#মন_গহীনে
#পর্বঃ৮
#দোলন_আফরোজ
সেদিনের পর কেটে গেছে কয়েকদিন,এর পর থেকে কাব্য কখনো আর তিথীকে একা ছাড়েনি। শত ব্যস্ততার মাঝেও একা ছাড়েনি আর।তিথীর এক্সাম এর আর মাত্র ২ দিন বাকি,তাই এখন পড়ার চাপ ও অনেক বেশি। দম নেয়ার সময় নেই তিথীর। তিথী স্টুডেন্ট মুটামুটি ভালো, তবে তমা তিথীর চেয়ে একটু বেশি ভালো স্টুডেন্ট। তিথী ও ভালো তবে দুষ্টু বেশি,তাই পড়াশোনায় অমনোযোগী। কোচিং এর বাইরেও তমা তিথীর পড়াশোনার বিশেষ খেয়াল রাখে। অফিসের জন্য ওর বাবা তেমন সময় দিতে পারে না তবে কাব্য মাঝে মাঝেই এসে খোঁজ খবর নেয় পড়ার। প্রথম কিছুদিন তিথী কাব্যর সাথে একদম ই কথা বলেনি ঔ ঘটনার পর, তাতে কাব্য বিশেষ পাত্তা দেয়নি।সে এসে ঠিক ই তার জোর খাটাতো, তবে ভালাবাসা টা প্রকাশ করেনি কখনো।
কাল এক্সাম, তাই আজ সন্ধ্যা থেকে কাব্য তিথীর রুমেই আছে। বিরক্ত লাগছে তিথীর, তবু কিছু করার নেই, এই কাবির সিং কে সহ্য করতেই হবে তার।তিথী টেবিলে পড়ছে আর কাব্য বেড এ বসে ফোন ঘাটছে। সন্ধ্যার নাস্তা নিয়ে এসেছে তানিয়া বেগম। এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়ে কাব্য কে চা দিয়ে চলে যান উনি।
এখন তিথীর ব্রেক টাইম। নাস্তা করে আবার পরবে। তিথী আলু পুড়ি খাচ্ছে। কাব্য চায়ে চুমুক দিয়ে মুখ বিষিয়ে বলে, উহুম চিনি হয়নি। তিথী অবাক হয়ে বড় বড় চোখ করে তাকায় কাব্যর দিকে।
-কি বিশ্বাস হয়নি?
-তিথী হা হয়ে তাকিয়েই আছে।
-খেয়ে দেখো তুমিই।
-উহুম..
-আরেহ দেখোই না।বলে নিজেই কাপ টা তিথীর হাতে ধরিয়ে দেয়।তিথীও বাধ্য মেয়ের মতো চায়ে চুমুক দেয়।
-কই ঠিক ই তো আছে।
– কই দেখি। বলে কাব্য চা নিয়ে চুমুক দিয়ে বলে, হুম এইবার ঠিক আছে। বলেই মুচকি হাসে।
সব যেনো তিথীর মাথার উপর দিয়ে যায়। সে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে।
এভাবে হা হয়ে থাকলে মুখে মাছি ঢুকবে।তারাতাড়ি নাস্তা শেষ করে পড়তে বসো। বলে মাথায় ছোট্ট করে ঘাট্টা মারে।
*******************
ভার্সিটি ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।আড্ডায় মেতে উঠেছে। আবির সবার সাথে গল্প করছে। কাব্য পকেটে এক হাত গুজে আরেক হাত ঠোঁটে চেপে সিগারেট ফুকছে।
আবিরঃ সমস্যা কি তোর বলতো? আগের মতো আড্ডাতেও পাই না তোকে। আর রবিন গ্রুপের ছেলেপেলেদের সাথে মারামারি করেছিস কেনো?
কাব্য ভাবলেশহীন ভাবেই আছে।
আবির বিরক্ত হয়ে, কি চলছে তোর মনে বলনা? কি লুকাচ্ছিস তুই।
আবিরের পিঠে চাপড় মেরে বলে লুকাচ্ছি যখন তার মানে লুকানোর মতোই কিছু হয়তো। সময় হলে ঠিক জানতে পারবি। এখনো জানানোর সময় হয়নি বুঝলি।বলে রহস্যময় হাসি দেয়।
তুই আগে থেকেই ইন্ট্রোভাট স্বভাবের, কিন্তু আমার মনে হতো আর কেউ তোকে বুঝুক না বুঝুক আমি অন্তত বুঝি, এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল। চরম লেভেলের ভুল।
আরেহ চিল ইয়ার, এতো ভাবছিস কেনো।তেমন কিছু না, সময় হলে তোকেই আগে জানাবো।
এর মাঝে একবার তমার সাথে আবিরের চোখাচোখি হয়। আবির ও এখন আর তমাকে জ্বালায় না। বুঝতে পেরেছে ভালোবাসা জোর করে হয় না। তার ভালোবাসা সে মনের মাঝেই দমিয়ে রেখেছে। তমার সরলতা, ভয় ভয় চাহনি তবুও পাগল করে দেয় আবিরকে। আবির তমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে বড় একটা নিশ্বাস টেনে কাব্যর আধা খাওয়া সিগারেট টাই নিয়ে লম্বা একটা টান দেয়।
এদিকে ঔ ঘটনার পর থেকে তমা কেনো যেনো আবিরের প্রতি নিজেকে দূর্বল অনুভব করে। কিন্তু আবিরের তরফ থেকে এখন আর কোনো রকম আগ্রহ না দেখায় এক প্রকার হতাশ ই হয় সে। চোখ টা নামিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ায়। কিছুই চোখ এড়ায় না কাব্যর।
মোহনা এসে কাব্যর সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলে, কেনো বুঝনা তুমি আমার চোখের ভাষা? আমি আর নিতে পারছি না তোমার অবহেলা। প্লিজ আমায় আর ফিরিয়ে দিও না। এতোটা হ্যাংলা আমি জীবনে কোনো দিন ও হইনি, যা তোমার সামনে এসে হয়ে যাই। প্লিজ কাব্য আমার ভালোবাসাটাকে এভাবে অবমূল্যায়ন করো না। আমি বাঁচতে পারবো না। খুব ভালোবাসি তোমায়।
আজ আর কাব্য রাগ করেনি। শুধু বলে সত্যিই ভালোবাসো?
মোহনার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। বাচ্চাদের মতো তৎক্ষনাৎ মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়।
-তবে তুমি বুঝবে আমার কথা। আমি জানিনা তুমি আমায় কতোটা ভালোবাসো। কিন্তু আমি আমার সবটা দিয়ে একজনকেই ভালোবাসি। সেখানে আর অন্য কাউকে ঠায় দেয়া সম্ভব না।প্লিজ বুঝার চেষ্টা করো। আমি আমার পক্ষ থেকে কোনোদিন ও তোমাকে পজেটিভ সাইং দেইনি। তাই আমার মনে হচ্ছে তোমাকে রিফিউজ করা টা দোষের কিছু না। দয়া করে অন্য কাউকে ভালোবাসার চেষ্টা করো। আমি বলছি তুমি সুখি হবে। কেউ একজন তোমায় এতোটা ভালোবাসবে যে এই বিষাক্ত ভালোবাসার কথা তোমার মনে থাকবে না।
– আমি তো আমার জীবনে অন্য কাউকে চাই না। চাই না কারো সাথে সুখী হতে। আমি আমার জীবনে শুধু তোমাকেই চাই।
– আমার জীবন টাই তো আমার নেই। বহু বছর আগে অন্য কারো হয়ে গেছে। আমি চাইলেও আমার জীবন টা ওর থেকে ফিরিয়ে নিতে পারবো না। আর আমি কখনো তা চাই ও না। প্লিজ আমায় অপরাধী করো না। ভালো থাকার চেষ্টা করো প্লিজ।
– তুমি পাগল হয়ে গেছো কাব্য, পাগল হয়ে গেছো তুমি। যার অস্তিত্ব ই নেই তুমি তাতেই মজে আছো।
এবার কিছুটা শক্ত হয়ে যায় কাব্য। চোখ মুখ শক্ত করে বলে, আছে ওর অস্তিত্ব।
মোহনাও সমান তেজে বলে, কোথায় আছে। একবার দেখাও আমায়, কথা দিচ্ছি আর বিরক্ত করবো না তোমায়।
কাব্য বুকের বা পাশটায় হাত দিয়ে বলে, এখানে, এখানে আছে ও। চাইলেও আর কাউকেই এখানে বসাতে পারবো না আমি।বলেই আরেকটা সিগারেট ধরায়।
মোহনা আর কোনো কথা বাড়ায় না। জানে বরাবর এর মতো এখনো কিছু বলে লাভ হবে না। তাই চোখের পানি মুছে আবির কে বলে, আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে, তোর বন্ধুকে বলে দিস আমি আমৃত্যু ওর জন্য অপেক্ষা করবো। এটুকু বলেই চলে যায়।
হতাশ হয়ে মোহনার যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে কাব্য। ভালোবাসা সুন্দর, তবে ভুল মানুষকে ভালোবাসার মতো কুৎসিত আর কিছু নেই। তোমার জন্য সেই ভুল মানুষ টা আমি।সব সময় চাইবো যেনো এমন কেউ তোমার জীবনে আসে যে তোমার জীবন টা ভালোবাসায় ভরিয়ে দিবে।
*********************
তিথীর পরিক্ষা চলাকালীন সময় কাব্যই আনা নেয়ার করেছে। মাঝে মাঝে তানিয়া বেগম আর তারেক রহমান ও নিয়ে গেছে।সেদিন এক্সাম শেষে ফিরার সময় কাব্য আর তিথী দেখে ড্রয়িং রুমে বসে কারো সাথে গল্প করছে। মহীলা দুটো বলছে, বুঝলেন ভাবি, পাড়ায় রি রি পরে গেছে আপনার মেয়ের হারানোর কথা টা। কেউ কেউ তো বলছে মেয়ে কোনো ছেলের সাথে ভেগেছে, আবার কেউ বলছে কি*ড*ন্যা* প যখন করেছে তবে কি আর এমনি এমনি ছেড়ে দিয়েছে। বললেই হলো? কোনো মুক্তি পণ দাবি করেনি কিছুনা, এমনি এমনি তো আর নেয় নি না। তানিয়া বেগম কিছুটা মন খারাপ করে বলেন এসব কি করে বলে এসব কি কথা বলছেন ভাবি। আমার ছোট্ট মেয়েটাকে এমন অপবাদ দিবেন না দয়া করে। ও এসবের কিছুই বুঝে না।
কি বলেন ভাবি। সারাক্ষণ এমপির ছেলের সাথে লেগে থাকে আর আপনি বলছেন কিছু বুঝে না? সব ই চোখে পড়ে ভাবি, শুধু আপনি ই দেখেও না দেখার জন্য চোখ বন্ধ করে আছেন।
এবার তানিয়া বেগম কিছুটা রেগেই বলেন যা জানেন না তা নিয়ে কেনো কথা বলেন। কাব্য আমার ছেলের মতো। ছোট থেকেই সে আমার ছেলে হয়েই বড় হয়েছে।
ছেলের মতো। ছেলে কিন্তু না। লোকে মোটেও এটা ভালো চোখে নেয় না।ঘরে দুইটা জোয়ান মেয়ে। আর সারাক্ষণ একটা ছেলের আসা যাওয়া বাসায়। লোকে কথা বলবেই। আপনি কজনের মুখ বন্ধ করবেন।
তখনই কাব্য আর তিথী এসে সব শুনে উনাদের কথা। উনারা চুপ হয়ে যায় কাব্য কে দেখে। আরো কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যান উনারা। তিথীও চলে যায় ফ্রেশ হতে।তানিয়া বেগম এক্সামের খোঁজ খবর নিয়ে রান্না ঘরে খাবার রেডি করতে চলে যান আর কাব্য কে বলে ফ্রেশ হয়ে খেতে আসতে।
খাবো না চাচী, সন্ধ্যায় আসবো। চাচা ফিরলে চাচার সাথে আর তোমার সাথে কথা আছে আমার।বলে বের হয়ে যায়। চিন্তায় পরে যায় তানিয়া বেগম, কি বলবে কাব্য? মহিলা গুলোর কথা নিশ্চয় শুনেছে সে। এখন কি সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে ছেলে? ভয়ে বুক দুরুদুরু করছে উনার।
কাব্য বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়।মা খাওয়ার জন্য ডাকতে আসে।
খেতে ইচ্ছে করছে না মা।
– কেনো কি হয়েছে বাবা?
-কেনো যেনো অশান্তি লাগছে খুব। মনে হচ্ছে জীবন থেকে অনেক বড় কিছু হারিয়ে ফেলবো।
ছেলে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে।
শাহানারা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
তিথীর কি খবর? এক্সাম কেমন হচ্ছে।
-ভালোই হচ্ছে।
শেফালী কে কাব্যর জন্য খাবার দিয়ে যেতে বলে শাহানারা বেগম। শেফালী খাবার দিয়ে গেলে নিজ হাতে খাইয়ে দেন উনি ছেলেকে।
খাইয়ে দেয়ার পর উনি কাব্য কে রেস্ট নিতে বলে চলে যান।
বুকের ভিতর এর অস্থিরতা টা বেড়েই চলেছে। না জানি কি হতে চলেছে ভবিষ্যতে। এতো দিন ধরে বুকের ভিতর হতে থাকা যন্ত্রণা টা আজ যেনো দিগুণ পরিমান বেড়ে গেছে।
।
।
।
।
চলবে………