মন গহীনের গল্প পর্ব -১৩+১৪

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-১৩
#রূবাইবা_মেহউইশ

💞
গাল বেয়ে গলায় নেমে এলো উষ্ণ আদুরে এক স্পর্শ। শীতের রাতে কোমল মোলায়েম হাত যতোটা আরামদায়ক লাগছিলো ঠিক ততোটাই যন্ত্রণাদায়ক হয়ে গলায় চেপে বসেছে মেহউইশের। ক্রমশ সেই যন্ত্রণা মৃত্যুর দিকে টেনে নিতে লাগলো তাকে।হাত-পা ছুড়াছুঁড়ি করতে করতে একটা সময় নিস্তেজ হয়ে এলো দেহ,শিথিল হলো গলায় চেপে বসা হাত দুটো।দম ফুরিয়ে গেল মেহউইশের যমদূত মুঠোয় পুরে নিয়ে গেল মেহউইশের জান। আঁধারে মিলিয়ে গেল অদেখা সেই মুখ যা যম হয়ে সামনে এসেছিলো।

‘মেবিশ! এ্যাই মেবিশ, চোখ খোলো৷ কি হয়েছে তোমার? ফুপু! ফুপু একটু আসো এদিকে ফুপু!’ এক নাগাড়ে চিৎকার করে একবার ফুপু তো একবার মেহউইশকে ডাকতে লাগলো রিশাদ৷ রাত তখন কত হবে তার জানা নেই। মধ্যরাত কি শেষরাত পাহাড়ে শীতের তীব্রতা আর ঘন অন্ধকারে বোঝার উপায় নেই। দূর থেকে তখন ভেসে আসছিলো হুতুমের মন ভাঙা আর্তনাদ মিশ্রিত ডাক। রিশাদের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেছে ছোট্ট নির্জনের সেও ভয় পেয়েছে বোধহয়। ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে ছেলেটা। বিছানায় শুয়ে থাকা মেহউইশ কাঁপছে থরথরিয়ে।তার হুঁশ নেই কিছুতেই। রিশাদের চিৎকার কিংবা নির্জনের কান্না কোনটাই তার কানে পৌঁছাচ্ছে না। রিশাদের ফুপু লাঠিতে ভর করে কোনমতে এসে পৌছুলেন দরজায় তার সাথে আনতুংও। আনতুং রাতে এ বাড়িতেই থাকে রিশাদের ফুপু একা থাকেন বলে। রিশাদের ডাকে তারা দুজনেই ভয়ে এসেছেন কিন্তু রিশাদ ঘুমন্ত মেহউইশের আচমকা থরথরিয়ে কাঁপা দেখে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলো৷ দরজা খোলার কথাটুকুও মাথায় আসেনি। ফুপুর ডাক আর দরজার করাঘাত শুনে দরজা খুলে দিলো। ততক্ষণে গেইটের দাড়োয়ানেরও ঘুম ভেঙে গেলে সেও এগিয়ে এলো বাড়ির ভেতরে।

-‘কি হয়েছে রিশাদ?’

-‘ফুপু, মেবিশ হঠাৎ করেই কাঁপছে,গোঙাচ্ছে আর কিছুক্ষণ আগে হাত-পাও ছোড়াছুঁড়ি করছিলো খুব। দেখো তার চোখ মুখ এই শীতেও ঘেমে গেছে৷ আমার ভয় লাগছে মেয়েটার কিছু হয়ে যাবে না তো!’ শেষের কথাটা বলতে গিয়ে রিশাদের গলার স্বর নরম হয়ে এলো৷

‘আচ্ছা, তুই এত অস্থির হয়ে পড়িস না। নির্জন কাঁদছে ওকে একটু কোলে নিয়ে হাট আমি নীলিমাকে দেখছি।’ কথাটা বলেই ফুপু মেহউইশের সামনে গেলেন। তার পেছন পেছন আনতুংও আগালো কিন্তু সে সন্দেহি নজরে তাকিয়ে রইলো মেহউইশের মুখের দিকে৷

নির্জনকে বুকে চেপে পাতলা একটা কম্বলকে দু পরতে ভাজ করে ডেকে নিলো৷ বাইরে প্রচণ্ড শীত যা এই বাচ্চার পক্ষে অসহনীয় হবে৷ নিজের ঘর ছেড়ে কড়িডোরে হাঁটতে লাগলো সে ছেলেকে জড়িয়ে । মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আজকে দিনের ঘটনা। মেহউইশ কি ট্রমা থেকে এমন করলো! আজ যখন সে জানতে পারলো ইভান বিয়ে করেছে তখনি বেঁহুশ হয়ে পড়েছিলো।রিশাদ তখন প্রয়োজনীয় কিছু কাজে বাড়ি ফিরেছিলো এবং তখনি দেখেছে ফুপু মেহউইশের মাথায় পানি ঢালছে। আনতুং তেল মালিশ করছিলো হাতে পায়ে। এরপর যখন তার হুঁশ এলো তখন থেকে গুমোট মেঘের মত চাপা মুখে বসেছিলো নির্জনকে নিয়ে। দুপুর এবং বিকেল না খেয়ে থাকলেও রাতে রিশাদের সাথে বসে খাবার খেয়েছে। নির্জনকে যত্ন করে খাইয়ে রাতে ক্রিম,ময়েশ্চেরাইজার মাখিয়েছে। ডায়াপার পরিয়েছে রাতের জন্য এমনকি তাকে নিজের বুকে আগলে ধরে ঘুমও পাড়িয়েছে।এরপর যখন সেও ঘুমিয়ে পড়লো তখন রিশাদ বসে থেকে কিছু কাজকর্ম করলো ল্যাপটপে। দিনে এখানে নেটওয়ার্ক খুবই দূর্বল তাই কিছু কাজ রাতেই করতে বসেছিলো। সেই কাজে কখন যে রাত থেকে মধ্যরাতে গড়ালো সময় তা টের পায় নি। এখন বিছানায় এসে শোয়ার পরই চোখ গেল নিজের বিপরীত পাশে ঘুমন্ত মেহউইশের দিকে। খোলা গাল এবং গলা বাতির আলোয় অন্যরকম এক আকর্ষণে আকৃষ্ট করছিলো তাকে৷ তাই সে নিজের আকর্ষণকে সক্রিয় রেখেই একটু ছেঁয়েছিলো মেহউইশের গাল ধীরে ধীরে গলা। তারপর কি হলো! মেহউইশের ওইরকম কেঁপে উঠা,ছটফটানো ভয় পাইয়ে দিলো রিশাদকে। সে কোন ক্ষতি করতে চায়নি এখন মেয়েটার। শুধু একটু স্পর্শ করেই সরে যেত। মেয়েটা কি ঘুমের মধ্যেও ভয় পেল তাকে! পাশের কোন পাহাড় থেকে ভেসে আসছে বাঁশির করুণ সুর। এ সুরে কান্না ভাসছে,কারো গল্প ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে। শীতগন্ধি শিশির ফোঁটায় ফোঁটায় এ সুরের মোহে জমে যাচ্ছে পত্রপল্লবে অভিমান করে। এই প্রথম রিশাদের বুকে রাগের পাহাড়ে ভয়ের মেঘ এসে জড়ো হলো। এ ভয় কিসের? বাবার ক্ষমতা মাথা থেকে সরে যাওয়ার নাকি নির্দোষ কারো জীবনে শাস্তি হয়ে বর্তে যাওয়ার!

ভোরের আলে ফুটতেই পাহাড়ের গায়ের অন্ধকার পাতার ফাঁকে একটু একটু করে লুকিয়ে পড়ছে। পুরো একটা নির্ঘুম রাতের পর মাত্রই চোখের পাতা এক হয়েছে রিশাদের। পাশেই নির্জন জেগে গিয়ে হাত পা ছুঁড়ে খেলছে। এখন শীত কেটে রোদের উম গায়ে লেগে আরামদায়ক অনুভূতি দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ফুপুর ঘরের জানালা খোলা থাকলে দারুণ বাতাস আসে পাল্লা দিয়ে রোদের আলেও৷ পূর্ব দিকের এ জানালাটা সাইজেও বড় হওয়ায় অধিক আলো বাতাসে গ্রীষ্মের মধ্য দুপুরে না চাইতে ঝিমুনি দিয়ে ঘুমের আনাগোনা দেখা যায় যে কোন ব্যক্তির। অথচ আজ এই মৃদুমন্দ শীতের ভোরেও বাতাসটা ঘুমের পক্ষে যথেষ্ট কোমলতা দেখাচ্ছে। রিশাদ ঘুমে ভেসে গেল এতোটাই যে পাশে থাকা নির্জনের কল কল হাসিটাও শুনতে পাচ্ছে। কাল রাতে ফুপু আর মেহউইশকে ছেড়ে নিজের ঘরে আসেননি। জোর করেই রিশাদকে নিজের ঘরে পাঠিয়েছিলেন নির্জনকে নিয়ে ঘুমানোর জন্য; তার ঘুম আসেনি একটুও। আনতুং নিজেও থেকেছে রিশাদের ঘরের ফ্লোরে তবে সে সারারাত ঘুমায়নি ভয়ে। বারবার মনে হচ্ছিলো মেহউইশকে পাহাড়ের জংলী ভূতে ধরেছে। সে বাংলা ভালো বলতে পারে৷ রিশাদের ফুপুকে ভোর হতেই বলেছে, ‘তোমার পুতবউয়ের(ছেলের বউ) ভূতে ধরছে।’ ফুপু ধমকে দিয়েছিলেন তাকে। সে জানে মেহউইশ কাল দিনে কোন এক ফোন কলে বেহুঁশ হয়েছে হয়তো সেই ব্যপারটাতেই সে রাতেও ভয় পেয়েছে। ঘুমের মধ্যে হয়তো ভয়ের কারণেই ওভাবে কেঁপেছে। একন তো মেয়েটা একদম স্বাভাবিক। ঘুম ভাঙতেই যেচে পড়ে চা বানাতে গেল। এক কাপ ফুপু আরেক কাপ আনতুং কে দিয়ে নিজের জন্যও নিলো এক কাপ। হাসি হাসি মুখে দুজনকে শুভ সকাল জানিয়ে পাশেই বসলে চা নিয়ে। ফুপু খেয়াল করলেন মেয়েটা আসার পর থেকে এতোটা স্বাভাবিক মোটেই ছিলো না৷ আজকের আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে এই ভিন্ন আচরণটাই যেন তিনি আশা করছিলেন। চা খেতে খেতে ফুপু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নামটা যেন কি?’

-মেহউইশ

-‘এ কেমন নাম? মুসলিমদের নাম!’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন ফুপু।

-জ্বী, মা বলেছিলো এটা নাকি পাকিস্তানিদের নাম। মানে সে দেশেই বেশি ব্যবহৃত।

মেহউইশের কথা শুনে রিশাদের ফুপু হায় হায় করে উঠলেন। বললেন, তোমার মা রাজাকার নাকি? ‘

মেহউইশের মুখের চা পিচিক করে সব পড়ে গেল সামনে থাকা আনতুংয়ের গায়ে। বিষম খেল সে এবং কাশতে কাশতে গলায় ব্যথা অনুভব করলো। ফুপু নিজের চায়ের কাপটা কাঠের চেয়ারের সমান্তরাল হাতলে রেখে উঠে দাঁড়ালেন মেহউইশের সামনে। পিঠে মালিশ করে শান্ত করলেন। কয়েক মিনিট স্থির থেকে মেহউইশ জবাব দিলো, আমার মা অতোটা বয়স্ক নয় যে যুদ্ধের সময় রাজাকার হবেন। আমার নাম মেহউইশ যার অর্থ সুন্দর। আমার নাম মা রেখেছিলেন কোন এক উপন্যাসের এক বিদ্রোহী চরিত্র পড়ে। সেই চরিত্রটি পাকিস্তানি ছিলো। মায়ের ভালো লেগেছিলো নামটা তাই রেখেছিলো৷ আর নামের অর্থটা কিছুদিন আগে আমি ইন্টারনেটে সার্চ করে পেয়েছিলাম। রাজাকারদের সাথে আমাদের কোন যোগসাজশ নেই। চায়ের পর্ব ভালোরকমে না শেষ হলেও নাস্তা বানানোর পর্বটা খুব জমলো তিনজন নারীর গল্পকথনে। নির্জন খেলতে খেলতে আরো এক দফা ঘুমিয়ে গেল। ফুপু এবার মেহউইশকে বললেন নির্জনের কাপড় বদলে দুধ খাইয়ে আসতে। তখনি মনে পড়লো মেহউইশের আজ সে ঘরে একা ছিলো কেন? ফুপু এক চিলতে প্রসন্নতার হাসি হেসে বললেন, ‘রাতে তো আমার বাপটাকে ভয় পাইয়ে ঘরছাড়া করেছিলে তাই সে তার ফুপুর ঘরে ঘুমিয়েছে৷ আর ফুপু বসে বউমার সেবা করেছে। মেহউইশের বিষ্ময় হলো শুনে তবে তা প্রকাশ করার আগেই কানে এলো নির্জনের কান্না। তড়িঘড়ি সে ছুটলো ফুপুর ঘরের দিকে। ঘরের দরজায় দাঁড়াতেই চোখে পড়লো রিশাদ দাঁড়িয়ে আছে নির্জনকে কোলে নিয়ে। পরনে তার পাহাড়ি খাদি কাপড়ের লুঙ্গি যার আর উদোম গা।
#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-১৪
#রূবাইবা_মেহউইশ

💞
‘নির্জনকে দিন।’

মেহউইশ কথাটা বলতেই রিশাদ বিনাবাক্যে নির্জনকে তার কোলে দিলো। শিরশিরে ভোরের বাতাস উদোম গায়ে হঠাৎ হঠাৎ কাঁপুনি দিচ্ছে রিশাদের।মেহউইশের খেয়াল করেছে রিশাদের হাতের পশমগুলো শিউরে আছে। নির্জনের দিকে হাত এগিয়ে আবারও বলল, ‘আমার কাছে দিন ওকে আপনি কাপড় পরুন৷’

-কাপড় পরবো মানে? আমি কি কাপড়ছাড়া ঘুরছি!

আমি সে কথা বলিনি৷রোদ এখনও পুরোপুরি উঠেনি শীত শীত ভাবটা আছেই৷ তাই শার্ট বা টি শার্ট কিছু একটা পরে নিন৷

সেটা কি সুন্দর করে বলা যায় না? কথাটা বলতে বলতেই নির্জনকে দিয়ে দিলো রিশাদ। বাচ্চাটা এত শান্ত কি করে হলো কে জানে! মেহউইশ অবাক হয় এতটুকু বাচ্চা কি করে থাকছে মা ছাড়া? একটুও কাঁদেনা চুপচাপ ফিডার মুখে দিলেই কেমন চুকচুক শব্দ করে খায়। হাসি পায় তার এই শব্দ শুনলে৷ মনে হয় কোন বিড়াল ছানা দুধের বাটিতে চাটছে। বাচ্চাটার গায়ের রঙ এতোই ফর্সা যা দেখে হিংসে হয় মেহউইশের। সেও মোটামুটি ফর্সা কিন্তু বাচ্চাটা একেবারে বাড়াবাড়ি রকমের ফর্সা৷ হয়তো মা, বাবার কারণেই সে এতো ফর্সা। প্লাসে,প্লাসে মিলে ডবল প্লাস আরকি! মেহউইশ সেদিন সন্ধ্যায় দেখেছিলো নীলিমাকে পরনে ছিলো কালো লেগিংস আর হলুদ কূর্তি। গলা, মুখ,হাত যতটুকু চোখে পড়েছে সাদায় ঝলসে যাওয়া রঙ মনে হয়েছিলো৷ আঁড়চোখে রিশাদের নগ্ন দেহে চোখ ফেরাতেই খেয়াল করলো রিশাদও অনেক ফর্সা। ব্যস হয়েই গেল তার হিসাব গণিতের প্লাস প্লাস। রিশাদ কয়েক মিনিট একই জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল নিজের ঘরে। ফুপুকে ডেকে গরম পানি চাইলো গোসলের জন্য।

রোদের তেজ সময়ের সাথে একটু একটু করে বাড়তে থাকলো। রিশাদ সকালের নাস্তা সেরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে ফুপুকে কিছু বলে গেল মেহউইশ তাদের শোবার ঘর থেকে লক্ষ্য করলো সেটা৷ কিন্তু ফুপুর মুখের রঙ বদলে গিয়েছিলো কোন কারণে৷ কি হতে পারে সেই কারণ! মেহউইশ জানে না আর রিশাদ অমন শার্ট,প্যান্ট, কোট পরে কোথায় গেল তাও জানে না। রিশাদের অফিস তো শুনেছিলো ঢাকায়। তবে কি সে এখন ওভাবে তৈরি হয়ে ঢাকায় গেল? তাকে আর নির্জনকে নিলো না কেন! তার ভাবনার মাঝেই আনতুং এলো ঘরের সামনে। জানতে চাইলো সে এখন গোসল করবে কিনা তাহলে বাথরুমে গরম পানি রেখে আসবে।

সকালের সময়টা যেনতেন করে কাটলেও দুপুর এবং বিকেলটা মেহউইশের দারুণ কাটলো। আনতুং আজ পাহাড়ি কিছু জংলী ফুল এনেছিলো তার জন্য । ভূতে ধরা লোকের নাকি ঔষধ সেইসব ফুল৷ সুতোয় বেঁধে মালা বানিয়ে তাকে সাজিয়েছিলো খুব৷ মনে মনে অনেক খুশি হয়েছে মেহউইশ কিন্তু মুখে বলেছে এ ফুল তার পছন্দ হয়নি। কেন বলেছে তা জানে না৷ বিকেলে ফুপুর সাথে বসে হালিম রান্নার ব্যবস্থা করেছে৷ নির্জন দু দিন ধরে তার কোলে এলেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে খুব৷ মেহউইশের এ জড়ানো ভালো লাগে,অন্যরকম আনন্দ হয় মনে মনে। সারা সন্ধ্যা সে নির্জনকে বিছানায় শুইয়ে কতরকম কথা বললো, খেলা করলো৷ সন্ধ্যার পর মায়ের ফোন পেয়েই কিছু সময় কথা বলেছে কিন্তু একটিবারও ইভানের কথা জানতে চায়নি। শীতের সন্ধ্যায় কুয়াশায় ঘেরা পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানো মুশকিল। তবুও রিশাদ বিকেলে সুযোগ থাকার পরও সন্ধ্যায় ফিরছে। কাল রাতে মেহউইশের ওই অবস্থা দেখার পর থেকেই মাথা থেকে রাগের আস্তরণটা একেবারেই যেন উবে গেছে। এ রিশাদ গত আটাশ বছরের রিশাদের চেয়ে আলাদা। এক রাতেই ভয়ংকররকম পরিবর্তন তার মস্তিষ্কে এসে বসে গেছে। গাড়ি চালাতে চালাতেই মনে পড়ছে বারবার মায়ের কথা। কতটুকু খেয়াল আছে মায়ের মুখ? মনেই পড়তো না বোধহয় বাড়িতে ছবি না থাকলে৷ ফুপুটার অল্পবয়সেই জীবনটা বেরঙিন না হলেও অন্তত তার জীবনে কিছুটা সময় ফুপুকে পাশে পাওয়া যেত কিন্তু এখানেও দূর্ভাগ্য। এক প্রেমের অবদানে ফুপু,খালা দুজনের স্নেহ থেকেই বঞ্চিত হয়েছে। এখন সেই প্রেমের খাতিরেই তার ছেলেটাও বঞ্চিত হচ্ছে। কি এমন আছে এই প্রেম ভালোবাসায়? সে কেন কখনো বুঝতে পারেনি প্রেমের স্বাদ কেমন! ভাবনারা পাহাড়ি মেঘের মতোই মাথায় ঠুকে ঠুকে এদিক ওদিক ঘুরছে। ড্রাইভিংয়ে মনযোগ রাখা দায়। মেহউইশের মা ফোন দিয়েছিলো রিশাদকে। সে ইচ্ছে করেই রিসিভ করেনি। ভদ্রমহিলা তাকে কল দিয়ে প্রথমেই বলেন, ‘আমার মেয়েটাকে মুক্তি দাও। আমাদের লাগবে না তোমার টাকা পয়সা। আমরা খেটে খেতে জানি।’ রিশাদের কাছে এ কথার জবাব নেই আজ থেকে আর। কালকে পর্যন্তও সে মাইমুনার কথা কানে তোলেনি কিন্তু আজ সকাল থেকে নিজ মনেই ভাবছে সব কথা। বাড়ি ফিরে প্রথমেই ভালো করে মুখ হাত ধুয়ে ঘরে গেল। কাপড় পাল্টাতে পাল্টাতেই খাটের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেহউইশ ঘুমুচ্ছে পাশেই নির্জন হাত পা নাড়িয়ে খেলছে। কতরকম শব্দও করছে মুখ দিয়ে৷ ভালো লাগছে দৃশ্যটা দেখতে তাই নিজের মুঠোফোনটায় তৎক্ষনাৎ তুলে নিলো কিছু ছবি৷ সন্ধ্যাক্ষণ পার হয়েছে অনেকক্ষণ রিশাদ নির্জনকে নিয়ে ফুপুর ঘরে বসলো৷ ফুপু আজ নাড়ু বানিয়েছেন নারকেলের৷ মেহউইশও সাহায্য করেছিলো কাজে। রিশাদকে নাড়ু দিয়ে ফুপু আরাম করে তার পাশেই বসলেন৷

‘তোমার বউয়ের নামটা তুমি ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারো না, তাই না!’

মাত্রই মুখে নাড়ুটা দিয়েছিলো। ফুপুর কথায় মুখের খাবার গলায় নেমেই আটকে গেল। ফুপু পানি এনে এগিয়ে দিলেন তার দিকে। ডকডক করে গ্লাসের সবটা পানি শেষ করে বলল, ‘আসলে তার নামটাই কেমন যেন। উচ্চারণ ঠিকঠাক মুখে আসে না।’

‘হুম, আমারও একই অবস্থা৷ মেয়েটাকে ডাকতে গেলে বউমা বলতে গয়৷ আমি কি অতো বুড়িয়ে গেছি নাকি! অত বড় মেয়েকে বউমা ডাকবো আজব লাগে। আমি ভাবছি তাকে নীলিমা বলেই ডাকবো। কি সুন্দর নাম।’

-কিহ!

‘চেঁচাচ্ছো কেন রিশাদ?’

‘তুমি ওকে নীলিমা ডাকবে কেন? ও তো মেহউইশ’ বলেই মনে পড়লো ফুপু কখনো নীলিমার ছবি দেখেন নি। এ বাড়িতে এসেছেন রিশাদের বিয়েরও বহু আগে আর সবার থেকে লুকিয়ে থাকার জন্যই তিনি রিশাদের একমাত্র ফুপু হয়েও বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন না।

‘নীলিমা পালিয়ে গেছে ফুপু৷ ও আমার দ্বিতীয় স্ত্রী মেবিশ।’

রিশাদের বলা কথাটা কানে বাজলো খুব তার ফুপুর। এসব কবে হলো সে জানেই না৷ ফোনে শুধু বিয়ের খবর শুনেছিলো এরপর বাচ্চার। তারপর মাস চারেক হলো যোগাযোগ বলতে শুধু টাকা পাঠানোর কাজটাই করতো রিশাদ৷ কথাও বলেনি ঠিকঠাক এ ক’মাসে। তবে কি এ ক’দিনেই এতকিছু হয়ে গেল!

-বাবা তুমি দ্বিতীয় বিয়ে কবে করলে? নাকি নীলিমাকে রেখে এই মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে এসেছো তাই আমাকে সেদিন বললে ভাইকে যেন না জানাই তারমানে সত্যিই,,,,৷ মুখের রঙ পাল্টে গেল রিশাদের ফুপুর তা দেখে রিশাদ আবারও বলল, ‘ তেমন কিছুই না ফুপু। নীলিমা চলে গেছে তার পুরনো প্রেমিকের সাথে আর নির্জনকেও এখন নেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আর মেহউইশকে আমি জোর করে বিয়ে করেছি নির্জনের জ,,, রিশাদের কথা শেষ হবার আগেই তার ফুপু সপাটে এক চড় মারলেন তার গালে। আচমকা থাপ্পড়ে হতভম্ব রিশাদ গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নিঃশব্দে। ততক্ষণে ফুপু তার সামনে থেকে গেছেন। হাতের নাড়ু হাতেই রইলো তার। এক পা দু পা করে ছেড়ে বেরিয়ে গেল রিশাদও। বাইরে কুয়াশা বাগানের মাটি শিশিরে ভিজে সোদা এক গন্ধ তৈরি করেছে যেন৷ এ গন্ধ অন্যরকম, অনেকটা ভ্যাপসা গরমে হালকা বৃষ্টিতে মাটি ভেতরের ফাঁপা গন্ধ । মন্দ লাগছে না রিশাদের তবে শীতটা গায়ে সুঁইয়ের মত বিঁধছে। কিন্তু এখন আর ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না গরম কাপড়ের জন্য। ফুপু নিশ্চয়ই এখন তার ঘরেই গিয়েছে। সে অন্যায় করেছে মেবিশকে জোর করে বিয়ে করে।কিন্তু তার কি উপায় ছিলো সেদিন! ছেলেটার সেদিনের অসুস্থতা, কান্না এবং মেবিশের কোলে যেতেই তার চুপ হয়ে যাওয়া। উগ্র চিত্তের রিশাদ সেদিন ছেলেটার ভালো শুধু মেবিশকে ঘিরেই মনে হয়েছিলো। একটাবারও তখন নিজের করা কাজগুলোকে অন্যায় মনে হয়নি। বাবা হিসেবে সবই ঠিক মনে হয়েছিলো কিন্তু এখন একটু একটু করে নিজের ভুলগুলো উপলব্ধি করছে সে। ভুলগুলো যেন এখন নিজ থেকেই তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সব৷ যা হয়েছে সব অন্যায়, যা করেছে সব ভুল কিন্তু সে কি এখন মেহউইশকে মুক্তি দিলে সেই ভুল শুধরানো সম্ভব! ‘নাহ, মেবিশকে ছাড়তে পারবো না আমি’ নিজের মন থেকেই যেন এমন এক জেদমাখা মন্তব্য শুনতে পেল রিশাদ।

চলবে
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here