#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-১৫
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞
দিনরাত পরিবর্তন রিশাদের চরিত্রে সেই সাথে মেহউইশেরও। একজন দিনভর বাড়িতে পা রাখে না অন্যজন নির্জনকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। রিশাদ নিজের কাজে এতোটাই মগ্ন হয়ে পড়েছে তার আর পেছনের ভাবনা মাথায় আসেনি। ডিভোর্স এখনও তার নীলিমার সাথে এ কথাও বেমালুৃম ভুলে বসে আছে সে। টাকা খরচ করে মেহউইশের সাথে রেজিস্ট্রি হয়ে গেলেও সেটা নিয়ে নীলিমা যে কোন সময়েই কেইস করতে পারে। আর ঠিক এই ব্যাপারটাকেই সে কাজেও লাগিয়েছে।নীলিমা তার বাবার সহযোগিতা না পেয়ে উকিল বন্ধুর সাহায্যে রিশাদকে মেসেজ পাঠিয়েছে নির্জনকে চেয়ে। রিশাদের নিজেরও বাবার সাথে সম্পর্ক ঠিক নেই তাই নিরুপায় হয়ে নীলিমাকে সামনাসামনি কথা বলার জন্য বলেছে। কক্সবাজারে নিজের হোটেলেই সে দেখা করার কথা জানিয়েছে। উঁচু উঁচু পাহাড়ের ফাঁকে একটা দুটো ঘর তার সাথে হাজারো প্রজাতির ছোট বড় গাছে ঘেরা জঙ্গল। পাহাড়ি ঢালু আঁকাবাকা পথ সে পথে চলার মত যানবাহন খুব কম। এলাকার পাহাড়ি লোকজন পায়ে হেঁটেই চলাচল করে বেশি। এদিকটাতে আবার পর্যটকদের আনাগোনাও নেই তেমন তাই হয়তো রিশাদ এই এলাকাটাই পছন্দ করেছিলো নিজের একটা বাড়ির জন্য ; এখন সেই পছন্দটাই তার কাজে এলো খুব। বাবার সাথে সংঘর্ষ বড্ড ভারী কাজ তবুও সে এখন পর্যন্ত স্বস্তিতেই আছে। একটু চতুরতার কারণে আজ সে সর্বস্বান্ত হতে হতেও হয়নি। বাবা যখন পুরো দেশের ব্যবসাটাকেই তার কাঁধে দিলো তখনই সে একটু একটু করে নিজের শখের জায়গাগুলোকে পূরণ করার চেষ্টা করলো৷ কিছু চেষ্টা সফল হলো তো কিছু অপূর্ণের খাতায় রয়ে গেল। সেই অপূর্ণ শখের একটা ছিলো তিশমার সাথে ঘর বাঁধার। বাবার সম্মানে লেগেছিলো মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েকে খান বাড়ির বউ করে আনতে। এখন নিশ্চয়ই সম্মান বেড়েছে খান বাড়ির বউ অন্য মেয়ের সাথে পালিয়েছে বলে! আবার লেগেছে সম্মানে ছেলে এক নার্স বিয়ে করেছে বলে। ভাগ্যিস কক্সবাজারে হোটেলটা নিজের নামেই করা হয়েছিলো আর চট্টগ্রামের বাড়িটা। নয়তো আজ রিশাদকে হয়তো পথের ফকির হয়ে ছেলে,বউ নিয়ে ঘুরতে হতো। সূর্যটা ঠিক মাথার ওপর যখন টগবগে হয়ে মস্তিষ্ক গলিয়ে দেবার পায়তারা করছিলো ঠিক তখনি ফুপুর আসা একটা মেসেজ মাথার ওপর শীতল এক টুকরো মেঘ ছড়িয়ে দিলো। মেহউইশ নাকি তার খোঁজ করছিলো। দুপুর হয়েছে খেতে আসবে কখন তাই জিজ্ঞেস করছিলো ফুপুকে। ভালো লাগলো জেনে কেউ তার খাওয়ার খোঁজ নিচ্ছে। চারদিকে যখন হাহাকার আর শূন্যতার পাহার তখন মেহউইশের এইটুকু খোঁজ তার কাছে সুখের বর্ষণ মনে হলো। যেই মানুষটার জীবনে সে ঘোর শত্রু সেই মানুষটাই তার খবর রাখছে। হোটেলের কাঁচ-ঘেরা অফিসরুমটা থেকে এক টুকরো নীলাকাশ দৃষ্টিগোচর হয়। সেই আকাশটার দিকে তাকিয়ে একটা লাইন আওড়ায় রিশাদ,, তুমি আকাশের বুকে বিশালতার উপমা।
বহুদিন পর গলায় সুর টেনেছিলো সে কিন্তু হতভাগার সময় অসময়েই পরিণত হয় সর্বদা। নীলাকাশের বুকে কালো মেঘের মত বেজে উঠে ফোনটা। স্ক্রীণে ভাসে ‘নীলিমা’ নামটা। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে চোখদুটো বিড়ালছানার মত গোল গোল হয়ে আসে। আপাতত এই ফোনকল এভোয়েড লিস্টেই থাক যেমনটা আছে বাবার। হিপোক্রেসি করা লোকগুলো তাকেও শিখিয়েছে হিপোক্রেসি করা, ধোঁকা দেওয়া আর নিজ প্রয়োজনে অন্যকে ব্যবহার করা।
ছোট ছোট আঙ্গুল বড় আঙ্গুল চেপে ধরেই বিশ্বজয়ের হাসি দেয়। আবার একটুখানি ওড়নার কোণা বহুকষ্টে মুখ অব্ধি নিতে পেরেই সে কি আনন্দ! মেহউইশ এই প্রথম দেখছে এই আনন্দ এতোটা কাছ থেকে। ভালোবাসার অংশ বুঝি এমনও হয়! ভুবনভোলানো হাসি কচি দুই ঠোঁটের মাঝে। দুপুরের খাবার বেড়ে ফুপু সেই কখন থেকে ডেকপ চলছে মেহউইশকে। তার কানে যেন ফুপুর স্বর একটুও পৌঁছায়নি৷ সে তো ছোট্ট নির্জনের সাথে খেলায় ব্যস্ত। একটু আগেই সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘ফুপু নির্জনের বাবা কি আজকেও খেতে আসেনি?’
ফুপু মেহউইশের দিকে কিছু সময় তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিলেন৷ মেয়েটাকে প্রথম দিন থেকেই তাঁর ভালো লেগেছিলো। চোখ,নাক,মুখ ভালোই মেয়েটার আবার গায়ের রঙটাও দারুণ৷ যদিও রিশাদের পাশে মেয়েটাকে খুবই ছোট লাগে আবার দেখতেও তত মানানসই নয়। দেখতে সুন্দর সবসময়ই কি মানানসই হয়! নিজেই ভাবে সে৷ তাকে তো বেশ মানাতো ওই লোকটার পাশে তাতে কি সবটা সুন্দর হলো! না হোক, নিজের জীবন নিয়ে এখন আর আক্ষেপ নেই তবে রিশাদটাকে সে বড্ড ভালোবাসে। ভাবীর মৃত্যুর পর সে আর জেবুন্নেসাই তো ছেলেটাকে আগলে নিতে চেয়েছিলো কিন্তু হলো কই! ছেলেটা বড় হলো আয়ার কাছে, ফুপুর আর খালা দুজনেই দু দিকের বাসিন্দা হয়ে পর হয়ে গেল তার কাছ থেকে। এই মেয়েটা থাক তার দীর্ঘজীবনের একমাত্র সঙ্গী। স্মিতহাস্যে ফুপু মেহউইশকে আবারও ডাকলেন, এবার মেহউইশের ঘরে ঢুকে। ফুপুর ডাকে নির্জনের সাথে খেলা থামিয়ে খাওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে পড়লো মেহউইশ আর নির্জনকে নিয়ে ফুপু আনতুংয়ের কাছে দিলেন। বাইরে রোদ অনেক তাই বারংবার করে বলে দিলেন কড়িডোরের বাইরে যেন না যায়৷ খাবার টেবিলে নিঃশব্দে খেতে লাগলো মেহউইশ তা দেখে ফুপু বললেন, ‘আমরা কি একটু কথা বলতে পারি?’
‘জ্বী’ সায় দিলো মেহউইশ।
‘তোমাদের বিয়ে কবে হয়েছে?’
মেহউইশ মুখের খাবার গিলে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে জবাব দিলো, ‘আজ সপ্তম দিন চলছে।’
‘বিয়েটাতে তোমার কোন মত ছিলো না তাই না!’
‘হুম’ ছোট্ট করে জবাব দিলো মেহউইশ সেই সাথে তার বদনখানি মলিন হয়ে গেল।
‘রিশাদ ভালো করেনি এটা।’
মেহউইশ শুনলো কথাটা কিন্তু কিছু বলল না। তার দৃষ্টি খাবারের প্লেটে আঙ্গুল নড়ছে ভাতে।
‘তুমি চাইলে আমি তোমাকে তোমার বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারি।’ মেহউইশ চোখ মেলে তাকালো ফুপুর দিকে। অবাক সেই চাহনি দেখে ফুপি হাসলেন ঠোঁট টেনে৷ শব্দহীন হাসির ফোয়ারা যা রহস্যময়ী মনে হচ্ছে মেহউইশের। সে বুঝতে পারলো না ফুপু এমন কথা কেন বলছেন?
‘ মিথ্যে বলছি না। সত্যিই আমি তোমাকে চলে যেতে সাহায্য করবো৷ ছেলেটা তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছে তা নিজেই বলেছে আমায়। তার সেই বলাতে পাপবোধ ছিলো, অনুতপ্ত কিন্তু সে তার সেই পাপ মোচন করার ইচ্ছা দেখায়নি৷ আমি তার মা না হলেও মায়েরই মতন। সুযোগ থাকতে কেন তাকে পাপী হয়ে থাকতে দেব? রিশাদের দুই বিয়ে হয়ে গেছে এই বয়সেই তবুও চাইলেই আরো এক বিয়ে করাতে পারবো৷ এমন মেয়েই পাবো যে সব জেনেশুনে নিজ ইচ্ছায় তাকে বিয়ে করবে। তবে এমন সুযোগ থাকতে কেন তোমায় অযথা বন্দী জীবনে বেঁধে রাখবো!’
রিশাদের ফুপু যা বলছে মেহউইশ জানে এ সবই সম্ভব । রিশাদ টাকার কুমির তাই জাগতিক সুখ কেনা তার জন্য কষ্টকর হবে না৷ কিন্তু রিশাদের সকল জুলুমের পরও একটা ব্যাপার মেহউইশের জীবনে ভালো হয়েছে। রিশাদ তার মা, ভাইয়ের দ্বায়িত্ব পালন করছে খুব ভালো করে। রিশাদের কাছ থেকে পালিয়ে গেলে হয়তো মেহউইশ বন্দী জীবন থেকে রেহাই পাবে কিন্তু ইভানকে কি ফিরে পাবে? হাসপাতালের চাকরিটা কি আর পাওয়া যাবে? মা আর ভাইয়ের জীবনের পারমানেন্ট একটা ব্যবস্থা কি করতে পারবে? এতদিন যা সহজ ছিলো আজ মুক্তির কথা শুনেও কেন তা কঠিন লাগছে! জীবন মানেই তো সংগ্রাম বাবার মৃত্যুর পর থেকে সে এই কথাটাকে মেনেছিলো। তবে আজ কেন সেই সংগ্রাম করতে ভয় লাগছে! ইভান অন্যকারো হয়ে গেছে বলে নয়তো? তাহলে কি তার সকল শক্তির মূল ইভান ছিলো! খাওয়া আর গলা দিয়ে নামবে বলে মনে হয় না। এই পাহাড়ি বাড়ির খোলা বারান্দার ডাইনিংয়ে বসে তৃপ্তি সহকারে খাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আজ তিক্ত স্বাদ লাগছে খাবারে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেহউইশ তা দেখে ফুপু বললেন, ‘ সে কি! খাওয়া ছেড়ে উঠছো কেন মেয়ে? আমি সুযোগ করে উঠতে পারছিলাম না বলে এই সময়ে কথাগুলো বললাম। প্লিজ কষ্ট নিও না মনে৷ আমি চাই রিশাদের কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে তুমি এ জীবনে আটকে থাকো এতে হয়তো তোমার ভাঙা মনের অভিশাপ পড়বে আমার ছেলেটার উপর।’ ফুপুর বলা প্রতিটা কথায় মেহউইশ ভীষণ আকুতির সুর শুনতে পেল। কত বড় সৌভাগ্যবান রিশাদ ভেবেই অবাক হয় মেহউইশ। ওই ছেলেটার মা নেই,বউ পালিয়ে গেছে তাতে সে যতোটা দুঃখী ঠিক ততোটাই সুখী এমন মায়ের মত ফুপু পেয়ে। ওই জেবু আন্টির মত সৎ মা পেয়ে সে সৌভাগ্যবান আবার রাইমার মত বোনও আছে আর আছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা৷ মেহউইশের জীবনে তো মা,ভাই আর ইভান ছাড়া কিছুই ছিলো না। এখন আবার ইভানও নেই মা, ভাই থাকলেও তাদের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষমতা তার নেই। সব ভাবনা যেন টাকাতেই আটকে যায়।
পাহাড়ে শীতের এই সময়ে রাত নামে কুয়াশার পাখায় ভর করে গৌধূলি বেলা থেকেই। দিনটা যেমন গরমে কাটে রাতটা ঠিক তেমন শীতে৷ সন্ধ্যের আগেই মেহউইশ নির্জনকে গরম কাপড় পরিয়ে ঘরের ভেতর নিয়ে বসে আছে। ফুপু আর দুপুরের পর মেহউইশের সাথে কোন কথা বলেননি। আনতুংকে দিয়ে এক মগ কফি আর দুটো চিকেন রোল বানিয়ে ঘরে পাঠালেন। কফির মগ হাতে তুলে নিতে নিতে মেহউইশ জিজ্ঞেস করলো, ‘ফুপু কোথায়?’
-রসুইয়ে(রান্নাঘরে)
-ওহ!
-‘তোমার জামাইর জইন্য এই পিঠা বানাইছে।’ রোলের দিকে দেখিয়ে বলল।
-আচ্ছা। ফুপুর কাজ শেষ হয়ে গেলে বলবেন এ ঘরে যেন আসে।
আনতুং চলে যাওয়ার একটু পরই ফুপু এলেন ঘরে। হাতে তাঁরও একটা কফি মগ। শাড়ির আঁচল কোমরে গোঁজা। বিছানায় থাকা নির্জনের গাল টেনে বললেন, ‘ কি ভাইয়া তুমিও খাবে কফি? নাকি বাবার মত বলবে আমি স্যুপ খাবো দিদুন।’ খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলেন ফুপু। নিঃসঙ্গ জীবনে তাঁর হাসির মুহূর্তগুলো খুবই সীমিত৷ মেহউইশ এ বাড়িতে আসার পর এই প্রথম এই মহিলাটিকে হাসতে দেখলো। অনেক কৌতূহল জন্মেছে মনের মধ্যে মহিলাটিকে জানার কিন্তু কোন সুযোগ পাচ্ছে না। নিজের জীবনের অসন্তোষের সময়গুলোই তো কাটিয়ে উঠতে পারছে না কি করে অন্য আরেকজনের জীবন নিয়ে কৌতূহল দূর করবে! ফুপু পাশে বসে বেশখানিকটা সময় নির্জনের সাথে কথা বললেন, খেললেন আবার ফাঁকে ফাঁকে রিশাদের ছোটবেলার স্মৃতি আওড়ালেন। কিন্তু একটিবারও বললেন না রিশাদের কাছাকাছি কেন থাকা হলো না। একটা সময় হঠাৎ নিজের পড়াশোনার কথা তুলতেই কথা বলা থামিয়ে দিলেন তারপরই কাজ মনে পড়েছে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কাছাকাছি থাকলে হয়তো এমন করেই আশেপাশের মানুষকে জানার আগ্রহ জাগে যেমনটা দু দিন ধরে রিশাদকেও জানার আগ্রহ হচ্ছে খুব। লোকটা কি কোনভাবে মানসিক রোগী!
রিশাদ বাড়ি ফিরলো রাত করে৷ নয়টা কি দশটা জানা নেই। মেহউইশ তখন রাতের খাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। শীতের প্রকোপ একটু বেশিই মনে হওয়ায় কম্বলের নিচে ঢুকে পড়েছে জলদি। নির্জন আজ খুব কেঁদেছে সন্ধ্যার পর। তাই ফুপু তেল মালিশ করে ভালো করে কম্বলে মুড়িয়ে দিয়েছে। তারপরই বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছে। মেহউইশেরও খাওয়া শেষ বলে সেও ঘুমিয়েছে। ফুপু জেগে আছে রিশাদের জন্য । খাবার গরম করবে তাকে খাওয়াবে এই ভেবে ফুপু বসে রইলো। রিশাদও বাড়ি ফিরে প্রথমেই ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত নির্জনের কপালে চুমো খেয়ে একপলক মেহউইশকে দেখলো। মুখটুকু ছাড়া সাড়াগায়ে কম্বল এমনকি মাথাটাও আরেকটা কম্বল দিয়ে ঢেকে রেখেছে। এক সপ্তাহের সম্পর্কে আজ প্রথমবার মায়া হলো মেয়েটার জন্য। কত বড় পাপ করে বসে আছে সে। অচেনা একটা মেয়েকে জোর করে বিয়ে করেছে, মেরেছে এবং জোর করে দৈহিক সম্পর্কও করেছে। দিনশেষে সকল ক্লান্তি, ক্লেশ একদম অসুস্থতায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে। এই পাপবোধ এখন দূর করারও উপায় পাচ্ছে না সে। কাপড় পাল্টে চুপচাপ ফুপুর ঘরে গেল। ফুপু তাকে দেখতেই কাবার গরম করলেন কিন্তু কোন কথা বললেন না৷ রাতের ঘুমুতে গিয়ে বুঝতে পারলো চোখে ঘুম আসছে না তবুও চোখ বুঁজে পড়ে রইলো বিছানায়৷ তার বা পাশে নির্জন আর মেহউইশ আরেক কম্বলে। মাঝরাতে কম্বলের নাড়াচাড়া টের পেয়ে আধবোজা চোখে মেহউইশ আর নির্জনকে দেখলো। মেহউইশ কম্বল ছেড়ে বেরিয়েছে এবং হাতে তার ফোনটা। রিশাদ তাকিয়েই রইলো সেদিকে মেহউইশ কোন দিকে খেয়াল না করে ঘরের বারান্দার দরজাটা অতি সাবধানে খুলে বারান্দায় গেল। এত শীতেও তার গায়ে গরম কিছু না চাপিয়েই সে বারান্দায় গেল কেন? ফোন হাতে বারান্দার কি করবে! রিশাদের মনে অনেকরকম প্রশ্ন জাগলেও সে উঠলো না বিছানা থেকে ;যাক মেয়েটা করুক যা খুশি। মিনিট পাঁচেক পর কানে এলো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করার আওয়াজ। মেহউইশ কাঁদছে। শুনেও না শোনার ভান করে চোখ বুঁজে রইলো রিশাদ । এই নিশীথের অন্ধকারে হয়তো প্রিয় মানুষটার জন্য বাদলধারা মেহউইশের চোখে। রিশাদ নিজেই যে বাদলের সৃষ্টিকারী সে কি করে থামাতে যাবে এই বর্ষণ? কাঁদুক সে রিশাদও তো কত কি হারিয়েছে তাই বলে কি সে কেঁদে বুক ভাষায়!
#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-১৬
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞
পূর্বের আকাশ রক্তিমবর্ণে রঞ্জিত সূর্যের দখল তখনও তেমন ছিলো না। নির্জন কম্বলের তলায় গড়াগড়ি করে পায়ের নিচে চলে গেছে মেহউইশের। নির্জনের নাড়াচাড়া পায়ের কাছে টের পেয়েই ধড়ফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে সে। নিজের কম্বলখানা সরিয়ে দেখতে পায় নির্জন উল্টো হয়ে হাত পা ছুঁড়ছে অথচ একটুও কাঁদছে না। আশ্চর্যজনক লাগলেও সত্যিই নির্জন আওয়াজ করলো না৷ মায়া হলো মেহউইশের তার প্রতি। বাচ্চাটা কি এখনই বুঝে গেছে মেহউইশ তার সৎ মা! আর তাই হয়তো দুষ্টুমি করবে না বলে ঠিক করেছে। কে জানে সৎ মা হয়তো মারবে দুষ্টুমি করলে৷ মেহউইশ হাসছে একা একাই এসব ভেবে। হঠাৎ খেয়াল হলো নির্জনের বিপরীতে কম্বল ভাজ করে রাখা। তারমানে রিশাদ তার কম্বলটা নিজেই গুছিয়ে রেখে গেছে। কম্বলের পাশেই মেহউইশের ফোন আর তার নিচে এক টুকরো সাদা কাগজ। ফোন উঠিয়ে কাগজটা হাতে নিতেই চোখে পড়লো গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, ‘বিকেলের মধ্যে একটা পার্সেল আসবে। নাম সাইন করে রেখে দিও। এবং আনপ্যাক করে সাইজ চেক করে নিও। যেগুলো আনফিট হবে সেগুলো আলাদা করে রাখবে।’
‘সাইজ’ শব্দটা পড়ে মেহউইশের প্রথমে অন্য কথাটাই মনে আসলো। সে বিরক্ত হলো বিশ্রী রকমের। মনে মনে গালিও দিলো অসভ্য,ইতর লোক আর কিছু পেলি না অর্ডার করতে। শালা খবিশ কোথাকার! সকালের ফুরফুরে মেজাজটা এক মুহূর্তেই খারাপ হয়ে গেল।শেষ পর্যন্ত কিনা আন্ডারগার্মেন্ট প্রোডাক্ট আসবে তার জন্য পার্সেল হয়ে!
অম্বর ছোঁয়া ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতে৷ অষ্টাদশী কন্যার নগ্ন পা ভিজিয়ে নোনাজল ফিরে ফিরে যাচ্ছে দূরে। ট্যুরিস্টদের আনাগোনায় পূর্ণ কক্সবাজারের প্রতিটি তীর। রিশাদের সময় থমকে আছে বালুতে দৌড়ে বেড়ানো লাল কাঁকড়ার পায়ে। সময়ও আজ তাকে চিমটি কেটে সাবধান করছে নির্জনকে সামলে রাখতে। শত্রুরা তার প্রতিটা পদচারণা তীক্ষ্ণ নজরে লক্ষ্য রাখছে। ডিভোর্সটাকে লিগ্যাল করতে আরও নাকি মাসখানেক লাগবে এমনটাই বলেছে উকিল। বাচ্চাটাকে নিয়ে লড়াই করাটা বড্ড মুশকিল। মেহউইশও তাকে নিজের করবে বলে মনে হয় না। পরনের সাদা শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা। সামুদ্রিক বাতাসের তেজে শার্টের ইন কখন একপাশ থেকে খুলে গেছে খেয়াল নেই। রুক্ষ চুলগুলো এলোমেলো হয়ে চোখেমুখে লুটোপুটি খাচ্ছে৷ বা হাতের কব্জিতে গাঢ় নীল রঙের টাইটা পেঁচিয়ে রাখা। দুশ্চিন্তাগুলো আচমকাই ঝড়ো বাতাসের মত রিশাদকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। এই ভর দুপুরে ক্লান্ত শঙ্খচিলের মত কিছুটা কষ্টও তাকে ক্লান্ত করে পথ হারা পথিকের মত উদভ্রান্ত করছে। ‘পিছুটান’ মারাত্মক পিছুটানে আটকে পড়েছে সে৷ অকূল পাথারে কোন কিনারা চোখে পড়ছে না। এতটুকু জীবনে মেহউইশ আর তার পরিবারের অনাকাঙ্ক্ষিত দ্বায়িত্ব নিজেই নিজের কাঁধে টেনে এনেছে।মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছে এদিকে নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎও এখন শংকাজনক বৈকি। বাবা কেন এত স্ট্যাটাস ফলো করছেন যেখানে তার সন্তানের সুখ নেই!
-‘স্যার!’ রিশাদের হোটেলের ম্যানেজার আল ইমরান বিচে এসে রিশাদকে ডাকলো।রিশাদ অন্যমনস্ক থাকায় প্রথম ডাকটা শুনলো না। ম্যানেজার আবারও ডাকলেন, ‘স্যার, মিসেস নীলিমা এসেছেন।’
– হু!
‘আপনার কাছে ম্যাম এসেছেন।’ ম্যানেজার ইতস্তত করেই বললেন কথাটা। তিনি জানেন নীলিমার পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা তাই হয়তো হেজিটেশন বোধ করছিলেন কিছুটা।
‘আপনি যান আমি আসছি’ বলেই রিশাদ শার্টের ইন পুরোটা খুলে ফেলল।হাত দিয়েই চুলগুলোকে ঠিক করার বৃথা চেষ্টা করলো। হাতের টাইটা খুলে গলায় পরতে পরতে হোটেলের দিকে রওনা দিলো সে। হাতের ঘড়িটাতে সময় দেখলো বারোটা বাজে। নীলিমার কি এসময় আসার কথা ছিলো! মনে করতে পারলো না সে সঠিক সময়টা। শুধু মনে হলো এখন তাকে স্ট্রিক্ট থাকতে হবে যতোটা সম্ভব । যে কোন কিছুর বিনিময়ে নির্জন শুধু তার কাছে থাকবে। পকেট থেকে ফোনটা বের করে নিজের ঠিক করা উকিলকে কিছু কাগজ তৈরি করতে বলে হোটেলের দিকে অগ্রসর হলো। মধ্যদুপুরে তপ্ত বালুতে রিশাদের পায়ের তালু ঝলসে যাওয়ার জোগাড় তবুও অনুভব কিছুই হচ্ছে না। জুতো জোড়া সে সমুদ্রের পানিতে ভাসিয়ে এসেছে। আজ হুমায়ূন আহমেদ এর হিমুর মত নগ্ন পায়ে একটু পথ চলেই দেখুক না। কেমন লাগবে! অনুভূতিশূন্য মনটাতে বালুর উত্তপ্ততা পায়ের চামড়া ভেদ করতেই পারেনি বুঝবে কি করে সে কেমন লাগে?
পাহাড়ের গা বেয়ে সরু একটা পথ নেমে গেছে সমতল এক রাস্তায়। মেহউইশ একটু আগেই নির্জনকে ফুপুর কোলে দিয়ে আনতুংকে সঙ্গী করে পাহাড় থেকে নিচে যাচ্ছে। রঙিন প্রজাপতির মত পাখনা মেলে ঘুরে বেড়ানোর দারুণ এক সুযোগ সে পেয়েছে আজ। একঘেয়ে জীবনের বাইরে এমন সবুজ এক ভুবন সে আগে কখনো দেখেনি। ফুপু নিজেই বলেছেন, ‘মেয়ে তুমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসো।’
মেহউইশ অবাক হয়ে তাকাতেই তিনি আবার বললেন, ‘ এই পাহাড় থেকে একটু নিচেই ছোট্ট একটা বাজার আছে চাকমাদের। ঘুরে আসতে পারো আনতুংকে সাথে নিয়ে যাও। গাড়ি তো রিশাদ নিয়ে গেছে তুমি রাস্তার পাশে অপেক্ষা করলে গাড়ি পেয়ে যাবে যাওয়ার।’ আনতুং বলে উঠলো, ‘ দুই মিনিটের রাস্তা গাড়ির কি কাম!’
কিছুক্ষণ দু মন দু দশা করে করে শেষ পর্যন্ত বেরিয়েই পড়লো মেহউইশ সঙ্গী হলো আনতুং আর এক প্রতিবেশী মেয়ে । ঠিক হলো হেটেই যাবে তারা। সোজা ঢালু পথটা রেখে আনতুং নিয়ে গেল পাহাড়ের গা বেয়ে উঁচু নিচু পথে। যে পথে গাছ আর ঘাস মিলে সবুজাভ লাগে পুরো পৃথিবীটাকেই। নামাটা কষ্ট না করে করেও অনেক কষ্টেই নামতে হলো তাদের। বাজার পর্যন্ত আসতেই ঘেমে নেয়ে একাকার মেহউইশ। সে পাহাড়ের গায়ে একটা ভাঙা পাথরের উপর বসে পড়লো৷ আনতুং বলল আর একটু সামনেই বাজার আমরা এসেই পড়েছি। এদিকে দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে মেহউইশের ভয় রিশাদের চিরকুটটা নিয়ে। সত্যিই কি ওসবের পার্সেল আসবে বাড়িতে! রিসিভ করতে হবে সেগুলো আবার কোন রকম ভুল হলে লোকটা থাপ্পড় মারবে নাতো! ভয়েই একটা হাত আপনাআপনি গালে চলে গেল তার। আনতুং ডাকলো জলদি করো বাজারে যেতে দেরি হচ্ছে । ফেরার পথে গাড়ি না পেলে এই পথেই কিন্তু ফিরতে হবে৷ মেহউইশ উঠে দাঁড়ালো, আবার চলতে শুরু করলো পাহাড়ের চিকন রাস্তা ধরে। কয়েক মিনিট বাদেই চোখে পড়লো পথের কিনারা ঘেঁষে কয়েকটা বাঁশের তৈরি মাচা। তাতেই রয়েছে কিছু বাশ,বেতের তৈরি জিনিস। একপাশে তাঁতে বোনা পাহাড়ি খাদি কাপড়। কিছু এ্যালুমিনিয়ামের তৈরি জিনিসপত্র আর কিছু চুড়ি আলতা,ফিতা,কাজল বিভিন্ন প্রসাধনী। হতাশ হলো মেহউইশ এই সামান্য কিছু জিনিস দেখে। এর চেয়ে ভালো আর বেশি কিছু তো তার বাড়িতেই ছিলো। আবার মনে পড়লো বাড়িতে আছে এখানে তো নেই। এখানে এক মুঠো চুড়ি, একটা কাজলও নেই৷ আর করবেটা’ইবা কি সে এসব দিয়ে? যার জন্য সে সাজতে ভালোবাসতো সেই মানুষটাই তো আর তার নেই৷ সে নিজেও কি আছে আর তার! এক গুচ্ছ রেশমি চুড়ি হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো সে পছন্দও হলো তার। হাতের মুঠোয় থাকা ছোট্ট একটা পার্স যেটা রিশাদের ফুপু আসার সময় দিয়েছিলো সেটা খুলল। ফুপু পার্সের সাথে পাঁচশ টাকার একটা নোটও দিয়েছেন কেনাকাটার জন্য৷ সেটা দিয়েই দু’মুঠো চুড়ি কিনলো, একটা কাজল আর একটা ঝুনঝুনি যা ছোট্ট বাচ্চাদের খেলনা। চুড়ি কেনার পরই পাশের মাচায় হলুদ আর গোলপি মিশ্রিত রঙের ঝুনঝুনিটাতে চোখ যায় মেহউইশের। মনে পড়ে যায় নির্জনের কোমল মুখটি। ওই শান্ত বাচ্চাটির জন্য মায়া হয় এখন তার। খুশিমনেই ঝুনঝুনিটা কিনে আর কিছুই কিনবে বলে আনতুংকে ডাকলো ফেরার জন্য । আনতুংও বেতের তৈরি কিছু ঝুড়ি কিনলো প্রতিবেশী মেয়েটিও কিনলো। রাস্তার কিনারায় দাঁড়িয়ে রইলো তারা অনেকক্ষণ কোন গাড়িই না পেয়ে মেহউইশ বলল, ‘চলো সোজা পথেই হেটে যাই। গাড়ি পেয়ে গেলে উঠে যাবো। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে এখানেই সন্ধ্যে নামবে।’ সম্মতি জানিয়ে বাকি দুজনও হাটতে লাগলো। চলতি পথে থেমে থেমে একটা দুটো গাড়ি সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছে। মেহউইশ শহরে থাকা মেয়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়া তার পুরনো অভ্যাস। গাড়ি থামানোটাও কঠিন ব্যাপার নয় কিন্তু এখানে হয়তো ঢালু পথে যখন তখন গাড়ি থামানোটা সম্ভব হয় না। কি জানি! মেহউইশ অতশত বোঝে না সে বারবার হাত বাড়িয়ে গাড়ি দেখলেই থামানোর জন্য ইশারা করছে৷ চলতি পথে সামনে থেকে আসা হঠাৎ একটা মাইক্রোবাস আচমকা এলোমেলোভাবে এসে মেহউইশদের ধাক্কা মেরে বসলো৷ কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই মেহউইশ আর প্রতিবেশী মেয়েটা পায়ে আঘাত পেল। কিন্তু তারা ভাগ্যের সুআচরণেই হয়তো অল্প আঘাতে বেঁচে গেলেও মাইক্রোবাসটি পড়লো খাদে৷ব্যথার চেয়ে ভয়টাই এতবেশি পেল মেহউইশ যার ফলে সে জ্ঞান হারালো। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সে চট্টগ্রাম শহরে একটা বেসরকারি ক্লিনিকের ছোট্ট কেবিনে শুয়েছিলো। পাশেই সাদা শার্ট গায়ে রিশাদ বসে আছে। সকালে কি ড্রেস পরেছিলো রিশাদ তা জানতো না মেহউইশ৷ এখন এই শুভ্ররঙে দেখে মনে হচ্ছে ঐশ্বরিক কোন সৌন্দর্য নিয়ে চিন্তিত মুখখানি বিমর্ষ করে বসে আছে সে৷ আর মেহউইশ তার বিমর্ষতার প্রধান কারণ। আদৌও কি তাই! সকল রাগ,জেদ কোথায় গেল এই দানবের?
চলবে
চলবে
(