মনোহরিণী পর্ব -০২

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২.
আজ আমার মনটা ভীষণ, ভীষণ খারাপ। সুন্দর সন্ধ্যাটা চোখে সুন্দর লাগলেও, মন তাতে সায় দিচ্ছে না। মন খারাপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিষ্ঠুর মুগ্ধতাও দেখার চোখকে অসুন্দর করতে লেগে পড়েছে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দূরের আবছা আকাশটা দেখার উৎসাহ পাচ্ছি না। অনুভব করতে চেয়েও ব্যর্থ হচ্ছি। অনুভব করার চেষ্টা করলেই ঘাড়ত্যাড়া মনটা অতি মধুর কন্ঠে বার্তা পাঠাচ্ছে, তোমার মন খারাপ। মন খারাপের মাঝে আমি আজকের সন্ধ্যার নাম দিলাম, মন খারাপের এক সন্ধ্যা। তাই নয় কি? আসলেই তো তাই। আমার আজকের সন্ধ্যাটা তো মন খারাপে ছাওয়া এক বিরক্তিকর সন্ধ্যা। আমার মতোই আমার মন খারাপগুলোও ভীষণই অদ্ভুত প্রকৃতির। আমি খুব সহজেই মন খারাপ করি না। মন খারাপ করে থাকতে আমার মোটেও ভালো লাগে না। কেমন অসহ্য লাগে! প্রচন্ড বিরক্তিতে ছেয়ে যায় মস্তিষ্ক। মাসে দুবার মন খারাপ করার আগে আমি চারবার ভাবি। অথচ আজ আর ভাবাভাবির সময় হলো না। হুট করেই মন খারাপের ডাকপিওন দোরে কড়া নাড়ল। আমি না চাইতেও দোর খুলতে বাধ্য হলাম। এটাই হলো আমার মন খারাপের এক সন্ধ্যার মূল কারণ। সাড়ে
আট মাস আগে তাজ ভাই যখন সুইডেন থেকে ফিরেছিলেন, তখন আমি ছিলাম শরীয়তপুর নিজের বাড়িতে। এইচএসসির চিন্তায় সিলেবাসের পদতলে পিষ্ট। তাই আব্বু ছাড়া কেউই ঢাকায় আসতে পারিনি। তাজ ভাইও সঙ্গে-সঙ্গে শরীয়তপুর যাননি, তাই আমার সাথে দেখাও হয়নি। তারপর উনি চলে গেলেন ট্রেনিংয়ে। উনি ট্রেনিংয়ে যাবার পর অবশ্য আম্মি শরীয়তপুর গিয়েছিল। তারপর আমার রেজাল্ট বের হলো। অ্যাডমিশন নিলাম ঢাকাতে। আব্বু হলে রাখার কথা বলায় নূর আঙ্কেল আর আম্মি রেগে যায়। তাদের কথাতেই আমি তাদের বাসায় উঠি। রাজ ভাই বাড়িতে থাকেন না। চাকরিসূত্রে চট্টগ্রাম থাকেন। মাঝেমধ্যে এসে কয়েকদিন থেকে যান। পুরো বাসায় আম্মি একা। গত পাঁচ বছর ধরে আম্মির একা সংসারে সঙ্গী ছিল নূর আঙ্কেলের বড়ো ভাইয়ের পরিবার। তারা পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে। তাজ ভাইয়ের বড়ো কাকার মেয়ে আমিরা আপু আর মিনহা আপু আম্মিকে সঙ্গ দিত। শরীয়তপুর থেকে নূর আঙ্কেল আর আম্মির পরিবারের লোকজনও আসত। প্রত্যেক মাসে আসেন হিমেল কাকা। আমি আসার পর আমিরা আপু আর মিনহা আপু ছুটি পেয়েছিল। তারপর থেকে আম্মির সংসারে আমিই একমাত্র সঙ্গী। ট্রেনিং শেষে গতকালই তাজ ভাই ফিরলেন। আর এটাই সুইডেন থেকে ফেরার পর ওনার সাথে আমার প্রথম দেখা। তাজ ভাই ফেরার পর আমার পরীক্ষার জন্য আব্বু ব্যতীত আর কেউ তাকে দেখতে আসতে পারেনি। এ কারণেই এবার আমার পরিবারের ঢাকায় আসা। মিথি আর ইকরার ক্লাস কামাই যাচ্ছে বলে তারা আজই চলে গেছে। পরিবার থেকে দূরে থাকার অভ্যাস আমার কোনোকালেই ছিল না। অথচ এখন পড়াশোনার জন্য দূরে থাকতে হচ্ছে। তারা চলে যাওয়ার সময়ও ইচ্ছে করছিল সবাইকে নিজের কাছে আটকে রাখতে। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। তারা যাওয়ার পর থেকেই তীব্র মন খারাপে ছেয়ে গেছে আমার সুন্দর সন্ধ্যা। রাজ ভাইও আগামীকাল চলে যাবেন। তাই উনি গেছেন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। আম্মি রান্নাঘরে কিছু একটা করছে। এই মহিলা যে সারাক্ষণ রান্নাঘরে কীভাবে থাকে, আমি ভেবে পাই না। সে পারলে বোধ হয় চব্বিশ ঘন্টাই ওখানে কাটিয়ে দিত। তাজ ভাই বাসায় আছেন, কিন্তু কী করছেন, সেই খবর আমি রাখিনি। রাখার ইচ্ছে নেই আর কী। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। মন খারাপের সময়গুলো আমার একা কাটাতেই ভালো লাগে। আমার ভালো লাগা, মন্দ লাগার টানাপোড়েনে এসে বাঁধ সাধলেন তাজ নামক বিপজ্জনক লোক। উনি কখন বেলকনিতে এসেছেন, আমি টেরই পাইনি। হঠাৎ পেছনে খুকখুক করে কাশির শব্দ শুনে আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। তাজ ভাই কাঁচের দরজায় হেলান দিয়ে সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ওনার চোখে চোখ পড়তেই আমি খানিক অপ্রস্তুত বোধ করলাম। পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার কথা মাথায় আনতেই উনি বললেন,
“আমি যেতে বললে তবেই যাওয়ার সাহস করিস। তার আগে এক পা-ও নড়বি না। বি কেয়ারফুল।”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ভাবলাম বেখেয়ালে কি চলে যাওয়ার কথা মুখ ফসকে বলে ফেলেছি না কি? কই? বলিনি তো। তবে? উনি জানলেন কীভাবে? ট্রেনিংয়ে ডিটেকটিভিটির সঙ্গে কি মাইন্ড রিডিংটাও শিখেছেন? না কি ক্রিমিনোলজির সঙ্গে মাইন্ড রিডিং সাবজেক্টেও পিএইচডি করেছেন? কী জানি! এই লোক এত বাড়তি মেধা কোথায় রাখে রে বাবা! আমি তো দুপুরে কী দিয়ে ভাত খেয়েছি, তা রাতেই ভুলে বসে থাকি। তাজ ভাই আমার মুখের অভিব্যক্তি দেখে মৃদু শব্দ তুলে হাসলেন। পরক্ষণেই পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে সেটা আমার সামনে মেলে ধরলেন। বাঁকা হেসে বললেন,
“চেনা যায়?”
আমি কাগজটায় চোখ বুলিয়েই চিনতে পারলাম, পাঁচ বছর আগের সেই অভিশপ্ত চিরকুট এটা। কাগজ পুরোনো হয়ে যাওয়ায় লেখাগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে। উনি পুনরায় অবাক হবার ভান করে বললেন,
“চিনতে পারিসনি? তোর সেই বিখ্যাত চিরকুট। পিচ্চিকালের আবেগ।”
আমি নিজের বিরক্তিটা চেপে রাখার চেষ্টা করে বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বললাম,
“পাঁচ বছর ধরে আপনি এই একই ভুল ধারণা নিয়ে আছেন? আপনি বিশ্বাস না করলেও সত্যিটা তো আর পালটাবে না। সেদিনও আমি বলেছিলাম এই চিরকুট আমি লেখিনি, আজও তা-ই বলছি। এসব আফরা আপুর দেওয়া ডেয়ারের কারণে হয়েছিল।”
উনি ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলিয়ে কাগজটা ভাঁজ করে পুনরায় পকেটে রেখে দিলেন। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
“তারপর? পড়াশোনার কী অবস্থা? পড়াশোনা ঠিকমতো চলে, না কি এই সং সাজানো মুখ দেখিয়ে কূল পাস না?”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
“মানে?”
উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“আসলেই কি তুই সেই আগের মতো ভোলাভালা আছিস, না কি অ্যাক্টিং করছিস? মনে তো হয় না আগের মতো আছিস। পাঁচ বছরে হয়তো সাপের পাঁচ পা দেখে ফেলেছিস। ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়ে আছিস। পরিবর্তন হবারই কথা। কিন্তু আমি ভাবছি তোর সেই আবেগের কথা। তার খবর তো বললি না, পিচ্চি।”
আমি এবার আর চুপ থাকতে পারলাম না। চোয়াল শক্ত করে বললাম,
“আপনি আসলে নিজেকে যতটা স্পেশাল ভাবেন, ততটাও স্পেশাল আপনি নন। না আগে ছিলেন, আর না এখন। তাই দয়া করে একটা ভুল চিরকুটের জের ধরে খোঁচা মেরে কথা বলা বন্ধ করুন। যে কাজটা আমি স্ব-ইচ্ছায় করিনি, তার জন্য কোনো কটুক্তি আমি সহ্য করব না।”
তাজ ভাই ঠোঁট কামড়ে হাসি চেপে রাখলেন। বললেন,
“আরে বাহ্! এ তো দেখছি আমার ধারণা সত্যি। বোবার মুখে কথা ফুটেছে।”
আমি চরম বিরক্তি নিয়ে ওনাকে পাশ কাটিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে চলে এলাম। মাথাটা বিরক্তিতে দপদপ করছে। কী ভেবেছে কী লোকটা? একটা ভুল চিরকুটের জন্য পাঁচ বছর পর এসেও অপমান করবে, আর আমিও মেনে নেবো! এত সহজ? আমার কি আত্মসম্মান নেই? নেহাতই আফরা আপু আমার বড়ো। ছোটো হলে যে কী করতাম, আমি নিজেও জানি না। পাঁচ বছর আগে তাজ ভাই সুইডেন যাওয়ার আগে শরীয়তপুর আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। আম্মি আর রাজ ভাইও গিয়েছিল। সেবার আড্ডা দিতে বসে আফরা আপু আমাকে ডেয়ার দিয়েছিল। আমার হাতে একটা ভাঁজ করা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল ওটা তাজ ভাইকে দিতে। তখন ছিলাম নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া পঞ্চদশী বালিকা। অত মারপ্যাঁচ বুঝতাম না। সবকিছু সরলভাবে নিতাম। নিতান্তই সবার বাধ্য ছিলাম বলে আফরা আপুর দেওয়া কাগজটা নিয়ে তাজ ভাইয়ের হাতে দিয়েছিলাম। আপুর কথামতোই তাজ ভাইকে কাগজটা দিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিলাম। সেদিন বিকেল বেলায় তাজ ভাই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি স্বাভাবিকভাবেই তার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। উনি কোনো ভূমিকা ছাড়াই আমাকে বকাঝকা শুরু করেছিলেন ওই চিরকুটের জন্য। অথচ আমি তখনও জানতাম না যে, ওই কাগজে কী লেখা ছিল। তাজ ভাই ছোটোবেলা থেকেই যেমনি চঞ্চল, তেমনি মিশুক ছেলে। হুটহাট রাগ উঠে গেলেও তাকে সামলানো সহজ ছিল না। আমাদের সাথে সবসময়ই উনি দুষ্টুমি করতেন। কারণে-অকারণে জ্বালিয়ে মা’রতেন সবাইকে। ওনার রাগ সম্পর্কে অবগত থাকলেও, সেবার ওই প্রথম আমি তার রাগের মুখোমুখি হয়েছিলাম। সেদিন আমি ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম। তখন আমি বড়োদের সামনে কথা বলার সাহস করতাম না। ওই যে সবার বাধ্য আর ভোলাভালা ভীতু মেয়ে ছিলাম যে, তাই। বকাঝকার এক পর্যায়ে আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম কাগজে কী লেখা। তাজ ভাই আমার এই কথা নিয়েও কৌতুক করেছিলেন। তবু অবশ্য কাগজটা আমার সামনে মেলে ধরেছিলেন। কাগজের লেখা পড়ে আমার চোয়াল ঝুলে পড়ার জোগাড় হয়েছিল। ভয়ে, লজ্জায় আমি তাজ ভাইয়ের সামনেই কেঁদে উঠেছিলাম। কাগজে লেখা ছিল,

তাজ ভাই,
আপনার সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলার সাহস নেই, তাই লিখে জানিয়ে দিলাম। আমি আপনাকে ভালোবাসি। কবে থেকে তা বলতে পারব না। কিন্তু অনেক ভালোবাসি, বিশ্বাস করুন। আমি জানি আপনি অনেক রাগী মানুষ। হয়তো এই চিঠি পেয়ে আমাকে খুব বকবেন। কিন্তু আমার কথা বদলাবে না। আপনি তো সুইডেন চলেই যাবেন। আমি আপনার ফেরার অপেক্ষায় থাকব। আমাকে ভুলে যাবেন না। আমি তো খুব একটা সুন্দরী বা চঞ্চল মেয়ে না, তাই প্রেমও করতে পারি না। আপনি কি আমায় ভালোবাসবেন? প্লিজ জানাবেন। আমি কিন্তু আপনাকে সত্যিই অনেক, অনেক ভালোবাসি।
ইতি
ইলোরা

চিরকুটের কথাগুলো বলে বলেও তাজ ভাই আমাকে বকেছিলেন। আমি অল্প বয়সে বেশি পেকে গেছি, আবেগে ভাসছি, প্রেম করার জন্য ম’রে যাচ্ছি, তাকে হাত করতে চাইছি, আরও কত কী! অথচ তখন প্রেম নামক শব্দটাও উচ্চারণ করার আগে আমি দশবার ভাবতাম। ভয় হত। পাছে না আবার আব্বু বকে। আফরা আপু তার কথা বলতে নিষেধ করায় আমি তার নামটাও মুখে আনিনি। মুখ বুজে সহ্য করেছিলাম সব অপমান। যখন বলেছিলাম আমি ওটা লেখিনি, তখন তাজ ভাই রীতিমতো হেসেছিলেনও। আফরা আপুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে আমার সাথে এমন মজা কেন করল। আপু স্বাভাবিকভাবেই বলেছিল সে এতটাও জটিল ভাবেনি ব্যাপারটা। তাজ ভাইয়ের রাগের ভয়ে সে আমাকে অনুরোধ করেছিল যাতে তাজ ভাইয়ের সামনে তার নাম না নিই। তাজ ভাই ঢাকায় ফেরার আগ পর্যন্ত আর আমি ভুল করেও তার মুখোমুখি হইনি। তবে খুব কেঁদেছিলাম। এরপর তাজ ভাইয়ের ফ্লাইটের দুদিন আগে পরিবারের সাথে একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমাকে তাজ ভাইদের বাসায় আসতে হয়েছিল। সেদিন আবার সে ওই চিরকুটের জন্য আমাকে নতুন করে কথা শুনিয়েছিল। বলেছিল এসব ফালতু চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে। আমি সেদিন রাগে দুঃখে আফরা আপুর নামই বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু কপাল! লোকটা আর আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করেনি। বাকি দুদিন আমি সামনে থাকলেও উনি আমার দিকে ফিরেও তাকাননি। চলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে উনি সবার থেকে বিদায় নিলেও, একমাত্র আমাকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন আমার কী হয়েছিল জানি না, ওয়াশরুমের দরজা আটকে আবারও খুব কেঁদেছিলাম। কাঁদতে-কাঁদতে মুখের যা-তা অবস্থা হয়েছিল! সেদিন না বুঝতে পারলেও, উনি চলে যাওয়ার অনেকদিন পর টের পেয়েছিলাম ওনার প্রতি আমার এক অজানা দুর্বলতা ছিল। অদ্ভুত এক টান জন্মেছিল, অথচ তখন উনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। সব বিষয়ে আমার ভয় ছিল আকাশ ছোঁয়া, সেজন্যই হয়তো নিজের মনের অনুভূতিটুকুও ধরতে পারিনি আমি। প্রথম-প্রথম খারাপ লাগা কাজ করলেও, পরে ওসব কাটিয়ে উঠেছিলাম। তাজ ভাই ফোন করে বাসার সবার সাথে কথা বলত, শুধু আমি ছাড়া। সেজন্য আমিও খুব একটা আগ্রহ দেখাতাম না। মাঝে-মাঝে ঢাকায় আম্মির কাছে এলে আম্মি ওনার সাথে কথা বলার সময় আমার কাছে ফোন দিতে চাইত। কিন্তু উনি নানান বাহানায় এড়িয়ে যেতেন। আমি আর ওসবে কান দিতাম না। পাঁচ বছরে ওসব কথা প্রায় ভুলে বসেছিলাম। কিন্তু ভুলে আর লাভ কী হলো? পাঁচ বছর পরে এসেও তো সেই পুরোনো ক্ষত খুঁচিয়ে নতুন করে রক্তাক্ত করতে শুরু করেছেন উনি। হুট করে এসেই আবার ওসব নিয়ে মজা নিবেন জানলে হয়তো আমি ম’রে গেলেও এই বাসায় উঠতাম না। তবে এটা ভেবে একটু অবাক লাগছে যে, উনি আর আমার ওপর পুরোনো রাগ দেখাচ্ছেন না। শুধুই মজা নিচ্ছেন। এটা কি কেবলই আমাকে ক্ষেপানোর ধান্দা, না কি অন্যকিছু? জানি না ওনার মাথায় কী চলছে; তবে এটুকু আঁচ করতে পারছি যে, ওনার এমন আচরণে আমি ওনার ওপর চরম বিরক্ত। বিপদের সামনে যাব না ভাবলাম, অথচ বিপদ নিজেই সহাস্যে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কী মুশকিল! ওনার জন্য কি এখন আমি স্পাই রাখব? যাতে উনি কখন ঘর থেকে বেরোন, সেই খবর পেয়ে আমি আগে থেকেই সরে থাকতে পারি? এই ভাবনা মাথায় আসতেই হুট করে মনে পড়ল কুলসুম আপার কথা। ওনাকে একটু হাত করলেই আমার স্পাই জোগাড়ের কাজ হয়ে যাবে। কী বুদ্ধি আমার! এমন অসাধারণ এক বুদ্ধি মাথায় আসার জন্য নিজেই নিজেকে এক দফা বাহবা জানালাম। কুলসুম আপা চলে গেছেন কি না দেখার জন্য রুম থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই কলিংবেল বাজল। আম্মি রান্নাঘর থেকে হাঁক ছাড়ল,
“ইলো, দেখো তো কে এসেছে।”
আমি ভাবলাম আমিরা আপুদের বাসার কেউ এসেছে। নাচতে-নাচতে গিয়ে না দেখেই দরজা খুলে দিলাম। দরজার ওপাশে দাঁড়ানো অতিশয় সুন্দর যুবককে চিনতে না পেরে ভদ্রভাবে প্রশ্ন করলাম,
“জি? কাকে চাই?”
লোকটা ক্যাবলাকান্তর মতো হেসে বললেন,
“আমি তাজের বেস্ট ফ্রেন্ড, শ্রেয়ান চৌধুরী।”
আমি দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললাম,
“ভেতরে আসুন।”
শ্রেয়ান ভাইয়া বিনা বাক্যে ভেতরে ঢুকলেন। আমি দরজা বন্ধ করে তাকে বসতে বললাম। উনি আরাম করে বসে আমাকে প্রশ্ন করলেন,
“তুমি ইলোমিলো?”
আমি কপাল কুঁচকে ফেললাম। এ আবার কার নাম?
“জি?”
“ওহ্ সরি, ইলোরা তো তুমি?”
“হ্যাঁ।”
মনে-মনে ভাবলাম, আমাকে চেনে কীভাবে? আর আমার নাম জানলে প্রথমেই নামের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করার মানে কী? আমার মনের প্রশ্নটা হয়তো শ্রেয়ান ভাইয়া ধরতে পারলেন। একগাল হেসে বললেন,
“তোমাকে আমি চিনতাম না। আন্টির সাথে যে থাকে, তার নাম ইলোরা, এটুকু জানতাম। তোমাকে দেখে আঁচ করলাম, এ বাসায় তুমি ছাড়া তো অন্য কোনো রমণী নেই, তাই। তোমার নামটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। তাই নাম শুনে প্রথমেই আমার মাথায় এসেছিল ‘ইলোমিলো’ নামটা। ভেবেছিলাম তোমার সাথে দেখা হলে বলব। ফাইনালি বলেই দিলাম। তারপর বলো, কেমন লাগল তোমার নতুন নাম?”
এক দমে কথাগুলো শেষ করে শ্রেয়ান ভাইয়া প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকালাম। বুঝলাম লোকটা বেশ মিশুক আর হাসিখুশি। নইলে প্রথম দেখাতেই কেউ অচেনা কারো নাম নিয়ে গবেষণা করতে বসে না। তাজ ভাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়া সত্ত্বেও লোকটার মিশুক স্বভাব আমার বেশ লাগল। আমিও হেসে ফেললাম। বললাম,
“বেশ সুন্দর।”
লোকটা নিজের কাঙ্ক্ষিত উত্তর পেয়ে অনেক খুশি হয়ে গেলেন। রান্নাঘর থেকে আম্মি জিজ্ঞেস করল,
“ইলো, কে এল?”
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে শ্রেয়ান ভাইয়া নিজেই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। আমিও ওনার পিছু নিলাম। দেখলাম আম্মিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে উনি আনন্দে গদগদ হয়ে আম্মির সাথে কুশল বিনিময় করলেন। আম্মিও তাকে পেয়ে বেশ খুশি। আম্মি রীতিমতো চেঁচিয়ে তাজ ভাইকে ডাকতে শুরু করল। ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই তাজ ভাই এসে উপস্থিত হলেন। শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে কোলাকুলি করলেন। পরে জানতে পারলাম শ্রেয়ান ভাইয়া আর তাজ ভাই একসঙ্গেই সুইডেনে পিএইচডি করেছেন। ট্রেনিং-ও দুজনের একসঙ্গে কেটেছে। সুইডেন যাওয়ার আগে থেকেই না কি শ্রেয়ান ভাইয়া এ বাসায় আসা-যাওয়া করতেন। দুই পরিবারের মাঝেও বেশ ভালো সম্পর্ক আছে। ঢাকায় আমার খুব একটা আসা হত না। আম্মি সুযোগ পেলে তার ছেলেদের নিয়ে নিজেই শরীয়তপুর যেতেন। সেজন্যই শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে আমার পরিচয় নেই। আম্মি আমাদের বলল টেবিলে বসতে। সে তাজ ভাইয়ের পছন্দের পাটিসাপটা তৈরি করেছে। তা খাওয়ার জন্য তাড়া দিলো। আমি বসলাম না। কিন্তু আম্মি বলামাত্রই তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়া গিয়ে চেয়ার দখল করে বসলেন। টেবিলে আমার আদরের বিড়াল জেমি সটান শুয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে ছিল। ওনাদের শব্দ পেয়েই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। গোলগোল চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,
“বিড়াল কার?”
আম্মি বলল,
“কার আবার? ওই যে আমাদের বিড়ালপ্রেমী।”
শ্রেয়ান ভাইয়া জেমির মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তোমার বিড়াল তোমার মতোই মিষ্টি দেখতে। ওর নাম কী?”
আমি সহাস্যে উত্তর দিলাম,
“জেমি।”
“সুন্দর নাম।”
পাশ থেকে তাজ ভাই পাটিসাপটায় কামড় বসিয়ে বললেন,
“এখান থেকে সরা এটাকে। আমার থেকে দূরে রাখবি, নয়তো এ বাসায় এর জায়গা হবে না।”
আমার মুখ থেকে হাসিটা গায়েব হয়ে গেল। উনি যে বিড়াল পছন্দ করেন না, এ কথা আমি ভুলে বসেছিলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,
“বিড়াল তোর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে,‌ বল তো? বিড়াল হচ্ছে আদুরে প্রাণী। ওদের দেখলেই তো আদর করতে ইচ্ছে করে। তুই আসলেই নিরামিষ।”
তাজ ভাই কপাল কুঁচকে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,
“নিরামিষ,‌‌ না আমিষ বুঝলি কীভাবে? এখনও তো বিয়ে-টিয়ে করলাম না। বিয়ের পর বউয়ের সাথে রোমান্স করে তোকে সেসবের ভিডিয়ো ক্লিপ দেখানোর মতো মহান কাজটা আমি অবশ্যই করব। তারপর না হয় নিরামিষ, আমিষের প্রকারভেদ করিস।”
অদূরে দাঁড়িয়ে আমি এ কথা শুনে আহাম্মক বনে গেলাম। লজ্জায় মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করল। আমার সামনে এমন বিশ্রী কথা বলতে ওনার একটুও বাঁধল না! আমাকে কি ওনার মতো নির্লজ্জ মনে হয়? লোকটা আর শুধরাল না। এদিকে শ্রেয়ান ভাইয়া আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে তাজ ভাইয়ের সাথে তাল মেলাতে লেগে পড়েছেন। দুই নির্লজ্জের পাশে আমার মতো এক অসহায় প্রাণীর লজ্জায় টিকে থাকা সম্ভব হলো না। তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে ঢুকে পড়লাম। ভাগ্যিস আম্মি ওসব শোনার আগেই রান্নাঘরে চলে এসেছিল। শ্রেয়ান ভাইয়াকে কত ভদ্র ভেবে ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। অথচ ওনার মাঝেও এত ভেজাল! ছিঃ, ছিঃ! মূলত বিপজ্জনক লোকের বেস্ট ফ্রেন্ডকে দুধে ধোয়া তুলসী পাতা ভাবাটাই ছিল আমার চরম ভুল। এসব সাংঘাতিক লোকদের নির্লজ্জ স্বভাব অস্বাভাবিক কিছু নয়। এদের বাক্য ব্যয়ের মাঝে লাগাম নামক কোনো শব্দ আছে বলে আমার মনে হয় না। না বাবা, এসব লোকদের বিশ্বাস করার মতো ভয়াবহ ভুল আর আমি ইহজীবনে করব না। পৃথিবী উলটে গেলেও না। আমার শান্তিপ্রিয় স্বভাব এর থেকে ঢের ভালো।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤

নোট: আজ হয়তো অনেকেই #ক্যানভাসের_রমণীর জন্য অপেক্ষা করেছিল। ওটা আগামীকাল দেওয়ার চেষ্টা করব, ইন শা আল্লাহ্। সবাইকে রেসপন্স করার অনুরোধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here