#ভ্রান্তির_অগোচরে
লেখা আশিকা জামান
পার্ট ১৭
মিম নিজেকে নিজের মতো করে বুঝাতে লাগলো কিন্তু শান্ত বোধ হয় হতে আর পারলোনা। অশান্ত মন পাগলা ঘোড়ার ন্যায় দুর্নিবার ছুটে চলার প্রয়াস খুঁজতে লাগলো।
” নিয়াজ কে? যার তার কথায় ওর মন কেন খারাপ করতে হবে? পাগলের কথায় কেন কান দিতে হবে?”
হৃদয়ের বদ্ধমূলে এই কথাটা ঢুকিয়ে দিয়েও ও শান্তি পাচ্ছেনা। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে রেলিংটা আরো শক্ত করে এমনভাবে ধরে যেন মুহুর্তেই পড়ে যাবে।
চোখ দুটো স্বাভাবিকের থেকে আরো বড় হতে থাকে শুধু একটি কথাই বারবার মনে হয়ে।
” নিয়াজ এখন যে কথাটা বললো সেটাতো ওর একার কথানা। অন্য ফ্ল্যাটের তথা গোটা পাড়ার লোকেরাতো ওর প্রতি এই ধারণাই পেষন করে।
ও হেরে গেছে? প্রবলভাবে হেরে গেছে। চেয়েছিল সন্তানকে একটা সুস্থ্য পরিবেশ দান করতে। চাইলেই কি সব পাওয়া যায়? যায়নাতো! সমাজতো আর ওর মুখের কথা বিশ্বাস করবেনা। তাদেরতো প্রমাণ চাই! চাক্ষুষ প্রমাণ চাই।
সন্তানের অনাগত ভবিষ্যৎ ভাবতে গিয়ে চারপাশটা বড্ড ঘোলাটে লাগছে। মুহুর্তেই পুরো পৃথিবী জুড়ে বিরাজমান দিব্য আলো ওর চোখে অন্ধকার হয়ে ধরা দিল।
নিয়াজ আর নীলিমা আন্টি দুতলায় চলে গেলেও মিমের বোধ হয় সিড়ির এক ধাপ উপড়ে উঠা আর সম্ভব হবেনা। মুহুর্তের মাঝেই অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে লাগল মিম।
মিমের ঠিক পাশের ফ্ল্যাটের নতুন ভাড়াটিয়া তিতিলি নামের মেয়েটা কি এক কাজে যেন বাইরে বেরিয়েছিল। আপনমনে গুনগুন করতে করতে দুতলার সিড়ি পাড় হয়ে, যেই তিনতলার প্রথম সিড়ীতে পা রাখতে যাবে ঠিক তখনি চোখের সামনে মিমকে গড়িয়ে নিচে পড়তে দেখে। দ্রুত পা চালিয়ে তিতলি মিমকে ধরে ফেলে। কিন্তু ততক্ষণে মিম সেন্সলেস অবস্থায় ওর শরীরের ভার সম্পূর্ন তিতলির উপড়ে দিয়ে দেয়।
তিতলি মিমকে নিয়ে সিড়ির উপড়েই বহুকষ্টে
বসে পড়ে। ভয় পাওয়া দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে নীলিমা আন্টিকে উচ্চ্বস্বরে ডাকতে থাকে।
নীলিমার পিছু পিছু নিয়াজ ও বেরিয়ে আসে। বিস্ফোরিত চোখে নীলিমা হিতাহিত বোধ শুন্য হয়ে মিমকে ধরে কাধের উপর শোয়ায়। চোখে মুখে পানি দিয়েও যখন মিমের সেন্স আসছিলোনা তখন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন নীলিমা।
• নিয়াজ এতক্ষণ হতবিহবল হয়ে মুখে রা কাটার বাকশক্তিটুকু হারিয়ে ফেলে। কিন্তু মায়ের কান্না ওর ধৈর্য্যের বাধণ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে যায়। এই প্রথমবার মিমের চেহারার দিকে তাকিয়ে এক অকারণ মায়ার উদ্রেক হতে লাগলো।
রিদিতা চলে যাওয়ার সাথে মায়া, মমতা, নম্রতা, সহানুভূতি সমস্ত মানবিক গুলগুলোকেও কেড়ে নিয়ে গেছে ওর থেকে। পৃথিবীর সমস্ত মেয়েদের একি রকম হৃদয়হীন, ছলনাময়ী মনে হলেও, এই মুহুর্তে মিমের প্রতি অকারণ
• মায়া কাজ করছে। ঠিক একটু আগে যে কাজটা ও করেছে তার জন্য চরম অনুতপ্ত অনুভব করল।
ফোনের কন্টাকস লিস্ট থেকে অ্যাম্বুল্যান্স ডাকার জন্য নম্বর বের করলো নিয়াজ। ফোনটা কানে দিয়ে এদিক সেদিক পায়চারী করতে করতে অ্যাএম্বুলেন্স বাড়ীর সামনে এসে দাড়ায়।
নিয়াজ যেন হালে পানি পেল। সত্যি বলতে টেনশনে ওর হাত পা কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে।
” মা উনাকে নিয়া গাড়ীতে উঠ। ইমিডিয়েট হস্পিটালাইজড করা দরকার।”
গলাটা খাদে নামিয়ে কথাটা বলল নিয়াজ।
” গরু মেরে জুতা দান করতে এসেছিস। মেয়েটার ভালমন্দ কিছু হয়ে গেলে তোকে আমি ছাড়বোনা মনে রাখিস।” কাঁদতে কাঁদতে কথাটা বলল নীলিমা।
” মা প্লিজ, আগে গাড়িতে উঠ। তারপর যা শাস্তি দেওয়ার দিও। উনার কন্ডিশন খুব একটা ভালো নয়।”
——————————————————————
শুভ্র সুন্দর সকাল আর শিশির ভেজা নরম ঘাসে লনের উপর খালি পায়ে হাটতে সবুজের বেশ ভালো লাগে। বুকপকেটে মিমের সেই অনাবিল কৈশোরের একটা ছবি! আপাতত এইটাই ওর শেষ সম্বল। এই ছবিটা সবসময় ওর ওয়ালেটে থাকতো এখন এটা বুকপকেটে স্থান পেয়েছে। মিম হয়তোবা জানেনা বা কোনদিন জানার চেষ্টাও করবেনা ও ঠিক কতোটা ভালোবাসে। হয়তোবা জোড় করে পারতো মিমকে আটকে রাখতে কিন্তু কি দরকার যে পাখির মুক্ত আকাশে বিচরণ করতেই ভুমিষ্ঠ হয়েছে তাকে কি জোড় করে আটকে রাখাটা মানায়।
“তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই, যেখানে থেকো ভালো থেকো।”
চিৎ কার করে কথাটা বললো সবুজ। সামনের পাহাড় এ কথাটা প্রতিধ্বনিত হয়ে বারবার ওর কানে বাজতে লাগলো। দু চোখের জল যখন গাল বেয়ে পড়তে লাগলো ঠিক তখনি বা হাতের উলটা পিঠে বারবার জল মুছতে লাগলো।
হঠাৎ ই কারো ডাকে সবুজের সম্বতি ফিরে।
” ওহ, মাই গড, তুমি এই ভুতের পাহাড়ে।
আমি কালকে থেকে তোমাকে খুঁজতেছি । আর তুমি এখানে?”
বেশ বিরক্তি নিয়ে নায়রা কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে দিলো। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও যেন হাপাচ্ছে।
সবুজ কোন উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করলো।
” তোমার কাছে কোন ওয়াটার বোটল হবে। বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।”
নায়রা আবার বলল।
” না নেই। তুমি এখানে কেন?”
বেশ ধমকের সুরেই কথাটা বললো সবুজ।
” না মানে, পুনাক বললো তোমাকে নাকি কাল রাত থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। তাই সবাই মিলেই তোমাকে খুজছিলাম।”
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে নায়রা কথাটা বললো।
” আমি কি বাচ্চা ছেলে যে আমাকে এইভাবে খুঁজতে হবে? আমি ঠিক আছি যাও এখান থেকে প্লিজ।”
উচ্চ্বস্বরে কথাটা বলে থেমে গেলো সবুজ ।
” আমিতো এখন যাবোনা সবুজ। তোমরার কান ধরে বিডিতে নিয়ে গিয়ে যেভাবেই হোক বিয়েটাতো করবোই। আর এখনতো তোমার বউ ও নেই। এটাইতো পার্ফেক্ট সময়। লিসেন, নায়রা সবসময় মোক্ষম সময়েই গোলটা দেয়।”
নিজের মনে নিজেই কিছুক্ষণ হেসে নেয়।
নায়রা সবুজের পিঠে হাত রাখে। সবুজ বেশ বিরক্তি নিয়ে নায়রার দিকে তাকায়।
অবশ্য নায়রার তাতে যায় আসেনা।
” সবুজ চলো বিডিতে যাই। ইনফ্যাক্ট তোমার যাওয়াটা জরুরি। দেখো যার থেকে পালিয়ে বেড়াতে তুমি ঠিক এতোটা দূরে এসেছো, পেরেছো কি ভুলতে তাকে? পারোনি!
দেখো মিম যদি নিজের জীবন নতুন করে সাজাতে পারে তবে তুমি কেন পারবেনা। কোন এক ইস্যুকে কেন্দ্র করে জীবনটাকে মাঝপথে থামিয়ে দিওনা।
তার থেকে বড় কথা তোমার বাবা-মায়ের তোমাকে খুব দরকার। উনাদের কথাটা অন্তত ভাবো।”.
” যাও এখান থেকে প্লিজ। আমাকে একা থাকতে দাও। এইগুলা বন্ধ করো আমি শুনতে চাইনা। আমার ভালো আমি বুঝে নিব। তোমাকে ভাবতে হবেনা।”
নায়রা আরো কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু সবুজই ওখান থেকে চট করে উঠে আসে।
” যাও যাও নো প্রবলেম। যেভাবেই হোক তোমাকেতো আমি বিডিতে নিয়ে যাচ্ছিই। পালিয়ে আর কতদিন থাকবে চান্দু। বেচারা বউ এর শোকে মাতাল!”
ফিচেল হাসলো নায়রা।
চলবে।।