মনোহরিণী পর্ব -০৩

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৩.
“হায় হায়! কী একটা ছ্যাঁকা খেলাম রে ইলো! শ্রেয়ান ভাইয়া যে এত সুন্দর হয়ে গেছে, ভাবতেই তো আমার মগডালে ঝু’লে পড়তে ইচ্ছে করছে। আমার প্রেম হওয়ার আগে কেন এল না? কেন, কেন? এখন আমি এ ছ্যাঁকাকথন কাকে শোনাব?”
মিনহা আপুর আহাজারি শুনে আমিরা আপু হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিমা করে চকচকে মুখ করে বলল,
“ধুর! তুই তো অলরেডি সেটিংস। এখন আর আহাজারি করে কী লাভ? হ্যাঁ, শ্রেয়ান ভাইয়াও আগের থেকে অনেক হ্যান্ডসাম হয়ে গেছে; কিন্তু তাজ ভাইকে টেক্কা দিতে পারেনি, হুঁহ্। তাজ ভাই ইজ তাজ ভাই। দ্য গ্রেট ইয়াং ডিটেকটিভ আহনাফ তাজওয়ার। উনি মিঙ্গেল হলে শ্রেয়ান ভাইয়াকে নিয়ে ভাবতাম। কিন্তু উনি যখন সিঙ্গেল আছেন, তখন আপাতত অন্যদিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করছি না। এখন ভালোয়-ভালোয় তাজ ভাইকে পটাতে পারলেই জীবন ধন্য।”
মিনহা আপু ঠোঁট উলটে বলল,
“আমার দুঃখে একটু তো দুঃখিত হ, আপু। কষ্টে আমার কলিজা, ফুসফুস, কিডনি হৃদপিন্ড যা কিছু আছে, সব ফেটে যাচ্ছে। গিভ মি সাম সিমপ্যাথি প্লিজ।”
আমার ইচ্ছে করল নিজেই এই দুটোকে মগডালে ঝু’লিয়ে দিই। আহাজারি করে-করে ম’রে যাচ্ছে, আবার বলছে ছ্যাঁকাকথন কাকে শোনাব! এরা এত ওভার অ্যাক্টিং কোত্থেকে শেখে মাবুদ জানে। হতেই পারে এসব তাদের গোষ্ঠিগত রোগ। শ্রেয়ান ভাইয়াকে দেখে হতে এক বোন বুকফাটা আহাজারি আরে চলেছে, আরেকজন স্বান্তনা দিয়ে চলেছে। স্বান্তনা দিতে গিয়ে সে-ও আবার তাজ ভাইয়ের গুণগান গাইছে। এরা এত কীভাবে পারে ভাই? ছুঁকছুঁক স্বভাবের মেয়েমানুষ। আমি আলগোছে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গেই মিনহা আপু প্রশ্ন করল,
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“ভালো লাগছে না, আসছি একটু,” মিথ্যে বললাম আমি। এদের এই আজাইরা বকবক শুনতে ইচ্ছে করছে না। এতক্ষণ সোফার কোণে বসে সৌরভ ভাইয়া ফোনে বুঁদ ছিলেন। এই ছেলে চব্বিশ ঘন্টা ফোনে মুখ গুঁজে কী করে তা সে জানে আর মাবুদ জানে। দীন দুনিয়ার খবর তার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। আমার ধারণা এই ছেলে ওপরে ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না ভাব করলেও, ভেতরে-ভেতরে দুনিয়ার সবচেয়ে বাঁদর প্রকৃতির মানবের মধ্যে একজন। প্রেম ভালবাসার কেসও আছে নিশ্চিত। নিতান্তই ভদ্র ছেলে বলে কারো বুঝার জো নেই। এই ছেলে আবার পড়াশোনা, কথাবার্তা, দুদিকেই ব্রিলিয়ান্ট। কথা বলে বড়োদের মতো। তাজ ভাইয়ের বড়ো খালার ছোটো ছেলে সৌরভ ভাইয়া। ঢাকাতেই পড়াশোনা করে। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র‌। হলে থাকে। তাজ ভাই এসেছে বলেই তার আগমন। অবশ্য সে প্রতি সপ্তাহেই আসে আম্মির আদরের টানে। আমার সমবয়সী হলেও, আমাকে সবসময় আপনি সম্বোধন করে। এর কারণ অবশ্য আমার জানা নেই। তার দেখাদেখি আমিও তাকে অযথাই আপনি সম্বোধন করি। সে আমাকে আপু আর আমি তাকে ভাইয়া ডাকি। আমি চলে যাওয়ার কথা বলায় সৌরভ ভাইয়া বললেন,
“যান আপু। এখানে বসে এই ফাও প্যাঁচাল না শোনার থেকে, এক পাতা উপন্যাস পড়েন। মনেও শান্তি আসবে আর সময়ও নষ্ট হবে না।”
আমিরা আপু সৌরভ ভাইয়ার বাহুতে চটাস করে এক চ’ড় বসিয়ে বলল,
“ফাও প্যাঁচাল মানে কী, হ্যাঁ? নিজে তো এই ফোনটার মধ্যে ঢুকে থাকিস সারাদিন। তুই আড্ডার কী বুঝবি? কালই তুই হলে ফিরে যাবি, নইলে আঙ্কেলকে বলে তোর এই ফোন আমি বুড়িগঙ্গায় ফেলব। গাধা কোথাকার!”
মুখ ঝামটা শুনে সৌরভ ভাইয়া রাগ করল না। আমিরা আপুদের সাথে তার বেশ ভালো সম্পর্ক আছে। একসঙ্গে থাকলে মনে হয় এরা আপন ভাই-বোন। অথচ এদের মাঝে রক্তের কোনো সম্পর্কই নেই।
“এই পাগলা গারদে থাকার চেয়ে আমি তাজ ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিই, তা ভালো” বলেই সৌরভ ভাইয়া উঠে ফোন ঘাটতে-ঘাটতে চলে গেল। আমিরা আপু পেছন থেকে বিদ্রুপের সুরে বলল,
“ওই ফোন নামক যন্ত্রটা যেদিন এক মুহূর্তের জন্য হাতছাড়া করতে পারবি, সেদিন তুই আড্ডার উপযুক্ত হবি। বুদ্ধু!”
মিনহা আপু ভাবুক হয়ে বলল,
“আপু, তুই কিন্তু ভুল বলেছিস। সৌরভকে একবার গাধা, আরেকবার বুদ্ধু বললি। বাট একচুয়্যালি হি ইজ আ ব্রিলিয়ান্ট গাই, অ্যান্ড ইউ নো দ্যাট।”
সঙ্গে-সঙ্গে আমিরা আপু চটাস করে মিনহা আপুর মাথায় এক চা’টি মা’রল। বলল,
“তোকে ওর চামচামি করতে বলছি?”
ব্যস, মিনহা আপুও এবার ফুঁসে উঠল। শুরু হলো দুই বোনের ক্যাঁচক্যাঁচনি। আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। আলগোছে সেখান থেকে সরে এসে ডাইনিং রুমে দাঁড়ালাম। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে কুলসুম আপার খোঁজ করলাম। তিনি এখন আম্মিকে রাতের খাবার রান্নায় সাহায্য করছেন। পড়তে বসতে ইচ্ছে করছে না। রুম থেকে একটা উপন্যাসের বই আর চশমাটা নিয়ে এসে ডাইনিং রুমের লাগোয়া বেলকনিতে চলে গেলাম। এই নিরিবিলি জায়গাটা বই পড়ার জন্য আমার কাছে বেশ প্রিয়। বেলকনির লাইট অন করে চেয়ারে পা তুলে বসলাম। তারপর বই খুলে বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ায় বুঁদ হলাম। কতক্ষণ পার করলাম খেয়াল নেই। আমার গভীর মনোযোগে বিঘ্ন ঘটল পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে। নাকের ডগায় নেমে আসা চশমাটা আঙুল দিয়ে ঠেলে চোখে পরতে-পরতে বই থেকে চোখ তুলে তাকালাম। তাজ ভাই কিছুটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আমার হাতের বইয়ের পাতায় চোখ বোলাচ্ছেন। আমি বিরক্তি বোধ করলাম। আমার এত সুন্দর মনোযোগে বাঁ হাত না ঢুকালে কি লোকটার বদহজম হত? এই লোক আসতে না আসতেই ভূতের মতো আমার ঘাড়ে চেপে বসল কেন? আশ্চর্য! এখন নিশ্চয়ই আবার ওই চিরকুট নিয়ে খোঁচা মা’রবে। উফ্! কী মুশকিলে পড়লাম রে বাবা! তাজ ভাই শিরদাঁড়া সোজা করে দু’পা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে তার চমৎকার গা জ্বালানো হাসিটা দিলেন। বললেন,
“বাহ্! একাডেমিক বই পড়ার সময় নন একাডেমিক বই পড়া হচ্ছে? বলছি কী, ওসব একাডেমিক বই ঘরে রাখার কী দরকার? পড়বি তো না। তার চেয়ে বরং ওসব ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে ফাঁকা জায়গায় আরও কিছু নন একাডেমিক বই রেখে দে। আর হ্যাঁ, এই চমৎকার আইডিয়ার বিনিময়ে অবশ্যই আমার অগোছালো কাপড়গুলো ভাঁজ করে দিবি।”
আমি গাল ফুলিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
“আপনার সব বস্তা পচা আইডিয়া গিয়ে ডিটেকটিভিটিতে লাগান। আমার এসবের প্রয়োজন নেই” বলতে-বলতে লম্বা-লম্বা পা ফেলে প্রস্থান করলাম।

নূর আঙ্কেলের ফোন আসায় আম্মি রান্নাঘর থেকে বেরিয়েছে লক্ষ্য করেই আমি এক ছুটে রান্নাঘরে ঢুকে পড়লাম। কুলসুম আপা চমকে উঠে চোখ দুটো রসগোল্লার মতো করে আমার দিকে তাকালেন। চট করে দোআ পড়ে নিয়ে বুকে ফুঁ দিয়ে বললেন,
“এমনে কেও আহে না কি আফা? ডরাই গেছি আমি। মনে হইতাছে আফনারে ডাকাইতে দৌড়ানি দিছে।”
আমি মনে-মনে স্বগতোক্তি করলাম,
“যেন-তেন ডাকাত না। উচ্চশিক্ষিত ডিটেকটিভ ডাকাত।”
মুখে অসহায়ত্ব এনে বললাম,
“আপনি কি আমায় একটা ছোট্ট সাহায্য করতে পারবেন, কুলসুম আপা?”
“কইয়া ফালান।”
“আম্মিকে বলবেন না। শুধু আম্মি না, কাউকেই বলবেন না। ঠিক আছে?”
কুলসুম আপা দৃষ্টি সন্দিহান হলো। উনি গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন,
“কী ব্যাপার কন তো, আফা?”
আমি মন খারাপ করে বললাম,
“আপনি তো জানেন কুলসুম আপা, আমি অনেক শান্তিপ্রিয় মেয়ে?”
“হ, হ, জানি। আফনে খুব ভদ্র মাইয়া।”
“আপনি কি জানেন, আমি আমার কাজিন আর নিজের গোটা তিনেক বন্ধুরা ছাড়া অন্য সব ছেলেদের থেকে দূরে-দূরে থাকি?”
কুলসুম আপা দাঁত কেলিয়ে হেসে বললেন,
“আফনেরে লইয়া আমার কোনো সন্দেহ নাই, আফা। আফনে হইলেন আমার দেহা সবচাইতে খাঁটি মাইয়া। কিন্তু আফনে হঠাৎ এইগুলান কন ক্যান?”
আমি গলা ঝেড়ে নিচু স্বরে বললাম,
“আসলে তাজ ভাইয়ের সাথে তো আমার দেখা হয়েছে অনেক বছর পর। আগে তো আমি ছোটো ছিলাম, আর এখন বড়ো হয়ে গেছি। তাই এখন উনি সামনে এলে আমার সঙ্কোচ হয়।”
“ভাইজান তো অনেক ভালা।”
আমার চোয়াল শক্ত হয়ে এল। লোকটা সবাইকে হাত করে নিয়েছেন! আমি কুলসুম আপাকে বুঝিয়ে বললাম,
“তাতে কী? উনিও তো এখন অন্য সব ছেলেদের কাতারেই পড়ে। সেজন্যই বললাম।”
“ও…। তয় অহন আমি কী করমু?”
কুলসুম আপা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
“এই সমস্যার কারণে আমি ওনার সামনে পড়তে চাই না। উনি যখন বাসায় থাকবেন, তখন আপনি একটু খেয়াল রাখবেন যে, কখন উনি রুম থেকে বেরোন। বেরোলেই আমাকে আগেভাগে জানিয়ে দিবেন। তাহলে আমি আর ওনার সামনে যাব না। পারবেন না?”
কুলসুম আপা কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
“পাড়মু। কিন্তু এক বাসায় থাইকা কয়দিন এমন করবেন?”
“ওসব আমার ব্যাপার। আপনি শুধু কাজটা ঠিকমতো করলেই হবে।”
“আইচ্ছা,” ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে বললেন কুলসুম আপা। ওনার মুখে চিন্তার ছাপ। আমি মনে-মনে নাচতে-নাচতে ওনার কাছ থেকে সরে এলাম। কুলসুম আপা যে কাজটা সত্যিই করবেন, এই নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। এই মহিলা আবার আমার দারুণ ভক্ত। আমার সবকিছুই তার কাছে বেস্ট মনে হয়। এ বাসায় কাজ করেন গত দুই বছর যাবত। কিন্তু তার একটা দারুণ সমস্যা আছে। তিনি হচ্ছেন সার্বজনীন আপা। তার অবশ্য কারণও আছে। তিনি শুধু আমাকেই আপা ডাকেন না। আম্মি, আমিরা আপু, মিনহা আপু, এমনকি আমিরা আপুর মাকেও আপা ডাকেন। আবার শুধু তাজ ভাইকেই ভাইজান ডেকে ক্ষান্ত নন। রাজ ভাই, সৌরভ ভাইয়া, হিমেল কাকা, মিনহা আপুর বাবা, ভাইয়া সবাই ওনার ভাইজান। ওনার এই অদ্ভুত স্বভাব কোনোভাবেই পরিবর্তন করা যায়নি। এজন্য প্রথম দিকে মজা করে সবাই ওনাকে আপা ডাকত। আর এখন সেটা সবার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অদ্ভুত হলেও আমার অবশ্য ব্যাপারটা খুব ভালোই লাগে। ওনার কথার ধরণ শুনতেও মজা লাগে। অশুদ্ধ ভাষায় কেমন সুর টেনে-টেনে কথা বলেন। ড্রয়িংরুমে এখনও আমিরা আপু আর মিনহা আপুর কথা শোনা যাচ্ছে। এখন আবার তাদের সাথে যোগ হয়েছে জুম্মান ভাইয়া। চেঁচামেচি শুনে বুঝলাম এরা টিভির চ্যানেল ঘুরানো নিয়ে ঝামেলা করছে। অথচ নিজেদের বাসায় কেউ সুযোগ পায় না। কারণ আন্টি সারাক্ষণ ইন্ডিয়ান সিরিয়াল নিয়ে বসে থাকেন। মা সিরিয়াল লাভার বলেই এরা তিন ভাই-বোন সুযোগ পেলেই এ বাসায় এসে টিভির রিমোট নিয়ে রীতিমতো মা’রামা’রি বাঁধিয়ে দেয়। আর আম্মি কাজের ফাঁকে একটু-আধটু হাঁক ছাড়ে। মাঝে আমি শুধু চেয়ে-চেয়ে এদের ড্রামা দেখি। ওদিকে যাওয়া যাবে না ভেবে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতেই দেখলাম তাজ ভাই রুম থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে এসে ড্রয়িংরুমের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। এক বাক্যে বললেন,
“পড়াশোনা নেই কারো?”
সঙ্গে-সঙ্গে তিন ভাই-বোন মূর্তির মতো নিশ্চুপ হয়ে গেল। সুরসুর করে একে-একে সবকটা বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। এদের মেলোড্রামা দেখে অভ্যস্ত আমার আর হাসিও পেল না। তাজ ভাই ড্রয়িংরুম থেকে হুট করে এগিয়ে এসে ডাইনিং টেবিলের ওপর থেকে একটা গ্লাস হাতে তুলে উঁচিয়ে ধরে শক্ত মুখে আমার দিকে তেড়ে আসতে-আসতে বললেন,
“এখানে কী? যা, পড়তে বোস।”
আমি চোখ বড়ো করে উলটো দিক ঘুরে দিলাম ভোঁ দৌড়। রুমে ঢুকেই ঠা’স করে দরজা লাগালাম। এই লোককে পাহাড়া দিবে কুলসুম আপা! কীভাবে? এই বিপজ্জনক ডিটেকটিভকে পাহাড়া দেওয়া তার কর্ম নয়। ধুর! আমার প্ল্যানটাই জলে গেল।

পরদিন সকালে ভার্সিটি যাওয়ার আগ পর্যন্তও তাজ ভাইকে বাসায় দেখলাম না। আম্মি আর রাজ ভাইয়ের কথোপকথনে বুঝলাম উনি সকাল-সকাল বেরিয়েছিলেন। এখনও পর্যন্ত ফেরেননি। আম্মি ফোন করার পর জানিয়েছেন পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেছেন। ব্রেকফাস্ট তাদের সঙ্গে করেই ফিরবেন। বেরোতে দেরী হচ্ছে বলে আমি যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করলাম। দুর্ভাগ্যবশত আমিরা-মিনহা আপু আর আমি আলাদা ভার্সিটিতে পড়ি। সৌরভ ভাইয়াও আলাদা। তবে জুম্মান ভাইয়া আর আমি একই ভার্সিটির স্টুডেন্ট। জুম্মান ভাইয়া এবার মাস্টার্সের স্টুডেন্ট। পড়াশোনায় খুব একটা মনোযোগী না হলেও, ক্লাস কামাই করেন না। আমার সুবিধা হচ্ছে, একই ভার্সিটিতে পড়ার দরুন আমাকে ভার্সিটিতে একা যাওয়া-আসার চিন্তা করতে হয় না। ভাইয়ার সাথেই যাওয়া-আসা করি। ছেলেটা একটু পাজি হলেও, এ কদিনে আমার প্রতি ওনার স্নেহের পরিমাণ আরও বেড়েছে। আমি একা রাস্তা পেরোতে পারি না, ভ্যাপসা গরম সহ্য করতে পারি না, অতিরিক্ত ঝামেলা সহ্য করতে পারি না। জুম্মান ভাইয়া এসব বিষয় খেয়াল রাখতে ভোলেন না। প্রতিদিনের মতোই আজও জুম্মান ভাইয়া ড্রয়িংরুমে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি ড্রয়িংরুমে যেতেই একগাল হেসে রওয়ানা হলেন। জুম্মান ভাইয়ার ক্লাস না থাকলে বা আগে শেষ হলেও, উনি ক্যাম্পাসে আমার জন্য অপেক্ষা করেন। আবার মাঝে-মাঝে আমার বেশি দেরী হলে আমাকে মেসেজ করে জানিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে এদিক-ওদিক ঘুরে এসে আমাকে নিয়েই বাড়ি ফিরেন। আজ আমার ক্লাস শেষ হলো দুপুর একটায়। জুম্মান ভাইয়াকে ক্যাম্পাসেই পেয়ে গেলাম। দুপুরে বাসায় ফেরার সময় ক্লান্ত থাকায় সারা রাস্তা আমি চুপচাপ চোখ বন্ধ করে সিটে পড়ে থাকি। জুম্মান ভাইয়াও চুপচাপ শুধু ড্রাইভ করেন। প্রয়োজন ছাড়া আমাকে একদম বিরুক্ত করেন না। তার এ আচরণগুলো আমার বেশ লাগে। আজও বাসায় ফিরলাম ক্লান্ত শরীরে। বাসায় ঢুকতেই বড়োসড়ো এক ঝ’টকা খেলাম। বিস্ময়ে থ হয়ে গেলাম। ডাইনিং রুমের একপাশে বিরাট একটা বুক শেলফ রাখা। কী সুন্দর তার কারুকাজ! দেখেই মন জুড়ে যায়। বুক শেলফের চেয়ে পাশে রাখা বইয়ের স্তুপ দেখেই আমার বেহুঁশ হবার জোগাড় হলো। তাজ ভাই আর রাজ ভাই মিলে বুক শেলফে বই সাজাচ্ছেন। পাশেই আম্মি আর মিনহা আপু দাঁড়িয়ে হা করে তাকিয়ে আছে। মূর্তির মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে চোখ দুটো ছানাবড়া করে আমিও ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আম্মি কোমরে হাত রেখে আমাকে বলল,
“দেখো আমার পা’গল ছেলে কী কাজ করেছে। ইয়া বড়ো বুক শেলফের সাথে বস্তা ভর্তি বই নিয়ে হাজির হয়েছে। এমন কাজও মানুষ করে?”
রাজ ভাই বললেন,
“মা, ওর ইচ্ছে হয়েছে তাই এনেছে। কী হয়েছে তাতে?”
“আনতে ইচ্ছে করলেই একসঙ্গে এত বই আনতে হবে? অল্প করে আনলে কি পরে আবার আনতে পারত না? না কি পরে আর পেত না এসব?”
তাজ ভাই এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় বই সাজানোয় মনোযোগ দিয়ে বললেন,
“বই পড়তে-পড়তে অভ্যাস হয়ে গেছে, আম্মি।”
“তো তুই কি এই বস্তা ভর্তি বই সব একসঙ্গে পড়বি? এতে তো বছর পার হয়ে যাবে।”
মিনহা আপু ঠোঁট টিপে চিন্তা করে বলে উঠল,
“তাজ ভাই তো ওই ডিটেকটিভ, থ্রিলার ধরণের বই পড়েন, তাই না? রোমান্টিকও পড়েন না কি? সব ধরণের বই দেখছি এখানে।”
তাজ ভাই স্বাভাবিকভাবেই বললেন,
“সবই পড়ি।”
“বাপ রে! ব্যস্ত মানুষ হয়ে এত সময় কোথায় পান আপনি? এ-ও সম্ভব!” চোখ বড়ো করে বলল মিনহা আপু।
তাজ ভাই বিদ্রুপ করে বললেন,
“টাইম মেইনটেইন করে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে জানলে সবই সম্ভব। তোর মতো রূপচর্চার পেছনে আজাইরা সময় নষ্ট করি না আমি। আটা-ময়দা-সুজি ঘষাঘষি বাদ দিয়ে ওই সময়টুকু বাঁচিয়ে রাখতে জানলে তোরও বই পড়ার সময় থাকত, বেকুব।”
রাজ ভাই হাসলেন। মিনহা আপুর মুখটা চুপসে গেছে। এই কথা অন্য কেউ বললে এতক্ষণে এই মেয়ে নিশ্চিত তুফান ডেকে আনত। কিন্তু এখানে অন্ধকার মুখে বলল,
“আমার এসব গল্পের বই পড়তে ভালো লাগে না।”
তাজ ভাই আবার শ্লেষের সুরে বললেন,
“তা লাগবে কেন? গেইম, মুভি, ভিডিয়ো যত হাবিজাবি আছে, তোরা তো ওসব গিলবি। গিলতে-গিলতে যেদিন বদহজম হবে, সেদিন বই পড়ার ইচ্ছে জাগবে। গাধা জেনারেশন!”
মিনহা আপু এবার গাল ফুলিয়ে চুপ মে’রে রইল। আম্মি আমাকে তাড়া দিলো রুমে গিয়ে গোসল সেরে নেওয়ার জন্য। নইলে আবার দুপুরের খাবারে দেরী হয়ে যাবে। আমার ইচ্ছে করছিল এত-এত বই নিজ হাতে শেলফে সাজাতে। কিন্তু এরা তো আমায় পাত্তাই দিচ্ছে না। তাই আম্মির কথামতো রুমে চলে গেলাম। গোসল সারলাম তাড়াহুড়ো করে। মাথায় এখন শুধু ওই বইয়ের স্তুপ ঘুরছে। গোসল সেরে বেরিয়ে ভেজা চুলগুলো আঁচড়ানোর সময় দরজায় টোকা পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম তাজ ভাই দাঁড়িয়ে। দরজা খোলাই ছিল। কিন্তু উনি হঠাৎ আমার রুমে কেন, বুঝতে পারলাম না। আমি প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। উনি ভেতরে ঢুকে আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। আমার দৃষ্টি এলোমেলো হলো। পরক্ষণেই উনি বললেন,
“শেলফ ভর্তি বই দেখে লোভ সামলাতে পারবি না জানি। কী, শেলফ থেকে বই পড়বি তো?”
আমার তো ইচ্ছে করছে শেলফের সব বই এখনই পড়ে শেষ করে বসে থাকি। অগত্যা আমি কাঁচুমাচু মুখে ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকালাম। উনি আমার দিকে একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে ধরলেন। আমি ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করলাম,
“কী এটা?”
“উত্তর এখানেই আছে। শেলফ থেকে বই পড়তে হলে এটা নিতে হবে,” চোখের ইশারায় ব্যাগ দেখিয়ে বললেন উনি।
আমি চিন্তিত মুখে ব্যাগটা হাতে নিলাম। উনি আর কথা বাড়ালেন না। ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসির রেখা ঝুলিয়ে যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই চলে গেলেন। আমি বিছানায় পা তুলে বসে ব্যাগের ভেতর উঁকি মেরে দেখে ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেললাম। কালো কাপড়! ব্যাগ থেকে কাপড়টা বের করলাম। কাপড়টার ভাঁজ খুলে আমি খানিক থমকালাম। কাপড়টাতে সাদা রংয়ের হ্যান্ড পেইন্টিংয়ে গুটি-গুটি অক্ষরে লেখা,‘বুক শেলফ পরিষ্কার রাখার কাপড়। হাত বদল করা নিষেধ। যে এর ভাঁজ খুলেছে, তার ওপর বুক শেলফ পরিষ্কার ও গুছিয়ে রাখার দায়িত্ব আরোপ করা হলো। দায়িত্বে হেরফের হলে বইয়ে হাত ছোঁয়ানোও নিষেধ।’
বারকয়েক লেখাটা পড়ে আমি বিস্ময় নিয়ে কাপড়টার দিকে তাকিয়েই রইলাম। এত ঢং করে আমাকে বুক শেলফের দায়িত্ব দেওয়ার মানে কী? আমাকে নিয়ে মজা করার নতুন ফন্দি না কি? কী জানি! উলটা-পালটা ভাবনা মাথায় চাপিয়ে বসলাম। আবার এ-ও ভাবলাম। যা-ই হোক। বই তো পড়তে পারব। আহ্, কত্ত বই! দেখলেই তো মনে আপনা-আপনি শান্তি চলে আসে। হুট করে কোত্থেকে যেন এসে জেমি আমার হাতের কাপড়টা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে টানতে শুরু করল। আমার হাতের সবই ওর খেলনা। আমি প্রশস্ত হেসে কাপড়টা ওর মাথায় ঘোমটার মতো পরিয়ে দিয়ে বললাম,
“নে, এবার তুই বুক শেলফের দায়িত্বে নিয়োজিত। গিয়ে শেলফের ওপর হাত-পা তুলে সারাদিন বসে থাক।”
জেমি মিয়াও, মিয়াও করে কাপড়টা হাত-পা দিয়ে খামচে ধরে দাঁত দিয়ে এলোপাথাড়ি কামড়াতে শুরু করল। কাপড়টা নিয়ে শুয়ে রীতিমতো গড়াগড়ি খাচ্ছে ও। আমি জিবে কামড় দিয়ে ওর থেকে কাপড়টা ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,
“হাত বদল নিষেধ। ছাড় বাপ, নইলে আমার সাধের বই পড়ার বদলে চেয়ে-চেয়ে শুধু দেখতে হবে। যেচে কলিজা ফুটো করতে চাই না।”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤

নোট: ভুলত্রুটি মার্জনীয়। #ক্যানভাসের_রমণী আগামীকাল দেওয়া হবে। সবাইকে রেসপন্স করার অনুরোধ রইল। হ্যাপি রিডিং।❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here