মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব -১৮+১৯+২০

#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৮
নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে।হলদেটে সূর্যটা তার প্রখর তেজে যেন ঝল’সে দিচ্ছে সব।গরমের মাঝে একটু সস্তি দেওয়ার জন্যে বোধহয় এই নির্মল বাতাস বয়ে চলেছে।মন প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো।ঘাসের উপর বসে দু হাটু ভাজ করে তাতে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে অথৈ।অনুভব করছে সে প্রকৃতির স্নিগ্ধতা।রুদ্রিকের জন্যে এই জায়গাটা চিনতে পেরেছে ও।রুদ্রিক ওকে এখানের ঠিকানা না দিলে ও এই সুন্দর পরিবেশটা উপভোগ করতে পারত নাহ।মনে মনে রুদ্রিককে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালো।ভাবনায় রুদ্রিক আসতেই চোখ মেলে তাকালো অথৈ।বাম হাতটা চোখের সামনে এনে হাত ঘড়িটায় সময় দেখে নিলো।ক্লাস শেষ করে এখানে এসে রুদ্রিকের জন্যে অথৈ বসে বসে অপেক্ষা করছে।প্রায় পনেরো মিনিট হয়ে আসল।লোকটার কোনো খবর নেই।কোথায় গিয়েছে সে? এইভাবে অথৈকে অপেক্ষা করার মতো তিক্ত অনুভূতির মাঝে ফেলে দিয়ে কি মজা পাচ্ছে লোকটা?অপেক্ষা জিনিসটা অথৈ একদম পছন্দ করে না।কারন বরাবরের মতোই অথৈয়ের ধৈর্য খুব কম।কিন্তু আজ যে ও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে পেরেছে সেটা দেখে ও নিজেই অবাক।একমাত্র রুদ্রিকের কারনেই এই অসাধ্য সাধণ করতে সক্ষম হয়েছে ও।কিন্তু এখন যে আর ভালো লাগছে না অপেক্ষা করতে।অন্য সময় হলে অথৈ রেগেমেগে চলে যেত।কিন্তু আজ যাচ্ছে না।কারন রুদ্রিক তো ওকে প্রমিস করেছে লোকটা আসবে।অথৈ আবারও অপেক্ষা শেষ হওয়ার প্রহর গুনতে লাগল।মনমরা হয়ে ছোটো ছোটো ইট আর মাটির কণা উঠিয়ে নদীর স্বচ্ছ পানিতে ঢিল ছুড়তে লাগল।একটা সময় আনমনা হয়ে গেল অথৈ।কিয়ৎক্ষণ এইভাবে অতিবাহিত হতেই হঠাৎ নিজের অতি নিকটে কারো উপস্থিতি অনুভব করল অথৈ।নাকে সেই চেনা পুরুষালি পারফিউমের ঘ্রাণ এসে লাগছে।যেটা সেই মানুষটার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।তবে মনে ক্ষুদ্র অভিমান জন্মেছে অথৈয়ের। এইভাবে আধাঘন্টা অপেক্ষা করানোর কোনো মানে আছে?একটা টেক্সট ও তো করতে পারত ওকে।অভিমানি অথৈ রুদ্রিকের উপস্থিতি বুঝেও ফিরেও তাকালো না ওর দিকে।তার দৃষ্টি সোজা অটল নদীর ঢেউয়ের দিকে।এদিকে অর্ধাঙ্গিনীর অভিমান বুঝতে পেরে মুচঁকি হাসল রুদ্রিক।বড্ড দেরি করে ফেলেছে আজ ও।মেয়েটা হয়তো অনেকক্ষণ যাবত ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল।তাই তো অভিমান করে মুখ ফুলিয়ে রেখেছে।রুদ্রিক নরম কণ্ঠে সুধাল,
‘ মাই বাটারফ্লাই আর ইউ এ্যাংরি উইথ মি?’

রুদ্রিকের মুখে নিজের জন্যে আখ্যায়িত করা এক একটা নতুন নতুন আদুরে ডাকগুলো অথৈয়ের বুকে তীব্রভাবে ঝড় তুলে দেয়।এতো ভালো কেন লাগে?এইযে ‘ মাই বাটারফ্লাই ‘ বলে ডাকল।এই ডাকে কি অথৈ অভিমান ধরে পারে? লোকটার কণ্ঠে এতো মাদকতা যে অথৈ সেই কণ্ঠের নেশায় পরে যায়।কিন্তু অথৈ সহজে গলে যেতে চায় নাহ।একটু,অল্প একটু নাহয় অভিমান করে থাকল।সে দেখতে চায় লোকটা কিভাবে তার অভিমান ভাঙায়।অভিমানের পাহাড় ধ্ব’সে পরেছে তো সেই কখনই।তবুও অথৈ মিথ্যে রাগ দেখিয়ে রুদ্রিকের দিকে পিঠ দিয়ে ঘুরে গেল।অথৈয়ের এমন বাচ্চামো দেখে হেসে ফেলল রুদ্রিক।হাটু গেড়ে ঘাসের উপর বসে অথৈয়ের কানের কাছে মুখটা এগিয়ে নিয়ে গেল।এদিকে নিজের অধিক সন্নিকটে রুদ্রিকের উপস্থিতি বুঝতে পেরে গলা শুকিয়ে আসল অথৈয়ের।রুদ্রিক আরেকটু কাছে আসল।মুখ নামিয়ে আনল অথৈয়ের কানের কাছে।রুদ্রিকের তপ্ত নিশ্বাসের ছোঁয়া অথৈয়ের ঘাড়ে এসে লাগতেই তীব্র শিহরণ বয়ে যায় ওর সারা শরীরে,প্রতিটি রন্দ্রে রন্দ্রে।অথৈয়ের ছোট্টো দেহখানি মৃদ্যুভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছে।রুদ্রিক অথৈয়ের কানে কানে ফিসফিস করে বলে,
‘ অভিমানির অভিমান ভাঙাতে এখন এই অপরাধি কি করতে পারে বলুন?মহারানি যা হুকুম করবেন।তা আমার শীরোধার্য।’

রুদ্রিকের এহেন কণ্ঠে বলা প্রতিটি বাক্যে অথৈয়ের দেহ,মন চনমনিয়ে উঠল।দ্রুত সরে গেল সে।আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে যে তার মৃ’ত্যু নিশ্চিত।নিশ্বাস আটকে মা’রা যাবে সে।অথৈ উঠে দাঁড়াল।বুকে হাত দিয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিল।উফ,বুকের বা-পাশটায় যে কি জোড়ে জোড়ে ধুকপুক করছে।রুদ্রিক অথৈকে সরে যেতে দেখে নিজেও উঠে দাঁড়াল।বড় বড় পা ফেলে একেবারে সম্মুখে এসে দাঁড়াল অথৈয়ের।আকস্মিক রুদ্রিক অথৈয়ের এতো সামনে আসায় ভড়কালো অথৈ।মনে মনে পালানোর পায়তারা খুজতে লাগল। রুদ্রিক বোধহয় বুঝল অথৈয়ের মনোভাব।ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করে হাসল ও।বলল,
‘ পালাতে চাচ্ছ বুঝি আমার থেকে?’

চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল অথৈ।এই লোক বুঝল কিভাবে? ও কি মনে মনে কথা বললেও কি অনেক জোড়ে বলে?যে লোকটা শুনে ফেলল? অথৈ আমতা আমতা করে বলে,
‘ পালাবো কেন আমি আশ্চর্য?’
‘ সেটা তো তুমি ভালো জানো।’
‘ আমি কিছু জানি না!’
‘ তাই বুঝি?’
‘ হ্যাঁ!’
‘ তা আমাকে জানো তো?’
‘ হ্যাঁ! না.. মানে?’ অথৈ থতমত খেয়ে গেল রুদ্রিকের এমন প্রশ্নে।তাই জবাব দেওয়ার সময় এইভাবে আটকে গেল।রুদ্রিক ভরাট স্বরে বলল,
‘তুমি তো বললে তুমি কিছু জানো না।তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম।আমাকে জানো তো?’

চোখ পিট পিট করে তাকালো অথৈ।এই লোকটা কি তার মজা নিচ্ছে? ভ্রু-কুচকে অথৈ বলে,
‘ আপনি কি আমার সাথে মজা নিচ্ছেন?আপনাকে জানবো না কেন? আজব লোক আর তার আজব প্রশ্ন।’
‘ তো বলো আমি কে?’ রুদ্রিকের সোজাসাপ্টা প্রশ্ন।

অথৈ ঘাবড়ালো না।বিচলিতও হলো না একটুও।রুদ্রিকের চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
‘ আমার স্বামী আপনি।’

এই একটা বাক্যে রুদ্রিকের দুনিয়া রঙিন হয়ে উঠল।মেয়েটা কি অকপটে বলে ফেলল কথাটা।কোনো প্রকার জড়তা নেই কণ্ঠে।এদিকে তার বলা এই একটা বাক্যে যে রুদ্রিকের হৃদয়ে তোলপাড় হচ্ছে।ইচ্ছে করছে মেয়েটা বুকের মধ্যে ঝাপ্টে ধরতে।ওর শক্তপোক্ত,প্রসস্ত বুকটার মাঝে মেয়েটার ওই ছোট্টো, নরম দেহটা নিয়ে একদম বুকের সাথে পি’ষে ফেলতে।অথৈকে যদি রুদ্রিক গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাহলে কি মেয়েটা রাগ করবে?কথা বলা বন্ধ করে দিবে?মনের এই তীব্র বাসনা কোনোমতেই দমাতে পারছে না রুদ্রিক।আচমকা দু ধাপ এগিয়ে গেল অথৈয়ের দিকে।অথৈ এইবার পিছালো না।স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল রুদ্রিকের দিকে।রুদ্রিক অস্থির গলায় বলল,
‘ অথৈ তুমি কি রাগ করবে?আমি যদি তোমায় জড়িয়ে ধরি?বিশ্বাস করো।নিজের এই ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখতে পারছি না।আ’ম ফিলিং সো হ্যেল্পল্যাস অথৈ।তোমাকে বুকে নেওয়ার জন্যে আমি অস্থির হয়ে আছি।তুমি কি বুঝতে পারছ?’

অথৈ জমে গেল যেন রুদ্রিকের এহেন কথায়।কি সুন্দর করে তার কাছে আবদার করে বসল লোকটা।লোকটা এমন কেন?এইভাবে অনুমতি চাইলেই কি সে অনুমতি দিতে পারে?লজ্জা করে না ওর?কণ্ঠে কথাগুলো যে দলা পাকিয়ে জড়িয়ে আসে।বলতে পারে না ও কিছু।অথৈয়ের কোনো ভাবভঙী না দেখে।রুদ্রিক মুখটা কালো হয়ে গেল।হৃদয়ে মাঝে এসে উপস্থিত হলো মন খারাপের দল।রুদ্রিক উলটো দিকে ঘুরে গিয়ে বলে,
‘ ইট্স ওকে অথৈ। নিজেকে জোড় করতে হবে না।আমি বুঝে নিয়েছি।আমিই একটু বেশি এক্সপেক্ট করছিলাম।’

রুদ্রিক পা বাড়াতে নিলে পিছন থেকে শার্টে টান অনুভব করল রুদ্রিক।থেমে যায় কদম।সোজা হয়ে অথৈয়ের মুখোমুখি হলো ও।অথৈ করুন চাহনী ছুড়ে দিলো ওর দিকে।যার মানে এটাই দাঁড়ায় যে, ‘ আপনি এতো বেশি বুঝেন কেন?আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখুন।আমার মন কি বলছে।’

রুদ্রিক ওই চোখের দিকে ধ্যানমগ্ন হয়ে চেয়ে রইল।যা বোঝার বুঝে ফেলল।হাসি ফুঁটে উঠল ওর ঠোঁটে। সেই হাসিতে অথৈ নিজেকে হারিয়ে ফেলল।কি সুন্দর লোকটার হাসি।কেউ কিভাবে এতো সুন্দর করে হাসে?এইযে লোকটার হাসিতে যে অথৈয়ের বুকে ব্য’থা করছে।সুখময় মিষ্টি ব্য’থা।সেই ব্য’থা অথৈ আজীবন বয়ে বেড়াতে সর্বদা প্রস্তুত।
রুদ্রিক দু কদম পিছনে নিয়ে নিল।হাত দুটো দুদিকে প্রসারিত করে নিলো।অথৈয়ের হৃদয়ের এলোমেলো অনুভূতিদের নাড়িয়ে দিয়ে অত্যন্ত আকুলতা মিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠল,
‘ বুকে আসো অথৈ।’

অথৈ কাঁধের ব্যাগটা ফেলে দিয়ে প্রায় একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে রুদ্রিকের প্রসস্ত বুকে নিজের ছোট্টো শরীরটা নিয়ে আছঁড়ে পরল।বুকের মাঝে অথৈয়ের নরম দেহটাকে দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।পারলে এক্ষুণি এই মেয়েটাকে নিজের বুকের ভীতর ঢুকিয়ে ফেলে।রুদ্রিক ভেবে পায় না।কি এমন আছে এই মেয়েটার মাঝে? যার কাছে আসলেই রুদ্রিক তার গম্ভীর্যতা ধরে রাখতে পারে নাহ?তার চারপাশ রঙিন হয়ে যায়।নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়।ঠোঁট থেকে যেন হাসিরা সরতেই চায়না।নিজের শক্ত সত্তাটাকে এই মেয়েটার সামনে ধরে রাখতেই পারে না।আর সবার সামনে যে গম্ভীর,রাগি,একরোখা,জেদি হলেও।এই মেয়েটার কাছে সে দূর্বল।রাগ যেন আসেই না মেয়েটা কাছে থাকলে।ওর আকুলতা,ব্যাকুলতা এই মেয়েটার সামনেই সে অনায়াসে ব্যক্ত করে ফেলে।ভালোবাসায় বুঝি মানুষকে এতোটাই পরিবর্তন করে দিতে পারে?অথৈকে নিজের সাথে আরেকটু ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো রুদ্রিক।ছাড়তে চায়না সে অথৈকে।ঠিক এইভাবে সারাজীবন নিজের বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়।

এদিকে রুদ্রিকের বক্ষে লেপ্টে থাকা অথৈ থরথর করে কাঁপছে।দুহাতে খামছে ধরে আছে রুদ্রিকের পিঠ।এই প্রথম সে আর রুদ্রিক এতোটা কাছাকাছি।একে-অপরের মাঝে দুজন হারিয়ে ফেলেছে নিজেদের।রুদ্রিকে দেহের সংস্পর্শে যেন অথৈ বিড়াল ছানার ন্যায় আদূরে ভঙিতে গুটিয়ে গিয়েছে।রুদ্রিকের বক্ষে আরও ভালোভাবে মুখ গুজে দিল অথৈ। পৃথিবীর চির শান্তি স্থান যেন এটাই তার কাছে। সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে ওর মাঝে।অথৈ নিজের এক একটা ব্যবহারে নিজেই ক্ষণেক্ষণে অবাক হয়।ও তো এতো নরম স্বভাবের মেয়ে নাহ।তাহলে কেন এই মানুষটার সামনে আসলেই এভাবে নরম হয়ে যায়।আদুরে,আহ্লাদী হয়ে যেতে মন চায়।মনে হয় এই মানুষটার কাছে সে বিনাদ্বিধায় নিজের আহ্লাদগুলো ব্যক্ত করতে পারবে।আদূরে বাচ্চাদের মতো এটা সেটা বায়না কর‍তে পারবে।তবে কি সেই মাত্র এই দুইদিনের একান্ত সাক্ষাতের মুহূর্তগুলোতেই প্রেমে পরে গেল লোকটার?আচ্ছা প্রেমে পরা কি এতোই সহজ?কাউকে মাত্র দুদিনের মধ্যে নিজের মনের বিশাল জায়গাটায় বসানো এতোই সহজ?কি জানি।কিছু আপাততো জানে না অথৈ। সে এই মুহূর্তে জানতেও চায়না।শুধু উপভোগ করতে চায় এই সময়টুক।আর প্রেমে পরলে পরেছে সে।তাতে কি হয়েছে?নিজের স্বামীর প্রেমেই পরেছে।আর ভাবল না অথৈ।লেপ্টে রইল রুদ্রিকের মাঝে।সময়টুকু এখানেই থেমে যাক না।ভালোই তো লাগছে।ক্ষতি কি এতে?উহু, কোনো ক্ষতি নেই।
#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৯
ভ্যাবসা গরমে প্রকৃতি নিস্তব্ধ হয়ে আছে।একটু বাতাসের ছিটেফোটাও নেই যেন কোথাও।আকাশে সূর্য্যিমামাটা যেন ক্ষণে ক্ষণে তার প্রখরতা বাড়িয়েই চলেছে।কপালে হাত দিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকালো রিধি।কিন্তু রোদের তেজে পারল না।দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল।গরমে তার অবস্থা কাহিল।বাসা থেকে বের হয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল সে কিন্তু একটা রিকশা বা সিএনজি কিছুই পায়নি।তাই উপায় না পেয়ে রাস্তায় হাটতে শুরু করে দিয়েছে সে।নাহলে যে দেরি হয়ে যাবে।বন্ধুরা বোধহয় এতোক্ষণে গন্তব্যে পৌছে গিয়েছে।শুধু ওই লেইট করছে বোধহয়।রিধি ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পরল।এই রোধের মাঝে আর হাটতে ইচ্ছে করছে নাহ।বিরক্ত হয়ে রিধি বলে,
‘ উফ,অসহ্য।এতো গরম আর ভালো লাগে না।’

পানির তৃষ্ণাও পেয়েছে।পাশেই একটা দোকান দেখতে পেল।রিধি সেদিকে এগিয়ে গেল।পানি না খেলে চলছেই না।রিধি দোকানে গিয়ে এক বোতল পানি কিনে নিল।তারপর দোকানের বাহিরে ছাউনিতে দাঁড়িয়ে ঢকঢক করে অনেকটা পানি পান করে নিল।হ্যা,এখন একটু শান্তি লাগছে।পার্স থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘামটুকু মুছে নিল রিধি।আর বার বার রাস্তার এদিক ওদিক তাকাতে লাগল।আজ মনে হয় সব রিকশা আর সিএনজি ওয়ালারা পণ করেছে।রিধি যেখানে আছে সেখানে ওরা কিছুতেই আসবে না।কি করবে এখন রিধি?এতোদূর অব্দি তো হেটে যাওয়ায় সম্ভব নাহ।এমন সময় মোবাইল ফোনটা সজোড়ে বেজে উঠল।দেখে প্রিয়ান কল করেছে।রিধি দ্রুত রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে প্রিয়ানের কণ্ঠ ভেসে আসল,
‘ওই ছেরি! কই তুই?এতোক্ষণ লাগে তোর আসতে?কতোক্ষণ ধরে বসে আছি।সামনে এতো এতো খাবারের আইটেম চাইলেও খাইতে পারতাছি না তোর জন্যে।জলদি আয়।’

রিধি কাঁদো মুখ করে বলে উঠল,
‘ আমার কি দোষ?আমি তো আসতে চাইছি।কিন্তু একটা রিকশা বা সিএনজি কিছুই পাচ্ছি না।হেটে হেটে এতোদূর অব্দি যাওয়া পসিবল নাকি?’

প্রিয়ান যেন তেতে উঠল রিধির কথায়।বলল,
‘ পাকনামি করছস ক্যান?আগেই কইছিলাম না আমি তোরে নিতে আসুম নেহ।তুই তোর ওই হিটলার বাপের ভয়ে আমারে মানা কইরা দিলি।ওই ছেরি আমি তোর ওই পুলিশ বাপরে ভয় পাই? এহন আয় একলা একলা হাইট্টা হাইট্টাই আসবি।হিটলার বাপের বলদা মাইয়া।’

রিধি প্রিয়ানের কথায় রেগে উঠল।চেঁচিয়ে বলে,
‘ ওই তুই কথায় কথায় আমার বাবাকে টানিস কেন?আর একদম আমার বাবাকে হিটলার বলবি না।’
‘ আমি তো একশবার বলমু।’
‘ প্রিয়ানের বাচ্চা শুধু একবার আমি আসি।তোর হাড্ডি একটাও আস্ত রাখমু নাহ।’
‘ আমি অপেক্ষায়।আগে তো আইসা নেহ।তুই আসতে আসতে দেখবি।আমাগো পিকনিক শেষ।আর তোর ভাগের খাবার সব আমার পেটের মধ্যে।’

প্রিয়ান কথাগুলো বলে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসল।রেগে মেগে রিধি কল কেটে দিল।পরক্ষণে রাস্তার দিকে তাকাতে আবারও ওর মুখশ্রী কাঁদো কাঁদো হয়ে আসল। কি করব সে? হঠাৎ রিধি পাশে কারো উপস্থিতি টের পেল।মানুষটার শরীরের ঘ্রাণ ওর খুব চেনা।কিন্তু এই লোক এখানে কিভাবে আসবে? রিধি পাশ ফিরে তাকাল।তাকাতেই ইহানের ফর্সা সুন্দর মুখশ্রীটা চক্ষুগোচর হলো।তাকিয়েই রইল রিধি।কি সুন্দর লাগছে মানুষটাকে।ব্লু শার্ট, ব্লাক ডেনিম প্যান্টটা যেন ইহানের ফর্সা শরীরে একদম ফুটে উঠেছে।লোকটার দিকে একবার তাকালে রিধির ঘোর লেগে যায়।চোখ ফিরাতেই ইচ্ছে করে না।মন চায় লোকটাকে আজীবন ওর সামনে বসিয়ে রাখতে।আর ও প্রাণভরে দেখবে।রিধির ভাবনা ভঙ হয় ইহানের ডাকে,
‘ কোথায় যাচ্ছিলে?’
‘ হ..হুঁ!’
‘ কোথায়?’

রিধি দৃষ্টি সরিয়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়াল।ইস,কিভাবে ড্যাবড্যাব করে লোকটার দিকে তাকিয়েছিল ও।মানুষটা মনে মনে ওকে কি ভাবছে কে জানে।ইহান রিধির জবাব না পেয়ে ফের বলে,
‘ বলছি তোমাদের পিকনিক স্পটটা কোথায়?ঠিকানা দেও।’

ইহানের কথা ঠাওর করতে পারল না রিধি।ভাবুক গলায় বলে,
‘ মানে?সেটা জেনে আপনি কি করবেন?’

ইহান রাশভারি স্বরে বলে,
‘ কতোক্ষণ যাবত তো দেখছি এখানে দাঁড়িয়ে আছ রিকশা অথবা সিএনজির জন্যে।কিন্তু এখন এই টাইমে এগুলা পাওয়া খুব দুষ্কর।তাই বেহেরবানি করে আমাকে ঠিকানা দিন আমি আপনাকে পৌছে দিচ্ছি।অথৈ আমাকে শুধু বলেছে তোমরা নাকি পিকনিক করবে।তবে ঠিকানা বলে নি।এখন তাড়াতাড়ি বলো।’

ইহান ওকে পৌছে দিবে?ও কি সত্যি শুনছে।ওর কতোকালের স্বপ্ন ছিল ও ইহানের বাইকে বসবে।ইহান বাইক চালাবে। আর রিধি মুগ্ধ হয়ে ইহানকে দেখবে।খুশিতে রিধির চোখজোড়া জ্বলজ্বল করতে লাগল।উচ্ছাসিত হয়ে বলে,
‘ সত্যি বলছেন আমায় পৌছে দিবেন আপনি?’
‘ নাহ মিথ্যে বলছি আমি।’

এই বলে ইহান হেটে গিয়ে বাইকে উঠে বসল।তারপর গম্ভীর স্বরে বলে,’ দ্রুত আস।আমার আরও কাজ আছে।’

রিধি দ্রুত পায়ে এসে ইহানের বাইকে উঠে বসল।ইস,মনটা খুশিতে তাথৈ তাথৈ করে নাচছে।কিন্তু এখন কি করবে?ইহানের কাধে কি হাত রাখবে?লোকটা যদি পছন্দ না করে?যদি ধমকে উঠে ওকে?ইহান বাইক স্টার্ট দিলে রিধি বাইকের পিছনের অংশটা চেপে ধরল।ইহান ভরাট কণ্ঠস্বরে বলে,
‘ আমায় ধরছ না কেন?বাইক থেকে উলটে পরে হাত পা ভাঙার নিয়ত আছে নাকি তোমার?আমার কাধ শক্ত করে ধরো।’

ইহানের পেয়ে রিধি খুশিতে আত্মহারা।দ্রুত ইহানের কাধের অংশ শক্ত করে ধরল।সাথে সাথেই যেন শরীরটা ঝংকার দিয়ে কেঁপে উঠল।লোকটাকে একটুখানি স্পর্শ করতেই যেন মনে হলো ওর শরীরের কারেন্টের শক লেগেছে।অন্যরকম শিহরণ বয়ে যাচ্ছে মনে।সহ্য করতে না পের রিধি পরনের জামা খামছে ধরল।এদিকে ইহান বাইক চালানোর ফাঁকে ফাঁকে ফ্রন্ট মিরোরে বারবার রিধির দিকে তাকাচ্ছে।তাকাতে চাইছে না ইহান।তাও কেন যেন চোখ চলে যাচ্ছে।কাঁচা হলুদ রঙের গাউন পরেছে রিধি।ওর ফর্সা শরীরে বেশ মানিয়েছে সেটা।ইহানের চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে একদম।চুলগুলো বেনি করে একসাইডে এনে রেখেছে।কিছু ছোটো ছোটো চুল কপালে, গালে এসে পরেছে।যা বাতাসের দাপাটো উড়াউড়ি করছে।গরমে ঘার্মাক্ত মুখশ্রীটা যেন আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে।ইহানের বুকের ভীতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল।দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল।নিজের বেহায়াপনায় হতভম্ভ সে।কি করছিল সে?এইভাবে রিধি দিকে তাকিয়ে কেন ছিল সে?বুকের বাপাশের তীব্র স্পন্দন যেন ক্ষণে ক্ষণে বাড়তেই আছে।নাম না জানা অনুভূতিরা যেন আঁকড়ে ধরছে ওকে ক্রমাগত।ইহান আর একবারও তাকালো না রিধির দিকে।এই মেয়ের দিকে একবার তাকিয়েই এই অবস্থা।তাহলে আবার তাকালে নিশ্চয়ই সে হার্ট এট্যা’ক করবে।ইহান হিসাব মেলাতে পারছে না।রিধিকে তো সেই ছোটোবেলা থেকেই সে দেখে আসছে।কই আগে তো কখনও এরকম অনুভূতি হয়নি।তবে আজ কেন এমন লাগছে?তবে কি ওর দৃষ্টিভঙি বদলেছে?আজ কি মেয়েটার দিকে একটু অন্য নজরে তাকিয়েছে বলেই এমন হচ্ছে?নাহ,ইহান আর এমন কিছু করবে না।এভাবে হয় না।বোনের বান্ধবীর দিকে এইভাবে তাকানো ঠিক না।শেষে রিধি তাকে নির্ল’জ্জ না ভেবে বসে।

দুজন মানুষ দুই বিপরীত ধরনের ভাবনা মাথায় নিয়ে সম্পূর্ণ পথ শেষ করল।ইহান বাইক থামিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,
‘ নামো এসে পরেছি।’

রিধি নেমে দাঁড়ালো।অবশ্য তার নামতে ইচ্ছে করছিল না।মন চাচ্ছিল এইভাবে ইহানের সাথে বসে গন্তব্যহীন ঘুরে বেড়াতে।এই পথ এতো তাড়াতাড়ি শেষ কেন হলো?আরেকটু দীর্ঘ হলে তো রিধি আরেকটু সময় ইহানের সাথে থাকতে পারত।দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিধি। মনের ভাবনা মনে রেখেই ধীর আওয়াজে বলল,
‘ ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘ ইট্স ওকে।এটা আমার দায়িত্ব।বোনের বান্ধবীকে চোখের সামনে বিপদে পড়তে দেখে এগিয়ে আসব এটা স্বাভাবিক।’

ইহানের কথায় বুক ভার হয়ে আসল রিধির।কেন যেন কষ্ট লাগল ইহানের কথায়।ওকে কি ইহান সবসময় বোনের বান্ধবী নজরেই দেখবে?কি হয় একটু অন্যরকম দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকালে?একবার ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখুক না লোকটা।তার চোখে লোকটার জন্যে আকাশসম ভালোবাসা আছে।সেটা কি একবারও চোখে পরে নাহ লোকটার?এতো নিষ্ঠুর কেন সে? আর কেনই বা রিধি এই নিষ্ঠুর মানুষটাকে মন দিয়ে বসল?যে ওকে একটুও বুঝে না।ভালোবাসায় এতো কষ্ট কেন?কেন এতো যন্ত্রনা? রিধির কষ্টে চোখে জল চলে আসল।কিন্তু তা চোখের কোটর হতে গড়িয়ে পরতে দিল না রিধি।দ্রুত নিজেকে সামলে নিল।ধরা গলায় বলল,
‘ জি তারপরেও আপনি ধন্যবাদের প্রাপ্য।তাই আপনাকে ধন্যবাদ জানালাম।’

একটু থামে রিধি ভদ্রতার খাতিরে বলল,
‘ আপনি চাইলে আমাদের সাথে জয়েন করতে পারেন।’

সরাসরি নাকচ করল ইহান,
‘ নাহ।তোমাদের বন্ধুদের মাঝে আমি যেয়ে কি করব?উলটো তোমরা আরও অসস্থিতে পরে যাবে।আর তাছাড়া আমার ইম্পোর্ট্যান্ট একটা কাজ আছে।এখন আসি।দেরি হয়ে যাচ্ছে।বাই।’

রিধিকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না ইহান।বাইক স্টার্ট দিয়ে দ্রুততার সাথে চলে গেল।ইহানের যাওয়ার পথের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে রইল রিধি।এতোক্ষণ সামলে রাখা চোখের জলগুলো গড়িয়ে পরল গাল বেয়ে।ভেজা কণ্ঠে বলল,
‘ এতো নিষ্ঠুর কেন তুমি?কেন বুঝোনা আমার মনের কথা।একবার #মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না। তাহলেই না বুঝবে ঠিক কতোটা ভালোবাসি তোমায়।’

আফসোস! ঠিক এই কথাগুলো ইহানের সামনে বলার সাহস রিধি করে উঠতে পারে না।যদি পারত তাহলে এক তরফা ভালোবেসে এইভাবে তিলে তিলে কষ্ট পেতো নাহ।
দূর থেকে পিহুর কণ্ঠস্বর কানে আসতে দ্রুত চোখ মুছে নিল রিধি।বার কয়েক জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলল।বুকের যন্ত্রনা গুলোকে ধামাচাপা দিয়ে দিল।তারপর হাসিমুখে এগিয়ে গেল বন্ধুদের দিকে।
_______________
গোল হয়ে বসে আছে পাঁচ বন্ধু।অথৈ,রিধি,পিহু,প্রিয়ান আর আহিদ।অথৈয়ের হাতে একটা আপেল।যেটাতে সে বড়ো বড়ো কামড় বসিয়ে কচকচ করে খাচ্ছে।আর একবার প্রিয়ানের দিকে তো একবার পিহুর দিকে তাকাচ্ছে ভ্রু-কুচকে। আর ওকে ভ্রু-কুচকে দেখছে রিধি আর আহিদ।অথৈয়ের ভাবভঙি বুঝতে পারছে না তারা।এদিকে পিহু আর প্রিয়ান যেন মুখে কুলুপ এঁটে বসেছে।পন করে নিয়েছে তারা যেন আর কোনোদিন কথাই বলবে না।কথা বললেই যেন তাদের স্যু’ট করে দেওয়া হবে।আহিদ অথৈয়ের কান্ড বুঝতে না পেরে বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ সেই কখন থেকে এমন করে আছিস।সমস্যা কি তোর?এমন করছিস কেন?’

রিধিও তাল মেলালো আহিদের কথায়।বলল,
‘ হ্যা অথৈ।কি হয়েছে বলবি তো?আর হঠাৎ এই পিকনিকের প্ল্যান কেন করলি তুই?’

অথৈ এইবার নড়েচড়ে বসল।সে এখন বেশ আগ্রহ পাচ্ছে কথাটা বলার জন্যে।আপেলটায় লাস্ট একটা কামড় বসিয়ে তা চিবিয়ে চিবিয়ে তাড়াতাড়ি গিলে ফেলল।মুখটার ভাবভঙি দ্রুত পরিবর্তন করে নিল ও।অত্যন্ত সিরিয়াস মুড নিয়ে বলল,
‘ তোরা খেয়াল করেছিস কি না জানি না।বাট আমি দেখেছি।এই প্রিয়ান আর পিহু স্বাভাবিক নেই।’

অথৈয়ের এহেন কথা বুঝল না কেউ।আহিদ প্রশ্ন করল,
‘ মানে?কি বলছিস?’

অথৈ বিজ্ঞদের মতো মাথা দুলিয়ে বলে,
‘ হ্যা।ওরা আগের মতো স্বাভাবিক নেই।কাল থেকে কেমন যেন অস্বাভাবিক ব্যবহার করছে।যেই প্রিয়ান আর পিহু একমুহূর্তের জন্যে ঝগড়া ছাড়া থাকতে পারে না।একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে টু শব্দ করলেই লঙ্কাকান্ড বেঁধে যায়।সেখানে ওর কাল থেকে এতোটা শান্ত কিভাবে?মানে হাউ ইজ দিস পসিবল?আমরা ক্লাস ওয়ান থেকে বেষ্টফ্রেন্ড।আহিদ তুই-ই বল।এমন কোনো দিন কি গিয়েছে যে সেদিন প্রিয়ান আর পিহু ঝগড়া করেনি?বল?তাহলে কাল থেকে ওরা এমন ঠান্ডা হয়ে কিভাবে আছে?কিছু একটা ঘাপলা অবশ্যই আছে।আর তা একমাত্র ওরাই বলতে পারবে আমাদের।’

অথৈ থেমে এইবার প্রিয়ান আর পিহুকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ এখন ফটাফট সব সত্যি কথা বলে ফেল।কোনোরকম মিথ্যে বলা চলবে না।কোনো বানোয়াট কাহিনিও যেন না শোনানো হয়।ঠাস ঠাস করে দুজন সত্যিটা আমাদের বলে দে।নাহলে ভালো হবে না একদম।বুঝেছিস?’

অথৈয়ের কথায় পিহু আর প্রিয়ান একে-অপরের দিকে তাকাতে লাগল।দুজনের অবস্থা একই।তারা এখন কি বলবে ওদের?
#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২০
একটু আগের গরমের ছ্যাট এখন আর নেই।প্রকৃতিতে ঠান্ডা হিমেল হাওয়া বইছে।প্রাণ জুরিয়ে যাওয়ার মতো বাতাস যাকে বলে।সূর্য তার প্রখরতা দেখাতে পারছে না।কারন একটু আগের শুভ্র মেঘে ভরা আকাশটা।এখন ঘনকালো মেঘে ঢেকে গিয়েছে।সেই কালো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গিয়েছে সূর্য।পৃথিবীর বুকে বর্ষন নামার আগমনি বার্তা দিচ্ছে তারা।ঠান্ডা এই পরিবেশের মতোই ঠান্ডা হয়ে আছে পিহু আর প্রিয়ান।একটু আগে অথৈয়ের করা প্রশ্নে তারা ঠিক কি জবাব দিবে জানে না।পিহু একটু পর প্রিয়ানের দিকে তাকাচ্ছে।তার চোখেও স্পষ্ট ভেসে আছে।সেও জানতে চায় কি চায় প্রিয়ান।ঠিক কি কারনে সে পিহুর সাথে ওইদিন ওরকম ব্যবহার করেছিল।ওদের চুপ থাকতে দেখে অথৈ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে,
‘ কি? মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছিস কেন?জবাব দিচ্ছিস কেন?তাড়াতাড়ি দে জবাব। নাহলে ভালো হবে না।’

পিহু কাচুমাচু হয়ে বসল।আমতা আমতা করে বলে,
‘ কি বলব?কিসের জবাব দিতে বলছিস?আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’

আহিদ এইবার গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘ পিহু বাই এনি চান্স। তুই কি আমি এখানে দেখে ভয় পাচ্ছিস বলতে?দেখ আমি তোর ভাই এটা ঠিক আছে।সাথে কিন্তু আমরা বেস্টফ্রেন্ডও।তাই কোনো কিছু লুকাতে হবে না।সোজাসাপ্টা বলে ফেল।’

পিহু আহিদের কথায় নাক মুখ কুচকে ফেলল।বলল,
‘ এমন একটা ভাব করছিস যেন আমি তোকে কতো ভয় পাই।আর সেই ভয়ে একদম গুটিয়ে থাকি।ভুলে যাস না আমি তোর দু মিনিটের বড়ো।সো তোকে ভয় পাওয়ার কোনো কারন নেই।আর তাছাড়া আমাকে প্রশ্ন করে লাভ নেই।কারন আমার কাছে কোনো উত্তর নেই।যা জিজ্ঞেস করার প্রিয়ানকেই কর।সেই ভালো জবাব দিতে পারবে।’

পিহুর কথায় আহিদ রাখি চোখে তাকালো।এই মেয়েটা তাকে দু পয়সার দাম দেয়না।আহিদ বির বির করল,’ বট গাছের ডা*য়নি কি কখনো কাউকে ভয় পায়?’

পিহু শুনলো আহিদ কিছু বলেছে।কিন্তু কি বলেছে তা শোনতে পায়নি।তাই বলল,’ কিছু বললি আমায়?’
‘ নাহ, তোকে আর কি বলব।তুই আমাকে ভয় পাস না।তাই তোকে কিছু বলে লাভ আছে?’
‘ এইতো লাইনে এসেছিস।’

অথৈ সবার কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে বলে উঠে, ‘ তোরা চুপ থাকবি?এখানে সিরিয়াস ডিসক্যাশন করছিলাম আমরা।আর তোরা ঝগরা করছিস।আর আহিদ,তুই এমন ঝগড়া করতে শিখেছিস কার থেকে?’

আহিদ বলল,’ ঝগড়া আবার না শিখে থাকা যায়?তুই একটা,রিধি একটা আর দুই দুইটার( প্রিয়ান আর পিহুকে দেখিয়ে) কথা তো বাদই দিলাম।যেই ঝগড়া করিস।তো আমি বাদ থাকবো কেন?’

আহিদের বলতে দেরি চারজোড়া রাগি চোখের দৃষ্টি ওর দিক পরতে দেরি হয়নি।অথৈ,রিধি,পিহু,প্রিয়ান ওই রাগি চোখের দৃষ্টির তেজে আহিদকে পারলে ভস্ম করে দেয়।আহিদ থতমত খেয়ে বলে,’ কিরে এইবাভে তাকিয়ে আছিস কেন?’

রিধি রাগি স্বরে বলে, ‘ তুই আমাদের ঝগড়াখোর বলছিস।তো এইজন্যে কি তোকে চুমু দিব?’

আহিদ রিধির কথায় দুষ্টু হাসল।লজ্জা পাওয়ার অভিনয় করে বলে, ‘ যাহ,সবার সামনে এসব কি বলিস? আমার লজ্জা করে নাহ।আর তাছাড়া যদি এতোই আমায় চুমু দিতে চাস তো অন্য জায়গায় গিয়ে দিতে পারিস।আমি মাইন্ড করবো নাহ।’

আহিদের এই কথায় রিধি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল।পরপরেই খেকিয়ে উঠল,’ আহিদ্দার বাচ্চা।তোরে তো আমি আজকে শেষ করে দিবো।বান্দর পোলা।’

রিধি গিয়ে আহিদের চুল টেনে ধরল।আকস্মিক হামলায় আহিদ ভড়কে যায়।চেঁচিয়ে উঠে,’ ছাড় আমাকে।উফ ছাড়।আমার কতো যত্নের চুল এগুলা।আমার একটা চুলও যদি ছিড়ে না। তাহলে তোর মাথায় একটা চুলও থাকবে না।’

এদিকে অথৈ বিরক্ত হয়ে বসে বসে এদের কান্ড দেখছে।সে এদের কি এইজন্যে ডেকেছিল? কি করতে এসেছে এখানে।আর কি হচ্ছে।তার এই মেন্টা’ল বন্ধুগুলো ভালো হবার নয়।তা সে বুঝে গিয়েছে।এদের সাথে যে একটা সুস্থ্য আলোচনা করবে বসে শান্তভাবে তা আর হবে না বোধহয় কোনোদিন।অথৈ দীর্ঘশ্বাস ফেলল তারপর উঠে গিয়ে রিধিকে টেনে সরিয়ে আনল।রিধি তখনও রাগে ফুসছে আহিদের দিকে তাকিয়ে।এদিকে আহিদ মাথায় হাত বুলাচ্ছে।এভাবে চুল ধরে টানাটানি করায় সে বেশ ব্যথা পেয়েছে।এদিকে অথৈ পিহুর কানে কানে বলে,’ কিরে এই আহিদ্দার হলোটা কি?ও তো এমন ব্যবহার তো কোনোদিন করে না।মনে হচ্ছে ও একটু বেশিই হ্যাপি মুডে আছে।কেমন যেন ঘ্যাপলা লাগছে।ডাল মি কুছ কালা হ্যায়।দায়া থুক্কু পিহু পাতা লাগাও।’

পিহু ভাবুক গলায় বলে,’ কিন্তু পাতা লাগায় কিভাবে?আমি তো জানি গাছ লাগায়।’

পিহুর কথায় অথৈ ওর মাথায় গাট্টা মারল,’ গাধি একটা।’

পিহু দাঁত কেলালো।এইভাবেই হইচই করে সারাটা বিকেল কেটে গেল।অথৈ ইচ্ছে করেই আর ঘাটেনি পিহু আর প্রিয়ানকে।যা তারা এখন বলতে চাচ্ছে না তা জোড় করে লাভ নেই।সময় হলে নিজেরা এসেই বলবে তা অথৈও ভালোভাবেই জানে।তবে এদের যে আগের মতো স্বাভাবিক করতে পেরেছে তাই অনেক।ওদের আড্ডার মাঝে আকাশে তীব্র স্বরে গর্জন করে উঠল।ওরা হাসি ঠাট্টায় এতোটাই মত্ত ছিলো যে আকাশের পরিস্থিতির কথা ভুলেই গিয়েছিল।কিন্তু যতোক্ষণে সজাগ হয়েছে ততোক্ষণে শো শো বাতাস ছেড়ে, আকাশে তীব্র মেঘের গর্জন করে,ঝমঝমিয়ে মুষুলধারে বৃৃষ্টি নেমে গেল।সামনে নদী,নদীর পানিতে বাতাসের কারনে উত্তাল ঢেউ সৃষ্টি হয়েছে,ঝড়ো হাওয়া,কালো মেঘে ঢাকা আবছা আধারে ছেঁয়ে থাকা প্রকৃতি, সাথে ঝুমঝুম বৃষ্টি।সেই বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা পাঁচজন বন্ধু।আহা আর কি চাই এই মুহূর্তে। ওরা পাঁচজন বন্ধু মিলে হইহুল্লোড় করে বৃষ্টিবিলাশে মত্ত হয়ে গেল।প্রায় একঘন্টা পর বৃষ্টি কমে আসছে।চারপাশ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে।তাই সিদ্ধান্ত নেয় এখান সবাই চলে যাবে।হলোও তাই।আহিদ আর পিহু চলে গেল একটা বাইকে করে।আর প্রিয়ান অথৈ আর রিধিকে সাথে নিয়ে চলে গেল।বাড়িতে এসে অথৈ ক্লান্ত শরীরে বাড়ির কলিং বেল বাজালো।মিনহা বেগম এসে দরজা খুলে মেয়েকে এমন জুবজুবে ভেজা অবস্থায় দেখেই শুরু করে দিলেন বকাবকি।অথৈ কানে নিলো না।নিজের রুমের দিকে যেতে লাগল।কিন্তু তার আগেই বসার ঘর থেকে ইহানের ডাকে থেমে গেল।
‘ এইভাবে ভিজে এসেছিস কেন?নিশ্চয়ই সবগুলো মিলে বৃষ্টিতে ভিজেছিস?’

অথৈ জোড়পূর্বক হাসল।ভাইয়ার বকা সে সহজে খায় না।তবে ইহান যখন রেগে যায়।তখন ইহানকে অথৈ অনেক ভয় পায়।ইহান অথৈর নিজেকে হেলাফেলা একদম সহ্য করতে পারে না। তখনই ও রেগে অথৈকে বকাঝকা করে।অথৈ ইহানের বকা খাওয়ার ভয়ে বলে,
‘ আরে, কি বলছিস ভাইয়া?এমন কিছুই না।ওই প্রিয়ানের বাইক দিয়ে এসেছি তো।রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে ভিজে গিয়েছি।’

ইহান গম্ভীর গলায় বলে,’ আমাকে মিথ্যে বলে লাভ নেই।আমি তোর সম্পর্কে সবকিছুই জানি।ভুলে যাস না আমি তোর ভাই।সো এইসব লেইম এক্সকিউজ একদম দিবি না।আমায়।এখন যা দ্রুত চেঞ্জ করে নেহ।জ্বর আজকে আসবে তা নিশ্চিত আমি। আম্মুকে দিয়ে গরম দুধ পাঠাচ্ছি।কোনোরকম ভণিতা ছাড়া খেয়ে নিবি।নাহলে তোর কপালে শনি আছে।’

অথৈ শুকনো ঢোক গিলল।ইহানের ভয়ে আর নাকচ করল না।না এদিক সেদিক তাকালো।একদৌড়ে নিজের রুমে।অথৈকে ভয় পেতে দেখে ইহান মুচঁকি হাসলো।পরক্ষণে হঠাৎ করেই তার রিধির কথা মনে পরে গেল।মেয়েটাও নিশ্চয়ই বৃষ্টিতে ভিজেছে।ঠান্ডা,জ্বরে তো সেও ভুগবে।পরমুহূর্তে নিজের ভাবনায় নিজেই হতভম্ব হয়ে যায়।আশ্চর্য! তার কেনো আজ হঠাৎ হঠাৎ রিধির কথা মনে পরছে।সে বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছে।নিজের মনে বিরবির করতে করতে ইহান নিজের রুমে চলে গেল।
——-
গরম পানি দিয়ে গোসল দিয়ে অথৈ কম্বল মুরি দিয়ে শুয়েছে।শরীর ম্যাজম্যাজ করছে,মাথা ব্যথা, সেই সাথে চোখ দিয়ে পানি পরছে অনবরত।তাকে যে ভয়ানকভাবে জ্বরটা কাবু করে নিচ্ছে তা সে ভালোভাবে বুঝতে পারছে।এমনসময় আজিজুর সাহেব অথৈয়ের রুমে আসলেন।অফিস থেকে ফিরে এসেই মিনহার কাছ থেকে শুনেছেন তার মেয়ে নাকি আজ বৃষ্টিতে ভিজে এসেছেন।তাই অথৈকে দেখতে আসলেন।নিশ্চয়ই জ্বর আসবে মেয়েটার।আজিজুর সাহেব রুমে প্রবেশ করে রুমের আলো জ্বালাতেই অথৈ চোখের উপর হাত রেখে মুখ ঢেকে ফেলল।মূলত অথৈ অন্ধকারে থাকতে বেশি পছন্দ করে।দিনের বেলায় রুমের পর্দা দিয়ে রাখে আর রাতে কাজ ছাড়া সহজে আলো জ্বালায় না।এদিকে হঠাৎ করে আলো এসে মুখে পরতেই অথৈ চোখে ঠাওর করতে পারেনি।আস্তে আস্তে আলোটা সয়ে আসতেই অথৈ চোখ থেকে হাত সরায়।তারপর সামনে তাকাতেই আজিজুর সাহেবকে চিন্তিত অবস্থায় তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে;কষ্ট হলেও কোনোরকমে উঠে বসল অথৈ।বিছানার হেডবোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে বসে দূর্বল গলায় বলে,
‘ আরেহ, বাবা তুমি কখন আসলে।আর ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?এদিকে আসো।’

মেয়ের ভাঙা গলার আওয়াজ শুনেই আজিজুর সাহেব যা বুঝে ফেলার বুঝে ফেললেন।দ্রুত মিনহা বেগমকে হাক ছুড়ে ডেকে মেয়ের কাছে গেলেন।গিয়েই আগে অথৈয়ের কপালে হাত রাখল।জ্বরে মেয়েটার গা পুড়ে যাচ্ছে।ইহান আর মিনহা বেগম তখন রুমে আসলেন।তাদের দেখে আজিজুর সাহেব বলেন,
‘ দেখেছ?মেয়ে আমার জ্বরে ভুগে এখানে পরে আছে।তুমি যেহেতু দেখেছ ও বৃষ্টিতে ভিজে এসেছে।তুমি এসে ওকে দেখবে না?আমি না আসলে তো মেয়েটা আমার এইভাবেই পরে থাকত।এতোটুকু খেয়াল রাখতে পারো না তুমি মিনহা?’

মিনহা বেগম স্বামির কথায় রেগে গিয়ে বলে,’ হ্যা,এখন সব দোষ আমার তাই নাহ?তোমার গুনধর মেয়ে গিয়েছে কেন বৃষ্টিতে ভিজতে?সে জানে না তার যে জ্বর আসবে?’
‘ ও তো ছোটো মানুষ বুঝে নাই।’
‘ হ্যা এমন ধিঙি মেয়েকে ছোটো ছোটো বলে আরও মাথায় উঠাও।এমনিতেই আমার কথা শুনে না।তোমার আহ্লাদে আহ্লাদে মেয়েটা পুরো বখে গিয়েছে।একটা কথাও শোনে না আমার।ওর যে বিয়ে হয়ে গিয়েছে।সেই খেয়ালও কি ও করে? এখন তো একটু শান্ত শিষ্ট হতে পারে?না তা হবে কেন?এটা করলে আমাকে জ্বালাবে কে?সব জ্বালা হয়েছে আমার।আমি চলে গেলেই বুঝবে তোমরা।’

মিনহা বেগম আরও অনেক কিছু বলতে বলতে রান্নাঘরে চলে গেলেন।মেয়ের জন্যে তিনিও চিন্তিত।দ্রুত চুলায় রঙচা বসালো।এটা খেলে গলা ব্যথা যদি থাকে সেরে যাবে।তারপর স্যুপ বানাতে লেগে পরলেন।ভাত যে তার মেয়ে এখন একটুও।মায়েরা এমনি।সন্তানের কিছু হলে তারা অস্থির হয়ে পরেন।কিভাবে সে সন্তানকে সুস্থ করে তুলবেন।

এদিকে আজিজুর সাহেব ইহানকে বললেন গিয়ে এক বালতি পানি আনতে অথৈয়ের মাথায় পানি ঢালতে হবে।ইহানও তাই করল।আজিজুর সাহেব নিজ হাতে মেয়ের সেবা করতে লাগল।এদিকে জ্বর বাড়ার কারনে অথৈ কথাও বলতে পারছে না।চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।গা থেকে মনে হয় লাভার আগুনের তাপ বের হচ্ছে এমন।
হঠাৎ ইহানের মোবাইল বেজে উঠল।ইহান মোবাইলে তাকিয়ে দেখে রুদ্রিক কল করেছে।ইহান একবার অথৈয়ের দিকে তাকিয়ে ফোনকল রিসিভ করে কানে লাগাল।পরপরেই শুনতে পেল রুদ্রিকের চিন্তিত কণ্ঠস্বর,’ ইহান?অথৈ কোথায়?ওর ফোনে কল দিচ্ছি।কিন্তু ওর মোবাইল বন্ধ শোনাচ্ছে।’

ইহান আশেপাশে তাকালো।তারপর দেখল ওয়ারড্রবের উপর অথৈয়ের ফোন চার্জে লাগানো।বোধহয় চার্জ নেই।ইহান বলল,’ ওর ফোনে চার্জ নেই।’

রুদ্রিক শ্বাস ফেলল সস্তির।কিন্তু তারপরেও ওর কেমন যেন লাগছে।মনে হচ্ছে অথৈ ঠিক নেই।রুদ্রিক বলল,’ অথৈ কোথায়?ওকে একটু দে তো।আজ সারাদিন কথা হয়নি।বলল বন্ধুদের সাথে পিকনিকে যাচ্ছে।তাই আমি ডিস্টার্ব করিনি।কিন্তু এখন কথা না বললে যে আমার রাতে ঘুম আসবে না।’

ইহান কি বলবে ভেবে পেলো না।সে কি এখন রুদ্রিককে বলে দিবে অথৈয়ের জ্বর এসেছে?রুদ্রিক যদি এই কথা শোনো তো পাগলামি করবে।কারন সে জানে তার বন্ধু অথৈকে ঠিক কতোটা ভালোবাসে।দুটো বছর যাবত নিজ চোখে দেখে আসছে তা।কিন্তু না বলেও পারছে না।সে অথৈয়ের হাজবেন্ড।তার জানার অধিকার কাছে।যা হওয়ার হবে।তাই ইহান আর বেশি ঘাটল না।সত্যি কথাটাই বলল,’ বন্ধুরা পিকনিক করতে গিয়েই ঝামেলা পাকিয়ে এসেছে।সবগুলো মনে হয় একসাথে এই সময়ের বৃষ্টিতে ভিজে এসেছে।এখন দেখ বাড়ি এসেই নেতিয়ে পরেছে।জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।’

ইহান কথাগুলো বলেই রুদ্রিকের পাগলামি শোনার আশায় রইলো।কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে রুদ্রিক বলল,’ মেডিসিন দিয়েছিস?’

ইহান অবাক হয়ে গেল।সে ভাবেনি রুদ্রিক এতোটা শান্ত থাকবে।ইহান অবাকের রেশ কাটিয়ে বলে,’ নাহ এখনও দেয়নি।আম্মুকে খাবার আনতে বলেছি।দেখি কিছু খাওয়াতে পারি কিনা।খাওয়ার পরেই মেডিসিন দিবো।’
‘ জোড় করে হলেও খাওয়াবি কিন্তু।রাখছি।’
‘ আরেহ কিন্তু শোন রুদ্রিক….!’

ইহান কিছু বলার আগেই রুদ্রিক ফোন কেটে দিলো।এদিকে ইহান আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে রইলো।এই ছেলের মাথায় কি চলে তা ও ছাড়া বোধহয় কেউ জানবে নাহ।ইহান লম্বা শ্বাস ফেলে অথৈয়ের কাছে এগিয়ে গেল।ততোক্ষণে মিনহা বেগম একবাটি স্যুপ,গরম দুধ নিয়ে এসেছেন।তারপর মেয়ের কাছে এগিয়ে গেলেন।আজিজুর সাহেবকে বললেন অথৈকে খাইয়ে দিতে।আজিজুর সাহেব তাই করলেন।আর মিনহা বেগম বসে বসে অথৈয়ের মাথায় পানি ঢালতে লাগল।মিনিট বিশেক পর ওদের বাড়ির কলিংবেল বেজে উঠল।ইহান অবাক হলো।ঘড়ির দিকে তাকালো।রাত তখন এগারোটা।এতো রাতে কে আসবে?হঠাৎই ওর মাথায় টনক নড়ল।সে একশ পার্সেন্ট নিশ্চিত এটা তার পাগল বন্ধু ছাড়া কেউ নাহ।ইহান দ্রুত পায়ে চলে গেল দরজা খুলতে।কিন্তু দরজা খুলতে সে অবাক হয়ে গেল।সে তো ভেবেছিল রুদ্রিক আসবে।অবশ্য সেটা সঠিক রুদ্রিকই এসেছে।তবে একা না সাথে আতিক মাহাবুব সাহেব,আরহাম সাহেব,আরিয়ান আর রোজাও এসেছে।ইহানকে এইভাবে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুদ্রিক ভ্রু-কুচকে বলল,’ সরছিস না কেন?না কি বাসায় ঢুকতে দিবি নাহ?’

রুদ্রিকের কথায় ইহান তার সম্ভিত ফিরে পেল।দ্রুত দরজা থেকে সরে গিয়ে দাঁড়াল।এরপর সবাইকে সালাম জানিয়ে ভীতরে আসতে বলল।তারাও সালামের জবাব নিয়ে বাসায় প্রবেশ করলেন।এদিকে বসার ঘরে মানুষের কোলাহলপূর্ণ আওয়াজে আজিজুর সাহেব আর মিনহা বেগম না চাইতেও মেয়ের কাছ থেকে উঠে এলেন।এসেই মেয়ের শশুড় বাড়ি মানুষদের দেখে ভড়কে গেলেন।তারপর দ্রুত গিয়ে তাদের সালাম জানিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন।মিনহা বেগম দ্রুত পায়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে উদ্যুত হলেন।কিন্তু তার আগেই রোজা উনাকে থামিয়ে দিলেন,’ একদম না আন্টি।কোনোরকম কোনো আয়োজন করবেন নাহ।এসব আজ না অন্য একদিন।আজ আমরা বেড়াতে আসিনি।অথৈ অসুস্থ তাই তাকে দেখতে এসেছি।এখন এখানে আসুন।’

আতিক মাহাবুবও বলেন,’ হ্যা বড় নাতবউ একদম ঠিক বলছে।আপনার মেয়ে অসুস্থ আপনি তার কাছে যান।আজকে আমরা আমাদের বাড়ির বউ অসুস্থ তাই তাকে দেখতে এসেছি।’

আজিজুর সাহেব আর মিনহা বেগম আর কিছু বললেন না।শুধু মনে মনে আল্লাহ্’র কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন তার মেয়েকে এতো ভালো একটা পরিবারের বউ হওয়ার ভাগ্য দেওয়ার জন্যে।আজিজুর সাহেব আর মিনহা বেগম সবাইকে নিয়ে অথৈয়ের রুমে আসলেন।অথৈ তখন গায়ে দুটো ভারি লেপ আর কম্ব্ল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে।মুখশ্রী জ্বরের প্রকোপে লাল হয়ে আছে।জ্বরের কারনে তার হুশ নেই।মিনহা বেগমের মন চাইছে না অসুস্থ মেয়েকে ডেকে তুলতে।কিন্তু না ডেকেও তো পারছেন না মেয়ের শশুড়বাড়ির লোক এসেছে।তিনি অথৈকে ডাকতে গেলেই আরহাম সাহেব বলে উঠলেন,’ আপা বউমাকে ডাকবেন না।সে অসুস্থ।জ্বরে মেয়েটা কেমন করছে।আমরা তো মেয়েটাকে একটু দেখতে এসেছি।আসলে কি বলেন তো রুদ্রিকের মুখে যখন শুনলাম বউমা অসুস্থ তখন আর নিজেদের ধরে রাখতে পারিনি।ও তো আমার ছেলের বউ না। আমার মেয়ে।মেয়ে অসুস্থ হলে বাবা না এসে পারে?’

আজিজুর সাহেবের চোখের কোণে জল জমেছে।এতো সুন্দর কথা শুনে কেইবা না কেঁদে পারবে?এতো সুখের কান্না।সবাই এইভাবে টুকাটুকি কথা বলতে লাগল।এদিকে রুদ্রিক শুধু পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো।তবে দৃষ্টি তার অশান্ত।বুকের ভীতর বয়ে চলেছে তীব্র ঝড়।প্রিয়তমাকে এইভাবে মূর্ছা যাওয়া অবস্থা দেখে তার মনে হচ্ছে কেউ তার বুকে ধারালো ছু’ড়ি দিয়ে ক্রমাগত আঘা’ত করে চলেছে।অথৈয়ের ফ্যাকাশে মুখশ্রীটা বড্ড পিড়া দিচ্ছে ওকে।অথৈকে এইভাবে একদম দেখতে পারছে না রুদ্রিক।মেয়েটাকে মন চাচ্ছে এই মুহুর্তে বুকের মাঝে ঝাপ্টে নিতে।কিন্তু সবাই থাকায় তা করতে পারছে না।চোখ বন্ধ করে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলো রুদ্রিক।অশান্ত মনটাকে একটুখানি শান্ত করার প্রয়াস চালালো।কিন্তু তা সম্ভব হলে তো?অথৈ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত রুদ্রিকের শান্তি নেই।এদিকে রোজা এসে অথৈয়ের হাত পা মুছে দিচ্ছে।মাথায় পানি ঢালতে গেলে রুদ্রিক কাউকে পরোয়া না করে নিজেই এগিয়ে যায়।তারপর রোজাকে বলে,’ ভাবি তুমি সরো।আমি করছি।’

রোজা বিনাবাক্যে উঠে গেল।সে কিছুটা হলেও রুদ্রিকের অবস্থা বুঝতে পারছে।রুদ্রিকের লাল হয়ে আসা চোখ দুটোই সব বলে দিচ্ছে।রুদ্রিক অথৈয়ের মাথায় পানি ঢালল।সরিষার তেল গরম করে এনে দিলেন মিনহা বেগম।শাশুড়িকে বসতে বলে নিজেই অথৈয়ের হাতে পায়ে তেল মালিশ করতে শুরু করল।যা দেখে এখানে আর কেউ বসে থাকতে পারল না।রুদ্রিক আর অথৈকে একা ছেড়ে দিয়ে সবাই রুমের বাহিরে চলে গেলো।সবাইকে যেতে দেখে রুদ্রিক দ্রত বিছানা থেকে নেমে রুমের দরজা আটকে আবার বিছানায় ফিরে আসল।তারপর দ্রুত অথৈয়ের কম্বলগুলোর নিচে নিজে ঢুকে গেল।কাল বিলম্ব না করে অথৈয়ের তপ্ত দেহখানা নিজের শক্তপোক্ত বুকের মাঝে আঁকড়ে নিলো।শক্ত করে ধরল অথৈকে।এদিকে এতো শক্ত করে ধরায় অথৈ অস্পষ্ট স্বরে গুঙিয়ে উঠল।পর পর বহু কষ্টে চোখ পিটপিট করে তাকালো।ঝাপ্সা চোখে তাকিয়ে আবছাভাবে রুদ্রিককে দেখে নিলো।এরপর চোখ বন্ধ করে ফেলল।তার চোখ খুলে রাখতে অনেক কষ্ট হচ্ছে।সে আবারও বিড়াল ছানার ন্যায় রুদ্রিকের বুকের উম পেয়ে রুদ্রিকের কাছে আরও গুটিয়ে গেল।দূর্বল কণ্ঠে থেমে থেমে বলে,’ আপ..আপনি এসেছেন?আ…আমি আপ…আপনাকে অনেক মিস করেছি।’

অথৈ ওকে মিস করেছে শুনে রুদ্রিকের হৃদয়ে শীতলতা ছেঁয়ে গেল।সে একটু সুযোগ নিল অসুস্থ অথৈয়ের।প্রশ্ন করল,’ তাই?’
‘হ…হুঁ!’
‘ কেন মিস করেছ?’

অথৈ ঠোঁট উলটে বলে,’ তা তো জানি নাহ।’
রুদ্রিক হাসল।অথৈয়ের এমন কান্ডে।ফের বলে,’ আচ্ছা তুমি আমার একটা কাজ করবে।আমি কিছু প্রশ্ন করব।প্রশ্নগুলোর সত্যি সত্যি জবাব দিবে।’

অথৈ কিছু বলল না।রুদ্রিক প্রশ্ন করল,
‘ তোমাকে আমার কেমন লাগে অথৈ?’

অথৈ সময় নিয়ে জবাব দেয়,’ অনেক ভালো।’
‘ কেমন ভালো।’
‘ তা জানি না তবে অনেক ভালো লাগে।আপনি দেখতে অনেক সুন্দর।’
‘ আমার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে?’
‘ হুঁ!’
‘ আমাকে দেখলে বুক ধুকপুক করে?’
‘ হুঁ!’
‘ আমি কাছে আসলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়?’
‘ হুঁ!’
‘ সারাদিন আমার সাথে কাটাতে ইচ্ছে করে?’
‘ অনেক।’
‘ ভালোবাসো আমাকে?’

এই পর্যায়ে আর অথৈয়ের জবাব এলো না।রুদ্রিক অথৈয়ের মাথাটা ওর বুক থেকে উঠিয়ে সামনে এনে দেখে অথৈ ঘুমিয়ে গিয়েছে।রুদ্রিক হাসল অথৈয়ের ঘুমন্ত মুখ দেখে।অথৈয়ের ভেজা চুলগুলো সুন্দরভাবে গুছিয়ে দিয়ে।ওর ওষ্ঠজোড়া স্পর্শ করল অথৈয়ের উত্তপ্ত কপালে।সময় নিয়ে সরে আসল।জ্বর কিছুটা কমেছে।এইভাবে প্রায় অনেকক্ষণ রইলো রুদ্রিক।হঠাৎ রোজার কণ্ঠ শুনতে পেল।রোজা ডাকছে ওকে।তাদের যেতে হবে।রুদ্রিক জানালো সে আসছে।রোজা চলে গেল।রুদ্রিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে অথৈকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে বালিশে শুইয়ে দিল।তারপর অথৈয়ের দিকে ঝুকে শীতল কণ্ঠে বলে,
‘ বলেছিলাম আমি তোমার মনে যেদিন জায়গা নিতে পারব সেদিনই এই বাড়িতে পা রাখব।আর দেখো আমি তাই করেছি।তুমি মুখে স্বিকার না করলেও আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসো।তবে চিন্তার কারন নেই।তোমার মুখ থেকেও একদিন স্বিকার করিয়ে নিবো তুমি আমায় ভালোবাসো।এখন আমার যেতে হবে জান।মন তো চাচ্ছে না তবে যেতে হবে।ভালো থেকো জান।নিজের খেয়াল রেখো।’

এইবলে অথৈয়ের কপালে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে রুদ্রিক রুম থেকে বের হয়ে গেল।আর তাকালো না পিছনে।কারন তাকালেই তার সর্বনাষ হয়ে যাবে।সে আর যেতে পারবে না তাহলে।এদিকে মির্জা বাড়ির সবাইকে অনেক জোড় করলেন আজিজুর সাহেব,মিনহা আর ইহান।কিন্তু তারা মানলেন না।অথৈ অসুস্থ এর মাঝে আর ঝামেলা করতে চাননা।তারা মির্জাদের কাছে হার মানতে বাধ্য হলেন।মধ্যরাতেই সবার থেকে বিদায় নিয়ে তারা চলে যান নিজেদের গন্তব্যে।

#চলবে___________
আমিই করব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here