মনোহরিণী পর্ব -০৪

#মনোহারিণী
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

৪.
মনোহারিণী,
বিশের কোঠায় পা দিয়েই কি তুমি বড্ড বড়ো হয়ে গেছ, না কি বড়োদের মতো আচরণ করে বড়ো হতে চাইছ? তবে যা-ই করো, আমার চোখে তো তুমি সেই পঞ্চদশী কিশোরীই আছো। তফাত হচ্ছে, তখন ভেজা চুলগুলো ভালোভাবে মুছতে না, শুকাতে না; অথচ মাথাভর্তি মিশমিশে কালো চুল ছিল। কিন্তু এখন তুমি ভেজা চুলে সযত্নে চিরুনিও চালাচ্ছ; অথচ মাথায় চুলের পরিমাণ আগের তিনভাগের একভাগ। তোমার বাহিরটা বদলেছে, যদিও আমি চাইনি তুমি বদলাও। শোনো কেশবতী, ওই লম্বা কেশ সামলে রেখো। ভেজা কেশে ভুল করেও আর আমার সামনে আসার মতো ভুল কোরো না। ওই কেশে যে আমার ভয়াবহ মুগ্ধতা। এই মুগ্ধতা মাত্রা ছাড়ালে আবার বিপদ নিশ্চিত।
ইতি
সব চিঠির প্রেরক খুঁজতে নেই

চিরকুট পড়ে আমি তব্দা খেয়ে বসে রইলাম। বিকেলের দিকে একটু ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠেই হাতের মুঠোয় এই চিরকুটটা পেয়েছি। প্রেরক চেনার চেষ্টা করতে গিয়ে বারবার পড়ার পরও চিনতে পারলাম না। শেষে নামও দেওয়া নেই। লেখা, সব চিঠির প্রেরক খুঁজতে নেই। এ আবার কেমন কথা? আশ্চর্য! এ বাসায় চিরকুট দেওয়ার মতো কে আছে? তা-ও আবার এই ধরণের চিরকুট। প্রথমে ভাবলাম আমিরা আপুদের মধ্যে কেউ মজা করার জন্য দিয়েছে? কিন্তু তাদের সবার হাতের লেখা আমি চিনি। সৌরভ ভাইয়া হলে চলে গেছে, রাজ ভাইও দুপুরের পরপর চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিল। বাসায় আছে শুধু কুলসুম আপা, আম্মি আর তাজ ভাই। তাজ ভাইয়ের কাজ? নাহ্,তা তো একদমই অসম্ভব। উনি এই প্রেমময় চিরকুট দিবেন আমাকে? উনি তো একটা ভুলভাল চিরকুটের জন্য আজও আমাকে খোঁচা মেরে কথা বলেন। চিরকুট যে লিখেছে, সে মনের গভীর অনুভূতি থেকে লিখেছে। এখানে এমন কে-ই বা আছে? তাজ ভাই না নিশ্চিত, তবু যেহেতু উনি ছাড়া এখানে কেউ নেই, সেহেতু খোঁজ নিয়ে দেখা যায়। ওনার হাতের লেখা কেমন ছিল ভুল গেছি। মিলিয়ে দেখলে নিশ্চিত হতে পারব। কিন্তু কীভাবে? যেচে গিয়ে যদি ধরা খাই? কাগজটা মুঠোয় নিয়ে চললাম তাজ ভাইয়ের ঘরের দিকে। আম্মিকে দেখছি না। আমিরা আপুদের বাসায় গেছে বোধ হয়। তাজ ভাই কি রুমে আছেন? রুমের দরজা তো হা করে খোলা। বাসায় থাকলে উনি দরজা এভাবে খুলে রাখেন না, সুতরাং এখন বাসায় নেই। তবু সাবধানের মা’র নেই। দরজায় দাঁড়িয়ে আমি ভেতরে উঁকি মে’রে সারা ঘরে চোখ বুলালাম। উনি নেই। মনে-মনে বেশ খুশি হলাম। পা টিপে-টিপে রুমে ঢুকে স্টাডি টেবিলের কাছে গেলাম। ভ্রুকুটি করে পুরো টেবিলে চোখ বুলিয়ে একটা নোটপ্যাড নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই কোমড়ে শক্ত কোনো বস্তুর চাপ অনুভব করলাম। সঙ্গে-সঙ্গে চকিতে ঘুরে দাঁড়ালাম। এমনভাবে চমকে উঠলাম যে দু’পা পেছাতে গিয়ে টেবিলের সাথে জোরেশোরে ধাক্কা খেয়ে আহাম্মক বনে গেলাম। চোখ দুটো ছানাবড়া করে শুকনো ঢোক গিলে কিছু বলার আগেই তাজ ভাই আমার কোমরে ঠেকানো পি’স্তলটা শক্ত করে চেপে ধরলেন। তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে ঝুলিয়ে বললেন,
“স্বয়ং ডিটেকটিভের ঘরে চু’রি করতে ঢুকে পড়েছিস? এত সাহস?”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তুতলিয়ে বললাম,
“আমি কী চু’রি করব?”
“আমি না থাকলে তো করতি। ভাগ্যিস ছিলাম। তা কী চু’রি করতে এসেছিলি, শুনি?”
আমি আলগোছে হাতের কাগজটা ওড়নার নিচে লুকিয়ে ফেললাম। কাঁদো কাঁদো মুখ করে ইনিয়ে-বিনিয়ে বললাম,
“চু’রি করতে আসিনি। জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম ওই হ্যান্ড পেইন্টিংয়ের এত সুন্দর কাপড়টা শেলফ পরিষ্কার করে নষ্ট করব কি না।”
“চো’রের মতো এলি কেন তুই?” ত্যাড়াভাবে ফের প্রশ্ন করলেন উনি।
আমি অসহায় মুখ করে বললাম,
“আপনাকে ভেতরে দেখছিলাম না বলে এসেছি। এটা সরান না।”
উনি আমার কথা না শোনার ভান করে পি’স্তলটা আরও জোরে চেপে ধরলেন। কোমরে এবার হালকা ব্যথাও পেলাম। এরপরও উনি থামলেন না। অপর হাত টেবিলে ঠেকিয়ে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে আমাকে সবদিক থেকে আটকে ফেললেন। আমি জড়োসড়ো হয়ে শুকনো ঢোক গিললাম। উনি গভীর দৃষ্টি আমার মুখে নিবদ্ধ করে নিচু স্বরে বললেন,
“এই পিচ্চি, এখনও সেই ভীতুই আছিস? খুব তো বকবক শিখেছিস। তো ভীতু স্বভাব যায়নি কেন?”
ওনার নিঃশ্বাস আমার মুখে পড়তেই আমি শিউরে উঠলাম। দম বন্ধ হয়ে এল। হঠাৎ ওনার এমন অদ্ভুত আচরণে পি’স্তলের ভয় বেমালুম ভুলে হতবাক হয়ে গেলাম। ছাড় পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলাম। কোনোমতে বললাম,
“আমায় যেতে দিন, তাজ ভাই।”
উনি কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আদেশের সুরে বললেন,
“অনুমতি ব্যতীত আমার কাজের কোনো জিনিসে কখনও হাত দিতে যেন না দেখি। মনে থাকবে?”
আমি বাধ্য মেয়ের মতো দ্রুত গতিতে ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকালাম। উনি বেশ শান্ত ভঙ্গিতে সোজা হয়ে আমার থেকে দু’পা সরে দাঁড়ালেন। এতক্ষণে যেন আমি শান্তিতে শ্বাস নিতে পারলাম। মুক্তি পেয়ে দ্রুত চলে যেতে নিতেই উনি আমার বাঁ হাতটা মুঠোয় চেপে ধরে পি’স্তলটা আমার হাতে গুঁজে দিলেন। অতঃপর খুব মিষ্টি করে হেসে বললেন,
“কাল গ্রামে যাব ‌তো। অলি আগেই একটা পি’স্তলের বায়না ধরেছে। তাই একশো টাকা দিয়ে কিনে এনেছিলাম। তোর কাছে রাখ তো, পিচ্চি বলদ।”
আমি এবার যেন পুরোপুরি রকম বোকা বনে গেলাম। বিস্ময়ে ‘থ’ হয়ে স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। উনি আমার বিস্ময়কে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে সামনে থেকে সরে গিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লেন। ল্যাপটপ খুলতে-খুলতে মহাসুখে গান ধরলেন,
“তোমার এলোমেলো চুলে
আমার সাদা মনে
হারিয়ে যেতে চাই
কোনো হুড তোলা রিকশায়-”

লোকটার গানের গলা বেশ সুন্দর। কিন্তু এখন ওসব শোনার মতো অনুভূতি নেই আমার। পি’স্তলটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে আমি রাগে গজগজ করতে-করতে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। বলা তো যায় না, কিছু বললে আবার না সত্যিকারের পি’স্তলই চেপে ধরে। না বাবা, রিস্ক নেওয়া একদম চলবে না। কুলসুম আপা আমার হাতের পি’স্তল দেখে দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে উঠলেন,
“ও আফা, আপনে এই খেলনা গু’ল্লি কই পাইছেন? আমার পোলার আছে একখান। গতমাসে বেতন পাইয়া কিন্না দিছিলাম। বা’ন্দরের বাচ্চায় প্রথম দিনেই ডা’ন্ডা ভাইঙ্গা ফেলছে। অহন ওই ভাঙ্গাডা দিয়াই খেলে। কিন্তু আপনে কিনছেন কার লাইগা? আপনের কি এগুলা দিয়া খেলার বয়স আছেনি?”
আমি হতাশ চোখে চেয়ে ভাবলাম, কুলসুম আপা একবার দেখেই বুঝে গেল এটা খেলনা পি’স্তল। আর আমি কি না ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পড়েছিলাম! সত্যিই কি এত বলদ আমি? এ-ও কী মানা যায়! অবশ্য আমার ভাবনাতেও বোধ হয় তেমন ভুল ছিল না। উনি ডিটেকটিভ মানুষ, পি’স্তল থাকাটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। রাগে-দুঃখে ঠোঁট উলটে পি’স্তল দিয়ে বার কয়েক কপাল চাপড়ালাম।

প্রতি সন্ধ্যায় আমিরা আপুরা তিন ভাই-বোন এ বাসায় চলে আসে চায়ের আড্ডা বসানোর জন্য। আজও এল। আমি তখন রুমে ছিলাম। মিনহা আপু আমায় ডেকে গেল চা খাওয়ার জন্য। গিয়ে এক কাপ চা নিয়ে সোফায় পা তুলে আরাম করে বসলাম। জুম্মান ভাইয়া ইতোমধ্যে আড্ডার আসর জমিয়ে ফেলেছেন। আড্ডার টপিক, তার এক্স গার্লফ্রেন্ড কেমন ভঙ্গিমায় কথা বলত। এখন উনি শরীর দুলিয়ে-দুলিয়ে তার এক্স গার্লফ্রেন্ডের ঢং করে কথা বলার ভঙ্গিমা শোনাচ্ছেন। আমি প্রথমে শুনেই ফিক করে হেসে উঠেছি। আমিরা আপু আর মিনহা আপু রীতিমতো হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আমি মুখ কুঁচকে ফেললাম। চিনি কম পড়েছে। এমনিতে আমি মিষ্টি জাতীয় খাবার খুব কম খেলেও, চায়ে চিনি কম হলে খেতে পারি না। চায়ের কাপটা রেখে আমি গেলাম চিনি আনতে। চিনি এনে চায়ে মেশানোর সময় এলেন তাজ ভাই। উনি আসতেই জুম্মান ভাইয়াসহ তার দুবোন মূর্তির মতো নিশ্চুপ হয়ে গেল। তাজ ভাই এসেই বললেন,
“চা খেতে এতক্ষণ লাগে? হেসে তো পুরো অ্যাপার্টমেন্ট উড়িয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। পড়াশোনা নেই?”
মিনহা আপু গাল ফুলিয়ে বলল,
“সবসময় এত পড়া-পড়া করেন কেন, তাজ ভাই? এসে হতে তো একটু আমাদের সাথে বসে আড্ডাও দিলেন না।”
তাজ ভাই মিনহা আপুর মাথায় চাটি মেরে বললেন,
“তোদের আড্ডার কোনো মাথামুণ্ডু আছে? পড়ার সময় নাচতে-নাচতে আসিস আড্ডা দিতে। ফাঁকিবাজের দল।”
জুম্মান ভাইয়া এবার হেসে বললেন,
“আরে ব্রো, বসো না। বহু বছর তোমার সাথে আড্ডা হয় না। এখন আমরা সবাই বেশ বড়ো হয়ে গেছি, একসাথে আড্ডায় বসাই যায়। তাই না?”
তাজ ভাই আমার দিকে একবার তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বললেন,
“সবাই বড়ো হয়ে গেছিস? হাউ ফানি!”
আমিরা আপুও এবার ওনাকে বসানোর জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন। বেশিক্ষণ অনুরোধ করতে হলো না। উনি এসে আমার পাশের খালি জায়গায় বসে পড়লেন। সবশেষে আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার চিনি মেশানো চা আমার আগেই উনি নিজের হাতে নিয়ে চুমুক দিয়ে বসলেন। ওনার এহেন কান্ডে আমি বোকা হয়ে শুধু বললাম,
“আমার চা।”
উনি চায়ের কাপে দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“চায়ে তোর নাম লেখা আছে?”
জুম্মান ভাইয়া চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,
“কুলসুম আপা, এখানে আরেক কাপ চা দিয়ে যান তো।”
আমি গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম। তাজ ভাই জুম্মান ভাইয়াকে বললেন,
“বুঝলি জুম্মান? এই ধরণের মহিলাদের ভুল করেও বিয়ে করবি না। দেখ, চায়ে পারলে বয়াম উলটো করে চিনি ঢালে। একদিকে তোর দুদিন পর-পর চিনি কিনতে হবে। আরেকদিকে বউয়ের ডায়াবিটিস হলে পকেটের সব টাকা দোকানদারের সাথে-সাথে আবার ডক্টরের পকেটেও ট্রান্সফার হবে। তোর অবস্থাটা কী হবে ভাবতে পারছিস? নিজের ইনকাম করা টাকা সব গোল্লায় যাবে। তাই বিয়ে বা প্রেম করার আগে জেনে নিবি মেয়ে চিনি কম খায় কি না।”
ওনার কথা শুনে জুম্মান ভাইয়া, আমিরা আপু আর মিনহা আপু দারুণ উৎসাহে হাসতে-হাসতে ওনার সাথে তাল মিলাতে লাগলেন। এদিকে আমি ভেতরে-ভেতরে রাগে ফুঁসে উঠলেও, পালটা জবাব দিতে পারলাম না। কুলসুম আপা আবার চা দিয়ে গেলেন। আমি সেই চায়ের কাপ ছুঁয়েও দেখলাম না। তাজ ভাই আড্ডা জমিয়েছেন বেশ। মাঝে বুঝি বেখেয়ালে এক পলক তাকিয়েছিলেন আমার দিকে। ওনাদের আড্ডায় যোগ দেওয়া আর হলো না আমার। তাল মেলাতে পারিনি যে। এই প্রথম আমিরা আপুদের আড্ডায় আমি চুপ মে’রে বসে রইলাম। তবে বেশিক্ষণ বসলাম না। আম্মিকে ডাকতে চলে গেলাম আমিরা আপুদের ফ্ল্যাটে। সেখানে গিয়ে আবার আমিরা আপুর মা আর আম্মির সাংসারিক বকবক শুনে কাটিয়ে দিলাম অনেকটা সময়। আমিরা আপুরা তাদের বাসায় ফিরে আসার পর আম্মি উঠল। আমাকে মিনহা আপু একটা কাজে ডাকায় আম্মি আমার আগেই চলে গেল। আমি আমিরা আপুদের বাসা থেকে বের হলাম তার কিছুক্ষণ পর। আগামী পরশু মিনহা আপুর বান্ধবীর জন্মদিন। ধুমধাম করে সেলিব্রেশন হবে। মিনহা আপু সেখানে আমাকে নিয়ে যাবে। ওসব লোকজনের সমাগম আমার মোটেও ভালো লাগে না। তবু মিনহা আপুর অনুরোধে রাজি হতেই হয়েছে। পরশু ওখানে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যে আমার ওভার থিংকিং মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, তা এখনই টের পাচ্ছি। এসব বিষয়ে আমি অভ্যস্ত। মিনহা আপুর বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ঠিক কেমন মানুষের সমাগম থাকবে ওসব ভাবতে-ভাবতেই আমি নূর আঙ্কেলের ফ্ল্যাটের দিকে যাচ্ছিলাম। আচমকা একটা শক্ত হাত আমাকে টেনে নিল পাশের লিফটের ভেতর। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার হৃদপিন্ড লাফিয়ে উঠল। ভয়ে চিৎকার দিতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম। মুখও বন্ধ করে দিয়েছে। চোখ দুটো ছানাবড়া করে আমি সামনের ব্যক্তির দিকে তাকাতেই ভয়ের সাথে চরম রাগও উঠে গেল। মুখ থেকে হাত সরিয়ে ভদ্র ছেলেটির মতো তাজ ভাই আমার কাছ থেকে সরে দাঁড়ালেন। কপাল কুঁচকে বললেন,
“হার্ট ফেইল করে ফাঁসিয়ে দেওয়ার ধান্দা? পিচ্চি পোলাপান নিয়ে দেখছি ভয়ানক রিস্ক।”
আমার হৃদপিন্ড তখনও শান্ত হয়নি। ভয়টা বাড়াবাড়ি রকমের যে। চাপা রাগটা আর চেপে রাখা হলো না। রেগেমেগে বললাম,
“সমস্যা কী আপনার? এভাবে ভয় দেখালেন কেন?”
উনি ভাবলেশহীন মুখে বললেন,
“ভয় দেখালাম না কি? তুই না বড়ো হয়ে গেছিস?”
“এভাবে লিফটে কেন এনেছেন আমায়?”
“আমি?” চূড়ান্ত অবাক হবার ভান করে বললেন উনি।
আমার মেজাজ এতে তরতর করে বেড়ে গেল।
“ত্যাড়ামি করছেন কেন? কোথায় যাচ্ছেন আমাকে নিয়ে?”
“তোর জন্য জামাই খুঁজতে। তোর মতো বলদ মেয়ের জন্য তো জামাই খোঁজা দুষ্কর হয়ে পড়বে। তাই ভাবলাম এখনই আমি খোঁজ লাগাই। ফুটপাত থেকে সুন্দর দেখে এক পাগল-ছাগল খুঁজে পেলেই, আলহামদুলিল্লাহ্।”
লিফট গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে থেমে গেছে। আমি চরম বিরক্তি নিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তাজ ভাই আমাকে বের হতে বলতেই আমি ত্যাড়াভাবে বললাম,
“আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না। বাসায় যাব। জোর দেখাবেন না তো।”
উনি কেমন রক্তচক্ষু করে তাকালেন। এতেই আমি দপ করে নিভে গেলাম। কাঁদো-কাঁদো মুখ করে লিফট থেকে বেরোতে-বেরোতে বিড়বিড় করে বললাম,
“খালি আলগা রাগ। আপনি ডিটেকটিভ, না মাফিয়া?”
উনি আমার পেছন-পেছন বেরিয়ে এসে বললেন,
“দুটোই।”
লিফট থেকে বেরিয়ে আর আমি পা থামাতে পারলাম না। বিরক্তিকর লোকটা আমার এক হাত মুঠোবন্দী করে সামনে হাঁটা শুরু করলেন। গেইটের দারোয়ান দুটো কেমন চোখে যেন তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে। আমি হাত মোচড়াতে-মোচড়াতে ছাড়ানোর চেষ্টা করে চাপা স্বরে বললাম,
“হাত ছাড়ুন।”
উনি তা না শোনার ভান করে চুপচাপ পা চালালেন। ডান দিকের রাস্তার কিনারা ধরে হেঁটে চলেছেন। আমার কোনো কথাই উনি পাত্তা দিচ্ছেন না। এই মুহূর্তে আমার ঠিক রাগ করা উচিত, বিরক্ত হওয়া উচিত, না কাঁদা উচিত বুঝে ওঠা মুশকিল হয়ে পড়ল। এ তো পুরো রোবটের মতো সোজা হয়ে হেঁটেই চলেছে। শেষে আমি অসহায় মুখে বললাম,
“আম্মি খুঁজবে।”
উনি এতক্ষণে মুখ খুললেন। তা-ও ছোট্ট একটা শব্দ করলেন,
“উঁহু।”
আমি ঠোঁট উলটে অধৈর্য হয়ে বললাম,
“কোথায় যাচ্ছেন তা তো বলুন। এমন করছেন কেন আপনি?”
উনি মুঠোয় ধরা আমার হাতটায় মৃদু চাপ দিয়ে অতিশয় স্বাভাবিক গলায় বললেন,
“গাড়ির তলায় পি’ষ্ট হতে না চাইলে মুখ বন্ধ রাখ।”
আমার ইচ্ছে হলো নিজেই গিয়ে গাড়ির তলায় ঢুকে পড়ি। এতটা বিরক্তিকরও মানুষ হতে পারে? ওনার তো এমন আচরণ করার কথা না। এ তো সম্পূর্ণ নতুন তাজ ভাই, যেন অন্য কেউ। আগেও আমাদেরকে জ্বালাতেন, কত মজা করতেন। কিন্তু তখন এমন বিরক্ত লাগত না। এখন যেন ওনার আচরণগুলো কেমন বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে। অথচ আমার নিশ্চিত ধারণা ছিল, সুইডেন থেকে ফিরে উনি আমার সাথে কথাও বলবেন না। আসলে হলোটা কী? আশ্চর্য! বেশ কিছুটা পথ হাঁটার পর একটা নিরিবিলি দোকানের সামনে এসে উনি পা থামালেন। চা, পানের দোকান। লোকজন নেই বললেই চলে। দোকানদার বসে ঝিমাচ্ছেন। তাজ ভাই উঁচু গলায় ডেকে বললেন,
“মামা, দুটো চা দিন তো।”
দোকানদার চকিতে মাথা তুলে তাকালেন। প্রশ্ন করলেন,
“রং চা, না দুধ চা?”
“একটা রং চা,‌ আরেকটা দুধ চা। রং চায়ে চিনি কম দেবেন।”
“আচ্ছা মামা। বসেন আপনারা”
তাজ ভাই আমাকে বসতে ইশারা করলেন। আমি টাইট হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে নিচু স্বরে বললাম,
“আপনি এই চা খাওয়ার জন্য এতদূর হেঁটে এসেছেন? আমি চা খাব না, বাসায় যাব।”
উনি তার থেকেও নিচু স্বরে বললেন,
“বাসায় জামাই রেখে এসেছিস, না কি দু মাসের বাচ্চা? আজাইরা মেয়ের এত তাড়া কিসের?”
“কথায়-কথায় আমাকে পচানোর জন্য লেগে পড়েন কেন আপনি?”
“বলছি তোর এই সাহস বাড়ানোর মতো মহান কাজটা কে করেছে বল তো? আগে বিড়াল হয়ে থাকতি, আর এখন কি শেয়াল হবার পাঁয়তারা করছিস?”
দোকানদার চা এগিয়ে দিয়ে তাজ ভাইকে বললেন,
“বউ রাগ করছে না কি, বাপ?”
তাজ ভাই আমার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে ধরেছিলেন। দোকানদারের কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই হাসিমুখে জবাব দিলেন,
“পিচ্চি মানুষ হলে এই জ্বালা, মামা।”
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। এমনভাবে উত্তর দিলেন, যেন আমি সত্যি সত্যিই ওনার বিয়ে করা বউ। চায়ের কাপটা শক্ত করে ধরে আমি আনমনে বিড়বিড় করে বললাম,
“আপনাকে কিছুতেই চিনতে পারছি না, তাজ ভাই। কেমন অদ্ভুত লাগছে!”
উনি মুচকি হাসলেন। বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় সেই হাসির রেখাটা স্পষ্ট ধরা পড়ল। নিঃশব্দে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে উনি নিজেও বিড়বিড় করলেন,
“অদ্ভুত!”

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।🖤

(ভুলত্রুটি মার্জনীয়। সবাইকে রেসপন্স করার অনুরোধ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here