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কথাগুলো বললো আয়ান। তারপর দুভাই মিলে মাকে সাতপাঁচ বুঝিয়ে দিলো। কিন্তু মিরা রহমান কোনভাবেই মানবেন না। তার এক কথা অবনীকা কে বাসা থেকে বের করে দিতে হবে।

কিছুক্ষণ পরে অবনীকা আয়ান কে ডেকে ওর শাশুড়ীর জন্য খাবার পাঠিয়ে দিয়ে গোসল করতে চলে গেল। অবনীকা গোসল করছে হঠাৎ মনে হলো ওর বাথরুমের ভেন্টিলেটর থেকে একজোড়া চোখ ওকে পর্যবেক্ষণ করছে। অবনীকা ভেন্টিলেটরে হাত দিয়ে দেখলো। নাহ কিছু নেই তো। তবুও কেমন যেন গা শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে। কোনমতে গোসল শেষ করে তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলো। বের হয়ে টেবিলে খাবার দিলো। আয়ান আর রিয়ান গোসল সেরে এসে তিনজনে একসাথে খেয়ে নিলো। বাথরুম এর ব্যাপার টা অবনীকা আয়ান কে বলেনি।

বিকেলে আয়ান একটু বের হলো। ফিরতে নাকি লেট হবে এটা বলে গেলো। সন্ধ্যার বেশ কিছুক্ষণ পরে রিয়ান এক কাপ কফি চাইলো অবনীকার কাছে। অবনীকা প্রায় সাথে সাথেক কফি নিয়ে গেল। রিয়ান কিছুটা অবাক হলো যে এত কম সময়ে কিভাবে দিলো? হয়তো নিজে খাওয়ার জন্য বানিয়েছে তাই এত তাড়াতাড়ি দিতে পেরেছে। ব্যাপার টা নিয়ে ততটা মাথা ঘামালো না। অবনীকা কফি দিয়ে আসার সময় হঠাৎ করে রিয়ান এর মনে হলো কেউ যেন নূপুর পায়ে দিয়ে খুব জোরে দৌঁড়ে গেল। রিয়ান কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখল অবনীকা ওর দিকে ঘুরে তাকিয়েছে। অবনীকার মুখের দিকে তাকাতেই রিয়ান যেন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছে। অবনীকার চোখ দুটো শ্বেত বর্ণের হয়ে আছে। চোখে কোন মণি নেই। মাথার একপাশ থেকে রক্ত বেয়ে বেয়ে পড়ছে। চুলগুলো মনে হচ্ছে উড়ন্ত সাপ। এখনই যেন ছোবল মারবে সামনে থাকা রিয়ানকে। অবনীকার কানফাটা হাসির আওয়াজে রিয়ান ভয়ে জমে গেল।

অবনীকা একটা চাকু নিয়ে আস্তে আস্তে রিয়ান এর দিকে এগিয়ে গেলো। রিয়ান বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে। দৌঁড় দেয়ার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। আচমকা ই অবনীকা রিয়ান এর চোখের মধ্যে চাকু ঢুকিয়ে দিলো। রিয়ান চোখে হাত দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো। ওর যন্ত্রণা দেখে অবনীকা আবার ও হেসে উঠলো ভয়ংকর ভাবে।

– কে তুমি? কেন করছো এসব? কি চাও তুমি??

– আমাকে চিনতে পারছো না? আমি অবনী। যাকে তুমি ভেন্টিলেটর দিয়ে গোসল করার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে। এত তাড়াতাড়ি সব ভুলে গেলে??

– এসব কি বলছো তুমি? । আমি এমন কিছুই করিনি। আর না তো তুমি অবনী।।অবনী কখনোই ফিরে আসতে পারে না। ও মরে গেছে।

– উহু। আমি অবনী। ভালো করে দেখো না আমায়, দেখো। আগে যেমন দেখতে সেভাবে দেখো। আরে শয়তান, চোখ দিয়ে মানুষ সুন্দর দৃশ্য দেখে। কিন্তু সেই চোখ যখন তার দৃষ্টি সংযত করতে না পারে, যখন সেই চোখ মানুষ এর মনুষ্যত্ব নষ্ট করে দেয়, অন্যের জীবন নষ্ট করে দেয়, তখন সেই চোখ থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। তোর পৃথিবী দেখার কোন অধিকার নেই।

অন্য চোখেও চাকু ঢুকিয়ে দিলো অবনীকা। রিয়ান ছটফট করতে করতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারালো। পুরো মেঝে লাল রক্তে রক্তাক্ত হয়ে গেল।

আয়ান অবনীকার ফোন পেয়ে এক প্রকার দৌড়ে বাসায় গেল। বাসায় গিয়ে রিয়ান এর এই অবস্থা দেখে চমকে উঠলো। কি হচ্ছে এসব তার পরিবারে? এক মূহুর্ত দেরী না করে রিয়ান কে হস্পিটালে নিয়ে গেল। অবনীকা ও সাথে গেলো। ডক্টররা রিয়ান কে ওটিতে নিয়ে গেলো। অপারেশন করাতে হবে ইমার্জেন্সি।

– এসব কি করে হলো অবনীকা? তুমি তো বাসায় ছিলে! তাহলে এসব…

আয়ান এর চোখে পানি টলমল করতে দেখে অবনীকা চোখ নামিয়ে ফেললো। ওর কেন যেন আয়ান এর চোখের পানি সহ্য হচ্ছেনা।

– আমি জানিনা এসব কি করে হলো। রিয়ান আমার কাছে কফি চেয়েছিলো। আমি রান্নাঘরে গিয়ে কফি বানিয়ে নিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি এই অবস্থা। রিয়ান মেঝেতে পড়ে আছে আর মেঝে রক্তে ভিজে আছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। তখনই আপনাকে ফোন করি।

– আমি বুঝতে পারছি না আমি কার কি করেছি। কেন সবসময় আমার প্রিয় মানুষ গুলোই কষ্ট পায়?

আয়ান কাঁদছে। অবনীকা কি করবে বুঝতে পারছে না। আয়ান কে কাঁদতে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে। আয়ান এর চোখের পানি মুছে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অবনীকার কেমন যেন শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে এভাবেই থাকতে পারতো।

কিছুক্ষণ পরে ডক্টর এসে জানালো…

(চলবে……)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here