#মন_গহীনে
#পর্বঃ২৭
#দোলন_আফরোজ
আজ ৪ দিন পর কাব্য এখন পুরোপুরি সুস্থ। এই ৪ দিন যাবৎ তিথী যেনো হঠাৎ ই বড় হয়ে গেছে। কারণ কাব্যর সেবা সেই করেছে। মুখে তুলে খাওয়ানো সহ, বাথরুমে ধরে নিয়ে যাওয়া থেকে গোছল করানো সহ সব ই তিথী করেছে। কাব্য শুধু অবাক হয়ে দেখেছে তার পিচ্চি পুতুল বউ কে। তিথীর এই রূপের সাথে সে একদম ই অপরিচিত। এতোটা দায়িত্বশীল কি করে তিথী হয়ে গেলো তা কাব্য সহ বাড়ির সবাই অবাক হয়।
আজ সন্ধ্যা থেকেই কাব্য যেনো ছাদে কি করছে। ছাদে কারোই যাওয়া নিষেধ। বিশেষ করে তিথীর। হিয়া আর কাব্য মিলে যে কি করছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। মুখ ভার করে বসে আছে সন্ধ্যা থেকে। হুহ কি এমন হলো যে আমার সাথে কথা বলার সময় পর্যন্ত নেই। আমিও কথা বলবো না, হুহ।
রাত ৯ টার দিকে নেমে আসে দুজন। গাল ফুলিয়ে রেখেছে তিথী। তা দেখে মিটমিট করে হাসছে হিয়া। কাব্যর তাতে কোনো ভাবলেশ নেই। সে তার মতো ফ্রেশ হতে চলে যায়।
ভাবি চলো সাজিয়ে দেই তোমাকে।
ভ্রু কুঁচকায় তিথী। সাজবো কেনো? সত্যি করে বলোতো কি প্ল্যান করেছো তোমরা?
তা কিছুক্ষণ পর ই দেখতে পাবে, চলো একটা শাড়ী পড়িয়ে দেয় তোমাকে।
কোনো শাড়ী টারি পরবো না আমি। আর ঐ ব্যাটা কাব্যর জন্য তো না ই।
বাব্বাহ,এত্তো রাগ?
রাগ হবে না? সেই সন্ধ্যা থেকে কোনো দেখা ও নেই কথা ও নেই। ছাদে কি করছে তা দেখতে পর্যন্ত দেয়নি আমাকে।( গাল ফুলিয়ে)
আচ্ছা, আচ্ছা আর রাগ করতে হবে না। আমার ভাই তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে। এবার তুমিও তাকে সারপ্রাইজ দিবে আর এটাই চাই আমি। বলে কাবার্ড থেকে একটা গোল্ডেন পাড়ের লাল কাঞ্জিভরম শাড়ী বের করে।
হিয়া নিজেই শাড়ী পড়িয়ে, হালকা মেকাব দিয়ে সাজিয়ে দেয় তিথীকে।
এর মাঝেই কাব্য ফোন করে তিথীকে। একবার ছাদে এসো প্লিজ।
এখন কেনো ডাকছেন? কেনো আসবো আমি? আসবো না।(অভিমানী কন্ঠে)
প্লিজ, এসো একবার। কাতর গলায়।
তিথী ছোট করে শুধু বলে আচ্ছা।এতেই যেনো কাব্যর খুশীর সিমা নেই।
ওদের কথা শুনছিলো হিয়া। সাজানো শেষ করে তিথীর দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। তিথী এখনো মুখ গোমড়া করে।
প্লিজ ভাবি, এবার তো একটু হাসো।
তিথী মুখ ভেটকি করে একটা মেকি হাসি দিয়ে বলে হয়েছে?
হাসতে হাসতে বলে হিয়া, হয়েছে হয়েছে।খুব সুন্দর লাগছে তোমায়।
এর মাঝে আবারো কল দেয় কাব্য। এবার কল কেটে দিয়ে ছাদের সিড়ির দিকে এগিয়ে যায় তিথী। ছাদে পা রাখতেই পা দুটো থমকে যায় তিথীর।
হা হয়ে তাকিয়ে দেখছে চারপাশ টা। মনেই হচ্ছে না এটা তাদের বাসায় ছাদ। মনে হচ্ছে নতুন কোনো জায়গা। পুরো ছাদ লাইটিং করা নীল রঙে। কারণ নীল তিথীর পছন্দের রঙ। ছাদের এক কোণে একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার দেয়া। এর ও চারপাশটা নীল লাইটিং এ ঘেরা। নীল লাইটের মাঝে সাদা কাপড়ে মুড়ানো টেবিল চেয়ার কে অন্য রকম আকর্ষণীয় লাগছে।
চিলেকোঠার ঘরটাও মনে হয় সাজানো। বাইরে থেকে তাই মনে হচ্ছে।তিথী যখন এসব দেখায় মগ্ন তখনই একটা ভারী গলার আওয়াজ শুনতে পায়।
Welcome to my Palace my Queen.
আওয়াজ অনুসরণ করে ওদিকে তাকাতেই তিথী দেখে কাব্য দুহাত বুকে গুজে ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখনই বিকট আওয়াজ আর আলোক রশ্মির আভাস পেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে উজ্জ্বল আলোক রশ্মির মাঝে লেখা
Welcome to my life putul bou.
তিথী অবাকের শীর্ষে পৌঁছে যায়। তার মানে এসব করছিলো এতোক্ষণ কাব্য।
কাব্য এগিয়ে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তিথীকে। শাড়ীর ফাঁক দিয়ে হাত টা পেটে চালিয়ে দেয়।
তিথীর শিরদাঁড়া দিয়ে যেনো ঠান্ডা কিছু বয়ে গেলো। কাব্য মুখটা কানের কাছে নিয়ে নেশালো কন্ঠে বলে, এতো সেজেছো কেনো? পাগল করে দিতে আমায়?
তিথীর মুখ থেকে কথা বেরুচ্ছে না। অনেক কষ্টে মুখ খুলে সে, আ আম আমি তো। কি বলবে সব গুলিয়ে ফেলছে সে।
তড়িৎ গতিতে তিথীকে ঘুরিয়ে ফেলে কাব্য। চোখে চোখ রেখে বলে কিচ্ছু বলতে হবে না তোমার। আজ আমাকে উন্মাদ করার জন্য এটুকু দরকার ছিলো। আজ আমি তোমাতে উন্মাদ হতে চাই।
তিথী আজও সেদিনের সেই কমনীয়তা দেখছে কাব্যর চোখে। ভয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলেই কোমড়ে শক্ত করে চেপে ধরে কাব্য। আহ্লাদী কন্ঠে বলে, আর কতো পালাবে বলো?এই অবলা পুরুষ মানুষ টার কথাটাও তো একটু ভাবো।
ভয়ে লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে তিথী। কাব্য তার চিবুকে হাত দিয়ে মুখটা উঁচু করে বলে, এভাবে লজ্জা পেলে তোমায় খে*য়ে নিতে ইচ্ছে করে। আর পারছি না আমি, বলেই ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। প্রায় ৫ মিনিট পর ছাড়ে। কাব্যর ঠোঁটে প্রাপ্তির হাসি, তিথীর চোখে লজ্জা। আবারো কানে কানে বলে কাব্য, আমার বউ টা এতো লাজুক জানতাম নাতো। আমি তো শুধু তার রাগী মুখটাই দেখেছি।এটা শুনে তিথী আরো লজ্জা পায়।
কিছুটা লজ্জা পরের জন্য ও তোলা রাখো নাগো। এখন আপাতত চলো ডিনার করে নেই। বলেই তিথীর হাত ধরে টেবিলের দিকে নিয়ে যায়। টেবিলে সাজানো আছে তিথীর প্রিয় কাচ্চি, কোল্ডড্রিং আর তার ই পাশে দেখতে অসুন্দর একটা পিৎজা। পিৎজার দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকে লাজুক হাসি দিয়ে কাব্য বলে পিৎজা টা সুন্দর হয়নি। আসলে ফার্স্ট টাইম করেছিতো তাই।
তিথী কাব্যর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে আপনি করেছেন?
কাচ্চিটাও আমি করেছি। তবে কাচ্চি ভালো হবে বলতে পারি। কারণ এটা আগে অনেক বার ট্রায়াল দিয়েছি। যেদিন শুনেছি তোমার কাচ্চি পছন্দ সেদিন থেকেই প্রায় মাঝে মাঝেই এটা করি। প্রথম দিকে ভালো হতো না অবশ্য। এখন খেতে কোনো শেইফ এর চেয়ে কম হয় না।
তিথী আজ শুধু অবাক ই হচ্ছে।। এই কাবির সিং যে এতোটা রোমান্টিক তা কল্পনা ও করেনি সে।
এতো অবাক হওয়ার ও কিছু নেই। আমার বউ এর জন্য সব করতে পারি আমি।ক্রেডিট নেয়ার ভান করে। এখন খেয়ে বলুন ম্যাম টেস্ট কেমন হয়েছে।
বলে একটা চেয়ার টেনে তিথীকে বসিয়ে দেয়। সামনের চেয়ারটাতে বসে কাব্য। সে নিজেই খাবার সার্ভ করেছে। তিথীর এবার বেশ লজ্জা লাগছে। খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে খাচ্ছে না।
কি হলো শুরু করো।তিথী খাবার মুখে নিয়ে আরেক ধাপ অবাক হয়। অসাধারণ টেস্ট। একটা মানুষের এতো গুন কি করে থাকতে পারে। সেই সাথে একটু কষ্ট ও হয় সে কিছুই পারে না।
তিথীর মন খারাপ দেখে কাব্য জিজ্ঞেস করে কি হলো ভালো হয়নি?
খুব ভালো হয়েছে খেতে।
তবে?
আপনি কতো কিছু পারেন, আর আমি কিছুই পারি না।( মন খারাপ করে)
কিচ্ছু পারতে হবে না তোমার।আর এসব রান্না বান্না? তা তো আমি তোমায় কক্ষনো করতেই দিবো না।
কেনো? সেদিন খেতে পাননি বলে?
এবার রাগ করে কাব্য। গম্ভীর গলায় বলে, আমি তা বলিনি। তুমি যা রান্না করেছিলে আমার জন্য তা আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার ছিলো। কিন্তু তা করতে গিয়ে তুমি যে হাত পুড়িয়েছিলে তা ভুলিনি আমি। আমি চাইনা এটার রিপিট হোক আবার।
রাগ করলেন?
না খাও। তুমি খেলেই আমার রান্না করা সার্থক হবে। স্বাভাবিক হয়ে।
তিথী আবার খাওয়া শুরু করে। তিথী খাচ্ছে, কাব্য এক মনে চেয়ে চেয়ে দেখছে। তার সামনের খাবারের প্লেট টা ওভাবেই আছে। কাব্যর এমন কান্ড দেখে লজ্জা পাচ্ছে তিথী। আপনি খাচ্ছেন না কেনো?
খাইয়ে দাও আমায়।
তিথী নিজের হাতে খাইয়ে দেয় তাকে। খাওয়া শেষ করে দুজন ছাদের একপাশে গিয়ে বসে চন্দ্র বিলাস করে। আজ চাঁদ টাও পূর্নিমা এই দিনটার জন্যই কাব্য অপেক্ষা করে ছিলো। কোনো এক পূর্নিমার রাতে তার প্রেয়সীকে কাছে পাবে, খুব খুব খুব কাছে। কাব্য বসে আছে, তারই বুকে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসে আছে তিথী।
আমার চাঁদের সামনে আকাশের চাঁদ টাকে বড্ড ফিকে লাগছে। কাব্যর কথায় লজ্জা পায় তিথী। কাব্যর তাতে ধ্যান নেই। সে যেনো আবেশে মুগ্ধ হয়ে আছে। চোখ দুটো বুজে আছে সে।
একটা গল্প শুনবে তিথী?
হুম বলুন।
প্লিজ আপনি টা না। বড্ড বেমানান লাগছে এই আপনি ডাক টা।
যাহ কি করে তুমি বলবো আমি।
আমি যেভাবে বলি।চেষ্টা করো। না না চেষ্টা না, এক্ষুনি বলবে তুমি। বলো।
আচ্ছা বলো।
সাউন্ড সো গুড। এখন থেকে তুমি বলবে। আর আপনি না। আচ্ছা গল্পটা শুরু করি। বলেই শুরু করে তিথীকে কাব্যর প্রথম দেখার এবং কোলে নেয়ার দিন থেকে শুরু করে ওদের ১৫ বছর পর দেখা হওয়ার দিন পর্যন্ত সবটা কাহিনী। শুধু নাম মেনশন করেনি কাব্য।
এবার তিথী অবাকের শেষ সিমা ও ভেঙে ফেলে। মেয়েটা যে সে আর ছেলেটা যে কাব্য তা সে ভালোই বুঝতে পারে। কাব্যর দিকে তাকিয়ে ডান হাত টা বা গালে রেখে, চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে মেয়েটা আমি আর ছেলেটা তুমি। তাই না?
ছোট করে মাথা নাড়ে কাব্য।
অশ্রু গুলো চোখে থাকা দায় হয়ে পড়ে তিথীর। জোর করে আটকে রাখার ব্যার্থ চেষ্টা ও করেনি সে। সব ছেড়ে দেয়।
কাব্য তার দুহাতের আজলায় তিথীর মুখটা নিয়ে বলে, এই পাগলি কি হয়েছে, কাঁদছো কেনো তুমি।
কাব্য কে জড়িয়ে ধরে তিথী। খুব শক্ত করে ধরে। এতোটা ভালো কি করে বাসতে পারে একটা মানুষ। এতোটা ভালো কি করে বাসলে তুমি আমায়। আমি তো কোনো দিক থেকেই তোমার যোগ্য না। আমার তো তোমার ভালোবাসা পাওয়ার কোনো যোগ্যতাই নেই। তবু বার বার কষ্ট দিয়েছি আমি তোমায়।
এই পাগলি কি বলছো তুমি এসব? তোমাকে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন ই আমার জন্য। আর যোগ্যতা অযোগ্যতার হিসেবে এখানে আসছে কেনো? আমি কোন দিক থেকে এতোটা যোগ্যতা অর্জন করে ফেললাম যে তুমি আমার অযোগ্য হয়ে গেলে? আর ভালোবাসা যোগ্য অযোগ্য দিয়ে হয় না।
তবুও এতোটা ভালোবাসা পাওয়ার কথা ছিলো না আমার। এতোটা ভালোবাসা আমি কি ধরে রাখতে পারবো? কাব্য কে আরো শক্ত করে ধরে।
কাব্য ও আরো শক্ত করে ধরে বলে, আমরা দুজন মিলে আগলে রাখবো আমাদের ভালোবাসাকে। তোমায় না দেখেও আমার ভালোবাসা বিন্দু মাত্র কমেনি, বরং বেড়েছে তীব্র আকারে। এখন যখন তোমাকে পেয়েছি, তোমার ভালোবাসা পেয়েছি তা প্রতিনিয়ত নতুন ভাবে নতুন রঙে সাজাবো।
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি। খুব খুব খুব ভালোবাসি।
তিথীকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে থাকে কাব্য। কতোক্ষণ থাকে কেউ বলতে পারে না। হেমন্তের শেষের দিক। গভীর রাতে ঠান্ডা টাও পরে বেশ। হঠাৎ ই কাব্য কোলে তুলে নেয় তিথীকে। কোলে নিয়ে চলে যায় চিলেকোঠার ঘরটাতে।
তিথী এখনো কাব্যর কোলে। ঘরে ঢুকে তিথী পুরো আকাশ থেকে পড়ে যেনো।ঘরটা নতুন ভাবে সাজানো। নতুন একটা খাট। সাদা বিছানার চাদরের উপর লাল গোলাপ দিয়ে লেখা “পুতুল বউ, তোমার অপেক্ষায়”
খাট টা রজনীগন্ধা দিয়ে সাজানো। পুরো ঘরটা লাল হলুদ সাদা গোলাপ আর রজনীগন্ধা দিয়ে সাজানো। ঘরে নতুন ছোট্ট একটা ড্রেসিং টেবিল, আর একটা সিংগেল ওয়ারড্রব। ওয়ারড্রব এ কাব্য তিথীর প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড়, যা কাব্য কদিন আগে থেকেই একটু একটু করে গুছিয়ে রেখেছে।
এতোসব আয়োজন দেখে তিথীর বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ শুরু হয়ে যায়। তিথীকে কোল থেকে নামিয়ে দিতেই সে ঘরের এক কোণে গুটিসুটি মেরে দাঁড়ায়। কাব্য তিথীর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, তোমার ফ্রেন্ড যা যা শেখায়নি তা আজ শেখাবো।
আ আমি আমি জানি সব। শি শিখ শিখাতে হবে না কিছু। আমতা আমতা করে বলে।
এবার হাসে কাব্য। ওহ তাহলে তো ভালোই হলো, কষ্ট করে শিখিয়ে নিতে হবে না আমার।
আম আমি বাইরে যাবো, বলে দরজায় পা বাড়াতে নিলেই হাত ধরে ফেলে কাব্য। নেশালো কন্ঠে বলে, প্লিজ আজ দূরে চলে যেও না, পারবো না আমি।
এ কন্ঠে যেনো কি ছিলো। তিথীর শরীরের সমস্ত রক্ত যেনো সব জমে বরফ হয়ে গেছে। এর আগেও কাব্য কাছে এসেছে, খুব কাছে, তবে এতোটা এমন লাগেনি যা এই একটা মাত্র কথায় লাগছে।চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে সে। তিথীর চুলে মুখ ডুবিয়ে দেয় কাব্য। ঘাড়ে পিঠে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দেয়। নাহ আর নিতে পারছে না তিথী কাব্য কে ঝাপটে ধরে তিথী।
কাব্য দিশেহারা হয়ে যায়। অতপর দুজনে সুখের সমুদ্রে ডুবে যায়।
তিথীর চিৎকারে ওয়াশরুম থেকে ছুটে আসে কাব্য। বেরিয়ে দেখে তিথী গলা কাটা মুরগীর মতো থরথর করে কাঁপছে। তিথীর মাথাটা বুকে চেপে ধরে কাব্য। কি হয়েছে সোনা? খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে? আম স্যরি, প্লিজ ক্ষমা করে দাও আমায়। আরেকটু কেয়ারফুল হওয়া উচিৎ ছিল আমার। বলোনা খুব কষ্ট হচ্ছে?
তিথী আংগুল দিয়ে বিছানার চাদর টা দেখায়। সাদা চাদরে রক্তের দাগ লেগে আছে।
তিথীর কপালে চুমু দিয়ে বলে, কিচ্ছু হয়নি সোনা। ফার্স্ট টাইম তো তাই এমনটা হয়েছে। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
তিথী আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাব্য কে। চলো ফ্রেশ হয়ে নিবে চলো।
সকাল বেলা তিথী চিন্তা করছে বাড়ির সবাইকে মুখ দেখাবে কি করে। সবাই কি না কি ভাববে। এদিকে কোমড়ের নিচ থেকে পচন্ড ব্যাথা। এসব ভাবনার মাঝেই কাব্য এসে বলে চলো নিচে। সবাই ব্রেকফাস্ট এর জন্য ওয়েট করছে। শেফালী এসে বলে গেছে দুবার।
মাথা নিচু করে আছে তিথী। কাব্য বুঝতে পেরে ওর পাশে বসে স্যরি বলে কপালে গভীর চুমু দিয়ে হাত ধরেই নিচে নিয়ে আসে।
সবাই আছে নাস্তার টেবিলে। সবাই স্বাভাবিক ই আছে, এমনকি কাব্য ও, যেনো কিছুই হয়নি। তিথী ই ভিতর ভিতর লজ্জায় মরে যাচ্ছে।
রাতের দিকে প্রচন্ড জ্বর আসে তিথীর, সাথে শরীর ব্যাথা ও। ডাক্তার ডাকতে চায় কাব্য। শাহানারা বেগম ই দেননি। বলেন এটা স্বাভাবিক, প্যারাসিটামল খেলেই সেরে যাবে। সেই মতো প্যারাসিটামল খাইয়ে মাথায় জলপট্টি দিয়ে এখন তিথীর হাত ধরে অপরাধী মুখ করে বসে আছে কাব্য। রাগী চোখে তাকিয়ে আছে তিথী।
।
।#মন_গহীনে
#পর্বঃ২৮
#দোলন_আফরোজ
মুখোমুখি বসে আছে পিয়াসের বাবা আর কাব্যর বাবা। হঠাৎ ই পিয়াস স্ব পরিবারে কাব্যদের বাসায় হাজির হয়েছে। এর কারণ কি বুঝতে পারছে না কেউ। কাব্য বার বার জিজ্ঞেস করেছে পিয়াসকে, তার এক কথা, বাবা বলবে। ভ্রু কুঁচকায় কাব্য, ও যা ভাবছে তাই নয়তো।
হালকা নাস্তা করে গলাটা ঝেড়ে পিয়াসের বাবা বলতে শুরু করেন।আসলে সেলিম ভাই, কথাটা পিয়াসকে নিয়ে। পিয়াস আপনার ভাগ্নী হিয়াকে পছন্দ করে। কথাটা শুনার পর সবাই বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় হিয়ার দিকে। হিয়া আর তিথী রান্না ঘর থেকে আসছিলো, হাতে নাস্তার প্লেট নিয়ে। হঠাৎ এমন কথায় যেনো সে আকাশ থেকে পড়ে। সবাই ওর দিকে তাকাতে মাথা খুব জোরে না করে জানান দেয় ও কিছু জানে না।
পিয়াসের বাবা মা কে নিয়ে আসায় কাব্য এমনই কিছু ধারণা করেছিলো। তবে অবাক হয় আগে পরে ওকে কিছু জানায়নি কেনো পিয়াস।
পিয়াসের বাবা আবারো বলতে শুরু করে, আমরা অনেকদিন থেকেই আসতে চেয়েছিলাম বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে, পিয়াস ই দেয়নি। কাব্য কিভাবে নেয় ব্যাপার টা, পাছে তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। কিন্তু এখন যখন বিয়ের জন্য চাপ দেই তখন তার এক কথা, বিয়ে করলে হিয়াকে করবে নয়তো করবে না। তাই অনেক জোরাজোরি করে নিয়ে এলাম।
আসলে এই ব্যাপারে আমার বোন হেনার সাথে আগে কথা বলতে হবে আমার। আর সবচেয়ে বড় কথা হিয়ার মতামত জানা জরুরী। নিস্বন্দেহে পিয়াস খুব ভালো ছেলে, তার উপর কাব্যর বন্ধু। তাই বলে আমার কাছে থাকে বলে যে আমার সিদ্ধান্ত তার উপর চাপিয়ে দিবো তা না।
তা তো অবশ্যই। সবার আগে হিয়া মার মতামত জরুরী। আমাদের তরফ থেকেও কোনো চাপ নেই।
হেনা বেগম জানান ছেলেকে উনার পছন্দ, উনার কোনো অসুবিধা নেই। হিয়ার মতামত জানতে চায়লে হিয়া জানায় বড় রা যা সিদ্ধান্ত নিবে তাই হবে।
আলহামদুলিল্লাহ বলে পিয়াসের মা হিয়াকে আংটি পরিয়ে দেয়।ওদেরকে একান্তে কথা বলার জন্য কাব্য আর তিথীই ছাদে নিয়ে যায়।
লজ্জায় হিয়া পিয়াসের দিকে তাকাতে পারছে না। পিয়াস এক দৃষ্টিতে দ তাকিয়ে আছে হিয়ার দিকে। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে হিয়া। এর আগে কখনো সে পিয়াসের সামনে তেমন একটা যায়নি। কিন্তু আজ এমন একটা পরিস্থিতিতে সে কি করবে বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারে পিয়াস। নিরবতা ভেঙে সেই বলে, এই বিয়েতে তোমার আপত্তি আছে?
বলেছিতো আমি বড়োদের।
হুম শুনেছি। আমি আবারো শুনতে চাচ্ছি।
উহুম, মামা, মা ভাইয়ারা যা সিদ্ধান্ত নেয় তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
আমি তোমার সিদ্ধান্ত জানতে চাচ্ছি।
চুপ করে আছে হিয়া।
তারমানে তোমাকে জোর করা হচ্ছে এই বিয়েতে? তুমি রাজি না?
রাজি আমি।
লম্বা একটা শ্বাস ছাড়ে পিয়াস। এতোক্ষণ যেনো তার গলাটা কেউ চেপে ধরে রেখেছিলো তাই দম নিতে কষ্ট হচ্ছিলো।
নিচে চলে যায় হিয়া। তখনই কাব্য এসে পিয়াসের মুখোমুখি দাঁড়ায়। ভয়ে ছোট করে একটা ঢোক গিলে পিয়াস। দুইহাত বুকে গুজে, কাব্য পিয়াসের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, এটুকু বিশ্বাস করতে পারলি না আমাকে।
আমতা আমতা করে বলে, আসলে আমি ভেবেছি…
হুম তুই ভেবেছিস, কাব্য তো একটা হার্টলেস মানুষ। সে কি করে বুঝবে আমার ভালোবাসা, তাই না।
এবার পিয়াস কাব্য কে জড়িয়ে ধরে। প্লিজ রাগ করিস না, হাসতে হাসতে বলে, তুই হার্টলেস? তুই ভালোবাসা বুঝিস না? ভালোবাসা শিখালি ই তুই।
মেকি রাগ দেখিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে, আচ্ছা আচ্ছা আর পাম্প দিতে হবে না। আরো কিছুক্ষণ কথা বলে নিচে নেমে আসে ওরা।
বিয়ে ঠিক হয় ২ সপ্তাহ পর।
*****-***********
পুরো বাড়িতে সাজ সাজ রব। বিয়ের আর ৪ দিন বাকি। কিছু কিছু আত্নিয় রা চলে এসেছে। কাব্যর চাচা ফুফুরা। হিয়ার বাবার বাড়ির লোকজন ও চলে আসবে বিয়ের দুদিন আগে।
সেদিন বিয়ের শপিং এ গিয়ে তিথী এক কান্ড করে বসে। শপিং এ গেছিলো কাব্য তিথী, হিয়া পিয়াস আর অর্না। সবাই তখন শপিং এ ব্যাস্ত, কাব্য কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তিথী কি কিনবে তা দূর থেকেই কাব্য কে ইশারায় দেখায়। কাব্য বলে তোমার যা পছন্দ হয় নাও, যাই পড়ো তুমি তাতেই ভালো লাগে।
তারপর শপিং এর এক পর্যায়ে তিথী ওদের রেখে অন্য আরেকটা দোকানে ঢুকে, তার বাইরেই দাঁড়ানো ছিলো কাব্য। তখন দুটো মেয়ে এসে তিথী কে বলে, হাই আপ্পি, কেমন আছো।
ছোট করে উত্তর দেয় তিথী, ভালো। তবে তার চোখে মুখে হাজারো বিস্ময়।
একটা মেয়ে হাত বাড়িয়ে এক বক্স চকলেট দেয় তিথীকে।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, আমি কি আপনাকে চিনি?
হাসি মুখেই মেয়েটা জবাব দেয়, উহুম, তাইতো পরিচিত হতে এসেছি।
ওকে থ্যাংক ইউ আপু, ভালো লাগলো আপনার কথা শুনে, তবে চকলেট গুলো নিতে পারবো না আমি। আর আমি যতোদূর বুঝতে পারছি এমনি এমনি আসেননি পরিচিত হতে, কোনো কারণ আছে নিশ্চয়। দয়া করে বলুন কি করতে পারি আপনার জন্য।
মেয়েটা একটা হাসি দিয়ে তিথীর গালে আলতো চেপে বলে, দ্যাটস লাইক এ স্মার্ট গার্ল। তোমাকে দেখেই আমার খুব স্মার্ট মনে হয়েছে।
আসলে তোমার ভাই কে আমার পছন্দ হয়েছে। এর আগেও ৩ বার দেখেছি ওকে, ২ বার শপিং মলে আর একবার রাস্তায়। তেমন কথা বলার সুযোগ হয়নি। আজ তোমরা যখন শপিং এ এসেছো শুরু থেকেই আমি তোমাদের ফলো করছিলাম। তোমার ভাই এর সাথে কথা বলার ও চেষ্টা করেছি, কিন্তু কথা বলেনি ও। তাই তুমি যদি ওর ফোন নাম্বার অথবা ফেসবুক আইডি টা দাও।
কে ভাই আমার? ভ্রু কুঁচকে।
গ্লাসের ভিতর থেকেই মেয়েটা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কাব্য কে দেখায়। মুহূর্তেই তিথী অগ্নি মুর্তি ধারণ করে। মাথা এতো পরিমাণ গরম হয়েছে, যদি রুটি দেয়া হয় ২ মিনিটেই রুটি সেকা হয়ে যাবে।ইচ্ছে করছে কাব্য কে গিয়ে এক্ষুনি খুন করে ফেলতে।
মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে, ওর নাম্বার চাই? নাম্বার কেনো, কথা বলিয়ে দিচ্ছি দাঁড়ান। বলে মেয়েটার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। ঐ মেয়েটার সাথে থাকা মেয়েটাও পিছু পিছু আসে। মেয়েটাকে এনে সোজা কাব্যর সামনে দাঁড় করায়। মেয়েটার চোখে মুখে লজ্জা।
তিথীর কান্ডে অবাক হয়ে তাকায় কাব্য।
কি বলেছেন? আমার ভাই? বলেই কাব্য মুখের কাছে নিজের মুখ টা নিয়ে বলে, চেহারার মিল আছে আমাদের? নাকি আমি ওকে একবারো ভাই বলে ডেকেছি হুম।
এক হাতে কাব্যর কলার টেনে ধরে আরেক হাতের আংগুল কাব্যর দিকে তাক করে বলে, বর হয় ও আমার, বর।রাগে ফুসছে তিথী।
আবারো মেয়েটাকে বলে,ছেলে দেখলেই মাথা খারাপ হয়ে যায়, না? হেংলা মেয়েছেলে জানি কোথাকার।আমার বরের দিকে যদি কেউ বদ নজরে তাকায় তার চোখ গেলে দেই আমি। ইচ্ছে করছে এখন তোর চোখ দুটো ও গেলে দিতে, যাতে আর কোনো ছেলের দিকে বদ নজর দিতে না পারিস।মেয়ে জাতির কলংক।
আর হ্যাঁ আপনি, কাব্য মশাই, সব সময় এতো এট্রেকটিভ মুড নিয়ে ব্যাচেলর হয়ে ঘুরে বেড়ান কেনো? প্রেম করার ধান্দা আছে নাকি, হ্যাঁ? ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিবো বলে দিলাম। পিছনে একটা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ঘুরবা, ওটাতে লেখা থাকবে আমি বিবাহিত।
তিথীকে ঠান্ডা করার জন্য কাব্য ওকে জড়িয়ে ধরতে গেলে রেগে ওখান থেকে চলে যায় সে। এদিকে এসব কান্ড দেখার জন্য চারপাশে মানুষ জন জড়ো হয়ে গেছে। পিয়াস হিয়া আর অর্না ও চলে এসেছে।
কাব্য মেয়েটাকে গিয়ে বলে, আপনি আমায় ফলো করছিলেন বলে দূরে দূরে থাকছিলাম আর সেই সোজা আমার বউ এর কাছে চলে গেলেন। ফুটন্ত লাভাকে আপনি আরো উস্কে দিলেন। আমার কপালে কি আছে আল্লাহ জানে। এটা বলে পিয়াসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিথীর পিছু চলে আসে সে।
এসব দেখে অর্না বলে, মেয়েটার মেনার্স এর অভাব। কোথায় কি বিহেইভ করতে হয় জানে না।।
বাসায় এসে তিথী ঘরের দরজা আটকে দেয়। অনেক ডাকাডাকির পর ও দরজা খুলে না। হতাশ হয়ে যায় কাব্য। দরজা না খুল্লে তো পাগলিটার রাগ ভাংগানো যাবে না।কিছুক্ষনের মাঝেই হিয়া আসে। সেও দরজায় নক করে। তবু খুলে না তিথী।
দেখো না ভাবি, বিয়ের বেনারসি কেনা হয়েছে। কেমন হয়েছে দেখে এটা বলবে তো নাকি।
৫ মিনিট এর মাথায় দরজা খুলে তিথী। দরজা খুলতেই কাব্য ঘরে ঢুকে আবার দরজা লাগিয়ে দেয়। কাব্য কে দেখে তিথী তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। বুকের মাঝে কিল ঘুষি মারতে মারতে বলে কেনো এসছিস। ব্যাচেলর হয়ে ঘুরে বেরাস না মেয়ে পাগল করার জন্য। এখন আবার আমায় পটাতে এসছিস?
উল্টো দিক থেকে জড়িয়ে ধরে কাব্য। এখানে আমার দোষ কোথায় সোনা?
ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে, না সব দোষ আমার, আমার কপালের দোষ। কাঁদতে কাঁদতে। আমার কলেজেও মেয়েরা তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আর বলে আমি অনেক লাকি, আমার বর এতো হ্যান্ডসাম।
নিজের দিকে ঘুড়িয়ে, আমি অনেক লাকি যে আমার বউ টা একটা ছোট্ট পরী। অবশ্য রাগলে পেতনী হয়ে যায়।
আবারো মারতে থাকে তিথী।হুম আমি তো পেতনী ই। চারপাশের এতো এতো রূপসী ঘুরঘুর করলে তো আমাকে পেতনী লাগবেই।
গালে গভীর একটা চুমু দিয়ে বলে, রাগলে তোমায় বোম্বাই মরিচের মতো লাগে, এন্ড আই লাইক স্পাইসি। তাইতো তোমায় আরো রাগিয়ে দেই।
ভালোবাসি সোনা, খুব বেশি ভালোবাসি। এই যে দেখো, বুকের বা পাশে হাত দিয়ে, কাল থেকে এখানে তোমার ছবি লাগিয়ে ঘুরবো। ভিতর টাতে তো তুমি আছোই, তবে বাইরে লাগালে দোষ কি বলো।
এবার কান্নার মাঝেও হালকা হাসে তিথী। থাক লাগবে না। বলে কাব্যর বুকে মাথা এলিয়ে দেয়।
হঠাৎ আবার মাথা তুলে বলে, কিন্তু কোনো মেয়ে যদি তাকায় তোমার দিকে আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই চোখ তুলে নিবো তার।
আচ্ছা বাবা আচ্ছা।হাসে কাব্য, আই লাইক ইউর চাইল্ডিস বিহেভিয়ার। এন্ড আই লাভ ইউ মোর দ্যান মাই লাইফ। বলে ঠোঁটে গভীর চুমু খায়।
।
।
।
।
চলবে…
( ।🙂)