#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২১
গতকাল যে মুষুলধারে বৃষ্টি হয়েছিলো,ঝড়ো হাওয়ায় প্রায় একপ্রকার সব লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো।তার এখন লেশ মাত্র নেই।উল্টো মনে হচ্ছে গতকালকের সেই বৃষ্টির কারনে সূর্য তার তেজের প্রখরতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ইহান অথৈকে নিয়ে ভার্সিটিতে মাত্রই পৌছালো।ইহান অথৈকে আনতে চায়নি।ওর শরীর ভালো না।কাল কি ভয়ানক জ্বরটাই না বাঁধিয়েছিল মেয়েটা।তাই বলেছিলো আজকে বিশ্রাম নিতে।কিন্তু এই ঘ্যাড়ত্যাড়া মেয়ে শুনলে তো? যেই বন্ধুরা ফোন করে বলল ওরা আজ ভার্সিটিতে আসবে।সেটা শুনে নিজেও জোড় জবরদস্তি করে এসেছে আজ।তাই রাগ দেখিয়ে কথা বলছে না ওর সাথে।অথৈ বাইক থেকে নামলে ইহানও নেমে দাঁড়ায়।অথৈ হাসে ভাইয়ের মুখ ফোলানো দেখে।চট করে ভাইকে জড়িয়ে ধরল।ইহান হকচকিয়ে গেল।তারপর নিজেও দুহাতে বোনকে আগলে নিল।অথৈ আহ্লাদী স্বরে বলে উঠে,
‘ ভাইয়া রাগ করে থাকবি না একদম।তুই রাগ করে থাকলে আমার ভালো লাগে না।আর যদি এমন মুখ ফুলিয়ে রাখিস তো আমি গিয়ে ইচ্ছে মতো আইসক্রিম খাবো।তারপর আবারও আমার জ্বর আসবে।তখন তুই খুশি থাকিস।’
অথৈয়ের কথায় ইহান অথৈকে বুক থেকে সরিয়ে আনলো।রাগ দেখিয়ে বলে,’ আর একবার যদি উল্টোপাল্টা কথা বলিস তো খবর আছে।’
‘ তাহলে আর রাগ করে থাকবে?বলো?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইহান।বোনের সাথে না পেরে বলে,
‘ আচ্ছা আর রাগ করে থাকব না।তবে এক শর্তে তুই সাবধানে থাকবি।আর নিজের খেয়াল রাখবি।আর হ্যা বেশি খারাপ লাগলে আমায় সাথে সাথে জানাবি কিন্তু।’
‘ আচ্ছা বাবা ঠিক আছে।এতো চিন্তা করো না তো।এখন আমি যাই ঠিক আছে?’
‘ আচ্ছা যা।সাবধানে কিন্তু।’
‘ ওকে।’
ইহান চলে গেল বন্ধুদের কাছে।আর অথৈ সামনের দিকে হাটা ধরল।জ্বরের রেশ এখনও কাটেনি।তাই হাটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।এইজন্যে আস্তে আস্তে হাটছে ও।এতোক্ষণ দূর থেকেই অথৈয়ের দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে রুদ্রিক।মেয়েটার কাল কি জ্বরটাই না এসেছিলো।আর এই মেয়ে আজ বাসায় বিশ্রাম না করে ভার্সিটিতে এসেছে।মন তো চাচ্ছে এখনই গিয়ে কয়েকটা চ’ড় মেরে আসতে।কিন্তু তা কোনোদিন রুদ্রিক পারবে না।কারন এই মেয়েটার গায়ে একটা ফুলের টোকাও লাগলে। তার হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হয়ে যায়।এই মেয়েটা তার অস্তিত্ব। আর নিজের অস্তিত্বের গায়ে কেউ কিভাবে হাত উঠাতে পারে?উহু, রুদ্রিক তা কোনোদিন পারবে না।কিন্তু রাগটাকেও তো সামলাতে পারছে না।মারতে পারবে না ঠিক আছে।কিন্তু যে করেই হোক আজ এই মেয়েকে দু চারটা ধমক তো সে অবশ্যই দিবে।শুধু বাগে পেয়ে নিক একবার।এদিকে ইহান এসে দাঁড়ালো ওর পাশে।বলে উঠল,
‘ কিরে কি দেখছিস ওদিক তাকিয়ে?’
রুদ্রিক তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো ইহানের দিকে।এমন দৃষ্টিতে ইহান ভড়কে গেল।রুদ্রিক রাগে হিসহিস করে বলে,
‘ তোর গাধি বোনকে দেখছি।ও যে অসুস্থ্ সেটা কি ও জানে নাহ?এই অবস্থায় আজ ভার্সিটি এসেছে কেন?নাকি সে একাই স্টাডি করে একেবারে উলটে দিবে সব?’
ইহান নাক-মুখ কুচকে বলে,’ এহহ! একদম আমাকে রাগ দেখাবি না।আর তাছাড়া তুই নিজেও ভালোভাবে জানিস।অথৈ যেই পরিমানে ঘ্যাড়ত্যাড়া।ও যা বলবে তাই করে।তোর কি মনে হয় আমি কি ওকে শখের বসে নাঁচতে নাঁচতে এখানে নিয়ে এসেছি?সে আমাকে,বাবাকে আর মা’কে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে আজ জোড় করে ভার্সিটিতে এসেছে।’
রুদ্রিক আবার দৃষ্টি তাক করল অথৈয়ের দিকে।মেয়েটা কেমন আস্তেধীরে হাটছে।নিশ্চয়ই শরীরটা অনেক দূর্বল।তাই তো এইভাবে হাটছে।রাগটা তরতর করে বাড়তে লাল রুদ্রিকের।দাঁতেদাঁত চিপে বলল,
‘ ওকে তো দেখে নিব।ছুটোচ্ছি ওর ঘ্যাড় ত্যাড়ামি।’
হঠাৎ সাফাত বলে উঠল,’ কিরে তোরা দুইটা কি ফুসুরফাসুর করছিস?’
ইহান বলল, ‘ এমনি কথা বলছিলাম।তেমন কিছু না।হ্যা রে অনিক কই?’
অনিকের কথা উঠাতেই নীল বলল,’ আর বলিস না ব্যাটা যে কি চায় সে নিজেও জানে না।সিয়াকে ভালোবাসলে বলে দিতে পারে নাহ?শুধু কেন মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছে?নিজেও কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটাকেও দিচ্ছে।আমি বললাম যা সিয়াকে গিয়ে মনের কথা বলে দে।সে তো শুনলই না।কেমন খাম্বার মতো কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এখন কই জানি চলে গিয়েছে।’
রুদ্রিক কিছু একটা আঁচ করতে পারল।পর পর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলে,’ ও সিয়ার কাছেই গিয়েছে।’
ওর এমন কথায় সাফাত অবাক হয়ে বলে,’ তুই কিভাবে বুঝলি?’
‘ ইটস ম্যাজিক।’ বলেই রুদ্রিক হাসল।
______________
সিয়া লাইব্রেরিতে বসে বসে বই পড়ছে।সামনে অনার্স ফাইনাল এক্সাম তাদের।পড়াশোনায় এমনিতে বেশ ভালো সিয়া।কিন্ত্য অনিকের সাথে ব্রেক-আপ হওয়ার পর থেকে পড়ালেখার প্রতি অতো একটা ধ্যান দেয়নি সে।কিন্তু পরিক্ষা প্রায় ঘনিয়ে আসছে।স্যারের মুখে এই কথা শুনে সবকিছু ভুলে গিয়ে পড়াশোনায় পুরো দমে মন দিতে চাইছে সে।এতে যদি অনিককে ভুলে থাকা যায়।কিন্তু বেহায়া মন মানলে তো?ক্ষণে ক্ষণেই অনিকের কথা মনে করিয়ে দেয় ওকে।এতে নিজের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে সিয়া পড়ার মাত্রা দ্বিগুন বাড়িয়ে দেয়।চায় না সে আর কিছু মনে করতে।অনেক তো হলো।প্রায় একবছর হতে চলেছে।অনিক তো দিব্যি লাইফটা এঞ্জয় করছে। তাহলে ও পারবে না কেন?পারতে হবে তাকে।কিন্তু মনের সাথে কি কেউ জোড় করে পারে?একবার যাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে।তাকে কি ভোলা এতোটাই সহজ?সাহজ না হলেও যে তাকে এটা করতেই হবে।আর কতোকাল পিছুটাব বয়ে বেড়াবে?সিয়া দিক বেদিক ভুলে পড়তে লাগল।সে বিন্দু মাত্র টের পায়নি তাকে এতোক্ষণ যাবত কেউ গভীর দৃষ্টিতে অবলোকন করছিলো।অনিক মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে সিয়ার দিকে।রিলেশন থাকা কালিন সময়েও অনিক এতোটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেনি সিয়াকে।যতোটা না এই ইদানিং ধরে করছে।আর তখন করবেই বা কিভাবে?তার আসল সৌন্দর্যযে ঢাকা পরে থাকতে ভারি মেক-আপের আস্তরনে।আর আজ দেখো একদম সাধারনভাবে আছে মেয়েটা।আজ সিয়া গোলাপি রঙের একটা গোল জামা পরেছে,চুলগুলো পনিটেইল বাধা,তার ছোটো চুলগুলো অবাধ্য হয়ে কপালের উপর পরে আছে,চোখে কাঁজল টানা,আর ঠোঁটে লিপগ্লস লাগানো।এতেই যেন অমায়িক সুন্দর লাগছে সিয়াকে।চোখ ফেরানো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।অনিক সিয়ার সৌন্দর্যে এতোটাই মোহিত হয়েছে যে ও বেশ জোড়েই মুখ ফোসকে বলে ফেলে,’ মাশা-আল্লাহ! একদম আমার মনের রানির মতো লাগছে।’
এদিকে আকস্মিক অতি কাছের চেনা মানুষটার কণ্ঠস্বর শুনে যতোটা না সিয়া চমকালো।তার থেকে বেশি চমকালো তার মুখে এমন এক বাক্য শুনে।অবিশ্বাস্যভাবে দৃষ্টি তাক করল অনিকের দিকে।হঠাৎ সিয়ার এহেন দৃষ্টিতে অনিক থতমত খেয়ে যায়। এতোক্ষণে তার হুশ আসল।সে সিয়াকে দেখতে দেখতে এতোটাই ঘোরে চলে গিয়েছিল যে সে যে বেশ জোড়েসোড়েই মনের কথাটা বলে ফেলেছে।তা খেয়ালই করেনি।সিয়া অনিককে নিজের পাশের চেয়ারে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো।বলল,’ তুমি…মানে আপনি এখানে কেন?’
অনিক ভ্রু-উঁচু করে বলল,’ কেন এখানে আসতে সমস্যা আছে নাকি?লাইব্রেরিটা কি তোর একার? আর কিসের আপনি আপনি করছিস?থাপ’ড়িয়ে গাল লাল করে দিবো।’
অনিকের এহেন ব্যবহারে যেন আকাশ থেকে পরল সিয়া।এই অনিকের কি হলো?সে আজ যেচে এসে ওর সাথে কথা বলছে?এই ছেলের মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেলো না তো আবার? সিয়া ভয়ে ভয়ে বলে,’ আপনার কি কিছু হয়েছে?অসুস্থ আপনি?নাহলে এইভাবে কথা বলছেন কেন?’
অনিক কেমন করে যেন তাকালো সিয়ার দিকে।তারপর হুট করে ঝুকে আসল সিয়ার দিকে।এতে সিয়া ভয় পেয়ে দ্রুত মাথা পিছনের দিকে নিয়ে যায়।হাত দুটো বুকের কাছে এনে গুটিয়ে নেয়।অনিক এইভাবে কাছে আসায় ওর শ্বাস আটকে যাচ্ছে।হাত পা কাঁপছে।তোলপাড় হচ্ছে বুকের মাঝে।হৃদস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিকভাবে দৌড়াচ্ছে।সিয়া কাঁপা গলায় বলে,’ কি করছেন?’
‘ শুনবি না আমার কি হয়েছে?’
সিয়া পিটপিট করে তাকালে।অনিক শীতল কণ্ঠে বলে,’ আমি ভীষণ বাজে একটা রোগে আক্রান্ত হয়েছি।যার থেকে নিস্তার নেই আমার। একবিন্দুও নিস্তার নেই।প্রতিনিয়ত সেই রোগটা আমায় গ্রাস করে নিচ্ছে।আমার স্বর্বষ কেরে নিচ্ছে।আমি আর আমার মাঝে নেই।আর আমাকে এই রোগের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো তুই।তুই-ই আমার এই রোগের উপশম!’
অনিকের এহেন রহস্যমাখা কথা সবটা সিয়ার মাথার উপর দিয়ে গেল।বোকা কণ্ঠে সুধালো,’ আমি রোগের উপশম?’
‘ হ্যা তুই।তাই বলছি নিজেকে তৈরি করে নেহ।আমার রোগের চিকিৎসা করার জন্যে।আমি সেরে না উঠা পর্যন্ত তোর কোনো নিস্তার নেই আমার হাত থেকে।বুঝেছিস?
আর হ্যা,ভুলেও আর আপনি আপনি করবি না।তাহলে খু’ন করে ফেলব।’
কথাগুলো বলে আর দাঁড়ালো না অনিক।দ্রুত পায়ে হেটে লাইব্রেরি থেকে চলে গেল।আর এক আকাশসম অবাকের মাঝে রেখে গেল সিয়াকে।যে আপাততো ব্যস্ত অনিকের সব কথাগুলো হিসাব মিলাতে।
____________
বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে অথৈ।বাকিগুলোরও একই অবস্থা।তবে সবচেয়ে বেশি খারাপ অথৈ,পিহু আর প্রিয়ানের।এই তিনটার জ্বর এসে একেবারে বেহাল অবস্থা।আহিদ আর রিধিরও জ্বর এসেছে।তবে ওতোটাও না।ওরা মেডিসিন নিতেই সেরে গিয়েছিলো।কিন্তু সর্দি কাশি আছে এখনও।পাঁচজনের হাতেই একটা করে রুমাল।একটু পর হাঁচি দিচ্ছে তারা।মাঝে তো একসাথেও দিয়ে ফেলে।এতে একে-অপরের দিকে তাকিয়ে অট্টহাসিতে ফেঁটে পরে ওরা।হঠাৎ ওদের আনন্দঘণ মুহুর্তে এসে ব্যাঘাত ঘটায় জেনি।সে এসেই ওদের মাঝে ঢুকে পরল।অথৈকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ এদিকে আসো তো মেয়ে।তোমার সাথে আমার কথা আছে।’
অথৈয়ের কপালে ভাঁজ পরল।এই মেয়ের সাথে জীবনেও কথা হয়নি ওর।তবে এটা জানে রুদ্রিক আর ওর ভাইয়ের ফ্রেন্ড সার্কেলের একজন।হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে।তাই পিছনে ঘুরে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে,’ তোরা এখানেই থাক।আমি আপুটার সাথে কথা বলে আসি।’
তারপর জেনির সাথে অথৈ চলে গেল।রিধি পিহুকে বলে,’ আমার কিন্তু বেশি সুবিধার লাগছে না এই মেয়েকে।’
‘ আমারও।তবে চিন্তা করিস না। এটা আমাদের অথৈ ভুলে যাস না।’
রিধি আর পিহু হেসে উঠল একসাথে।
এদিকে বন্ধুদের কাছ থেকে সরে গিয়ে বেশ খানিকটা দূরে এসে দাঁড়াল অথৈ আর জেনি।অথৈ শান্ত কণ্ঠে বলে,’ জি আপু।কি কথা বলবেন বলুন।’
জেনি বুকে হাত গুজে দাঁড়াল।ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলে,’ আরে এতো তারা কিসের? নাকি বয়ফ্রেন্ড দাঁড়িয়ে আছে তোমার।চিপায় চাপায় যাবে নাকি বয়ফ্রেন্ডের সাথে?’
জেনির কথায় মাথায় ধপ করে রাগ উঠে গেল অথৈয়ের।তবে নিজের স্বামী আর ভাইয়ের বন্ধু বলে নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত রেখে বলে,’ ভদ্রভাবে কথা বলুন আপু।আপনি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন।’
জেনি রেগে গেল অথৈয়ের কথায়।রাগে দাঁত কিরমির করে বলে,’ আমি বাড়াবাড়ি করছি?বাড়াবাড়ি তো করছিস তুই।তুই-ই তো ছ্যাছড়া মেয়েদের মতো আমার রুদ্রিকের পিছনে পরে আছিস।কেন যাস আমার রুদ্রিকের কাছে?ইহানের বোন যে এতোটা চিপ ম্যান্টালিটির তা আগে জানতাম নাহ।কিভাবে ফাসিয়েছিস আমার রুদ্রিককে?বল?নিশ্চয়ই শরীর দেখিয়ে।এ ছাড়া তোদের মতো মেয়েরা আর পারেই বা কি? আরে এতোই যখন দেহ দেখানোর শখ তাহলে পতি…..’
বাকিটা আর বলতে পারল না জেনি।আর আগেই অথৈ নিজের শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে কষিয়ে চ’ড় মারে জেনিকে। অথৈয়ের হাতে চড় খেয়ে জেনির মাথা ভনভন করে ঘুরতে লাগল।মাথায় হাত চেপে সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করল।পরপরেই রেগে আবার তেড়ে গেল অথৈয়ের কাছে।
‘ তোর সাহস কিভাবে হলো আমাকে মারার।তোকে আজ আমি শেষ করে দিব।’
জেনি অথৈয়ের কাছে এগিয়ে আসতেই অথৈ প্রচন্ড রাতে এলোপাথাড়ি প্রায় আট দশটা চড় মেরে বসল।জেনি এইবার মাঠের মধ্যে বসে পরেছে।ততোক্ষণে আহিদ,প্রিয়ান,রিধি, পিহু এসে পরেছে।অথৈ রেগে আবারও তেড়ে যেতে নিতেই আহিদ অথৈকে টেনে ধরে।অথৈ রাগে ফুসফুস করে বলতে লাগল,’ ছাড় আমাকে তুই,ছাড়।ওর সাহস কিভাবে হলো আমাকে এসব বলার।তোর জিভ টেনে আমি ছিড়ে ফেলব।ও জানে ও কাকে কি বলছে?’
অসুস্থ অথৈকেও যেন ধরে রাখা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে আহিদের।রেগে গেলে মেয়েটার হুশ থাকে না।অথৈ ঝাটকা মেরে আহিদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো।তারপর জেনির কাছে গিয়ে ওর ব্রাউন কালার করা চুলগুলো সজোড়ে টেনে ধরল।তেজি কণ্ঠে বলে,’ আর তুই সাহসের কথা বলছিস?তাই নাহ?যে আমি কোন সাহসে রুদ্রিকের কাছে যাই।আরে তুই কে রে? যে তোকে জবাবদিহিতা করতে হবে?এখন আমি বলছি তোর সাহস কিভাবে হয় রুদ্রিককে ‘ আমার, আমার ‘ বলার?বল এতো সাহস কে দিয়েছে?’
ব্যথায় ছটফট করছে জেনি।তাও নিজেকে দমালো না।বলল,’ আমার সাহস জানিস তুই?রুদ্রিক আর আমি একে-অপরকে ভালোবাসি।আর তুই আমাদের মাঝখানে এসে পরেছিস।তুই কোন অধিকারে ওর কাছে যাস?’
অথৈ জেনির কথায় হেসে উঠল।পর পর আবার একটা থাপ্পড় লাগালো জেনির গালে।জোড়ালো কণ্ঠে বলে উঠল,’ অধিকারের কথা বলছিস? তবে বলে দেই রুদ্রিকের কাছে যাওয়ার অধিকার যদি কোনো মেয়ের হয়ে থাকে।তবে সেটা হবে শুধু মাত্র আমার।বুঝেছিস?’
‘ মিথ্যে কথা।তুই কে যে তোর কথা আমি বিশ্বাস করব?’
জেনির কথায় জেনিকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো অথৈ।বুকে আড়াআড়িভাবে হাত বেঁধে বাঁকা হেসে বলে,’ মানলাম তুই রুদ্রিকের প্রেমিকাই।তবে এখন আর নেই।যদি অতীতে হয়েই থাকিস।তবে সেটা বর্তমানে না।আর অতীত ঘাটিয়ে লাভ নেই।আর আমি কে শুনতে চাস?আমি হলাম রুদ্রিকের বর্তমান আর ভবিষ্যত।রুদ্রিকের সব।আমি হলাম মিসেস আরিহান রুদ্রিক মির্জা।মানে রুদ্রিকের বিয়ে করা বউ।তার অর্ধাঙ্গিনী।এখন বল তোর অধিকার বেশি না কি আমার?’
অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো জেনি।রুদ্রিক বিয়ে করে ফেলেছে?তাও এই মেয়েটাকে?কিন্তু কিভাবে এটা সম্ভব? ও বিয়ে করলে তো ওর মাকে ওর মামা এই বিষয়ে জানাতো।মেয়েটা মিথ্যে বলছে।জেনি বলে উঠল,’ মিথ্যে বলছিস তুই।এমন কিছু হলে সবার আগে আমি জানতাম।’
অথৈ ঠান্ডা কণ্ঠে বলে,’ এখন তুই কে জানিসনি তা তো আমি জানি না।তবে বিশ্বাস না হলে রুদ্রিককে গিয়েই স্বয়ং জিজ্ঞেস করে নিস।চল তোরা এখানে আর একমুহূর্ত দাঁড়াতে পারব না আমি।দেখা যাবে রাগে একে খু’নও করে ফেলতে পারি।আমার প্রচুর রাগ লাগছে।আজকে এমন একটা পরিস্থিতিতে আমায় পরতে হবে ভাবিনি। এর জবাব মিস্টার আরিহান রুদ্রিক মির্জাকে দিতেই হবে।হবে মানে হবেই।চল।’
শেষ কথাগুলো বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে পা বাড়াতে নিয়েও থেমে যায়।ঘুরে তাকিয়ে জেনিকে শীতল গলায় হুমকি ছুড়ল, ‘ তুই রুদ্রিকের আগে কি আছিলি না আছিলি সব ভুলে যাহ।আমার স্বামীর দিকে ফের বাজে নজর যদি তোকে দিতে দেখি তাহলে তোর চোখ দুটো আর তোর সাথে থাকবে না। কথাটা মাথায় রাখিস।’
হাড়কাঁপানো হুমকিতে জমে গেল জেনি।অথৈয়ের সেই লাল চোখজোড়া যেন পারলে এখনি ভস্ম করে দেয়।অথৈ বাকিদের নিয়ে সামনে পা বাড়াতে গিয়েই দেখে সাফাত দাঁড়িয়ে আছে।চোখে মুখে কেমন অস্বাভাবিকতা তার।অথৈ ভ্রু-কুচকালো।এই লোক এমন রিয়েকশন দিচ্ছে কেন?তবে কি রুদ্রিক তাদের বিয়ের বিষয়টা ওর বন্ধুদের জানায়নি?কেন জানায়নি?কি কারনে এমন লুকোচুরি করল রুদ্রিক।ও এমন না করলে তো আজ ওর সাথে এসব হতো না।রুদ্রিকের প্রতি রাগ আরও একধাপ বেড়ে গেল।রাগে হনহন করে সাফাতের পাশ কাটিয়ে চলে গেল।ওর পিছন পিছন রিধি,পিহু,প্রিয়ান আর আহিদও চলে গেল।
কিন্তু অথৈ তো জানতেই পারল না। একটু আগে তার বলা কথাগুলো ঠিক কতোটা ধারা’লো ছুড়ির ন্যায় আঘা’ত করেছে সাফাতের বুকে।সাফাত এখনও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে।
সামনে কি হতে চলেছে কে জানে?সাফাত কি মানতে পারবে এই তিক্ত সত্তিটা?নাকি এই সত্যের কারনে ফাটল ধরে যাবে ওর আর রুদ্রিকের বন্ধুত্বে?
#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২২
সূর্য যেমন নিজের তেজের প্রখরতা চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে।পারলে প্রকৃতিকে জ্বা’লিয়ে পুড়িয়ে দেয়।ঠিক ওই সূর্যের মতোই তেজ নিয়ে বসে আছে অথৈ।রাগে তার সারাশরীর কাঁপছে।ঠিক কিভাবে রাগ নিয়ন্ত্রণ করবে ভেবে পাচ্ছে না সে।জীবনে প্রথম এমন জঘন্য সিচুয়েশনে পরতে হয়েছে ওকে।আর নিজের সম্পর্কে জঘন্য সব কথা শুনতে হয়েছে।উপরে উপরে নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করে রাখলেও। অভ্যন্তরীণে হচ্ছে রক্তক্ষর’ণ।সে আজ অনেক কষ্ট পেয়েছে।পাওয়ারই কথা তা নয় কি?একটা মেয়ে নিজের সম্পর্কে বাজে সব উপাধি শুনতে পেলে কষ্ট পাবে না? অথৈ রাগে,দুঃখে দু হাতে মুখ ঢেকে ফেলল।অনেক কান্না করতে ইচ্ছে করছে ওর।কিন্তু সে তো এতো নরম এতোটাও নরম মনের মানুষ নাহ?অথৈকে এই অবস্থায় দেখতে রিধি,পিহু,প্রিয়ান আর আহিদের একটুও ভালো লাগছে না।প্রিয়ান হাটু গেড়ে বসল ওর সামনে।রিধি আর পিহু দুজন ওর দুইপাশে বসল।আহিদ দাঁড়িয়েই আছে।তবে সে অবস্থাতেই অত্যন্ত স্নেহ নিয়ে অথৈয়ের মাথায় হাত রাখল।এই মেয়েটাকে নিজের বোনের মতোই ভালোবাসে আহিদ।ঠিক যতোটা পিহুকে ভালোবাসে,ভাইয়ের দায়িত্ব নিয়ে বোনকে আগলে রাখে।ঠিক ততোটাই অথৈ আর রিধিকেও করে।ওরাও যে তার আরও দুটো বোন। রক্তের সম্পর্ক না হলেই বা কি?মনের সম্পর্কও অনেক মজবুত হয়।আর প্রমান সরূপ তারা পাঁচ বন্ধু।মাথায় ভরসাশীল মানুষের হাতের স্পর্শ পেয়ে মাথা তুলে তাকায় অথৈ। তাকাতেই সবাই আঁতকে উঠে।অথৈয়ের চোখজোড়া ভয়ানকরকম লাল হয়েছে।মুখটাও লালচে আকার ধারণ করেছে।মূলত কান্না আটকে রাখার কারনেই এমনটা হয়েছে।আহিদ অস্থির হয়ে বলে উঠল,’ এ কি?কি অবস্থা করেছিস নিজের অথৈ? ‘
প্রিয়ান অথৈয়ের হাত দুটো নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলে উঠল,’ তোকে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখতে একদম ভালো লাগছে না অথৈ। আমাদের অথৈ তো অনেক স্ট্রং একটা মেয়ে।সে বাহিরের একটা মেয়ে।যার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।তার জন্যে এইভাবে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার তো কোনো মানে নেই তাই নাহ?’
পিহু অথৈয়ের কাধে হাত রেখে বলে,’ একদম ঠিক বলছে আহিদ আর প্রিয়ান।ফালতু একটা মেয়ের জন্যে তুই কেন এতো কষ্ট পাচ্ছিস?’
রিধি অথৈয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,’ তুই তো আমার আর পিহুর থেকেও স্ট্রং।তাহলে আজ কেন এমন করছিস? এই অথৈকে আমরা চিনি না।আমদের স্ট্রং অথৈকেই চাই।’
বন্ধুদের ভরসায় আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়। উঠে দাঁড়িয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি এনে দু হাত প্রসারিত করে দেয়।এতে রিধি,পিহু,প্রিয়ান আর আহিদের ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠে।তারা দ্রুত এসে প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে।অথৈ প্রশান্তির শ্বাস নেয়।এখন অনেকটা শান্তি লাগছে।এই চারটা মানুষ না থাকলে যে ওর কি হতো?ও নিজেও জানে নাহ।ওরা শুধু অথৈয়ের বন্ধু না।ওর বন্ধু থেকেও বেশি কিছু।তার আরেকটা পরিবার।ওর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।যাদের ছাড়া অথৈ অচল।একদমই অচল।দীর্ঘ একটা হাগ করে সবাই সরে আসল।প্রিয়ান বলল,’ এখন ঠিক আছিস তুই?’
অথৈ মাথা দুলিয়ে জানালো সে ঠিক আছে।তারপর বলে উঠে,’ চিন্তা করিস না আমি ঠিক আছি।আর যা এখন তোরা বাড়ি চলে যা।ক্লাস শেষ অনেকক্ষণ হয়েছে।’
পিহু চিন্তিত কণ্ঠে বলে,’ কিন্তু তুই?’
অথৈ বলে উঠল,’ আমার আবার কি? এটা তো নিত্যদিন হয়ে আসছে।রুদ্রিকের সাথে আমি একান্তভাবে সময় কাটাই এই সময়টায়।তা তো তোরা জানিসই।আর রইলো যেটার জন্যে তোরা এমন করছিস।সেটা হবে না।আমি অথৈ এতো সহজে এই লোককে ছাড়ব না।উনি বিয়ের বিষয়টা নিজের বন্ধুদের কাছে কেন গোপন রেখেছে?সেটার জবাবদিহিতা তো তার করতেই হবে।তিনি যদি বন্ধুদের কাছে এই বিষয়ে বলে দিতেন। তবে আজ আমায় এসব শুনতে হতো না।আমার রাগে ভীতরটা ধাউ ধাউ করে জ্বলছে।সেই রাগের আগুনে যদি তাকে আমি ভ’স্ম না করেছি দেখে নিস তোরা।’
মুহূর্তেই রাগে ওর ফর্সা মুখশ্রী লাল হয়ে আসল।আজ অথৈ প্রচন্ড রেগে আছে।বরাবরের মতোই অথৈয়ের রাগকে ওরা বেশ ভয় পায়।মেয়েটা রাগলে ওরা হুঁশ থাকে না।আর আজ তো এই বাঘিনীকে আঘাত করা হয়েছে।বলে না ব্যথিত বাঘিনীরা আগের থেকেও আরও দ্বিগুন হিংশ্র হয়ে উঠে।অথৈয়ের বেলাতেও ঠিক তাই হয়েছে।ওরা চারজন আর বেশি একটা ঘাটল না।এটা তাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার বিষয়।তারাই সামলে নিতে পারবে।মন না চাওয়া সত্তেও অথৈয়ের কাছে হার মেনে ওরা বাড়ির যাওয়ার জন্যে রওনা দিলো।
অথৈ মন মরা হয়ে বসে রইলো গাছের নিচে।স্থির দৃষ্টি তার আকাশপাণে।আনমনা হয়ে কি যেনো ভেবে চলল নির্নিমেষ। প্রায় আধাঘন্টা পর সেখানে এসে উপস্থিত হলো রুদ্রিক।দূর থেকেই প্রেয়সীকে মন মরা হয়ে বসে থাকতে দেখে বুকের বা পাশটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব হতে শুরু করল।মেয়েটা এইভাবে কেন বসে আছে?কোনো কারনে কি মেয়েটার মন খারাপ?রুদ্রিক দ্রুত কদম ফেলে চলে এলো অথৈয়ের কাছে।অথৈ টের পেলো ঠিকই।তবে ওর কোনো হেলদোল হলো না।সে এখনও আকাশে তাকিয়ে আছে।রুদ্রিকের বুক কাঁপছে।অথৈয়ের মুখশ্রী ভয়ংকর লাল হয়ে আছে। সেই সাথে চোখজোড়াও লাল হয়ে আছে।রুদ্রিক কি করবে ভেবে পেলো না।অথৈকে এমন অবস্থায় দেখে তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।রুদ্রিক এদিক সেদিক তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল।কিন্তু পারল না।তাই হুট করে অথৈকে টেনে বাহুডোরে জড়িয়ে নিলো।এতেও যেন অথৈয়ের কোনো নড়চড় নেই।ও শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্রিকের যেন এতে পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।একহাত অথৈয়ের কোমড়ে রাখল।আরেক হাত অথৈয়ের মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
‘ কি হয়েছে অথৈ?এমন করছ কেন?এমন শান্ত, নিরম অথৈকে দেখতে আমার ভালো লাগছে না।কথা বলছ না কেন?শরীর খারাপ লাগছে তোমার?কিছু তো বলো অথৈ।’
রুদ্রিকের কথার পরিপেক্ষিতে অথৈ নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ আমাদের বিয়ের বিষয়টা নিজের বন্ধুদের কাছ থেকে কেন গোপন রাখলেন রুদ্রিক?’
অথৈয়ের আকস্মিক এহেন কণ্ঠে আর কথায় চমকে উঠে রুদ্রিক।অথৈকে ঝট করে বুক থেকে সরিয়ে আনল।শক্তপোক্ত হাতটা অথৈয়ের নরম,কোমল কপোল স্পর্শ করল।আজ আর অথৈ লজ্জা পেল না।মিইয়ে গেল না রুদ্রিকের স্পর্শে।বরংচ কেমন যেন কঠোরতার সহিত তার দিকে তাকিয়ে আছে।এই কঠোরতা কিসের জন্যে?তার অথৈ তো সে কাছে আসলেই লজ্জায় মোমের মতো গলে যায়।তাহলে আজ কি এমন হলো?রুদ্রিক ব্যাকুল কণ্ঠে সুধালো,’ কি বলছ এসব অথৈ? আর হঠাৎ এসব কেনই বা বলছ?’
অথৈ রুদ্রিকের হাত নিজের গাল হতে সরিয়ে দিল।তারপর শক্ত কণ্ঠে বলে উঠল,’ আমার প্রশ্নের উত্তর দিন রুদ্রিক।’
রুদ্রিক থমকালো অথৈয়ের ব্যবহারে।পর পর অথৈকে বোঝাতে লাগল,’ আকস্মিক আমাদের বিয়েটা হয়েছে।আর তাছাড়া আমাদের সম্পর্কে এখনও প্রনয় তৈরি হয়নি।আর ওদের না জানিয়ে আমি হুট করে বিয়ে করে নিয়েছি।ওদের এই কথা বললে ওরা কষ্ট পাবে।তাই আমি সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম।সুযোগ সুবিধা বুঝে ওদের সামনে তোমাকে নিয়েই গিয়েই বিয়ের কথাটা বলতাম।’
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে থামল রুদ্রিক। ফের বলে উঠে,’ কিন্তু কি হয়েছে?তুমি আমাকে সব খুলে বলো অথৈ। আমি জানি তুমি অকারনে এমন ব্যবহার কোনোদিন করবে না।’
রুদ্রিকের কথা শেষ হতে দেরি।অথৈয়ের রাগি ভয়ংকা’রি দৃষ্টি ওর উপর পরতে দেরি নেই।রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে আচমকা রুদ্রিকের শার্টের কলার চেপে ধরল অথৈ। রাগে চিৎকার করে উঠে অথৈ, ‘ কেন করছি জানতে চান?তো শুনুন।আপনার কারনে?হ্যা,ঠি শুনছেন আপনার কারনেই।আপনি বিয়েটা গোপন রেখেছেন এই কারনেই।আমি আপনার সাথে দেখা করি,একান্ত সময় কাটাই।এইজন্যে বাহিরের একটা মেয়ে এসে আমার চরিত্র নিয়ে কথা তুলেছে।আমাকে ভার্সিটির মধ্যে যা নয় তাই বলেছে।আমার নাকি চরিত্রে দোষ আছে।এইজন্যে নাকি আমি আপনার উপরে হাত ধুয়ে পরেছি।আমা….আমাকে পতিতালয়ের মেয়েদের সাথে তুল….’
আর বলতে পারল না অথৈ। ঝটকা মেরে রুদ্রিকের কলার ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে গেল।উল্টো দিকে ঘুরে রাগে ফোঁপাতে লাগল।সে স্ট্রং একটা মেয়ে।যার তার সামনে সে তার আবেগ দেখাতে পারে না।কিন্তু আজ কেন যেন নিজেকে সামলাতে পারছে না মেয়েটা।কথায় আছে না যতোই তুমি নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করে রাখ না কেন?দিনশেষে প্রিয় মানুষটার সান্নিধ্যে আসলে তোমার সেই শক্ত খোলস একসময় ভেঙে গুড়িয়ে যাবেই।এটাই যে নিয়ম।তাই অথৈও পারছে না নিজেকে সামলাতে।কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে কণ্ঠনালিতে এসে আটকে আছে।কষ্ট হচ্ছে ওর।খুব কষ্ট হচ্ছে।অথৈ ভেজা কণ্ঠে বলে উঠল,’ আমি কি জোড় করেছিলাম আপনায় আমাকে বিয়ে করার জন্যে?করেনি তো! তাহলে,আজ কেন আমায় এইসব কথা শুনতে হবে।আপনার স্ত্রী আমি।তাহলে কেন আপনার কাছে যাওয়ার জন্যে আমাকে চরিত্রহীন উপাধি পেতে হবে।বলুন?জবাব দিন।আমি কি এতোটাই অযোগ্য আপনার স্ত্রী হওয়ার? নাহলে কেন আপনি সবার থেকে আমাদের বিয়েটা আড়াল করে রাখলেন?’
বহু কষ্টে নিজের অশ্রুকণাগুলো ধরে রাখতে চেয়েছিল অথৈ। কিন্তু তা আর সম্ভব হলো অক্ষিপটের বারিধারাগুলো নিমিডষেই সিক্ত করে তুলল অথৈয়ের কপোল( গাল)। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না অথৈ। নিজেকে দূর্বল হতে দেখে সহ্য করতে পারছে না ও।তাই আর কাল বিলম্ব না করে দৌড়ে সেই স্থান ত্যাগ করল অথৈ। তবে যাবার আগে রুদ্রিককে বলে গেল,’ আপনাকে অনেক কিছু সহ্য করতে হবে মিঃআরিহান রুদ্রিক।একটা মেয়ের সবচেয়ে বড়ো আর মূল্যবান সম্পদ হলো তার চরিত্র।আর আজ আপনার একটা ভুলের কারনে আমার সেই চরিত্রের উপরে মানুষ এনে আঙুল তুলেছে।এতো সহজে আমি জাফ্রিন অথৈ আপনাকে ক্ষমা করছি না।আমার হৃদয়ের অন্তঃকরণে যে রক্তক্ষরণ হয়েছে তা না থামা পর্যন্ত অন্তত নাহ।কথাটা মাথায় স্যেট করে নিয়েন।’
অথৈয়ের বলা প্রত্যেকটা কথার প্রতিত্তুরে কিছুই বলেনি রুদ্রিক।এমনকি অথৈয়ের চলে যাবার সময়েও তাকে থামায়নি ও।তবে অথৈয়ের মুখগহ্বর হতে নিশ্রিত প্রতিটা শব্দ যেন ধারা’লো ছুড়ির ন্যায় ওর হৃৎপিণ্ডটা ঝা’ঝড়া করে দিয়েছে।অথৈয়ের চোখের প্রতি ফোটা জল যেন ওর সমস্ত কায়াকে আগুনে ভ’স্ম করে দিয়েছে।অথৈয়ের কষ্টে জর্জরিত প্রতিটা শব্দ,বাক্য ওর কানে বাজতে লাগল অনবরত।চোখ বন্ধ করে জোড়ে একটা নিশ্বাস নিলো রুদ্রিক।কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ধপ করে চোখ খুলে তাকালো ও।রুদ্রিকের সেই টকটকে লাল চোখজোড়া দেখলে যেন যে কেউ ভয়ে আঁতকে উঠবে।মস্তিষ্কের রগগুলো রাগের কারনে ধাপাধাপি করছে।সর্বশক্তি প্রয়োগ করে হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো রুদ্রিক।ফলে দৃশ্যমান হলো হাতের প্রতিটি শিরা উপশিরা।রুদ্রিকের অথৈয়ের যাওয়ার পাণে তাকিয়ে থেকে ঠান্ডা,শীতল গলায় বলে উঠল,
‘ আজ যার জন্যে, যার কথার তিক্ত কথার কারনে কষ্টে পেয়ে তুমি কাঁদলে।আর তোমার চোখের প্রতিটা অশ্রুকণার সাক্ষি হলাম আমি।সেই মানুষটাকে সস্তির নিঃশ্বাস নিতে দিবো না।আমার সুখ তুমি।আর আমার সুখকে আজ এতোটা দুঃখি করার জন্যে সেই মানুষটাকে খু’ন করতেও আমার দ্বিধা কাজ করবে না।সে যেই হোক না কেন।আমার স্ত্রী,আমার অর্ধাঙ্গিনীর চোখের প্রতি ফোটা অশ্রুকণার বিনিময়ে তাকে যে আমি কি করব আমি নিজেও জানি না।তুমি শুধু অপেক্ষা করো অথৈ। আমি সব ঠিক করে দিব।শুধু আমায় ভুল বুঝে দূরে সরে যেও না।তোমার দূরত্ব আমি মেনে নিতে পারব না।তার আগেই নাহয় শ্বাস আটকে মে’রে ফেলো আমায়।কারন অথৈ ছাড়া রুদ্রিক অসম্পূর্ণ। ‘
#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৩
ভার্সিটি থেকে ফিরে এসে মাত্রই ফ্রেস হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো রিধি।ভালো লাগছে না কিছু।প্রাণপ্রিয় বান্ধুবীর সেই বিধ্বস্ত অবস্থা মনে করলে এখনও বুকে ব্যথা উঠে।না জানি কি করছে মেয়েটা?একবার কি কল করে দেখবে?ফোনকলের কথা চিন্তা করতেই।ওর মোবাইল ফোনটা তীব্র শব্দে বেজে উঠল।রিধি হাতের তোয়ালেটা চেয়ারে রেখে এগিয়ে যায়।মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে।সচরাচর তার ফোনে আননোন নাম্বার থেকে কল আসে না।কিছুটা চিন্তিত হয়ে উঠল রিধি।কল কেটে যাওয়ার আগেই রিসিভ করে কানে ধরল।সাথে সাথে কানে এসে বারি খেল গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠস্বর,
‘ রিধি,আমি রুদ্রিক বলছি।আজ ভার্সিটিতে অথৈয়ের সাথে কি হয়েছে।সবটা আমায় বলো।ইচ এন্ড এভ্রি ডিটেইলস!’
আচমকা রুদ্রিকের এহেন কথায় থতমত খেয়ে গেল রিধি।রুদ্রিক যে তাকে কল করেছে ব্যাপারটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে।রুদ্রিকের কণ্ঠস্বর আবারও শোনা গেল,
‘ রিধি?শুনছ?’
‘ হ..হুঁ!’
‘ ভার্সিটিতে কি হয়েছে?’
রিধি একটা লম্বা শ্বাস ফেলে একে একে সব বলল রুদ্রিককে।ফোনের অপাশ হতে রুদ্রিক সব শুনে রাগে ওর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।দাঁতেদাঁত চিপে বলে উঠল,
‘ এই মেয়েকে অনেক ছাড় দিয়েছি।কিন্তু আর দিবো না।আমার অথৈয়ের চোখের পানি ঝরেছে ওর জন্যে।ওকে আজ আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।’
রুদ্রিকের রাগমিশ্রিত কথায় ভয় পেয়ে যায় রিধি।আমতা আমতা করে বলে উঠল,
‘ ভাইয়া?অথৈয়ের কি কিছু হয়েছে? আর এখন ও কোথায়?’
রুদ্রিক বলল,’ ও বাড়ি চলে গিয়েছে।ঘটনাটায় বেশ আঘাত পেয়েছে ও।স্বামী হিসেবে আমি ব্যর্থ।আমি আমার স্ত্রীকে প্রটেক্ট করতে পারিনি।’
‘ এভাবে বলবেন না ভাইয়া।তবে আমি এটাও বলব না যে আপনার একেবারেই দোষ নেই।আপনার দোষ একটাই আপনি বিয়েটা গোপন রেখে কাজটা ভালো করেননি।’
রিধিও রাগ লাগছে রুদ্রিকের উপর।কেন সে এমন করল?এটা না করলে তো আর অথৈ এতো কষ্ট পেতো না।রুদ্রিক হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলে,’ হ্যা আমি মানছি আমার দোষ।তবে আমিও পরিস্থিতির স্বিকার।তবে বুঝতে পারিনি এমন কিছু ঘটবে।অথৈ আমার উপর তীব্র অভিমান করেছে।রাগ করলে রাগ ভাঙানো যায়।তবে অভিমানের পাহাড় এতো সহজে ভাঙা যায় না।’
‘ অথৈয়ের অভিমান ভাঙাতে আপনার অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে ভাইয়া।’
‘ তা তো আমি জানিই।বুঝতে হবে না ও বউটা কার।তবে চিন্তা নট।আমার দুটো সালিসাহেবা আর দুটো সালাবাবু আছেন না?তারা তো আছেই আমাকে হেল্প করার জন্যে।’
লাস্ট কথাগুলো দুষ্টুমির স্বরে বলল রুদ্রিক।রিধি হেসে ফেলল রুদ্রিকের কথায়।বলল,’ তা তো অবশ্যই।আমরা আপনাকে সবরকম হ্যেল্প করতে প্রস্তুত।’
‘ থ্যাংক ইউ।’
‘ ইয়্যুর মোস্ট ওয়েলকাম ভাইয়া।’
‘ হুম ভালো থেকো।রাখছি।’
‘ আচ্ছা ভাইয়া।ভালো থাকবেন।’
কথপোকথন শেষ করে কান থেকে মোবাইল সরালো রুদ্রিক।তারপর নিজের রুম থেকে বের হয়ে যায় রেগে।বসার ঘরে বসে আছেন সবাই।আরহাম সাহেব আর আরিয়ান মাত্রই অফিস থেকে এসেছেন লাঞ্চ টাইমে।ছেলেকে রাগে চোখ মুখ লাল করে নিচে নামতে দেখে,হাতের থাকা চায়ের কাঁপতে টি-টেবিলে রাখলেন।আরহাম সাহেব চিন্তিত গলায় বলেন,’ রুদ্রিক?কি হয়েছে তোর?এতো রেগে আছিস কেন?’
রুদ্রিক রাগ চেপে রেখে কোনোরকমে বলে,’ বাবা সব বলব।কিন্তু আপাততো তোমার বোন আর তার মেয়েকে এক্ষুনি এই বাড়িতে আসতে বলো।আর নাহলে যদি আমি যাই। তো তোমার বোনের মেয়ের কপালে বহুত দুঃখ আছে।’
আরহাম সাহেব ভড়কে গেলেন ছেলের কথায়।তার মন একশ পার্সেন্ট সিউর জেনি কিছু করেছে।তাই তো তার ছেলে এমন রেগে আছে।আরহাম সাহেব প্রশ্ন করলেন,’ কিন্তু কি হয়েছে সেটা তো জানতে পারি নাকি?’
‘ সেটা নাহয় তারা আসলেই বলব।’
আরহাম সাহেব কিছু বলবেন তার আগেই আরিয়ান চোখের ইশারায় ওর বাবাকে বলে রুদ্রিক যা বলেছে তাই যেন করে।রুদ্রিকের চিৎকারে আতিক মাহাবুব আর রোজা রুম থেকে বেড়িয়ে আসলেন।রোজা মেডিসিন নিয়ে গিয়েছিলো আতিক মাহাবুবের কাছে।রুদ্রিকের রাগি গলার আওয়াজ শুনে তারা ছুটে এসেছেন।রোজা অস্থির হয়ে প্রশ্ন করল,’ কি হয়েছে?রুদ্রিক তুই এতো রেগে কেন?’
‘ তা একটু পরেই বুঝতে পারবে ভাবি।একটু অপেক্ষা করো।’
আতিক মাহাবুব সোফায় আয়েশ করে বসলেন।ছেলের উদ্দেশ্যে বলেন,’ আরহাম!শেফাকে ফোন দিয়ে আসতে বল।আর সাথে যেন রাগিবকেও নিয়ে আসে।আর হ্যা জেনি তো অবশ্যই যেন আসে।’
আরহাম সাহেব বাবার কথামতো ফোন করলেন তার বোন,মানে শেফাকে।আরহাম সাহেব বেশ শান্তভাবেই তাদের এক্ষুনি এই বাড়িতে আসার কথা বলেন।শেফা বেগম ভাইয়ের এমন জরুরি তল্লবে।একমুহূর্তের জন্যে মনে করলেন।তিনি বোধহয় রুদ্রিক আর জেনির বিয়ের বিষয়ে কথা বলবেন।তাই ভাইয়ের কথামতো সবাইকে নিয়ে হাজির হলেন। অবশ্য জেনি আসতে চায়নি।অথৈয়ের হাতে মার খেয়ে তার গাল ফুলে ফ্যাপে উঠেছে।অবস্থা বেশ খারাপ।যা মেক-আপের আস্তরণে ঢেকে রেখেছে।কাউকে বুঝতে দেয়নি।সে যদি ওর মা বা বাবাকে বিষয়টা জানায়।তো তারা গিয়ে রুদ্রিকদের বাড়ি গিয়ে ঝামেলা করবে।আর রুদ্রিক এসব জানলে তো তার করা কীর্তির কথা যেনে যাবে।তখন রুদ্রিক রেগে মেগে যে কি করবে সেটার ভয়ে ও যেতে চাইছে না।এইযে এখন ও বাড়ি থেকে খবর এসেছে।জেনির ভয় করছে।সে যেটার ভয় পাচ্ছে।তা যদি হয়ে থাকে তবে ওর কপালে শনি আছে।কিন্তু মায়ের জোড়াজুড়িতে ওকে বাধ্য হয়ে যেতে হলো।মির্জা বাড়িতে ওরা এসে হাজির হলো।তারা এসে সোফায় বসবে।তার আগেই রুদ্রিক প্রচন্ড রেগে জেনির হাত টেনে কাছে এনে ওর গাল চেপে ধরল।চিৎকার করে বলে উঠল,’ তোর সহস কিভাবে হলো?তুই রুদ্রিকের জানে আঘাত করিস।আমার স্ত্রীকে যা নয় তাই বলে অপমান করেছিস। তোর এই মুখটা দিয়েই তো সব বলেছিস?তাই নাহ?এখন যদি তোর এই মুখটাই আমি ভেঙে দেই কি বলিস?’
রুদ্রিকের এহেন কান্ডে সবাই চমকে উঠেন।শেফা দৌড়ে মেয়ের কাছে যান।রুদ্রিকের কাছ থেকে ওকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করতে লাগলেন কিন্তু পারলেন না।কারন রুদ্রিক ঠিক এতোটাই জোড় প্রয়োগ করেছে।রোজা এইবার এগিয়ে যায়।রুদ্রিকের কাছ থেকে জেনিকে ছাড়াতে এসে বলে,’ ছেড়ে দে রুদ্রিক।কি করছিস এসব?ছাড়,নাহলে ও ম’রে যাবে তো।’
রুদ্রিকের কঠোর কণ্ঠস্বর,’ যাক ম’রে।’
রুদ্রিক এইবার ধমকে উঠেন আরহাম সাহেব।বাবার ধমকে জেনিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।আরহাম সাহেব রাগি গলায় বলে উঠেন,’ এটা ধরনের ব্যবহার রুদ্রিক?ও সম্পর্কে তোমার বোন ভুলে যেও না।আর আমরা সবাই এখানে আছি।আমাদের সামনে এরকম জালিমদের মতো আচরণ করার কারন কি?’
রুদ্রিক গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল, ‘ কারন জানতে চাইছ?আর এ আমার বোন?রিডিকিউলাস! এ আমার বোন কেন?এই মেয়ে আমার কিছুই নাহ।’
শেফা মেয়েকে আঁকড়ে ধরে আছেন।সারাদিনে এতো এতো মার খেয়ে জেনি পুরো নিস্তেজ।শেফা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কেঁদে বলেন, ‘ এইভাবে অপমান করার জন্যে এই বাড়িতে ডেকেছিস আমাদের ভাই।আর বাবা তুমি কিছু বলছ না কেন?’
আতিক মাহাবুব বেশ শান্ত গলায় বলেন,’ তুই আর তোর মেয়ে কেমন ধাচের মানুষ।তা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না।রুদ্রিকের এমন ব্যবহারের পিছনে যে বিশাল বড়ো কারন আছে।তা ওর কথাতেই বুঝতে পেরেছি। আর বিষয়টা যদি আমার বাড়ির, মানে মির্জা বাড়ির ছেলের বউয়ের বিষয়ে হয়।তো ফল তোদের জন্যে খারাপ হবে।কারন আমার বাড়ির ছেলের বউরা হলো আমার বাড়ির সম্মান।আর এই বাড়ির সম্মানে যে আঘাত করবে।তাকে শাস্তি তো পেতেই হবে। যেটা যেই হোক না কেন! ‘
আতিক মাহাবুবের কথায় শেফা কান্না থামিয়ে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকান।অবাক হয়ে বলেন,’ ছেলের বউরা মানে?আর রুদ্রিক ও তখন বললো ওর স্ত্রী।কিন্তু রুদ্রিক তো এখনও বিয়ে করেনি।’
রুদ্রিক বলে উঠল,’ ঠিকই শুনেছ তুমি ফুপি।আমি বিয়ে করেছি।আমার স্ত্রী আছে।’
‘ মানে?’
‘ মানে আমার বিয়ে হয়েছে।এই বিষয়ে আপনাদের জানানো হয়নি।দাদু আমাকে মেয়ে দেখাতে নিয়ে গিয়ে।হুট করে সেই মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন।আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে এই বাড়িতে উঠিয়ে আনলে আপনাদের জানাবো ভেবে রেখেছিলাম।’
রুদ্রিক বেশ শান্তভাবে কথাগুলো বললেও।শেফা শান্তভাবে তা হজম করতে পারল না।চিল্লিয়ে উঠেন তিনি,’ এটা হতে পারে না।আমি ভাইকে বলেছিলাম না।জেনির সাথে তোর বিয়ে দিব।এটা আমার স্বপ্ন।তাহলে?ভাই তুই এসব কিভাবে করতে পারলি?’
শেষের বাক্যটা আরহাম সাহেব উদ্দেশ্য করে বললেন তিনি।আরহাম সাহেব ভাবলেসহীনভাবে বলে,’ তোর বা আমার কথাতে তো হবে না?আমার ছেলে যা চাইবে তাই হবে।তাছাড়া বিয়েটা বাবার ইচ্ছেতে হয়েছে।আর বাবার কথাই এই বাড়িতে শেষ কথা।তিনি যা বলবেন তাই হবে।’
রোজা এই সুযোগে রুদ্রিককে প্রশ্ন করল,’ রুদ্রিক কি এমন হয়েছে যে তুমি জেনিকে এইভাবে মারলে?অথৈকে জেনি কি করেছে?’
রুদ্রিক রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায় জেনির দিকে।জেনি ভয়ে একদম গুটিয়ে গেল মায়ের কাছে।রুদ্রিক রাগকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে বলতে লাগল,’ অথৈ আমি যেই ভার্সিটিতে পড়ি সেখানেই পড়ে।তো এখন যেহেতু আমরা স্বামি স্ত্রী।আমি চাইছি আমাদের সম্পর্কটা আর পাঁচটা কাপলদের মতো স্বাভাবিক করতে।সেইজন্যেই অথৈ আর আমার ক্লাস শেষে। আমি আর অথৈ দুজন মিলে ভার্সিটির পিছনে নদীর পাড়ে একান্তভাবে কিছু সময় কাটাই।সেটা বোধহয় এই রাস্কেলটা দেখেছে।ও তো ছ্যাছড়ার মতো আমার পিছনে পরে থাকে। আমার থেকে পাত্তা না পেয়ে আজ সকালে অথৈকে ভার্সিটিতে মানুষের সামনে যা নয় তাই বলেছে।ওর চরিত্রের দিকে আঙুল তুলেছে।আরও অনেক বাজে কথা বলেছে।অথৈ রেগে গিয়ে ওকে মেরেছে।ও নিজেও মারতে গিয়েছিল। কিন্তু পারেনি।মেয়েটা অসুস্থ এই অবস্থাতেই ওর সাথে পারলি না।সুস্থ্য থাকলে তুই এখনও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পেতি না।’
শেষের কথায় জেনিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করল রুদ্রিক।ফের বলতে লাগল,’ আমি একটা কারন বশত ওর কাছ থেকে মানে আমার ফ্রেন্ডদের কাছ থেকে বিয়ের বিষয়টা গোপন রেখেছি।ভেবেছিলাম সঠিক সময় এলে।সুযোগ মতো সবাইকে জানাবো।জানে শুধু ইহান।ও নিজেও জানত না যদি না ও অথৈয়ের ভাই না হতো।অথৈ বুঝতে পেরেছে আমি ওদের জানায়নি আমাদের বিয়ের বিষয়।তাই আমি দেখা করতে গেলে।আমার সাথে রাগ দেখালো।আমাকে ভুল বুঝল।আমার সাথে নরম স্বরে কথা বলা অথৈ। আজ কঠোরভাবে আমার সাথে কথা বলেছে।অভিমান করে চলে গিয়েছে।মানলাম ও জানে অথৈ আমার স্ত্রী।কিন্তু! ও কেনই বা একটা মেয়েকে না জেনে শুনে এইসব বিশ্রি কথা বলবে?কেন বলবে?আর ও বলেছে আমি নাকি ওকে ভালোবাসি।এই তোকে আমি কবে বলেছি ভালোবাসি?তোর দিকে তো আমার তাকাতেই ঘৃনা লাগে।মন তো চাচ্ছে তোকে গলা টি’পে মেরে ফেলি।আজ তোর কারনে আমার অথৈ এতোটা কষ্ট পেলো।’
নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আবারও তেড়ে মারতে চলে গেল রুদ্রিক।আরিয়ান দ্রুত উঠে ওকে আটকালো।আতিক মাহাবুব বললেন,’ রুদ্রিক বিশৃঙ্খলা আর সৃষ্টি করিস না। যা বলার আমি বলব।’
দাদার কথায় থেমে যায় রুদ্রিক।তবে রাগে এখনও হিসফিস করছে।আতিক মাহাবুব গম্ভীর গলায় বলেন,’ তুমি এই বাড়ির মেয়ে তাই তোমাকে এইখানে আসার জন্যে আমি বাধা দিতে পারব না।তবে আমি প্রচন্ড খুশি হবো যদি তুমি তোমার মেয়েকে রেখে তবেই আসো।কারন এতো এতোটা অভদ্র,অসভ্য নাতনির আমার কোনো দরকার নেই।যেদিন নিজেকে সুধরাতে পারবে সেদিনই আমার বাড়িতে পা রাখবে।আর তুমি শেফা মেয়েকে সঠিক শিক্ষা তো দিতে পারোনি।এইজন্যেই আজ এই অবস্থা।মেয়ে আর মা দুজন ভালো হতে পারলেই এই বাড়িতে আসবি।আর যদি এতো নোংরা মনকে আজীবন ধরে রাখতে চাস। তবে মির্জা বাড়ির দরজা তোমাদের জন্যে চিরকালের জন্যে বন্ধ।’
শেফা আতিক মাহাবুবের কথায় তেজ দেখিয়ে বলে,’ এতো বড়ো অপমান। ঠিক আছে আসবো না আর এই বাড়িতে।চল জেনি।আজ থেকে আমার বাবা আর ভাই আমার জন্যে মরে গিয়েছে।’
আরহাম সাহেব আর আতিক মাহাবুব বেশ কষ্ট পেলেন তার কথায়।একজনের একমাত্র বোন আরেকজনের একমাত্র মেয়ে। কষ্ট তো পাওয়ারই কথা।তবে অন্যায় যেহেতু করেছে শাস্তি তাদের পেতে হবেই।রাগিব এতোক্ষন চুপই ছিলেন।এটা তাদের বিষয় তাই আর তিনি কিছু বলেননি।তিনি এসে নিজের স্ত্রী আর মেয়ের ব্যবহারের জন্যে ক্ষমা চাইলেন।আতিক মাহাবুব উনাকে ছোটো হতে মানা করলেন।কারন এতে উনার কোনো দোষ নেই।তার নিজের মেয়ে খারাপ।পরের ছেলেকে আর দোষ দিয়ে লাভ কি?
#চলবে__________
।