#ভ্রান্তির_অগোচরে
লেখা আশিকা জামান
পার্ট ০৭
সন্ধ্যে থেকেই উথাল পাথাল দমকা হাওয়ায় পরিবেশ ধুলোর স্তুপে পরিণত হয়ে গেলো।। মাঝেমাঝে আবার দু একটা করে মেহগনি গাছের পাতা পড়ে পড়ে ব্যালকনি সয়লাব। দু একটা পাতা আবার মিমের উড়ন্ত রুক্ষ্ণ চুলের উপড়েও পড়তে লাগলো। চোখেমুখে ধুলো আর বাতাসের তান্ডবে পুরো শরীর শুষ্ক থেকে শুষ্কতর হতে লাগলো।
” মিম, এইরকম ধুলো, বাতাসে দাড়িয়ে করছিস টা কি?
আরে চোখে মুখে যাবেতো।”
মেঘ হিড়হিড় করে টানতে টানতে মিমকে রুমের ভিতরে নিয়াসলো।
মিমের চোখেমুখে উৎকন্ঠার ছাঁপ স্পষ্ট।
” আচ্ছা ও এখন কেমন আছে?”
মিমের করা প্রশ্নটা মেঘ প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে ঠিকি বুঝতে পারে।
” হ্যা ভালোইতো দেখলাম। এখন একা একা একটু হাটা-চলা করতে পারে। খালাকে দেখলাম স্যুপ এর বাটি নিয়ে যেতে।
কালকে মনে হয় মাথার ব্যান্ডেজটা খুলতে যাবে।”
মিম ওড়না ঠিক করতে করতে বিছানার এক পাশে গিয়ে বসে।
মেঘ কিছুক্ষণ নিজের মনেই কিছু একটা ভেবে নিয়ে বিছানার এক কোণায় বসে পড়ে।
” মিম, এখন যে প্রশ্নটা করবো তার ঠিক ঠিক উত্তর দিবি?”
ওর গলাটা কেমন যেন অস্বাভাবিক শোনা গেল।
” সেটা প্রশ্নের ধরণের উপর ডিপেন্ড করবে। ভণিতা না করে বলে ফেলো। আমার জীবনে এতো রাখ ঢাকের কিছু নেই। সবটা সবারই জানা”
” নিজেকে নিজের মধ্যে এইভাবে গুটিয়ে নিয়েছিস কেন?
ভাইয়ার এইরকম একটা ক্রিটিক্যাল মুহূর্তে তুই ওর পাশে না গিয়ে নিজের রুমে কেন? হুয়াই মিম?”
মিম কোন উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করলোনা। কি উত্তর দেবে ও?
ওতো নিজেই জানে, ও কতোটা অপয়া, অলক্ষী। এতো বড় একটা ইনজিউর হওয়ার পরো, সবুজ যে সুস্থ অবস্থায় আছে এইটাই ওর জন্য অনেক কিছু। তাছাড়া ওতো মাকে কথা দিয়েছে সবুজ সুস্থ না হওয়া অব্দি ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করবেনা। এইগুলা কি আর সবাইকে বলা যায়। অন্তত মিম পক্ষে সম্ভবপর নয়।
মিমের এই নির্লিপ্ততায় সবুজের মনে বিষাদের ছায়া ঘনীভূত হতে লাগলো।
“তোদের এইসব বিয়ে বিয়ে নাটক আমার একদম ভালো লাগছেনা। এটা আর কতোদিন কন্টিনিউ করবি শুনি। আরে বেরিয়ে আয়, এইরকম মিনিংলেস রিলেশন থেকে? তুই আরো বেটার কাউকে ডিজার্ভ করিস, একটু বোঝ?”
মেঘ উত্তেজিত হয়ে ষাড়ের মতো চিল্লিয়ে কথাটা বললো।
মেঘ কোন কিছু বোঝার আগেই মিম ঠাস করে ওর গালে চড় বসায়।
ঘটনার আকস্মিকতায় মেঘ বাকশুন্য হয়ে মিমের চোখের দিকে তাকায়।
” সেট আপ, জাস্ট সেট আপ। তোমার সাহস কি করে হয় আমাদের সম্পর্কটাকে মিনিংলেস বলার? আরে আমরা হাজব্যান্ড ওয়াইফ। আর সব থেকে বড় কথা আমি সবুজকে ভালবাসি আর ওকে নিয়েই বাকী জীবন কাটাতে চাই। আশা করি অন্য কোন অপশনের দরকার পড়বেনা। আর সবুজই আমার জন্য পার্ফেক্ট। তোমাকে এতকিছু ভাবতে কে বলেছে। আমার চোখের সামনে থেকে যাও বলছি।”
মেঘ হাত মুষ্ঠি পাকিয়ে তারপর নিজেকে কোনরকম শান্ত করে ফুঁসতে ফুঁসতে রুমের বাইরে চলে আসে। মিমের করা অপমান ওর ভেতরটা ওলটপালট করে দিতে লাগলো।
ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে নিজের বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়লো।
——————————————————–
” আচ্ছা আম্মু, মিম কোথায়? মানে ওর কি শরীর খারাপ?
আসলে বাসায় আসার পর থেকে ওকে একবারের জন্যেও দেখতে পাচ্ছিনা।”
সবুজ কোনরকম ভণিতা ছাড়াই সরাসরি কথাটা বললো।
শিউলি ছেলের কথা শুনে প্রথমে কিছুটা আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়েপ্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই আবার ছেলের মলিন মুখপানে তাকায়,
” কেন এই যে, রাতের বেলা আমি তোমার সাথে থাকছি। সেবা করছি এটা তোমার ভালো লাগছে না।
সবাই হয়তোবা ঠিকি বলে? ”
” সবাই কি বলে?”
উদ্বিগ্ন হয়ে সবুজ প্রশ্নটা করে বসে।
” ওসব তোর শুনে কাজ নেই।
নে হা কর, তাড়াতাড়ি করে খেয়ে নে বাবা। না খেলে কি শরীর ঠিক থাকবে। কতোট ব্লাড বের হয়ে গেছে কোন খবর আছে।”
” আগে বলো? নইলে আমি খাবো না । কথাটা ক্লিয়ার করো?”
সবুজের জেদের কাছে শিউলি বরাবরের মতো এইবারও হার মেনে নিবে। অবশ্য
ছেলের কাছে হার মানা দোষের কিছু না।
” ওইযে বিয়েরপর মা পর হয়ে যায়। বউই সব তাইতো।”
সবুজের চরম বিরক্ত লাগতে লাগলো। মিমের বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞাস করার ইচ্ছেটাই মরে গেছে। ও ভেবে পায়না ওর ওয়েল এডুকেটেড, শিক্ষিত মা কি করে এইরকম টিপিক্যাল মায়েদের মতো বিহেভ করতে পারে। মায়ের আচার আচরণে যে অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে তা সবুজের চোখ এড়ায় না। এই মুহুর্তে ওর কাউকেই সহ্য হচ্ছে না। একা থাকতে পারলে বোধ হয় সব থেকে বেটার হতো।
” আম্মু আমার খুব ঘুমঘুম পাচ্ছে। তুমি এখন একটু যাও।”
কথাটা বলেই সবুজ ধপাশ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
” দেখ ছেলের কান্ড! এইবার খাবেটা কে? খাওয়ার মাঝখানে এইভাবে কেউ শুয়ে পড়ে। আরে বাবা উঠ! বাকীটা শেষ কর।”
সবুজ শোনেও না শোনার ভাণ করে শুয়ে থাকলো।
ছেলের উপর বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে গেল শিউলি।
অন্ধকার হাতড়ে সুইচটা অন করলো মিম। মুহুর্তেই পুরো ঘর আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো।
“এইরকম ঘুটঘুটে অন্ধকারে বসে আছো কেন? রুমে আলো জ্বালাও নাই কেন?”
মেঘ সিগেরেটটা এশ্ ট্রে নিভিয়ে মিমের দিকে তাকায়। ছিপছিপে দোহারা গঠন, তীর্যক নাক, আর পাতলা কমলার কোয়ার মত ঠোট যুগল মেঘকে বরাবরের মতোই আকর্ষিত করতো। আচ্ছা সামনে দাঁড়ান মানবীটি কি জানে, তার কথা ভেবে ভেবে
কত সহস্র স্বপ্নের জাল বুনে নির্ঘুম রাত কেটেছে।
অবশ্য জানার কথাও না। সেতো এখন অন্য কারো ওয়াইফ। তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে শুধু সবুজ আর সবুজ। মেঘ আবার সিগেরেট হাতে তুলে নেয়। বিয়ের কথা শুনে ও যতোটা না আহত হয়েছে তার থেকে বেশী আহত হয়েছে ওর মুখে ভালোবাসি কথাটা শুনে। মিম সবুজকে ভালোবাসে!
ঘরের চার দেয়াল একদম ওর মুখের দিকে ঝুঁকে এসে শুধু এই কথার সত্যতাই জানান দিচ্ছে। ” মিম সবুজকে ভালোবাসে তোকে নয়।”
মেঘ সিগেরেটটা হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে সজোরে ছুড়ে মারে।
” মেঘ ভাইয়া, আ’ম সরি। তুমি আমার উপর অনেক রেগে আছো আমি জানি। আসলে আমি তোমার সাথে ওরকম বিহেভ করতে চাইনি। আসলে আমি মাত্রাতিরিক্ত মানসিক টানাপোড়ন এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। হুট করে তোমার এইসব স্বাভাবিক প্রশ্ন আমি সহজভাবে নিতে পারিনি। তাই রিএক্ট করে ফেলেছিলাম। হয়তোবা তুমি তোমার যায়গা থেকে ঠিক। আমারই ভুল হয়েছে। প্লিজ এইবারের মতো আমাকে মাফ করে দাও।”
মিম এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে মেঘের দিকে তাকায়।
মেঘ হু হা কোন শব্দই করলোনা।
” কিছুতো বলো? কি হলো। তুমি কথা না বললে আমি বুঝে নিবো তুমি আমার বিহেভিয়ার এ খুবই কষ্ট পেয়েছো। জানি সরি বললেই সব সমস্যা মিটে যাবে না। তবুও আমি লজ্জিত। আর একবার সরি।”
” আমি রেগে নেই।”
হুট করে কথাটা বলেই মেঘ দাঁড়িয়ে পড়লো।
” সত্যি বলছো? তুমি রেগে নেই।”
“না। একবার বলেছিতো।”
” আচ্ছা আমি বিশ্বাস করবো, যদি তুমি আমাকে সাহায্য করো।”
” আমারতো তোক দেওয়ার মতো কিছু নেই। আচ্ছা বেশ যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।”
মিম অতিউৎসাহে মেঘের হাত ধরে।
” সত্যি সাহায্য করবে? আমি জানতাম তুমিই পারো আমার আর সবুজের সম্পর্কটা ঠিক করে দিতে। আমি তোমাকে সব বলবো।”
মেঘ ঈষৎ বিদ্যুৎপৃষ্ঠ ন্যায় চমকাতে লাগলো। ও ঠিক করে দিবে মিম আর সবুজের সম্পর্ক!
ওর সাথেই কি এটা হওয়ার ছিলো? মিমের দিকে আবার তাকায় মেঘ। মেয়েটার চোখেমুখে উচ্ছ্বাস যেন ফেটে পড়ছে। চোখেমুখে শুধু সবুজের ভালোবাসাই যেন ঝরে ঝরে পড়ছে।
নিজের রাগ, ক্ষোভ দূরে সরিয়ে মেঘ মিমের কথাই
শুনতে লাগলো।
চলবে…