ভয়ংকর প্রণয় পর্ব ১৭

#ভয়ংকর_প্রণয়
Part_17
লেখনীতে_#Nusrat_Hossain

আমি এত ভণিতা করে কথা বলতে পছন্দ করিনা তাই সরাসরি বলছি ,

আই এম ইন লাভ উইথ ইউ ।ভালোবাসি তোমাকে ।স্পর্শ কথাটা বলে থামল ।সে নাফিয়ার মুখপানে তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায় ।

নাফিয়া বুজতে পেরেছিল স্পর্শ তাকে ভালোবাসে কিন্তু স্পর্শ এভাবে সরাসরি প্রপোজ করাতে নাফিয়া ঘাবড়ে গেছে ।চারদিক এত বাতাস হওয়া সত্ত্বেও নাফিয়ার কপালে চিকন ঘামের রেখা ।আর এদিকে স্পর্শ ওর উত্তরের আশায় নাফিয়ার মুখপানে এখোনো তাকিয়ে আছে ।দেখা যায় অনেকটা সময় পার হবার পর-ও নাফিয়া কিছুই বলছেনা ।

নাফিয়ার দৃষ্টি অদূরে থাকা একজোড়া কপোত কপোতীর দিকে যারা একে অপরকে মজা করে সমুদ্রের পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে ।

নাফিয়াকে চুপ থাকতে দেখে স্পর্শ এবার মুখ খুলল ।সে শান্তস্বরে ডাকল

নাফিয়া….

নাফিয়া সেই কপোত কপোতীর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চমকে স্পর্শের দিকে তাকাল ।এই ফার্স্ট টাইম স্পর্শ তার নাম ডাকল ।কেন যেন স্পর্শের গলায় নামটা খুব মিষ্টি শোনাল নাফিয়ার কাছে । প্রথমবার শুনছে বলেই হয়ত।

স্পর্শ আলতো করে নাফিয়ার হাতদুটো নিজের হাতজোড়ার মাঝে আবদ্ধ করে বলল,

নাফিয়া ভালোবাসি তোমায় ।ঠিক কতটুকু ভালোবাসি তা জানিনা ! তবে সত্যি-ই তুমি অজান্তেই আমার মনে অনেকটা জায়গা করে নিয়েছো ।যদি এটা আমার ভালো লাগাই হয় তাহলে দিনরাত তোমায় নিয়ে কেন এত ভাবি বলতে পারো আমায় ?

নাফিয়া নতজানু হয়ে স্পর্শের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতজোড়া ছাড়াতে চাইল কিন্তু পারলনা ।স্পর্শ আরো শক্ত করে তার হাতজোড়া ধরে বলল

উহ একটুও নড়াচড়া করবেনা ।যে পর্যন্ত না তুমি কিছু না বলবে ঐ পর্যন্ত কোত্থাও যেতে পারবেনা আমি যেতে দিব না ।একটা কিছু তো তোমাকে বলতেই হবে ।নাফিয়ার এমন মৌনতায় স্পর্শের খুব রাগ হচ্ছে ।তারপর-ও নিজেকে সামলে নিচ্ছে ।এই মুহূর্তে যেভাবেই হোক মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে ।নাহলে তার প্রানপাখিটাকে যে হারাতে হবে সেটা সে সইবে কিভাবে ?
প্রেয়সীর এমন মৌনতায় সে যে বড্ড ধৈর্যহারা হয়ে পরছে ।

স্পর্শের চেহারায় রাগ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নাফিয়া ।মনে হচ্ছে অনেক কষ্টে নিজের রাগটাকে সামলাচ্ছে স্পর্শ ।স্পর্শ এবার ধৈর্যহারা হয়ে বলল , তুমি কি তোমার ফ্যামিলিকে ভয় পাচ্ছ ? দরকার হলে আমি তোমাদের বাড়ি গিয়ে তাদের সাথে কথা বলব ।কক্সবাজার থেকে ফিরেই তোমাদের বাড়ি যাব বিয়ের প্রস্তাব দিতে ।

নাফিয়ার চেহারায় মুহূর্তেই আতংক ছেয়ে গেল ।সে মৃদু চিৎকার দিয়ে বলল ,

খবরদার না !আমি আমার অনিশ্চিত জীবনে আপনাকে জড়াতে চাইনা।আমি ইচ্ছা করলে এক্ষুণি পারতাম আপনার প্রপোজে রাজি হতে ।এমনকি আমার জায়গায় অন্য কেউ হলেও আপনার প্রপোজে মুহূর্তেই রাজি হয়ে যেত আমি নিশ্চিত ।কিন্তু আমি !আমার ভেতর থেকে কেউ আমায় বারবার সাবধান করে বলছে , রাজি হোস না নাফিয়া ।তোর অনিশ্চিত জীবনে কাউকে জড়াসনা ।নাফিয়া একদমে কথাগুলো বলল ।

স্পর্শ ভ্রুকুটি করে বলল, অনিশ্চিত জীবন মানে ?ক্লিয়ার করে বল ।

নাফিয়া শান্তস্বরে বলা শুরু করল , প্রেম ভালোবাসা আমাদের বাড়ির মেয়েদের জন্য নিষিদ্ধ ।এমনকি কোনো ছেলের সাথে কথা বলা তো দূরের কথা তাদের ছায়া মাড়ালেও আমাদের কপালে শনি এনে দেয় আমার বাবা , চাচারা। আমরা বাড়ির মেয়েরা হাঁসতে পারবনা , কারো সাথে কথা বলতে পারবনা , কোনো বিয়েতে যেতে পারবনা ,এমনকি নিজের আপনজনের বিয়েতেও থাকতে পারবনা ,বান্ধবীদের সাথে কথা বলতে পারবনা ।এক কথায় সবকিছুতেই বাধা আমাদের ।এমনকি আমাদের পড়াশোনাও এইচ এস সি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ । যাতে আমাদের বরপক্ষ বলতে না পারে মেয়ে মূর্খ । বলতে গেলে আমাদের বাড়ির বৌ মেয়েরা সবাই বাড়ির পুরুষদের খাঁচায় বন্দি ।কিন্তু লাইফে এত এত বাধা থাকা সত্ত্বেও আমার মেঝ বোন মাহনূর এক ভয়ংকর ভুল করে ফেলল চার বছর আগে।

স্পর্শ নির্বাক দৃষ্টি নিয়ে নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে ।সে জিজ্ঞেস করল ,

কি ভুল ?

নাফিয়া নিচের ঠোট টা ভিজিয়ে নিয়ে আবারো বলতে শুরু করল ,
ভয়ংকর প্রণয়ে জড়িয়ে গেল ও । চাচা , বাবাদের এত নজরবন্দি থাকা সত্ত্বেও কিভাবে যে ও কারো প্রেমে পরে গেল এটা বাড়ির কারো-ই বোধগম্য হয়নি আজ পর্যন্ত ।আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়তাম ।বুজতে পারতাম কিছু কিছু আপুর ভাবসাব দেখে আপু যে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করত ।সারাক্ষণ আপুর ঠোটে লেপ্টে থাকা মুচকি হাঁসিটাই বলে দিত আপু যে ভয়ংকর প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েছে ।সম্ভবত মাহিব ছিল ছেলেটার নাম ।তবে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করলেও আপুর শেষ রক্ষা হলনা ।ধরা পড়ে গেল বাবা , চাচাদের হাতে ।শেকল দিয়ে হাত পা বেধে ঘরবন্দি করে রাখল আপুকে ।ইচ্ছামত মারত বাবা আপুকে , দিনরাত না খায়িয়ে রাখত ।যত রকমের কষ্ট আছে সব কষ্ট তারা আপুকে দিত ।বাবা প্রতিটা মুহূর্তে শাস্তি দিয়ে আপুকে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়াত তার বিরুদ্ধে যাওয়ার শাস্তি ঠিক কি ?নাফিয়ার গলা কাঁপছে ।
নাফিয়া কিছুক্ষণ থেমে ধরা গলায় আবার বলতে শুরু করল ,

রুহ কেঁপে উঠত সবার ।তবে আপুর প্রণয় মাহিব নামের ছেলেটার প্রতি ছিটেফোঁটাও কমলনা বরং এত অত্যাচারের মাঝেও আপুর ভালোবাসা মাহিব নামের ছেলেটার প্রতি দিনকে দিন বাড়তে থাকল ।যেন আপু জেদ ধরে বসেছিল ও মরে যাবে তারপর-ও ভালোবাসার মানুষটাকে ছাড়বেনা ।একবার রাতে আপু বাড়ি থেকে পালিয়ে পর্যন্ত গিয়েছিল সেই ছেলেটার কাছে ।কে যেন বাবার অগোচরে আপুর হাত পা-এর শেকল খুলে দিয়েছিল ।হয়ত মা হবে ! তবে আমার বাবা চাচারা ঠিক খুঁজে বের করে ফেলল আপুকে ।ছেলেটাকে কি করেছিল জানি না তবে আপুকে আবার ঘরবন্দি করে ফেলল । আবার শুরু হল অমানুষিক অত্যাচার ।তার কয়েকদিন পর আবার আপু বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল কারো সাহায্য পেয়ে।দ্বিতীয়বার পালিয়ে গিয়েও আপুর আর শেষ রক্ষা হলনা ।আজম
খাঁন ঠিক খুঁজে বের করে ফেলল আপুকে ।শোনা গেল আপু এবার তার বান্ধবীর বাড়িতে উঠেছিল ।এবার আপুকে খুঁজে পেয়ে যেন আজম খাঁনের শরীরে ভয়ংকর এক দানব ভর করল ।দানব ওত পেতে রইল আপুকে শেষ করার জন্য ।আজম খাঁন আপুকে হত্যা করে মেরে ফেলে ।সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম আপু ফাঁসিতে ঝুলছে অথচ ওর পাজোড়া মেঝে পর্যন্ত স্পর্শ করছিল ।গলায় আঙ্গুলের দাগগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল ।শরীরে আঘাতের চিহ্নগুলো স্পষ্ট ফুঁটে উঠেছিল ।কষ্ট দিয়ে দিয়ে মেরেছে আজম খাঁন আমার আপুকে ।
আজম খাঁন তার মেজো মেয়েকে হত্যা করে সবাইকে বলল মাহনূর আত্মহত্যা করেছে ।আর এটাই সবত্র জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল মাহনূর ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে প্রেমের শোকে ।তবে কিছুসংখ্যক মানুষ এটা বিশ্বাস করেনি ।তারাও বুজতে পেরেছিল এটা আজম খাঁনের কাজ ।এমনকি ক’দিন আগে আজম খাঁন আমার মাকেও হত্যা করেছে ।নাফিয়া কথাগুলো শেষ করে চোখজোড়া মুছল ।তার চোখের পানি আজকে বাধ মানছেনা ।

স্পর্শ আশ্চর্যজনক গলায় বলল, কেউ পুলিশকে খবর দেয়নি ?

নাফিয়া ধরা গলায় বলল , কে বলবে ? কার এত সাহস ? আর যদি কেউ বলেও কোনো লাভ নেই ।আজম খাঁনের ক্ষমতা সবার জানা ।বড় বড় পুলিশ অফিসারদেরকে আজম খাঁন তার পকেটে রাখে ।

হ্ঠাৎ করে স্পর্শের মনে পড়ে গেল রিসোর্টে তাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে নাফিয়ার বলা কথাটা ।এতদিন খেয়াল-ই ছিলনা তার কথাটা ।এখন সব শুনে মনে পড়ে গেল ।সে তড়িৎগতিতে বলল,

আচ্ছা তুমি রিসোর্টের দিন হ্ঠাৎ আমাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে বলেছিলে আমি ঠিক আছি কিনা , আমার কিছু হয়েছে কিনা আবার ওরা আমার কিছু করেছে কিনা বাই দা ওয়ে তুমি কাদের কথা বলছিলে ?

আমার চাচাত ভাই তনয় নাকি আপনাকে মারতে গিয়েছিল । তাই ঐদিন আপনাকে দেখে আমি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম নাফিয়া বলল।

ওয়েট ওয়েট তারমানে আমরা যেদিন তুশিদের বাড়ি থেকে ফিরছিলাম কয়েকটা ছেলে আমার গাড়ি আটকিয়ে আমাকে মারতে এসেছিল তার মানে ঐ ছেলেগুলো তোমার ভাই আর তার বন্ধুরা ছিল ?

নাফিয়া মাথা ঝুলিয়ে হ্যাঁ বোঝাল ।আর বলল , আমায় পছন্দ করে তনয় ।আজম খাঁনকে বলে-ও আমায় বিয়ে করতে চায় আর আজম খাঁন-ও রাজি হয়ে যায় বিয়েতে ।কিন্তু মা এতে আপত্তি জানায় । জীবনের প্রথমবারের মত আজম খাঁনের বিরুদ্ধে কথা বলে আর এটাই মায়ের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায় ।মা মারা যাবার কয়দিন পর আজম খাঁন আমাদের বিয়ে-ও ঠিক করে ফেলেছিল কিন্তু আমি বিয়ের দিন বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে পড়ি নাফিজ আঙ্কেলের বাড়ি ।

স্পর্শ সব শুনে তাজ্জব বনে গেল ।সে নিজেকে সামলে নিয়ে রাগী গলায় বলল , সব কয়টা জানোয়ারকে পুলিশে দিব আমি ।

নাফিয়ার চোখজোড়া বড়বড় হয়ে গেল ।সে তড়িৎগতিতে স্পর্শের হাত ধরে ভয়ার্ত গলায় বলল , এটা করবেন না প্লিজ ।আমি চাইনা আপনার কোনো ক্ষতি হোক ।প্লিজ…. ।

তার প্রতি নাফিয়ার এত উত্তেজনা দেখে স্পর্শ যা বোঝার বুঝে ফেলল ।অজান্তেই ঠোটে মুচকি হাঁসি ফুটে উঠে তার ।সে নাফিয়ার হাত শক্ত করে ধরে আশ্বস্ত করে বলল,

তোমার আর আমার মাঝখানে কাউকে বাধা হতে দিবনা আমি ।আমার উপর ভরসা রাখতে পারো তুমি ।কক্সাবাজার থেকে ফিরে আমি নাফিজ আঙ্কেলের কাছে তোমার আর আমার বিয়ে প্রস্তাব নিয়ে যাবো ।বিয়ের পর তোমায় বাহিরের দেশে চলে যাবো ।যেখানে কোনো বাধা , অশান্তি কিছু থাকবেনা ।শুধু থাকবে ভালোবাসাময় সুন্দর এক সংসার । স্পর্শ নাফিয়ার কানে কানে ফিসফিস করে বলল , তোমার আর আমার সংসার ।শুধু তুমি আর আমি ।

স্পর্শ বলল অনেক সময় পার হয়ে গেছে এখন আমাদের হোটেলে ফিরতে হবে ।ওরা হয়ত অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য ।হোটেলে ফিরে সবাই হিমছড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিব ।আজকে সারাটাদিন সবাই হিমছড়িতে কাটাব ।তুমি কিন্তু সব সময় আমার সাথে সাথে থাকবে বুজলে ?

নাফিয়া থমথমে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পর্শের দিকে ।স্পর্শের চোখজোড়ায় তাকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন ।সে মনে মনে ভাবছে , আজম খাঁনকে আপনি চেনেন না স্পর্শ ? যদি একবার আজম খাঁন আমায় পেয়ে যায় তাহলে আমার আর রেহায় নেই ।হয়ত ঐদিন আমার শেষ দিন হবে ।

চলবে,
@Nusrat Hossain

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here