#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
১.
বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে ভীষণ দুঃখিনীর মতো মুখ করে মিথি বলল,
“আপু, তুই কবে বিয়ে করবি বল তো? তোর জন্য আমিও বিয়ে করতে পারছি না। বিয়ের বয়স তো সেই কবেই হয়েছে, এবার তো রাজি হ। তোর আগে তো আর আমাকে বিয়ে দিবে না। তোর সাথে আমারও বয়স বাড়বে। তারপর দেখা যাবে আমি আমার নাতি-নাতনির মুখ দেখার আগেই টুক করে ওপরে চলে যাব।”
পাশেই জামাকাপড় ভাঁজ করতে ব্যস্ত ছিলাম আমি। ছোটো বোনের এরূপ আহাজারি শুনে বিস্মিত চোখ তুলে তাকালাম। বোকা-বোকা ভাব নিয়ে বললাম,
“বিয়ে না হতেই নাতি-নাতনি!”
মিথি দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলল,
“তুই জানিস, আমার দারুণ একটা স্বপ্ন আছে?”
“কী?” প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চাইলাম আমি।
মিথি আয়েস করে বসে কল্পনার সাগরে ভাসতে-ভাসতে বলল,
“আমি তাড়াতাড়ি বিয়ে করব, আর জলদি-জলদি বেবির মা হব। বেবি বড়ো হলে তাকেও তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেবো। তাদেরকেও বলব আমার মতো জলদি-জলদি মা হতে। তারপর আমি হব ইয়াং গ্র্যান্ডমাদার। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে, আমি আমার নাতি-নাতনির বিয়েও তাড়াতাড়ি দিয়ে নাতজামাই দেখতে পারব। আরও সুপ্রসন্ন হলে নাতনির ঘরে কী যেন বলে? পুতনিও দেখতে পারব। কিন্তু সেটা কবে? তোর জন্য আমার এত সাধের সাজানো স্বপ্নগুলো জলে যাবে। কবে আমার বিয়ে হবে?”
ওর কথা শুনে অবাক হবার কথা থাকলেও, আমি মোটেও অবাক হলাম না। কারণ এসব নতুন নয়। বিয়ে পাগল বোন আমার। সারাক্ষণ কানের কাছে বিয়ে ছাড়া আর কোনো কথা তার মুখে আসে না। ইন্টারে পড়ুয়া সতেরো বছর বয়সী চঞ্চল রমণী সে। অথচ নিজেকে বিবাহযোগ্যা দাবি করে সে আম্মুর মাথাও খারাপ করার অসীম ক্ষমতা রাখে। তার সবচেয়ে বড়ো আক্ষেপ, বিয়ের বয়স হবার পরও আমি কেন বিয়েতে রাজি হচ্ছি না। আমার জন্য সে বিয়ে করতে পারছে না। পৃথিবীর সব সুদর্শন ছেলে ফুরিয়ে যাচ্ছে। পরে তার কপালে যদি কালাচাঁদ জোটে, তার দায়ভার কে নেবে? সে মোটেও এমন ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। আমি বরাবরই ওর এই এক জ্বালায় অতিষ্ট। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। চরম বিরক্তি নিয়ে বাঁ হাত দিয়ে মিথির মাথার পেছনে চটাস করে এক চ’ড় বসিয়ে দিলাম। তিরষ্কারের সুরে বললাম,
“চাপ’ড়ে বিয়ের ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলব। যা ভাগ এখান থেকে।”
মিথি ভীষণ মনক্ষুণ্ণ হবার ভান করে বিড়বিড় করল,
“ভালো কথা তো তোর কোনোকালেই ভালো লাগে না। বিয়ের আগে আমি মরে গেলে তো আমার না হওয়া বরটাই বিধবা হবে। তুই কী বুঝবি আমার দুঃখের?”
আমি ধমকে উঠে বললাম,
“যাবি তুই?”
মিথি দুঃখে-কষ্টে কাতর হয়ে আপন মনে বিড়বিড় করতে-করতে সামনে থেকে সরে গেল। আমি জামাকাপড় ভাঁজ করা ফেলে রেখেই রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। করার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলাম। মিথি সেখানেই টিভি ছেড়ে বসেছিল। ওর পাশে আমাদের ছোটো বোন ইকরা, রাজ ভাই আর তার তিনজন কাজিন আমিরা আপু, মিনহা আপু আর সৌরভ ভাইয়াও আছে। আমাকে দেখে মিথি কপাল কুঁচকে বলল,
“আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে এখন আবার নিজেই এসেছিস?”
আমি কপাল কুঁচকে বললাম,
“তো?”
আমিরা আপু আমাকে ডেকে পাশে বসাল। কিন্তু আমি বেশিক্ষণ বসলাম না। উঠে চলে গেলাম রান্নাঘরের সামনে। আমার দুই মমতাময়ী জননী মিলে রান্না করছে। একজন আমার জন্মদাত্রী মা, আরেকজন মায়ের থেকে কম নয় আমার কাছে। আমার আব্বুর প্রাণপ্রিয় বন্ধু নূর আঙ্কেলের স্ত্রী সে। নূর আঙ্কেল আব্বুর বন্ধু হলেও, বয়সের দিকে সে আব্বুর চেয়ে একটু বড়ো। আমার ছেলেবেলায় যখন আব্বু আর নূর আঙ্কেল একসঙ্গে প্রবাসে ছিল, তখন থেকেই তাদের বন্ধুত্ব। বলা চলে আঙ্কেল আব্বুকে খুব স্নেহ করতেন। অবশ্য আমি ছোটো থাকতেই আব্বু প্রবাস ছেড়ে দেশে ফিরে এসেছিল। কিন্তু আঙ্কেল আজও প্রবাস জীবন থেকে বেরোতে পারেননি। পুরো পরিবার দেশে রেখে তিনি প্রবাসেই থাকেন। বছরে অবশ্য দুই-তিনবার দেশে আসেন, পরিবারের সাথে সময় কাটানোর জন্য। তাদের বন্ধুত্বের সূত্র ধরেই আমাদের দুই পরিবারের মধ্যকার সম্পর্কের সূচনা। নূর আঙ্কেলের স্ত্রী এমনই এক নারী, যাকে মায়ের স্থানে না বসিয়ে শান্তি পাওয়া যায় না। নিজের আম্মুর পর এই সেই নারী, যাকে আমি সত্যিই নিজের মায়ের স্থানে বসিয়েছি, আর সে আমায় মেয়ের স্থানে। আমাদের তিন বোনকে নিজের ছেলেদের থেকে কোনো অংশে কম ভালোবাসেন না তিনি। আমার মতে ইনি এমনই এক নারী, যাকে কেউ কাছ থেকে মাত্র কয়েক ঘন্টা চেনার চেষ্টা করলেও, সে তাকে নিজের আপন কেউ ভাবতে শুরু করবে। মাঝে-মাঝে এই মানুষটার ভালোবাসার ক্ষমতা দেখলে আমি অবাক হই। ভেবে পাই না কীভাবে এত সূক্ষ্মভাবে ভালোবাসতে পারে সে। মোটকথা অসাধারণ একজন মানুষ সে। তাই তো নিজের মাকে আম্মু আর তাকে আম্মি ডাকতেই আমি অভ্যস্ত। দুজনেই সর্বগুণনিধি মা। মাঝেমাঝে আমার নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয়। দু-দুটো মা পেয়েছি। আমি নই তো কে ভাগ্যবতী? এককথায় আমার ডবল মাদার লাক। তাদের রান্নার মাঝে এই নিয়ে আমি প্রায় পাঁচ-ছয়বার রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার চলেও গিয়েছি। এতক্ষণ কেউ কিছু না বললেও, এবার আম্মি বলেই ফেলল,
“তোমার কি কিছু লাগবে, ইলো?”
আমি হেসে বললাম,
“না তো।”
পাশ থেকে আমার আম্মু বলে উঠল,
“তাহলে এতবার রান্নাঘরের সামনে ছুটোছুটি করছিস কেন? কী সমস্যা?”
“কিছু না।”
মিনমিনে গলায় কথাটা বলেই আমি দরজা থেকে সরে এলাম। ডাইনিংয়ের চেয়ারে বসে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি ঢকঢক করে গলধঃকরন করলাম। তারপর আবার উঠে গিয়ে সেই রান্নাঘরের সামনেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পা দিয়ে মেঝেতে আঁকিবুঁকি করার পর আম্মু ধমকের সুরে বলল,
“তুই কি একজায়গায় চুপ করে বসতে পারিস না, না কি সারা বাসায় কোথাও বসার জায়গা নেই? ফড়িংয়ের মতো লাফাচ্ছিস কেন?”
আম্মি তাকে থামিয়ে বলল,
“থাক না, ভাবি। বকছেন কেন?”
আমি মুখ কালো করে রুমে চলে এলাম। রুম জুড়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করে আবার চলে এলাম ড্রয়িংরুমে। রাজ ভাইরা সবাই বেশ মনোযোগ দিয়ে টিভিতে গান দেখছে, আর সেসব নিয়ে গল্প করছে। আমি এবার গিয়ে বসলাম মিথির পাশে। সবার সাথে পাল্লা দিয়ে টিভিতে মনোযোগ দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করলাম, কিন্তু লাভ হলো না। কারণ টিভির প্রতি আমার আকর্ষণ নেই। আজ ফোনটাও ছুঁয়ে দেখিনি। বসে থাকতে-থাকতে একটা গান ভালো লাগায় সবেমাত্র একটু মনোযোগ এসেছে, ঠিক তখনই কলিংবেল বেজে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে আমি ভীষণ চমকে এক লাফে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার এমন অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়ায় উপস্থিত সবাই অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। রাজ ভাই বললেন,
“কী হয়েছে? কলিংবেলের শব্দেও মানুষ ভয় পায়? যা দরজা খুলে দে, ওরা এসেছে বোধ হয়।”
আমি দরজার দিকে তাকালাম। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিকে কল্পনা করতেই হৃদপিন্ড লাফিয়ে উঠল। সবার মাঝে আমি এক আহাম্মকের মতো কাজ করে বসলাম। এদিক-ওদিক না তাকিয়ে রুদ্ধশ্বাসে এক ছুটে রুমে এসে দরজার ছিটকিনি লাগালাম। আমার এহেন কান্ডে যে ড্রয়িংরুমের মানুষগুলো বিস্ময়ের সপ্ত আকাশ অতিক্রম করেছে, তা বুঝতে পেরে ফাটা বেলুনের মতো মুখ করে বিছানায় পা তুলে বসে রইলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাইরে পরিচিত সেই পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম। রীতিমতো বাসায় একদম হৈ-হুল্লোড় বেঁধে গেছে। আমি ছাড়া সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছে। এদিকে গোবেচারা আমি ঘরে দোর দিয়ে এক কোণে নিষ্পাপ বিড়াল ছানার মতো বসে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার দরজায় টোকা পড়ল। বাইরে থেকে মিথি চেঁচিয়ে বলছে,
“আপু, দরজা বন্ধ করে রেখেছিস কেন? আম্মু ডাকছে, বের হ।”
আমি কপাল চাপড়ালাম। এত মানুষের মধ্যে আমার কথা মনে না পড়লে চলত না? এবার আমার কী হবে? মিথি আবার ডাকতেই আমি ঠোঁট উলটে বললাম,
“আসছি।”
সময় নিয়ে মনে সাহস সঞ্চয় করে কিছুক্ষণ পরেই দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিলাম। এখানে কাউকে না দেখে রুম থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম ডাইনিং টেবিল জুড়ে খাবার সাজাচ্ছে দুই মা জননী। পাশাপাশি চেয়ারে বসে আব্বু আর হিমেল কাকা কথা বলছে। হিমেল কাকা আম্মির ছোটো দেবর, অর্থাৎ রাজ ভাইয়ের ছোটো কাকা। আমি হিমেল কাকাকে সালাম জানালাম। তিনি হাসিমুখে সালামের জবাব দিয়ে আমার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। আমি মুখে হাসি ফুটিয়ে কথা বললেও সন্ধানী দৃষ্টি ছিল আশেপাশে। পাশে যে কখন মিথি এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পাইনি। হুট করে ও টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিতে-নিতে আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
“ফ্রেশ হতে গেছে।”
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। মিথি ভাবলেশহীন মুখে মুচকি হেসে একটা চেয়ার দখল করে বসল। আম্মি হাঁক ছেড়ে বলল,
“রাজ, টিভি বন্ধ কর। খেতে আয় সবাইকে নিয়ে।”
আমাকেও বসতে বলতেই আমি বললাম,
“সবাই বসুক, আমি পরে বসি।”
আম্মু বলল,
“বসে থাকার দরকার নেই। একসাথে খাওয়া-দাওয়ার ঝামেলা শেষ কর, তাই ভালো।”
আব্বু, হিমেল কাকা, রাজ ভাই, মিনহা আপু আর আমি বসার পর একটা চেয়ার খালি থাকায় মিথি, ইকরা, আমিরা আপু আর সৌরভ ভাইয়াকে খাবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সোফায় বসতে বলা হলো। খাবার শুরু করার সময়ই বরাদ্দকৃত চেয়ারটার কাঙ্ক্ষিত মানুষ এসে দখল করে বসল। সঙ্গে-সঙ্গে আমি মাথা নিচু করে প্লেটে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। হাত-পা মৃদু কেঁপে উঠল। সেই যে মাথানত করলাম, ভুল করেও আর চোখ তুলে কারো দিকে তাকানোর সাহস করলাম না। চুপচাপ প্লেটের খাবারটুকু কোনোরকমে শেষ করতে লেগে পড়লাম। আম্মি আমার প্লেটে আরও খাবার দিতে চাইলে বাঁধা দিয়ে জানালাম আমার পেট ভরে গেছে। এ কথা শুনে আম্মি কিছুক্ষণ জোরাজুরি করল। কিন্তু আমি খাবার তো নিলামই না, বরং প্লেটের খাবারটুকু দ্রুত শেষ করে উঠে টেবিল ছাড়লাম। ড্রয়িংরুমে যেতেই আমিরা আপু আর মিথি অবাক হয়ে জানতে চাইল আমি সত্যিই খেয়েছি কি না। আমি বললাম আমার খেতে ইচ্ছে করছে না বলে অল্প করে খেয়েছি। তাদের পাশে বসেও লাভ হলো না। এরা খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। এদিকে আমার ঘুমও পাচ্ছে। ঘুমাতে হলে রুমে যেতে হবে, আর রুমে যেতে হলে ডাইনিং রুম দিয়েই যেতে হবে। তাই ঘুমাব না ভেবে বসে থাকলেও হামি তুলতে লাগলাম। শেষমেষ বিরক্ত হয়ে উঠে পড়লাম। এদিক-ওদিক না তাকিয়ে ডাইনিং রুম দিয়ে সোজা হেঁটে রুমে ঢুকে পড়লাম। বিছানায় শুতেই চোখ জোড়ায় নিদ্রা এসে ভর করল।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম আম্মু আর আম্মি রুমে বসে গল্প করছে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠার কারণে নিজের আতঙ্কের কথাও ভুলে বসে ছিলাম। মিথিদের খুঁজতে গিয়ে ড্রয়িংরুমে টিভির শব্দ পেয়ে ভাবলাম ওরা ওখানেই। কিন্তু ড্রয়িংরুমে এসেই পুরোদস্তুর আহাম্মক বনে গেলাম। সোফায় বসা ব্যক্তিকে দেখেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। অথচ এই মুহূর্তে আমার ছুটে পালানো উচিত, না কি মুখে হাসি ঝুলিয়ে কথা বলা উচিত, তা ভাবতে গিয়ে দোটানায় পড়ে গেলাম। মূর্তির মতো এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার ভাবনার মাঝেই সোফায় বসা ব্যক্তি ফোন থেকে চোখ তুলে তাকালেন। সামনে অযথা টিভি ছেড়ে উনি ফোনে ডুবে ছিলেন। আমার দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে ঠাট্টার ছলে বললেন,
“কী খবর, পিচ্চি? ঘুম থেকে উঠেছিস, না কি ম্যানহোল থেকে? ফুটপাতের পাগলীও তোর থেকে গোছালো থাকে।”
কথাটা শুনে আমার কেমন অপমান বোধ হলো। জানি আমাকে উনি পছন্দ করেন না। তাই বলে এমন কথা বলবেন? তবু আমি কথাটা উড়িয়ে দিলাম। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, বাকিরা সবাই কোথায়। কিন্তু এনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে ইতস্তত বোধ করছি। তাই মানে-মানে এখান থেকে কেটে পড়ার ফন্দি এঁটে ঘুরে দাঁড়াতেই উনি পিছু ডাকলেন,
“দাঁড়া।”
আমি অসহায় মুখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমি চাই পালাতে, আর উনি আমাকেই পেয়েছেন কথা বলতে। আমি ফিরে তাকাতেই উনি সূক্ষ্ম চোখে আমাকে নিরীক্ষণ করলেন। এতে আমি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। ফাঁকা একটা ঢোক গিলে আমতা-আমতা করে প্রশ্ন করলাম,
“কিছু বলবেন?”
“আমাকে চিনিস তো?”
আমি অবাক হলাম। এ আবার কেমন প্রশ্ন? তাকে কি আমি নতুন চিনি? সেই ছেলেবেলা থেকেই তো চিনি।
“চিনব না কেন?”
আমার কথায় উনি ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
“আমি কে?”
“তাজ ভাই”, বিস্ময় নিয়েই বললাম আমি।
“আমি তোর সিনিয়র, না জুনিয়র?”
“সিনিয়র।”
“তো সিনিয়রদের সাথে কেমন বিহেভ করতে হয় জানিস না? আমার সাথে যে এত বছর পর দেখা হয়েছে, সালাম দিয়ে কেমন আছি তা-ও তো জিজ্ঞেস করিসনি। তুই তো দেখি চরম বেয়াদব হয়েছিস। পাঁচ বছর আগে তো ভোলাভালা আন্ডা বাচ্চা ছিলি। দিনদিন তাহলে এমন অবনতি হয়েছে?”
আমি চরম বিরক্ত হলেও, মুখে কিছু বলতে পারলাম না। একে তো আজাইরা সব প্রশ্ন করছে, তার মধ্যে আবার অপমানও করছে। পাঁচ বছর আগে সুইডেন যাওয়ার আগমুহূর্তেও তো লোকটা আমার সাথে ঠিকমতো কথাই বলেনি। এখন আবার সেই ছোটোবেলার মতো আচরণ করছে! ইচ্ছে করেই করছে, না কি সুইডেন যাওয়ার আগের সেই কাহিনি ভুলে গেছে? নাহ্, ভুলে যাবে কীভাবে? উনি তো আর বাচ্চা না যে ভুলে যাবেন। সুইডেনে ক্রিমিনোলজি সাবজেক্টে পিএইচডি করা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট সে। এত তুচ্ছ বিষয় ভুলে যাওয়ার কথা না তার। আমার মাঝের জড়তার কারণে ওনার অপমান গায়ে মাখার মতো সময় পেলাম না। এখান থেকে দ্রুত সরে পড়ার জন্য কোনোমতে প্রশ্ন করলাম,
“মিথি কি আমিরা আপুদের বাসায় গেছে?”
উনি সরু চোখে তাকিয়ে মাথা দোলালেন, যার অর্থ হ্যাঁ। উত্তর পেয়েই আমি আমিরা আপুদের বাসায় যাওয়ার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গেই তাজ ভাই পেছন থেকে বলে উঠলেন,
“সেই চিঠিটা কিন্তু এখনও আমার কাছে সংরক্ষিত আছে।”
আমি থমকে দাঁড়ালাম। ব্যস, হয়ে গেল। যে ভয় পাচ্ছিলাম, ঠিক তা-ই হলো। বিপজ্জনক লোকটা সেই কথা উঠিয়েই ছাড়ল। এত বছর পরে এসব কথা না উঠালে হত না? তা-ও আবার চিঠিটা এখনও আছে বলছে! এমনটা তো হবার কথা নয়। আমি তো ভেবেছিলাম সেই চিঠির টিকিটিও এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি শুকনো ঢোক গিললাম। ভীষণ ইতস্তত করে এদিক-ওদিক দৃষ্টি বিচরণ করতে লাগলাম। উনি পুনরায় সকৌতুকে বললেন,
“আরে সেই বিখ্যাত চিঠিটা। তোর তো ভোলার কথা নয় পিচ্চি। তা, এখনও কি আবেগের জোয়ারে ভেসে বেড়াস, না কি কেউ জুটেছে কপালে? অবশ্য এখন জুটতেও পারে। আগের চেয়ে সুন্দরী হয়েছিস দেখছি। বেশ পরিবর্তন এসেছে। নিজের আর কষ্ট করে খুঁজতে হবে না। যেচে ধরা দেবে।”
এতক্ষণ অপমানিত আর বিরক্ত হলেও, এ পর্যায়ে এসে আমার প্রচন্ড রাগ উঠে গেল। অপমান কি কম ছিল যে এখন আবার সেই পুরোনো কাহিনির জের ধরে খোঁচা মেরে কথা বলছে? তা-ও আবার একটা ভুল চিঠির জন্য। পাঁচ বছর আগেও ওনাকে সত্যিটা বিশ্বাস করানো যায়নি, আর পাঁচ বছর পরেও যাবে না বলেই আমার ধারণা। তাই আমি প্রত্যুত্তর করতে পারলাম না। অযথা উত্তর দিয়ে যেচে নিজের সঙ্কোচ বাড়ানোর চেয়ে এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম মনে করলাম। এরপর আর এক মুহূর্তও ওনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। পিছু ডাকও শুনলাম না। দ্রুত দরজা খুলে বাসা থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে এলাম। কপাল খারাপ বলে এত পালিয়ে বেড়াতে চেয়েও মুখোমুখি হতেই হলো। কিন্তু এবার মনে-মনে জোর প্রতিজ্ঞা করলাম, ভুল করেও আর ওনার সামনে যাব না। প্রয়োজনে সারাদিন ঘরবন্দী হয়ে থাকব, তবু না। তারই সঙ্গে মনের ভেতর বারবার একটা প্রশ্নই খোঁচা মা’রল। পাঁচ বছর আগে যে চিঠি পেয়ে উনি আমার ওপর রেগেমেগে চেঁচামেচি করতেও দুবার ভাবেননি, সেই ওনার কাছেই পাঁচ বছর পরেও ওই ভুলভাল চিঠিটা কীভাবে আছে? আশ্চর্য!
চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤