মনের গহীনে পর্ব ১৩

#মনের_গহীনে
১৩ তম পর্ব
লেখনীতে:নাদিয়া হোসাইন

সকাল দশটার দিকে প্রাচুর্য প্রিয়দের বাসায় গেলো। সুবহান সালেহ প্রথম এসেছে, তাই শান্তা তার খুশি ধরে রাখতে পারছে না। ভাই-কে কোন খান থেকে সমাদর করবে বোধগম্য হচ্ছে না খুশিতে৷ বিয়ের আগে ভাই বোনের সম্পর্কে কিছুটা দুষ্টু-মিষ্টি তিক্ততা থাকে, কিন্তু বিয়ের পর কোন ভাই বোনের শশুড় বাড়ি এলে সব কিছু উজার করে দেয়। প্রাচুর্যের এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। প্রিয়কেও দেখতে পাচ্ছে না, হয়তো ঘুমাচ্ছে। তার ইচ্ছে করছে প্রিয়র ঘুমন্ত মুখটা দেখতে। কিন্তু ভদ্রতা বলেও কিছু কথা থাকে। ইস.. এখন যদি ও প্রিয়র বউ হতো, তাহলে কোন বাধা-ই থাকতো না। সারাদিন ও রাত প্রিয়র কাছে থাকতে পারতো প্রাচুর্য ।

প্রাচুর্য ডাইনিং টেবিলে বসে যোহরা আর জারিফকে খাইয়ে দিচ্ছে । বাচ্ছারা নতুন নতুন মানুষের হাতে খেতে পছন্দ করে। প্রাচুর্যও যত্ন সহকারে দুজনকে খাইয়ে দিচ্ছে৷ দু’জন প্রচন্ড দেরি করছে খেতে। তখন উপর থেকে প্রিয় নিচে নেমে এলো । প্রিয়র পরনে একটা কালো রিঙের থ্রি-কোয়াটার আর চকলেট কালারের টি-শার্ট। প্রাচুর্য এক দফা ক্রাস খেলো। দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই ঘুম থেকে উঠেছে। কি মিষ্টি লাগছে দেখতে। প্রাচুর্য টেবলের শেষ প্রান্তে বসেছে বিধায় প্রিয় এখনো তাকে দেখেনি। পাশের সেন্টার টেবিল থেকে একটা ম্যাগাজিন উঠিয়ে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে বসে পরলো । যোহরা, জারিফের দিকে তাকানো মাত্রই থতমত খেয়ে গেলো প্রাচুর্যকে দেখে। বুঝতে পারলো না, এ সময় প্রাচুর্য কীভাবে এলো।প্রিয়র থতমত ভাব দেখে প্রাচুর্য হেসে ফেললো । মুচকি হেসে প্রিয়কে “গুড মর্নিং ” জানালো। প্রিয় নিজের থতমত ভাবটা ঠিক করে প্রাচুর্যকে বললো, __গুড মর্নিং! তা, তুমি কখন এলে প্রাচুর্য?
এইতো সকালেই এলাম আব্বুর সাথে। আপনি কি এখন-ই ঘুম থেকে উঠছেন?
হ্যাঁ! প্রিয় এবার নিরব হয়ে গেলো। বাড়িতে আর যাই হোক কথা বলা ঠিক না। কে কি মনে করে বলা তো যায় না। সে নিজের মতো খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। কিছুক্ষণ পর প্রিয়র মা প্রিতি চৌধুরী প্রিয়কে কনফ্লেক্স দিয়ে গেলো। প্রিয় সব সময় স্বাস্থ সম্মত খাবার খায়৷ যারা ডক্টর, তারা কিছুটা নিয়ম মেনে চলে। প্রিয়ও তার ব্যতিক্রম নয়। সে নিজের মতো খেয়ে উপরে চলে গেলো। প্রাচুর্য এতোক্ষণ প্রিয়কে লুকিয়ে দেখছিলো। কি কিউট ই না লাগছিলো৷

যোহরা, জারিফের খাওয়া হয়ে গেলে প্রাচুর্য ও রুমে চলে গেলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো প্রিয়র ম্যাসেজ,__ তুমি যে আসবে, বললে না কেন? প্রাচুর্য রিপ্লাই দিলো, __আপনাকে সারপ্রাইজ দিলাম। কেনো খুশি হন নি? প্রিয় প্রাচুর্যের ম্যাসেজের জবাব না দিয়ে ফোন দিলো। প্রাচুর্য একটুও লেট করলো না ফোনটা রিসিভ করতে।

হ্যালো! প্রাচুর্য, খুশি হব না কেন৷ তোমার ফুপির বাড়ি, যখন ইচ্ছে আসতে পারো৷
উহু.. ফুপির বাড়ি সে জন্য তো আসিনি। এসেছি, যেনো আপনাকে অনেকক্ষণ দেখতে পারি।
প্রিয় জানে, প্রাচুর্য তাকে নিয়ে একটু বেশি-ই যত্নশীল। প্রিয়র জন্য অনেক বেশি-ই পাগলামি করতে প্রস্তুত । মেয়েরা প্রথম রিলেশনে গেলে পাগলামির পরিমাণটা একটু বেশি-ই থাকে। ফ্যামেলির মধ্যে রিলেশনে গেলে বেনিফিটটা একটু বেশি-ই হয়। যখন ইচ্ছা ভালোবাসার মানুষটাকে দেখতে পাওয়া যায়। অনেক কিছু জানা যায়। আর প্রাচুর্য সেই বেনিফিট গুলোর সব কিছুই লুফে নিচ্ছে। আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর প্রিয় রেডি হয়ে কলেজে চলে গেলো। সারাদিন আর প্রিয়র দেখা পায়-নি প্রাচুর্য। প্রাচুর্যের বাবা তাকে দিয়ে দু’ঘন্টার মাঝেই চলে গিয়েছিলো । সামনেই তার পরীক্ষা আর সে এখানে, সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা তার কাছে মন্দ লাগছে না। সে রুম থেকে বেড় হয়ে সারাদিন শান্তা আর প্রিতির সাথে-ই কাটালো। প্রাচুর্য সারাদিন তাদের দুজনের সাথে বেশ আনন্দ করলো। কয়দিন পর তো এ সংসারটা তার হয়ে যাবে। এখনি দুই শাশুড়িকে কম্পানি দেওয়ার বিষয়টা খারাপ না। প্রাচুর্যের ভাবতেই লজ্জা লাগছিলো, তার ফুপিও একদিন তার শাশুড়ি হয়ে যাবে৷ প্রিয়র মা প্রিতি অত্যন্ত ভালো একজন মহিলা। প্রাচুর্যের নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে এমন একটা শাশুড়ি পাবে বলে।

বিকেলে প্রিয় বাড়ি ফিরতেই সে প্রিয়কে ম্যাসেজে বললো ঘুরতে যেতে চায়। তখন প্রিয় ম্যাসেজের রিপ্লাই দিলো, __এখন কেমনে ঘুরতে নিয়ে যাব । বাসায় কি বলবো, যে তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড আর তোমাকে নিয়ে এখন ঘুরতে যাবো। যদি তোমার বাসায় থাকতা, তাহলেও পারতাম। প্রাচুর্যর মন খারাপ হয়ে গেলো। প্রিয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আবার ম্যাসেজ দিলো, __আচ্ছা শুনো, যোহরা, জারিফ আর প্রাণকেও আমাদের সাথে নিয়ে যাই। ওদের আমি ম্যানেজ করছি, আর ওরা গেলে তোমাকে তো অবশ্যই যেতে হবে। কোন সমস্যা নেই তো, এতে তোমার? ম্যাসেজটা পেতেই প্রাচুর্যের মন ভালো হয়ে গেলো। সে তৎক্ষনাৎ প্রিয়কে ম্যাসেজ দিয়ে রাজি হয়ে গেলো।

প্রিয় সবাইকে ম্যানেজ করে নিলো। সর্বপ্রথম সে প্রানকে ম্যানেজ করলো৷ প্রানকে প্রাচুর্য আর তার সম্পর্কে সব কিছু জানিয়ে দিলো। প্রান আর প্রিয় পিঠাপিঠি, তাই দু’জনের মধ্যে অনেক ভাব। মূলত তারা দুই ভাই-ই সবাইকে ঘুরতে যাওয়ার জন্য রাজি করয়েছে।

প্রাচুর্য কি পরবে ভেবে পাচ্ছে না। এটা তার বাসা না যে প্রচুর জামা আনবে । কিছু সংখ্যক জামা এনেছে, যেগুলো সবই তার ফেভারিট। অনেক বাচ্ছাবাছি করে একটা মেরুন রঙের ফ্রগ, ব্লু জিন্স আর কালো হিজাব পরে নিলো। বাইরে শীত তাই একটা পাতলা জিন্সের জ্যাকেট পরে নিলো। বাইর আসতেই দেখলো প্রিয় একটা কালো আর সাদার মিশ্রনের হুডি পরে আছে । হুডির চেইন নেই , তাই ভিতরে কি পরেছে বুঝা গেলো না। ৷ হুডির কালো রঙের একটা জিন্সের পেন্ট পরেছে৷

গাড়ির সামনে প্রিয় আর প্রান বসেছে, পিছনে প্রাচুর্যরা তিন জন। প্রাচুর্য এখনো জানে না, প্রিয় কোথায় নিয়ে যাচ্ছে । জিঙ্গেস করার প্রয়োজনও পরে নি। প্রিয় যেখানে নিয়ে যাবে, প্রাচুর্য সেখানে যেতে এক পায়ে খাড়া।

প্রিয় সবাইকে নিয়ে যমুনা ফিউচার পার্কে গেলো। যোহরা জারিফ খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো । প্রাচুর্যও তাদের সঙ্গ দিয়ে তাদের সাথে উল্লাসিত হয়ে উঠলো। প্রান কায়দা করে বাচ্ছাদের নিয়ে রাইডে উঠার জন্য চলে গেলো। প্রাচুর্যও যেতে চাইলো, কিন্তু প্রান যেতে দিলো না। প্রান চায়, তাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হোক। তার ভাই যেনো সামায়াকে ভুলে প্রাচুর্যকে নিজের করে নিতে পারে, তার সব চেষ্টা সে করবে।

প্রান যাওয়ার পর প্রাচুর্য আর প্রিয় চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো। হিসেব মতো এটা প্রিয়র সাথে তার দ্বিতীয় ডেট। এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট ছাড়া কিছু হবে না, তাই প্রাচুর্যকে নিয়ে প্রিয় সপিং কর্নারে চলে গেলো। প্রিয় ফোনে গেইম খেলছিলো, তখন প্রাচুর্য প্রিয়কে বললো, __এই আমাকে এক সেট চুড়ি পছন্দ করে দেন না।
প্রিয় ভ্রূ কুঁচকিয়ে তাকালো। প্রাচুর্যকে বললো,__ আমি তো কখনো এগুলা কিনি-ই নাই। আমি পছন্দ করলে তোমার পছন্দ হবে না।
কে বলছে হবে না! আর পছন্দ না হলে নাই৷ কিন্তু আমার কাছে আপনি যা পছন্দ করেন, তা বেস্ট। আপনি পছন্দ করে দিলে জিনিসটা অন্য রকম হবে। প্লিজ, অনুরোধটা রাখুন আমার!
প্রিয় আর কিছু না বলে প্রাচুর্যকে এক সেট স্টোনের চুড়ি, আর দুই সেট রেশমি চুড়ি কিনে দিলো। প্রিয় চাইছিলো প্রাচুর্য আরো কিছু কিনুক, কিন্তু কিছু কিনলো না। শপিং করার সময় প্রাচুর্যের অনাগ্রহটাই বেশি থাকে। প্রাচুর্যর শপিং বেশির ভাগ তার মা-ই করে দেয়। সে হুট করে প্রিয়র হাতের ভাজে নিজের হাত ঢুকিয়ে দিলো। প্রিয়ও আর কিছু বললো না। প্রাচুর্য জোর করে প্রিয়কে সেলুনে নিয়ে গেলো। প্রিয়র কাছে ব্যাপারটা মোটেও ভালো লাগেনি, কিন্তু প্রাচুর্যের খুশির জন্য কিছু বললো না। প্রিয়র চুল গুলো বেশ বড় হয়ে গেছে। ইদানিং নিজের যত্ন একদমই নেয় না প্রিয়৷ জীবনটা অনেক বেখেয়ালিভাবে চালিয়ে নিচ্ছে৷ প্রাচুর্য প্রিয়কে তার পছন্দ মতো চুল কাটাতে বললো। প্রিয়ও বাধ্য ছেলের মতো তা করলো। ইদানিং প্রিয়র অনেকটা বিরক্ত-ই লাগছে। অন্য জনকে খুশি করা খুব সামান্য ব্যাপার না। এতে মনে অনেকটা তিক্ততা এসে যায়। কিন্তু প্রিয় এখন হেল্পলেস। তাই যেভাবে সব হচ্ছে৷ সে-ও তা সেভাবে করে যাচ্ছে শুধু এক মুক্তির আশায়।

রাতে ডিনার করে পাঁচজন বাসায় ফিরে গেলো এগারোটার পর। প্রাচুর্য টায়ার্ড হয়ে ঘুমিয়ে গেলো। রাতে প্রিয়র সাথে কথা বলার ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু চোখ কোন ভাবেই সেটা মানতে পারছিলো না। ইদানিং প্রাচুর্যের ঘুম অনেক ভালো হয়। যখন মানুষ সব রকম টেনশন ফ্রি থাকে, তখন ঘুমের অভাব হয় না। কিছুদিন আগেও প্রাচুর্য ঠিক মতো ঘুমাতে পারতো না। আজ জীবনটা খুব সুন্দর বলে তার কোন কিছুরই অভাব নেই!

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here